You dont have javascript enabled! Please enable it! রক্ষীবাহিনী নিয়ে বিতর্ক | আনোয়ার উল আলম - সংগ্রামের নোটবুক

রক্ষীবাহিনী নিয়ে বিতর্ক | আনোয়ার উল আলম

জাতীয় রক্ষীবাহিনীর তরতাজা সদস্যরা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সামরিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই বীরবিক্রমে যুদ্ধ করেছেন। মুক্ত স্বাধীন দেশে পরিপূর্ণ প্রশিক্ষণ ও যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ছাড়াই প্রাণপণে নতুন দেশ গড়া এবং দেশের শান্তি-শৃঙখলা বজায় রাখার লক্ষ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু যারা এ দেশটাই চায়নি এবং মনে পাকিস্তানের জন্য সুপ্ত প্রেম লালন করে, তারা তাে দেশে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় থাকুক এবং পুনর্গঠনের মাধ্যমে দেশটি উন্নতির দিকে এগিয়ে যাক, সেটা চায়নি। স্বাধীনতার পর তারা নিজেদের ভােল পাল্টে জনগণের মধ্যে মিশে যায়। পরে দেশপ্রেমিক জনগণ ও মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে বিভেদ ছড়ানাের জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। এদের সঙ্গে যােগ দেয় কিছু সংবাদপত্র ও অতিবিপ্লবী মুক্তিযােদ্ধা। তারা রক্ষীবাহিনীর সমালােচনায় মুখর হয়ে ওঠে।
প্রথমেই গুজব ছড়ানাে হয় রক্ষীবাহিনীর পােশাক নিয়ে। রক্ষীবাহিনী কী পরিস্থিতিতে জলপাই সবুজ পােশাক ব্যবহার শুরু করে, সে ব্যাপারে আগে কিছুটা উল্লেখ করেছি। রক্ষীবাহিনীর দ্বিতীয় ব্যাচের সদস্যদের শিক্ষা সমাপনী কুচকাওয়াজের সময় সরকার স্পষ্টতই ঘােষণা করেছিল যে পােশাকের রং যত দূর সম্ভব তাড়াতাড়ি পরিবর্ত করা হবে । দ্বিতীয় ব্যাচের কুচকাওয়াজ উপলক্ষে প্রকাশিত স্যুভেনিরেও এর উল্লেখ ছিল। বাহিনীর চতুর্থ ব্যাচের সদস্যদের শিক্ষা সমাপনী কুচকাওয়াজ উপলক্ষে প্রকাশিত স্যুভেনিরেও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় যে রক্ষীবাহিনীর পােশাকের রং হবে ধূসর নীল। চতুর্থ পাসিং আউট উপলক্ষে প্রকাশিত স্যুভেনিরের১ ২০ অনুচ্ছেদে এ কথার উল্লেখ ছিল। তার পরও অনেকে ধারণা করতেন যে রক্ষীবাহিনী যে জলপাই সবুজ রঙের পােশাক পরে, ভারতের সেনাবাহিনীও পরে একই রঙের পােশাক। সুতরাং, রক্ষীবাহিনী সেজে ভারতীয়রা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করবে।
সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, রক্ষীবাহিনীর জন্য খাকি ছাড়া অন্য রকম সুবিধাজনক রঙের পােশাক ঠিক করা হবে। তবে জলপাই সবুজ পােশাক রাখা হবে না। তখন আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল, অস্ত্রধারী কোনাে বাহিনী মানেই খাকি পােশাকধারী । কারণ, গ্রামগঞ্জের মানুষ ১৯৭১ সালের আগে বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর সদস্যদের তেমন দেখেনি। তাদের সংখ্যাও খুব কম এবং তারা দেশের কয়েকটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে মােতায়েন থাকে। রক্ষীবাহিনীর প্রাথমিক পােশাকের সমালােচনাকারীরা কখনাে বলেননি বা লেখেননি যে ভারতের বিশাল নৌবাহিনীর মতো বাংলাদেশের নৌবাহিনীও সাদা পােশাক পরে এবং ভারতীয় নৌবাহিনী বাংলাদেশের নৌবাহিনীর বেশে সমুদ্রপথে আমাদের দেশে প্রবেশ করতে পারে।
বিভিন্ন বাহিনী ও যুদ্ধ সম্পর্কে যারা অভিজ্ঞ তারা জানেন, খাকি পােশাক মরুভূমি বা খরা এলাকার যুদ্ধপোশাক । জলপাই সবুজ পােশাক সাধারণত সবুজ অঞ্চলে সামরিক পােশাক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমন আমাদের প্রতিবেশী মিয়ানমার এবং এশিয়ার অনেক দেশ, যেমন মালয়েশিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার সামরিক বাহিনী সবুজ অঞ্চলে জলপাই সবুজ বা জঙ্গল-রঙা সবুজ পােশাক পরে। ভারতের পশ্চিম সীমান্তে বহু এলাকা মরুভূমি-অধ্যুষিত। ওই এলাকায় আমাদের দেশের মতাে সবুজের সমারােহ নেই। সেখানে ভারতীয় সেনারা পরে খাকি পােশাক। ভারতের উত্তর সীমান্তে হিমালয় এলাকায় যখন সাদা ধবধবে বরফ পড়ে, সেখানে সীমান্ত রক্ষায় নিয়ােজিত ভারতীয় সেনারা সাদা পােশাক পরে। আর পূর্ব এলাকায় অর্থাৎ বাংলাদেশ, চীন ও মিয়ানমার সীমান্তের সবুজ এলাকায় ভারতীয় সেনাবাহিনী পরে জলপাই সবুজ পােশাক। এর এক সম্ভাব্য কারণ, ক্যামােফ্লেজ বা প্রতিপক্ষের দৃষ্টি এড়ানাের চেষ্টা। এটা একটা সামরিক কায়দা। কাজেই পােশাকের রং অত গুরুত্বপূর্ণ নয়, যত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীর সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান বজায় রাখা, যুদ্ধ-পরিস্থিতি এড়িয়ে চলা এবং প্রয়ােজনে দেশের জনা বীরবিক্রমে যুদ্ধ করা।
আবার কোনাে কোনাে মহল বলত, রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের বেশির ভাগই ভারতীয়। কারণ, রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের মতাে কালাে মানুষ বাংলাদেশে নেই। আসলে জলপাই সবুজ বা জঙ্গল-রঙ সবুজ পােশাক পরে সারা দিন খর রােদে দাড়িয়ে যারা দীর্ঘক্ষণ দায়িত্ব পালন করেন, রোদের তাপে সবুজ পােশাকে তাদের বেশি কালাে দেখায়। রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা যদি ভারতীয়ই হবেন, তাহলে ১৯৭৫ সালে যখন রক্ষীবাহিনীর সব সদস্যকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নেওয়া হলাে, তখন কি ভারতীয়রা সেনাবাহিনীতে প্রবেশ করেছে?
কয়েক বছর পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যুদ্ধের পােশাক হিসেবে জলপাই রঙের ক্যামােফ্লেজ পােশাক পরতে শুরু করে। অবাক হয়ে দেখি, রক্ষীবাহিনীর পােশাকের সমালােচনাকারীরা আর সেনাবাহিনীকে সমালােচনা করছে না। ওই পােশাক পরে ভারতীয় সেনাবাহিনী যে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে, সে চিন্তা তাদের হয়নি।
এ প্রসঙ্গে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা লিখতেই হয়। ১৯৭২ সালের ঘটনা। বঙ্গবন্ধু বিদেশে। ২৬ জুলাই তিনি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান এবং প্রায় দুই মাস দেশের বাইরে ছিলেন । তার অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
৩ সেপ্টেম্বর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী একটি ভুখামিছিল নিয়ে রমনা পার্কের পাশে তৎকালীন গণভবনে যান। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদ সেখানে মওলানা ভাসানীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। এ সময় গণভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে রক্ষীবাহিনীর একদল রক্ষীও মােতায়েন ছিল। আমি নিজেও তখন সেখানে ছিলাম। ভুখামিছিল গণভবনের কাছে পৌছালে মওলানা ভাসানী, কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন ও হায়দার আকবর খান রনােকে ভেতরে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ ছিল আমাদের ওপর । সেখানে নিয়ােজিত রক্ষীবাহিনীর একটি দলকে আমি নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলাম, মওলানা ভাসানীকে স্বাগত জানানাের সময় তাকে যেন সামরিক কায়দায় সালাম জানানাে হয়। গণভবনের গেটে তাকে সালাম জানানাের ফলে মওলানা ভাসানী খুব খুশি হন এবং সবার খোজখবর নিতে থাকেন। রক্ষীবাহিনীর প্রায় প্রত্যেক সদস্যকে তিনি জিজ্ঞেস করেন, তােমার বাড়ি কোন জেলায়, কোন গ্রামে, ইত্যাদি। রক্ষীবাহিনীর সদস্যরাও জবাব দিতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর মওলানা ভাসানী তার পাশে থাকা কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেননকে বলেন, ‘তােমরা না কও রক্ষীবাহিনীর সবাই ভারতীয়। আমি তাে দ্যাখতাছি এরা আমাগো পােলা।’ কাজী জাফর, রাশেদ খান মেনন কোনাে কথা না বলে চুপ থাকেন।

ওই ভুখামিছিলের উদ্দেশাই ছিল সরকারকে বেকায়দায় ফেলা। কারণ, দেশে তখন অনেকটা দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছিল। মওলানা ভাসানী যখন গণভবনের ভেতরে বসে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে খাদ্যাভাব আর দুর্ভিক্ষ নিয়ে কথা বলছিলেন, তখন গণভবনের বাইরে ওই মিছিল থেকে স্লোগান উঠছিল : ‘কেউ খাবে কেউ খাবে না তা হবে না তা হবে না’। এ সময় হঠাৎ আমার মনে হলাে যে মওলানা ভাসানীকে আপ্যায়ন করা প্রয়ােজন। তিনি খেতে খুব ভালােবাসেন। আমি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের বলে তার সামনে ভালাে মিষ্টি, স্যান্ডউইচ দেওয়ার ব্যবস্থা করি। খাবার দেখে মওলানা ভাসানী খুব খুশি হন এবং সঙ্গে সঙ্গে তা খেতে থাকেন। কাজী জাফর আর রাশেদ খান মেনন অবশ্য তাকে খেতে মানা করছিলেন। এ সময় উপস্থিত ক্যামেরাম্যানরা মওলানা ভাসানীর খাওয়ার ছবি তােলেন। পরদিন এ ছবি ও খবর বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হয়।
৪ সেপ্টেম্বর দৈনিক ইত্তেফাক-এ প্রকাশিত খবরে বলা হয়:
গণভবনে ভাসানী-: গতকাল (রবিবার) মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর পল্টনে আয়ােজিত জনসভা শেষে একটি মিছিল বাহির করা হয়। মিছিলটি বিকাল ৫-৪৫ মিনিটে গণভবনের সামনে উপস্থিত হয় এবং মিছিলের সঙ্গে একখানি খোলা জীপে করিয়া মওলানা ভাসানী কাজী জাফরসহ অন্যান্য স্যাপ নেতা তথায় আগমন করেন। বিকাল ৫-৫০ মিনিটে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলামের নিকট একখানি স্মারকলিপি পেশ করেন। এই সময় গণভবনে অধিকাংশ বিভাগীয় মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা উপস্থিত ছিলেন। তন্মধ্যে ছিলেন খাদ্যমন্ত্রী শ্রী ফণীভূষণ মজুমদার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব আবদুল মান্নান, শ্রমমন্ত্রী জনাব জহুর আহম চৌধুরী, অর্থমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দীন আহমদ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমদ, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব জিল্লুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব আবদুর রাজ্জাক এম, সি, এ প্রমুখ।
মুদ্রিত স্মারকলিপিটি পেশ করার পর আলােচনা প্রসঙ্গে মওলানা ভাসানী বলেন যে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সর্বদলীয় দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা না হইলে দেশের বর্তমান সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নহে। তিনি বলেন যে, ভুখা মিছিল নতুন কিছু নয়। ইহা গণতান্ত্রিক অধিকার। তিনি বলেন যে, সারা জীবনই আমি বিরােধী দল করিয়া আসিয়াছি এবং ইহা ছাড়া আমি আর কিছু করিতেও পারি না। মওলানা ভাসানী বলেন যে, নক্সালদের লাইনে যাই নাই আর কোন দিন যাইবও না। যাহাদের একটি হাল ও ২ বিঘা জমি আছে, তাহাদেরকেই শ্রেণীশত্রু বলিয়া নক্সালরা হত্যা করিতেছে। ইহা আমি পছন্দ করি না। আমি কোন কিছুই জালাইব না ও পােড়ইব না। সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটে মওলানা ভাসানীকে কিছু স্যাণ্ডুইস ও পেপে কাটিয়া পরিবেশন করা হয়।
মওলানা ভাসানী স্যাণ্ডুইস খাইতে খাইতে বলেন, সকলকেই সুখ-দুঃখ সমানভাবে ভাগ করিয়া লইতে হইবে। তিনি আরও বলেন যে, দেশের যত লােকসংখ্যা তত সংখাক রেশন কার্ড বিলি করা দরকার। আলােচনা কালে তিনি বলেন যে, শেখ মুজিব আর আমি এক সঙ্গে চীনসহ মধ্যপ্রাচ্য সফর করিলে সকল দেশই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য। মুজিব দেশে ফিরিয়া আসিলে তাহার সঙ্গে আমি আলােচনা করিব। সৈয়দ নজরুলের সহিত আলােচনার এক পর্যায়ে মওলানা সাহেব দাবী করেন যে, অন্যত্র ৫০ টি লাশ কাপড়ের অভাবে কলাপাতার কাফন দিয়া দাফন করা হইয়াছে বলিয়া তার নিকট প্রমাণ রহিয়াছে।
তিনি আরও বলেন যে, আমাকে সি আই, এর লােক বলিয়া অনেকেই অভিযােগ করে। কিন্তু আমি ইহা কিছুতেই বরদাশত করিতে পারি না।
নিত্যপ্রয়ােজনীয় ও অত্যবশ্যক দ্রব্যের শহর ও গ্রামভিত্তিক পূর্ণ রেশন চালু, ঘুষ, দুর্নীতি বন্ধ, মুনাফাখোর, কালােবাজারী ব্যবসায়ীদের শাস্তি দান, দুর্নীতিবাজ এম, সি, এ, আমলা, রাজনৈতিক কর্মীর সম্পত্তির হিসাব নিকাশ, চোরাচালান রােধ প্রভৃতি সম্বলিত মওলানা ভাসানীর পেশকৃত স্মারকলিপির মধ্যে অন্যতম দাবী হিসাবে মুদ্রণ করা হইয়াছে।
মওলানা ভাসানী যখন খাচ্ছেন, তাজউদ্দীন আহমদ তাঁকে একটা প্রস্তাব দিয়ে বললেন, ‘হুজুর, আমাদের সরকারের প্রতি যদি আপনার এতই অনাস্থা, তাহলে আপনিই সরকারের দায়িত্ব নিন, আমরা চলে যাই।’ এই প্রস্তাব শুনে কাজী জাফর আর রাশেদ খান মেননের চোখমুখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। কিন্তু মওলানা ভাসানী তাে ক্ষমতায় যাওয়ার লােক নন। তিনি তাজউদ্দীনকে বােঝাতে লাগলেন—“ক্ষমতায় তােমরাই থাকে। আমাকে শুধু সমালােচনা করতে দাও আমাকে সমালােচনা করতে না দিলে অন্যরা তাে সমালােচনা বন্ধ রাখবে না।’
একপর্যায়ে আবার একটা গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, জাতীয় রক্ষীবাহিনীতে শুধু মুজিব বাহিনী ও টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর সদস্যরাই আছে। কথাটা মােটেই ঠিক নয়। প্রথম দিকে মুজিববাহিনীর সদস্য ও টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র সমর্পণের পর নিজ নিজ এলাকায় এবং পিলখানায় জাতীয় মিলিশিয়া ক্যাম্পে ব্যাপক হারে যােগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের বেশির ভাগই ছাত্র ছিলেন। কিছুসংখ্যক চাকরিজীবীও ছিলেন। তাদের বেশির ভাগই যার যার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও চাকরিস্থলে চলে যান। শুধু যাদের চাকরি করার প্রয়ােজন ছিল, তারাই রক্ষীবাহিনীতে যােগ দেন। টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর প্রায় সবাই টাঙ্গাইল জেলার আধবাসী ছিলেন, সুতরাং, তাদের মধ্যে যারা রক্ষীবাহিনীতে যােগ দিয়েছিলেন, তারা টাঙ্গাইলেরই ছিলেন। কিন্তু মুজিব বাহিনীর সদস্যরা ছিলেন সারা দেশের, সেখানে কোনো জেলার প্রাধান্য ছিল না। তারপর রক্ষীবাহিনীতে যাঁরা মিলিশিয়া ক্যাম্পগুলাে থেকে এসেছিলেন, তারাও এসেছিলেন সারা দেশ থেকেই।
একটা কথা স্পষ্ট করে বলা প্রয়ােজন, মেধার ভিত্তিতে নির্বাচিত রক্ষীবাহিনীর প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ব্যাচের কর্মকর্তাদের সবাই মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন। এরপর আরও চারটা ব্যাচের কর্মকর্তা, যথা চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের সবাই প্রতিযােগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে মেধার ভিত্তিতে যথার্থভাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁদের অনেকে আবার মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন না। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তাদের মধ্যে সাতটা ব্যাচে মােট কর্মকর্তা ছিলেন ২১৩ জন২। এর মধ্যে প্রথম তিন ব্যাচে ছিলেন মাত্র ৪৮ জন। এঁদের মধ্যে ১০ জন হয় চাকরি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন অথবা বিভিন্ন কারণে চাকরিচ্যুত হন। সপ্তম ব্যাচের প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার আগেই বাকি ১৬৫ জন কর্মকর্তাসহ জাতীয় রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে আত্তীকরণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তাদের সবাই সেনাবাহিনীতে তাদের যােগ্যতা ও দক্ষতা প্রমাণ করতে সক্ষম হন। অনেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছান।
কোনাে কোনাে মহল থেকে এমন কথাও শােনা গিয়েছে যে রক্ষীবাহিনী ছিল প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজস্ব ব্যক্তিগত বাহিনী। বিষয়টি আমি কল্পনাও করতে পারি না। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় কোনাে বাহিনী ব্যক্তিবিশেষের নিজস্ব ব্যাক্তিগত বাহিনী ছিল না। বাহিনীর সদস্যদের কেউ কেউ ব্যক্তিবিশেষের অনুগত ছিলেন। সেটা অন্য প্রসঙ্গ। তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের শাসক রাষ্ট্রের সম্পদ ব্যবহার করে এ রকম ব্যক্তিগত বাহিনী সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে নিজস্ব ব্যক্তিগত বাহিনী গড়া সম্ভব ছিল না। আর বঙ্গবন্ধুর নিজের টাকায় তো তা করাই সম্ভব ছিল না। কারণ, তার যা বেতন ও অন্যান্য আয় ছিল, তা দিয়ে রক্ষীবাহিনীর ১২ হাজার সদস্যকে বেতন দেওয়া সম্ভব ছিল না। রাষ্ট্রীয়ভাবে রক্ষীবাহিনী প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা তো দূরের কথা, তার সরকারি বাড়ি ও কার্যালয়- কোনােটারই পাহারা দেওয়ার কাজে নিয়ােজিত হয়নি। তার পরিবারের কোনাে সদস্যের নিরাপত্তার জন্যও কোনাে দিন রক্ষীবাহিনী নিয়ােগ করা হয়নি। তাহলে এই বাহিনী তার ব্যক্তিগত বাহিনী হয় কীভাবে? রক্ষীবাহিনী ছিল একটা সরকারি বাহিনী। সরকার এর খরচ মঞ্জুর করত এবং নীতি নির্ধারণ করত। সামরিক বাহিনী ও রক্ষীবাহিনী দুটোই প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের অধীনে ছিল। পুলিশ ও বাংলাদেশ রাইফেলস ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে। রক্ষীবাহিনী শুধু দেশের অভ্যন্তরে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য পুলিশ ও প্রশাসনকে সহযােগিতা করেছে। সমালােচনার জন্য সমালােচনাই ছিল এ-জাতীয় সমালােচনার উদ্দেশ্য।
ভারতের সিআরপি (Central Reserve Police) নকশাল বাহিনীর সন্ত্রাসীদের যেমন সফলভাবে দমন করেছিল, তার চেয়েও সফলভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন সন্ত্রাসী বাহিনী ও অবৈধ অস্ত্রধারীদের দমন করতে সক্ষম হয়েছিল রক্ষীবাহিনী। এতে নাখােশ হয়ে তথাকথিত গােপন বামপন্থীদের শ্রেণীসংগ্রামের সুপ্ত সমর্থকেরা তখন বলার চেষ্টা করে যে ভারতের সিআরপির আদলে রক্ষীবাহিনী প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দেশবিরােধী, দেশের শত্রু, সন্ত্রাসী, হত্যাকারী, চোরাকারবারি ও শিল্পকারখানায় অগ্নিসংযােগকারীদের দমন করা যদি প্রতিপক্ষকে নির্মূল করা হয়, তাহলে পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে রক্ষীবাহিনী সে কাজটি করেছে। কিন্তু রক্ষীবাহিনী কোনাে গণতান্ত্রিক, দেশপ্রেমিক, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার কাজে কখনাে ব্যবহৃত হয়নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভুল তথ্যের ভিত্তিতে ভুল অভিযানে রক্ষীবাহিনীকে স্থানীয় প্রশাসন ও নেতারা ব্যবহার করেছে, যা মােটেই কাম্য ছিল না। এসব ক্ষেত্রে রক্ষীবাহিনীর সংশ্লিষ্ট সদস্যদের কঠোর শান্তি দেওয়া হয়েছে। অল্পসংখ্যক বিপথগামীর জন্য গােটা বাহিনীর দুর্নাম কাঙ্খিত নয়। জাতীয় রক্ষীবাহিনীর ১৯৭২ সালের সংশােধিত অধ্যাদ্দেশে সুস্পষ্টভাবে লেখা ছিল যে, রক্ষীবাহিনীর কোনাে সদস্য সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে কাউকে গ্রেপ্তার করলে অনতিবিলম্বে একটি রিপাের্টসহ পুলিশের নিকটস্থ থানা বা ফাঁড়িতে তাঁকে হস্তান্তর করতে হবে। ফলে গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণে রক্ষীবাহিনীর কোনাে দায়িত্ব ছিল না। কোনাে কোনাে সময় দেখা গেছে, কিছু পত্রপত্রিকায় দুষ্কৃতকারীদের গ্রেপ্তারের খবর ছাপা হলেও তাদের বিচার-প্রক্রিয়া, শাস্তিবিধান বা মুক্তির বিষয়ে কোনাে খবর ছাপা হয়নি।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমনও হয়েছে যে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী বা দলকে নিরস্ত্র করতে গিয়ে রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা নিজেরাই আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছেন। এতে উভয় পক্ষের গােলাগুলির কারণে হতাহতের ঘটনা ঘটে, যা অনেক ক্ষেত্রে এড়ানাে সম্ভব হয়নি। অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের সঙ্গে রক্ষীবাহিনীর গুলিবিনিময়ে রক্ষীবাহিনীর সদস্যরাই বিজয়ী হয়েছেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে গুলিবিনিময় করে পাকিস্তানি সেনারাই যেখানে পারেনি। সেখানে বাংলাদেশে সর্বহারা দল, একাত্তরের পরাজিত শক্তি, গণবাহিনী ও বাংলাদেশের অস্তিত্বকে যারা স্বীকার করেনি, তারা কীভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে পারবে? এসব সংঘর্ষে মুক্তিযােদ্ধারা, অর্থাৎ সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত রক্ষীবাহিনীর সদস্যরাই বিজয়ী হন। ফলে দেশে আইনশৃঙ্খলা-পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে। সর্বহারা ও অন্য সন্ত্রাসীরা দেশে তখন যে হারে থানা, পুলিশ ফাঁড়ি লুট এবং সাংসদসহ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের হত্যা করছিল, এই অবস্থায় রক্ষীবাহিনী না থাকলে তাদের দমন করা সহজ হতাে না। এই সত্য সবাইকে অনুধাবন করতে হবে।
একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন, অবৈধ অস্ত্রধারীদের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করা সহজ কাজ নয়। কাটা দিয়ে যেমন কাটা তুলতে হয়, তেমনি অস্ত্র দিয়ে অস্ত্র উদ্ধার করতে হয়। বিপথগামী সন্ত্রাসীরা অস্ত্রহীন ব্যক্তির কাছে কখনো অস্ত্র জমা দেয় না। এটা ঠিক, কিছু কিছু ক্ষেত্রে রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের বাড়াবাড়ি হয়েছে। সেটা হয়েছে অনেকটা অনভিজ্ঞতার কারণে। সমালােচনাকারীরা অনেক ক্ষেত্রে, বিশেষত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রকৃত অপরাধীকেও শান্তিকামী সাধারণ নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে। আসলে কয়েকটি ঘটনা ছাড়া শান্তিকামী সাধারণ নাগরিকেরা রক্ষীবাহিনীর হাতে নিগৃহীত হয়নি। পরিচালক নূরুজ্জামান এ ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন। তার কাছে এ ব্যাপারে তেমন রিপাের্ট আসেনি।
রক্ষীবাহিনীর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষার কাজটি সঠিকভাবে এবং কঠোরভাবে সম্পন্ন করা হতাে। প্রতিটি রক্ষী সদস্য ও কর্মকর্তা সততা, দক্ষতা ও সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়ােজিত ছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ নামের দেশটাকে যারা অঙ্কুরেই বিনষ্ট ও অকার্যকর করতে চেয়েছে, এমনকি লাখ লাখ মানুষের আত্মত্যাগকে অস্বীকার করেছে এবং দেশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে নােমছে, তাদের কঠোর হাতে দমন করা ছিল প্রতিটি বাহিনী ও দেশপ্রেমিক নাগরিকের দায়িত্ব।
জাতীয় রক্ষীবাহিনী অধ্যাদেশ ১৯৭২ অত্যন্ত জরুরি ভিত্তিতে তৈরি ও জারি করা হয়েছিল। তখন দেশে নতুন আইনের খসড়া তৈরি করার মতাে যথেষ্ট লােক ছিল না। সে জন্য কার্যক্ষেত্রে বাস্তব অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে অধ্যাদেশটি সংশােধন করার প্রয়ােজন দেখা দেয়। রক্ষীবাহিনীর অধ্যাদেশ ১৯৭২ মােতাবেক রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষায় সরকারি প্রশাসনকে সহযােগিতা করার কথা ছিল। কিন্তু সব সময়, বিশেষ করে দেশের দুর্গম এলাকার সন্ত্রাসী দলগুলােকে সরাসরি মােকাবিলা করার সময় একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে সঙ্গে নিয়ে অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব ছিল না। ফলে একটি সংশােধনী এনে রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তাদের সন্দেহভাজন অপরাধীদের গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়। অবশ্য কেন এবং কোন পরিস্থিতিতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তার যুক্তিযুক্ত কারণ দেখিয়ে একটি প্রতিবেদনসহ নিকটস্থ পুলিশ স্টেশনে তাকে হস্তান্তর করার বিধান ছিল। রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করার মত দেওয়ায় স্বার্থান্বেষী মহলে সমালােচনা শুরু হয়েছিল। অথচ গ্রেফতারের ক্ষমতা দেওয়ার পর রক্ষীবাহিনী যথেষ্ট কার্যকারিতার সঙ্গে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিধানে এ দেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দমনে ব্যাপকভাবে সফল হয়। দেশে সন্ত্রাসী তৎপরতা দ্রুত হ্রাস পায়। সন্ত্রাসীরা পালাতে থাকে। বহুলাংশে কমে আসে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। পুলিশের থানা লুট প্রায় বন্ধ হয়ে যায় । জনমনে স্বস্তি ফিরে আসে। রক্ষীবাহিনীর অভিযানের ফলে দেশের সন্ত্রাসী দলগুলাে; বিশেষ করে নকশাল বাহিনী, সর্বহারা, পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল), পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল), সাম্যবাদী দল ও জাসদের গণবাহিনীর তৎপরতা অনেকটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন পর থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভেতরে সরকারবিরােধী মনােভাব সৃষ্টির লক্ষে বিভিন্ন মহল থেকে নানা গুজব ছড়ানাে হতে থাকে। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তান থেকে বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ও সেনারা ফিরে আসার পর এটা আরও জোরদার হয়। একটা মহল বলতে থাকে যে, সেনাবাহিনীর প্রতিপক্ষ হিসেবে রক্ষীবাহিনী গঠন করা হয়েছে এবং রক্ষীবাহিনীকে সেভাবেই সাজানাে হয়েছে। এমন গুজবও ছড়ানাে হয় যে, রক্ষীবাহিনীর বাজেট প্রতিরক্ষা বাহিনীর বাজেটের চেয়ে অনেক বেশি ইত্যাদি। সেনাবাহিনীর ভেতরে ধ্যানধারণা কেমন ছিল তা বােঝার জন্য তিনজন সেনা কর্মকর্তার বক্তব্য তুলে ধরা যায়।
মুক্তিযােদ্ধা ও প্রথম সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহ বীর উত্তম রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে বিরূপ কোনাে মন্তব্য করেননি। সেনাবাহিনীর ভেতরের তখনকার বাস্তব অবস্থা তুলে ধরেছেন, অর্থাৎ সেনাবাহিনীর সদস্যরা রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে কী ধারণা পােষণ করতেন, সে কথাই বলেছেন। ১৯৯৩ সালে ভােরের কাগজ-এর সম্পাদক মতিউর রহমানের কাছে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে৩ তিনি বলেন :
…সেনাবাহিনীর সদস্যদের এ রকম মনােভাব ছিল যে, তারা কিছুটা অবহেলিত। যদিও ব্যাপারটা পুরােপুরি সত্য ছিল না। তবে কতকগুলাে কার্যকলাপ, যেমন রক্ষীবাহিনীর আবির্ভাবটা অসন্তোষের একটা বড় কারণ ছিল। বিরােধী পক্ষ এর পুরাে সুযােগ নেয়। তারা এটা প্রচার করে অনেকের মধ্যে এটা প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয় যে, শেষ পর্যন্ত রক্ষীবাহিনী সেনাবাহিনীর জায়গা নিয়ে নেবে। আর এ জন্য কিছু ঘটনা কাজ করেছে। সেটা হলাে, সেনাবাহিনীর প্রায় সবকিছুই ছিল পুরােনাে বা পূর্ব-ব্যবহৃত। এটা নয় যে, এগুলাে তাদের দেওয়া হয় এগুলাে তাদেরই ছিল। দেশে যা ছিল, সেটা দিয়ে সেনাবাহিনীকে গড়ে তােলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু রক্ষীবাহিনী যখন তৈরি করা হয়, তখন তাদের জন্য তাে কিছু ছিল না। তাদের অস্ত্র, পােশাক, যানবাহন বা অন্য কোনাে কিছুই ছিল না। সে জন্য সবকিছুই নতুন করতে হয়। তাই ওদের সবকিছু নতুন ছিল। পােশাক, অস্ত্র, যানবাহন, থাকার জায়গা—সবই নতুন ছিল। এ সবকিছুই সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে কিছুটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। রক্ষীবাহিনীকে যখন দেখত, অন্যরা মনে করত, আমরা অবহেলিত। এর ওপর আরেকটি বড় ব্যাপার ছিল। রক্ষীবাহিনীকে কিছু ক্ষমতা দেওয়া হয়, যা দিয়ে তারা যে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারত। যার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কিছু দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল দুই বাহিনীর মধ্যে।
এটা ঠিক, তারা (সৈনিকরা) ভাবে যে, দেশের প্রতিরক্ষা বিষয়টি তাে তাদের ওপর ন্যস্ত । যদি তা-ই হয়, তাহলে বিকল্পের কী প্রয়ােজন? রক্ষীবাহিনী গঠন করা হয়েছিল মূলত পুলিশকে সাহায্য করার জন্য। পুলিশ তখন কার্যকর ছিল না। তাদের পক্ষে আইনশৃঙ্খলা-পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার মতাে অবস্থা ছিল না। এ অবস্থায় হয়তাে রক্ষীবাহিনী গঠন করা হয়। পরে এমন প্রচারণা ছিল যে, রক্ষীবাহিনীর সংখ্যা প্রায় এক লাখের কাছে চলে গেছে। ১৫ আগস্টের পরে তাে দেখা গেল, তাদের সংখ্যা ছিল ১০-১২ হাজারের মতাে। বলা হতাে, এদের কামান দেওয়া হয়েছে। পরে প্রমাণিত হলো, সেটা ছিল না। এসব অপপ্রচারও সেনাবাহিনীর মধ্যে কাজ করেছে। (ভােরের কাগজ, ১৫-১৬ আগস্ট, ১৯৯৩)
মুক্তিযােদ্ধা সেনা কর্মকর্তা মইনুল হােসেন চৌধুরী৪ তার এক জেনারেলের নীরব সাক্ষী বইতে লিখেছেন :
এ কথা সত্যি, সে সময় আমাদের পুলিশবাহিনী সংগঠিত ছিল না। এ ছাড়া স্বাধীনতার পর পরিস্থিতির কারণে সমাজে একশ্রেণীর সুযােগসন্ধানী লােকের উদ্ভব হয়। অনেকের হাতে অবৈধ অস্ত্র থাকায় কিছু কিছু এলাকায় আইনশৃঙ্খলা-পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি ঘটে। তার ওপর গুপ্ত বামপন্থী দলগুলাে পুলিশ ফাঁড়ি, থানা ইত্যাদি আক্রমণ করে অস্ত্রশস্ত্র লুট করত। তা ছাড়া খাদ্য গুদাম, পাটের গুদামে আগুন দেওয়া, রাজনৈতিক, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপর আক্রমণ ও তাদের হত্যা শুরু করে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রক্ষীবাহিনীকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপকভাবে মােতায়েন করতে হয়। তাদের ওপর ভরসা করার একটা বড় কারণ, এই বাহিনীর সদস্যরা ছিল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে রক্ষীবাহিনী দ্রুতই সমালােচনার সম্মুখীন হয়। তারা গুপ্ত বামপন্থী দলগুলাের আক্রমণের শিকার হয়। ফলে কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে তারাও অতিমাত্রায় প্রতিক্রিয়া দেয়। তাই রক্ষীবাহিনী আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে অন্য রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন চালাত বলে অভিযােগ ওঠে। রক্ষীবাহিনীকে অনেকে আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডার বলে ধারণা করতে শুরু করে। ফলে রক্ষীবাহিনী নিয়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরে তথা পুলিশ, বিডিআর, সেনাবাহিনীতে চরম বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এর প্রথম কারণ, রক্ষীবাহিনী কর্মকর্তাদের ভারতীয় উপদেষ্টাদের তত্ত্বাবধানে সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর মতাে পােশাক গ্রহণ । দ্বিতীয়ত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ। তা ছাড়া সামরিক বাহিনীকে বঞ্চিত করে রক্ষীবাহিনীকে সরকার উন্নত বেতন, খােরাক, পােশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি সুযােগ-সুবিধা দিচ্ছে বলে প্রচারণা শুরু হয়, যদিও সব অভিযােগ সঠিক ছিল না। (পৃ. ৩৮)। মইনুল হােসেন চৌধুরী আরও লেখেন :
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, পুনর্বাসন ও আইন-শৃঙ্খলার দৃষ্টিকোণ থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে একটা সদ্য স্বাধীন দেশে আধা সামরিক কিংবা অন্য কোনাে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা গঠন করা অস্বাভাবিক কিছু
নয়।
তিনি রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে নানা অভিযােগের কথা লিখে নিজেই আবার সুস্পষ্টভাবে লিখেছেন, “সব অভিযােগ সঠিক ছিল না।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক সাফল্যে পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালি সেনা কর্মকর্তা, সৈনিকসহ সব বাঙালি বাংলাদেশে ফিরে আসতে পেরেছিলেন। তাদের একজন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা এম সাখাওয়াত হােসেন৫। তিনি বাংলাদেশ: রক্তাক্ত অধ্যায়, ১৯৭৫-৮১ নামের একটি বই লিখেছেন। তিনিও মইনুল হােসেন চৌধুরীর মন্তব্যের মতােই রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে কিছু বিরূপ মন্তব্য করেছেন। রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে পাকিস্তান-প্রত্যাগত অমুক্তিযােদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের কেমন বিদ্বেষী মনােভাব ছিল, তা তার লেখা থেকে পাওয়া যায়।
এম সাখাওয়াত হােসেন লিখেছেন :
সেনাবাহিনীতে মুক্তিযােদ্ধা এবং অমুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে মানসিক দূরত্ব থাকলেও রক্ষীবাহিনীর কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সকলেই একমত পােষণ করত। সকল সদস্যেরই দৃঢ় বিশ্বাস রক্ষীবাহিনীর বাজেট প্রতিরক্ষা বাজেট থেকে অনেক বেশি ছিল। রক্ষীবাহিনীর রসদ থেকে শুরু করে সকল সরঞ্জামের প্রাধিকার ছিল অন্যান্য বাহিনীর উর্ধ্বে। তখন সেনাবাহিনীতে ইউনিফর্মের ঘাটতি পূরণের জন্য কিছু কিছু ভারত থেকে আনানাে হলেও ওগুলাের সাইজ এত ছােট ছিল যে, যার বেশির ভাগই সঠিক মাপে লাগত না। গুজব রটানাে হল যে, ভারত ইচ্ছে করে সে দেশের বাতিলকৃত পােশাক পাঠায় বলেই এরূপ অবস্থা। তবে এটা সত্য যে, তখন জুতা থেকে রাইফেল পর্যন্ত প্রচুর ঘাটতি ছিল আর এ ঘাটতি মিটাতে এসব সরঞ্জাম আমদানি করা হত ভারত থেকে যার বেশিরভাগ দ্রব্যই ছিল নিম্নমানের।
সাখাওয়াত হােসেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে মুক্তিযােদ্ধা ও অমুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যকার মানসিক দূরত্বের কথা উল্লেখ করেছেন এবং তা
স্পষ্ট হয়ে উঠেছে রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে মুক্তিযােদ্ধা সেনা কর্মকর্তা ও অমুক্তিযােদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের বক্তব্য থেকেই। সত্য উদঘাটনের স্বার্থে তাদের মতামত খণ্ডন করা প্রয়ােজন।
স্বাধীনতার পর নবগঠিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৮-১৯ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার একজন এ এন এম নূরুজ্জামান। তাঁকে জাতীয় রক্ষীবাহিনীকে সংগঠিত করার গুরুদায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাঁর নেতৃত্বে এবং সার্বিক পরিচালনায়, অর্থাৎ সেনাবাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠন করা হয়। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা আবুল হাসান খান, সাবিহ উদ্দিন আহমেদ, এ কে এম আজিজুল ইসলাম, এ এম খান, শরিফ উদ্দিন আহমেদ ও সালাহউদ্দিন আহমদসহ সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকজন সাবেক ও চাকরির সুবেদার ও হাবিলদারকে প্রেষণে রক্ষীবাহিনীতে পাঠানাে হয় । এই সেনা কর্মকর্তাদের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। সুতরাং, রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীর প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখার কোনাে যুক্তি ছিল না। বরং রক্ষীবাহিনী সদ্য স্বাধীন দেশে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, চরম বামপন্থী সন্ত্রাসী দলগুলাের বিরুদ্ধে অভিযান এবং স্বাধীনতার বিরােধীদের দমনের ক্ষেত্রে অসাধারণ সাহস ও উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করেছে । রক্ষীবাহিনী গঠনের ফলে সেনাবাহিনীকে সীমিত কয়েকটি অভিযানে মােতায়েন করা হয়েছিল। অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে সীমিত পরিসরে মােতায়েন করায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা তেমন খুশি ছিলেন না। একবার এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল সেনা সদর অফিসার মেসে। সেনাবাহিনীর চাকরিতে থাকা অবস্থায় মেজর জয়নাল আবেদীন নামের একজন সেনা কর্মকর্তা সেনাসদর অফিসার মেসে প্রকাশ্যে সরকার উৎখাতের কথা বলেছিলেন। এ ছাড়া সেনা কর্মকর্তা মােহাম্মদ জিয়াউদ্দিন আহমেদ। ১৯৭৪ সালে চাকরিরত থাকা অবস্থায় সরকারবিরােধী একটি প্রবন্ধ লেখেন। সেটা তিনি সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকায় প্রকাশ করেন, যা ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি। চাকরিচ্যুত হওয়ার পর তিনি সর্বহারা দলে যােগ দিয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে গুপ্ত হত্যাকাণ্ড চালাতে থাকেন। আবার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল যুদ্ধাহত যুক্তিযােদ্ধা আবু তাহের সেনাবাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে (সেপ্টেম্বর ১৯৭২) গিয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলে (জাসদ) যােগ দেন এবং সঙ্গোপনে সেনাবাহিনীর মধ্যে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গঠনের চেষ্টা চালান। এতে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, সেনাবাহিনীর মধ্যে শৃঙখলার অভাব ছিল, অবশ্য তা অস্বাভাবিক ছিল না। একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সবার প্রত্যাশা পূরণ করা সরকারের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল।
স্বাধীনতার পর জ্যেষ্ঠ, যােগ্য, দক্ষ, ত্যাগী ও শক্ত নেতৃত্বের মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে সুশৃঙ্খলভাবে গড়ে তােলার প্রয়ােজন ছিল। কিন্তু সুদীর্ঘ সংগ্রাম আর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রাপ্ত স্বাধীন দেশে তখন যে পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল, তাতে সরকারের পক্ষে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল। এম এ জি ওসমানীকে এক আদেশে জেনারেল করা হয়। তার সুপারিশে একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঠিক করেছিলেন যে খাজা ওয়াসিউদ্দিনকে সেনাপ্রধান নিয়ােগ করবেন। কিন্তু তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। মুক্তিযুদ্ধের পর একজন অমুক্তিযােদ্ধাকে সেনাপ্রধান করার চিন্তা যুক্তিযুক্ত বা গ্রহণযােগ্য ছিল না। ওসমানীরও সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান থাকা আইনসম্মত ছিল না। কারণ, তিনি ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ ও নির্বাচিত সাংসদ। ফলে সরকারের সামনে ছিল মুক্তিযুদ্ধের তিনজন ফোর্স কমান্ডার, যাদের একজনকে সেনাপ্রধান করা যায়। যদিও তারা সেনাপ্রধান হওয়ার মতাে জ্যেষ্ঠ ছিলেন না এবং তাদের অভিজ্ঞতাও যথেষ্ট ছিল না। সেনাবাহিনী যতই ছােট হােক, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, মেজর জেনারেল বা তদূর্ব পদের অধিকারীরা সাধারণত সেনাপ্রধান হন। মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকালে উপযুক্ত তিনজন ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর। এর পরবর্তী র্যাংক লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে যারা পদোন্নতি পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু না হলে তাঁরা হয়তো কয়েক মাসের মধ্যে ওই পদে পদোন্নতি পেতেন। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ সরকার তাদের লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি দেয়। তিনজনের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ছিলেন জিয়াউর রহমান । কিন্তু এম এ জি ওসমানী তাকে মােটেই পছন্দ করতেন না; মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি তাঁকে একবার মুক্তিবাহিনী থেকে অব্যাহতি দিতে চেয়েছিলেন। ফলে পরবর্তী জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা কে এম সফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান এবং জিয়াউর রহমানকে উপ সেনাপ্রধান করা হয়। দুজনকেই কর্নেল পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে জিয়া ও তার সমর্থিত একটি অংশ অসন্তুষ্ট ছিল। ১৯৭৩ সালের ৬ জুন তাদের দুজন একসঙ্গে প্রথমে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে উন্নীত হন। এর কিছুদিন পর তাদের দুজনকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করা হয়। কিন্তু সেনাবাহিনীর মধ্যে একটা চাপা অসন্তোষ থেকেই যায়। কয়েকজন মেজরও দ্রুত গতিতে কর্নেল ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হন। অন্যদিকে বীর সিপাহি সিপাহিই থেকে যান। এতে তাদের মধ্যেও দেখা দেয় চাপা অসন্তোষ।
সেনাবাহিনীর ভেতরে পুঞ্জীভূত এসব চাপা অসন্তোষ প্রকাশ করার তেমন সুযােগ ছিল না। ফলে অসন্তোষ প্রকাশের একটা নতুন পথ বের হয় এবং সেটা হচ্ছে জাতীয় রক্ষীবাহিনী। সেনাবাহিনীতে নিম্নমানের ব্যারাক সে দোষ রক্ষীবাহিনীর নিম্নমানের খাবার, সে দোষও রক্ষীবাহিনীর; পােশাক নিম্নমানের, সে জন্যও রক্ষীবাহিনী দায়ী এবং বেতন কম, সে জন্যও দায়ী রক্ষীবাহিনী। অথচ রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের বেতনের স্কেল এবং খাবার ও পােশাকের সুবিধা ছিল পুলিশের মতে, সেনাবাহিনীর চেয়ে অনেক কম। রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের থাকার ব্যারাক ছিল না। সাভার ট্রেনিং সেন্টারে ছাপরাঘর তৈরি করে গাদাগাদিভাবে তাদের খাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। নতুন দেশে সেনাবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর সরঞ্জাম আমদানি করা হয়েছে ভারত থেকে। কারণ, অন্য দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে আমদানি করার অর্থ সরকারের ছিল না। পুলিশ, বিডিআর ও রক্ষীবাহিনীর জন্য ভারত থেকে আমদানি করা সরঞ্জাম নিম্নমানের ছিল না। কিন্তু সেনাবাহিনী মনে করত, তাদেরগুলাে নিম্নমানের। এর কারণ দুটি। প্রথমত, সেনাবাহিনীর বেশির ভাগ সদস্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সরঞ্জামের বেশির ভাগ আমদানি করা হতাে আমেরিকা থেকে। সেগুলাের মান ভারতীয় সরঞ্জামের চেয়ে অনেক উন্নত ছিল। ফলে তাদের কাছে ভারতীয় সরঞ্জাম, পােশাক-আশাক নিম্নমানের মনে হতে পারে । দ্বিতীয় কারণ হতে পারে, যারা ভারত থেকে আমদানির দায়িত্বে ছিলেন, তারা দুর্নীতি করে নিম্নমানের সরঞ্জাম কিনেছিলেন। এ কথা অনেকের হয়তাে জানা যে, টিসিবির ক্ষেত্রে ঘটেছিল এমন ঘটনা ।
এটা ঠিক যে, রক্ষীবাহিনীর লিডারদের প্রশিক্ষণ ভারতে হতো। এ বিষয় নিয়ে যারা চিন্তিত ছিলেন, তারা কিন্তু চিন্তা করে দেখেননি যে ওই সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অনেক কর্মকর্তা সেনাকেও ভারতেই প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানাে হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় ব্যাচের কর্মকর্তাদের সবাই ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন। তাঁরা অত্যন্ত সাহস ও দেশপ্রেমের সঙ্গে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করতে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করেন। এ ছাড়া পাকিস্তান-প্রত্যাগত সেনা কর্মকর্তা ও মুক্তিযােদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে হােসেইন মুহম্মদ এরশাদ, সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম৯, দানিয়েল ইসলামসহ১০ অনেক কর্মকর্তা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ভারতে। আমাদের সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে পারলে রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তারা প্রশিক্ষণ নিতে পারবেন না কেন? এখানে উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সাল থেকে রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তাদের সেনাবাহিনীতেও প্রশিক্ষণের জনা পাঠানাে শুরু হয়। ওই বছর লিডার এন এ রফিকুল হােসেন১১ এবং এম এম ইকবাল আলমকে১২ জুনিয়র ট্যাকটিক্স কোর্স ও ইউনিট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কোর্সে পাঠানাে হয়েছিল ।
কোনো কোনাে মহল, বিশেষ করে সেনাবাহিনীর পাকিস্তান প্রত্যাগত কর্মকর্তা যারা ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি, আবার কারও কারও যুদ্ধে অংশ নেওয়ার ইচ্ছেও ছিল না, তাদেরই অনেকে এই মর্মে গুজব ছড়াতে শুরু করেন যে রক্ষীবাহিনীর বাজেট সেনাবাহিনীর বাজেটের চেয়ে অনেক বেশি। এটা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। আমার মনে আছে, ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে রক্ষীবাহিনীর বাজেট ছিল সর্বসাকল্যে ৯ কোটি টাকা এবং সেনাবাহিনীর বাজেট ছিল ৯২ কোটি টাকা, যা আবার বাড়িয়ে ১২২ কোটি টাকা করা হয়েছিল। দুই বাহিনীর লােকবল হিসেবেও সেনাবাহিনীর জন্য বাজেটে অর্থ বরাদ্দ বেশি ছিল। আসলে পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের অনেক খেদ ছিল, যা প্রকাশ্যে বলার মতো সাহস তাদের ছিল না। তারা সাহসী হলে তো পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন। যেমন অংশ নিয়েছিলেন আবু তাহের বীর উত্তম, এম এ মঞ্জুর বীর উত্তম, মাে. জিয়াউদ্দিন আহমেদ বীর উত্তম, এ এফ এম শামসুল আরেফিন১৩ ও সাজ্জাদ আলী জহিরের১৪ মতাে অনেক বাঙালি সেনা কর্মকর্তা। যাদের সাহস নেই তারা একটা কাজ খুব ভালাে করতে পারে, সেটি হলাে সাহসীদের সমালােচনা। একজন সেনা কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ ও বেতন দেওয়া হয় দেশের জন্য যুদ্ধ করতে। যুদ্ধে নিহত হলে তাদের শহীদ হিসেবে গণ্য করা হয়, বীরত্ব দেখালে পদক দিয়ে সম্মানিত করা হয়। শত্রুর হাতে গ্রেপ্তার হলে বা শত্রুর কবলে থাকলে, তার একটাই দায়িত্ব থাকে। সেটা হচ্ছে শত্রুর কবল থেকে পালিয়ে আসা।
সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতায় পাকিস্তান থেকে সেনা কর্মকর্তারা ফিরে এলে দেখা গেল তাঁদের পরিবারে থাকার ব্যবস্থা বাংলাদেশে নেই। কারণ, পাকিস্তান শাসনামলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পর্যাপ্ত সেনানিবাস এবং সেনা কর্মকর্তা ও সেনাদের থাকার মতাে বাসস্থান বা ব্যারাক ছিল না। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল অনেক সেনানিবাস এবং পর্যাপ্ত বাসস্থান ও ব্যারাক। ১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তান সরকার পশ্চিম পাকিস্তানে অনেক সেনানিবাস, সেনা কর্মকর্তা ও সেনাদের জন্য পর্যাপ্ত বাসস্থান-ব্যারাক নির্মাণ করে। পূর্ব পাকিস্তানে সে হারে করেনি। বাংলাদেশ সরকার অস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে তাদের জন্য টিনের ঘর তৈরি করার অর্থ মঞ্জুর করে। কিন্তু সেই সব ঘর নির্মাণে অনেক দুর্নীতির অভিযােগ ওঠে, তা-ও পাকিস্তান থেকে ফিরে আসা কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তারা ওই ঘর নির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন। প্রত্যাগত সেনা কর্মকর্তা ও তাদের পরিবার ১৯৭১ সালের অক্টোবর নভেম্বরের আগ পর্যন্ত পাকিস্তানে খুব আরাম-আয়েশে ছিলেন । কিছু কর্মকর্তা, যারা পাকিস্তানিদের সহযােগিতা করেছেন, তারা তো একেবারে শেষ পর্যন্ত আরাম-আয়েশেই ছিলেন। তাদের নাম আর উল্লেখ করলাম না। বাংলাদেশের টিনের ঘর তাদের ভালাে লাগেনি। সরকারের হাতে অর্থ ছিল না। যা বরাদ্দ করা হয়েছিল তা-ও সেনাবাহিনী সঠিকভাবে ব্যয় করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রেও তাঁদের ক্ষোভ সৃষ্টি হয় বাংলাদেশের নতুন বাহিনী, মুক্তিযােদ্ধাদের বাহিনী জাতীয় রক্ষীবাহিনীর ওপর, যে বাহিনীর সদস্যরা ছাপরার নিচে গাদাগাদি করে থাকত।
সেনাবাহিনীতে এমন কথাও প্রচলিত ছিল, রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনী থেকে বেশি অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর মধ্যে এ ধারণা থাকার কথা কে এম সফিউল্লাহও তার সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনার পর রক্ষীবাহিনীকে তার সমস্তু অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদসহ যখন সেনাবাহিনীর সঙ্গে আত্তীকরণ করা হয়, তখন কী দেখা গেল? রক্ষীবাহিনীর হাতে তেমন কোনাে অস্ত্রশস্ত্র আর গােলাবারুদই নেই। অস্ত্রের মধ্যে ছিল শুধু এসএমজি, রাইফেল, এলএমজি ও কয়েকটি মর্টার। তবে হ্যা, নিজস্ব জায়গায় রক্ষীবাহিনীর কিছু স্থাবর সম্পত্তি ছিল । যেমন সাভারের প্রশিক্ষণকেন্দ্র, চট্টগ্রামের ভাটিয়ারীর জোনাল হেডকোয়ার্টার্স, খুলনার গিলতলা, সিলেটের বাটেশ্বর, বগুড়া ও ঢাকার মিরপুরসহ আরও কয়েকটি জায়গায় জমি ও স্থাপনা ছিল। এসব স্থাবর সম্পত্তি সেনাবাহিনীকে হস্তান্তর করা হয়েছিল। এই সব সম্পদ বা সম্পত্তি রক্ষীবাহিনীর সুযােগ্য ও দূরদর্শী পরিচালক এ এন এম নুরুজ্জামানের অসাধারণ নেতৃত্ব, দক্ষতা, পরিশ্রম এবং প্রচেষ্টার ফলে হয়েছিল।
আসলে কোনাে বাহিনীর তিপক্ষ হিসেবে বা কারও ব্যক্তিগত বাহিনী হিসেবে রক্ষীবাহিনী গঠিত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ শেষে মুক্তিযােদ্ধাদের দেশের কাজে লাগিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ বাহিনীকে সহযােগিতা করে সুপ্ত সর্বহারা, চরম বামপন্থী সন্ত্রাসী, অবৈধ অস্ত্রধারী ও আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনীর মতাে বাহিনীগুলােকে দমন করা এবং তাদের কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধার করে বাংলাদেশ নামের নতুন দেশটিকে একটা স্থায়ী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে জাতীয় রক্ষীবাহিনী অসাধারণ অবদান রেখেছে। শুধু তা-ই নয়, ১৯৭৫ সালের পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পাচটি ব্রিগেডকে পাঁচটি ডিভিশনে উন্নীত করতে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে জাতীয় রক্ষীবাহিনী।
জাতীয় রক্ষীবাহিনীকে একটি সুশৃঙ্খল , সক্ষম ও কার্যকর বাহিনী হিসেবে গড়ে তােলার জন্য এ এন এম নূরুজ্জামান দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন। এ জন্য আমাদেরও কঠোর পরিশ্রম করতে হতো। ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সারা দেশে রক্ষীবাহিনী মােতায়েন করা সম্ভব হয় এবং দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিতে বাংলাদেশ পুলিশের সহযােগী ও সহায়ক শক্তি হিসেবে দারুণ সাফলা অর্জন করে। এ কারণে প্রশংসাকারী ও সমালােচনাকারী উভয়ের দৃষ্টিই পড়ে রক্ষীবাহিনীর ওপর। এতে বাংলাদেশ পুলিশ ও বিডিআরের মধ্যে কোনাে ঈর্ষার ছাপ লক্ষ করা যায়নি। তবে সেনাবাহিনীর মধ্যে ঈর্ষার ভাব ছিল প্রথম থেকেই। এর কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সেনাবাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলার অভাব ছিল। অপ্রীতিকর হলেও কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। যেমন-
ক. বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে অভিজ্ঞতা ও একতার অভাব ছিল। তা ছাড়া নেতৃত্বের শীর্ষে থাকা তিন কর্মকর্তার মধ্যে ছিল বিভেদ ও মতানৈক্য । ফলে কে এম সফিউল্লাহর ঐকান্তিক চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও তার নেতৃত্ব সব স্তরের সেনাসদস্যের পূর্ণ আস্থা ও অবিভাজ্য আনুগত্য অর্জনে সমর্থ হয়নি।
খ. সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে কে এম সফিউল্লাহ নিজ পদ ও দায়িত্বে
সন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু তার চেয়ে একটু জ্যেষ্ঠ জিয়াউর রহমান ও পাকিস্তান-প্রত্যাগত জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকররা মােটেই সন্ত্রষ্ট ছিলেন না।
গ. জিয়াউর রহমান দিন গুনছিলেন তিনি কখন এবং কীভাবে সেনাপ্রধান হবেন। সে জন্য তাঁর প্রতি আস্থাশীল ব্যক্তিদের নিয়ে সেনাবাহিনীর মধ্যে নিজের একটা বলয় তৈরি করতে সচেষ্ট ছিলেন তিনি।
ঘ. সেনাবাহিনীর চিফ অব দ্য জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) খালেদ মােশাররফের (তখন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল) লক্ষ্যই ছিল জিয়াউর রহমানকে পাশ কাটিয়ে কে এম সফিউল্লাহর মেয়াদের পর সেনাপ্রধান হওয়া। এ ব্যাপারে নিজের পথ সুগম করতে তিনি ১৯৭৪ সালেই জিয়াউর রহমানকে পূর্ব জার্মানিতে১৫ রাষ্ট্রদূত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজি করিয়েছিলেন। এতে শঙ্কিত হয়ে জিয়াউর রহমান রাজনীতিক মাে. জিল্লুর রহমান১৬, তােফায়েল আহমেদ, নূরুল ইসলাম চৌধুরী১৭, গাজী গােলাম মােস্তফা, আনােয়ার হােসেন মঞ্জু১৮ প্রমুখ আওয়ামী লীগের নেতার কাছে তদবির করেছিলেন।
জিয়াউর রহমান এমনকি আমার কাছেও তদবির করেছিলেন। বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়ােজন বলে আমি মনে করি। কারণ, এর পরিণতিতে বাংলাদেশের ইতিহাস পরিবর্তিত হয়েছিল এবং এ জন্য আমি নিজেকে সব সময় অপরাধী মনে করি।

জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়ার১৯ বড় বােন ছিলেন খুরশিদ জাহান হক২০। চকলেট আপা নামে তিনি পরিচিত ছিলেন। তিনি কয়েক বছর টাঙ্গাইল কুমুদিনী মহিলা কলেজে পড়াশােনা করেন । আমার মেজো বােন ফেরদৌস জাহান, খন্দকার আসাদুজ্জামানের২১ স্ত্রী কুলসুম আপা এবং ড. আর এ গনির২২ স্ত্রী এলি আপাও তখন টাঙ্গাইল কুমুদিনী মহিলা কলেজে পড়াশােনা করতেন। তারা চারজন বান্ধবী ছিলেন। এ ছাড়া আমার বাবা মো. আবদুর রাহীম ইছাপুরী ছিলেন খুরশিদ জাহান হকের স্থানীয় অভিভাবক। ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত খুরশিদ জাহান হক মাঝেমধ্যে ছুটির দিনগুলােতে আমাদের বাসা ইছাপুরী লজে থাকতেন। সেই সূত্রে তার পরিবারের সঙ্গে আমাদের খানিকটা গনিষ্ঠতা হয় এবং তা পরেও অক্ষুন্ন ছিল।
১৯৭৪ সালে একদিন, এখন তারিখ মনে নেই, ছুটির দিনে চকলেট আপা তার বাসায় দুপুরবেলা আমাকে খেতে যেতে বলেন। তিনি ও তার স্বামী ইস্কাটনে থাকতেন। ভাবলাম, অনেককেই হয়তাে তিনি দাওয়াত দিয়েছেন। কিন্তু গিয়ে দেখি, বাসায় শুধু চকলেট আপা ও তাঁর স্বামী মােজাম্মেল হক (তখন ট্যানারিজ করপোরেশনের ফাইনান্স ডিরেক্টর) আছেন। আর কেউ নেই। ভাবলাম আর কাউকে হয়তাে বলেননি। তাঁদের সঙ্গে গল্প করছিলাম। কিছুক্ষণ পর সেখানে জিয়াউর রহমান ও তার স্ত্রী খালেদা জিয়া উপস্থিত হন। এই সময় চকলেট আপা আমাকে বললেন, ‘জিয়া তাের সঙ্গে কথা বলতে চায়’। আমাদের দুজনকে ড্রয়িংরুমে রেখে তারা সবাই ভেতরে চলে গেলেন। জিয়াউর রহমানের সঙ্গে এর আগেও অনেকবার দেখা হয়েছে। বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠানে, বিশেষ করে চকলেট আপার বাসায় ও এলি আপার ধানমন্ডির বাসায়। সব সময় তাকে একটু গম্ভীর মনে হয়েছে। কিন্তু এই দিন তাকে অনেকটা স্বাভাবিক ও বন্ধুসুলভ মনে হলাে। তিনি এটা-সেটা আলাপের পর বললেন, সরকার তাকে পূর্ব জার্মানিতে রাষ্ট্রদূত করে পাঠাতে চায়। কিন্তু তিনি সেখানে যেতে চান না। তিনি ভেবেছেন, আমি বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের মানুষ । আমি বললে বঙ্গবন্ধু সেই আদেশ বাতিল করতে পারেন। আমি তাকে বােঝালাম, বঙ্গবন্ধুর কাছে সুপারিশ করার মতাে অবস্থান আমার নেই এবং আমি বললেও এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু কোনাে গুরুত্ব দেবেন না। তার চেয়ে আপনি আগরতলা মামলায় যারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অভিযুক্ত ছিলেন, তাদের বলেন। বঙ্গবন্ধু তাদের কথার গুরুত্ব দিতে পারেন।

আমার কথামতো জিয়াউর রহমান আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত এম শওকত আলী ও ডা. শামসুল আলমের২৩ কাছে যেতে পারেননি। শুধু ডা. খুরশিদ উদ্দিন আহমেদকে২৪ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলেন এবং তার বদলি আদেশটি বাতিল করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে এর পরিণতি যা হয়েছিল, তা নিয়ে খুরশিদ উদ্দিন আহমেদ ও আমি দুজনই নিজেদের সব সময়ই অপরাধী মনে করি।
ঙ. আবার সেনাবাহিনীতে খালেদ মােশাররফের চেয়ে জ্যেষ্ঠ ছিলেন মীর শওকত আলী২৫। তিনি সে সময় যশােরে ব্রিগেড কমাণ্ডার ছিলেন । যশোরের কই মাছ ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রিয়। শীর শওকত আলী বঙ্গবন্ধুর জন্য নিয়মিত যশােরের কই মাছ পাঠাতে থাকেন এবং তার আসল কাজ রেখে কৃষি উৎপাদন বাড়ানাের চেষ্টা করেন। এ জন্য কৃষিপদকও পেয়েছিলেন। খালেদ মােশাররফকে ব্রিগেডিয়ার ও সিজিএস করায় তিনি মনঃক্ষুগ্ন হন। সে জন্য তার আনুগত্য ছিল জিয়াউর রহমানের প্রতি।
চ. পাকিস্তান-প্রত্যাগত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের মধ্যে খাজা ওয়াসিউদ্দিনকে কুয়েতে রাষ্ট্রদূত করে পাঠানাে হয় । অন্যদের মধ্যে খলিলুর রহমান২৬, মাজেদুল হক২৭, কাজী গােলাম দস্তুগীর২৮, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও অন্যরা মাথা গুঁজে চাকরি করতে থাকেন। তারা সবাই এ ভেবে অপেক্ষায় ছিলেন যে, সুযোগ একটা এসে যেতে পারে।
ছ. ১৯৭৩ সালের পর মুক্তিজোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা ও পাকিস্তান-প্রত্যাগত অমুক্তিযােদ্ধা কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য দ্বন্দ্ব লেগেই ছিল । সরকারের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের বীরদের আর্থিক সুবিধা দেওয়ার মতাে সামর্থ্য ছিল না। তাই তাদের দুই বছর জ্যেষ্ঠতা দেওয়া হয়েছিল । এ নিয়ে অমুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে অসন্তুষ্টি বাড়তে থাকে।
জ. পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে সেনাসদস্যদের যেসব সুযােগ-সুবিধা ছিল, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সেসব সুযােগ-সুবিধা দেওয়া সরকারের পক্ষে সহজ ছিল না। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের কঠিন বাস্তবতা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন অনেক সেনা কর্মকর্তা। যারা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, তাঁরা তাঁদের পেশাগত জীবনে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
ঝ. সাধারণ সেনাসদস্যদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠতে থাকে নানা কারণে। একটা উল্লেখযােগ্য কারণ হচ্ছে কর্মকর্তাদের ব্যাটম্যান হিসেবে সাধারণ সৈনিকদের কাজ করতে অনাগ্রহ। এ ছাড়া বেতন, বাসস্থান ও অন্যান্য বিষয়ে সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে অসন্তোষ ছিল ।

আরও কারণ ছিল। সব মিলে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে শৃঙ্খলার অভাব লক্ষণীয় ছিল । দৃশ্যত উর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের উদ্যোগ, পরিশ্রম ও দূরদৃষ্টির অভাবে সেনাবাহিনীর পুনর্গঠন ও অগ্রগতি ত্বরান্বিত করা সম্ভব হয়নি, যা সম্ভব হয়েছিল এ এন এম নূরুজ্জামানের নেতৃত্বে জাতীয় রক্ষীবাহিনীতে। এর ফলে সেনাসদসাদের মধ্যে ঈর্ষাভাব সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক ছিল না।
অথচ অভিজ্ঞ, বিচক্ষণ, একাগ্র, পেশাদার ও গুণাবলিসম্পন্ন নিঃস্বার্থ নেতত্ব গড়ে তুলতে পারলে ওই সময় সীমিত সম্পদের মধ্যেও দ্রুত একটা শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তােলা সম্ভব ছিল। কিন্তু সেনা নেতৃত্বের মধ্যে দেশপ্রেম, সাহস ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও নিজেদের মধ্যে দলাদলির কারণে তাদের দৃষ্টি ছিল অন্যত্র। সে জন্য সব ব্যর্থতার দায়ভার নবগঠিত রক্ষীবাহিনীর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা দৃশ্যমান ছিল।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করছি। জাতীয় রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয় ও সাভার প্রশিক্ষণকেন্দ্রে দায়িত্ব পালনের জন্য কয়েকজন রক্ষী সদস্যকে বাহিনীর রক্ষীপুলিশ হিসেবে নিয়ােগ দেওয়া হয়। তাদের পােশাক রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের মতােই থাকে, তবে তাদের ব্যারেট (টুপি) দেওয়া হয় লাল রঙের। এতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রতিক্রিয়া হয় । সেনাসদর আর মিলিটারি পুলিশ এতে আপত্তি জানায়। তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল ছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনি রক্ষীবাহিনীর পরিচালককে একটা চিঠি লিখে জানান, মিলিটারি পুলিশ লাল ব্যারেট পরে, তাই রক্ষীপুলিশ লাল ব্যারেট পরতে পারে না। আমরা সুন্দর করে একটা ছােট উত্তর লিখলাম যে, সেনাসদর হয়তাে খেয়াল করেনি যে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরাও লাল ব্যারেট পরেন। উপপরিচালক সরােয়ার হােসেন মােল্লা স্বাক্ষরিত চিঠিটি অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেলের কাছে পাঠানাে হয়। তারপর সেনাসদর এ ব্যাপারে আর উচ্চবাচ্য করেনি।
রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যেও তখন এবং ১৯৭৫ সালের পর কয়েক বছর নানা বিভ্রান্তি ছড়ানাে হয়। প্রয়াত এনায়েতুল্লাহ খানের সর্বদা সমালােচনাকারী পত্রিকা সাপ্তাহিক হলিডে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের মুখপত্র দৈনিক গণকণ্ঠ ও ভাসানী ন্যাপের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত সাপ্তাহিক হক-কথা পত্রিকায় রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে প্রচুর লেখালেখি হয়। কয়েকজন রাজনীতিকও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন

রক্ষীবাহিনী বিলুপ্ত হওয়ার কয়েক বছর পর রাজনীতিক মওদুদ আহমদ তাঁর Bangladesh: The Era of Sheikh Mujibur Rahman বইতে রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে অনেক কিছু লিখেছেন। এর বেশির ভাগই মিথ্যা, আংশিক সত্য ও অর্ধসত্য। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, যা-ই হােক, জাতীয় রক্ষীবাহিনী কোনাে ভালাে কাজ করেনি, এ কথা ঠিক নয়। বিপুল পরিমাণ বেআইনি অস্ত্র এরা উদ্ধার করেছে এবং আটক করেছে প্রচুর পরিমাণে চোরাচালানকৃত পণ্য। কালােবাজারি এবং অবৈধ গুদামজাতকারীরা রক্ষীবাহিনীর নাম শুনেই আতঙ্কবােধ করত। তার বইতে রক্ষীবাহিনীর প্রশংসা এটুকুই। বাকি অংশে রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে যা লিখেছেন, তার সবই সমালােচনামূলক। এসব সমালােচনার জবাব ইতিমধ্যেই দিয়েছি। তবে মওদুদ আহমদ সম্পর্কে এ কথা অবশ্যই বলতে হয়, একজন তুখােড় আইনজীবী হিসেবে তিনি যেকোনাে বিষয়ের পক্ষে যেমন যুক্তি দিয়ে বলতে পারেন, তেমনি যুক্তি দিয়ে বলতে পারেন বিপক্ষেও। কাজেই তাঁর কথায় পরিপূর্ণ বিশ্বাস রাখা মুশকিল।
আমাদের দেশে কিছু কথা প্রচলিত আচ্ছে, যার মধ্য দিয়ে বাঙালির অন্তর্নিহিত চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটে থাকে যেমন, যত দোষ মৃন্দ ঘােষ, যাকে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা ইত্যাদি। জাতীয় রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে যত সমালােচনা আমাদের দৃষ্টিগােচর হয়েছে, তা বিশ্লেষণ করলে উপরিউক্ত প্রবাদকথা যথাযথ বলে মনে হয়। আমাদের দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর থেকেই আমরা খেয়াল করছি একশ্রেণীর বাঙালি দেশপ্রেমিক মুক্তিযােদ্ধাদের দোষত্রুটি খুঁজে বের করতে ব্যস্ত। তারা কিন্তু ১৯৭১ সালে যারা ইসলামের নামে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে, তাদের সমালােচনা করেনি। এমনকি তারা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযােগী রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর নির্মম নির্যাতন আর নিষ্ঠুরতার কথাও বলেনি। আসলে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে যত অভিযােগ, তার বেশির ভাগই ছিল পাকিস্তানি মনােভাবাপন্ন ব্যক্তি ও দেশবিরােধী চরম বামপন্থী সন্ত্রাসী দলগুলাের সুপ্ত সমর্থকদের আজগুবি বয়ান।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা। স্বাধীনতার পর পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া বাড়িঘর প্রভাবশালী ব্যক্তিরা দখল করতে থাকে। কেউ রাজনৈতিক, কেউ প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় বাড়িঘর ও অন্যান্য সম্পত্তি দখল করতে থাকে। আবার মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত অনেককে সরকার অস্থায়ীভাবে থাকার জন্য পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া বাড়িঘর বরাদ্দ দেয়। যারা অবৈধ দখলদার ছিল, তাদের অপসারণ করার জন্য সরকার পুলিশের পাশাপাশি নিয়ােগ করে রক্ষীবাহিনীকেও। এ কাজে একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিষ্ট্রেটের আদেশ মােতাবেক বেশ কিছুদিন অপসারণের অভিযান চলে। এ নিয়ে তখন, বিশেষত অবৈধ দখলদারদের সম্পর্কে বিভিন্ন পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হতাে। কোনাে অভিযােগ উঠলেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতাে। এ সময় ভুল তথ্যের ভিত্তিতে বৈধভাবে বরাদ্দ পাওয়া কয়েকজনকে বাড়ি থেকে পুলিশ বা রক্ষীবাহিনী কর্তৃক উচ্ছেদের ঘটনাও ঘটে । একবার অভিনেত্রী সুমিতা দেবী আমাকে জানান, শহীদ জহির রায়হানের স্ত্রী হিসেবে সরকার মােহাম্মদপুরে তাকে একটা বাড়ি দিয়েছে। কিন্তু পুলিশ তাকে সেই বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে পথে বসিয়েছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে তখনকার ঢাকার এসপি মুক্তিযােদ্ধা মাহবুবউদ্দিন আহমেদ ও জেলা প্রশাসক সৈয়দ রেজাউল হায়াতকে বলে সুমিতা দেবীকে তার নামে বরাদ্দ দেওয়া বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করি। কিন্তু রক্ষীবাহিনী কাউকে তার জন্য বরাদ্দ করা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে, এমন তথ্য আমার কাছে কখনাে আসেনি।
কিছুদিন আগে খ্যাতনামা লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের একটি লেখা পড়ে আমি খুব লজ্জিত ও বিব্রত বােধ করি। তিনি আমার ও আমার স্ত্রীর খুব প্রিয় একজন লেখক এবং তার প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে। তিনি লেখেন, রক্ষীবাহিনী তার বিধবা মাকে সরকারিভাবে বরাদ্দ করা বাড়ি থেকে উৎখাত করে সত্যিকার অর্থে পথে নামিয়ে দেয়। তার বাবা ফয়জুর রহমানকে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করেছিল । একজন মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে আমি চিন্তাই করতে পারি না, একটি শহীদ পরিবারকে বাড়িছাড়া করা হবে। তা-ও আবার সেই বাহিনী কর্তৃক, যে বাহিনীতে আমি চাকরি করেছি এবং যেটি ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের বাহিনী। বিষয়টি আমার একেবারে অগােচরে ছিল। তখন হয়তাে আমি অন্য কোনাে কাজে ব্যস্ত বা দেশের বাইরে ছিলাম। এত দিন পরে বিষয়টি জানার পর একটা অপরাধবােধ আমাকে কুরে কুরে খেতে থাকে।
এই অপরাধবােধ থেকেই একদিন আমি রক্ষীবাহিনীর পরিচালক প্রয়াত এ এন এম নূরুজ্জামানের স্ত্রী দিল আফরােজ জামানের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলি। তিনি আমাকে জানান যে ঘটনাটি পুরােপুরি সত্যি নয়। কারণটা তার মা আয়েশা ফয়েজের লেখা বই জীবন যে রকম পড়লে স্পষ্টভাবে জানা যাবে। কয়েক দিন পর মিসেস জামান আমাকে বইটা সংগ্রহ করে দেন। সেই বই পড়ে জানতে পারলাম, রক্ষীবাহিনী সত্যিই বরাদ্দ করা বাড়ি থেকে তাঁকে বের করে দিয়েছিল । কিন্তু খবরটা পেয়েই আমাদের পরিচালক নিজে মুহম্মদ জাফর ইকবালের মা আয়েশা ফয়েজকে ফোন করেন এবং বরাদ্দ করা ওই বাড়িতেই তার থাকার ব্যবস্থা করেন। জীবন যে রকম বইটা পড়ে আমি সত্যিই আমাদের পরিচালক এ এন এম নূরুজ্জামানের সংবেদনশীল মনােভাবের জন্য গর্ব অনুভব করি। কিন্তু আমার প্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বিষয়টি তার লেখায় উল্লেখ করেননি। ফলে আমিও তার লেখা পড়ে বিভ্রান্ত হই। আমার নিজের যখন এ অবস্থা, তখন সাধারণ মানুষের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। প্রকৃতপক্ষে রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে যত অপপ্রচার করা হয়েছে, তার সব সত্য নয়। কিছু সত্য, কিছু কিছু অর্ধসত্য এবং বেশির ভাগ নির্জলা মিথ্যা। এ জনাই এই ঘটনার অবতারণা করলাম।
তথ্যনির্দেশ
১. রক্ষীবাহিনীর চতুর্থ ব্যাচের শিক্ষা সমাপনী কুচকাওয়াজ উপলক্ষে প্রকাশিত স্যুভেনিরের মুখবন্ধ। পরিশিষ্ট ৮ দেখুন।
২. যারা রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তা ছিলেন। পরিশিষ্ট ৯ দেখুন।
৩. কে এম সফিউল্লাহর সাক্ষাৎকার। পরিশিষ্ট ১০ দেখুন।
৪. মইনুল হােসেন চৌধুরী বীরবিক্রম : পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে মেজর এবং দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। এর অবস্থান ছিল জয়দেবপুরে। মার্চে অসহযােগ আন্দোলনের সময় ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে সাধারণ জনগণের ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণচেষ্টা তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মােকাবিলা করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন তাতে। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রথমে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের, পরে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা অনন্য। পরে মেজর জেনারেল হন। সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকাকালে প্রেষণে তিনি বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০০ সালে
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন ।
৫. এম সাখাওয়াত হােসেন : ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, পরে সামরিক বিষয়ে বিশ্লেষক ও নির্বাচন কমিশনার (২০০৭-১১)
৬. জয়নাল আবেদীন: পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ও বরখাস্ত।
৭. মােহাম্মদ জিয়াউদ্দিন আহমেদ বীর উত্তম । ১৯৭১ সালে সেনাবাহিনীর মেজর হিসেবে পাকিস্তানে (তখন পশ্চিম পাকিস্তান) কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জুলাই মাসে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে তাতে যােগ দেন। তাকে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অধীন প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা অনন্য। চাকরিতে থাকা অবস্থায় ১৯৭৪ সালে সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকায় নিবন্ধ লেখার জন্য শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযােগে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। তখন তাঁর পদবি ছিল লেফটেন্যান্ট কর্নেল।
৮. আবু তাহের বীর উত্তম : ১৯৭১ সালে সেনাবাহিনীর মেজর হিসেবে পাকিস্তানে (তখন পশ্চিম পাকিস্তান) কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জুলাই মাসে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে তাতে যােগ দেন। তাকে ১১ নম্বর সেক্টরের সেক্টর অধিনায়ক হিসেবে নিয়ােগ দেওয়া হয়। ১৪ নভেম্বর কামালপুর যুদ্ধে আহত হন। মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা অনন্য। ১৯৭২ সালের এপ্রিলে বিদেশে চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল পদে নিয়ােগ পান। জুন মাসে ৪৪ ব্রিগেড অধিনায়ক নিযুক্ত হন। সেনাসদরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে দ্বিমত পােষণ করায় ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাকে সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করা হয়। এরপর তিনি জাসদে যোগ দেন। সহসভাপতি ছিলেন। জাসদে থাকাকালে গণবাহিনী গঠন করেন। ১৯৭৩ সালে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়াধীন ড্রেজার সংস্থার পরিচালক নিযুক্ত হন। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরের অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের ঘটনায় তাকে ২৫ নভেম্বর আটক করা হয়। ১৯৭৬ সালে সামরিক আদালতের বিচারে ১৭ জুলাই তিনি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। তার মৃত্যুদণ্ড ২১ জুলাই কার্যকর করা হয়।
৯. সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক : ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট এবং দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাতে যােগ দেন। প্রতিরােধযুদ্ধ শেষে প্রথমে ৩ নম্বর সেক্টরে, পরে ‘এস’ ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন। ১৯৯৬ সালে মেজর জেনারেল হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় কথিত অভ্যুত্থানের অভিযােগে তাকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করা হয় । তখন তিনি যশােরের জিওসি ছিলেন। বর্তমানে রাজনীতিক। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি।
১০. দানিয়েল ইসলাম : পরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হন।
১১. এন এ রফিকুল ইসলাম: ১৯৭৫ সালে রক্ষীবাহিনী বিলুপ্ত হওয়ার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হন। পরে মেজর জেনারেল হন।
১২. এম এম ইকবাল আলম। রক্ষীবাহিনী বিলুপ্ত হওয়ার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হন। পরে উন্নীত হন কর্নেল পদে।
১৩. এ এফ এম সামসুল আরেফিন : ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লেফটেনান্ট ছিলেন। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে ৯ নম্বর সেক্টরের শমশেরনগর সাবসেক্টরে যুদ্ধ করেন। পরে মেজর হন। বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।
১৪. সাজ্জাদ আলী জহির বীর প্রতীক : ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট ছিলেন। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে ২ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেন। মুক্তিবাহিনীর আর্টিলারি ইউনিট মুজিব ব্যাটারির সহ-অধিনায়ক ছিলেন। পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত হন। বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ গবেক্ষক।
১৫. বর্তমানে পূর্ব জার্মানি নামে কোনাে দেশ নেই। পূর্ব জার্মানি পরে পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। পশ্চিম জার্মানি নামেও দেশ নেই। একীভুত পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির বর্তমান নাম ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানি।
১৬. কয়েকবার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ১৯৯৬-২০০১ সালে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী। ২০০৯ সালে স্বল্প সময়ের জন্য মন্ত্রী। পরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি (২০০৯-২০১৩)।
১৭. নূরুল ইসলাম চৌধুরী : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বৃহত্তর চট্টগ্রাম এলাকা থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য হন ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় প্রতিমন্ত্রী ছিলেন।
১৮. আনােয়ার হােসেন মঞ্জু : একাধিকবার বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী। বর্তমানে দৈনিক ইত্তেফাক এর সম্পাদক ও জাতীয় পার্টির (জেপি) সভাপতি।
১৯. খালেদা জিয়া: সাবেক প্রধানমন্ত্রী। বর্তমানে সাংসদ, জাতীয় সংসদের বিরােধীদলীয় নেতা এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন।
২০. খুরশিদ জাহান হক : ২০০১-০৬ সালে খালেদা জিয়ার শাসনামলে মন্ত্রী।
২১. খন্দকার আসাদুজ্জামান : মুক্তিযােদ্ধা। বাংলাদেশ সরকারের অবসরপ্রাপ্ত সচিব। বর্তমানে সাংসদ।
২২. ড. আর এ গনি : ১৯৭৮-৮২ সালে জিয়াউর রহমান ও বিচারপতি আবদুস সাত্তারের মন্ত্রিসভায় প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) স্থায়ী কমিটির সদস্য।
২৩. ডা. শামসুল আলম: আগরতলা মামলার ২৪ নম্বর আসামি ছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর, পরে কর্নেল ।
২৪. ডা. খুরশিদ উদ্দিন আহমেদ : আগরতলা মামলার ৩৪ নম্বর আসামি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন এবং মেডিকেল কোরে চাকরি করতেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে অন্তর্ভুক্ত হন। পরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল।

২৫. মীর শওকত আলী বীর উত্তম: ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর ও অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ঝাপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রতিরােধযুদ্ধে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পরে ৫ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক নিযুক্ত হন। ১৯৭৫ সালে কর্নেল। পরবর্তী সময়ে লেফটেন্যান্ট জেনারেল, রাষ্ট্রদূত। ১৯৯১-৯৫ সালে খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী।
২৬. খলিলুর রহমান : ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এবং তখন পশ্চিম পাকিস্তানে (বর্তমান পাকিস্তান) কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তান থেকে ফিরে আসার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হন। মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি পান। ১৯৭৫ সালে বিডিআরের
মহাপরিচালক হন।
২৭. মাজেদুল হক: ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এবং, তখন পশ্চিম পাকিস্তানে (বর্তমান পাকিস্তান) কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তান থেকে ফিরে আসার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হন। পরে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি পান। ১৯৭৮-৮২ সালে জিয়াউর রহমান ও বিচারপতি আবদুস সাত্তারের মন্ত্রিসভায় এবং ১৯৯১-১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী হন।
২৮. কাজী গােলাম দস্তগীর: ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্নেল এবং তখন পশ্চিম পাকিস্তানে (বর্তমান পাকিস্তান) কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তান থেকে ফিরে আসার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হন। পরে মেজর জেনারেল ও রাষ্ট্রদূত হন।
২৯. মাহবুবউদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম : ১৯৭০ সালে ঝিনাইদহ মহকুমার মহকুমা পুলিশ প্রশাসক (এসডিপিও) ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ৮ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেন। জুলাই থেকে ভোমরা সাবসেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন। স্বাধীনতার পর ঢাকা জেলার পুলিশ প্রশাসক (এসপি) ছিলেন। বর্তমানে ব্যবসায়ী।
৩০. সৈয়দ রেজাউল হায়াত: মুক্তিযােদ্ধা, বাংলাদেশ সরকারের সচিব, চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব লজিস্টিক অ্যান্ড ট্রান্সপাের্টের প্রেসিডেন্ট, সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সহসভাপতি, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা ফোরামের সভাপতি এবং ডেইলি সান ও বাংলাদেশ হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা ছিলেন। মৃত্যু ১৬ এপ্রিল ২০১২।
 

Ref: রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যা, আনোয়ার উল আলম, pp 70-98