মেজর খালেদ মোশাররফ অনন্য আদেশ, দুঃসাধ্য কাজ
মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া
প্রচণ্ড ভালোবাসা, অগাধ বিশ্বাস আর অফুরান স্নেহ অবজ্ঞা করা বর্ণনাহীন কষ্টের। সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ কিছু অনুরোধ করলেন আমাকে । এগুলো হওয়ার কথা ছিল আদেশ এবং মেজর খালেদের আদেশ যে কী জিনিস তা তার অধীনস্থরা খুব ভালো করেই জানেন । আমি তার তুলনায় শুধু নয়, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও একটা পিঁপড়া । আমাকে তাহলে অনুরোধ কেন? সে প্রসঙ্গেই আসছি । নতুন ছেলে, অস্ত্র আর গোলাবারুদ আনতে সেপ্টেম্বর মাসে গিয়েছিলাম সেক্টর সদর দপ্তর মেলাঘরে । দেশের ভিতর প্রবেশ করার প্রক্রিয়া শেষ হয় মেজর খালেদ মোশাররফ বা ক্যাপ্টেন হায়দারের ব্রিফিং এর মাধ্যমে । ব্রিফিং শেষে মেজর খালেদ আমাকে ডাকলেন । বললেন, দেখোতো কিছু টেলিফোন সেট, টাইপ রাইটার আর সাইক্লোস্টাইল মেশিন (এখনকার ফটোকপিয়ারের মতো বহু পুরাতন ঢং এর মেশিন । (স্টেনসিল পেপারে টাইপ করে হাতে ঘুরিয়ে একাধিক কপি ছাপানো বের করা যেতো) আনতে পারো কিনা । আমার সেক্টর কমান্ডার ভালো করেই জানেন কুমিল্লা জেলার যে এলাকায় (মুরাদনগর, কোম্পানিগঞ্জ, নবীনগর) আমরা যুদ্ধ করি এবং যেসব এলাকায় যুদ্ধের দায়িত্ব তিনি আমাকে দিয়েছেন সেসব জায়গায় তার চাহিদা পূরণের সামগ্রীসমূহ নেই । অর্থাৎ সরকারি অফিস আদালত নেই বা থাকলেও সেগুলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দ্ধারা সুরক্ষিত । সেনাবাহিনীতে ‘না’ বলে কিছু নেই । আমি অ্যাটেনশন হয়ে সব জেনেশুনেও জবাব দিলাম, ‘জি স্যার’ । উনিও যে জানেন না তা নয় তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘আর টাকাপয়সার অবস্থা তো দেখছোই’। সিদ্ধ ডিম দিয়ে পোচ করার অনুরোধ । আমার দৃঢ় বিশ্বাস এ অনুরোধটির শতভাগ সম্ভাব্যহীনতার কথা উনিও জানতেন । তবুও কেন আমাকে এ অনুরোধ? ফিরে এলাম এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে-যে করেই হোক আমার সেক্টর কমান্ডারের ইচ্ছা পূরণ করবো, তা সে যেভাবেই হোক ।
৯৩
যে রাস্তাটি ময়নামতি থেকে বেয়াক্ষণবাড়িয়া যায় সে রাস্তায় ময়নামতি থেকে ১৮ কি.মি. দূরে গোমতি নদীর উপর ব্রিজ । ব্রিজের অপর পাড়ে কোম্পানিগঞ্জ বাজার । বাজার হয়ে উত্তর-পশ্চিম দিকে চলে গেছে অসম্পূর্ণ কাঁচা রাস্তা নবীনগর । কোম্পানীগঞ্জ বাজারের শ’খানেক গজ দূরে ন্যাশনাল ব্যাংক অফ পাকিস্তানের একটি ছোট শাখা । আমার সেক্টর কমান্ডারের টাকার একমাত্র উৎস। পাকিস্তানি ক্যাম্পটি আমরা উত্তর-পূর্ব দিক থেকে রেইড করবো । স্বভাবতই গুলিবর্ষণের জবাব পাকিস্তানিরা গুলি দিয়েই দেবে এবং প্রচণ্ডভাবে । আদতে রেইড নয় রেইডের একটি মহড়া হবে । উদ্দেশ্য দুইটি, এক. শত্রুর দৃষ্টি অন্যদিকে অর্থাৎ রেইডিং দলের দিকে নিয়ে যাওয়া এবং দুই. গুলির প্রচণ্ড শব্দে যেন ব্যাংক ভাঙার শব্দ পাকিস্তানিরা শুনতে না পায় রেইড দলকে ব্যাংক ভাঙার বিষয়ে কিছুই বলা হলো না । তাদের রেইড শুধু পাকিস্তানি ক্যাম্পের উপর প্রচণ্ড গুলিবর্ষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে বলা হলো । তার জন্য নিরাপদ অবস্থানও নির্বাচন করা হলো । বিশ্বস্ত চারজন ছেলেকে ১০ পাউন্ড করে প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ, পাঁচটি ডেটোনেটর-২৭ এবং ১২ ফুট সেফটি ফিউজ সাথে নিলাম ।এ চার সহযোদ্ধাকে ব্যাংক ভাঙার বিষয়ে কিছুই বলা হলো না । তাদের সাথে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র দেয়া হলো না । শুধু আমি একটি ৯ এম.এম সাব-সাব মেশিন কারবাইন(ভারতীয়) এবং দুই ম্যাগাজিন ভর্তি গুলি নিলাম । সাথে একটি চার ব্যাটারী টর্চ । এই ছিল পরিকল্পনার সংক্ষেপ । অভিজ্ঞতা ও রণাকৌশল শিক্ষার অভাবে পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি রয়েই গেলো । সেপ্টম্বরের শেষ বা অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের এক রাতে ছেলেরা শত্রু অবস্থানের উপর পরিকল্পনা অনুযায়ী গুলিবর্ষণ শুরু করলো । চার সহযোদ্ধাসহ আমি ব্যাংক বিল্ডিং-এ পৌছালাম পূর্ব দিক থেকে অত্যন্ত সাবধানে। আমাদের রেইডিং পার্টিরই লক্ষ্যভ্রষ্ট গুলি আসতে পারে । রাতের আঁধারে এ এক কঠিন সমম্বয় । সামান্য এক্সপ্লোসিভ দিয়ে কলাপসেবল গেট এবং দরজার তালাগুলো ভেঙে ফেলা হলো । এবার ভোল্ট (যে ভারি ও নিরাপদ সিন্দুকে টাকা থাকে) ভাঙার পালা । সবার বুক দুরু দুরু করছে । একটু টের পেলেই শত্রু দালানটি ঘেরাও করে ফেলবে । নির্ঘাৎ মৃত্যু । ভোল্ট এর চাবির ছিদ্রের ভিতর টিপে টিপে কিছু এক্সপ্লোসিভ ঢুকিয়ে অল্প সেফটি ফিউজ ডেটোনেটরসহ লাগিয়ে সবাই বাইরে এলাম । বিকট শব্দ হলো । গিয়ে দেখি বেশ খানিকটা লোহার সিন্দুক ভেঙে গেছে । এবার ৪০ পাউন্ডের বাকি সবটুকু এক্সপ্লোসিভ লাগালাম (এটি আটা বা ময়দার কাই এর মতো)। ভয়ের কারণ এখন । কেননা বিকট শব্দ হবে, নিশ্চিত। শত্রু শব্দের উৎস খুঁজতে পারে । আমাদের ধারণা এ প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে শব্দ বিকট হলেও খুব কমই শোনা যাবে এবং শত্রু এটিকে আমাদের মর্টারের শেল এর আওয়াজ হিসেবে গুরুত্ব নাও দিতে পারে । এবার ডেটোনেটর লাগালাম । সেফটি ফিউজ দিলাম ৬ফুট । অপর প্রান্তে আগুন দিলে এক মিনিটে পুড়বে ১/৫
৯৪
ফুট । তার অর্থ আমরা বিস্ফোরণের আগে নিরাপদ দূরত্ব যাবার জন্য ৪ মিনিট সময় পাবো । বিকট শব্দে এলাকা কাঁপিয়ে বিস্ফোরণ ঘটলো । আমরা যাভাবে হাত দিয়ে বসেছিলাম মিনিটখানেক সেভাবেই বসে রইলাম । শত্রু টের পেয়ে থাকলেও ওরা কোনো ব্যবস্থা নেয়ার আগেই আমাদের কাজ সমাধা করতে হবে । ব্যাংকে ঢুকে পড়ে দেখি ভোল্ট ভেঙে চারিদিকে সব টাকা ছড়িয়ে আছে । টাকা কিসে করে নেবো তার ব্যবস্থা করা হয়নি । আসলে ভাবতেই পারিনি এতো টাকা হবে । পাশে টাকা বহন করার টিনের ট্রাংক পেলাম চারটা । তাড়াতাড়ি করে তার তিনটিতে টাকা ভরলাম । তালার অভাবে আটকানো গেল না । এগুলো ভারতে সেক্টর হেডকোয়ার্টারে বহন করে নিয়ে যাবার শ্রমিক দরকার । বহু কষ্ট করে রাস্তা পার করে নবীনগর যাবার রাস্তা যেখান থেকে শুরু তার পাশে একটি ঝোপে এনে রাখলাম । দুইজনকে পাঠালাম ছয়জন শ্রমিক আনতে । পরিবারকে এই আশ্বাস দিয়ে যে মুক্তিযোদ্ধাদের একটু সাহায্য করতে, পরদিনই চলে আসবে । ওরা মিনিট দশের মধ্যেই ছয়জন লোক নিয়ে এলো । ইতোমধ্যে বিস্ফোরকের শব্দে আশেপাশের গ্রামের সবার ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো । আমার বয়স ১৯, তবু ১৯ মণ ওজনের দায়িত্ব আমার কাঁধে । তিন ট্রাংক টাকা এবং আমার সাথে কেবল একটি আগ্নোয়াস্ত্র । ভারতীয় বিএসএফ এবং ভারতীয়দের নজর এড়াতে হবে । সবচেয়ে বড় ভয় আমার চার সহযোদ্ধা এবং ছয়জন গ্রামবাসী । কেননা কোনো ট্রাংকেরই তালা নেই, ঢাকনা খুললেই টাকা । এক মুহূর্তে অসতর্ক হবার সুযোগ নেই । নগদ টাকা বলে কথা এবং তা অ-নে-ক । সত্যি বলতে কী-এক পর্যায়ে নিজের প্রাণ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে গেলাম । যদি আমাদের ছেলেরাই আমাকে টাকার জন্য হত্যা করে । আমাদের সেক্টর হেডকোয়ার্টার মেলাঘরের দূরত্ব বেশি নয় কিন্তু পথটা বন্ধুর । মাথায় ট্রাংক নিয়ে বিশেষ করে উঁচুতে ওঠা কষ্টকর । কিছুক্ষণ পর পর বিশ্রাম নিতে হতো । কাউকে কারণ ব্যাখ্যা না করলেও সূর্য ওঠার আগেই মেলাঘর পৌছবো এ উদ্দেশে অটল রইলাম । ভোর হবার আগেই মেলাঘর প্রবেশ করলাম । ঘাম দিয়ে আমার জ্বর ছাড়লো । রেজিমেন্টাল পুলিশ চেক পোস্টের পাশে ৩০/৪০ মিনিট জিরিয়ে নিলাম সবাই । ক্ষুধায় পেটের নাড়িভুঁড়ি সমেত হজম হয়ে যাবার উপক্রম । পাহাড়ের উপর দু’টি ১৮০ পাউন্ড তাঁবু লম্বালম্বি করে লাগিয়ে নিচে মাটি খোদাই করে ক্যাপ্টেন হায়দার বানিয়েছেন ‘অপারেশন রুম’ । তিনি অপারেশন রুমের ভেতরেই ছিলেন । ট্রাংকগুলো রাখতেই উনি জানতে চাইলেন ভিতরে কী । আমি একটা ট্রাঙ্কের ঢাকনা তুললাম । এতো টাকা দেখে তিনি এক লাফে উপর উঠে এলেন । ৫০গজ দূরেই সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশারফের ‘ডেরা’ । মুলি বাঁশের নির্মিত তিন কামরার ঘর । আসবাবসহ সমই মুলি বাঁশের । তিনি
৯৫
বারান্দায় বসে ছিলেন । তার সামনে ট্রাংকগুলো রাখতেই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হায়দার এগুলি কী’ । ‘স্যার, কামরুল এনেছে’ ক্যাপ্টেন হায়দারের জবাব । বলেই একটি ট্রাংকের ঢাকনা খুললেন । মুহূর্তেই খালেদ আমাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং ধরেই রইলেন । অনুভব করলাম উনার আনন্দাশ্রু পড়েছে আমার পিঠে । আমি যে কিছু বলবো তখন কোনো সুযোগই রইলো না । নোট পরে জেনেছি মরহুম মেজর. জেনারেল আবুল মনজুর, বীর উত্তমের ভাই ব্যারিস্টার আবুল মনসুর (০১৮১৭১৫৮১৪৩) মেজর খালেদ মোশারফের অনুরোধে মোট টাকার একটি অংশ ভারতীয় মুদ্রায় বদল করেছেন । ওনার সাথে আমার এ বিষয়ে কথা হয়েছে ১৪জুলাই, ২০১৫ তারিখে রেসিডেন ব্লু ওয়াটার গার্ডেন হোটেলের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহাঙ্গীর আলমের অফিসে । মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া জন্ম ২৪জুলাই, ১৯৫২, কুমিল্লা । শিক্ষা যশোর জিলা স্কুল এবং ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ । ১৩এপ্রিল এইচএসসি পরীক্ষার আঠারো দিন আগে মুক্তিযুদ্ধে, ২নম্বর সেক্টরে । চুয়াত্তরের ৯জানুয়ারি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে পঁচাত্তরের ১১জানুয়ারি ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এ কমিশন লাভ করেন । ১২ জুলাই, ১৯৯৬ স্বেচ্ছায় অবসর নেন । ১৯৮৩ সালে বেইজিং ভাষা ও সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চীনা ভাষায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক তার বইয়ের সংখ্যা ২৭টি, সামরিক ইতিহাসের লেখা একটি এবং শিশুতোষ গ্রন্থ ৪টী । বর্তমানে তিনি সেন্টার ফর বাংলাদেশ লিবারেশন ও্য়ার স্টাডিজ-এর চেয়ারম্যান ও প্রধান গবেষক ।