You dont have javascript enabled! Please enable it!

মাকে ভালোবেসে প্রাণ বাজি রেখে যুদ্ধ করেছি
ইউ কে চিং বীরবিক্রম

ছোটবেলায় খুব দুষ্ট ছিলাম। পড়াশোনা করাটা ছিল আমার কাছে বিরক্তিকর বিষয়। কাজের চেয়ে অকাজেই লিপ্ত থাকতে পছন্দ করতাম। আমাকে নিয়ে বাবা-মা বেশ চিন্তা করতেন। একদিন আমার এক ভগ্নিপতি জোর করে ঢাকায় নিয়ে আসেন। তারপর ভর্তি করিয়ে দেন ইপিআরে। পাহাড়ি কিশোর হওয়ার কারনে সমতলের মানুষের সঙ্গে মেশার তেমন কোনো অভিজ্ঞতাও ছিল না। তাই ইপিআরে ভর্তি হওয়ার পর থেকে মনের ভেতরে সর্বদাই ভ্য কাজ করতো। ট্রেনিং শুরু হলে এই ভ্যটা ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করে। পাহাড়িদের জীবন অনেক কঠিন ও কৌশলময়। তাই ট্রেনিংয়ে কৌশলগুলো ও শরীর গঠন করার পদ্ধতিগুলো আমার কাছে মজার কোনো খেকার মতোই মনে হতো। আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবন করতাম। ১৯৭১ সালে আমি রংপুরের হাতিবান্ধায় ইপিআরের বর্ডার আউটপোস্টে নায়েক হিসেবে কর্মরত ছিলাম। যুদ্ধ শুরু হলে আমাকে হাবিলদার পদে উন্নীত করা হয়। আমার অধীনে ৬৫ জন সৈনিক ছিল। আমি তাদের নিয়ে রংপুর , লালমনিরহাট, পাখিউড়া, কাউয়াহাগা, বাঘবান্ধা, হাতিবান্ধা, চৌধুরীহাট,ভূরুঙ্গমারী, কুলাঘাট প্রভৃতি অপারেশ্নে অংশ নিই। কাউয়াহাগার অপারেশন যুদ্ধ দেশব্যাপী বিস্তৃত হয়েছে কিছুদিন হলো। লালমনিরহাট নদীর ওপারে আমরা একদিন দেখতে পেলাম আগুন জ্বলছে। আমার সঙ্গে গার্ড হিসেবে ছিল দুজন সিপাহি। ওদের বললাম, কোনো ফায়ার-টায়ার করার দরকার নেই, শুধু দেখতে থাকো। এর আগে অবশ্য আমরা ওখানে এমবুশ করেছিলাম। এক্সময় দেখলাম, দুজন পাকিস্তানি প্যান্ট-শার্ট ক্লোজ করে শাড়ি পরে ঘরে ঢুকছে।ভাবলাম,যদি গুলি করি তাহলে হয়তো মারা যাবে, নয়তো পালিয়ে যাবে। কিন্তু ওদের জীবিত ধরতে হবে নয়তো জানা যাবে না মূল ঘটনাটা। তাই ওদের দুজনকে জীবিত ধরে আনার জন্য চারজনকে পাঠালাম।বলে দিলাম,যদি ঘরে দুটি দরজা থাকে তাহলে দুটি দরজায় দুজন দাঁড়াবে আর দুজন ঘরে ঢুকবে।যেই কথা সে কাজ।কিন্তু একজন তবুও পালিয়ে গেল আর একজন জীবিত ধরা পড়ল।সে ছিল একজন পাঞ্জাবি সেনা।সেনাটিকে ধরে এনে গাছের সঙ্গে বেঁধে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো –কী জন্য ছদ্মবেশ ধরেছে,তার দলের নেতা কে?দলের কে কোথায় আছে ইত্যাদি।সে সবই বলে দিয়েছিল।কারন,তাকে বলা হয়েছিল যে সে বাঁচতে চায়,নাকি মরতে চায়।যদি বাচতে চায় তাহলে আমাদের সব কথা শুনতে হব,আর মরতে চাইলে এখনিই তাকে বেয়োনেট চার্জ করা হবে।তাই সে বাঁচার জন্য সবই বলে দিয়েছিল। সারা রাত আগুন জ্বলল নদীর ওপারের গ্রামটায়।তবুও আমরা রাতে কোনো ফায়ার ওপেন করলাম না।কারন,জান্তে পেরেছিলাম পাকিস্তানিদের কেউই আর ওখানে নেই।তাই আমি রাতে সেনাটাকে ভারতীয় ফোর্সের কাছে পৌছে দিতে চাই।অব্যশ ওকে বাঁচিয়ে রাখার বিরুদ্ধে আমার দলের অনেক সেনা আপত্তি তুলেছিল।আমি তখন ঠান্ডা মাথায় তাদের বুঝিয়ে বলেছিলাম-ওকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে আমাদের স্বার্থেই।তাছাড়া পাকিস্তানিদের হাতে আমাদের দেশের অনেক মানুষ বন্দি হয়ে আছে। এমনকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও ওদের জেলে বন্দি। ওকে আমরা তখনই ফিরিয়ে দেব যখন ওরা আমাদের ক্যাম্পে ২০-২৫ জনকে ফিরিয়ে দেবে। তাই রাতেই আমি পাঞ্জাবি সেনাটিকে ভারতীয় ফোর্সের কাছে হ্যান্ডওভার করে আসি। ওকে পৌঁছে দিয়ে এসে আমি আমরা দুজন সেনা নিয়ে আবার নদীর ঘাটে গেলাম। কান পেতা শুনলাম, মহিলা ও বাচ্চাদের কান্না শোনা যাচ্ছে। সিপাহিরা ও শুনল। সারা গ্রাম তো পুড়ে ছাই, বাচ্চারা এল কীভাবে? তাড়াতাড়ি করে মাঝিকে খুজে বের করে এনে বললাম, নদীর ওপারে গিয়ে তোমাকে জানতে হবে কারা ওখানে কাঁদছে। মাঝি তো ভয়ে অস্থির। কারন, ওখানে পাকিস্তানিরা থাকতে পারে। যা-ই হোক, তাকে অভয় দিয়ে পাঠালাম নদীর এপারে। ফিরে এসে সে বলল, স্যার ওপারে কোনো পাকিস্তানি নেই, অনেক মহিলা আর বাচ্চা বালুর মধ্যে গর্ত করে বসে বসে কাঁদছে। তাকে বললাম, যে করেই হোক ওদের এপারে ফিরিয়ে বিয়ে আসতে হবে। মাঝিকে বললাম,তুমি গিয়ে বলো যে মুক্তিফৌজের হাবিলদার সাহেব আপনাদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছেন। এভাবে ছয়টি পে দিয়ে ৩২ জন মহিলা আর তাদের সন্তানদের নদী পার করে এনে গ্রামের স্কুলে নিয়ে ওঠালাম। গ্রামের মাতব্বর, স্কুলের শিক্ষকদের ডেকে সব বাড়ি থেকে কাঁথা, শাড়ি,চাল,ডাল তুলে ওদের সবকিছুর ব্যবস্থা করলাম।এরপর ওদের সবার নাম রেজিস্ট্রি করে ক্যাম্পে পৌঁছে দিয়ে এসে আবার নদীর ওপারে গেলাম আমার দল নিয়ে। তার আগে অবশ্য নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম যে ওখানে কোনো পাকিস্তানি নেই।গিয়ে দেখি কোনো জীবিত প্রাণীর অস্তিত্ব নেই সেখানে। কেবলি আগুনে পুড়ে যাওয়া কালো কালো ছাইয়ের স্তূপ । এর মধ্যে আমাদের দেখে কচুক্ষেতের মাঝ থেকে একজন বুড়ো আর একটি বাচ্চা বেরিয়ে এল । ওরা দুজন গোপনে লুকিয়ে ছিল । তাদের কাছ থেকে শুনলাম, যত বাঙালি পুরুষ ছিল, সবাইকে ব্রাশফায়ার করে মেরে ঘরের চাল তাদের ওপরে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে পাকিস্তানি সেনারা । ওদের কথামতো টিনগুলো উঁচু করে দেখি সেই বীভৎস দৃশ্য । কাউকে চেনার উপায় নেই, কেবলি পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া মাংসের কালো স্তূপ । ওই অবস্থায়ই গর্ত করে তাতে দুজন করে সমাহিত করে আমরা আমাদের ব্যারাকে ফিরে আসি আমার স্মরণে এটা ছিল এক ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ । নৃশংসতা অসংখ্য অঘটনের জন্ম দিয়েছে ওই বেজন্ম পাকিস্তানিরা । আমার আরও মনে পড়েছে যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে, ডিসেম্বর মাসের শুরুর দিকে আমি তখন রংপুরে অবস্থানরত । একদিন সকালবেলা । কয়েকজন সিপাহি নিয়ে গেলাম শহরের পাশে । সেখানে ছিল একটা ছোট ব্রিজ । দেখলাম ব্রিজের নিচে অনেক চাটাই স্তূপ করা । সঙ্গীদের নিয়ে একে একে সাতটি চাটাই তললাম । চাটাই তুলে যা দেখলাম তা বলতে আজও আমি শিহরিত হই । সেই বীভৎস দৃশ্য ভোলার নয়-প্রতিটি চাটাই এর নিচে রক্তে ভেজা ক্ষতবিক্ষত মানুষের লাশ । সব লাশই ছিল মেয়েদের । হাতে ঘড়ি, পায়ে জুতা দেখে বুঝলাম স্কুল-কলেজের ছাত্রী । চেহারা দেখে চেনার কোনো উপায়ই ছিল না । কারণ, সবারই মুখের আর বুকের মাংস খুবলে নিয়েছে পাকিস্তানি শয়তানের বাচ্চারা । পার্শ্ববর্তী আরেকটি ব্রিজের নীচে দেখলাম কচুরিপনাগুলো কেমন যেন এলোমেলো । সন্দেহ হলে সেনাদের বললাম কচুরিপনাগুলো তুলে দেখতে । সেই একই দৃশ্যের অবতারণা হলো- বাঙালি নারীদের বীভৎস মৃতদেহ । কারোরই শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো আস্ত নেই । খুবলে খেয়েছে হানাদাররা । মেয়েদের লাশগুলো তুলে এনে সারা শহরে মাইকিং করলাম যে এরকম মেয়ে কারও আছে কি না বা ছিল কি না । কেউই সাড়া দিল মা, তাই রংপুর টাউন হলের পাশে ওদের একত্রে দাফন করি । এর কয়েকদিন পর আবার হাঁটতে হাঁটতে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার সময় একদিন দেখলাম কাঁচা মাটির তৈরি হালকা উঁচু ঢিবি । কেমন যেন সন্দেহ হলো আমার । সিপাহিদের বললাম, মাটির ওপর ঘা দিয়ে দেখতে । ওরা ঘা দিয়ে দেখল নরম নরম লাগে । মাটি খুঁড়তে বললাম ওদের । দেখতে পেলাম দুটি করে লাশ একেকটি গর্তে হাত-পা বাঁধা । এ রকম তিন-চারটি গর্ত খুঁড়লাম-একই অবস্থা । লাশগুলোর চেহারা দেখে বুঝলাম তারা উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন । আর না খুঁড়ে সেনাদের বললাম, পুনরায় মাটি চাপা দিয়ে রাখতে, অনর্থক মৃত ব্যক্তিদের কষ্ট দিলে পাপ হবে । তাছাড়া দিনাজপুর এলাকায় দেখেছিলাম বিহারিদের অকথ্য নৃশংসতা । ওরা ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ধরে নিয়ে পানির মধ্যে চুবিয়ে মারত । প্রথমে গলার ওপরে পা দিয়ে পানির মধ্যে চেপে ধরে রাখত । তখন বাচ্চাগুলোর আর ছোট ছোট শরীর নড়াচড়া করত না, ঠিক তখনই ছেড়ে দিত । অর্থাৎ মরে যাওয়ার পর ছেড়ে দিত পানির মধ্যে । এভাবে অসংখ্য শিশুকে মেরেছে বিহারিরা । এই বিহারিরাই আবার কোথাও নদীর ধারে নারীদের লম্বা লাইনে দাঁড় করিয়ে ইচ্ছেমতো বেঘোরে পেটাত । যখন মহিলারা অজ্ঞান হয়ে যেত বা মারা যেত তখন ধাক্কা মেরে নদীতে ফেলে দিত । এমনি করে নৃশংসভাবে অসংখ্য মহিলাকে খুন করেছে বিহারিরা । সহযোদ্ধা হারানোর বেদনা যুদ্ধ যখন চলে তখন সহযোদ্ধাদের সবার প্রাণ এক প্রাণে পরিণত হয় । তাই সে সময়ে হারানো কোনো বন্ধুর কথা মানুষ সহজে ভুলতে পারে না । আমিও পারিনি । বাঘবান্ধায় অবস্থানকালে আমার ডেফেন্সে দুজন আনসার ছিলেন-আপন দুই ভাই । যুদ্ধের মাঝখানেই বড় ভাই এক ডেলিভারি কেস থাকায় বাড়িতে যায় । বাড়ি থেকে ফেরার সময় সে খাওয়ার জন্য একটি মুরগি নিয়ে আসে । বহুদিন পর বাড়ির সবাইকে দেখতে পেয়ে সে তখন খুব উৎফুল্ল । মুরগিটি জবাই করার জন্য বাংকারের সামনে যায় ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে । ওদিকে পাকিস্তানিরা অদূরেই তাদের ক্যাম্প থেকে সব সময় আমাদের বাংকারে দৃষ্টি রাখত আমি বুঝতে পেরে ওদের দুই ভাইকে বকাঝকা করে বাংকারে ঢুকতে বললাম । ঠিক তখনই বোমা নিক্ষেপ করে পাকিস্তানি বাহিনী । প্রথম বোমাটি পড়ল ওদের ২৫গজ ডানে, দ্বিতীয়টি ২৫গজ বামে । এই অবস্থা দেখে ওরা ভয় পেয়ে বাংকারের মুখের দিকে দৌড় দিল । তৃতীয় বোমাটি পড়ল ঠিক বাংকারের মুখ বরাবর । ঘটনাস্থলেই দুই ভাই শহীদ হন সেদিন । আমি খুবই কষ্ট পেয়েছিলাম সেই সহোদরদের ম্ররতিত্যুতে । এরপর ভুরুঙ্গমারীতে হারিয়েছিলাম একজন সৈনিক । এক পাকিস্তানিকে সে নিজ হাতে মেরে খুশিমনে লাশ আনতে গিয়েছিল । কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেও লাশ হয়ে ফিরে এসেছিল । তবে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম চৌধুরীহাট অপারশনের সময় । সেই অপারেশনে আমাদের সঙ্গে এক লেফটেন্যান্ট ছিলেন । খুবই সুদর্শন, বিএ পাস একজন যুবক । বুদ্ধিমত্তা ও নৈপুণ্যের কারণে ভারত থেকে তাঁকে এই উপাধি দেওয়া হয়েছিল । তো রাতের বেলা আমরা পার্শ্ববর্তী পাকিস্তানি ঘাঁটিতে এ্যাটাক করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম । তিনি আমাকে দিলেন ডান দিক আর নিজে নিলেন বাম দিক । দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাম দিকে কয়েক গজ এগোতে না এগোতেই একটি বোমা এসে পড়ে তার ওপর, সঙ্গে সঙ্গে মারা যান তিনি । কতটা কষ্ট যে সেদিন মুখ বুজে সহ্য করতে হয়েছিল সেই রাতের আঁধারে, তা আর বলে বোঝানো যাবে না । তাঁর নাম ছিল আব্দুস সামাদ (আবু মঈন আশাফাকুস সামাদ, বীরউত্তম)। ভুরুঙ্গমারী বাজারের পাশেই তাঁকে দাফন করা হয়েছিল । আজও সেই অঞ্চলে সামাদনগর নামে একটি এলাকার পরিচিতি রয়েছে । লেফটেন্যান্ট সামাদ সাহেব আজও বেঁচে আছেন ওই এলাকার মানুষের মুখে মুখে । অপ্রীতিকর ঘটনা মনে পড়ছে, আমি আমার দল নিয়ে তখন অবস্থান করছি কুলাঘাটে অতি সতর্কতার সঙ্গে সবকিছু সাজিয়ে-গুছিয়ে নিচ্ছি । অন্যদিকে নিকটবর্তী পাকিস্তান টিম উপর্যুপরি গুলি ছুঁড়ে যাচ্ছে । দিনের বেলা ভারতীয় ফৌজ এল । জিজ্ঞাসা করল, হালচাল কী, ওদের অবস্থান এখান থেকে কত দূরে… ইত্যাদি । আমি তাদের অভয় দিয়ে বললাম, শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই । আমরা আমাদের মতো নিরাপদ দুরত্বে আছি এবং আরও গুছিয়ে নিচ্ছি । সকাল তখন ১০-১১টা হবে । মেশিনগান বসালাম একটি গাছের ওপর । ব্রাশ মারলাম পর পর কয়েকটা । দেখলাম সব নিশ্চুপ, সাড়াশব্দ নেই । সেদিন সারা দিন আমরা বাংকারে অবস্থান নিয়ে থাকলাম । রাত ৯টার দিকে ওরা প্রথমে ফায়ার ওপেন করল, এরপর শুরু করল বোম্বিং । এই অবস্থায় আমি সেনাদের প্রস্তুত হতে বলার জন্য বাংকারে যাই । গিয়ে দেখি বাংকারে কেউ নেই, সবাই হেডকোয়ার্টারে । দেখলাম, সবাই খোশগল্পে মেতে চা-নাশতা খাচ্ছে । রাগে-ক্ষোভে তখন আমার সারা শরীর এসেছ, নাকি পেট পুরতেই এসেছ? আমাকে একা বাংকারে ফেলে রেখে তোমরা কীভাবে আসতে পারলে? যুদ্ধের ময়দানে এত ভয় পেলে চলবে কী করে? আমি তো মরিনি, এখনো বেঁচে আছি । এক সিলেটি হাবিলদার ছিলেন আমার দলে । দেখি তিনি রিসিভার হাতে নিয়ে আরামে চা খাচ্ছেন। টেলিফোনের রিসিভারটা তাঁর কাছ থেকে নিয়ে বললাম, যত দিন এখানে আছেন ততদিন আপনি আর রিসিভার ধরবেন না, সেই যোগ্যতা আপনি আজ থেকে হারিয়ে ফেলেছেন । আমি তখন রিসিভারটা নিয়ে ভারতে কল করলাম । ধরলেন এক মেজর । তাঁর বাড়ি ছিল পাবনায়, এক হিন্দু অফিসার । সব বৃত্তান্ত শুনে তিনি বললেন, ঠিক আছে কমান্ডার সাহেব, আমি এখনই গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি । আপনারা সবাই হাতিয়ার রেখে গাড়িতে উঠে চলে আসেন । মেজর সাহেবের কথামতো গাড়ি এলে আমরা সবাই বেডিংসহ গাড়িতে উঠে ভারতে চলে গেলাম । গিয়ে এমন এক জায়গায় পৌছলাম, সেখানে একটি অফিস ও একটি ক্যান্টিন আছে, আর আছে একটি বিশালাকার গোডাউন । প্রথমে ভেবেছিলাম, খাবারের গোডাউন হবে । কিন্তু না, পুরোগুদাম ভর্তি হাতিয়ার । রাশিয়ান অস্ত্র । মেজর সাহেবের নির্দেশমতো সবাই যে যার ইচ্ছামতো হাতিয়ার নিয়ে আমরা চলে এলাম ভুরুঙ্গমারী ও বাঘবান্ধার মাঝামাঝি একটি জায়গায় । সেখানে ডিফেন্স নিয়ে আমরা পাকা রোডের ওপর দুটি এলএমজি বসালাম। বাংকার বানালাম গাছের আড়ালে । সেখানে খাট পাতা, খাটের ওপর মশারি ও হারিকেন । বাংকার থেকে ৫০গজ দূরে রোডব্লক দিলাম যাতে পাকিস্তানিরা গাড়ি নিয়ে এলে রাস্তা ক্রস করতে না পারে । পার্শ্ববর্তী ক্যাম্পের পাকিস্তানিদের দুটি আর্টিলারি ছিল । রাতে খুব আর্টিলারি মারল । ওদের অটোমেটিক ভালো ছিল- বোমাগুলো সব আশেপাশে পড়ত । আমি আমার সেনাদের বললাম, ফায়ার ওপেন করার দরকার নেই । ওরা যদি সামনাসামনি আসে তবেই আমরা যুদ্ধ করব । তবুও তোমরা সব সময় প্রস্তুত থাকবে । সেই রাতে পাকিস্তানিরা আমাদের একটানা খুব ফায়ার করল । আমরা চুপচাপ রাত কাটিয়ে দিলাম । সকালবেলা ভারতীয় ফৌজ নিয়ে মেজর সাহেব এলেন । পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান জানতে চাইলে বললাম ভুরুঙ্গমারী বাজারের পাশে আছে ওরা । মেজর ওদের দেখতে চাইলে তাঁকে নিয়ে একটি ঢালু জায়গা থেকে বাইনোকুলার দিয়ে দেখলাম পাকিস্তানিদের । সকালবেলা ওদের বা-নাশতা খাওয়াচ্ছেন এক বাঙালি মহিলা । দেখে-শুনে মেজর বললেন, যে করেই হোক ওদের খতম করতে হবে । এরপর তিনি আমাদের বাংকার দেখতে গেলেন । বাংকার দেখে খুব উৎফুল্ল হয়ে বললেন, আজ রাতেই শুরু হবে আখেরি অপারেশন । তোমরা ততক্ষণ নিশ্চিন্তে বসে থাকো । রাতের বেলা আমরা ১০-১২টা তিন মর্টার, ১০-১২টা চার ইঞ্চি মর্টার আর, আর মেশিনগান নিয়ে তৈরি হলাম এরপর সারা রাত ধরে চলল ফায়ারিং বোম্বিং । সকালে এলেন জেনারেল আরোরা । আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বললেন, শুনলাম ভুরুঙ্গামারী অঞ্চল ক্লিয়ার, তাই না? আমারও সে রকম মনে হয়েছিল তাই মাথা নাড়ালাম । রাস্তার ওপর দেওয়া বাঁধটি খুলে দিলাম জেনারেলের গাড়ি যাওয়ার জন্য । যেই উনি বাঁধটি ক্রস করেছেন, সঙ্গে সঙ্গে ফায়ারের ওপর ফায়ার । জিপের ওপর দিয়ে, আরোরা সাহেবের মাথার ওপর দিয়ে গুলি ছুটে চলল একের পর এক । ভাগ্য নিতান্তই ভালো যে গাড়ির চাকা এবং ওনার মাথায় কোনো গুলি লাগেনি । তড়িঘড়ি করে জিপ থেকে নেমে এসে জেনারেল বললেন, ইউ কে তোমার সন্দেহই বোধ হয় ঠিক । ওরা এখনো স্ট্রং আছে । এরপর আমরা পাকিস্তানিদের লক্ষ্য করে পর পর ৩০টি বোমা মারলাম । দেখি কোনো সাড়াশব্দ নেই আর । শেষে যখন ওখানে গেলাম, দেখি চারটি লাশ ছাড়া আর কিছু নেই । চারজনই ছিল সেখানে । আরেকটি অপারেশনের কথা মনে পড়ছে । ওই পাকিস্তানি দলটিরও দুটি আর্টিলারি ছিল । খুবই নিরাপদ স্থানে থেকে আমাদের ফায়ার করত একের পর এক । ভারতীয় ফৌজের মেজর এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন ওদের অবস্থান কোথায়? ওদের অবস্থান জানার পর বললেন, তিন মাইল দূর দিয়ে ঘুরে গিয়ে ওদের কাউন্টার-এ্যাটাক করতে হবে, সামনাসামনি নয় । তার কথা অনুযায়ী কয়েকজন সাহসী রাজপুত সেনা নিয়ে তিন মাইল ঘুরে ওদের বাংকারের কাছাকাছি গেলাম । রেললাইনের স্লিপারের নিচে গর্ত করে বাংকার বানিয়েছিল ওরা । সেই গর্ত থেকেই ফায়ার ও বোম্বিং করতো । আমাকে কিছু বুঝতে না দেয়েই রাজপুত সেনারা একেবারে বাংকারের মুখে গিয়ে বলল, হ্যান্ডসআপ । হাতিয়ার দেখে একে একে বেরিয়ে এল সাতজন । একজন কমান্ডার ছয়জন সিপাহি । ওই সাতজন আমরা গুলি করে মারিনি । মেরেছিলাম বিষাক্ত ইনজেকশন পুশ করে । একটি ইনজেকশনই যথেষ্ট । এভাবে সাতজনকে মেরে রাস্তার ওপর লাইন করে শুইয়ে দিয়েছিলাম আমরা । গ্রামবাসীর সহযোগিতা সম্ভবপর সব ধরনের সহযোগিতা করেছেন গ্রামবাসী । কেননা, যুদ্ধের সময় শত্রু ছাড়া বাকি সবাই একে অন্যের মিত্র । আমরা যেমন গ্রামবাসীদের নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছি । পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছি । গ্রামবাসী আমাদের জন্য তার চেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছে । চাল, ডাল, কাঁথা, কাপড়-সবকিছু দিয়েই পাশে থেকেছে তারা । ভাত না থাকলে ভাতের ফ্যান দিয়েছে, ঘরে চাল না থাকলে গ্রামের সবার থেকে চাল উঠিয়ে আমাদের দিয়েছে । এমনকি গরু, হাঁস, মুরগি, ছাগল এগুলোও দিয়েছে । তবে আমাদের দলটি যেহেতু ইপিআরের সৈনিকদের নিয়ে, ফলে আমরা খাবার-দাবারের ব্যাপারে তেমন চিন্তাভাবনা করতেম না । স্বপ্ন শুধু স্বাধীনতা তখন শুধু একটাই স্বপ্ন ছিল-দেশটা কেমন করে আজাদ হবে । স্বাধীন হবে । কেননা, এই দেশকে আমার নিজের দেশই মনে করতাম, করেই যাব আমৃত্যু । এখানেই আমার তিন পুরুষের নাড়ি পোঁতা । তাই দেশ আমাকে যা-ই মনে করুক, আমি নিজেকে এই দেশের বাইরের ভাবতে পারি না । ভালোবাসি এই মাতৃভূমিকে । আর এই ভালোবাসা থেকে আমি প্রাণ বাজি রেখে যুদ্ধ করেছি । আমার স্মরণে ১৯৭১-র ভয়াবহ যুদ্ধের উত্তাল সময়গুলোতে কখনোই ভাবতে পারিনি আগামীকাল আমি বেঁচে থাকব । প্রতিটি দিন জীবনের বোনাস টাইম মনে হতো । তাই যত বিপদেই পড়েছি ঘাবড়ে যাইনি, ভয় পাইনি । আমার সেক্টর কমান্ডার আবুল বাশার (বীরবিক্রম) সাহেব আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ইউ কে আপনি কি মনে করেন দেশটা স্বাধীন হবে! জবাবে বলেছিলাম, অস্ত্র যখন হাতে নিয়েছি স্যার যতক্ষণ আমার অস্ত্র ধরে রাখার শক্তি থাকবে আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাব । তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, সাহস আছে তো লড়ে যাওয়ার? বলেছিলাম, আমাকে সাহস দেওয়া-না দেওয়ার ব্যাপার আমার সৃষ্টিকর্তার । তবে স্যার এখনো আমি কিছুতে সাহস হারাইনি, ভয়ও পাইনি । এভাবেই আমি আমার দেশমাতার মুক্তির স্বপ্নকে সামনে রেখে এগিয়ে গিয়েছি সব ভয়ভীতি বাধাবিপত্তিকে পেছনে ফেলে । কেননা, মুক্তির প্রশ্নে ভীতি কখনো সাফল্য আনতে পারে না । স্বপ্নের মূল্যায়ন করতে হয় সাহস দিয়ে । বিজয়ী বাংলাদেশ ১৪ ডিসেম্বর থেকে আমি আমার গ্রুপ নিয়ে তিস্তা ব্রিজ এলাকায় অবস্থান করছিলাম । টানা দুই দিন হালকা-পাতলা গোলাগুলি হলো । এরপর ১৬ ডিসেম্বর সকালে হঠাৎ করে আমাদের জানানো হলো নয়টা পর্যন্ত সময়, আর ফায়ার করা যাবে না । দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, বিজয় ঘোষিত হয়েছে । ইতোমধ্যে আমরা সকাল নয়টার আগেই ছোট্ট একটি অপারেশন সারলাম । চারজন পাকিস্তানি একটি বাংকারের সামনে বসে চা খাচ্ছিল । সবকিছু পজিশন করে দিলাম ব্রাশ । চারজনের মধ্যে দুজন মারা গেল আর দুজন পালিয়ে গেল । এর কিছুক্ষণ পর নয়টা বাজলে আশপাশের পাকিস্তানিরা সাদা পতাকা টানিয়ে দেয় । ‘দেশ স্বাধীন হয়েছে’–এই কথাটুকু তাৎপর্য যে কত ব্যাপক ও বিস্তৃত তখনো আমি বুঝে উঠতে পারিনি । বুঝতে পারলাম যখন আমরা তিস্তা ব্রিজ পার হয়ে রেলস্টেশনে গেলাম । গিয়ে দেখি রেলের স্টাফরা আনন্দে কথা বলতে না পারার মতো সময়ের সন্ধিক্ষণেও গরু-খাসি জবাই করে আমাদের খাবার তৈরি করছে । চারদিকে তখন বিজয়ের সুগন্ধী বাতাস । পৃথিবীর দরিদ্রতম এই দেশটির মানুষের আনন্দের কত ধরনের প্রকাশ যে থাকতে পারে সেদিন দেখেছিলাম । স্টেশনের খাওয়া সমাপ্ত করে দুটি গরুর গাড়িতে আমাদের সব বেডিং আর অস্ত্র নিয়ে আমি রংপুরে রওনা হলাম, বাকিরা সবাই হেঁটে এল রাত নয়টার গিয়ে উঠলাম রংপুর কলেজে । সেই রাতেই গ্রামের লোকজন আমাদের অভ্যর্থনা জানায় এবং গরু জবাই করে খেতে দেয় । স্মরণীয় মুহূর্ত রাতেই জানতে পাই আত্মসমর্পনকারী পাকিস্তান সেনারা অনেকে কলেজ গেটে অবস্থান করছে । সকালে সেখানে গিয়ে তাদের মধ্যে অনেককেই চিনতে পারলাম । কেননা, যুদ্ধের আগে আমরা একসঙ্গে থেকেছি, খেলেছি, খেয়েছি । আমাকে দেখেই তাদের কয়েকজন হাসিমুখে এগিয়ে এল । অনেক দিন পরে ঘনিষ্ঠ কোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে যেমন হয় । তেমনিভাবে বলে উঠল, শালা ইউ কে, তুমি এখনো মরোনি দেখছি । জবাবে আমি বললাম, শালা আমি এখনো বেঁচে আছি বলেই তোমাদের জীবিত দেখছি । এভাবে কিছুক্ষণ বাকযুদ্ধ করে হাত মেলায় । ওরা বলল, ভাই তোমাদের দেশ তোমাদেরই থাক । সবকিছু ভুলে যাও, যা হয়েছে হয়তো বা ভালোই হয়েছে । তোমরা তো যা-ই হোক খেতে পেরেছ। আর আমরা না খেয়ে মরেছি । যা-ই হোক, এসব শেষ হয়েছে ভালো হয়েছে । তোমাদের শুভ হোক । আমিও ওদের কল্যাণ কামনা করে পরস্পর বিদায় নিলাম । স্বপ্ন দেখি স্বাধীনতার পর ভেবেছিলাম, দেশটাকে আমরা নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নেব । একসঙ্গে গড়ে তুলব আমাদের ভবিষ্যৎ । আমাদের অনাবিল সুখ । কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি।।….আমি মনে করি আমি যে আজও বেঁচে আছি এটা আমার বোনাস লাইফ । শুধু আমি নই, যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরে আসা সব যোদ্ধারই বোধ হয় একই ভাবনা আমার মতো । স্বপ্ন জন্ম দেয় সম্ভাবনা, আর সম্ভাবনা রূপ পায় বাস্তবে । আমাদের স্বপ্ন ছিল স্বাধীনতা । সেই স্বাধীনতা শুধু একটি শব্দ নয়, সব ধরনের বৈষম্য থেকে মুক্তি । নিপীড়ন, অত্যাচার, লুণ্ঠন, সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্তি । আমরা চেয়েছি, এমন একটি দেশ, তার সব নাগরিককে মর্যাদা দেবে, দারিদ্র থেকে মুক্তি দেবে, সুশাসন কায়েম করবে, আইনকানুন প্রণয়ন করবে, যার পরিণত রূপ হবে সুখী সমৃদ্ধ একটি বাংলাদেশ । সেই ভাবনার সঙ্গে বাস্তবতার অনেক অমিল । তারপরও স্বপ্ন দেখি একদিন আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে উঠবে । ইউ কে চিং বীর বিক্রম জন্মঃ ৫ মে, ১৯৩২, বান্দরবান । তিনি ১৯৫২ সালে তদানীস্তন ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) এ যোগদান করেন এবং নায়েব সুবাদার পদে ১৯৮২ সালে অবসর গ্রহণ করেন । একাত্তরে রংপুরে অবস্থিত ১০ উইং ইপিআর এর অধীন হাতিবান্ধা বিওপিতেও কর্মরত ছিলেন । ৬ নম্বর সেক্টরের সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টরের নাগেশ্বরী সীমান্তবর্তী চৌধুরীহাটে শত্রু অবস্থান দখলে বীরত্বের সাথে লড়াই করেন । যুদ্ধের সীমানা তার বিস্তৃত-নাগেশ্বরী, রৌমারী, হাতিবান্ধা, পাখিউড়া, ভুরুঙ্গামারী ইত্যাদি । মুক্তিযুদ্ধের অসামান্য সাহসী ভূমিকার জন্য তাকে সরকার ‘বীর বিক্রম’ বীরত্ব উপাধি প্রদান করেন । ইউ কে চিং একমাত্র উপজাতি খেতাবপ্রাপ্ত বীর ।

Ref: স্বাধীনতা মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!