You dont have javascript enabled! Please enable it!

তেঁতুলিয়া সাব সেক্টরের যুদ্ধ
মাসুদুর রহমান, বীর প্রতীক

মূর্তি ক্যাম্পের ট্রেনিং মূর্তি ক্যাম্পের ট্রেনিং প্রথম বাঙ্গালদেশ ওয়ার কোর্স ২৭জুন, ১৯৭১, জলপাইগুড়ির মূর্তি চা বাগানে ট্রেনিং শুরু করে । তৎকালীন ১১টি সেক্টর থেকে মোট ৬১ জন ক্যাডেট এই কোর্সে যোগদানে সমর্থ হন । আমাদের মূলত যুদ্ধের কৌশল, গেরিলাযুদ্ধ, এক্সপ্লোসিভ ও অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় । একটানা প্রশিক্ষণ ৯ অক্টোবর পর্যন্ত চলতে থাকে । আমাদের পাসিং আউট প্যারেডে তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ও যুদ্ধকালীন কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী উপস্থিত ছিলেন । সেকেন্ড লেফটেনযান্ট হিসেবে আমরা কমিশন্ড প্রাপ্ত হই এবং আমাকে ৬ নম্বর সেক্টরে যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হয় । আমি ভজনপুরের ডিফেন্সে যোগ দিই । ভজনপুর ছিল তেঁতুলিয়া থানার সাব সেক্টর । ৬ নম্বর সেক্টর ৬ নম্বর সেক্টর গঠিত হয়েছিল বৃহত্তর রংপুর জেলা ও বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমা নিয়ে । উইং কমান্ডার বাশার (মোহাম্মদ খাদেমুল বাশার, বীর উত্তম) ছিলেন ৬নম্বর সেক্টরের কমান্ডার । এই সেক্টরকে পাঁচটি সাব সেক্টরে বিভক্ত করে পাঁচজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয় । যথাক্রমে-সাহেবগঞ্জে কমান্ডার ক্যাপ্টেন নওয়াজেস আহমেদ, মোগলহাটের কমান্ডার ক্যাপ্টেন দেলওয়ার হোসেন, পাটগ্রামের কমান্দার ক্যাপ্টেন মতিউওর রহমান, চিলাহাট্টির কমান্ডার ফ্লাইট লে. ইকবাল রশিদ এবং তেঁতুলিয়া কমান্ডার স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দিন হোসেন । ৬নম্বর সেক্টরের কমান্ডার খাদেমুল বাশার আমাদের কমিশনিং প্যারেডে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন । আমি, সেকেন্ড লে. মতিন চৌধুরী, সে. লে. আশফাক সামাদ ও সে.লে. আবদুল্লা ৬ নম্বর সেক্টরে নিয়োগ পেলাম । আমাদের সেক্টর কমান্ডার খাদেমুল বাশার আমাদের চারজনকে অভিনন্দন জানালেন । তিনি আমাদের পেয়ে ভীষণ আনন্দিত হন । তাঁরই গাড়িতে করে আমরা চারজন উদ্দীপ্ত তরুণ পাটগ্রামের

৭৬

বুড়িমারিতে উপস্থিত হই । সেখানে করা হয়েছিল ৬ নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার । সব সাব-সেক্টর কমান্ডার এবং সেক্টর মেডিক্যাল অফিসার ক্যাপ্টেন মোসাহেব হোসেনসহ একটি কনফারেন্স ডাকা হলো । সবার সঙ্গে আমাদের চারজন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় । এরপর আমাকে ও মতিনকে তেঁতুলিয়া সাব সেক্টরে পোস্টিং দেওয়া হলো ।কনফারেন্স শেষে সাব সেক্টর কমান্ডার সদরুদ্দিনের সঙ্গে তেঁতুলিয়ার ভজনপুরে পৌঁছালাম ।আমরা ভজনপুর রাতে থাকলাম । সে রাতে আমাদের সাব-সেক্টর কমান্ডার আমাদের এলাকায় যুদ্ধ-পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্ভাব্য বিবরণ বুঝিয়ে দিলেন । পরদিন তিনি আমাদের দুইজনকে সোজা রণক্ষেত্রে নিয়ে উপস্থিত হলেন । পরিচয় করে দেওয়া হলো ক্যাপ্টেন শাহরিয়ারে সঙ্গে । তিনি পদাতিক বাহিনীর অফিসার । যিনি কিছুদিন আগে পাকিস্তানের যুদ্ধবন্দি ক্যাম্প থেকে পালিয়ে এসেছেন , পাকিস্তানিদের ওই এলাকার সবচেয়ে দুর্ভেদ্য পোস্ট ছিল অমরখানা । তিনি ব্যাটালিয়ন কমান্ডার হিসেবে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ওই এলাকার প্রতিরক্ষার দায়িত্বে ছিলেন । এ এলাকা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২৩ পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার ছিল । যার হেডকোয়ার্টার ছিল সৈয়দপুরে । আমরখানা ছিল পাকিস্তানিদের শক্তিশালী ঘাঁটি । যার বাংকারগুলো ছিল কংক্রিটের । এই শক্ত ঘাঁটি প্রস্তুতের কারণ ছিল যাতে তেঁতুলিয়া দিয়ে আমাদের সেনারা ঠাকুরগাঁও হয়ে সৈয়দপুরের দিকে যেতে না পারে । তাই অমরখানা ছিল পাকিস্তানিদের সর্ব উত্তরের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি । এই ঘাঁটিতে ১ কোম্পানি ৪৮ পাঞ্জাবের সেনা, ১ কোম্পানি ৯ উইংয়ের ইপকাফ, রাজাকার ও মোজাহিদ ছিল । এখানে তারা নিয়মিত আর্টিলারি সাপোর্ট পেত । পাকিস্তানিদের এই ঘাঁটি চাউই নদীর পূর্ব তীরে ছিল । অন্যদিকে, মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি ছিল নদীর পশ্চিম পাড়ে । আমাদের যে ব্যাটালিয়নের পোস্টিং দেওয়া হয়, সেই ব্যাটালিয়নের অধিকাংশ ছিল ৯ উইংয়ের ইপিআর ও কিছু ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনা, পুলিশ ও আনসার । ২৫ মার্চ ৯ উইং ইপিআর ঠাকুরগাঁওয়ে পোস্টিং ছিল । কিন্তু যখন তারা জানল যে পিলখানায় ইপিআরের বাঙালি সেনাদের নিরস্ত্র অবস্থায় পাকিস্তানিরা গুলি করে হত্যা করেছে, তখন তারা সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিনের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে এবং পরে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয় । অমরখানার প্রতিরিক্ষা ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার আমাদের দুইজনকে সেখানকার যুদ্ধ-পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্রিফ করেন । এখানকার প্রতিরক্ষা সাজানো হয়েছে বৃহত্তরভাবে, বাঁ থেকে ডানে বিস্তৃত । এ কোম্পানি এবং বি কোম্পানি বাঁ প্রান্তে । সি কোম্পানি এবং ডি কোম্পানি দান প্রান্তে । আমাকে বাঁ প্রান্তের দায়িত্ব দেওয়া হলো । অন্যদিকে, মতিনকে দেওয়া হলো ডান

৭৭

প্রান্তে । আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে এখানে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনী পরস্পরকে আক্রমণ করে এবং উভয়পক্ষই একে অন্যকে বিতাড়নের চেষ্টা করে । কিন্তু কোনো পক্ষই সাফল্য লাভ করতে পারেনি তবে উভয়পক্ষেরই প্রচুর হতাহত হয়েছে । আমরা যুদ্ধে যোগ দেওয়ার কিছুদিন আগে থেকে এখন পর্যন্ত তুলনামূলক আক্রমণ কম, মাঝেমধ্যে মর্টার কিংবা ফায়ারিং । আমাদের যোগদানের কয়েকদিনের মধ্যেই মিত্র বাহিনীর কিছু ঊর্ধ্বতন অফিসার এ এলাকা পরিদর্শনে এলেন এবইং সাব সেক্টর কমান্ডার ও ব্যাটালিয়ন কমান্ডারের কাছে যুদ্ধ-পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজখবর নিলেন । এরই মধ্যে আমাদের কমান্ডার ইন-চার্জ জেনারেল ওসমানী ৬নম্বর সেক্টর কমান্ডার খাদেমুল বাশারকে নিয়ে উপস্থিত হলেন । জেনারেল ওসমানী ৬নম্বর সেক্টর কমান্ডার খাদেমুল বাশারকে নিয়ে উপস্থিত হলেন । জেনারেল ওসমানী ওই দিন আমাদের সেনাদের মধ্যে বক্তব্য দিলেন এবং আমাদের অনুপ্রাণিত করলেন । অমরাখানা পাকিস্তানি ঘাঁটি দখল আমরা অনুধাবন করতে পারলাম অচিরেই খুব বড় কিছু সংঘটিত হতে যাচ্ছে । এরই মধ্যে ক্রমান্বয়ে মিত্র বাহিনীর ট্যাংক, আর্টিলারি ও ইঞ্জিনিয়ারিং রেজিমেন্টে আসা শুরু করেছে এবং ট্যাংক চলাচলের উপযোগী ব্যবস্থা সংস্কার শুরু করে দিয়েছে । এরই মধ্যে আমাদের কমান্ডার নির্দেশ দিয়েছেন শত্রুর বাংকার, মেশিনগান পোস্ট ও অন্যান্য প্রতিরক্ষা কোথায় আছে তা শনাক্ত করার জন্য । আমরা কাজে নেমে পড়লাম এবং শিগগিরই শত্রুর অনেক দুর্বল অবস্থান চিহ্নিত করা সম্ভব হলো । ওই সময়ে একদিন আমাদের কমান্ডার লুঙ্গি পরে এবং মাথায় সাধারণ কৃষকের মতো গামছা পেঁচিয়ে লম্বা একটি গাছের মাথায় উঠে বাইনোকুলার দিয়ে শত্রুর ঘাটির বিভিন্ন প্রতিরোধ অবস্থান দেখে একটি ম্যাপ করে ফেললেন । এর মধ্যে আমাদের ব্রিফ করা হলো প্রস্তুত হওয়ার জন্য । চূড়ান্ত আঘাত করার সময় আসন্ন । আমরা ম্যাপ এক্সাইজ, কৌশলগত এক্সাইজ, বালুর মডেল ইত্যাদি সম্পন্ন করলাম কোনো সেনা লরাই । এটা করার কারণ ছিল আমাদের ক্ষয়ক্ষতি যাতে সর্বনিম্ন পর্যায়ে থাকে । আধুনিক যুদ্ধের জন্য যার প্রয়োজন খুবই বেশি, তা হলো আর্টিলারি ফায়ার সাপোর্ট । এই একটি জায়গায় আমরা অত্যন্ত দুর্বল, যা আমাদের ছিল না । এ অবস্থায় মিত্র বাহিনীর কাছে আমরা অনুরোধ রাখলাম আর্টিলারি সাপোর্ট দেওয়ার জন্য । মিত্র বাহিনী আর্টিলারি সাপোর্ট দিতে রাজি হলো । এটা শুনে আমাদের মনোবল দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হলো । তখন রমজান মাস । যুদ্ধের সব প্রস্তুতি আমরা চূড়ান্ত করেছি । ২০নভেম্বর, ঈদুল ফিতর উদযাপিত হলো । ওই দিনই সন্ধ্যায় দীর্ঘ অপেক্ষার পর আমাদের আক্রমণে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে বলা হলো । আমাদের সন ব্যাটালিয়নের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল । মধ্যরাতে আমরা আমাদের ঘাঁটি পরিত্যাগ করে সম্মুখে শত্রুর ঘাঁটির দিকে রওনা হলাম । যখন আমাদের সব সেনা ও কমান্ডার যার যার

৭৮

ইউনিটের সঙ্গে আক্রমণাত্মক পজিশনে প্রস্তুত হলো, সঙ্গে সঙ্গে মিত্র বাহিনীর আর্টিলারি ফায়ার যেন শত্রুর অবস্থানকে নরকে পরিণত করল । অমরখানা ঘাঁটি আর্টিলারি সেলের আঘাতে মনে হলো যেন মুহুর্মুহু বজ্রপাত হচ্ছে । আর্টিলারি ফায়ার বন্ধ হওয়ার পরপরই আমরা ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করে শত্রুর অবস্থান লক্ষ্য করে প্রচণ্ড আক্রমণ চালাই । পাকিস্তানি বাহিনী প্রতিরোধের চেষ্টা করেও ভীত-সস্ত্রস্ত হয়ে অমরখানা ঘাঁটি পরিত্যাগ করে জগদলের দিকে পালিয়ে গেল । এই ঘাঁটি দখল করতে গিয়ে আমাদের পক্ষের অনেক হতাহত হয় । ভোরের প্রথম আলোয় অমরখানা দীর্ঘ অপেক্ষার পর দখল হলো । আমাদের ভজনপুর সাব সেক্টরের মিলিতারি ফোর্স ও চৌলহাটি বিওপির মুক্তিযোদ্ধাদের দীর্ঘদিনের লক্ষ্য ছিল এই ঘাঁটি দখল করা । অবশেষে অমরখানা আমাদের দখলে এল । অমরখানা এই শক্ত ঘাঁটি পাকিস্তানিদের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর মূলত খানসামা ব্যতীত কোথাও পাকিস্তানি সেনারা তেমন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি । জগদলহাটের যুদ্ধ অমরখানা ঘাঁটি থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর পাকিস্তানি সেনারা জগদল হাটে গিয়ে দ্রুত প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে । ইতোমধ্যে পঞ্চগড় থেকে আরও সেনা এনে জগদল হাটে জড়ো করে । তারা আর্টিলারি ফায়ারের সহযোগিতায়ও নেয় । কিন্তু মুক্তিবাহিনী আর্টিলারি ফায়ার ও অন্যান্য ক্ষুদ্রাস্ত্রের আক্রমণ উপেক্ষা করে ক্রমাগত জগদলের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে । ২৩নভেম্বর আমরা সন্ধ্যা নাগাদ জগদল হাটের উপকন্ঠে উপস্থিত হই এবং প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থা গড়ে তুলি । অমরখানা যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা বেশি হওয়ায় এটা ঠিক করা হয় চৌলহাটি মুক্তিবাহিনী ক্যাম্প থেকে লোকবল নিয়ে আসা । চৌলহাটি ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মাহবুব আলম । গেরিলা কমান্ডার হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতা, দৃঢ় মনোবল ও সাহসিকতার সঙ্গে সে শত্রু এলাকার ভেতরে থেকে কাজ করেছে । তার গেরিলা গ্রুপের তৎপরতায় এ অঞ্চলের রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধীরা তেমন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি । মাহবুবদের গেরিলা গ্রুপ একবার অমরখানা ঘাঁটিতেও আক্রমণ চালিয়েছিল, যাতে পাকিস্তানি সেনারা নির্ভীকভাবে চলাফেরা করতে ভয় পায়, ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে । ওই রাতেই মাহবুবদের গেরিলা গ্রুপ আমাদের সঙ্গে যোগ দেয় । পাকিস্তানিরা জগদলহাটে আমাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে মুহুর্মুহু আর্টিলারি ফায়ার, মর্টার ও মেশিনগানের অবিরত গুলি করতে থাকে । আমাদের বাঁ দিকের অবস্থান ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায়, প্রচুর হতাহত হয় । এমন অবস্থায় মাহবুব তার গেরিলা দল নিয়ে আমার কমান্ডে রিপোর্ট করে । যথাসম্ভব আমি তাকে দ্রুত ব্রিফ করে ডিফেন্স

৭৯

লাইনে চলে যেতে বলি । আমাদের ডিফেন্স লাইনে দ্রুত খোলা ট্রেঞ্চ, মাথার উপর দিয়ে যাওয়া হাজার হাজার গুলি, মুহুর্মুহু মর্টার শেল বিস্ফোরণ আর গগন বিদারী আর্টিলারি শব্দে ফ্রন্ট লাইন প্রকম্পিত । এতদসত্ত্বেও আমরা এক পাও না পিছিয়ে প্রতিয়াক্রমণ চালিয়ে গেলাম । যুদ্ধের এই ভয়াবহতার মধ্যেও মাহবুব তার দলের ছেলেদের, যারা সম্মুখযুদ্ধে অভ্যস্ত তাদের মনোবলকে চাঙা রাখার জন্য বাংকার থেকে বাংকারে গিয়ে সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে । এভাবে সারা রাত উভয়পক্ষের প্রচণ্ড গোলাগুলির পর ফজরের দিকে পাকিস্তানিদের তরফ থেকে আক্রমণ শিথিল হয়ে আসে । একপর্যায়ে গোলাগুলি বন্ধ হয়ে যায় । সকালের আলো ফুটে ওঠার পর শত্রুপক্ষের আর কোনো তৎপরতা দেখা গেল না । আমরা রেকি টিম পাঠালাম শত্রুর অবস্থান পর্যবেক্ষণের জন্য । কিছুক্ষণ পরেই যুদ্ধের হুংকার শোনা গেল- ‘জয় বাংলা’। খবর এল পাকিস্তানি সেনারা জগদল অভিমুখে রওনা হলাম এবং জগদল দখল করলাম । জগদলের এই যুদ্ধে আমাদের অনেক হতাহত হয়েছে এবং অসীম সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে শাহাদাতবরণ করেছে হাবিলদার সাকিম উদ্দিন । তাঁর বীরত্বের জন্য সরকার পরে তাকে ‘বীর বিক্রম’ উপাধি দেয় । জানাজার পর জগদলেই এই বীর বিক্রমকে সমাহিত করা হয় । জগদল থেকে পালিয়ে পাকিস্তানি সেনারা তাদের পরবর্তী শক্ত ঘাঁটি পঞ্চগড়ে আশ্রয় নেয় । ন্যায় অধিকার আদায়েরজন্য যুদ্ধ করি ১৯৭১ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর দেশের অন্যান্য স্থানের মতো চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরও উৎফুল্ল হয়ে ওঠে । শিক্ষক, ছাত্র, প্রশাসনিক কর্মচারী ও সাধারণ জনতা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে শুরু করল। (তৎকালীন পরিস্থিতি আশা-ভরসায় পরিপূর্ণ ছিল, যা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ভাষণে, যেখানে জাতীয় পরিষদের ঢাকার অধিবেশন স্থগিত করায়।) তখন আমি চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশোনা করছিলাম ।থাকতাম আলাওল হলে । মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম । দেশের অন্য সবার মতো আমিও হতাশ হয়ে পড়ি । একজন বিবেকবান বাঙালি হয়ে আমিও দুই পাকিস্তানের বৈষম্যের সাক্ষী ছিলাম । আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন, তখন জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর হওয়ার কথা ছিল এবং আমরা ন্যায্য অধিকারের জন্য সমর্থন করি । এরই মধ্যে পাকিস্তানিরা গোপন সভায় মিলিত হয় তৎকালীন অশান্ত পরিবেশ শান্ত করার জন্য । এছাড়া তারা কালক্ষেপণ করছিল, তাদের সেনা-শক্তি বাড়াতে, যাতে তারা পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনতার ন্যায্য অধিকারের দাবি দমন করতে পারে । তারা গভর্নর এস. এম এহসানকে পরিবর্তন

৮০

করে বেলুচিস্তানের কসাই হিসাবে পরিচিত জেলারেল টিক্কা খানকে ক্ষমতায় আনলেন সাধারন মানুষের ওপর বর্বর হামলা চালানোর জন্য। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে আমি চট্রগ্রামের চকবাজারে আমার ভাইয়ের বাসায় ছিলাম। মধ্যরাতের দিকে ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে আসা গুলির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আমাদের। সকালে আমরা গোলাগুলির কারন জানার চেষ্টা করি। জানা গেল,ক্যান্টনমেন্ট এলাকার পাকিস্তানি সেনারা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে হামলা চালায় এবং পূর্ব পাকিস্তানকে আয়ত্তে রাখার জন্য বাঙালি অফিসার ও সেনাদের হত্যা করে। ষোলশহর দিয়ে যাওয়ার সময় আমরা লক্ষ করলাম, ক্যান্টনমান্ট এলাকা রেলওয়ে ওয়াগন দিয়ে ঘেরা হয়েছে, যাতে পাকিস্তানি সেনারা সহজে ঢুকতে না পারে। আমরা কিছু বাঙালি সেনা এবং ইপিআর দেখলাম, যারা ক্যান্টনমেন্ট দিয়ে যাচ্ছিল। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম,বাঙ্গালি সেনারা ৮ নম্বর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অবস্থান করছে। বাঙালি জনতার হত্যার খবর শুনে তারা বিদ্রোহ করে। আমরা তাদের অভিনন্দন জানাই এবং তাদের সাহায্য করতে চাইলাম। ১৯৬৪ সালে যখন চট্রগ্রাম কলেজে পড়ি তখন ইউনিভার্সিটি অফিসার্স ট্রেনিং ক্রপস (ইউওটিসি)- এর মেম্বার ছিলাম। সেখানে আমরা পিটি,ড্রিল, মাইনর ট্যাকটিস এবং ক্যাথারিংয়ের জন্য ট্রেনং নিতাম। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে সিদ্ধাত নিলাম যে মাতৃভূমির সংকটপূর্ন পরিস্থিতিতে প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ্যতা প্রমান করব। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ আমাদের সুযোগ বাস্তবে পরিনত হলো, যখন আমরা চট্রগ্রাম রেডিওতে মেজর জিয়ার বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহের ঘোষনা এবং পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার ঘোষনা শুনলাম। পরবর্তী সময়ে রেডিওতে আরেকটি ঘোষনায় ভলান্টিয়ারদের পাকিস্তানিদের বিরিদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহন করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ আমি কালুরঘাটের ৮ ইস্ট বেঙ্গলে যোগ দিই। তখন এখানকার ব্যাটালিয়ন রেল-কান-র ওড ব্রিজ পাহারা দিচ্ছিল। আমি বি কোম্পানির ক্যাপ্টেন চৌধুরী খালেকজ্জামানের অধীনে ছিলান এবং ১০ রাউন্ডে অ্যামুনিশনসহ ইউওসিটি এর একটি ক্যাডেট রাইফেল আমার জন্য ইস্যু করা হয়। এ সময় আমরা পাকিস্তানি ব্যাটালিয়নশিপের নজরদারিতে ছিলাম। ১১এপ্রিল পাকিস্তানিরা আমাদের ওপর আক্রমণ এবং শহরের শেষ প্রান্তের ব্রিজ দখল করে নেয়। এই হামলায় ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরী আহত হন কিন্তু আমরা তাঁকে উদ্ধার করে ব্রিজের পাটাতনে নিয়ে আসি। এছাড়া লেফটেন্যান্ট শমশের মুবিন চৌধুরী ও আহত হন কিন্তু তাঁকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তিনি পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়েছিলেন এবং তারা তাঁকে ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে যায়। ক্যাপ্টেন হারুন তখন সৌভাগবান ছিলেন যে যথাযথ চিকিৎসা সেবা তাকে সুস্থ করে তোলে। শহরের শেষ প্রান্তের ব্রিজ দখল থাকায় পাকিস্তানিরা সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল এবং তারা

৮১

আর্টিলারি এবং মর্টার ফাটার শুরু করল আমাদের জনতার ওপর। উপযুক্ত প্রতিরোধ- ব্যবস্থার অভাবে আমাদের অনেক সেনা আহত এবং নিহত হলো। তখন ওই অবস্থান পরিবর্তন করে আমরা রাঙ্গামাটি গেলাম। এটা উল্লেখ্য করা ভালো, তখন আমি কালুরঘাট ৮ বেঙ্গলের সেনাবাহিনীতে যোগ দিই, যা মেজর মীর শওকত আলীর কমান্ডে ছিল। মেজর জিয়া তখন রামগড়ে ইন্ডিয়ার সঙ্গে অস্ত্র ও গোলাবারুদের জন্য চুক্তি করছিলেন। ১৯৭১ সালের ১২/১৩ এপ্রিল আমরা কালুরঘাট ত্যাগ করি। আমরা বান্দরবান, চন্দ্রঘোনা কাপ্তাই পাড়ি দিয়ে রাঙ্গামাটি পৌঁছলাম। সেনাবাহিনীর আহত সেনাদের বিশ্রাম এবং সুস্থ হওয়ার জন্য সময় দেওয়া হলো এবং এটা যুদ্ধের সময় ছিল বলে মহালছড়িতে প্রতিরক্ষা বাবস্থা গড়ে তোলা হলো।এখানেই প্রধান প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল এবং আশপাশের এলাকায় নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়েছিল, যাতে করে শত্রুর আনাগোনা আগে থেকেই জানা যায়।একটা ফাঁড়ি বুড়িঘাটে ছিল। ১৯ এপ্রিল পাকিস্তানিরা এই ফাঁড়িতে হামলা চালায় এবং সাথীদের বাঁচাতে গিয়ে ল্যান্স নায়েক মুন্সি আবদুর রউফ শহীদ হন।পরে তাঁকে সর্বোচ্চ মর্যাদা বীর শ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি সেনারা কিছু সময় ধরে একের পর এক হামলা চালাতে লাগল। শত্রুরা আমাদের অবস্থান পরিবর্তনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে কিন্তু আমাদের প্রতিরোধ- ব্যবস্থা যথেষ্ট থাকার জন্য তারা কোনো হামলা চালাতে পারেনি। শেষে তারা গোপনে মিজো উপজাতির সাহায্য নেয় ভারতের ভিতর সন্ত্রাসী হামলা চালানোর জন্য। ২৮ এপ্রিল পাকিস্তানি এবং মিজো উপজাতি আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা মহালছড়িতে হামলা চালায়। তারা শক্তিশালী অস্ত্রে সজ্জিত ছিল এবং জঙ্গল যুদ্ধে পারদর্শী মিজো উপজাতি, যাদের প্রচন্ড আক্রমন আমরা মোকাবিলা করতে পারিনি। সেনাদের যুদ্ধের নির্দেশ দেওয়ার সময় ক্যাপ্টেন আফতাব কাদের গুলিবিদ্ধ হন এবং ঘটনাস্থলেই মারা যান। এই ঘটনা আমাদের সেনাদের হতোদ্যম করে। শেষে আমরা ১৯৭১ সালে ২৯ এপ্রিল আমাদের অবস্থান পরিত্যাগ করে রামগড়ে যাই। ক্যাপ্টেন কাদেরকে রামগড় আনা হয় এবং মসজিদের পাশে কবর দেওয়া হয়। করেরহাট অথবা গুইমারার শত্রুদের থামানোর জন্য রামগড়ে নতুন প্রতিরোধ-ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। মেজর জিয়া যে রামগড় পোস্ট অফিসকে হেডকোয়ার্টার বানিয়েছিলেন, তিনি ব্যাটালিয়ন কমান্ডের দায়িত্ব নিলেন। ফেনী নদীর তীরে এবং পূর্ব পাকিস্তান এবং ভারতের বর্ডারের পাশে রামগড় অবস্থিত। এই বর্ডারের পাশে ইন্ডিয়ার সাবডিভিশনাল হেড কোয়া র্টার সার্বভৌম ছিল। আমরা যখন রামগড়ের প্রতিরক্ষা গড়ায় ব্যস্ত ছিলাম তখন ইন্ডিয়া থেকে পূর্ব পাকিস্তানে আসার জন্য নদীর উপর বাঁশের ব্রিজ তৈরি করা হয়। মে মাসের ২ তারিখে আমরা শত্রুদের যে আক্রমন আশা করছিলাম, সেই শত্রুদের অনুপ্রবেশ ১/২ তারিখেই হয়েছিল। রামগড়ের মূল ঘাঁটি শত্রুরা ফেলে

৮২

যাওয়ার এবং যথাযথ প্রতিরোধ ব্যবস্থা না থাকায় তারা আমাদের ওপর আক্রমন চালায়, যাটা আমাদের জন্য ছিল খুবই ক্ষতিকর। পরবর্তী সময়ে আমরা যখন আক্রমনে বাধা দিই এবং কিছু কাউন্টার এয়াটাক চালাই তখন শত্রুদের কার্যক্রম ধীর হয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের কাছে আধুনিক অস্ত্র,গোলাবারুদ, মর্টার এবং ভারী মেশিনগান থাকার কারনে তারা বেশি সুবিধা পাচ্ছিল। যখন অন্ধকার হতে শুরু করল তখন আমরা আমাদের অবস্থান বদলানোর সিদ্ধান্ত নিলাম এবং বর্ডার ক্রস করলাম। দুঃখভরা হ্নদয়ে আমরা আমাদের মাতৃভূমিকে বিদায় জানালাম এবং বিজয়ী হয়ে ফিরে আসার প্রতিজ্ঞা করলাম। আমরা হরিণাতে আমাদের ক্যাম্প করলাম, যা পাহাড়ি রাস্তা থেকে কিছুটা দূরে ছিল। সেখানে জরুরি ভিত্তিতে আমাদের প্রশিক্ষন পুরোদমে এফ এফ এবং স্বল্প সময়ের এফ এফ এবং স্বল্প সময়ের এফ এফ ট্রেনিং শুরু করলাম। এরই মধ্যে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার ক্যাডেটদের আর্মি অফিসার করার সিদ্ধান্ত নিলো। আমি আবেদন করলাম এবং ট্রেনিংয়ের জন্য নির্বাচিত হলাম। ১৯৭১ সালের ২৭ জুন, বাংলাদেশ যুদ্ধ প্রশিক্ষন জলপাইগুড়ি জেলার মূতি টি গার্ডেনে শুরু হয়। বাংলাদেশের ১১টি সেক্টরের জন্য আমরা ৬১ জন ক্যাডেট নির্বাচিত হয়েছিলাম। আমাদের ট্রেনিংয়ে মাইনর ট্যাক্টিস, গেরিলা ওয়ার ফেয়ার, এক্সপ্লোসিভ এবং আর্মস হ্যান্ডেলিং অন্তভূর্ন্ত ছিল। আমাদের ট্রেনিং ৯ অক্টোবর পর্যন্ত ছিল। অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী সোইয়দ নজরুল ইসলামের পর্যালোচনায় প্যারেড অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমি বাংলাদেশ ফোর্সের সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে নিযুক্ত হই। সেই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ এবং চিফ কমান্ডার আতাউর গনি ওসমানী ও উপস্থিত ছিলেন। আমি ৬ নম্বর সেক্টরে পোস্টেড হই এবং তেঁতুলিয়া থানার সাব সেক্টর ভজনপুরের প্রতিরক্ষা কাজে যোগ দিই। মেজর জেনারেল মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান, বীর প্রতীক জন্ম ৩১ মে ১৯৪৭,ভোলা। শিক্ষা এসএসসি(১৯৬৩), কাজেম আলী হাই স্কুল, এইচএসসি (১৯৬৫), চিটাগাং কলেজ এবং চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রহেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স (১৯৭০)। ন্যাশনাল সিকিউরিটি এয়ান্ড স্ট্রাটেজি বিষয়ে আমেরিকার ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভাসির্টি (ওয়াশিংটন ডিসি) ১৯৯৫ সালে ডিগ্রি লাভ করেন। সেনাবাহিনীতে যোগ দেন জুন, একাত্তরে। ৯ অক্টোবর কমিশন লাভ করে নিয়োগ দান ৬ নম্বরের তেঁতুলিয়া সাব- সেক্টরে। তার অন্যতম অংশগ্রহনের যুদ্ধ-অমর খানা, পঞ্চগড়, বাবুরগাঁ, খানশামা প্রভৃতি। তার অসম সাহসের স্বীকৃতিস্বরুপ সরকার তাকে ‘বীর প্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত করে।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!