You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভয়শূন্য চিত্তে যুদ্ধ করি
মোঃ রফিকুল ইসলাম, বীর প্রতীক

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ ঢাকায় ছিলাম । ২৫ ও ২৬ মার্চে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা দেখে আমি বরিশালে আমার গ্রামের বাড়িতে চলে যাই । আমার মায়ের কাছে সব ঘটনা খুলে বলি । আমি রেডিওতে শুনতে পাই ভারত আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়তা করছে । মাকে বলি, আই ভারতে যাব এবং আমার হাতে কিছু টাকা দিয়ে আমার ছোট মামা নিজামউদ্দিন আহম্মেদের সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দেন । মা আমাকে বিদায়ের মতো বাঁচবি । তোকে আমি আল্লাহর কাছে সঁপে দিলাম’। এ কথা বলে আমার মুখখানা আঁচল দিয়ে মুছে দিলেন । আমি এক পা দু পা করে ভারতের উদ্দেশে হাঁটতে শুরু করলাম । আর পেছনে ফিরে ফিরে মায়ের মুখিখানি দেখছিলাম । মা আমার পুকুর ঘাটে দাঁড়িয়েছিলেন । আমি হাঁটছি আর ভাবছি আমি কি আর কখনো মায়ের মুখ দেখতে পাব? একসময় রাতের আঁধারে মায়ের মুখখানি ঢাকা পড়ে যায় । আমি মামা বাড়ি যাই, মামাকে নিয়ে সারা রাত হেঁটে গোপালগঞ্জের কাছাকাছি যাই । গোপালগঞ্জ ও যশোর জেলার মধ্য দিয়ে শিকারপুর বর্ডার পার হয়ে তিনদিন পর ১৩ এপ্রিলে ভারতে প্রবেশ করি । ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নদীয়া জেলার রানাঘাটে ইয়ুথ ক্যাম্পে তিন মাস শারীরিক প্রশিক্ষণ নিই । এরপর ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধীনে বীরভূম জেলার চাকুরিয়া সেনাঘাঁটিতে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিই । দীর্ঘ ৩০ দিনের প্রশিক্ষণের পর আমাদের ১২ আগস্ট বসুরহাট টাকি ক্যাম্পে ৮নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিলের নিকট পাঠিয়ে দেয় । তিনি আমাদের ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন এবং তাঁর অধীনে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য আমাদের ৬৪ জনকে ৯ নম্বর সেক্টরের অধীনে তাঁর সঙ্গে বরিশালে পাঠান । বরিশালে আসার পথে আমরা ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমরের নেতৃত্বে নড়াইল জেলার আড়পাড়া গ্রামে প্রথমে যুদ্ধে অংশ নিই । এই যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর অনেক ক্ষতি সাধন করে আমরা

৭৩

বরিশালের উদ্দেশে রওনা হই । বরিশাল জেলার উজিরপুর থানার অন্তর্গত হাবিবপুর গ্রামে আমরা আমাদের ক্যাম্প স্থাপন করি । ২২ আগস্ট জানতে পারি, নদীপথে পাকিস্তানি বাহিনী আসছে । আমরা যেতে যেতে বেলা ১১টায় সময় পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের পার হয়ে হার্তারবাজারে গিয়ে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও লুটপাট করে । আমরা দেখতে পাই দুপুর একটার সময় পাকিস্তানি বাহিনী ওপর প্রচণ্ডভাবে গোলাবর্ষণ করি এবং এতে তাদের ব্যাপক ক্ষতি হয় । পাকিস্তানি হানাদারদের ৪০জন নিহত হয় । এই যুদ্ধে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ আহত হননি । এই যুদ্ধের সংবাদ আকাশবাণী, ভয়েস অব আমেরিকা ও বিবিসি রেডিও প্রচার করে । এরপর আমরা বানারিপাড়া থানার জামান ভাইয়ের নেতৃত্বে সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নিই । এই যুদ্ধে আমরা পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের ব্যাপক ক্ষতি করি । এতে অনেক রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় । এরপর ২৪ সেপ্টেম্বর বেণু বাবুর নেতৃত্বে আমরা আবার বানারিপাড়া যুদ্ধে অংশ নিই এবং এ যুদ্ধে অনেক পাকিস্তানি সেনা নিহত ও আহত হয় । ৩ অক্টোবর আমরা বাবুগঞ্জ থানা আক্রমণ করি । এখানে রাত ১১টা থেকে ভোর চারটা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে । এ যুদ্ধে বীর বিক্রম আলতাফ হোসেন শহীদ হন এবং আমাদের কমান্ডার ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমরসহ আমরা ১৭জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হই । গুলিতে আমিও আহত হই । এখানে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি করি । রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাসহ ২০-২২ জন নিহত হয় । এরপর আমরা ১২ থেকে ১৪ নভেম্বর নলছিটি থানার অন্তর্গত চাচির গ্রামে আসা পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে এমবুশের মাধ্যমে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি । এই যুদ্ধ ১০০-এর ওপরে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত হয় । এরপর স্বরূপকাঠি থানার অন্তর্গত ইন্দিরহাট নামক গ্রামে সন্ধ্যা নদীতে ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমরের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাদের গানবোটের আক্রমণ করি । এতে গানবোটটি ধ্বংস হয়ে যায় এবং গানবোটের সব সেনা নিহত হয় । এরপর কাউখালী থানার কেউন্দিয়া গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর দ্বারা আমরা আক্রান্ত হই । পাকিস্তানি বাহিনী নদী দিয়ে পাঁচ দিক থেকে আমাদের ওপর আক্রমণ করে । সেদিনটি ছিল পবিত্র শবে বরাতের দিন এবং সময় ছিল ভোর সাড়ে পাঁচটা । আমি, মর্টার জিয়া ভাই ও আরও তিনজন মর্টার জিয়া ভাইয়ের নেতৃত্বে একদল পাকিস্তানি সেনার প্রায় ৪০জনের মুখোমুখি হই । আমরা তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি । আমরা রণকৌশলে একসঙ্গে সাতজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারকে হত্যা করি ও অনেক সেনা আহত হয় । আমাদের সঙ্গে যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হয়ে গানবোটে করে পালিয়ে যায় ।

৭৪

আমার সাহসে খুশি হয়ে মর্টার জিয়া ভাই আমার অনেক প্রশংসা করেন । এরপর বীর বিক্রম হক ভাইয়ের নেতৃত্বে ডিনামাইটের সহায়তায় গৌরনদী থানার আশুকাঠি ব্রিজটি উড়িয়ে দিই । এরপর শাহজাহান ওমরের নেতৃত্বে ২২ থেকে ২৭ নভেম্বর রাজাপুর থানা আক্রমণ করি । এ যুদ্ধে আমাদের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন । ব্যাপক যুদ্ধের পর আমরা থানা দখল করতে সক্ষম হই । এছাড়া আরও ছোট-বড় অনেক যুদ্ধে আমি অংশ নিই । আমরা ৩ থেকে ৭ ডিসেম্বর বাকেরগঞ্জ থানা আক্রমণ করি । পাঁচদিনের যুদ্ধের পর আমরা অনেক রণকৌশল ছিল, যা আমাদের থানা দখল করতে সহায়তা করে । এখানে অনেক স্বাধীনতাবিরোধী নিহত হয় । ১০-১১ ডিসেম্বর বিনা বাধায় বরিশাল শহরে প্রবেশ করি । ডিসেম্বরের শেষের দিকে দোয়ারিকা ও রহমতপুর বিমানবন্দর এলাকা থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর ১৫০ জন আত্মসমর্পণ করে । যুদ্ধের বীরত্বের জন্য আমাকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয় । এই খেতাবের জন্য আমি চির কৃতজ্ঞ । মোঃ রফিকুল ইসলাম, বীর প্রতীক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!