সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করি
মো. আবুল খায়ের বিশ্বাস
২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার প্রথম যে জেলাটি স্বাধীন হয়, সেটি পাবনা জেলা । স্বাধীনতার ঘোষণার পরপর ৩১ সদস্যের একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় । ২৫ মার্চ পাবনায় শত শত বাঙালি হত্যা করার পর ২৮ মার্চ প্রবল উত্তেজনায় পাবনাবাসী ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর । অস্ত্র না থাকলেও মেধা ও সাহসিকতার ওপর ভর করে পাবনা পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণে হাজার হাজার মানুষ পুলিশ লাইন, টেলিফোন ভবন, ইপসিক শিল্পনগরসহ পাকিস্তানি বাহিনীর সব অবস্থানে ঝাঁপিয়ে পড়ে । ২৯মার্চ পাবনা স্বাধীন হয় । এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন অসংখ্য কিশোর মুক্তিযোদ্ধা । ১৯৭১ সালে আমার বয়স মাত্র ১৬বছর । তখন পাবনার জিসিআই স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র । মার্চ মাস থেকে পাবনার হেমায়েতপুরের আমিসহ নয়জন সমবয়সী বালক যুদ্ধে যাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করি । চারদিকে ভয়ের ছড়াছড়ি । সুযোগ পেলেই যেখানে সেখানে গোপনে মিটিং করি । সবশেষে মিটিংটি ৭অক্টোবর হেমায়েতপুর মানসিক হাসপাতালের নার্স কোয়ার্টারের বটতলায় । এই দিনই সিদ্ধান্ত নেই বাড়ি থেকে বের হওয়ার । সিদ্ধান্ত মতো ৮ অক্টোবর সকাল আটটায় বেরিয়ে পড়ি । আমিসহ বাকি আটজন সাহসী বালক হলো মাহবুবুর রশিদ, এসএম আনসার আলী, নুরুল ইসলাম, আবদুর রশিদ, আতিয়ার রহমান, আবুল হোসেন । তাঁদের মধ্যে পাঁচজন ছাত্র, দুজন শ্রমিক ও একজন বেকার ছিলেন । বাড়ি থেকে বেরিয়ে চরঘোষপুর ও ডিগ্রির চর হয়ে ডিঙিনৌকায় পদ্মা পার হই । অতঃপর কুষ্টিয়ার মিরপুর থানা এবং চিতলমারির ওপর দিয়ে ধর্মদহ বর্ডারে পৌঁছাই পরদিন সকাল সাতটায় । সম্পূর্ণ পথ হেঁটে যাই । দীর্ঘ ২৩ঘন্টায় বিরামহীন যাত্রায় কেবল চিড়া খেয়ে পার করি । ধর্মদহ বর্ডার পার হলে সেখানে ভারতের নদীয়া জেলার কেচুয়াডাঙা ইয়ুথ ক্যাম্প । এই ক্যাম্পে উচ্চ প্রশিক্ষণের বাছাইয়ে চারজন বাদ পড়ে যান । আমি, আবদুর রশিদ, এসএম আজম, আনসার আলী ও নুরুল ইসলাম এই বাছাই পর্বে উত্তীর্ণ হই । এখানে মোহল আমলের তৈরি অতি পুরনো এক মসজিদে শবে বরাতের নামাজ আদায় করি । দুই দিন
৬৯
এখানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি । ১৪ দিন পর গৌর থেকে উচ্চ প্রশিক্ষণের জন্য শিলিগুড়ির পানিয়াঘাটায় যাই । পাহাড়ি ঝরণার মাঝে এই ক্যাম্পে যুদ্ধ প্রশিক্ষণের জন্য ছিল উত্তম পরিবেশ । ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সেখানে প্রায় ১৭ দিন উচ্চ প্রশিক্ষণে অংশ নিই । তিনটি প্লাটুনে মোট ৯০ জন প্রশিক্ষণার্থী ছিলেন । পানিয়াঘাটাতেই আমাদের (—) নম্বর দেওয়া হয় । ১৭ দিন হায়ার ট্রেনিং শেষ করে অস্ত্র ও গোলাবারুদের জন্য ৭ নম্বর সেক্টরের অস্তর্গত পশ্চিম দেনাজপুর জেলার তরঙ্গপুর আসি । এই সময় ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য ভারতীয় সেনাদের ট্রাক ও ভারতীয় রেল-ব্যবস্থা ব্যবহার করা হতো । পাঁচদিন তরঙ্গপুরে অবস্থান করে ৯০ জন যোদ্ধা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ মুর্শিদাবাদ জেলার জলঙ্গি ক্যাম্পে চলে আসি । মির্শিদাবাদ জেলা কুষ্টিয়া জেলার চিতলমারি সীমানার অপর পাশে অবস্থিত । এখানে ঈদুল ফিতরে নামাজ পড়ি । নামাজ আদায় করে পুনরায় ক্যাম্পে ফিরে যাই । জলঙ্গিতে প্লাটুন আঞ্চলিক স্থানীয় এলাকার ভিত্তিতে বিন্যাস করা হয় । আমরা কিসমত প্রতাপপুর গ্রামের এসএম মাহবুবুর রশিদের প্লাটুনে অন্তর্ভুক্ত হই । প্লাটুন নম্বর ছিল ৩২১ । ৭ নম্বর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন লে. কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান । ছয় দিন পর রাতের আঁধারে প্লাটুন ও ওয়্যারলেস সেটসহ চিতলমারি দিয়ে পাকশি হয়ে বাঘাইলে ঢুকে পড়ি । বাঘাইল পাবনা জেলার ঈশ্বরদী থানার অন্তর্গত । রূপপুর ও দাদাপুর হয়ে ভোরে চরকাতলা এসে পৌঁছাই বকুল ভাই (রফিকুল ইসলাম বকুল)বলেন, ‘তোমরা এসেছ খুব ভালো হয়েছে । বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ তোমরা নিয়ে এসেছ । তোমাদের সঙ্গে প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ আছে । আমি কয়েকদিন পরেই শানিড়দিয়ায় অবস্থানরত পাকিস্তানি ও নকশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করব ‘। নকশাল বলতে সর্বহারা কমিউনিস্টদের বোঝায়, যাদের নামকরণ হয় ভারতের নকশালবাড়ি এলাকার নামানুসারে । নকশাল বাহিনীর সদস্যরাও আমাদের শত্রুপক্ষ ছিল । তারা সে সময় পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করেছিল । শানিড়দিয়ার আঞ্চলিক যুদ্ধ ৩০ জন যোদ্ধা পাঁচ-ছয়টি দলে বিভক্ত হয়ে চরকাতলা এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে অবস্থান করি । সবকটি দলের থাকার জায়গা হলেও আমার দলের জায়গা পাইনি । আমরা অবস্থান নিই বাঁধসলগ্ন মসজিদে । চরকাতলায় কিছুদিন অবস্থানের পর পরিস্থিতিতে বুঝে কমান্ডার রফিকুল ইসলাম বকুল একটি মিটিং ডাকলেন । বললেন, ‘আজ রাতেই শানিড়দিয়ার পাকিস্তানি নকশাল বাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমণ করা হবে’। পরিকল্পনা অনুযায়ী রাত দুইটায় প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান করি । নভেম্বরে ২৭ তারিখ, শীতের রাত । ভোর চারটায় শুরু হয় সম্মুখযুদ্ধ । চলতে থাকে প্রচণ্ড গোলাগুলি । সকাল প্রায় নয়টায় দিকে আমার সামনে পাবনা
৭০
কৃষ্ণপুরের হামিদ খান আহত হন । দুইজন ধরে তাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেন । এই সময় তাঁকে সাহায্য করতে চাইলে হামিদ ভাই বলেন, ‘না না, তুই আসিস না । তুই যুদ্ধ চালিয়ে যা । এই যুদ্ধ অনেক দীর্ঘস্থায়ী হবে’। হামিদ ভাইয়ের পায়ে গুলি লেগেছিল এবং সেখান থেকে অঝোর রক্ত ঝরছিল । হামিদ ভাইকে একটা কুঁড়েঘরে নিয়ে যাওয়া হয় । সাত ঘন্টায় মাত্র ৬০-৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা প্রায় ২০০ শত্রুর বিরুদ্ধে বিরতিহীন যুদ্ধ করার পর বেলা ১১টায় প্রত্যাহার করি । শেষে পাকিস্তানি বাহিনী কুঁড়েঘরটি পুড়িয়ে দেয় এবং হামিদ ভাই কুঁড়েঘরেই শহীদ হন । হামিদ ভাইসহ এই যুদ্ধে সেলিম ও আমির হোসেন শহীদ হন এবং অনেকে গুরুতর আহত হন । আর শত্রুপক্ষের নিহত হয় ২২জন । সুজানগর স্বাধীনতা যুদ্ধ শানিড়দিয়া যুদ্ধ শেষ করে আমরা পাঁচজন সহযোদ্ধা নভেম্বরের ২৯তারিখ রাতের অন্ধকারে চরকাতলা থেকে নৌকাযোগে রওনা দিই সুজানগর থানার উদ্দেশে । সম্মুখযুদ্ধ ছাড়া প্রায় সবসময় চলাচল হতো রাতের বেলা । কারণ, দিনের বেলা শত্রুপক্ষের কড়া নজর থাকত । ভোরে সুজানগর পৌঁছলাম । এখানে চর ভবানীপুর গ্রামের মেহের মেম্বারের বাড়িতে অবস্থান করি । কাকডাকা ভোরেই শুরু সুজানগর অপারেশন পরিকল্পনা । সেখান থেকে থানা ভবনের দূরত্ব প্রায় এক মাইল । এভাবে ভেঙে ভেঙে থানার আশপাশের এলাকায় প্রায় শতাধিক যোদ্ধা ছোট ছোট গ্রুপে অবস্থান গ্রহণ করেন । ১১ ডিসেম্বর মধ্য রাতে জেলা কমান্ডার রফিকুল ইসলাম বকুল, এফএফ কমান্ডার মকবুল হোসেন ও এফএফ কমান্ডার ইকবাল হোসেনের কমান্ডে পাকিস্তানি হানাদার বেষ্টিত সুজানগর থানায় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে সশস্ত্র আক্রমণ করেন । উভয়পক্ষে প্রচুর গুলিবর্ষণ হয় । আমরা সাতজনের একটি গ্রুপ শত্রু বাহিনীকে বাধা দেওয়ার জন্য থানা ভবন থেকে আধা মাইল দূরে পাবনা সদরমুখী রাস্তায় এমবুশ করি, যাতে শত্রুপক্ষ পাবনা সদর থেকে সুজানগর থানা ভবনে যোগ দিতে না পারে । বিকেলে শত্রু বাহিনীর একটি বিশেষ দল এমবুশের সামনে এসে পড়ে । মুহূর্তে আমরা তাদের ওপর আক্রমণ করি । প্রচুর গোলাগুলি হয় । গ্রানেড ও শেল নিক্ষেপ হয় এবং দুজন পাকিস্তানি সেনা সেখানে মারা যায় । অবস্থা বেগতিক দেখে পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় । সন্ধ্যায় আবার সুজানগর থানা ভবনে পাকিস্তানি সেনাদের সাহায্য করার জন্য শত্রুবাহিনীর আরও বড় একটি দল তাদের এমবুশের আওতায় আসে । পুনরায় গুলিবর্ষণ হয় । একটানা প্রায় দুই ঘন্টা যুদ্ধের পর শত্রুবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়ে ।
৭১
এভাবে টানা তিনদিন ও তিন রাত যুদ্ধ চলার পর ১৪ডিসেম্বর ভোরে সুজানগর থানা ভবন দখলে চলে আসে এবং আবু বকর, দুলাল, নুরুল ইসলামের জীবনের বিনিময়ে মুক্তিবাহিনী যুদ্ধে জয়লাভ করি । ১৫ ডিসেম্বর রাতে সুজানগর থেকে পদ্মারচর হয়ে পাবনা সদর ও সদরচর এলাকায় অবস্থান নিই । পরিকল্পনা করি নতুন যুদ্ধের জন্য । তখনো আমরা জানি না ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হবে । বিকেল সাড়ে চারটায় রেডিওতে জানতে পারি, কিছুক্ষণ আগে পাকিস্তানি বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল নিয়াজি ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনাসহ ভারতীয় মিতে বাহিনীর সর্বাধিনায়ক অরোরার কাছে ঢাকায় আত্মসমর্পণ করছে । বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে । আনন্দে বুক ভরে যায় । কন্ঠ থেকে বিজয়ের উল্লাস বেরিয়ে আসে । সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠি ‘জয় বাংলা’ বলে । বিশ্বাস করতাম বাড়ি ফিরে যাব । ঠিক তা-ই হলো । ১৭ ডিসেম্বর আমি বাড়িতে ফিরে আসি । অপ্রত্যাশিত এক উপস্থিতি কেউ জানত না আমি ফিরব কিনা । বাড়ি ফেরার সঙ্গে সঙ্গে মা আমাকে গরুর দুধ খেতে দিলেন । যেন এই দুধের বিনিময়ে যুদ্ধে হারানো শক্তির পুনরুদ্ধার করি । জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে আমার দাদি । সবার মুখে হাসি আর আর চোখে জল । আনন্দের জল । ছেলে ফিরে পাওয়ার আনন্দ, স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার আনন্দ । আমার প্রায়ই হামিদ ভাইয়ের সেই কথা মনে পড়ে । “তুই যুদ্ধ চালিয়ে যা”। সত্যি আজ আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি দুর্নীতির বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে । সত্যি আজও আমাদের যুদ্ধ শেষ হয়নি’। মো. আবুল খায়ের বিশ্বাস