You dont have javascript enabled! Please enable it!

সাফল্য নিয়ে ক্যাম্পে ফিরি
শাহজামান মজুমদার, বীর প্রতীক

সাতছড়ির ঘটনার কয়েকদিন পর রেললাইনের পাশের শাহপুর তেলিপাড়া রেল স্টেশনের মাঝের রাস্তায় আমরা মাইন পোঁতার সিদ্ধান্ত নিই । আমরা আগে থেকে ওই এলাকায় শত্রুর অবস্থান সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নিই । তারপর মাইন পোঁতার জন্য উপযুক্ত জায়গা খুঁজে বের করি । আমাদের মতো পাকিস্তানিরাও তেলিপাড়ার কেন্দ্রে স্থায়ী ব্যুহ তৈরি করেছিল । এছাড়া আশপাশের অন্য কোনো চা-বাগানে ওদের স্থায়ী কোনো ব্যূহ ছিল না । তবে পাকিস্তানিরা এসব এলাকায় নিয়মিত টহল দিত । আমরা এক কিলোমিটার পথ হেঁটে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত পার হয়ে গাছপালাবেষ্টিত কুঁড়েঘরের সারি পেলাম । কুঁড়েঘরগুলোর পিছনে কাদায় ভরা ধানক্ষেত । সেই কাদা-পানি ভেঙে প্রায় ৩০০মিটার পথ পার হয়ে রেললাইন । এই রেললাইন এবং এর পাশের মাটির রাস্তাটা ভালোভাবেই পর্যবেক্ষণ করি । গাছের আড়ালে আমরা লুকিয়ে রেললাইন আর মাটির রাস্তাটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম । রাস্তা থেকে কিছু দূর পর পর অনেকগুলো বাংকার দেখা যাচ্ছিল । বাংকার খালি কিনা বুঝতে পারছিলাম না । যদি ওগুলোতে লোক থাকে তবে এই ভেবে- আমরা কুঁড়েঘরের ভেতর গাছের আড়ালে বসে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিই । প্রায় এক ঘন্টা পর আমাদের বামদিকে অবস্থিত শাহপুর স্টেশনের দিক থেকে একটা পিকআপ আসতে দেখি । পিকআপটি আমাদের সামনেই একটা বাংকারে এসে থামলে বাংকার থেকে একজন খাকি পোশাক পরা পাকিস্তানি সেনা বেরিয়ে আসে এবং পিকআপে বসা সেনাদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে । দূরত্বের কারণে আমরা তাদের কথোপকথন শুনতে পাইনি । কিচুক্ষণ পর পিকআপটা চলে যায় । লোকটা আবার বাংকারে ঢুকে পড়ে । এখানে পরপর তিনটি বাংকার থাকলেও পিকআপটা একতার সামনে থামার কারণে একজন আমরা আন্দাজ করতে পারি বাংকারগুলো অধিকাংশই ফাঁকা । হঠাৎ করেই একজন সেনা আগের বাংকারটা থেকে বের হয়ে ধীরে পায়ে বাংকারের সামনে হাঁটতে লাগল । দূর থেকে আগে যাকে দেখেছিলাম, সেই লোকটাকেই মনে হলো । কিছুক্ষণ পরেই

৬০

আরও একজন বাংকার থেকে বেরিয়ে তার সঙ্গে যোগ দেয় । দুজনই সিগারেট জ্বালিয়ে বাংকারের ওপরে বসে আয়েশ করে সিগারেট টানতে থাকে । ওই দিন আমাদের কাজ ছিল মাইন পোঁতার জায়গা নির্বাচন করা, বাংকার আক্রমণ করা না । যদিও দুজন শত্রু সেনাই আমার রাইফেলের নাগালের মধ্যে ছিল, কিন্তু ক্যাপ্টেন মতিনের কঠোর দৃষ্টি আমাকে নিরুৎসাহিত করে । তিনি আমাদের শত্রুকে আক্রমণ করার অনুমতি দিলেন না । কারণ, তিনি চাচ্ছিলেন না পাকিস্তানি বাহিনী জানুক যে আমরা এই এলাকায় ঘোরাফেরা করছি । আমাদের কাজ শেষে যখন চলে যাব, ঠিক তখনই আমরা গুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম, যেটা আসছিল আমাদের পেছনে বাঁশবনের দিক থেকে । গুলির আওয়াজ শুনেই দুই পাকিস্তানি সেনা ত্বরিৎগতিতে বাংকারে ঢুকে গেল । আমরা ঠিক করলাম গোলাগুলি কোথায় হচ্ছে দেখা দরকার । পেছনে বাঁশবাগানের দিকে আসতেই দেখলাম যে আমাদের একটা দলের সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর একটা টহল দলের বন্দুকযুদ্ধ চলছে । সম্ভবত পাকিস্তানিরা তেলিয়াপাড়া স্টেশন থেকে বাঁশবনের দিকে আসছিল আর তখনই আমাদের একটা টহল দলের সামনে পড়ে যায় । দুটো টহল দলই প্রায় সমান শক্তিধর এবং পরস্পরের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে আক্রমণ চালাচ্ছে । আমরা ঠিক করলাম গোপনে শত্রুর ডানদিক থেকে অগ্রসর হয়ে শত্রুকে পেছন থেকে আক্রমণ চালাব । যেহেতু আমাদের কাছে কোনো ওয়াকিটকি ছিল না তাই আমাদের পরিকল্পনার কথা যুদ্ধরত কমরেডদের জানাতে ব্যর্থ হই । আমরা বাঁশবাগানের উদ্দেশে দৌড়াতে শুরু করি । এখানে কোনো রাস্তা নেই, আমরা দৌড়াচ্ছিলাম উঁচু-নিচু জমি, মাঝে মাঝে ঝোপঝাড় আর লম্বা লম্বা ঘাসে ভরা জমির ওপর দিয়ে । মাঝেমধ্যে দু-একটা গাছ চোখে পড়ছিল । কয়েক মিনিটের মধ্যে আমরা পাকিস্তানিদের অবস্থান থেকে রাইফেলের নাগালের দূরত্বে পৌঁছে গেলাম । এর মধ্যেই আমাদের যুদ্ধরত কমরেডরা আমাদের অবস্থান সম্পর্কে জেনে গেল এবং নতুন উদ্যমে গুলি করতে লাগল । আমাদের দশজনের দলের সঙ্গে ছিল একটা লাইট মেশিনগান, দুটো চায়নিজ ৭.৬২ এসএমজি এবং কয়েকটা সেমি অটোমেটিক রাইফেল । এগুলো নিয়ে আমরা শত্রুকে লক্ষ্য করে এমনভাবে অবস্থান সহজে শনাক্ত করতে পারল না । আমাদের আকস্মিক হামলায় ওরা ঘাবড়ে গেল । দুই দিক থেকে আক্রমণ আসায় শত্রুপক্ষ একদম নাজুক অবস্থায় পড়ে গেল । ওদের বাঁচার একমাত্র খোলা রাস্তা হচ্ছে বাঁশবনের মধ্য দিয়ে পালানো । আমি মাটিতে একটু গর্ত মতো জায়গায় অবস্থান নিয়ে আমার রাইফেলের সাইটটা ৩০০মিটার দূরত্বের জন্য প্রস্তুত করলাম । শত্রুর কাছে দুটো এলএমজি

৬১

ছিল, যা দিয়ে ওরা একবার আমাদের দিকে আর একবার আমাদের অপর দলের দিকে গুলি চালাচ্ছিল । আমি শত্রুর নিশানা ঠিক করলাম এবং ছুঁড়তে শুরু করি । আমার দিকেও গুলি আসছিল কিন্তু তার অধিকাংশই যাচ্ছিল আমার মাথার ওপর দিয়ে । পাঁচ মিনিট সংঘর্ষ চলার পর আমরা গোলার আওয়াজ শুনতে পেলাম । হাউটসার (আর্টিলারি গান) থেকে পর পর দুটি বুম বুম আওয়াজ শোনা গেল । সেগুলো আমাদের ১০০মিটার পেছনে এসে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলো কিন্তু পেছনে পড়ায় আমাদের কোনো ক্ষতি হলো না । ফাঁকা স্থানে পাকিস্তানিদের সেনাদলকে সাহায্য করার জন্য আর্টিলারি সবসময় প্রস্তুত থাকে । এখন এই ফাঁকা স্থানে আমাদের দুই দলেরই অবস্থা খারাপ । আর্টিলারি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমাদের কোনো ব্যবস্থাই নেই । আরও দুটো গোলা ছোঁড়ার আওয়াজ শোনা গেল, তবে দুটোই আমাদের মাথার ওপর দিয়ে আগের মতো পেছনে কোথাও গিয়ে পড়ল । এর মধ্যে আমাদের আক্রমণ শ্লথ হয়ে পড়লে পাকিস্তানি বাহিনী বাঁশবনের দিকে পালাতে শুরু করল । এ অবস্থায় সীমান্তের দিকে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় থাকল না । ক্যাপ্টেন মতিন হাত নেড়ে সবাইকে ফিরে আসার সংকেত দিচ্ছিলেন । আরও দুটো গোলা মাটিতে বিস্ফোরিত হলে এখানে কয়েক মুহূর্ত আগেই আমরা ছিলাম । আরও দুটো গোলা, এ দুটোও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে সীমান্তের কাছাকাছি কোথাও পড়ল । কিন্তু এই শেল দুটো ছিল এয়ারব্লাস্ট । যখন আমরা বুঝতে পারলাম যে এগুলো এয়ারব্লাস্ট, তখন সঙ্গে সঙ্গে দিক পরিবর্তন করলাম । আমরা দিক পাল্টে কোনাকুনিভাবে সীমান্তের দিকে দৌড়াতে শুরু করলাম । এর মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী নিরাপদে বাঁশবনে পৌছে আবার আমাদের দিকে গুলি ছুঁড়তে আরম্ভ করল । কিন্তু ততক্ষণে আমরা শত্রুর অস্ত্রের সীমার বাইরে চলে গেছি । ফলে তাদের ছোঁড়া গুলি আমাদের পর্যন্ত পৌঁছল না । যখন আমরা সীমানা পেরিয়ে ভারতে ঢুকে পড়লাম, তখন দেখলাম আমাদের একজনের বাঁ পায়ে এয়ারব্লাস্টের স্প্লিন্টার লেগে অনর্গল রক্ত বের হচ্ছে । আমাদের জিপটা কাছাকাছি থাকায় তাকে দ্রুত হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো যদিও গুরুতর আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা আমাদের হেডকোয়ার্টারে ছিল না । আমি নিশ্চিত শত্রুদের অনেকেই হতাহত হয়েছে । বিশেষ করে আমরা যখন ওদের পাশ থেকে আক্রমণ করছিলাম । তবে দুঃখজনক যে এ রকম বিক্ষিপ্ত গোলাগুলির সঠিক ফলাফল নিশ্চিতভাবে যাচাই করে দেখা সম্ভব হয় না । যুদ্ধ চলাকালীন মাথা ঠাণ্ডা রাখা সাধারণ মানুষের পক্ষে সহজ না । এটা আয়ত্ত করতে নিয়মিত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ।এটা আয়ত্ত করার সবচেয়ে ভালো

৬২

এবং দ্রুত প্রক্রিয়া হলো যুদ্ধক্ষেত্র, তবে সেজন্য প্রশিক্ষণার্থীকে চরম মূল্য দিতে হোটে পাড়ে । কেননা ট্রেনিংয়ের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো দ্বিতীয় সুযোগ থাকে না । আত্মরক্ষা মানুষের সহজাত প্রবৃতি আর এই প্রবণতাই অধিকাংশ মানুষকে বিপদে পড়লে নিরাপত্তা খুঁজতে বাধ্য করে । যখন বুলেট কারও দিকে ছুটে আসতে থাকে তখন একধরনের যুক্তিহীন আতঙ্ক গ্রাস করতে চায় । ভয় হচ্ছে মানুষের সহজাত আদিম অনুভূতি, সেখানে যুক্তি বা বিবেচনার মতো শিক্ষালব্ধ বিষয়গুলো ঠিক কাজ করে না । আমার মনে আছে, প্রথমবার বুলেটের মুখোমুখি হয়ে কী ভয়ই না আমি পেয়েছিলাম । চারদিকে বুলেটের হিসহিস শব্দ আতঙ্ক ছরাচ্ছিল । আমি যেন কেমন ভয়ে জমে যেতে লাগলাম । আমার পা মনে হলো মাটিতে গেড়ে বসেছে, নরাতে পারছি না । ভয়কে জয় করা না গেলে এই লাগামহীন ভয় মানুষকে পঙ্গু করে দেয়, ভয় ক্রমেই এক মানুষ থেকে অন্য মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং একবার আক্রান্ত করতে পারলে প্রায় মানুষকে অসাড় করে ফেলে । আমি এটা অনেকবার ঘটতে দেখেছি । প্রথম প্রথম নিজেও এর শিকার হয়েছি অধিকাংশ যোদ্ধাই কয়েকটা যুদ্ধের পর এই ভয় কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয় । আমার হতে, এক্ষেত্রে দলনেতার একোতা বিশেষ ভূমিকা থাকে । তার দায়িত্ব কেবল সদস্যদের আচরণ নিয়ন্ত্রণই নয়, বরং গোটা দলকে সাহস জোগান এবং দলপতির মতো আচরণ করা । একজন যোগ্য নেতার কাজ হচ্ছে তার মধ্যকার সাহস ও শক্তি দলের অন্যদের মধ্যে সঞ্চারিত করা এবং দলের সবার কাছাকাছি এসে দলীয় বন্ধনকে মজবুত করা । নবাগতরা তাদের ঊর্ধ্বতনদের দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত হয় । ফলে একজন সাহসী নেতার পক্ষে সম্ভব নির্ভীক যোদ্ধা তৈরি করা অন্যদিকে হীনম্মন্য নেতৃত্ব থেকে কেবল দুর্বল ও কাপুরুষেরই সৃষ্টিও হয় । এজন্য যেসব দলনেতা বুদ্ধিমান ও সাহসী, তাদের অধীনস্থরা অতি দ্রুত এসব ভয়-ভীতিজনিত দুর্বলতা কাতিয়ে উঠতে পারে । এদিক দিয়ে আমি বেশ ভাগ্যবান বলা যায়, ট্রেনিং শেষ করার পরে সেলিম ভাইয়ের মতো একজন সাহসী ও সমর্থ মানুষকে নেতা হিসেবে পেয়েছিলাম । লে.মোর্শেদও ছিলেন একই প্রকৃতির মানুষ । সর্বোপরি ক্যাপ্টেন মতিন এবং তাঁর ইপিআর বাহিনী যে সাহস ও বীরত্বের নজির স্থাপন করেছিলেন, তা ছাড়িয়ে যাওয়া কঠিন । একটা দলের সঙ্গে কিছুদিন থাকলে মানুষের আচার-আচরণের কিছু পরিবর্তন আসে এবং সে শিগুগিরই দলের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয় । তার মানে এই নয় যে আমার মধ্যে ভয় ছিল না । দুঃখজনক হলেও সত্যি যে চেষ্টা করেও আমার পক্ষে হলিউড হিরোদের মতো হয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি । বুঝতে পারলাম, বাস্তব যুদ্ধ সিনেমার যুদ্ধের মতো নয় । আমাদেরও কিছু হলিউডের মতো হিরো ছিলেন । আমাদের দুলা মিয়া ছিলেন । আমি আরেকজনের কথা পরিষ্কার মনে করতে পারি,

৬৩

মফিজ নামে সাবেক ইপিআরের হাবিলদার । শান্ত, ধীর-স্থির এবং স্বল্পভাষী একজন মানুষ, এক কথায় একটু ভাবলেশহীন । কিন্তু সে যখন তার মাঝারি মেশিনগানটা ব্যবহার করত তখন সে হয়ে উঠত অন্য মানুষ । সে যখন একটা অবস্থান থেকে যুদ্ধ করত, সে জায়গা থেকে নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত উঠত না, অবস্থা চরম প্রতিকূল হলেও । মফিজ দুলা মিয়ার মতো ছিল না, সে ছিল নম্র এবং নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকা একজন মানুষ । তার ঊর্ধ্বতনরা আমায় বলেছেন যে সাধারণ সময়ে ছিল খুবই নিরীহ প্রকৃতির লোক, যাকে কোনো কোনো সময় অনেকে নিরুৎসুক বলেও মনে করত এবং ফলে তিরস্কারের পাত্র ছিল । অনেক অফিসারকেই সাধারণ সময়ে দক্ষ ও পরিপাটি মনে হলেও বিপদের সময় বা শত্রুর মুখোমুখি হলেই তারা তাদের এই কৃত্রিম ভাবমূর্তি আর ধরে ধরে রাখতে পারতেন না । জীবন-মরণের টানাপোড়েনে তাদের এই উদ্দীপ্ততার খোলস খুব দ্রুতই ভেঙে পড়ে । একজন মানুষ যখন চরম বিপদের মুখোমুখি হয় তখন সকল ভদ্রতা ও ভারসাম্য বজায় রাখার প্রচেষ্টা বিফলে যায় । নকল আবরণ ভেদ করে আসল চেহারা দ্রুতই বেরিয়ে আসে এবং নিজের ভেতরকার আসল মানুষটাকে মেলে ধরে । এটাই মানুষের ভেতরকার প্রকৃত সত্তা । যা-ই হোক, আমরা ঘাঁটিতে ফিরে এসে অস্ত্র পরিষ্কার শেষে বসে বসে সারা দিনের কর্মকাণ্ড নিয়ে আলাপ করতে লাগলাম । অভিযান পরবর্তী এই আলোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । কেননা এর মাধ্যমে আমরা আমাদের ভুলগুলো খুঁজে বের করতে পারপ্তাম । এই আলোচনার নতুন নতুন কৌশল ও পরিকল্পনার জন্ম হতো এবং আমি পারতপক্ষে এই আলোচনায় অনুপস্থিত থাকতাম না । রেললাইন সংলগ্ন এলাকা পর্যবেক্ষণ শেষে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ওই দিন সন্দ্যায় আমরা মাইন পুঁতবো । এ অভিযানের জন্য ক্যাপ্টেন মতিন নেতৃত্বে কুড়িজনের একটা দল তৈরি হলো । রাত হলে আমাদের ডান দিকে (বাঁশবনের দিকে) নিরাপত্তার জন্য বাড়তি টহল দলের প্রয়োজন ছিল না, কেননা পাকিস্তানিরা সাধারণত রাতের বেলায় সীমান্তের খুব একটা কাছাকাছি আসে না । সূর্যাস্তের পরপরই রাতের খাবার সেরে নিয়ে আমরা ঘাঁটি থেকে বেরিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হলাম । জনমানবশূন্য একতা এলাকার বাংলাদেশি রিফিউজিদের মধ্যে পাকিস্তানিদের গুপ্তচর থাকতে পারে । যখন সীমান্তে পার হচ্ছিলাম তখন পুরোপুরি অন্ধকার, এই গাঢ় অন্ধকারে রেললাইনের পাশের সেই কুঁড়েঘরের সারি খুঁজে পেতে একটু কষ্টই হলো । তাছাড়া কোনো ঝামেলা ছাড়াই আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম । আমরা যখন পৌঁছলাম তখন আকাশ পরিষ্কার, অসংখ্য তারা হীরার মতো ঝলমল করে স্বররগীয় দ্যুতি ছড়াচ্ছিল । চারদিকে সুনসান নীরবতা মাঝেমধ্যে দূর

৬৪

থেকে রাতজাগা পাকিস্তানি প্রহরীদের রাইফেলের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। শব্দ শুনে অস্ত্রের ধরনের আন্দাজ করতে আমরা বেশ পারদর্শী হয়ে উঠি। রাইফেলের আওয়াজ এবং সুপারসনিক বুলেটের তীক্ষ্ম আওয়াজের মধ্যবর্তী সেকেন্ড গুনে আমরা রাইফেলের ধরণ নির্নয় করতে পারতান। যেমন এ৩ রাইফেলের আওয়াজ ছিল স্বতন্ত্র ।প্রথমে টাক তারপরে ড্রুম। চায়নিজ রাইফেলের আওয়াজ কিছুটা কোমল। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের আওয়াজ এবং গুলি ছোঁড়ার গতি থেকে আমরা অস্ত্রের ধরণ সনাক্ত করতে পারতাম। কুঁড়ে ঘরগুলোর কাছে যাওয়ার পর ক্যাপ্টেন মতিন সবাইকে আরও একবার আমাদের মিশন সম্পর্কে বিস্তারিত বলে দিলেন। অন্ধকার রাতে কিছুই দেখা যায়না, তাই আমরা ধৈর্য ধরে কিছুক্ষণ কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম, অস্বাভাবিক কোন আওয়াজ শোনা যায় কিনা। তখন রাত প্রায় ৮ টা বাজে।
দিগন্তের বিপরীতে আমাদের সামনের তিনটি বাঙ্কারের অবয়ব অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু সামনে কাউকে দেখা যাচ্ছেনা। কিছুক্ষণ পরে একটা গাড়ির হেডলাইট দেখতে পেলাম। গাড়িটা আমাদের দিকে আসছে। রেললাইন পাহারা দেবার জন্য এটা পাকিস্তানিদের ভ্রাম্যমান টহল। আমরা এটাকে নিরাপদেই যেতে দিলাম। আমরা জানতাম এটা অন্য দিক থেকে ঘুরে আসতে অন্তত ৩০ মিনিট সময় লাগবে। লক্ষ করলাম যে গাড়িটা আমাদের সামনে থাকা ৩ টি বাংকারের একটার সামনেও থামল না। আমরা ধরে নিলাম যে সামনের ৩ টি বাংকারই খালি। গাড়িটা অন্য কোথাও না থেমে একই গতিতে উঁচু নিচু রাস্তা দিয়ে হেলে দুলে এগিয়ে যেতে লাগল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই হেডলাইটের আলো অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
সিদ্ধান্ত হল ২০ জনের মধ্যে ৬ জন যাবে মাইন লাগাতে আর বাকিরা এই ঘরগুলোর কাছে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নিয়ে থাকবে। যদি কোন সমস্যা হয় তাদের দ্বায়িত্ব পিছন থেকে গুলি করে আমাদের রক্ষা করা এবং নিরাপদে পিছনে ফিরে আসতে সাহায্য করা। আমরা দুটো এল এম জি সঙ্গে নিলাম। এবং দেখে নিলাম তা প্রস্তুত করা আছে কিনা। কারণ রাতের এই পিনপতন নীরবতায় এল এম জি প্রস্তুত করার শব্দ একটি ছোট ক্যালিবারের পিস্তল থেকে গুলি ছোঁড়ার শব্দের সমান। রাইফেল এবং বুট রেখে একটা ছোট কোদাল, ছোট একটা লাঠি এবং ট্রাকের একটা টায়ার নিয়ে আমি রওনা হলাম।

ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে খুব শান্ত ভাবে ধীর গতিতে আমরা রাস্তার দিকে এগোচ্ছিলাম। ধানক্ষেত পানিতে ভেজা এবং কাদায় ভরা, ফলে প্রতিবার পা ফেলতেই কাদায় পা আটকে যাচ্ছিল। আঠালো মাটিতে পা পিছলে একবার আমি প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম। অনেক কষ্টে ভারসাম্য রক্ষা করি।

৬৫

শেষের ৫০ মিনিট আমরা খুবই ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলাম, প্রতিবার পা ফেলার আগে সাবধানে ও সতর্কতার সঙ্গে পায়ের সম্পূর্ণ ভর কাদার মধ্যে ফেলছিলাম। কেননা হঠাত করে পা ফেললে কাদা পানির মধ্যে একটা প্যাঁচ প্যাঁচ শব্দ হয়। যেটা রাতের নীরবতায় অনেকদূর পর্যন্ত শোনা যায়। ধানক্ষেত থেকে রেললাইন ও মাটির রাস্তাটা প্রায় ৬ ফুট উপরে। ধানক্ষেত পার হয়ে খুব সাবধানে হামাগুড়ি দিয়ে আমরা মাটির রাস্তায় উঠলাম। আমরা দুটো বাঙ্কারের প্রায় মাঝামাঝিতে আছি। আর সামান্য পথ হামাগুড়ি দিয়ে দুই বাংকারের মাঝখানে একটা জায়গা মাইন লাগানোর জন্য ঠিক করলাম। আমাদের থেকে ১৫ মিটার দূরত্বে দুই দিকে দুটো বাঙ্কার। এল এম জি দুটো দুই বাংকারের দিকে মুখ করে বসানো হল। খুব সন্তর্পনে কোন রকম শব্দ না করে আমরা রাস্তার নরম মাটি খুঁড়তে শুরু করলাম।
রাস্তার উপরে উঠতেই আমার হৃদকম্পন বাড়তে শুরু করে। উত্তেজনা, ভয়, আশংকা, প্রতিশোধ স্পৃহা আর লক্ষ্য অর্জনের সংকল্প, সবকিছু মিলিয়ে তখনকার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। আমি খুব আতঙ্কিত ছিলাম। আমরা পাকিস্তানি বাঙ্কারের এত কাছে যে, যে কোন মূহুর্তে কিছু ঘটতে পারে। কেউ বাংকার থেকে বেরিয়ে এলে আমাদের দেখে ফেলতে পারে। যে গাড়িটা চলে গিয়েছিল, সেটা আবার ফিরে আসতে পারে। আবার নতুন কোন যানবাহনও আসতে পারে। সুতরাং অনেক কিছুই ঘটতে পারে। আমি জানিনা আমার সঙ্গের অন্যদের কেমন লাগছিল। তবে তাদের কারোর মধ্যেই ভয়ের কোন চিহ্ন দেখলাম না। সবাই সতর্ক, তবে ভীত নয়। আমি তাদের মতোই নিজেকে সংযত রেখে নিজের কাজে মন দিলাম। সাহস এবং ভয় উভয়ই সংক্রামক হয়। এবং খুবই দ্রুত ছড়ায়।
আমি একটা ছোট কোদাল নিয়ে গিয়েছিলাম এবং আমার দ্বায়িত্ব ছিল মাইনের মাপ মতো গর্ত খোঁড়া। আমাদের সঙ্গে আরও দুজনের কাছে কোদাল ছিল। আমরা গর্ত গুলো খুঁড়ে তাতে মাইন বসালাম, বৃত্তাকার মাইনের কেন্দ্রে গোল মতো একটা গর্ত থাকে ডেটোনেটর লাগানোর জন্য, সেখানে সাবধানে, শব্দ না করে ডেটোনেটর লাগানোর পর স্পাইডারটার সতর্কতার সঙ্গে ঠিকভাবে ডেটোনেটরের উপর বসিয়ে দিলাম। সবশেষে মাইনগুলো মাটি দিয়ে ঢেকে দিলাম। অন্য একজন এই মাটির উপরে ট্রাকের টায়ার দিয়ে ছাপ দিয়েছিল। একদম শেষে আমি সঙ্গে নিয়ে যাওয়া চটের বস্তা বের করে তাতে বাড়তি মাটিগুলো রাস্তা থেকে তুলে বস্তায় ভরে নিলাম। আমরা যেহেতু হামাগুড়ি দিয়ে রাস্তায় উঠেছিলাম, তাই রাস্তায় আমাদের পায়ের কোন ছাপ থাকল না।
রাস্তার একপাশে পাশাপাশি ৩ টি মাইন পোতা হল। আমাদের কাজ যখন প্রায় শেষ তখন হঠাত একটা আওয়াজ শুনে আমার রক্ত ঠান্ডা হয়ে গেল। মনে হল কেউ দেশলাই দিয়ে আগুণ জ্বালাচ্ছে এমন শব্দ শুনলাম। আমার হৃদকম্পন

৬৬

সঙ্গে সঙ্গে ধপ করে দ্বিগুণ হয়ে গেল আর এক ধরনের অসাড়তা আমাকে কেমন যেন গতিহীন বা অনুভূতিশূন্য করে ফেলতে চাইল। আমার সব শক্তি প্রয়োগ করে কোন রপকমে নিজের ভয়কে নিয়ন্ত্রণ করলাম।
সবাই একযোগে শব্দের উৎসের দিকে মাথা ঘোরালাম। বাংকারটা আমাদের ডানে। আমরা বুঝতেই পারিনি বাংকারের মধ্যে কেউ থাকতে পারে। মাত্র ১৫ মিটার দূরে বাংকারটিতে আবছা আলোর আভা দেখতে পেলাম। ভাগ্য ভাল বাংকারের গুলি করার ছিদ্র গুলি সামনের দিকে তাক করা, পাশের দিকে নয়। সবাই মাটিতে শুয়ে পড়লাম এবং বাংকারের দিকে অস্ত্র তাক করে রইলাম। আমাদের কারও সঙ্গে কোণ গ্রেনেড ছিলনা। থাকলে হয়ত একটা গ্রেনেড বাংকারের ভিতর ছোঁড়ার কথা ভাবা যেত। ক্যাপ্টেন মতিন আমাকে ইশারা করলেন ধানক্ষেতের দিকে ক্রলিং করে নেমে যেতে। এরমধ্যে আমরা টায়ারের ছাপ দেওয়া শেষ করেছি। শুধু কোদাল হাতে আমার পক্ষে নেমে যাওয়াটা সহজ ছিল কিন্তু যাদের হাতে অস্ত্র ছিল , বিশেষ করে এল এম জি নিয়ে কোন শব্দ না করে নিঃশব্দে নেমে আসা খুবই কঠিন। যাই হোক কোন মতে তেমন কোন শব্দ না করেই আমরা ধানক্ষেতের মধ্যে নামতে পারলাম। ধানক্ষেতে নামতে পেরে আমরা কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেলাম। খুব আস্তে আস্তে যতটা সম্ভব নিঃশব্দে আমরা কুঁড়েঘরগুলোর কাছে ফিরে এলাম। যখন কুঁড়েঘরে বসে জুতামোজা পরছি, তখন সেই টহল গাড়িটাকে অন্য দিক থেকে ফিরে আসতে দেখলাম। কিছুক্ষণ পর পিক আপ টা আমাদের পোঁতা মাইনের উপর দিয়ে নির্বিঘ্নে চলে গেল। আমরা জানতাম মাইন ফাটবে না। একটা নির্দিষ্ট ওজনের চাপ না পড়লে ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন ফাটে না। অবশ্য একটা ছোট পিক আপ ট্রাক মাইনে পড়ুক তা আমাদের কাম্য ছিলনা। আমরা আর দেরি না করে আমাদের ক্যাম্পের দিকে রওনা হলাম।
রাতে আর কিছুই হলোনা। আমি ভীষণ ক্লান্ত ছিলাম তাই ক্যাম্পে ফিরেই ঘুমিয়ে পড়ি।
পরদিন সকালে প্রতিদিনকার মত ভোরে ঘুম থেকে উঠে যখন নিমের ডাল দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করছি, ঠিক তখনই একটা প্রচন্ড বিস্ফোরণের আওয়াজ সকালের স্নিগ্ধতাকে ভেঙে চুরমার করে দিল। আমরা সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলাম কী ঘটেছে। যেখানে মাইন পোঁতা হয়েছে তা থেকে আমাদের ক্যাম্পের দূরত্ব প্রায় ৫ কিলোমিটার হওয়া সত্ত্বেও ট্যাংক বিধ্বংসী ৩ টা মাইন বিস্ফোরণের আওয়াজ এতই ভয়ানক যে আমরা সবাই সেই বিস্ফোরণ এতদূর থেকেও বেশ জোরেই শুনতে পেলাম। আমাদের ফাঁদে কী শিকার ধরা পড়ল, সেটা জানার জন্য সবাই উদগ্রীব হয়ে রইলাম। কাজেই তাড়াতাড়ি কোন রকমে সকালের নাস্তা সেরে আমরা কুঁড়ে ঘরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। এখন যেহেতু দিনের বেলা তাই

৬৭

ক্যাপ্টেন মতিন ১০জনের একটা দলকে আমাদের ডানদিকের সীমান্ত সংলগ্ন বাঁশঝাড়ের দিকে বসিয়ে নির্বিঘ্নেই আমরা কুঁড়েঘরগুলোর কাছে পৌঁছে গেলাম । সেখানে আড়ালে দাঁড়িয়ে আমরা দেখতে পেলাম একটা পাঁচ টনি আর্মি ট্রাক বিধ্বস্ত হয়েছে । ট্রাকের সামনের বাঁ দিকের সম্পূর্ণ অংশ একেবারে উড়ে গেছে এবং ট্রাকটা রাস্তা থেকে উল্টে ধানক্ষেতের মধ্যে পড়ে আছে । আশপাশে কোনো পাকিস্তানি সেনা বা অন্য কোনো লোকজন দেখতে পেলাম না । দুর্ভাগ্যবশত এবারও আমরা পাকিস্তানি হতাহতের সংখ্যাটা জানতে পারলাম না । নিজেদের সাফল্যে খুশি হয়ে ফুরফুরে মনে কোনো ঝঞ্ঝাট ছাড়াই আমরা ক্যাম্পে ফিরে এলাম । শাহজামান মজুমদার, বীর প্রতীক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!