পাক-বে ডকইয়ার্ড অপারেশন
মোহাম্মদ গিয়াসউদ্দীন, বীর প্রতীক
শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পাড় বন্দর থানা এলাকার নবীগঞ্জ কাইত্যাখালিতে অবস্থিত পাক বে ডকইয়ার্ড। এখানে বড় বড় জাহাজ তৈরি করা হতো । এরই অন্য একটি প্রকল্প ছিল যেখানে স্পিডবোট তৈরি করা হতো । বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, এই পাক বে ডকইয়ার্ডে একটি বড় জাহাজ পাক বাহিনীর একটি ঘাঁটি ছিল । এই ঘাঁটি হতে স্টিল বডির ছোট লঞ্চে করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নদী পথে দিনে ও রাত্রে টহল দিত । (পাক বে ডকইয়ার্ডটি একজন পাকিস্তানি মালিকের ছিল) । মে মাসের শেষ সপ্তাহে আমাদের ২নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ আমাদের ক্যাপ্টেন হায়দার সাহেবের উপস্থিতিতে বলেন যে, পাক বে-তে ব্যাপকহারে স্পিডবোট তৈরি হচ্ছে- যে স্পিডবোট দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নদীপথে অতিদ্রুত চলাচল করতে পারবে । যে কোনো মূল্যে এই স্পিডবোট প্রকল্পটি ধ্বংস করতে হবে । আমাকে পাক বে ডকইয়ার্ডের একটি পূর্ণাঙ্গ মডেল তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয় । শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পাড়ে অবস্থিত পাক বে ডকইয়ার্ডের একটি মডেল ৬/৭দিনের মধ্যে তৈরি করতে সক্ষম হই, অতঃপর ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে প্রয়োজনীয় গোলাবারুদ ও অস্ত্র আমাদের দেয়া হয় । ক্যাপ্টেন হায়দার বিদায়ের সময় সকলকে বুকে জড়িয়ে ধরেন এবং অপারেশনের সাফল্য কামনা করে বিদায় দেন । জুন মাসের ৮/৯ তারিখে আমরা আমাদের এলাকাতে আসি । পরে পাক বে ডকইয়ার্ডের প্রয়োজনীয় খোঁজখবর নেই । পরবর্তী সময় সহযোদ্ধাদের সাথে পরামর্শ করে অপারেশনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেই । ২৩ জুন রাত নয়টার অপারেশনের দিন ও সময় নির্ধারিত করা হয় এবং অপারেশনের প্রয়োজন অতিরিক্ত বিশেষ কিছু দায়িত্ব কয়েকজন সহযোদ্ধাকে দেওয়া হয় । যেমন- যে সময় আমরা পাক বে তে অপারেশনে যাব ঠিক সে সময় ৩০ মিনিটের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা, যথাসময়ে আমরা পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী পাক বে-তে অবস্থান নিলাম ।
৫৬
অতিদ্রুত যার যার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পূর্ণ করে চূড়ান্ত অভিযানে (এই অপারেশনে প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিড ব্যবহার করা হয়।)সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয় স্পিডবোট তৈরি করার প্রকল্পটি । এখন নিরাপদে ফিরে আসার চিন্তা । নদীর পশ্চিম পাড়ে আমাদের আসতে হবে । পরিকল্পনা অনুযায়ী সাধারণ চলাচলকারী মানুষের সাথে মিশে গিয়ে আমরা লক্ষণখোলা খেয়াঘাটে চলে আসি । খেয়াঘাটে ৫/৬ নৌকা ভিড়ানো ছিল কিন্তু নদী পার করে দেবার মতো কোনো মাঝি ঘাটে ছিল না । আমরা কঠিন চিন্তায় পড়ে গেলাম । এমনি সময়ে এক যুবক দৌড়ে এসে ছিল না । আমরা কঠিন চিন্তায় পড়ে গেলাম । এমনি সময়ে এক যুবক দৌড়ে এসে বলে, আমি আপনাদের নদী পার করে দেব এবং সে নদী পার করেও দেয় । এই সাহসী যুবকের নাম জাফর উল্লাহ সাউদ (লক্ষণখোলা) পরে সে প্রশিক্ষণ নিয়ে একজন মুক্তিযোদ্ধার দায়িত্ব পালন করে । এই অপারেশনে আরও যারা অংশগ্রহণ করেন-নুরুল হক, শফিউদ্দিন, খোরশেদ, মহিউদ্দিন, আবু তালেব, অন্য যেসব সহযোদ্ধাদের নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না তাদের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী । বিশেষভাবে উল্লেখ্য এই যে, যুদ্ধকালীন সময়ে নারায়ণগঞ্জ, ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ, বন্দর এসব এলাকায় এতবড় সফল অপারেশন দ্বিতীয়টি হয়নি । এই সফল অপারেশনের খবর বিবিসি ও ভয়েজ অব আমেরিকা হতে ফলাও করে প্রচার করা হয় এবং আগরতলা শহরে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও মুক্তিযোদ্ধারা একটি আনন্দ মিছিল বের করে । আমি অপারেশনের তিনদিন পর মেলাঘরস্থ আমাদের সেক্টর হেডকোয়ার্টারে যাই । সময় রাত ন’টা । চেকপোস্ট থেকে আমাকে ভিতর যেতে দেয়া হচ্ছে না । অনেক অনুরোধ করে চেক পোস্টে নিয়োজিত নিরাপত্তা কর্মীদের প্রধানকে বিনীতভাবে অনুরোধ করায় ক্যাপ্টেন হায়দার এর নিকট খবর দেয়া হয় যে, আমি চেক পোস্টে অবস্থান করছি । কয়েক মিনিটের মধ্যে ক্যাপ্টেন হায়দার নিজে জিপ চালিয়ে চেক পোস্টে চলে আসেন । জিপ থেকে লাফ দিয়ে নেমে আমাকে জড়িয়ে ধরে জিপে নিয়ে আসেন এবং মুহূর্তের মধ্যে আমরা হেডকোয়ার্টারে চলে আসি । বহু আলোচনা এবং আনন্দ উল্লাস শেষে গোসল ও রাতের খাবার সারা হয় । পর দিন সকালে ক্যাপ্টেন হায়দার আমাকে বলেন, তুমি মানসিকভাবে প্রস্তুত হও, বেলা ১১টার সময় তোমাকে স্যার (ক্যাপ্টেন শওকত, বর্তমানে কর্নেল শওকত এমপি) নিয়ে যাবেন, ৯১ বিএসএফ হেডকোয়ার্টার্সে । ওখানে ভারতীয় উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তারা পাক বে’র সফল অপারেশন সম্পর্কিত বিস্তারিত রিপোর্ট গ্রহণ করবেন । যথাসময়ে শওকত স্যার আমাকে নিয়ে জিপযোগে রওনা দেন । ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে ভারতীয় বড় মাপের একটি সেনানিবাসে পৌঁছে । পরে জানতে পারলাম, এটাই ৯১ বিএসএফ হেডকোয়ার্টার্স । একজন অফিসার এসে স্যারকে স্যারসহ আমাকে একটি সজ্জিত বসার ঘরে বসালেন এবং চা বিস্কুটে আপ্যায়ন করলেন । ৮/১০ মিনিট পর অন্য একজন অফিসার এসে জানতে চান, মি. গিয়াস উদ্দীন কে? শওকত স্যার আমাকে পরিচিয় করিয়ে দেন । বিনয়ের সাথে একটি ইংরেজি পত্রিকা শওকত
৫৭
অনুযায়ী আমার একটাই চাওয়া ছিল আমি অস্ত্র চাই এবং আমাদের অস্ত্র চাই । দীর্ঘ নব্বই মিনিটের রিপোর্টটি শেষে উনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন, অস্ত্র দেবো এবং যুদ্ধ চালিয়ে যেতে যা যা প্রয়োজন সবই দেবো । একথা বলে স্যারের হাতে দিয়ে আমাকে ওনার সাথে নিয়ে আসলেন এবং অতি সুন্দর সুসজ্জিত একটি বড় কামরায় আমাকে নিয়ে যান । মুহূর্তে ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন এবং অনেক স্নেহ করেন । ঐ সময় সোফাতে বসা দুজন সেনা কর্মকর্তা (লে. জেনারেল সগত সিং এবং মে. জেনারেল আরডি হীরা)র সাথে আমাকে পরিচিয় করিয়ে দেন । এরপর শুরু হয় পাক বে অপারেশন সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনা । আলোচনার শেষ পর্যায়ে উনি জানতে চান, আমি কী চাই এবং আমরা কী চাই? আমার কমান্ডারের পরামর্শ ভারতীয় ২০০ টাকা, ২ কার্টন পানামা সিগারেট, ৪ কার্টন উন্নত মানের বিস্কিট, উপহার সামগ্রী আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেন, বেটা আমার পক্ষ থেকে এই ক্ষুদ্র উপহার তোমাদের জন্য । পুনরায় তিনি আশ্বস্ত করেন সব ধরনের অস্ত্র তোমাদের দেয়া হবে । তারপর সকলের সাথে করমর্দন শেষে তিনিম আমাকে ও শওকত স্যারকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেন । প্রশিক্ষণ চলাকালীন সময়ে আমাদের সাথে ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং এর পরিচয় হয় । সকলের সাথে ভালো সম্পর্ক ছিল । এই সফল অপারেশনের কৃতিত্ব আমার সকল সহযোদ্ধার । বলা বাহুল্য পাক বে ডকইয়ার্ডে আমার বড় ভাই প্রথম শ্রেণির একজন শিপবিল্ডার (ঠিকাদার)ছিলেন । সেই সুবাদে পাক বে ডকইয়ার্ডে আমার যাওয়ার সুযোগ ছিল । এ লেখাটি লিখতে গিয়ে গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি কে ফোর্স কমান্ডার মরহুম মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম ও লে. কর্নেল মরহুম এটিএম হায়দার, বীর উত্তমের নাম । গানবোট অপারেশন ব্রক্ষপুত্র, মেঘনা ও শীতলক্ষ্যা নদীর মিলনস্থল শম্ভুপুরাটেক (কলাগাছিয়া) এ আমাদের অবস্থান । ২৫ অক্টোবর, ১৯৭১ বিভিন্ন সূত্রে আমরা খবর পাই যে, নদীর এই মোহনায় সবসময় গানবোট টহল দেয় । ঐদিন বিকেল ৫টায় ৫৭ মি. মি. ব্লেন্ডিসাইডসহ ৩০জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল নিয়ে গানবোট অপারেশনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করি । সন্ধ্যার পর রাতের খাবার শেষে যার যার অবস্থানে যাই, সারারাত্রি কেটে গেল । কিন্তু ঐ রাতে গানবোট টহলে এল না । পরদিন অর্থাৎ ২৬ অক্টোবর সকাল বেলা গোসল সেরে সকালের নাস্তা শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের বিশ্রাম নিতে বলা হয় । ঠিক বেলা ১১টার সময় এক কৃষক এসে আমাকে জানাল, ভাই গানবোট আসতেছে । মুহূর্তের মধ্যে ব্লেন্ডিসাইডসহ মুক্তিযোদ্ধাদের যার যার অবস্থানে যাবার নির্দেশ দেয়া হয় । গানবোট আমাদের আয়ত্তে আসার সাথে সাথে
৫৮
ব্লেন্ডিসাইড গানার ফায়ার করল । মোট তিনিটি গোলা নিক্ষেপ করা হয় । গানবোটে গোলা আঘাত করার সাথে সাথে গানবোটটি ঘুরে যায়, শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে গোলাগুলি । মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত গানবোটটি বাঁকা হয়ে নদীর উত্তর দিকে(যেখানে আমাদের অবস্থান ছিল) আস্তে আস্তে আসতে থাকে ।সাহসী বীর যোদ্ধাদের গুলিতে ৬/৭ জন পাকিস্তানি হানাদার মারা যায়, এর মধ্যে দুজনকে নদীতে পড়তে আমরা অনেকেই দেখেছিলাম । পরমুহূর্তে আমরা দেখতে পাই মুন্সিগঞ্জ টার্মিনাল থেকে অন্য একটি গানবোট বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে মুক্তিযোদ্ধাদের গোলায় ক্ষতিগ্রস্ত গানবোটটিকে রক্ষার জন্য অতিদ্রুত ধেয়ে আসছে । আমরা আমাদের অবস্থান ত্যাগ করলাম এবং নিরাপদ আশ্রয়ে চলে আসলাম । অংশগ্রহণকারী সহযোদ্ধা গানার আতাউর, মতিন, বাতেন, নীরুজ্জামান, সবুজ, কুতুব, মিলন, বাবুল, সামছুদ্দিনসহ আরো অনেকে । দ্রুত লিখতে গিয়ে অনেক সহযোদ্ধার নাম মনে করতে না পারায় আমি তাদের নিকট ক্ষমা চাইছি ।
মোহাম্মদ গিয়াসউদ্দীন, বীর প্রতীক জন্মঃ ৩১শে ডিসেম্বর, ১৯৪৯ । ১৯৬৫ সালে এসএসসি পাস করে সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে যথাক্রমে ১৯৬৭ সালে এইচএসসি ও স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন । হৃদযন্ত্রের ব্যাধিতে ঢাকার মিরপুর হাসপাতালে মারা যান ৫ই ডিসেম্বর, ২০০৪ সালে । অসম সাহসী গিয়াসউদ্দীন অসাধ্য সাধন করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন । এ সংক্ষিপ্ত লেখাটি আমার অনুরোধে তিনি লিখেছিলেন । লেখাটি আকারে ছোট, আজ সেটাই অমূল্য