অপারেশন আড়ানি
আজাদ আলী, বীর প্রতীক
আড়ানি ব্রিজ রাজশাহী জেলায় । আড়ানি দিয়ে সুনসান বয়ে গেছে বড়াল নদ । খুব বেশি চওড়া নয় নদটি । আড়ানিতে বড়ালের উপর ছিল একটি রেলব্রিজ । রাজশাহীর সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগের জন্য রাজশাহী আবদুলপুর রেললাইন ছিল গুরুত্বপূর্ণ । রেলপথটিকে বিচ্ছিন্ন করতে হলে দরকার ছিল রেলব্রিজটি ধ্বংস করা । তাই আমরা ডিনামাইট দিয়ে আড়ানি ব্রিজ ধ্বংসের পরিকল্পনা করি । কিন্তু আড়ানি বাজারে শক্ত অবস্থান ছিল রাজাকার এবং মিলিশিয়াদের । পাকিস্তানি সেনাদের দুটি বাংকার ছিল আড়ানি ব্রিজের পশ্চিম পাশে রেললাইনের উত্তর এবং দক্ষিণ দিকে । আর দুটি বাংকার ছিল নদের পূর্ব পাশে রেললাইন ঘেঁষে । সেতুটি ধ্বংস করতে হলে প্রথম দরকার ছিল রাজাকার মিলিশিয়া ও পাকিস্তানি সেনাদের এ অঞ্চল থেকে হটিয়ে দেওয়া । এ অপারেশন পরিচালনার ভার বর্তায় আমার ওপর । অপারেশন আড়ানি ব্রিজে ২১জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল অংশ নেয় । এছাড়া দলের শক্তি বৃদ্ধির জন্য মেজর রশিদ তাঁর অধীনে থাকা ১১ জন সেনা ও দুজন নৌ কমান্ডারকে যুক্ত করেন আমাদের দলে । শেষ পর্যন্ত সব মিলিয়ে আমাদের সেনাসংখ্যা দাঁড়ায় ৩৫-এ । আমাদের অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে ছিল একটি এলএমজি, তিনটি এসএমসি, ছয়টি ৭.৬২ এমএম এসএলআর এবং ২২টি থ্রি নট থ্রি রাইফেল, ম্যাগনেটসহ আটটি ডিনামাইট, প্রয়োজনীয় কার্ডেক্স এবং টাইম পেনসিল/সুইচ । আড়ানি রেলওয়ে ব্রিজের দক্ষিণে আড়ানি বাজার, উত্তরে জোতরঘু এবং পশ্চিমে বাসুদেবপুর এবং পূর্বে আড়ানি রেলওয়ে স্টেশন । ব্রিজের দুই পাশে আনুমানিক ২০-২৫ জন শত্রুসেনা বাংকার এবং ট্রেঞ্চে অবস্থান করছিল । তাদের মধ্যে চার-পাঁচজন মিলিশিয়া ছাড়া বাকি সবাই বিহারি অথবা বাঙালি রাজাকার । মিলিশিয়া ও রাজাকারদের কাছে শুধু রাইফেল এসএমজি ছিল, কোনো এলএমজি ছিল না ।
৪৮
২২ অক্টোবর, ১৯৭১, ভারতের কাজীপাড়া ক্যাম্প থেকে আমি ও আমার দল আমাদের যুদ্ধাস্ত্র এবং সরঞ্জামসহ হেঁটে পদ্মা নদী পার হয়ে শেষ রাতে তেঁতুলিয়া গ্রামে আসি । তারপর আমাদের দলটি তিনটি ভাগে ভাগ হয়ে একই গ্রামের হযরত আলী, মোগল সরকার ও চিকিৎসক আখতারের বাড়িতে আশ্রয় নিই । দুপুর পর্যন্ত আমরা সবাই তেঁতুলিয়া গ্রামেই বিশ্রাম করি । জুমার নামাজের আজানের সঙ্গে সঙ্গেই আমরা তিনটি সেকশনে ভাগ হয়ে আড়ানি বাজারে পৌঁছে যাই । দুপুর ১ঃ৪৫ মিনিটের দিকে ১ নম্বর সেকশনটি নদীর পাড় বরাবার, ২ নম্বর সেকশনটি আড়ানি গ্রামের পূর্বদিক বরাবর এবং ৩নম্বর সেকশন দুটি দলের মাঝ দিয়ে পাকিস্তানি বাংকারে আক্রমণ চালায় । শত্রুপক্ষও বাংকার থেকে গুলি ছুঁড়ে পাল্টা জবাব দেয় । কিন্তু আমাদের তীব্র আক্রমণের মুখে শত্রুসেনারা টিকতে পারিনি । রেললাইনের উত্তর দিক অর্থাৎ গ্রামের মধ্য দিয়ে তারা পালিয়ে যায় । সর্বডানে আমাদের যে দলটি (২নম্বর) অগ্রসর হয়েছিল, তারা টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হয়েছিল । আমাদের আক্রমণে একজন মিলিশিয়া এবং দুজন রাজাকার নিহত হয় । অস্ত্রসহ ধরা পড়ে দুজন বিহারি । পাকিস্তানি সেনারা অবস্থা বেগতিক দেখে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যায় । শত্রুসেনার চারটি রাইফেল এবং কিছু গোলাবারুদ আমাদের হাতে আসে । এই যুদ্ধে আমাদের তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি ।
৪৯
আমাদের প্রাথমিক অভিযান খুব সহজে সফল হওয়ায় দলের সবাইকে ব্রিজ পাহারার নির্দেশ দিই। ইতিমধ্যে দুইজন নৌ কমান্ডো পরিকল্পনা অনুযায়ী পূর্বদিক থেকে ব্রিজে প্রবেশ করে এবং ব্রিজের মাঝখানের নিচের দুটি স্প্যানে ৮ টি ডিনামাইট লাগায় এবং সাইক্লিক অর্ডারে দুটি সার্কিটের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে টাইম পেনসিল দুটির পিন অপসারণ করে ফেরত আসে। সবাই স্পট থেকে প্রায় ৫০০ গজ দূরে সরে এসে পুনরায় পজিশন নেয়। প্রায় ৩০ মিনিটের মধ্যে প্রচন্ড বিস্ফোরণে ব্রিজের দুটি স্প্যান ভেঙে নদীতে পড়ে যায় এবং ব্রিজ ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। অপারেশন সফল হবার পর আমাদের দলটি ভারতের দিকে চলে যেতে থাকে। আড়ানি ত্যাগ করার পথে আড়ানি বাজারে পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের উপর শেলিং করে। তবে শত্রুদের শেলিং লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। আমাদের কোন ক্ষতি হয়নি।
আড়ানি ব্রিক ধ্বংস ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন। এ ব্রিজ ধ্বংসের ফলে রাজশাহীর সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। শত্রুসেনাদের মনোবলও ভেঙে যায়। সাফল্যে উজ্জীবিত হয় মুক্তিযোদ্ধারা।
আজাদ আলী, বীর প্রতীক
একাত্তরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের দ্বিতীয় বর্ষ সম্মানের ছাত্র। যুদ্ধ করেন ৭ নম্বর সেক্টরে। যুদ্ধে ডানহাত হারান বিস্ফোরণে। অসম সাহসের জন্য সরকার তাঁকে ‘বীর প্রতীক’ বীরত্ব উপাধিতে ভূষিত করেন।