দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিই
তাহের আহমেদ, বীর প্রতীক
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সারা রাত ধরে সমগ্র ঢাকা শহরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বর হত্যাযজ্ঞের তাণ্ডবলীলার স্মৃতি এখনো আমাকে মানসিকভাবে প্রচণ্ড বিচলিত করে । রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে আমার পৈত্রিক বাসস্থান মাত্র এক কিলোমিটার পূর্ব দিকে অবস্থিত । ৩মার্চ থেকে বাসাবো মাঠে আমরা ২০-২১ জন প্রত্যয়ী বন্ধু মিলে পিএমএ থেকে সদ্য বাদপড়া একজন বাঙালি ক্যাডেটের তত্বাবধানে নিয়মিত প্রতি সন্ধ্যায় গেরিলা যুদ্ধের বিভিন্ন কৌশল রপ্ত করছিলাম । আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল, ‘ইয়াহিয়া-মুজিব’ আলোচনা ব্যর্থ হলে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে মাতৃভূমি স্বাধীন করব । উত্তাল মার্চের দিনগুলোতে এমনি একটি প্রত্যয়ী লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে যেতে নিজেকে উত্তরোত্তর সাহসী এবং দৃঢ়চিত্তের অধিকারী মনে হতে লাগল । ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় ডেমরা এলাকায় অ্যামবুশের মহড়া শেষ করে রাত পৌনে ১০টার দিকে বাসাবো মাঠে ফিরে এসে লক্ষ্য করলাম সমগ্র এলাকা কেমন যেন এক অসহনীয় থমথমে ভাব এবং এলাকার সব লোকজন দ্রুত যার যার বাড়িতে ফিরে যাচ্ছেন । ঠিক যেন এক প্রলয়ের পূর্বাভাস । রাত সোয়া ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে পশ্চিম দিকে খুব কাছ থেকে প্রথম এক ঝাঁক গুলির শব্দ শুনতে পেলাম । মনে হলো রাজারবাগ পুলিশ লাইনের দিক থেকে শব্দের উৎপত্তি । বন্ধুরা কয়েকজন মিলে সাহস সঞ্চয় করে ঠিক করলাম সতর্কতার সঙ্গে খিলগাঁও রেল ক্রসিংয়ের কাছে গিয়ে প্রকৃত ঘটনা জানার চেষ্টা করব । ইতোমধ্যে গোলাগুলির প্রচণ্ডতা ভয়ানকভাবে বেড়ে গেছে । শাহজাহানপুর থেকে দৌড়ে ছুটে আসা দু-একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম পুলিশ লাইনকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে রেখে পাকিস্তানি সেনারা লাইনের ভেতর প্রতিরোধরত বাঙালি পুলিশ সদস্যদের ওপর ভারী অস্ত্র থেকে গুলি করছে এবং শহরের অন্যান্য এলাকায়ও যথা পিলখানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি স্থানে একইভাবে পাকিস্তানি হায়েনারা বর্বর আক্রমণ শুরু করেছে । দ্রুত বাসায় ফিরে এলাম । মা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আমাদের (সাত ভাইবোন)নিয়ে বাড়ির উঠানের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ময়লা ফেলার গর্তে দ্রুত
৩৪
আশ্রয় নিলেন এবং সবাইকে উচ্চস্বরে দোয়া পাঠ করতে বলেন । ২৫ মার্চের কয়েকদিন আগে থেকে আমার বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী । রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ওপর গোলাগুলির কিছু অংশ লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে আমাদের বাসার আশপাশে পড়তে লাগল । আশ্রয় নেওয়া সেই ময়লার গর্ত থেকে হতাশা ও আতঙ্কে ক্রমশ উপলব্ধি করতে লাগলাম যে উত্তাল মার্চের প্রথম দিনগুলোতে একটু একটু করে সঞ্চিত সাহস এবং চিত্তের দৃঢ়তা যেন ক্রমেই ফিকে হয়ে যাচ্ছে । একসময় মাকে আঁকড়ে ধরলাম হারিয়ে যাওয়া সাহস ফিরে পাওয়ার জন্য । কিন্তু হতাশা ও ক্ষোভে আমার মাও কাঁদছে এবং কাঁপছেন ।অস্পষ্ট গলায় বলেন, ‘বাবা, আমাদের বুঝি সবই শেষ হয়ে গেল’। পরদিন অর্থাৎ ২৬ মার্চ সকাল ১০টায় বাসাবো মাঠের কোণো একটি রেস্তোরাঁর সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এবং প্রধান সামরিক শাসক জেনারেল টিক্কা খানের দম্ভভরা ভাষণ মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম । মূলত পূর্ব পাকিস্তানি বাঙালিদের চিরতরে দমন করে রেখে পাকিস্তানে শুধু দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বাঁচিয়ে রাখার তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ সেই ভাষণই আমার মনকে তাৎক্ষণিকভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে আর একত্রে না থাকার জন্য চূড়ান্তভাবে বিদ্রোহী করে তোলে । তখনই ঠিক করলাম যদি কোনো সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়, আমি তাতে যোগ দেবই । হয় স্বাধীন, না হয় মৃত্যু । বাসায় গিয়ে মাকে আমার মনের অবস্থা ব্যক্ত করলাম । তিনি আমাকে প্রবল এক আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে আবারও কেঁদে ফেললেন । কিন্তু আমার বড় ভাই তহুরুর রহমান সে কথা শুনে বলেন, ‘আমাদের চারপাশ অবাঙালি দ্বারা পরিবেষ্টিত । তুমি সে রকম কোনো সিদ্ধান্ত নিলে ওরা আমাদের পুরো পরিবারকে মেরে ফেলবে’। কিন্তু মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বলতে শুরু করলে তাকে কে নেভায়! ঠিক করলাম অসুস্থ পিতাকে হাসপাতাল থেকে এনে বড় ভাই ছাড়া (তিনি ব্যাংকে চাকরি করতেন) মা, বাবা এবং ছোট ভাইবোনদের নিয়ে গ্রামের বাড়িতে (নোয়াখালীর চাটখিল থানার অন্তর্গত) রেখে আমি স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেব । ২৭ মার্চ বিকেলে আমরা ঢাকার বাসাবোর বাসা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পূর্বদিকমুখী শত-সহস্র মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়ে মাদারটেক হয়ে মাধবদীর এক বাড়ির উদ্দেশে প্রাথমিক যাত্রা শুরু করি । অসুস্থ বাবার কারণে আমরা মাত্র বাসাবো সংলগ্ন মাদারটেক পর্যন্ত যেতে পেরেছিলাম রাত সাড়ে ১০টায় । সেখানে আমরা ছাড়াও আরও অনেক নারী-পুরুষ ও শিশু ছিল । অচেনা এক অবস্থাপন্ন কৃষক আমাদের সবাইকে আগ্রহভরে রাতের খাবার ও আশ্রয় দেন । তাঁর সেই আতিথেয়তার জন্য হৃদয় নিংড়ানো কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য । বস্তুত, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ওই কৃষকের মতো সারা দেশে বহু মানুষ মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় সহযোগিতা করেছিলেন । সমগ্র জাতি তাঁদের সেই অবদানের জন্য চিরকৃতজ্ঞ ।
৩৫
রাত ১১টার দিকে আমি কালুরঘাটে বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হৃদয়স্পর্শী এবং পরম কাঙ্ক্ষিত সেই বেতার ঘোষণা শুনতে পাই, আই মেজর জিয়া, প্রভিশনাল কমান্ডার-ইন-সেইফ অফ দ্যা বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মি, হেরেবি প্রচলিয়াম, অন বেহাফ অফ শেখ মুজিবর রাহমান, দ্যা ইন্ডিপেন্ডেনস অফ বাংলাদেশ’। উপস্থিত জনতার মধ্যে তখন আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করে ‘জয় বাংলা’ মুহুর্মুহু উচ্চারিত হতে লাগল । ২৯মার্চ ভোরে যাত্রা শুরু করে বেলাব ফেরিঘাট নৌকায় পার হয়ে রাত নয়টায় আমরা মাধবদীতে আমার খালাতো ভাই নেছার আহমেদের বন্ধু সামাদ সাহেবের বাড়িতে গিয়ে উঠলাম । সেখানে ১০-১২দিন ছিলাম । ৭এপ্রিল মাধবদী বাজারের কাছে ঢাকা-নরসিংদী রোডে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের একটি দল নরসিংদীর দিকে যাওয়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি কনভয়কে অ্যামবুশ করে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে । গোলাগুলি থামলে আমরা বিকেলে ঘটনাস্থলে গিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের কৃতজ্ঞতা জানালাম এবনহ নিজে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য আরও উদ্বুদ্ধ হলাম । পরে মাধবদী (চাইটখিল) ত্যাগ করে আশুগঞ্জ, চাঁদপুর ও রায়পুর হয়ে ২০এপ্রিল নিজ গ্রাম নিজাভাওর পৌঁছলাম । ইতোমধ্যে মা আমার মনোভাব সম্ভবত বুঝতে পেরে এক টাকার ১০০টি নোটের দুটি বান্ডিল আমার ব্যবহৃত ক্যারিয়ার ব্যাগের পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছিলেন, যাতে তা যেন সহজে নজরে পড়ে । এ যেন মা ও ছেলের এক অদ্ভুত লুকোচুরি খেলা । একদিকে মেকে চলে যাওয়ার চূড়ান্ত মুহূর্তে বলে যেতে না পারার ছেলের সাহসের অভাব-কি জানি না তাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলার ভয়ে কিছু একটা করে বসেন-ওদিকে মা হয়তো ভাবছেন, তাঁর মানিক চলে যেতে চাইলে তাকে আঁকড়ে ধরে রাখেন । এপ্রিলের ২৬তারিখে নিজ গ্রাম ও আশেপাশের ১৫-১৬ জন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণেচ্ছু উৎসাহী তরুণকে নিয়ে দূর থেকে মাকে এক নজর শ্রদ্ধাভরে দেখে ভারতের উদ্দেশে রওনা হই । ১৯৭১ সালে আমি ঢাকা কলেজের বিএসসি শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলাম । এপ্রিল মাসে আমাদের ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল । কিন্তু-মুক্তিযুদ্ধ আমার শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি সেখানেই টেনে দিল । ভারতে গিয়ে ২নম্বর সেক্টরের অধীনে মেলাঘর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত মেজর হায়দারের তত্ত্বাবধানে গেরিলাযুদ্ধের উপযোগী সব ধরনের কৌশলের প্রশিক্ষণ নিই । বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে রাতের বেলায় শত্রুর অবস্থান পর্যবেক্ষণ করা ছিল এই প্রশিক্ষণের উল্লেখযোগ্য অংশ । অতঃপর জুন মাসের শেষ সপ্তাহে ‘প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্স’ নামের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সর্বপ্রথম কমিশন ট্রেনিং নম্বর সেক্টরের অধীনে ‘ডাল’ সাব সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হই । ১৬ অক্টোবর আমি আমার সাব সেক্টরের দায়িত্ব গ্রহণ করি ।
৩৬
হালুয়াঘাট থানার অন্তর্গত সীমান্তসংলগ্ন শক্তিশালী তেলিখালি ইপিআর ক্যাম্প আক্রমণ যুদ্ধ, নকলা থানা মুক্তিযুদ্ধ ও ময়মনসিংহ-জামালপুর রেল যোগাযোগ লাইনে মধ্যবর্তী বিদ্যাগঞ্জ-বেগুনবাড়ি রেল ব্রিজ সংলগ্ন ‘বুরেরচর’ গ্রামের যুদ্ধে সামনে নেতৃত্ব দিই । আজ সীমিত পরিসরে শুধু ‘বুরেরচরের’ যুদ্ধ সম্পর্কে বলতে চাই । কারণ, ওই যুদ্ধটি ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ, যা প্রায় ৩০ ঘন্টা স্থায়ী হয়েছিল এবং এ যুদ্ধে সাহসিকতা, বিভক্ষণতা ও দৃঢ় নেতৃত্বের জন্য আমাকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয় । যদিও খেতাব পাওয়ার উপযুক্ত আরও বেশ কয়েকজন সহযোদ্ধা ছিলো কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপর সেদিকে নজর দেওয়ার মতো মানসিকতা ও প্রস্তুতি তখনকার সামরিক বেসামরিক নেতৃত্বের ছিল না । যুদ্ধে আমার সাহসিকতা এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিপুল ক্ষয়ক্ষতির কথা আমি কখনো আমার কোনো উধর্বতন সামরিক কর্মকর্তাকে বিশদভাবে জানানোর ইচ্ছা পোষণ করিনি এবং তা করার জন্য পর্যাপ্ত সময় ও সুযোগও পাইনি । কারণ’ ১৯৭২ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি ছয় মাসের জন্য বিদেশে উচ্চতর সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত হয়ে চলে যাই । পরে জানতে পারি, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে আমার ব্যাটালিয়ন কমান্ডার আমার সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে বুরেরচর যুদ্ধ সম্পর্কে শুনে আমাকে বীরত্বপূর্ণ খেতাবের জন্য সেনা সদরে সুপারিশ পাঠান । যা হোক, আমার অন্যান্য সহযোদ্ধারা ওই যুদ্ধে অপরিসীম সাহসিকতা প্রদর্শন সত্ত্বেও কোনো সাহসিকতার খেতাব না পাওয়ার দায়িত্বভার আমার ওপরে কিছুটা বর্তায় । সেই অপারগতার গ্লানিতে আমি ওই যুদ্ধে শহীদ ও জীবিত সব সহযোদ্ধাকে আমার বীরত্বসূচক খেতাবটি উৎসর্গ করলাম । বুরেরচরের যুদ্ধ বর্তমান শেরপুর জেলার নকলা উপজেলার পুরাতন বেক্ষপুত্র নদের পাশে বুরেরচর গ্রাম । ২৫ নভেম্বর বিকালের দিকে ৬০ জন বাছাই করা সাহসী মুক্তিযোদ্ধা এবং মাসে ৪০০ পাউন্ড পিইকে এক্সপ্লোসিভ ও একটি বিশেষ অপারেশনের জন্য পয়োজনীয় গোলাগুলি, তিনটি হালকা মেশিনগান, ১০টি সাবমেশিনগান, ১০/১২টি থ্রি নট রাইফেল নিয়ে সেখানে পৌঁছাই । এই গ্রামকেই ‘বিশেষ অপারেশনের, জন্য চূড়ান্ত হাইডআউট হিসেবে নির্বাচন করি । বিশেষ অপারেশনটি ছিল বেগুনবাড়ি-বিদ্যাগঞ্জ ব্রিজটি এক্সপ্লোসিভ দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে ময়মনসিংহ-জামালপুর রেল যোগাযোগটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে অকেজো করে দেওয়া । বিলের মাঝামাঝি উত্তর-দক্ষিণ বরাবর একটি বাঁধ বুরেরচর গ্রামকে পূর্ব ও পশ্চিমে দুই ভাগে ভাগ করেছে । আমরা পশ্চিম দিকে অপেক্ষারত শুকনো জায়গায় অবস্থিত মোট চার-পাঁচটি বাড়িতে অবস্থান নিয়েছি । নকলা থানা অঞ্চল থেকে নেওয়া গাইড
৩৭
আবুল পারি এবং তার সহযোগী আমাকে সতর্ক করে দিল যে বুরেরচর ও এর আশপাশের অঞ্চলের বেশকিছু তরুণ ফুলপুরে রাজাকার-আলবদর ক্যাম্পে যোগ দিয়েছে । তাৎক্ষণিক স্থানীয় ‘সহযোগী, মুক্তিযোদ্ধা’ এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণেচ্ছু নির্ভরশীল কয়েকজনের কাছ থেকে জানতে পারলাম যে পাকিস্তানে বিশ্বাসী মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘের কিছু তরুণ স্বেচ্ছায় যোগ দিলেও অধিকাংশ তরুণকে গ্রাম/ইউনিয়ন পিস (শান্তি)কমিটির নেতারা জোর করে অথবা মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে অথবা ঘর থেকে মা বোনকে উঠিয়ে নিয়ে পাকিস্তানি ক্যাম্পে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে রাজাকার ও আলবদর বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করে । এই সংবাদ এতই বাস্তব ছিল যে আমার হাবিলদার মেজর মো. ইদ্রিস আলী (ইদ্রিস আলী মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ময়ময়সিংহ ১৩ ইপিআরের এজকজন ল্যান্সনায়েক ছিলেন এবং তিনি সেখানে ১৩ ইপিআর রাইফেলের একটি কোম্পানির এলএমজি ম্যান ছিলেন । দুর্ধর্ষ এই বীর মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার এলএমজি ছয়টি গুলিভর্তি ম্যাগজিন এবং ম্যাগজিন রক্ষিত একটি স্টিলের বাক্স নিয়ে সক্রিয় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন ।)আমাকে জানান, যে বাড়িতে আমার থাকার ব্যবস্থা করল সেই বাড়ির মালিকের ছেলেই একজন রাজাকার! তার সঙ্গে আলাপচারিতায় সে স্বীকার করল যে তার ছেলে ফুলপুরে রাজাকার ক্যাম্পে আছে ।আমাদের মনোবল তখন তুঙ্গে । দু-তিন দিনের ভেতর রেলওয়ে ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়ার সম্ভাব্য সাফল্যের কল্পনায় সবাই রোমাঞ্চিত । আমি আমার সব সহযোদ্ধাকে ডেকে সতর্ক থাকে । আমাদের তার বাড়িতে নিশ্চিন্তে থাকার নিশ্চয়তার লক্ষ্যে প্রথম রাতের খাবার ওই রাজাকারের বাবাই স্বতঃস্ফুর্ত হয়েই আয়োজন করলেন । তবুও পরবর্তী দুই-তিন দিন এক মুহূর্তের জন্যও ওই লোকের প্রতি আমার বিশেষ নজরদারি শিথিল করিনি । ২৬ ও ২৭ নভেম্বর আমি এক্সপ্লোসিভ ব্যবহারে বিশেষ প্রশিক্ষণ নেওয়া পাঁচ-ছয়জনের রেকি পার্টি সকাল-সন্ধ্যা পাঠিয়ে রেলওয়ে ব্রিজের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, নির্মাণ কাঠামো, ব্রিজটি পাহারায় কতজন শত্রুসেনা মোতায়েন আছে এবং তাদের কাছে কী কী ভারী অস্ত্র আছে ইত্যাদি তথ্য সংগ্রহ শুরু করি । আমি মন স্থির করি যে ২৮ তারিখ সকাল ও সন্ধ্যায় আমি নিজে ব্রিজটি পর্যবেক্ষণ করে ২৯/৩০ নভেম্বর ভোরের মধ্যে ব্রিজটি ৪০০ পাউন্ড এক্সপ্লোসিভ চার্জ দিয়ে ধ্বংস করব । ময়মনসিংহ থেকে রাতে দু-একটি ট্রেন জামালপুর পর্যন্ত আসা-যাওয়া করত । বেগুনবাড়ি স্টেশনে ট্রেন এলে আমি সতর্ক হয়ে যেতাম । অবশ্য পাঁচ-ছয় মিনিট পর ট্রেন নিয়মমাফিক ছেড়ে দিলে আবার শঙ্কামুক্ত হতাম । ২৮ নভেম্বর মধ্যরাত পেরিয়ে ২৯ নভেম্বর ভোর তিন-চারটার দিকে আগের সময়সূচি ভঙ্গ করে একটি ট্রেন বেগুনবাড়ি আসে এবং আধা ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও স্টেশন ত্যাগ করার কোনো লক্ষণ না দেখে আমার অনুধাবন করতে এতটুকু অসুবিধা হলো না যে আসলে
৩৮
ট্রেনটি পাকিস্তানি সেনা নিয়ে আসা একটি ‘বিশেষ ট্রেন’ এবং সম্ভবত তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো সূর্য উদয়ের প্রাক্কালে আমাদের অবস্থানে আক্রমণ করা । পুনশ্চঃ অনেক বছর পার হয়েছে বুরেরচরের যুদ্ধ । তত দিনের অনেক স্মৃতি কালের গহবরে ঢুকে এখন বিস্মৃত হয়েছে । সহযোদ্ধাদের সবার নাম ও অনেক ঘটনা হারিয়ে গেছে স্মৃতি থেকে । এই লেখার কিছু দিনক্ষণ ভুল হতে পারে । এ অপারগতার সব দায় আমার একার । এখন প্রচণ্ড আক্ষেপ হয়, কেন সময়মতো স্মৃতিগুলো লিপিবদ্ধ করিনি । আমাকে কি বর্তমান কিংবা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ক্ষমা করবে? আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি আমি ত্বরিৎ গতিতে শোয়া অবস্থা থেকে উঠে গেলাম এবং হাবিলদার ইদ্রিস ও অন্যান্য অভিজ্ঞ মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে দ্রুত মতামত বিনিময় করি । অন্যান্য বাড়িতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পৃর্ণ সতর্ক করে দিয়ে পৃর্ব নির্ধারিত স্ব স্ব ডিফেনসিভ অবস্থানে অস্ত্র নিয়ে শত্রু আক্রমণের জন্য প্রস্তুত থাকতে বললাম । যেহেতু আমরা একটি বিলের মধ্যে ছিলাম, সেহেতু আক্রমণ যেকোনো দিক থেকে আসার আশঙ্কা ছিল এবং আমরা সবাই চরম এক উত্তেজনা নিয়ে যে কোনো দিক থেকে শত্রুর আক্রমণের অপেক্ষায় চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম । পূর্বদিগন্তে ভোরের আকাশ মাত্র ২৯ নভেম্বরের দিনটির যাত্রা শুরু করল, ঠিক তখনই আমাদের পূর্ব দিকে অবস্থিত বেড়িবাঁধের পূর্ব পাশে বুরেরচর গ্রামের অবশিষ্ট বাড়িগুলো থেকে ‘টাক ডুম’ শব্দ করে প্রথম গুলির আওয়াজ আমাকে নিশ্চিত করল, যে প্রথম আক্রমণটা খুব সম্ভবত পৃর্ব দিক থেকে আসছে । মুহূর্তের মধ্যে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সব সহযোদ্ধাকে নিজ নিজ অবস্থান ছেড়ে দ্রুত নিচে নেমে উত্তর-দক্ষিণে লম্বা লাইনে সঙিন উঁচু করে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বেড়িবাঁধের দিকে দৌড়ে গিয়ে সেটা দখল করে তার গোড়ায় অবস্থান নিতে চিৎকার করে নির্দেশ দিই এবং একই সঙ্গে সহযোদ্ধা নজরুল (ঢাকার মিরপুর), আবুল পারি (নকলা), শেরপুরের মনিরুল ইসলামকে (১৪/১৫ বছরের দুর্দান্ত সাহসী মুক্তিযোদ্ধা (ঢাকার শেরেবাংলা নগর) দ্রুতগতিতে গিয়ে দক্ষিণ ও উত্তর দিকের বাড়িগুলোতে অবস্থানরত সব সহযোদ্ধাকে আমার আদেশ পরিস্কার বুঝিয়ে দিতে পাঠিয়ে দিলাম । ওই সময় আমার নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল, যে পক্ষই ওই বেড়িবাঁধ আগে দখল করে তার আড়ালে অবস্থান নেবে সে পক্ষই ওই যুদ্ধে জয়ী হবে এবং তা করব বলেই দৃঢ়চিত্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি । তিন-চার মিনিটের মধ্যে নভেম্বরের শীতের কুয়াশায় আবছা ঢাকা বেড়িবাঁধের ওপারে থেকে শত্রুদের সমবেত কন্ঠে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি শুনতে লাগলাম এবং আমাদের সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত করে কয়েকজন রাজাকার ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি করতে করতে আমাদের অবস্থানের দিকে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে বাঁধ আক্রমণ করে এগুতে লাগল । বোঝা গেল পাকিস্তানি সেনাদলের মূল অংশটি তখনো বাঁধের পূর্ব দিকের বাড়িগুলোতে অবস্থান নিয়ে আছে । আর
৩৯
কালবিলম্ব না করে আমি সহযোদ্ধাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সঙিন উঁচু করে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে বাঁধের দিকে দৌড়াতে শুরু করলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার ৭০ জনের অধিক সহযোদ্ধা আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করে । ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে দুর্বার বেগে বাঁধের দিকে সুশৃঙ্খলভাবে ধাবিত হতে লাগল । সামনে তাকিয়ে দেখলাম, আমাদের এই অপ্রত্যাশিত হুংকার এবং প্রচণ্ড গতি দেখে বাঁধের এপাশে চলে আসা তিন-চারজন রাজাকার আলবদর আতঙ্কিত হয়ে উল্টো দিকে ফিরে দৌড়ে বাঁধ অতিক্রম করে অল্প কাদাযুক্ত নাড়ার ক্ষেতের উপর দিয়ে পূর্বদিকের বাড়িগুলোর দিকে পালাতে লাগল । এই সময় ওখান থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কমান্ডারদের পুনঃপুনঃ চিৎকার শুনতে পেলাম, ‘শালা লোক ওধার পজিশন লেও, পিছে মাত আও’। কিন্তু তাদের পিছে পিছে নেকড়ের গতিতে ধেয়ে আসা মুক্তিপাগল একদল দুর্দান্ত তরুণের ছোঁড়া গুলিতে নিশ্চিত মৃত্যুভয় তাদের পাকিস্তানি ওসব কমান্ডারদের আদেশ মানতে কোনো রকম অনুপ্রণিত করল না । এক মিনিটের মধ্যে এক প্রচণ্ড বেগে আমরা বেড়িবাঁধ দখল করে ফেললাম । আমাদের হেডকোয়ার্টারে ছিল হাবিলদার ইদ্রিস এলএমজি নিজে বহন করছে বিধায় সে এবং তার এলএমজিম্যান-২ আমাদের ১০ গজ পিছে ছিল । এর মধ্যে পাকিস্তানিদের দিক থেকে আমাদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু হয়ে গেছে । যেই মুহূর্তে আমি এবং মুজিবর বাঁধের গোড়ায় সেই মুহূর্তে যুদ্ধ কৌশলের রীতি অনুযায়ী পৌঁছে গেলাম, আমি সতর্ক ছিলাম যেন আমার মাথা বা শরীরের কোনো অংশ শত্রুর দৃষ্টিতে না পড়ে । কিন্তু টগবগে তরুণ মুজিবরের সেই সম্মুখযুদ্ধ কৌশলের সার্বিক প্রশিক্ষণ জানা ছিল না বিধায় কিছু না বুঝে ওঠার আগেই দেখলাম, সে সম্ভাব্য শত্রু নিধনের চরম উত্তেজনায় দুর্বার গতিতে এসে বেড়িবাঁধের ওপর উঠেই দৃঢ়ভাবে মুষ্ঠিবদ্ধ ডান হাতটি সজোর আকাশের দিকে ছুঁড়ে মেরে প্রচণ্ড গলায় ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে লাফিয়ে উঠল । প্রায় একই সঙ্গে দেখলাম ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিটি তার মুখ থেকে সম্পূর্ণ উচ্চারিত শেষ হওয়া অস্পূর্ণ থাকতেই তরুণ মজিবর একই যেন প্রচণ্ড একটি অশুভ ধাক্কায় ছিটকে বাঁধের গোড়ায় আমার শরীর ঘেঁষে পড়ে গেল । দেখতে পেলাম তার গলার ডান পাশ একটি ক্ষত থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে । ঘাতকের একটি নিষ্ঠুর গুলি তার ডান চোয়ালের নিচে আঘাত করল । ইদ্রিসের কাছ থেকে গামছা নিয়ে বৃহদাকার ক্ষতস্থানে চেপে ধরলাম । কিন্তু প্রচুর রক্তপাত কোনোক্রমেই বন্ধ করতে পারলাম না । মুজিবর আমার বাম হাতটা খুব জোরে চেপে ধরে মাত্র ১৫ সেকেন্ডের মধ্যে নিজের শরীরের অজস্র রক্তে বাংলা মায়ের বদনখানি রঞ্জিত করে চিরবিদায় নিয়ে চলে গেল । গ্রামের এই সরল যুবকের রক্তের ঋণ আমরা এখনো পরিশোধ করতে পারিনি । স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের বীরত্ব-সূচক কোনো সম্মান তো দূরের কথা, তার অমর কীর্তির কথাটি পর্যন্ত আমরা কোথাও লিপিবদ্ধ করতে পারিনি । আমি সে জন্য নিজেকে অপরাধী মনে করি এখনো ।
৪০
ইতোমধ্যে দুই পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গোলা বিনিময় শুরু হয়ে গেছে । আমাদের কৌশলগত সুবিধাজনক স্থানে অবস্থানের কারণে, ‘নাড়া ক্ষেতে’ ইতস্তত পড়ে থাকা এবং বাঁধের পূর্ব দিকের দু’তিনটি বাড়িতে প্রচুরসংখ্যক পাকিস্তানি নিয়মিত সেনা রেঞ্জার এবং আলবদর ও রাজাকার সমন্বয়ে গঠিত শত্রু পক্ষ ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়ে এবং তাদের পরিস্কারভাবে দেখে-শুনে নির্দিষ্ট লক্ষ্য ভেদ করতে পারছিলাম । আমার মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল রেলওয়ে ব্রিজটি উড়িয়ে দেওয়া, বুরেরচরের মতো একটি সম্মুখযুদ্ধে বেশিক্ষণ জড়িয়ে পড়ার মতো অতিরিক্ত গোলা-বারুদ আমার দলে ছিল না । তখন আমি ‘ফায়ার শৃঙ্খলার’ দিকে নজর দিলাম এবং সবাইকে নির্দেশ দিলাম যে, শত্রুর অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এবং তাকে নিশ্চিত ঘায়েল না করতে পারলে কোনো গুলি খরচ করা যাবে না । তিনটি এলএমজির একটি আমি নিজে চালাতে লাগলাম । সকাল নয়টা নাগাদ কুয়াশা কেটে অনেকাংশে দেখতে পেলাম বাঁধের দক্ষিণ প্রান্তে (আমাদের অবস্থান থেকে ৭০০-৮০০ গজ) শত শত গ্রামবাসী জট হয়ে কৌতূহলভরে আমাদের এবং শত্রুপক্ষের মধ্যে যুদ্ধ উপভোগ করছে । দুর্ভাগ্যবশত বুরেরচর গ্রামের পূর্বাংশের দক্ষিণ দিক থেকে ১৫০-২০০ গজ দূরে সক্ষিণে একটি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা কৌতুহলী এক তরুণী কুলবধূ ও কোলে থাকা তার ছোট্র একটি শিশু উভয়ই মারাত্মকভাবে গুলিবিদ্ধ হয় । অবশ্য পরে জেনেছি যে অলৌকিকভাবে দুজনই বেঁচে যায় । আমার সহযোদ্ধাদের দক্ষিণাংশের একটি ছোট দল, তাদের কমান্ডার আবদুল আলীম । যুদ্ধ-পূর্বকালীন সময়ে সে নকলা থানা এলাকায় ডাকাতি করত বলে জনশ্রুতি ছিল এবং সে এলাকায় ভূত নামেও নাকি পরিচিত । তার সম্পর্কে এবং যুদ্ধে তার দুঃসাহসিকতার কাহিনি লিখে বর্তমান পরিসরে শেষ করা যাবে না । সে আমার কাছে এসে বলল, ‘স্যার, আপনি অনুমতি দিলে আমি আমার অবস্থানের উল্টো দিকে শত্রুপক্ষকে আরও দক্ষিণ দিক থেকে গিয়ে ঘায়েল করতে কিংবা সারেন্ডার করতে চেষ্টা করাতে পারি’। যুক্তি হিসেবে সে বলল, ওই দলে কিছু রাজাকার এবং পুলিশ সদস্য তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছে, তারা আত্মসমর্পণ করতে ইচ্ছুক । আমি তাকে সতর্ক করে দিয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘আবদুল আলীম, এটা তো এমনও হতে পারে যে কৌশলে তোমাকে সেখানে নিয়ে তুমি এবং তোমার সহযোদ্ধাদের তারা বন্দি করে ফেলবে’ উত্তরে আবদুল আলীম অত্যন্ত দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, ‘স্যার, আপনার দোয়া থাকলে ‘ফাইয়ার’ (অর্থাৎ পাকিস্তানিরা) আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না এবং আমি নিশ্চিত যে শত্রুপক্ষের ওই লোকগুলো প্রকৃতই আত্মসমর্পণ করতে চায়’। যা হোক, যুদ্ধে অধিকতর পাওয়ার আশায় ঝুঁকিও কিছুটা নিতে হয়, তাই আমি রাজি হয়ে তাকে খুবই সতর্কতার সঙ্গে প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে বললাম এবং সর্বদক্ষিণে অবস্থিত এলএমজিম্যান মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ (যুদ্ধ-পূর্বকালে পুলিশে চাকরি করতেন) মুক্তিযোদ্ধা কাসেম (সম্ভবত টাঙ্গাইলের), মুক্তিযোদ্ধা নজরুল প্রমুখকে আবদুল আলীমের দুঃসাহসিক অভিযানে কাভারিং ফায়ার দিতে নির্দেশ
৪১
দিলাম । আনুমানিক আধা ঘন্টা পর আবদুল আলীম ময়মনসিংহ কোতায়ালী থানার ওসি, সাব-ইন্সপেক্টর আবুল হোসেনসহ ১২জন বিভিন্ন পদমর্যাদার পুলিশ সদস্য, একজন গুরুত্বর আহত কালো ড্রেস পরা আলবদর সদস্য এবং জানা তিনেক রাজাকার ধরে নিয়ে সগর্বে আমার সামনে উপস্থিত । আমি আবদুল আলীমের সাহসিকতায় বিস্মিত না হয়ে পারলাম না । তাকে আন্তরিক ধন্যবাদ দিয়ে তার আগের অবস্থানে যেতে বললাম এবং দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক থেকে কোনো সম্মান বা পদক আমি এবং আমরা দিতে তো পারলাম না বরং তার নামে স্বাধীনতা-পূর্ব ডাকাতির কয়েকটি মামলা তার পিচু নিয়ে তাকে বেশ কিছুদিন লোকচক্ষির আড়ালে নিয়ে গিয়েছিল । বেলা বাড়তে লাগল । প্রায় সকাল সাড়ে ৯টা-১০টা, আমরা সবাই দেখে-শুনে একটি একটি করে শত্রু নিধনে ব্যস্ত এবং পাকিস্তানিদের ছোঁড়া ইতস্তত দুই ইঞ্চি মর্টার শেল যখন আমাদের সমূহ ক্ষতি করতে পারছিল না, তখন এই যুদ্ধরত দলের লিডার হিসেবে একটি সুগভীর সুশ্চিন্তা আমাকে তাড়া করছিল যে, সবাইকে তো খাবার দিতে হবে । তারা শেষ খাবার খেয়েছে গত রাতে । তখন সৈনিকের সেই বেদ বাক্য ‘সলডার মারচেস অন বেলি’ (সৈনিক পেট ভরা থাকলে হাঁটে) ভীষণ মনে পড়তে লাগল । রাত আটটার দিকে । কিন্তু কী আশ্চর্য, আমার প্রিয় সহযোদ্ধারা খাবারের জন্য এতটুকুও বিরক্ত করছে না, তারা শুধু শত্রু নিধনে বিভোর । যা হোক, আমি ও ইদ্রিস যখন খাবার নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়তে লাগলাম, তখন দেখি দক্ষিণ গ্রাম থেকে বাঁধের আড়ালে আমাদের দিকে দু-তিন জন লোক আসছে । প্রথমে ভাবলাম, শত্রুর কোনো চাল নয় তো? আরও তিন-চার মিনিট গেলে বুঝতে পারলাম দুজন লোক লুঙ্গি মালকোচা করে একটি বেশ বড় টুকরি ধরাধরি করে কিছু একটা নিয়ে আসছে । একটু পর দেখলাম টুকরি থেকে ভাপ উঠছে । চোখ বুজে বিধাতাকে কৃতজ্ঞতা জানালাম তাঁর ওই মহানুভবতায় । টুকরিভর্তি গরম ভাঁপাপিঠা । শুনলাম যে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে দূরের দক্ষিণের ঐ গ্রামের সব নারী একত্র হয়ে ভাঁপাপিঠা বানিয়ে তাদের স্বামীদের দিয়ে ওই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পথে আমাদের জন্য পাঠিয়েছে । বুরেরচরের যুদ্ধে ওই গ্রামের মানুষেরা বিশেষ করে নারীরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন আমাদের খাদ্য সরবরাহ করে । পরম তৃপ্তিতে সবাই প্রায় দুটো করে ভাঁপাপিঠা খেয়ে আবার যুদ্ধে মনোনিবেশ করলাম । তাহের আহমেদ, বীর প্রতীক