You dont have javascript enabled! Please enable it!

আখাউড়া এলাকার কয়েকটি যুদ্ধ
মতিউর রহমান, বীর প্রতীক

একাত্তর সাল। বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার মহা জাগরণের উত্তাল তরঙ্গ সর্বত্র তথা সারা বাংলার আনাচে কানাচে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, যুবক যুবতীকে জাগিয়ে তুলেছিল। স্বাধিকার আন্দোলন থেকে এক দফা স্বাধীনতার জাগরণে জেগে উঠেছিল টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত। সর্বস্তরের দেশপ্রেমিক বাঙালি নারী-পুরুষ। তাই রেসকোর্স ময়দানে ৭ ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর বজ্রকন্ঠে যে সত্য উচ্চারিত হয়েছিল সেই উচ্চারণই ছিলো স্বাধীনতার এক দফার ঘোষণা- এবারের সংগ্রাম, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমাদের যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় দুর্গ গড়ে তোল। জয় বাংলা। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটি ছিল স্বাধীনতার দিক নির্দেশনা। তাই ৭ ই মার্চ হতেই বাংলার সর্বস্তরের জনগণ, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় গ্রামে গঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি (স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেছিল।) আমরা বাঙালি সৈনিকরাও ৭ ই মার্চের ভাষণেই স্বাধীনতার সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা পেয়েছিলাম। আমরা প্রথমে পাকিস্তানের ডেরা ইসমাইল খানে জিসি ট্রেনিং শেষে, ও পরে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার (ইবিআরসি) চট্টগ্রামে প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে ঢাকা সেনানিবাসের বালুর ঘাট বিমান বাহিনীর সাথে ৩৮ নং প্লাটুনে যুদ্ধ বিমান সংরক্ষণ কোম্পানির এমওডিসিতে যোগদান করি। আমরা সকলেই ছিলাম ১৭/১৮ বছরের নবীন সৈনিক, উত্তপ্ত, টগবগে রক্ত। রাজনীতি সম্পর্কে কোন ধারণাই আমাদের ছিলনা। তবে আমরা পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলাম পাকিস্তানি শাসিক গোষ্ঠি কোন রকমেই হার মানতে চাইবেনা। যুদ্ধ অনিবার্য। যুদ্ধ ছাড়া পাকিস্তানি শাসকদের হার মানানো সম্ভব নয়।
৭ মার্চের পর প্রতি মূহুর্তই ছিল শ্বাসরুদ্ধকর তারপর অবাঙালি বিহারিদের যেখানেই অবস্থান ছিল, সেখানেই ঘটেছিল অপ্রীতিকর ঘটনা। বিহারিদের আচরণে সেদিন মনে হয়েছিল তারাই এদেশের নাগরিক। আমরা বাঙালিরা মোহাজের ও উদ্বাস্তু।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রতিশোধের আগুনে দপদপ করে জ্বলতে থাকে আর তাই পূর্ব পাকিস্তানের সকল সেনা ছাউনি হতে বাঙালি সৈনিকদের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নেয়, আর বাঙালি সেনাদের সাথে দুর্ব্যবহার ও নজরদারি করতে থাকে। এমও ডিসিতে আমরা ২৫০ জন বাঙালি সৈনিক বিমান বাহিনীর সাথে একটি ব্যারাকে অবস্থান করছিলাম। ২৩ মার্চ বিকালে ২০ জন বাঙালি সৈনিক ঢাকা সেনানিবাস বালুরঘাট ব্যারাক হতে বর্তমান পুরাতন বিমানবন্দরের উত্তর দিকে রানওয়ের মাথায় যুদ্ধবিমান রক্ষিত বাঙ্কারে নায়েক সুবেদার রশীদ সাহেবের নির্দেশে ডিউটিতে আসি। নায়েক সিদ্দিকের নেতৃত্বে বাঙালি সৈনিকরা ২০ জনের একটি গ্রুপ ডিউটিতে রত হই। ১) নায়েক সিদ্দিক ২) ল্যান্স নায়েক মতিউর রহমান ৩) ল্যান্স নায়েক আনিসুর রহমান, ময়মনসিংহ ৪) ল্যান্স নায়েক দেলোয়ার হোসেন, ফরিদপুর ৫) সিপাহী দিলদার, রংপুর ৬) সিপাহি শাহজাহান, বরিশাল ৭) সিপাহি আব্দুল কুদ্দুস, নড়াইল ৮) সিপাহি গোলাম নবী, নড়াইল ৯) সিপাহি আইন উদ্দিন, বরিশাল ১০) সিপাহি লুতফর রহমান, পাবনা ১১) সিপাহি শাহজাহান, বরিশাল ১২) সিপাহি শেখ সালাম, বরিশাল ১৩) সিপাহি কেরামত আলী, ময়মনসিংহ ১৪) সিপাহি চৌধুরি, নোয়াখালী ১৫) সিপাহ মোকলেস, ফরিদপুর ১৬) সিপাহি সাহাবুদ্দিন, বরিশাল ১৭) সিপাহি আব্দুল মতিন, কুমিল্লা ১৮) সিপাহি আনোয়ার, কুমিল্লা। এখানে ডিউটি রত অবস্থায় ভয়াবহ আক্রমণের আশংকা করতে থাকি। কারণ বিমান বন্দরের চারপাশে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট যুদ্ধ সাজে বাঙ্কারে অবস্থান নিয়েছে এরই মধ্যে। ২৪ মার্চ ফিল্ড আর্টিলারি ট্যাংক বিমান বন্দরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থানে নিয়ে রণসাজে সজ্জিত। পরদিন ২৫ মার্চ রাত্রি ৯ ঘটিকার সময় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাস ভবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে গৃহবন্দী করা হয় এবং এই ২৫ তারিখ রাত্রেই পাক হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র, ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর পৃথিবীর জঘন্য, ঘৃণিত, নৃশংস, বর্বোরোচিত আক্রমণ ও হত্যা চালায়। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে ঘরবাড়ি, অগণিত নর-নারী, শিশু-কিশোর, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের হত্যা করে হানাদার বাহিনী, অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা মাফিক তাদের আর্টিলারি ফিল্ডকে আর্টিলারি আক্রমণের প্রথম লক্ষ্যবস্তু ছিল ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস, পিলখানা, ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স ও রাজারবার্গ পুলিশ লাইন। সার্চলাইট পরিকল্পনা অনুযায়ী ১২ টা ১ মিনিটে পাকহানাদার বাহিনী তেজগাঁও বিমানবন্দর হতে আর্টিলারি/ফিল্ড আর্টিলারি/৪ ইঞ্চি, ৩ ইঞ্চি মর্টার এর গোলার আঘাতে এ এলাকাগুলো তছনছ করে লন্ডভন্ড করে ফেলে। তারই সাথে হানাদার বাহিনির সাঁজোয়া ট্যাংক শহরে প্রবেশ করে বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ চালায়। ২৫ মার্চ রাত্রে আনুমানিক ১০ টা ৩০ মিনিটের সময় পুরাতন বিমান বন্দরের উত্তর দিকে কাফরুল, পূর্ব আগারগাঁও, পূর্ব শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া জনবসতির উপর পাকি হানাদার
১০
বাহিনী বর্বরোচিত অত্যাচার চালায়, ঐ সকল গ্রাম থেকে নারীদের ধরে এনে বিমান বন্দরে পৈশাচিকভাবে উলঙ্গ করে ধর্ষণে লিপ্ত হয় । আমরা বিমান বন্দরের উত্তর দিকে তাঁবুতে না থেকে জঙ্গলে লুকিয়ে লুকিয়ে এ দৃশ্য দেখে পরিস্কার বুঝতে পেরেছিলাম আমাদের অবস্থান টের পেলে আমাদের রক্ষা নেই । তাই আমরা সকলেই পালিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিই । রাত্র সাড়ে ১১টায় এখান থেকে রানওয়ের পশ্চিম পার্শ্বের দেওয়াল টপকিয়ে আগারগাঁও, খেজুর বাগান, রাজাবাজার, এলিফ্যান্ট রোড় হয়ে রমনা পার্কের মধ্য দিয়ে পুরাতন শহর সিদ্দিক বাজার, কাপ্তান বাজারে গিয়ে নাদির+সামসুর বাহিনীর সাথে যোগ দিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে থাকি । এইভাবে পালিয়ে এসে সরাসরি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লিপ্ত হলাম । এর কী পরিণাম হবে একবারও সেদিন ভেবে দেখিনি । এর পরিণাম ছিল এই যুদ্ধে হেরে গেলে গাছের সাথে ঝুলিয়ে ফাঁসি । সপরিবারে সকলকে! কিন্তু তারুণ্যে প্রজ্জলিত রক্ত দেশপ্রম আমাদের সব ভুলিয়ে দিয়েছিল । ভুলে গিয়েছিলাম সেদিন মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-কন্যাকে । সামান্য শক্তি দিয়ে কি আমরা পারবো বিশাল শক্তিশালী পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে? এরকম কোনো কিছুই সেদিন আমাদের মনে জাগ্রত হয়নি । মহান আল্লাহ হয়তো আমাদের মন হতে এই ভয়ভীতিটা তুলে নিয়েছিলেন । অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে জিহাদে অংশ নিতে । ২৫ মার্চ রাত্রে পৌনে ১টা বা ১টার সময়ে বংশাল ফাঁড়ির পুলিশের অস্ত্রশস্ত্র সব গোলাবারুদ এম্যুনিশন নাদির+সামসুর নেতৃত্বে আমাদের আয়ত্তে নিয়ে নিই এবং পুরান ঢাকার কাপ্তান বাজার, নবাবপুর, সিদ্দিক বাজার এলাকায় পাকিসেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তুলি । যে কারণে ২৫/২৬/২৭ তারিখ পর্যন্ত পাকিসেনারা পুরান ঢাকায় প্রবেশ করতে পারেনি । ২৫ তারিখ সন্ধ্যায় সম্মুখ যুদ্ধে জয় বাংলা, জয় বাংলা বলতে বলতে নাদের শহীদ হন । তারপরে আমরা পিছু হটে যাই । ঐ রাত্রেই আমাদের অস্ত্রগুলো ওয়ারীর খ্রিস্টান কবরস্থানের একটি পুরাতন কবরের মধ্যে লুকিয়ে রাখি, কিছু অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমরা রাতেই ঢাকার পূর্বদিকে বিলের মধ্যে অবস্থান নিই । ২৭ তারিখে কারফিউ শিথিল হলে ঢাকার লক্ষ লক্ষ জনতার ঢাকা ছাড়ার মিছিলে আমরাও শরিক হয়ে বিকাল ৫টায় নরসিংদী শহরে পৌঁছাই । সেখান স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর ভলান্টিয়াররা আমাদের সাদরে গ্রহণ করেন ও খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করেন এবং নরসিংদী প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য বলেন । আমরা সেনাবাহিনী, পুলিশ, ইপিআরের ২০ থেকে ২৫ জন সৈনিক নরসিংদীর পশ্চিম দিকে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিয়ে যুদ্ধে রত হই । এরই মধ্যে আমাদের কিছু সঙ্গী চলে গেল । আমরা যারা ডিফেন্সে রইলাম তারা পাকিসেনাদের মুখোমুখি যুদ্ধে রত রইলাম । পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র আর আমাদের থ্রি নট থ্রি রাইফেল ও গাঁদা বন্দুক দিয়ে
১১
যুদ্ধ চালিয়ে যাই ২৮, ২৯ ও ৩০ তারিখ সকাল পর্যন্ত । ৩০ মার্চ সকাল থেকেই আমাদের উপর ব্যাপক বিমান হামলা হয় আর হানাদারদের সাঁজোয়া ট্যাংকের আক্রমণে নরসিংদী প্রতিরোধ ডিফেন্স তছনছ হয়ে যায় । এই যুদ্ধে অনেক মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হন, তাই সেদিন আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যেদিকে পারলাম চলে গেলাম । আমি লঞ্চযোগে নবীনগর যাই এবং গোপালপুরে মুজিবুর রহমানের বাড়িতে উঠি । এখানে উল্লেখ্য, মুজিবুর রহমানের ছেলে শাহ আলম ঢাকা ছাড়ার মিছিলে নরসিংদীতে একত্রিত হয় । মুজিবুর রহমান সাহেব আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি ছিলেন ও প্রাক্তন সৈনিক ছিলেন । মুজিবুর রহমান সাহেব ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষণের দিক নির্দেশনায় অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক, পুলিশ, ইপিআর, আনসার, মুজাহিদের একটি দল সকলেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ২৪/২৫ জন সৈনিকের একটি দল প্রস্তুত করে রেখেছিলেন, আমাকে পেয়ে তিনি খুব খুশি হলেন ও পরের দিন সকালে ১ এপ্রিল নবীনগর লঞ্চঘাট থেকে একটি লঞ্চে করে আমার নেতৃত্বে আমাদের সকলকে ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় পাঠিয়ে দিলেন । আমরা বিকাল ৫টায় ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় গোনঘাট লঞ্চঘাটে পৌঁছলে সেখানে ক্যাপ্টেন গফফার সাহেব আমাদেরকে গ্রহণ করে বেয়াক্ষণবাড়িয়ার সরকারি স্কুল মাঠে নিয়ে যান, সেখানে পূর্ব থেকেই ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় অবস্থান নিয়েছে । আমরা ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে মিলিত হয়ে বাংলা মাকে উদ্ধারের সংগ্রামে শপথ গ্রহণ করলাম এবং জানতে পারলাম গাজীপুর সেনানিবাস হতে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ ঘোষণা করে ভৈরব ও আশুগঞ্জে ডিফেন্স নিয়েছে, ওদিকে চট্রগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট থেকে মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে কালুরঘাটে ডিফেন্স স্থাপন করেছে ও ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের নেতৃত্বদানকারী মেজর জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করে সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার, মুজাহিদ সকলকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য অনবরত আহ্বান করেছেন । যা আমি নিজ কানে অনেকবার শুনেছি । মেজর খালেদ মোশাররফ সাহেব ব্রাক্ষণবাড়িয়াকে মুক্ত অঞ্চল রাখার জন্য উজানিশ্বর ব্রিজ ভেঙে দিয়ে এর উত্তর প্রান্তে শক্ত ডিফেন্স স্থাপন করেছে । আখাউড়ার দক্ষিণে তিতাস নদীর পাড়ে গঙ্গাসাগর নামক স্থানে ইপিআর সমন্বয়ে ডিফেন্স স্থাপন করেছে । ওদিকে ভৈরব-আশুগঞ্জে ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা ডিফেন্স স্থাপন করেছে যাতে করে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট ও ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকি সেনাবাহিনী ব্রাক্ষণবাড়িয়া বা সিলেট অভিমুখে আক্রমণ চালাতে না পারে ।
১২
প্রথম অপারেশন আমরা ৭ই এপ্রিল মেঘনা নদী বক্ষে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর একটি শিপ ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হই । এরপর ৮, ৯, ১০, ১১ ও ১২ তারিখ পর্যন্ত পাকিহানাদার বাহিনীর জঙ্গি বিমান ব্রাক্ষণবাড়িয়ার উপর ব্যাপক আক্রমণের পর আক্রমণ চালায় । এই আক্রমণে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নিরস্ত্র বেসামরিক বাঙালিরা নিহত ও আহত হয়, আমাদেরও কিছু মুক্তিসেনা আহত হন । মেজর খালেদ মোশাররফ সাহেব ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ব্রাক্ষণবাড়িয়া থেকে সরিয়ে আখাউড়া জংশনের উত্তর দিকে কল্লা শাহের মাজার সংলগ্ন স্থানে অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দেন । আমাদের রেজিমেন্ট আখাউড়ায় পৌঁছানোর পর সেখানকার আশপাশের জনগণ যা দেখাল তা সহ্য করার মতো নয় । সেখানে আখাউড়া জংশনে কর্মরত অবাঙালি বিহারিরা আজমপুর গ্রামের আশপাশ গ্রামগুলো থেকে অসংখ্য বাঙালিকে ধরে এনে নৃশংসভাবে হত্যা করে এবং নারীদের ওপর নৃশংসভাবে অত্যাচার চালায় । আমরা অন্তত ১৮/১৯টি নারীর দেহ দেখেছি যাদের উলঙ্গ অবস্থায় যৌনাঙ্গে বাঁশের লাঠি, গাছের ডাল, লোহার রড ঢুকিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে অবাঙালি বিহারিরা । এখানে হযরত কল্লা শাহ’র মাজারের খাদেম সাহেব আমাদের জন্য আহারের ব্যবস্থা করে রেখেছিল । আমরা ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত । ক্ষুধা নিবারণ শেষে আল্লাহ পাকের পক্ষ হতে আমাদের শক্তির সঞ্চার হলো-আমরা মুহূর্ত দেরি না করে অবাঙালি বিহারিদের আস্তানা আজমপুর গ্রামে আক্রমণ চালাই-তছনছ করে পুরো বিহারিদের এলাকা খতম করে দিলাম । তারপর আখাউড়া ফিরে এসে সকলে বিশ্রাম নিলাম । আখাউড়া জংশনের এক মাইল দক্ষিণে গঙ্গাসাগর নামক স্থানে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক প্লাটুন ইপিআর সৈনিক পাকিসেনাদের সাথে সম্মুখ প্রতিরোধ যুদ্ধে রত ছিল । মেজর খালেদ মোশাররফ সাহেব হাবিলদার হালিম, হাবিলদার আওয়াল,নায়েক রহমান, লে. নায়েক আর্মি মতিউর রহমানকে এক প্লাটুন সৈনিক (৫০ জন)নিয়ে গঙ্গাসাগর নামক স্থানে দরুইন গ্রামের দক্ষিণে এনডারস নদীর উত্তর পাড়ে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেওয়ার নির্দেশ দেন । ১৪ এপ্রিল আমরা বিকালের মধ্যে খাওয়া-দাওয়া সেরে সন্ধ্যার আগ মূহূর্তে গঙ্গাসাগর কানের নদীর উত্তর পাশে দক্ষিণমুখো হয়ে অবস্থান নিই । আমার দায়িত্ব পড়ে গঙ্গাসাগর দিঘির ডান দিকে রেললাইনের পূর্বে একটা ডব্লিউ টাইপের বাংকারে মোস্তফা কামালের সাথে (মোস্তফা কামাল ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন দেশপ্রমিক সাহসী সৈনিক ছিলেন) সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেওয়ার । ১৫ এপ্রিল ফজর নামাজের আযানের সাথে সাথে পাকিহানাদার বাহিনীর তাদের মুগরা বাজার ক্যাম্প হতে আমাদের উপর আক্রমণ প্রতিহত করি, সেখানে পাকি হানাদার বাহিনীর অন্তত দুটি কোম্পানি সৈনিক সম্পূর্ণরূপে নিহত ও আহত হয় । অতঃপর সকাল ৯টা হতে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী রেডক্রসের সাদা

১৩

পতাকা উড়িয়ে গ্রাম থেকে বাঙালিদের ধরে এনে তাদের নিহত লাশগুলো টেনে টেনে উপরে তুলে নেয় ও বাঙালিদের বন্দি করে রাখে । হানাদার বাহিনীর হিংস্র দানবেরা এনডার্সন নদীর দক্ষিণ পাড়ে বাংকারে অবস্থান নেয় । তাদের এত সৈন্য নিহত হওয়ায় আক্রোশে এ এলাকার মনিয়ন্দ গ্রামসহ আশপাশের গ্রামগুলো আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয় । পুরুষদের ধরে এনে বন্দি করে রাখে, নারীদের বন্দি করে তাদের ওপর চালায় নৃশংস পাশবিক অত্যাচার । তাদের আর্তচিৎকারে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হতে থাকে । এখানে প্রতিমুহূর্তেই স্মমুখ যুদ্ধ চলতে থাকে পাকিস্তানি হানাদাররা আমাদের ওপর আর্টিলারি ফিল্ড আর্টিলারির সেল মেরে পুরা আখাউড়া এলাকা ও আশপাশ প্রকম্পিত করতে থাকে । ১৬ এপ্রিল পূর্বের ন্যায় ফজরের নামাজের সাথে সাথে হানাদার বাহিনীর একটি রেজিমেন্ট আমাদের ওপর আক্রমণ চালায় । সে আক্রমণও আমরা মুক্তিসেনারা সাহসিকতার সাথে প্রতিহত করে দিই, যার ফলে হানাদারদের পুরো রেজিমেন্টটাই আহত ও নিহত হয়ে এনডারসন নদীর মধ্যে পড়ে থাকে । এদিনও পাকি হানাদাররা রেডক্রসের পতাকা লাগিয়ে গ্রামের ঐ সকল বন্দি লোক দিয়ে তাদের লাশগুলো টেনে তুলে নেয় । তারপর হায়েনার দল ক্ষিপ্ত হয়ে আমাদের পজিশনের ওপর তাদের ফিল্ড আর্টিলারি/আর্টিলারি/৪//মর্টার /৩//মর্টার/আর-আর/৮৩ ব্লান্ডার সাইড থেকে ৪/৫ শত গোলা প্রতি মিনিটে আমাদের ওপর আঘাত হানতে থাকে এবং মুগরা বাজারের ডিফেন্সের নদীর পাড়ের বাংকারগুলোর ওপর বাঙালি মা-বোনদের বস্ত্রহীন করে মানব ঢাল তৈরি করে মাইকের সাহায্যে চিৎকার করে বলতে থাকে মার তেরা মাকো মার, তেরা বহিনকো মার আমরা হাবাদার বাহিনীর এত কাছাকাছি ছিলাম, যার কারণে আর্টিলারির গোলাগুলি আমাদের পিছনে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডিফেন্সের ওপর আঘাত হানতে থাকে । ভীষণ গোলার আঘাতের কারণে আমাদের ওয়্যারলেস যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় । ম্যাসেঞ্জার পাঠানোরও অবস্থা ছিল না আমাদের ব্যাটালিয়নের সাথে কোনো রকম যোগাযোগ করতে পারছিলাম না । পরে জানতে পেরেছিলাম আর্টিলারি ফিল্ড আর্টিলারির গোলার আঘাতে আমাদের পিছনের ডিফেন্স লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়ে, অনেকেই হতাহত হন । যার কারণে ১৬ তারিখেই আমাদের পিছনের ডিফেন্স ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সকল সৈনিকই আখাউড়া ডিফেন্স ছেড়ে আগরতলা চেকপোস্টে গিয়ে ডিফেন্স নেয় । ১৬ তারিখ হতেই আমাদের জন্য কোনোরকম খাওয়া-দাওয়া ও অ্যামুনিশন সাপ্লায়ের ব্যবস্থা ছিল না আমরা ওখানকার দূরইন গ্রামের এক হিন্দু পরিবারের ছেড়ে যাওয়া বাড়ি থেকে তাদের পূজার জন্য সংরক্ষিত চিড়া, গুড়, মুড়ি দিয়েই আমাদের ক্ষুধা নিবারণ করি । ১৭ এপ্রিল পাকিহানাদাররা আমাদের ওপর পুন্রায় আক্রমণ শুরু করে, সেই আক্রমণও আমরা সাহসিকতার সাথে প্রতিরোধ করি । সেদিন সকাল হতেই গুঁড়ি গুঁড়ি ও ভারী বৃষ্টি হচ্ছিল । হাবিলদার আবদুল হালিম, হাবিলদার রহমান, নায়েক বাহাদুর, হাবিলদার আওয়াল ও বিডিআর এর

১৪

নায়েক সেকান্দার ও আমি একত্রিত হয়ে ডিফেন্স ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিই। কারণ আমাদের খাদ্য ও অ্যামুনিশন সাপ্লাই নেই। সেখানে বাঁধ সাধে সিপাহী (বীর শ্রেষ্ঠ) মোস্তফা কামাল। সে কোনো রকমেই ডিফেন্স ছাড়তে রাজি হলো না। তার যুক্তি সকলে একসাথে ডিফেন্স ছেড়ে গেলে সকলেই নিহত হব। মোস্তফা কামাল বললেন, আমার কাছে প্রচুর অ্যামুনিশন আছে ও শক্তিশালী ফায়ার সাপোর্ট এইচ.এম.জি (৭.৯২ হেভি মেশিনগান) আছে। তোমরা আমার মেশিনগানের অ্যামুনিশনের চেইনগুলো ভর্তি করে দিয়ে যাও। আমি যাতে শত্রুদের সন্ধ্যা পর্যন্ত আটকে রাখতে পারি এরই মধ্যে তোমরা পূর্বদিকে সরে আগরতলা বর্ডারের দিকে চলে যেতে পারবে। আমরা মোস্তফা কামালকে পীড়াপীড়ি করলাম। তুমি শক্রর হাতে ধরা পড়লে, তোমার ওপর অনেক অত্যাচার হবে, যা তুমি সহ্য করতে পারবে না। মোস্তফা কামাল এ কথা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে চিৎকার করে বলে উঠল, আমি আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি, আমি আত্মসমর্পণ করবো না শত্রুর হাতে। প্রয়োজন হলে শেষ বুলেট দিয়ে সুইসাইড করবো। যুদ্ধ করতে করতেই শাহাদাত বরণ করবো। তোমরা যদি জীবিত থাক আর দেশ যদি স্বাধীন হয় তোমরা বাঙালি জাতির কাছে গর্বভরে বললাও আমাদের সাথি মোস্তফা কামাল জাতির সাথে বেঈমানি করে নাই। আমাদের সাথি মোস্তফা কামাল যুদ্ধ করতে করতেই শাহাদাত বরণ করলো। আমরা মোস্তফা কামালের চেইনগুলো ফ্লিম করে বাক্সে সাজিয়ে তাকে রেখেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে পিছু হটে পূর্ব-উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকি। কিছুদূর অগ্রসর হতেই পাকিহানাদার বাহিনীর সামনাসামনি হয়ে পড়ি, রু হয় সম্মুখ যুদ্ধ, আমরা পজিশন নিই। শত্রুরা গুলি করে, শত্রুরা পজিশন নেয়, আমরা উঠে দৌড় দেই, শত্রুরা আমাদের উপর গুলি করতে থাকে, আমরা পজিশন নিই ও গুলি করতে থাকি। এমন করতে করতেই পূর্ব-উত্তর দিকের হাওর পাড়ে এসে পৌঁছাই। আল্লাহর অশেষ রহমতের কারণেই আমরা এখানে নিরাপদে এসে যাই। শত্রুরা পজিশন নিয়েছে ঠিক সেই সময়-শত্রুদের আর্টিলারির গোলাগুলি শত্রুদের উপরই আঘাত হানতে থাকে। এই সুযোগে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা হাওরের মধ্য দিয়ে বোরো ক্ষেত মাড়িয়ে পূর্বদিকে অগ্রসর হতে থাকি কোথাও মাজা পানি কোথাও হাঁটু পানি- কাদা, কচুরিপানা ঠেলে পূর্বদিকে অগ্রসর হতে হতে এক সময় হাওর পাড়ি দিয়ে আগরতলার বর্ডার সংলগ্ন গ্রামে পৌঁছে যাই। এখানে আমরা আমাদের ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে মিলিত হই, আমরা যারা গঙ্গাসাগরে ডিফেন্সে ছিলাম তারা সকলেই দ্রিাহীন ও অনাহারী তাই সকলে ক্লান্ত, অনেকেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। সেখান থেকে আমাদের সঙ্গীরা আমাদেরকে আগরতলার ভেতরে নিয়ে আসে এবং বিশ্রামের ব্যবস্থা করেন। আমাদেরকে আগরতলার ভেতরে নিয়ে আইনুদ্দিন সাহেবের নেতৃত্বে সি কোম্পানির কমান্ড প্রদান করেন। আইনুদ্দিন সাহেবের নেতৃত্বে আমরা সি কোম্পানির সদস্যরা মনতলিতে ক্যাম্প স্থাপন করি। কয়েক দিন বিশ্রামে থাকার পর সুস্থতা ফিরে পাই।

১৫

জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে আমরা মনতলি ক্যাম্প হতে পশ্চিম দিকের মনিয়ন্দ গ্রামে রেললাইনে পাকিস্তানি হানাদারদের একটি টুনকে অ্যামবুশে আটকাই। সেখানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এক প্লাটুনের প্রায় সকল সৈন্যই নিহত-আহত হয়। মনিয় থেকে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প মুগরা বাজার আধা মাইলের মতো, তাই আমরা সেখান থেকে দ্রুত পূর্বদিকে আমাদের মুক্তাঞ্চলে চলে আসি। জুলাই মাসের ১০/১১ তারিখ পাকিস্তানিদের আর্টিলারি ডিফেন্স তিলকপুর নামক স্থানে সন্ধ্যার সাথে সাথে চুপিসারে শত্রুর কাছাকাছি গিয়ে আমরা মুক্তিসেনারা অতর্কিতে আক্রমণ করি এবং পাকিস্তানিদের পালাতে বাধ্য করি। আমরা সেখানে ৫টি ফিল্ড আর্টিলারি ব্যারেলের ভেতর গ্রেনেড ফাটিয়ে নষ্ট করে দেই, কারণ গানগুলো টেনে আনার কোনো ব্যবস্থা আমাদের ছিল না। কসবা স্টেশনের উত্তর দিকে ইমামবাড়ি স্টেশনে জুলাই মাসের শেষ দিকে দুপুর ১২টার দিকে আমরা এমবুশ করি। সেই এমবুশে পাকিস্তানি হায়েনাদের একটা কোম্পানি আটকাই। স্থানটা ছিল ইমামবাড়ি স্টেশনের দক্ষিণ কসবা স্টেশনের উত্তরে পূর্বে গোপিনাথপুর, পশ্চিমে ল্যান্তাবাজ পূর্বে গ্রাম। আমরা তিন ভাগে ভাগ হয়ে একটি গ্রুপ স্টেশনে অবস্থান নেই, অন্য একটি গ্রুপ আমি নিজে ল্যান্তাবাজ গ্রামের পূর্ব দিকে রেললাইনের দিকে মুখ করে অবস্থান নিই। স্টেশনের পূর্ব দিকে এখানে দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত একটানা যুদ্ধ চলতে থাকে। সেই যুদ্ধেও পাকিস্তানি হায়েনারা পরাজিত হয়ে নিহত ও আহত হয়ে পড়ে থাকে। পরবর্তী সময় কুটির ছতরা, চানপুর/মুগরা বাজার ক্যাম্প হতে হায়েনারা এসে তাদের আহত ও নিহতদের উদ্ধার করে নিয়ে যায়। জুলাই মাসের ১০/১১ তারিখ সায়েদাবাদ গ্রামের পূর্বদিকে এবং ল্যান্তাবাজ গ্রামের পশ্চিম দিকে সিএন্ডবি রোডে একটি কালভার্ট ভেঙে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় আমাদের ওপর। মতিউর রহমান, মো. হোসেন, আবদুল লতিফ, আ. খালেক, আ. মজিদ বীর প্রতীক, দেলোয়ার হোসেন বীর প্রতীক ও আ. ছাত্তার, ৬ জনের এই অপারেশন গ্রুপটি আনুমানিক রাত ১১টার দিকে সিএন্ডবি রোডের কালভার্টের নিচে পৌঁছাই এবং এক্সপ্লোসিভ ও কাটিং চার্জ লাগিয়ে ইকোপ্লাস্টার লাগাতে থাকি। এমন সময় সেখানে হঠাৎ করে একটি পাকিস্তানি ডজ গাড়ি এসে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। আমাদের সাথে একজন বন্ধু ভয় পেয়ে তার হাতের গ্রেনেড পাকিস্তানিদের ওপর ছুঁড়ে মারে যে কারণে আমাদের পজিশনটি প্রকাশ হয়ে যায়, পাকিস্তানিরা আমাদের দুই বন্ধু আ. খালেক ও আ. ছাত্তারকে তাৎক্ষণিক গুলি করে হত্যা করে। আমাদেরকে হ্যান্ডসআপ করে উপরে উঠার জন্য নির্দেশ করে। এই সময় ঐ পাকিস্তানিদের মধ্যে হতে একজন কমান্ডার চিৎকার করে বলতে থাকে ইনকো মাত মারো ইনকো পাকড়ালো, যিয়াদা ইনাম মিলেগা। একথা শুনে আমার মনে হল এখনি আমাদেরকে মারবে না হয় ধরে

১৬

নিয়ে যাবে তারা, বেশি পুরস্কার পাওয়ার আশায়। তাৎক্ষণিকভাবে আমি আমার কমান্ডো প্রশিক্ষণের আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হতে থাকি। আমি বাংলাতে আমার সহযোদ্ধাদের বললাম, ধরা পড়ার চেয়ে গুলি খেয়ে মরে যাওয়া ভালো। অতএব আমার মনে হয় এখান থেকে আমরা বেঁচে যেতে পারব, রিস্ক নিতে হবে। আমি প্রতি মুহূর্তেই ঘটনার পর্যালোচনা করছিলাম, প্রথম দিকে আমার বন্ধু মো. হোসেনকে উপরে উঠিয়ে সৈনিকদের মধ্য হতে একজন অফিসার তার ডান হাতের অস্ত্রটা বাম হাতে নিয়ে রাস্তার উপরে উঠার সাথে সাথে বন্ধুকে সজোরে বাইনচোত বলে গালি দিয়ে থাপ্পড় মারে, সে রাস্তার উপর পড়ে যায়। ২ জন পাকিস্তানি সৈনিক এসে তার বুকের উপর বুট দিয়ে চাপ দিয়ে রাইফেলের নলটা বুকের উপর ঠেকিয়ে রাখে, এ সময় ওই পাকিস্তানি অফিসারটি চিৎকার করে বলতে থাকে ইনকো মাত মারো, পাকড়ালো, আমার ২য় সহযোদ্ধা দেলোয়ার হোসেন বীর প্রতীক তাদের কমান্ড মতো উপরে ওঠে, অনুরূপ তার উপরেও বাইনচোত শব্দটি বলে ডান হাতের অস্ত্রটা বাম হাতে নিয়ে সজোরে থাপ্পড় মারে। ৩য় সহযোদ্ধা আ. রশিদ বীর প্রতীক এর বেলায়ও অনুরূপ হলো। এবার আমার পালা। ৪র্থ জন আমি ইতোমধ্যেই পরিকল্পনা করে ফেলেছি, আমি উপরে উঠার সাথে সাথে আমাকে থাপ্পড় মারলে আমি পড়ে যাওয়ার ভান করে অফিসারের বাম হাতের অস্ত্রটির উপর ঝাপিয়ে পড়ব। পরিকল্পনা মাফিক আমি উপরে উঠলে সাথে সাথে আমাকে বাইনচোত গালি দিয়ে থাপ্পড় মারলে আমি পড়ে যাবার ভান করে অফিসারের বাম হাতের অস্ত্রটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। আল্লাহর অশেষ রহমতে অস্ত্রটি আমার হাতে চলে আসে। আমি ইয়া আলী চিৎকার দিয়ে সেখান থেকে লাফ দিয়ে একটু দূরে সরে যাই এবং আমার হাতের অস্ত্রটি দিয়ে দাঁড়ানো পাকিস্তানি সৈনিকদের ওপর ব্রাশ ফায়ার করতে থাকি। পাকিস্তানি সৈনিকরা গুলিতে আহত হয়ে মাটিতে পড়ে যায়, আমি একটু দূরে সরে গিয়ে পজিশন নিয়ে গুলি করতে থাকি। আরো একটু দূরে যেয়ে রাস্তার নিচে নেমে পড়ি আর ধানক্ষেত দিয়ে পশ্চিম দিকে সাঁতরাতে সঁতরাতে পাশের গ্রাম সায়েদাবাদে গিয়ে উঠি। সেখান থেকে চুপিসারে আরও পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে থাকি। এরই মধ্যে কখন যে রাত শেষ হয়েছে বুঝতে পারিনি। ইতোমধ্যেই মসজিদে মসজিদে ফজরের আজানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এক দরিদ্র গৃহস্থের ভাঙাচোরা বাড়িতে উঠে তাদের বিস্তারিত বলি। বাড়ির মালিকের নাম ছিল বেলায়েত, সে আমাকে তার ভাঙা ঘরের ভেতর লুকিয়ে রাখে এবং খাওয়ার ব্যবস্থা করে, সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে আমাকে নিয়ে বেলায়েত ভাই ঐখান হতে প্রায় ১০ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে দিয়ে আগরতলায় নিয়ে যায়। সেখানে একটি স্থানে প্রথমে বিএসএফ এর সাহায্যে ও পরে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে আমি আবার মনতলি ক্যাম্পে ফিরে যাই। আমার সাথি সহযোদ্ধারাও ৩/৪ দিন পর মনতলি ক্যাম্পে ফিরে আসে।

১৭

ঘটনাস্থলে ২জন শাহাদাত বরণ করেন। দুই বন্ধু আ. ছাত্তার ও আ. খালেক ঐ ব্রিজের নিচে চিরদ্রিায় শুয়ে থাকে। জানি না তাদের লাশ দুটির কী হয়েছিল। জুলাই মাসের শেষে আইনুদ্দিন সাহেব আমাদের ৪০ জনের একটি টিম করে সিঅ্যান্ডবির রাস্তার পশ্চিমদিকে পাঠান। রাজাকার মুক্ত অঞ্চল গঠন করতে হবে। এই এলাকা দিয়ে যাতে সদ্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকায় বা ঢাকার আশপাশে যেতে পারে। কাজটি করা ছিল খুবই কঠিন, তারপরও কমান্ডারের নির্দেশ মানতে হবে। তাই আমরা মনের মধ্যে কোনো রকম ভীতি না নিয়ে নির্দেশ মেনেছিলাম। আর আমরা তো পূর্বেই আমাদের জীবনটা আল্লাহ রাস্তায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে জিহাদে দেশ মাতাকে মুক্ত করার জন্য সঁপে দিয়েছি ভয় কিসের! ৪০ জনের গ্রুপটি দুই ভাগে ভাগ হয়ে। এক গ্রুপের দায়িত্ব নেন হাবিলদার আউয়াল যিনি ওই অঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দা। অপর দলটির দায়িত্ব হাবিলদার আবদুল হালিম, যার দ্বিতীয় কমান্ডার হিসাবে ছিলাম আমি। আমরা ওই অঞ্চলে রাত্রে প্রবেশ করি এবং আওয়ামী লীগ নেতা বাড়ার মনা আক্তারের বাড়িতে অবস্থান নিই। সেখানে দুই দিন দুই রাত আত্মগোপন করে থেকে পরিকল্পনা করি কীভাবে ওই এলাকা মুক্ত করা যায়। এলাকাটি ছিল শান্তি বাহিনীর বাপস কমিটি ও রাজাকারদের এলাকা। পরিকল্পনা হলো এখানে ত্রাস সৃষ্টি করে পাকিস্তানি দোসরদের মনে ভীতি সৃষ্টি করা। সময়টা ছিল বর্ষাকাল। চতুর্দিকে পানিতে ডোবা। নৌকা ছাড়া চলাচলের উপায় ছিল না। পরিকল্পনামাফিক আমরা দুটি নৌকাযোগে রাত্রে এলাকার (চারগাছ এলাকা) পিস কমিটির চেয়ারম্যান তিনজন, শান্তি বাহিনীর মেম্বার ৬ জনকে ধরে নিয়ে আসি এবং মরা তিতাস নদীর মাঝে হাত-পা বেঁধে ফেলে দিই, গুলি খরচ না করে। পরবর্তী সময়ে তারা মৃত্যুবরণ করে নদীতে ভাসতে থাকে। এই অপারেশনের উদ্দেশ্য ছিল এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করা, দেশপ্রেমিক মুক্তিসেনারা এলাকায় প্রবেশ করেছি তারই জানান দেওয়া। এই অপারেশনে কাজও হয়েছিল তাই রাজাকাররা পালিয়ে যায়। এলাকাটি আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। আমরা মুক্তভাবে চলাফেরা করতে থাকি। জুলাই মাসের শেষের দিকে সায়েদাবাদ গ্রামের পূর্ব দিকে সিএন্ডবি রোডে রাত্রে, একটি অপারেশন করি এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর তিনটি সাঁজোয়া ট্রাককে বা (৮৩ ব্লান্ডার সাইড) এর সেলের আঘাতে ধ্বংস করি এবং ঐ ট্রাকের সকল সৈনিক আহত ও নিহত হয়। সেখান থেকে আমরা আমাদের বিশ্রাম নেওয়ার স্থান মেহারি গ্রামে এসে রাত্রে অবস্থান নিই। ঐদিনই সকালবেলা ফজরের আজানের সাথে সাথে পাকিহানাদার বাহিনী আমাদের ওপর আক্রমণ চালায়। আমরা সেই আক্রমণ প্রতিহত করি ও হানাদারদের একটি কোম্পানির সকল সদস্য নিহত ও আহত হয়। আগস্ট মাসের প্রথমদিকে ৪ বা ৫ তারিখ মিরপুর নামক গ্রামে পাকিস্তানি হায়েনারা ব্যাপক অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ ও এলাকার লোকদের উপর অত্যাচারে লিপ্ত থাকে। আমরা সংবাদ পেয়ে দ্রুত সেখানে পৌঁছাই এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলি ও

১৮

সম্মুখ যুদ্ধ শুরু করি। এখানেও পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ব্যাপকভাবে হতাহত হয়। এই যুদ্ধে আমাদের সামী মুক্তিসেনা মো. শহীদ শাহাদাত বরুণ করেন, যাকে আমরা সমাহিত করেছি বিটঘর হাই স্কুল মাঠের এক প্রান্তে। এই এলাকায় মুক্তাঞ্চল গঠন করায় ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের সেনানায়করা অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে এবং ড় ধরনের আক্রমণের পরিকল্পনা করে। একসাথে ৩/৪টি ব্যাটালিয়ন/রেজিমেন্ট একত্রে আক্রমণ করে এলাকাটি তাদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য। এরই প্রেক্ষিতে আনুমানিক ১৯ আগস্ট চারগাছ বাজার ও পাশের গ্রামগুলোর উপর সারাদিন সারারাত ব্যাপক আর্টিলারি ও ফিল্ড আর্টিলারি গোলা আঘাত হানতে থাকে। যার ফলে অত্র এলাকার বাড়ি-ঘর তছনছ হয়ে টিনের চালাগুলো ঝাঁজরা হয়ে যায় এবং গাছপালা ভেঙে পড়ে। আমরা পূর্ব থেকেই জানতে পারি অবিলম্বে হানাদার আমাদের এলাকায় আক্রমণ চালাবে। আমরাও এলাকার অন্যান্য সকল মুক্তিযোদ্ধাদের এ বিষয়ে অবগত করি এবং তাদেরকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য বলি। ২১ আগস্ট পকিস্তানি হানাদার বাহিনী এলাকায় তিন দিক থেকে আক্রমণ শুরু করে। এদের একটি দল আসে তিতাস নদীর উত্তর পূর্ব দিক দিয়ে ৫টি লঞ্চ, ৫টি গানবোট ও ১০টি নৌকাযোগে এবং পূর্ব দিক তিলকপুর থেকে আর একটি গ্রুপ অগ্রসর হতে থাকে স্থলপথে ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিক মান্দারপুর, যবিন, মেহারীর দিক থেকে অপর একটি রেজিমেন্ট অগ্রসর হতে থাকে। আমরা এই যুদ্ধ প্রতিহত করার জন্য চারগাছ বাজারে ডিফেন্স নিই। কারণ শত্রুদের লক্ষ্য চারগাছ বাজার তাদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া। এখানে উল্লেখ্য যে হাবিলদার আউয়ালের গ্রুপকে আমরা যুদ্ধে অংশ নিতে বলি। ২, হাবিলদার রেজাউলের গ্রুপকে যুদ্ধে অংশ নিতে বলি ৩, হাবিলদার গিয়াস উদ্দিনের গ্রুপকে যুদ্ধে অংশ নিতে বলি ৪, নবীনগরের মিজানের গ্রুপকে যুদ্ধে অংশ নিতে বলি। দুঃখের বিষয় হাবিলদার হালিমের গ্রুপ ছাড়া এই যুদ্ধে অন্য কেউ অংশগ্রহণ করেনি। এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ৫টি লঞ্চ, ৫টি গানবোট, ১০টি নৌকায় আসা এক হাজার সদস্যের হানাদারী আক্রমণকে সাহসিকতার সাথে প্রতিহত করি। আমরা মুক্তিসেনারা হানাদার বাহিনী যখন চারগাছ এর পূর্বে ব্রিজের নিকটে এসে নামে ও ব্রিজ পার হয়ে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে থাকে চারগাছ বাজারের দিকে এবং হায়েনারা যখন পুরোপুরি আমাদের অ্যামবুশের মধ্যে এসে যায় তখনি তিনদিক থেকে ত্রিমুখী আক্রমণ চালাই। এতে হায়েনাদের ৫টি লঞ্চই পানিতে ডুবে যায় এবং হানাদার বাহিনীর একটি রেজিমেন্টের সকল সৈনিকই নিহত ও আহত হয়ে পড়ে থাকে। এই যুদ্ধ দুপুর ১টা হতে বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে। আমাদের অ্যামুনিশন স্বল্পতার কারণে আমরা পিছু হটে কালিগঞ্জ বাজারে অবস্থান নিই। এই কালীগঞ্জ বাজার এলাকা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্ত এলাকা। এখানে কয়েকদিন অবস্থান নেওয়ার পর আইনুদ্দিন সাহেব আমাদেরকে আগরতলা ক্যাম্পে চলে আসার জন্য নির্দেশ পাঠান। আমরা ২/৩ অক্টোবর মনতলি ক্যাম্পে পৌঁছালে সেখানে কয়েকদিন বিশ্রামের পর আমাদের কসবা

১৯

রেল স্টেশন সংলগ্ন কমলাসাগর নামক স্থানে লে, ইকবাল সাহেবের সাথে অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দেন। আমরা সেখানে পৌঁছে পাহাড়ের ঢাল কেটে ক্যাম্প স্থাপন করি, এখানে সাপ, বিচ্ছু, চেলা ও চিনে জোক এর সাথে দুর্বিষহ অবস্থায় অবস্থান করতে থাকি। ৯ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সি কোম্পানির সকল সদস্যই মুক্ত অঞ্চল গঠন করার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকি। আমরা বার বার আমাদের ৯ম বেঙ্গলের সিও সাহেবের সাথে মুক্ত অঞ্চল গঠন করার ও আক্রমণ করার অনুমতি চাইতে থাকি। কিন্তু উপর কমান্ড থেকে আক্রমণ করার জন্য আদেশ বা নির্দেশ না থাকায় আমরা নির্দেশ পেলাম না। সাথি মুক্তি পাগল যোদ্ধাগণ দুর্বিষহ অবস্থা হতে অবসানকল্পে হাবিলদার হালিম, হাবিলদার রেজাউল, হাবিলদার গিয়াস উদ্দিন, নায়েব বাহাদুর ও আমিসহ অন্যান্য বন্ধুদেরকে নিয়ে পরিকল্পনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো- এ রকম দুর্বিষহ জীবনযাপনের চেয়ে মুক্ত অঞ্চল গঠন করতে গিয়ে যদি মৃত্যু হয় তাও শ্রেয়। অক্টোবর মাসে পরিকল্পনামাফিক সি কোম্পানির সদস্যদের নিয়ে মুক্ত অঞ্চল গঠন করার সিদ্ধান্ত হলো। উপরের হুকুম ছাড়াই পরিকল্পনায় উপনীত হলাম। পরিকল্পনাটি তিনভাগে ভাগ করা হলো। প্রথম দল হাবিলদার হালিম ও মতিউরের নেতৃত্বে ফায়ারিং মুভ করে দৌড়ে রেললাইন পার হয়ে শত্রুদের পেছনে গিয়ে অবস্থান নেওয়া হবে এবং শত্রুদের ওপর আক্রমণ করতে থাকবে। শত্রুরা তাদের রাইফেল ও সকল অস্ত্রশস্ত্রের নল পশ্চিম দিকে ঘুরিয়ে গুলি করতে থাকবে। ঠিক সেই সময় ২য় দলটি হাবিলদার রেজাউল করিম ও নায়েক বাহাদুরের নেতৃত্বে আক্রমণ করবে এবং পিছন থেকে শত্রুদের বাংকারগুলোতে গ্রেনেড আক্রমণ করে তছনছ করে সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে শত্রুদের লঙ্গরখানার পাশে অবস্থান নেবে। ৩য় দলটি অগ্রসর হয়ে কসবা থানার দিকে এগিয়ে যাবে এবং কসবা থানার আশেপাশে পজিশন নেবে এবং এ অবস্থায় সুবেদার ওহাব সাহেব তার মর্টার প্লাটুন নিয়ে প্রস্তুত থাকবে। আমাদের আক্রমণে শত্রুরা যখন ছোটাছুটি করবে ঠিক তখনই সুবেদার ওহাব সাহেব তার ৩ ও ৪ ইঞ্চি মর্টার দিয়ে অনবরত গোলাবর্ষণ করতে থাকবে। পরিকল্পনামাফিক উপরের নির্দেশ ছাড়াই ২২ অক্টোবর সূর্য যখন পশ্চিম আকাশে অস্ত যাওয়ার অপেক্ষায় ঠিক তখনই আমরা পরিকল্পনা মাফিক আক্রমণ শুরু করলাম। যথাযথ প্রথম দলটি কসবা রেল স্টেশন ও রেললাইনের ওপর দিয়ে দৌড়ে শত্রুদের পিছনে গিয়ে পজিশন নিলাম এবং শক্রদের ওপর আক্রমণ হানতে লাগলাম। শত্রুরাও তাদের রাইফেল ও অস্ত্রের নল পশ্চিম দিকে ঘুরিয়ে আমাদের দিকে আক্রমণ করে প্রতিহত করার চেষ্টা করতে লাগল। ঠিক সেই মুহূর্তে ২য় দলটি পরিকল্পনামাফিক আক্রমণ হানল শত্রুদের পিছন থেকে পূর্ব দিক দিয়ে শত্রুদের বাংকারগুলো রেললাইনের পাশ দিয়ে পূর্ব দিকে মুখ করা অবস্থায় ছিল। শত্রুরা যখন তাদের রাইফেলের নল পশ্চিম দিকে ঘুরালো তখনই পেছন হতে আমাদের মুক্তিপাগল মুক্তিযোদ্ধারা গ্রেনেড আক্রমণে শত্রুর বাংকারগুলো তছনছ করে শত্রুদের নিহত করে ফেলল। এমন সময় ৩য় দলটিও আমাদের প্রথম

২০

দলটিকে অতিক্রম করে পশ্চিম দিক দিয়ে অগ্রসর হয়ে লঙ্গরখানার ও কসবা থানার পাশে গিয়ে পজিশন নিয়ে আক্রমণ শুরু করল। পাকহানাদাররা রাতে খাওয়া-দাওয়ার জন্য ব্যস্ত ছিল। শত্রুরা অস্ত্র নিয়ে পজিশনে যাওয়ার পূর্বেই এলাকাটি দখলে নিয়ে নিলাম। শক্ররা দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পশ্চিম উত্তর ও দক্ষিণ দিকে পালাতে লাগল। সুবেদার ওহাব সাহেব এমন একটি অবস্থার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন, এবার তার ৩ ও ৪ ইঞ্চি মর্টার শেল অনবরত আক্রমণ করতে লাগলো। কসবা থানা, কসবা নতুন বাজার ও কসবা স্টেশন পুরোটাই আমাদের দখলে এল। এই গোপনীয় আক্রমণটি আমাদের মিত্র বাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনী ও আমাদের সেক্টর কমান্ডার ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিও কেউই জানতেন না। আমাদের এই আক্রমণের ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বর্ডার সংলগ্ন তাদের আর্টিলারি ও ফিল্ড আর্টিলারি কামানের গোলার আঘাতে আগরতলা শহর প্রকম্পিত করে তুলল। ২ নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ সাহেব আমাদের দখলকৃত অঞ্চলে ছুটে এলেন এমন সময় এয়ার ব্রাসের গোলার শেলের স্প্রিন্টার লেগে মেজর খালেদ মোশাররফ সাহেব গুরুতর আহত হলেন। আমরা ধরাধরি করে তাঁকে আগরতলা পাঠিয়ে দিলাম। এরই মধ্যে পুরো অঞ্চলটি আমরা পুরোপুরি দখলে নিয়ে পজিশন শক্ত করে শত্রুদের পাল্টা আক্রমণকে প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রইলাম। আমাদের এই অনির্ধারিত আক্রমণের জন্য ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার, ২ নং সেক্টরের কমান্ডার, ৯ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিও আমাদেরকে আন্তরিকভাবে অভিনন্দন ও সাহসিকতার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেন। অক্টোবর মাস চলে গেল। যুদ্ধের আট মাস অতিবাহিত হলো। আমাদের প্রবাসী সরকারকে ভারত সরকার স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন সময় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও পদাতিক বাহিনীকে প্রবাসী সরকারের আন্ডার কমান্ডে নিয়ে কে ফোর্স, এস ফোর্স, জেড ফোর্স সৃষ্টি করে সরকারের নিয়মিত সেনাবাহিনী সৃষ্টি করলেন। ২১ নভেম্বর কসবা থানার উত্তর দিকে চন্দ্রপুর গ্রামের উত্তর পাশে লতিয়ামোড়ায় শত্রুসেনাদের এ অঞ্চলের সবচেয়ে শক্ত ঘাঁটি সেখান হতে আগরতলা আক্রমণ করার জন্য অস্ত্রশস্ত্র মোতায়েন করল। পূর্ব থেকেই এ খবরটি আমাদের রেকির আওতায় ছিল, তাই আমাদের উপরে নির্দেশ হলো লতিয়ানমোড়ার হানাদারদের ডিফেন্স আক্রমণ করতে হবে ও শক্রদের ডিফেন্স আমাদের নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে। সেই মোতাবেক নবম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সি কোম্পানির কোম্পানি কমান্ডার লে. আজিজ, হাবিলদার হালিম, হাবিলদার আওয়াল, হাবিলদার গিয়াস, নায়েক বাহাদুর, ইপিআরের নায়েক জলিল, নায়েক আবদুল লতিফ, নায়েক খালেক, নায়েক মতিউর রহমান ও অন্যান্য মুক্তিযযাদ্ধাদের নিয়ে ২১ নভেম্বর ১২টা ১মিনিটে লতিয়ামোড়া আক্রমণের উদ্দেশে রওয়ানা হই। আমাদের দায়িত্ব ছিল চন্দ্রপুর গ্রামের পশ্চিম দিয়ে রেললাইনের পূর্ব দিয়ে লতিয়ামোড়ার পশ্চিমের গ্রামটিতে শত্রুদের পজিশনের উপর আক্রমণ করা। শুরুতেই পৌনে ১টার দিকে আমাদের কমান্ডার লে.

২১

আজিজ শক্রর গুলিতে শাহাদাত বরণ করেন। ওদিকে লতিয়ামোড়ার পূর্ব দিক থেকে মিত্র সেনাদের একটি রেজিমেন্ট তিয়ামোড়া আক্রমণ করে, উল্লেখ্য আমাদের মিত্র বাহিনীর প্রায় ১ কোম্পানি সৈনিক এখানে শাহাদাত বরণ করেন। আমাদের ৯ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট সি কোম্পানির লে, আজিজ, হাবিলদার হালিম, নায়েক বাহাদুর, মো. হোসেনসহ ৬০জন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত বরণ করেন এবং প্রায় ১০০জন মুক্তিপাগল মুক্তিযোদ্ধা গুরুতর আহত হয়। এখানে উল্লেখ্য, পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ৩/৪টি ব্যাটালিয়ন লতিয়ামোড়ায় পূর্বে অবস্থান করছিল। আমাদের আক্রমণে শক্রদের সকল সৈন্য নিহত ও আহত হয়েছিল। আমি ভোর ৪টার সময় শত্রুদের এক ব্রাশফায়ারে আহত হই। আমার ডান হাতটার উপরের ভাগের হাড়গুলো ভেঙে গুড়ও গুড়ো হয়ে যায় ফলে আমার ডানহাতটি পিছনে হেপারসিকের সাথে বেঁধে রাখা হয়, এ অবস্থায় আমি অনুভব করি ডান হাতটি হয়তো কেটে পড়ে গেছে তাই আমাদের দখলকৃত শত্রুসেনাদের একটি বাংকারে ঢুকে ব্যথা নিবারণ ইনজেকশন লাগিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকি। সকাল ৮টা পর্যন্ত আমার জ্ঞান ছিল, রক্ত ঝরতে ঝরতে শরীরের রক্ত কখন যে শেষ হয়ে গেছে বুঝতে পারিনি, জানতে পারিনি। জ্ঞান ফিরলে বুঝতে পারি একটি সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। একটু সুস্থ হয়ে বুঝতে পারি আমার ডান হাতটি তখনো আছে। আমার চিকিৎসা প্রথমে আগরতলা সালবোন, দ্বিতীয়ত গৌহাটি সামরিক হাসপাতালে, তৃতীয়ত পাটনা সামরিক হাসপাতালে ৪র্থ লক্ষৌ সামরিক হাসপাতালে, ৫ম পুনা আর্টিফিসিয়াল হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে ১৯৭২ সালের ২২ এপ্রিল কলকাতা হয়ে যশোর সেনানিবাসে ফিরে আসি, সেখান হতে আমাকে ৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট পাঠায়। ঢাকা শেরেবাংলা নগর ক্যাম্পে আমাদের বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে যুক্ত হয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকি। এখান থেকে ১৯৭২ সালের শেষের দিকে আমার পূর্বের অবস্থানে (বিমান বাহিনী, ঢাকা) প্রেরণ করেন। এখানে বৈষম্যের কারণে আর চাকরি করা হয়নি। এরপর বেসাময়িক জীবনে ফিরে যাই।

মতিউর রহমান, বীর প্রতীক জন্ম : ২১ এপ্রিল ১৯৪৯, নড়াইল। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন প্রারম্ভিক সময়ে একজন সাধারণ সৈনিক হিসেবে। দুই নম্বর সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধে আহত হন। তার বীরত্বের স্বীকৃতি হিসেবে সরকার তাকে বীর প্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত করে।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!