You dont have javascript enabled! Please enable it!

কুমিল্লা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা
গোলাম মুস্তাফা
২৫ মার্চ, ১৯৭১। মাকে নিয়ে বেড়াতে আসলাম কুমিল্লা শহরে বড় বোনের বাসায়। আমার বড় ভগ্নিপতি কলিম উল্লাহ ভূঞা তখন কুমিল্লার ডেপুটি রেভিনিউ কালেক্টর। তাদের বাসা ছোটরায়, কুমিল্লা পুলিশ লাইনের কাছে, জেলখানা সংলগ্ন। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে খাওয়া-দাওয়া সেরে আমরা চলমান আন্দোলন ও সংগ্রাম নিয়ে গল্প-গুজব করছি। হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে শুরু হলো স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গোলাগুলি। ২/৩ মিনিট পরে গগনবিদারী শব্দে ধ্বনিত হতে থাকলো “জয় বাংলা” এবং বিরামহীনভাবে শুরু হলো রাইফেলের গুলি। সবাই ফ্লোরে শুয়ে পড়লাম। বুঝলাম, পাকিস্তানি সৈন্যরা কুমিল্লা পুলিশ লাইনের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করছে এবং বাঙালি পুলিশ বাহিনী তা প্রতিহত করছে। তুমুল যুদ্ধ। কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যদের বিপুল সংখ্যা ও অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের বিরুদ্ধে স্বল্প সংখ্যক পুলিশ মান্ধাতা আমলের থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল দিয়ে বেশিক্ষণ টিকতে পারলো না। পুলিশ বাহিনীর অনেকেই হতাহত হলেন। রাত প্রায় ২ টার দিকে তারা পশ্চাদপসরণ করলেন। পরবর্তী সময় ২ নং সেক্টরে মেজর খালেদ মোশাররফের অধীনে সংগঠিত হয়ে এবং আধুনিক অস্ত্রেশস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে অন্যদের সাথে তারাও মুক্তিযুদ্ধে সার্থকভাবে অংশগ্রহণ করেন। তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ যুদ্ধের কারণ হলো এই যে, সুদীর্ঘ স্বাধিকার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু পুরো জাতিকে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য ধীরে ধীরে প্রস্তুত করে ফেলেছিলেন। ২৫ মার্চের কালো রাতে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী ঢাকা ও চট্টগ্রাম সহ সমগ্র বাংলাদেশেই বাঙালিদের ওপর অতর্কিতে ঝাপিয়ে পড়েছিল, মেতে উঠেছিল নির্মম হত্যাযজ্ঞে। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তখন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত পাকিস্তানি আর্মির বাঙালি সদস্য, বাঙালি পুলিশ, ই. পি. আর., আনসার, মুজাহিদ, ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-জনতা সকলেই যে যেখানে ছিল সে সেখানেই সম্মিলিতভাবে বা বিচ্ছিন্নভাবে “যার যা কিছু ছিল তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করেছিল”। শুরু হয়ে গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ। এজন্য কাউকে আলাদা করে আবার ডাক দিতে হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের এ পর্যায়কে প্রতিরোধ যুদ্ধ বলা যায়, যা ছিল

২৩

সংক্ষিপ্ত ও বিক্ষিপ্ত। এতে কোনো সমন্বয় বা একক নেতৃত্ব বা কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো কমান্ড ছিল না। পরবর্তী সময় ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের আম্রকাননে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্যগণ কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। গঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর প্রবাসী সরকার কর্নেল এম. এ. জি. ওসমানীকে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ড-ইন-চিফ হিসেবে নিযুক্ত করে এবং সামরিক দিক দিয়ে পুরো বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে। এরপর সরকার যখন ১১টি সেক্টরে ১০ জন সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ | দেয়, তখনই ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধ সুসংগঠিত হতে শুরু করে এবং পাকিস্ত হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে কাক্ষিত বিজয় অর্জিত হয়, অভ্যুদয় হয় বঙ্গবন্ধুর ও বাঙালির আজন্ম লালিত স্বপ্ন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। তখন আমি ছিলাম চিটাগাং ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির দ্বিতীয় বর্ষ সম্মানের ছাত্র। একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও ১১ দফা আন্দোলন সহ স্বাধিকার আন্দোলনে নিবেদিত ও স্পর্ধিত যৌবনের এক উদ্দীপ্ত যুবক ছিলাম আমি। পাকিস্তান নামক দেশটিতে তথা ফাকিস্তানে গণতন্ত্র ছিল সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। সামরিকতন্ত্রের যাতাকলে নিষ্পেষিত পূর্ব বাংলায় তখন ছিল উত্তাল গণ জোয়ার। লাখো লাখো প্রতিবাদী কণ্ঠের মধ্যে আমিও ছিলাম একজন। পাকিস্তানি নির্মম সামরিক শাসন, রক্তচক্ষু, দুঃশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী একজন সচেতন বাঙালি যুবক এবং একজন স্বাধিকার সংগ্রামী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য যে উত্তেজনা ও ছটফটানি সেদিন আমাকে অস্থির করে তুলেছিল সে আবেগের আজ আর কিছুতেই ভাষায় মূর্ত করে তোলা সম্ভব নয়। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র ও স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কিত প্রসঙ্গ ভয়ানক টেনশন ও দুশ্চিন্তায় কেটে গেল ২৫ মার্চের দিবাগত রাত। এল ২৬শে মার্চ। ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশের কোনো খবরই পাচ্ছি না। বঙ্গবন্ধু কোথায় আছেন, কী অবস্থায় আছেন, কী করছেন এসব জানার জন্য প্রাণ ছটফট করছে। আজকের প্রখ্যাত মঞ্চ, বেতার ও টেলিভিশন শিল্পী, পরিচালক, নাট্যকার এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব লাকী ইনাম আমার ভাগনী। তাদের কুমিল্লার বাসায় ছিল পুরনো দিনের ইয়া বড় এক ফিলিপস্ রেডিও। খুব পাওয়ারফুল। লাকীসহ ধীরে ধীরে রেডিওর নব ঘুরাচ্ছি, যদি কোনো দেশের কোনো বেতার কেন্দ্র থেকে ঢাকার প্রকৃত অবস্থা জানার সুযোগ পাই। তখন আনুমানিক সকাল সাড়ে এগারোটা। রেডিওর নব আমরা ঘুরিয়েই চলেছি। হঠাৎ তড়িতাহতের মতো আমরা চমকে উঠলাম। রেডিও থেকে হঠাৎ ঘোষণা এল :“স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী

২৪

বেতার কেন্দ্র চট্টগ্রাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অক্ষত অবস্থায় বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। তারই নির্দেশে…”। আর শোনা যাচ্ছিল না। কিন্তু এটাই আমাদের জন্য যথেষ্ট ছিল। চোখ থেকে আনন্দ ও বেদনার অশ্রু নেমে এল। বঙ্গবন্ধু অন্তত বেঁচে আছেন ! এর এক দেড় মিনিট পর ভেসে এল “কারার ঐ লৌহ কপাট, ভেঙে ফেল কররে লোপাট” জাতীয় পর পর অনেকগুলো দেশাত্মবোধক গান। গানের ফাঁকে ফাঁকে রাজনৈতিক, ছাত্র, যুবক, শ্রমিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তি ও সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে নাম-না-জানা অনেকের কণ্ঠেই পাকিস্তানি জল্লাদদের বর্বরতার কাহিনি, বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে এগিয়ে আসার জন্য আহবান শুনলাম। যাদের কাছে সামরিক বা বেসামরিক আগ্নেয়াস্ত্র আছে তাদেরকে অস্ত্রশস্ত্রসহ লালদিঘি ময়দানে জড়ো হওয়ার জন্য ঘোষকরা আহ্বান জানাতে থাকেন। উদ্দেশ্য ছিল সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ সুসংগঠিত করা। পরে অবশ্য পাকিস্তানিদের দ্বারা বিমান হামলার সম্ভাবনা এবং নিরাপত্তার কারণে সে পরিকল্পনা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। দুপুর আনুমানিক আড়াইটার দিকে আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আবদুল হান্নান তার ভরাট ও দরাজ গলায় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘঘাষণা দিলেন। এতে আমরা আরো উদ্দীপ্ত হলাম। এভাবে বিভিন্ন জন বিভিন্ন সময়ে স্বাধীনতার ঘোষণা এবং মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিতেই থাকলেন। মাঝে-মাঝে অবশ্য সম্প্রচার বন্ধ থাকছিল এবং কখনোবা দুর্বল ও ভুলে ভরা ইংরেজিতেও স্বাধীনতার ঘোষণা জারি হচ্ছিল। এভাবেই চলে গেল ২৬ মার্চ। এল ২৭ মার্চ। বিকেলের দিকে একজন ঘোষক হঠাৎ ঘোষণা করলেন যে এবার স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন মেজর জিয়াউর রহমান। কিন্তু কোনো ঘোষণা এল না। শুধু ভুটভাট-ফুট-ফাট ধরনের আওয়াজ এল। তারপর হঠাৎ ভেসে এল একটার পর একটা দেশাত্মবোধক গান। মাগরেবের নামাজের কিছুক্ষণ পর জিয়ার ঘোষণাটি এল I, Major Zia, Provisional Commander-in-Chief of Bangladesh Liberation Army, hereby proclaim on behalf of our – great leader Bangabandhu Sheikh Muzibur Rahman, the independence of Bangladesh…, The Government formed under Sheikh Muzibur Rahman is the sovereign and legal Government of Bangladesh and is entitled to recognition from all democratic nations of the world”.পরে মেজর জিয়া বাংলায়ও স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এভাবে : “আমি, মেজর জিয়া, আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।…” আর্মির একজন বাঙালি মেজরের কণ্ঠে চমৎকার ভাষায় স্বাধীনতার এ ঘোষণায় সকলেই আমরা আরো উজ্জীবিত হলাম। মুক্তিযুদ্ধ হলো আরো বেগবান।

২৫

মেজর জিয়ার আগেই জানা-অজানা অনেকেই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল হান্নানও করেছিলেন, মেজর জিয়াও করেছিলেন। আবদুল হান্নান করেছিলেন আগে, মেজর জিয়া করেছিলেন পরে। আবদুল হান্নান ছিলেন রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি এবং বেশ পরিচিত। মেজর জিয়া সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন এবং তাই মেজর পদমর্যাদার এই অফিসারকে আমরা কেউই তখন চিনতাম না। এরা যদি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ নাও করতেন তাহলেও স্বাধীনতা হততা এবং বাংলাদেশও স্বাধীন হতো। মনে রাখতে হবে, এঁদের ঘোষণার বেশ আগেই, আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথেই স্বতঃস্ফূর্তভাবেই স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। সকলেই বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন, তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে না হলে ওই সময় ঐ ঘোষণার কোনো মূল্যই হতো না। কেননা অনির্বাচিত কোনো ব্যক্তির স্বাধীনতা ঘোষণার কোনা যুক্তিপূর্ণ, নৈতিক ও আইনগত অধিকার ছিল না। এ অধিকার শুধু ছিল জনগণের দ্বারা বিপুল ভোটে নির্বাচিত সংসদে মেজরিটি দলের নেতা এবং জনগণের মেন্ডেট প্রাপ্ত বাঙালি ও বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বিকেলে এবং ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে সেই দায়িত্বই পালন করেছিলেন। জননেতা আবদুল হান্নান ও মেজর জিয়াও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তারা কেউই নিজে সরাসরি নিজের পক্ষে বা নিজের নামে স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি, কেননা সে অধিকার তাদের ছিল না। তারা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে এবং বঙ্গবন্ধুর নামেই স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন। এটিই ঐতিহাসিক সত্য। জননেতা আবদুল হান্নান এবং মেজর জিয়ার ঘোষণা রেকর্ড করা আছে। রেকর্ডগুলো অবিকৃত অবস্থায় বাজিয়ে শুনলেই আমার বক্তব্য যে সত্য তা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। তবে এটিও সত্য যে, ওই মুহূর্তে স্বাধীনতার ওই দুটো ঘোষণা পাঠ স্বাধীনতা যুদ্ধকে সুসংগঠিত করার বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে কেন এতো হীনমন্যতা ? জননেতা আবদুল হান্নান ঘোষণা আগে দিয়েছিলেন এবং মেজর জিয়া পরে দিয়েছিলেন বলেই কি চট্টগ্রাম বিমান বন্দরের নাম “আবদুল হান্নান আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর” মুছে দিয়ে “হযরত আমানত শাহ আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর রাখতে হবে, তাও আবার একজন বুজুর্গ ব্যক্তির নামে, যাতে ইসলামি আবেগে আঘাত আসতে পারে এই ভয়ে প্রতিপক্ষ নতুন নামটি বাতিল করে আবদুল হান্নান নামটি পুনরায় প্রতিস্থাপিত করতে না পারে ? ফল হলো কী? প্রথম পক্ষের চালাকি থেকে শিক্ষা নিয়ে দ্বিতীয় পক্ষও ঢাকা বিমান বন্দরের নাম “জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর” পালটিয়ে নতুন নাম দিল “হয়রত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর !”

২৬

এতে কার কী লাভ হলো ? একপক্ষ জননেতা আবদুল হান্নানের নাম মুছে দিল বলে অন্য পক্ষ মেজর জিয়ার নামও মুছে দিল। নাম থাকুক আর নাই থাকুক, প্রকৃত সত্য হলো, হান্নান ও জিয়া দু’জনই স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন, জনাব হান্নান পাঠ করেছিলেন ২৬ মার্চ এবং মেজর জিয়া পাঠ করেছিলেন ২৭ মার্চ এবং দু’জনেই স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর নামে। তাই কবির কাব্য একটু পরিবর্তন করে বলতে চাই “সবার উপরে বঙ্গবন্ধু, তাহার উপরে নাই”! কুমিল্লা টু ফেনী : এ জার্নি বাই রিকশা কয়েকদিন ধরে কুমিল্লা শহরে পাকি হানাদার বাহিনীকে টহলরত অবস্থায় দেখলাম আর বুঝলাম যে লাঠি-বল্লম দিয়ে, ঢিল-পাটকেল ছুঁড়ে অথবা ব্যারিকেড দিয়ে আর যাই হোক অন্তত এদেশ থেকে এ জালিমদেরকে তাড়ানো যাবে না। এদের মুখখামুখি হতে হলে সামরিক ট্রেনিং চাই, চাই আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র। প্রচণ্ড আবেগ, মানসিক অস্থিরতা এবং শত্রু-সেনাদের মোকাবিলা করে দেশকে হানাদারমুক্ত করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এক নিঝুম সন্ধ্যায় বেরিয়ে পড়লাম বাসা থেকে। অসংখ্য বাড়ির দেয়াল টপকিয়ে এবং হায়েনাদের দৃষ্টি এড়িয়ে অবশেষে শহর থেকে বের হতে পারলাম। পৌছলাম গোমতী নদীর তীরে এবং সব শেষে সোনামুড়া বর্ডার হয়ে ভারতের মাটিতে। অগণিত শরণার্থী দলে দলে বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসছে নিরাপদ আশ্রয়ের প্রত্যাশায়। ভারতের জনগণ তাদের জন্য খুলেছে অসংখ্য অভ্যর্থনা কেন্দ্র। চিড়া-মুড়ি-কলা খেয়ে তেমনি এক অভ্যর্থনা কেন্দ্রে রাত কাটালাম। পরদিন সকালে খোঁজ-খবর নিয়ে জানলাম যে, কুমিল্লার দেবীদ্বার এলাকা থেকে জাতীয় সংসদে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের এমএনএ ক্যাপ্টেন (অব.) সুজাত আলী সাহেব ত্রিপুরা রাজ্যের উদয়পুর শহরের নিকটবর্তী পালাটানা নামক স্থানে সহসাই একটি ট্রেনিং ক্যাম্প খুলবেন। পালাটানা ট্রেনিং ক্যাম্পের ঠিকানা জোগাড় করা গেল। মা আমার বড় বোনের বাড়িতে নিরাপদেই থাকবেন। কিন্তু ট্রেনিং তথা যুদ্ধ-যাত্রার পূর্বে এবং স্বদেশের তরে নিজের জীবনটি দান করার পূর্বে মাকে সালাম করার এবং এক নজর দেখার জন্য প্রাণে দারুণ অস্থিরতা বোধ করলাম। সুতরাং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আবার ফিরে গেলাম কুমিল্লা শহরে, বোনের বাড়িতে। আমার মা, ভগ্নিপতি ও ভাগিনা-ভাগনী সবাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক। অনেক উৎসাহ আর উত্তেজনার সাথে তারা আমার পকেটে করে নিয়ে যাওয়া ভারতীয় মুদ্রা দেখলো এবং মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার আমার সিদ্ধান্তের কথাটি শুনলেন। কিন্তু একটি কারণে মিঞাভাই (আমাদের বড় ভগ্নিপতিকে আমরা মিঞাভাই বলেই ডাকি) অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হলেন। কারণ তার মতে ভারতীয় মুদ্রাসহ পাক সেনাদের হাতে ধরা পড়লে আমাকে যেমনি হত্যা করা হতো তেমনি আমার বড়

২৭

বোনের পুরো পরিবারই ভয়াবহ বিপদ ও ধ্বংসের সম্মুখীন হতে পারতো। তাই তো ! নিজের বোকামোপনায় নিজে খুবই লজ্জিত হলাম। মিঞাভাই অত্যন্ত রাগত স্বরে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তার বাড়ি ত্যাগ করার নির্দেশ দিলেন। আমি অবশ্য ওই মুহূর্তেই চলে যেতে চাইলাম। কিন্তু উনি বাধা দিলেন এবং পরদিন ‘মা’কেসহ নিয়ে যেতে বললেন। তার ধারণা, যুদ্ধের ফাঁকে ফাঁকে সুযোগ পেলেই আমি মায়ের টানে তার বাসায় আসবো এবং সবার জন্য বিপদ সৃষ্টি করবো। তাকে আশ্বস্ত করে বললাম যে, যুদ্ধে হয় আমি শহীদ হবো, না হয় শুধু বিজয়ী হয়ে তবেই ফিরে আসবো। কিন্তু উনি ওনার সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। মিঞাভাইয়ের কঠোর-কঠিন সিদ্ধান্তে পরিবারের সবাই নিশ্ৰুপ রইলেন। বেশ অসহায় বোধ করলাম। অস্বস্তিকর রাতটি বড় কষ্টে অতিবাহিত করলাম। এ বিপদসংকুল পরিস্থিতিতে মাকে নিয়ে কোথায় যাই ? এ ঘটনায় আমার মুক্তিযুদ্ধে যোগদান কিছুটা হলেও বিলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলো। ঠিক করলাম, মাকে নিয়ে ফেনীর বর্তমান ফুলগাজী থানাধীন দরবারপুর গ্রামের নিজ বাড়িতেই চলে যাব। কিন্তু যাব কীভাবে? বিক্ষুব্ধ জনতা বহু স্থানেই রেললাইন উপড়ে ফেলেছে। তাই রেল চলাচল বন্ধ। ঢাকা-চট্রগ্রাম হাইওয়ের অনেক ব্রিজ উড়িয়ে দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা। বিশাল বিশাল গাছের গুড়ি দিয়ে রাস্তায় বারিকেড তৈরি করে রেখেছে প্রতিবাদী জনতা। সুতরাং বাস চলাচল বন্ধ। শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল একটি রিকশা। নতুন রিকশা। চালক সুঠাম দেহের কালো কুচকুচে ও তেলতেলে শরীরের ও এক তাগড়া যুবক। আমার মা বড়ই স্বল্পভাষী, বড় বেশি সহজ-সরল মহিয়সী অনন্যাসাধারণ এক মা। অনাকাক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত এ পরিস্থিতিতে তিনি খুবই ব্ৰিত। সকাল সাড়ে আটটায় আমাদের বিপদসংকুল রিকশা-যাত্রা শুরু হলো। অশ্রুসিক্ত এবং নিঃশব্দে বিদায়ের এ করুণ দৃশ্যটি আমার ঘটনাবহুল জীবনের একটি সকরুণ অধ্যায় হয়ে রইলো। ছোটরা হতে শহরের বিভিন্ন রাস্তা ঘুরে কান্দিরপাড়, মনোহরপুর, চৌমুহনী মোড়, চকবাজার হয়ে শহর থেকে বের হয়ে ফেনীর পথে ডানে মোড় নিলো রিকশা। কিন্তু মোড়ের বাম দিকের পেট্রোল পাম্পের দিক হতে হঠাৎ উদিত হয়ে ৫/৬ জন পাকি আর্মি আমাদের রিকশার গতি রোধ করে দাঁড়ালো এবং উন্মুক্ত বেয়নেটসহ চাইনিজ রাইফেল ঠেসে ধরলো আমার কণ্ঠনালি বরাবর। মা অনুচ্চ কণ্ঠে সূরা আর-রহমান’ ও ‘সূরা ইয়াসীন তেলাওয়াত শুরু করলেন। কণ্ঠনালির উপর বেয়নেটের চাপ ক্রমেই বাড়ছে। নেমে আসছে রক্তের ক্ষীণ একটি ধারা। সম্ভাব্য অসহায় এবং অর্থহীন মৃত্যুর জন্য আমি প্রস্তুত হয়ে গেলাম। কিন্তু কল্পনাতীত রকমের কষ্ট হচ্ছিল শুধু এই ভেবে যে, এ স্থানে এ পরিস্থিতিতে আমার মৃত্যুর পর আমার মা’র কী হবে। কিন্তু উদ্ধত ও নিষ্ঠুর পাকি সেনাদের মধ্যে একজনকে কেমন জানি একটু ভিন্ন রকম মনে হলো। তিনি এগিয়ে এলেন এবং

২৮

আমার দিকে অনুসন্ধিৎসু ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি তাঁকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বললাম। ‘ওয়ালাইকুম সালাম’ বলে উনি এবার অত্যন্ত সম্মানের সাথে ‘মা’র দিকে তাকালেন। মুগ্ধ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ কোরআন তেলাওয়াত শুনলেন, সঙ্গিনধারীকে নিবৃত্ত করলেন এবং আমাদেরকে চলে যেতে বললেন। জমে থাকা নিশ্বাস ফোস করে বেরিয়ে এল আমার বুক থেকে। রিকশা আবার চলতে লাগলো উল্কার মতো তীব্র গতিতে। পথিমধ্যে অসংখ্য ব্যারিকেড এবং ভাঙা ব্রিজ পাওয়া গেল। স্থানীয় জনগণের সহায়তায় সেসব বাধা অতিক্রম করে এবং নৌকায় করে রিকশাসহ নদী পার হয়ে এগিয়ে চললাম আমরা। কিন্তু যে বিষয়টি আমাকে হতবাক করে দিলো তা হলো, শত শত পরিবারের হাজার হাজার পুরুষ, মহিলা এবং শিশু হাতে ও মাথায় ব্যাগস্যুটকেস-গাট্টি-বোকাসহ ধীর পায়ে ক্লান্ত ও ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। হাইওয়ে ধরে দক্ষিণ দিকে। সে এক অবিশ্বাস্য রকমের সুদীর্ঘ মানব কাফেলা ! আলাপ করে জানা গেল, এদের বেশিরভাগই ঢাকা হতে কুমিল্লার দক্ষিণাংশ, ফেনী, নোয়াখালী অথবা চট্টগ্রামের পথ-যাত্রী। ঢাকায় হানাদার দস্যুদের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ হতে পলায়নরত এসব পরিবারের মধ্যে শিক্ষিত-অশিক্ষিত-স্বচ্ছলঅস্বচ্ছল সব ধরনের মানুষই ছিল। কিন্তু আজ সবাই একাকার। প্রিয় শহর ঢাকা আজ তাদের কাছে বিভীষিকাময় এক নরকপুরী ছাড়া আর কিছুই নয়। সেখান থেকে এরা কোনো রকমে বেরিয়ে এসেছে, ছুটে চলেছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে, শেকড়ের সন্ধানে। সেই অবহেলিত গ্রামীণ জনপদের দিকে তারা অগ্রসরমান, যেখানে এই চলমান বিশাল কাফেলার অধিকাংশ মানুষই হয়তো তাদের শিশু ও কৈশোর কাল কাটিয়ে ছিল, তারপর ধীরে ধীরে বিস্মৃত হয়েছিল সেই মূল শিকড়ের কথা, নগর সভ্যতার অমোঘ আকর্ষণে। কিন্তু সেই অবহেলিত গ্রামই হতে যাচ্ছে আজ তাদের অপেক্ষাকৃত নিরাপদ আশ্রয়স্থল। আরেকটি অবাক ব্যাপার হলো এই যে, কিছুদূর পরপরই গ্রামের জনগণ এই অসহায়, অচেনা ও ক্লান্ত পথিকদের জন্য সামিয়ানা টাঙিয়ে বিশ্রামের ও আতিথেয়তার ব্যবস্থা করে রেখেছে। পানীয় জল, চিড়া-মুড়ি-খই-গুড় দিয়ে আপ্যায়ন করছে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ছুটে-চলা এই অসহায় বাঙালিদের। তাল-পাতার হৃদয়-কাড়া মনোরম ডিজাইনে তৈরি হাত পাখা দিয়ে করছে বাতাস। বেড়া দিয়ে তৈরি অস্থায়ী টয়লেট ও প্রস্রাবখানাগুলো মা-বোন-বৌদের জন্য যে কতখানি | প্রয়োজনীয় ছিল তা আজ আর লিখে বুঝানো যাবে না। রাস্তার পাশের এ ধরনের অস্থায়ী “সরাইখানায়” আমরাও বেশ কয়েকবার আপ্যায়িত হলাম আর অবাক বিস্ময়ে, তৃপ্তিতে ও কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হলাম। ২০১৪ সালের শুরুতে এসে তাই আজ বারে বারে মনে পড়ে ১৯৭১ সালের সেই সব আবেগমথিত দিনগুলোর কথা যখন সমগ্র জাতি বঙ্গবন্ধুর ডাকে

২৯

অনুপ্রাণিত, স্বাধিকার তথা স্বাধীনতার প্রশ্নে ইস্পাত-কঠিন দৃঢ়তায় একতাবদ্ধ, মানবিকতায়-ভ্রাতৃত্ববোধে-সহমর্মিতায় ছিল সমৃদ্ধ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজ চোখে পড়ে ঠিক তার বিপরীত চিত্র। প্রাণে তাই বড় কষ্ট পাই। ফেনী তখনো মুক্তিযোদ্ধাদের তথা জনতার নিয়ন্ত্রণে। ফেনী শহরের প্রবেশমুখে মুক্তিযোদ্ধাদের চেক-পোস্ট এবং সামরিক প্রস্তুতি দেখে উল্লসিত হলাম। ফেনীর সর্বজন শ্রদ্ধেয়, নিঃস্বার্থ ও অবিসংবাদিত চিরকুমার জননেতা, আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য জন্মভিটা খাজা আহমেদ তখন সার্থকভাবে ফেনীতে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সংগঠিত করছিলেন। মধ্য রাত্রির পর বাড়ি এসে পৌছালাম। এটাই আমাদের। রিকশাওয়ালার খাওয়া-থাকার ব্যবস্থা করে মা ও আমি বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। অশান্ত মন শান্ত হয়ে এল, প্রশান্তিতে জুড়িয়ে গেল প্রাণ। মুহুর্তের মধ্যেই তলিয়ে গেলাম গভীর নিদ্রায়। দেশকে রাহুমুক্ত করতে হবে, হটিয়ে দিতে হবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে, আনতে হবে প্রত্যাশিত স্বাধীনতা – এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে পরদিন সকাল থেকেই শুরু হলো আমার যুদ্ধযাত্রার।
গোলাম মুস্তাফা জন্ম : ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫০, ফেনী। আলী আজম হাই স্কুল, ফেনী কলেজ হয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে সম্মানসহ এমএ। গর্বিত রোটারিয়ান গোলাম মুস্তাফা মানুষকে ভালোবেসে সমাজের কম ভাগ্যবানদের ভাগ্য পরিবর্তনে সচেষ্ট। একাত্তরে গোলাম মুস্তাফা। ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর সাথে গণযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধ করেন। কমান্ডিং অফিসারের স্টাফ অফিসার ও পাইওনিয়ার প্লাটুনের একাংশের কমান্ডার হিসেবে রণাঙ্গনে বীরত্বের স্বাক্ষর রাখেন। তার ফেনী বিলোনিয়া-রণাঙ্গনে এক প্রান্তর এবং যুদ্ধ করেছি বিজয় এনেছি বই দুটি আমাদের যুদ্ধ সাহিত্যের অনন্য সংযোজন।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!