You dont have javascript enabled! Please enable it! লে.কর্নেল মো. হাবিবুল্লাহ বাহার - সংগ্রামের নোটবুক

লে.কর্নেল মো. হাবিবুল্লাহ বাহার

কুমিল্লার মুরাদনগর থানার গাজীপুর গ্রামে আমার জন্মস্থান । জন্মতারিখ ৬ই ডিসেম্বর ১৯৩৪ । আমার পিতার নাম মৃত হাজী ছমিরউদ্দিন । তিনি জমির মালিক (গৃহস্থ) ছিলেন । ১৯৭৮ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন । মাতা আবেদুন নেছা । আমার ছোট বেলায় তার মৃত্যু হয় । আমরা চার ভাই, দুই বোন । আমি দ্বিতীয় । গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে প্রথমে লেখাপড়া করি । তারপর শিমরাইল সেকেন্ডারী স্কুল (কসবা,কুমিল্লা) ও পরে চারগাছ অখিল দত্ত হাই স্কুল (কসবা, কুমিল্লা) হতে ১৯৫১ সনে ২য় বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করি (তখন সাইন্স, আর্টস ছিল না)। ১৯৫১ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে এ্যাপ্রেনটিস হিসেবে যোগদান করি । তারপর পাকিস্তানের মারী হিল ও রাওয়ালপিণ্ডিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি । সকল যোগ্যতা অর্জন করে কম্পিটিশনে পশ্চিম পাকিস্তানের কোটায় নির্বাচিত হই । ১৯৫৯ সনে অফিসার্স ট্রেনিং স্কুল, কোহাটে শিক্ষা গ্রহণ করে ১৯৬০ সালে সিগন্যাল কোরে কমিশন প্রাপ্ত হই । তারপর রাওয়ালপিণ্ডি, কোহাট, করাচীতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি । ১৯৬৩ সনে ঢাকাতে কমামডো প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি । মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলাম না তবে সচেতন নাগরিক হিসাবে আওয়ামী লীগ ও তার নেতা বঙ্গবন্ধুর ভক্ত ছিলাম । আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করার পর আমার স্ত্রী-পুত্র সবাইকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট ইস্পাহানী পাবলিক শুলে বন্দি করা রাখা হয়েছিল । আমি রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছিলাম । ষাট দশকের প্রথম লোকজনের মনোভাব দেখলেই বোখা যেত যে এরা মার্শাল ল মনে প্রাণে মেনে নেয়নি । ঊনসত্তরে যখন সেকেণ্ড মার্শাল ল জারী করা হল তখন আমি ভবিষ্যতবাণী করেছিলাম যে পাকিস্তান ভেঙে যাবে । কারণ লোকজনের চালচলন, মোনভাব সবই পাকিস্তানের বিপক্ষে ছিল । তবে একাত্তরের মতো যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতে হবে-এ ধরনের চিন্তা করিনি ।

উনসত্তরে আমি কোহাট ছিলাম। চিন্তা করলাম কীভাবে পূর্ব পাকিস্তানেয়াসা যায়। তখন পোস্টিং ব্রাঞ্চ বাঙালি অফিসার ছিলেন লে. কর্নেল মান্নান সিদ্দিকী। আমি আমার স্ত্রীসহ তাঁর বাড়িতে গিয়ে তাকে বললাম যা বাড়িতে (দেশে) অসুবিধা, আমাকে পূর্ব পাকিস্তানে বদলী করে দেন। জুলাই মাসে (১৯৬৯) পূর্ব পাকিস্তানে আসি। আসার সময় আমার প্রভিডেন্ট ফান্ড হতে দশ হাজার টাকা হাউজিং এর বাহানা দিয়ে তুলে নেই। সত্তরের নির্বাচনের সময় পিন্ডিতে ছিলাম ইলেকট্রনিক ওয়ারগেয়ারের উপর এক মাসের একটা কোর্সে। পাকিস্তানিরা জানতে চাইত ইলেকশনের খবর। বলতাম আওয়ামী লীগ ৯৯.৫০% ভোট পাবে। যেহেতু আমি হাবিজাবি কিছুই সহ্য করতাম না তাই পাকিস্তানিরা আমাকে বলত এই-ই শেখ মুজিব। এখানে উল্লেখ্য ৭০/৭১ সালে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে যাদের সাথে আলাপ করতাম তাদের তেমন চেতনা ছিল না।চাকরি-বাকরি করে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে সুখের সংসার করব এরকমই মনোভাব ছিল।তবে কেউ কেউ পাকিস্তানপন্থী ছিলেন। আমি ২৫ শে মার্চে ১৯৭১ স্নে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের বিগ্রেড সিগন্যাল অফিসার ছিলাম(তখন ক্যান্টনমান্ট থেকে চট্রগ্রামের দিকে রওয়ানা হয়। এই সংবাদ আমি কুমিল্লা এক্সচেঞ্জের মি. আবদুস সুকুর, যিনি এক্সচেঞ্জ সুপারভাইজার ছিলেন তার মারফত নোয়াখালী, ফেনী ও চট্রগ্রাম পাঠিয়েছিলাম।যার ফলে ফেনীতে একটা কাঠের পুল জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং মেজর রফিক যিনি চট্রগ্রামে ইপিআর হেডকোয়ার্টারে এডজুটেন্ট ছিলেন, এম্বুশ স্থাপন করে ২৪এফেফ-এর ব্যাটালিয়ান কমান্ডার লে. কর্নেল শাহপুর খান বখতিয়ার ও তার সৈন্যদের নিহত করেছিলেন। ২৫শে মার্চ রাত ১২টার সময় ব্রিগেড মেজর সুলতান (পাণজাবি, বালুচ রেজিমেন্টে কর্মরত)আমাকে জানায় যে বাঙালিরা বিদ্রোহ করেছে। তুমি একটা নিরাপত্তা ঝুঁকি। আমাকে বন্দো অবস্থায় সেলে রাখা হয়। আমার স্ত্রী আমার বন্দী অবস্থার কথা জানতে পেরে মেজর সুলতাঙ্কে ফোন করে বলে, “আমার স্বামীকে যদি না ছেড়ে দাও তবে ফোন করে অন্য সব অফিসারকে বলে দিব। ২৬ শে মার্চ সকালে আমাকে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসা হয় ও ৪জন গার্ড বাড়ির ৪ কোনে মোতায়নে রাখা হয়। তারাবাড়ির টেলিফোন লাইন কেটে দেয়। তারপর কোনো খবর পাওয়ার সুযোগ ছিল না। রেডিওতে ভয়েস অফ আমেরিকা, বিবিসি শুনতাম। ২৬শে মার্চ দিন ও রাত নিজ বাসায় বন্দী অবস্থায় থাকি। ২৭শে মার্চ সন্ধ্যার পর আমি পালিয়ে যাবার সিন্ধান্ত নিলাম। কারন বন্দী অবস্থায় ভয়েস অফ আমেরিকা এবং মূলত বিবিসি হতে জেনে গেছি এদেশে কী ঘটছে। আমি বাচঁতে চাইলাম কারন আমি ভালো করে জানতাম আমার জীবন মৃত্যু ঝুঁকিতে আছে। স্ত্রীকে বললাম যে বাড়ির সামনে গিয়ে হৈ- হল্লা করতে মানে কান্না কাটি করে সেন্ট্রীদের মনযোগ যেন তার দিকে যায়। আমার বাড়ির পেছনে ধান ক্ষেত ছিল। পাকের ঘরের জানালার ফ্লাইপ্রুফ নেট কেটে নীচে নেমে ধানক্ষেতের ভিতর দিয়ে প্রায় ১০০ গজ হামাগুড়ি দিয়ে চলে যাই। তারপর অন্ধকার হয়ে গেল তখন আমিঠে হাঁটতে লাগলাম। এই এলাকাটা ক্যান্টমেন্টের মেইন রোডের খুব কাছে ছিল। তারপরই সিভিল এরিয়া।একজন বেসামিক ব্যক্তি আমাকে চ্যালেঞ্জে করল। তাকে পরিচয় দিলাম। সে কিছু না বলে চলে গেল। তারপর উত্তর- পূর্ব দিকে হাঁটতে লাগলাম। রাস্তায় কাদা , পানি ছিল। আলেকার চর বাজারের মাঝখান দিয়ে যে রাস্তা গেছে তা দিয়ে গোমতী নদীর পাড়ে গেলাম। নদীতে পানি কম ছিল। নদী পার হয়ে দেখলাম যে লোকজন কুমিল্লা শহর হতে পালিয়ে যাচ্ছে। সেখানে আওয়ামী লীগের একজন লোক পেলাম। তার সাথে বুড়িচং চলে গিয়ে তার বাড়িতে রাত কাটালাম। তার নাম মনে নেই। যেহেতু আমি আমার আইডেটিটি দেইনি ওরা সন্দেহ করে আমাকে বুড়িচং থানায় নিয়ে এলো। থানার ওসিকে আমার পরিচয় দিলাম। তারপর ওখানে অনেক লোক জড় হলো।আমি আর্মির লোক। ওরা (জনগন) কী করবে? দিক নিদের্শনা পাবার জন্য। যেহেতু আমার হাতে কোনো সৈন্য ছিল না তাই মনে মনে ডিসিশন নিলাম যে যেহেতু আর্মি ক্যান্টনমেন্ট কাছে তাই এই জায়গা হতে দূরে চলে যাওয়াই ভাল। ২৮শে মার্চ বুড়িচং থানায় যখন বসে আছি তখন আমার সাথে থানায় মিলিত হলেন তখন কার ক্যাপ্টেন হায়দার। তার সৈনিক ব্যাটম্যান্ব তার সাথে ছিল। হায়দার কুমিল্লা ক্যান্টমেন্টে কমেন্ডো ব্যাটলিয়ানে ছিলেন, আগে হায়দারের সাথে আমার পরিচয় ছিল না, বুড়িচং- এ প্রথম পরিচয় হয়। আমি বললাম যে, ফোর বেঙ্গলতো ব্রাক্ষণবাড়িয়া চলে গিয়ে একটা কোম্পানি নিয়ে কুমিল্লা নিয়ে কুমিল্লা ক্যান্টমেন্ট রেইড করে অস্ত্র উদ্ধার করবেন। আমি মেনে নিলাম। ২৮ শে মার্চ রাতে আমি চলে গেলাম কংশনগর বাজার।ওখানে এক আওয়ামী লীগ কর্মীর বাসায় রাত কাটালাম। হায়দারের কোনো খোঁজ খবর না পেয়ে ব্রাক্ষনবাড়িয়া ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গিয়ে দেখি ওখানে দুই জন জুনিয়র ক্যাপ্টেন গাফফার ও অফিসার, সেকেন্ড ইন কমান্ড ও কোয়ার্টার মাস্টার পাঞ্জাবী ছিল ও তাদের ডিসআর্ম করে জেলে রাখা হয়েছিল। মেজর খালেদ মোসশাররফ এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে শামসেরনগর চলে গিয়েছিলেন কাজেই কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট আক্রমন করার জন্য ডিসিশন দেবার মতো কোনো অফিসার ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় ছিলেন না। ২৯ তারিখে (মার্চ) বিকাল বেলা আমরা বসে আছি এমন সময় মি.আবদুল মান্নান (যিনি সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার হাউসের কর্মকর্তা ছিল) ও আরো একজন লোক দুজনে এসে আমাদের বললেন যে ইন্ডিয়া থেকে আর্মি অফিসার চাচ্ছে। তখন আমি কালবিল্ম্ব না করে ওদের সাথে রওয়ানা দিলাম। ক্যাপ্টেন হায়দার ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে যোগ দেন। মি.মান্নান ও তার সঙ্গীর বাড়ি ছিল কসবাতে। ওরা কসবার এম.পি সিরাজুল হকের নির্দেশে ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় এসে আমাদের খবর দেয় (মি.মান্নানরা ইন্ডিয়া যায়নি, সিরাজুল হক গিয়েছিল কিনা বলতে পারব না।) তারাসবাই আমার সাথে ইন্ডিয়া গিয়েছিলেন। তারপর ব্রাক্ষনবাড়িয়া থেকে দক্ষিন দিকে আসতে লাগলাম। উজনিসার ব্রীজের উত্তর পাড়ে আসার পর দেখলাম যে, পুলের দক্ষিন পাড়ে পাক আর্মির সম্ভবত ৩১ মর্টার ব্যাটারী ব্রাক্ষনবাড়িয়ার সিকে এডভান্স করার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। পুলের দক্ষিন পাড়ে জনগন রাস্তা কেটে প্রতিবন্ধক তৈরি করেছিল, তারজন্য তারা আসতে পারছিল না। আমরা এই খবরটা ব্রাক্ষনবাড়িয়া পাঠিয়ে দেইও ব্রীজ বাইপাস করার জন্য পশ্চিম দিকের মাঠে নেমে যাই। এই ঘটনাটা এখনও মনে পড়ে। তারপর ২৯তারিখ রাতে একটা গ্রামে রাত কাটাই। ৩০ তারিখ সকালবেলা কসবার দিকে রওয়াবা হই। কসবার মমতাজ বেগমের (তখন সংসদ সদস্য) বাড়িতে কিছু খাওয়া দাওয়া করি এবং ওখান থেকে সিরাজুল হক সাহেবের একটা ভক্সওয়াগন গাড়িতে করে সিরাজুল হক সাহেব সহ কমলা সাগর বিওপি (ইন্ডিয়া) যাই। সেখানে বিএসএফের ক্যাপ্টেন চক্রবর্তী (বাঙালি এবং বাড়ি ছিল বাংলাদেশে) আমাদের অভ্যর্থনা জাবিয়ে আগরতলা নিয়ে যান। আগরতলায় সন্ধ্যার সময় আমি ৯১ BSF কমান্ডার লে.কর্নেল ব্যানাজীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। কমলাসাগর বিওপিতে ক্যাপ্টেন চক্রবর্তীর সাথে বিশেষ কথা হয়নি। আমরা সবাই খুব পরিশ্রান্ত ছিলাম। ৯১ BSF এর কর্নেল ব্যানার্জীর সাথে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ হয়েছিল। ওরা সে পর্যন্ত রেডিও, পত্র-পত্রিকা আর কিছু শরনার্থীর কাছথেকে পূর্ব পাকিস্তানের খবর জেনেছিল। আলাপের শেষ দিকে কর্নেল ব্যানার্জী ঠাট্রা করে বললেন, “দাদা এবার ইলিশ মাছ খেতে পারব”। ৩১তারিখ ( মার্চ) সকালের দিকে মান্নানসহ আমি থ্রি, এয়ামুনিশন ও গ্রেনেড নিয়ে কসবা আসি। কসবায় ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের একজন সৈনিককে পাই (তার নাম এখন মনে নেই)। তাকে সহ মন্নাঙ্কে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার হাউস এরিয়াতে আর্মস অয়ামুনিশন গুলো দিয়ে পাঠিয়ে দেই এগুলো (আর্মস-অ্যামুনিশন) ব্যবহার করার জন্য লোকটা যেহেতু ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের ছিল তাই এগুলোর ব্যবহার সম্বন্ধে জানত। ওকে পাঠানো হয়েছিল যেন ঐসব অস্ত্রের ট্রেনিং- এ দিতে পারে। তারপর আমি আগরতলা চলে গেলাম। ১লা এপিল-আগরতলা থেকে রামগড় গেলাম চট্রগামের অবস্থার খোঁজ নিতে। ওখানে গিয়ে দেখতে পেলাম মেজর জিয়াউর রহমান, ক্যাপ্টেন রফিককে যিনি ইপিআরে ছিলেন। রফিকের অবাঙালি ইপিআর সেক্টর কমান্ডারকে এরেস্ট করে ইন্ডিয়ার আর্মির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। জিয়া,রফিক কাউকেই আগে চিনতাম না। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ- আর ও দক্ষিণে সীতাকুন্ডে গেলাম ট্রুপ্সদের অবস্থা দেখার জন্য। সীতাকুন্ড পর্যন্ত জিয়াউর রহমানের ট্রিপ্সদের লাস্ত পজিশন ছিল। রামগড় থেকে আবার আগরতলা হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করি। এটা এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহের দিকে হবে। বাংলাদেশে ঢুকে কসবায় মমতাজ বেগমের বাড়িতে তখনকার অবসর প্রাপ্ত কর্নেল ওসমানীকে বড় খারাপ অবস্থায় দেখতে পেলাম(শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত)।

সময়টা প্রায় এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে হবে। তার ছদ্মবেশ ছিল, মোচ কামানো ছিল। আগে কর্নেল ওসমানীর সাথে আমার ব্যাক্তিগত পরিচ্য ছিল রাওয়ালপিন্ডিতে। আমি ওসমানী সাহেবকে ভারতে যাবার প্রস্তাব দিলে তিনি রাজি হতে চাননি।তার ভয় ছিল ভারতীয়ারা তাঁকে বন্দী করবে যেহেতু তিনি ১৯৬৫ সনে ভারতীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। যাহোক তাকে অনেক বুঝালাম- আপনিতো জেনেরেল হেডকোয়ার্টার, রাওয়ালপিন্ডিতে ডিপুটি ডাইরেক্টর, মিলিটারি অপারেশন ডাইরেকরেট ছিলেন।যুদ্ধ করেছেন, আমিতো ফ্রন্টে করেছি ’৬৫-এ, কই আমাকেতো ওরা কিছু বলেনি। সিচুয়েশন এখন্তো অন্য রকম। এখনতো আপনি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে। শেষে কর্নেল ওসমানী শর্ত দিলেন যে তাকে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে এমএনএ হিসেবে, Mr.osmani, MNA of bangladesh. আমরা দুজনে কসবা দিয়ে পায়ে হেঁটে বর্ডার ক্রস করলাম।সাথে অন্য কেউ ছিল না। যাবার পথে তাকে বিস্তারিতভাবে সব বিষয় বললাম। যখন বললাম Lt Col Reza has crossed over to the border. হঠাৎ তখন উনি বলে বসলেন, তাকে কিছু দেয়া যাবে না। He (Lt Col Reza) was a senior officer at that time. আমি বললাম Why not? তাকেতো অন্তত ট্রেনিং- এর দায়িত্ব দেয়া যায়….। জিয়াউর রহমানের কথা বললাম। কর্নেল ওসমানী জিজ্ঞাসা করলেন, Which Zia? Is that দালাইলাম? তাকে বললাম, কোনো দালাইলামা টালাইলামা কাউকে চিনিনা, মেজর জিয়াউর রহমান…। পরে জেনেছি যে মেজর জিয়ার (যিনি বর্তমানে বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ও আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিলেন) নাকের গড়নের জন্য ওসমানী তাকে দালাইলামা বলে ডাক্তেন। আগরতলা ৯১ বিএসএফ হেডকোয়ার্টারের ব্রিগেডিয়ার ভিসি পান্ডের সাথে কর্নেল ওসমানী পরিচয় করিয়ে দেই একজন বেসামরিক লোক হিসেবে। কারন তিনি আমাকে তাই বলেছিলেন যে তার যেন কর্নেল হিসেবে পরিচয় না দেই। ব্রিগেডিয়ার পান্ডে ইন্টেলিজেন্স- এর অফিসার ছিলেন। দিল্লী থেকে এসেছিলেন আগরতলা তারা দুজনে দীর্ঘক্ষন আলোচনা করলেন। লম্বা আলাপের পর ব্রিগেডিয়ার পান্ডে বললেন,’তুমি সেই ওসমানী না যে ১৯৪২ সালে আমার সাথে কোর্স করেছিল? ওসমানী বুঝলেন লুকানোর আর কিছুই নেই। যুদ্ধের সময় সবচেয়ে অসুবিধা ছিল যে আওয়ামী লীগের কেউই আর্মি সম্বন্ধে তেমন কিছুই জানতেন না। ওসমানী যা বলতেন ভাবতেন তাই ঠিক। ওসমানী ছিলেন একমাত্র সামরিক বিষয়ক উপদেষ্টা। তিনি প্রবল ভালোলাগা এবং প্রবল ঘৃনার মানুষ। আমি মুক্তিযুদ্ধে যাবার আগে মেজর ছিলাম। যেখানে মেজর শফিউল্লাও মেজর জিয়া মেজর জেনারেল হয়ে গেলেন।বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের খড়গ হস্তের শিকার হলাম[কারন, যুদ্ধের সময় জিয়া আর শওকত উভয়েই চট্রগ্রামে থাকতে চাইতেন যেহেতু তাদের ট্রুপ্স চট্রগ্রামে ছিল এবং দুজনের মধ্যে বচসা হয়। কিন্তু ওসমানী একজনকেও চট্রগ্রামে রাখেননি। দুজনকেই সরিয়ে মেজর রফিককে ওখানে রাখেন। তারপর শওকত কলকাতায় গিয়ে ওসমানী রাগ ভাঙাতে সক্ষম হন।একাত্তরের অগাস্টের পর জিয়ার হাতে কোনো কাজ ছিল না। দেশ স্বাধীন হবার পর জিয়ারই চীফ অফ স্টাফ হবার কথা কারন জিয়া শফিউল্লার কোর্স মেট হলে ও সিনিয়র ছিলেন।জিয়া খুব মনমরা থাকতেন। এককথায় যেহেতু আমি সামরিক বাহিনীর কমেন্ডো ট্রেনিং প্রাপ্ত ছিলাম সেহেতু আমি বন্দী অবস্থা থেকে পালাতে পেরেছিলাম এবং আল্লাহতালার উপর পূর্ন বিশ্বাস রেখেই এ কাজ করেছিলাম যার জন্য আমার সব অসুবিধা আল্লাহতালা সহজ করে দিয়েছিলেন। কর্নেল ওসমানী যাবার পর আরও কিছু রাজনৈতিক নেতা ( যেমন প্রফেসর রেহমান সোভান,সিরাজুল হক,আবদুল কুদ্দুস মাখন) আগরতলা চলে গেলেন এবং একটা নিউক্লিয়াস গড়ে উঠল। মেহেরপুরে গভর্নমেন্ট ফর্ম আপ হবার আগেই 1st week of April-এ আগরতলার শালবনে ৯১ বিএসএফ ব্যাটালিয়ানের ছত্রছায়ায় আমরা একটা হেডকোয়ার্টার(এসেলন বা সাপোটিং বা রিয়ার হেডকোয়ার্টার) তৈরি করে ফেললাম। ইনচার্জ বানানো হলো কর্নেল রবকে। তাঁর সাথে ছিলেন মেজর আবুল ফাত্তাহ (উনি আগে মেডিকেল ইউনিটের administrative officer ছিলেন)। ৯১ বিএসএফ আমাদের সব fascility দেয়,রাজনীতিকগন দিল্লী গিয়ে ভারত সরকারের সাথে বুঝাপড়া করে সাহয্যের আশ্বাস পেলেন। এরপর আমি আমার কাজে লেগে গেলাম অর্থাৎ মুক্তিবাহিনীর কমুয়নিকেশন ব্যবস্থা ঠিক করা। বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তের ৫টি সেক্টর হেডকোয়ার্টার থেকে আগরতলা মুক্তিবাহিনী হেড কোয়ার্টার পর্যন্ত বেতার যোগাযোগের স্থাপন করা করা হল। এই যোগাযোগের জন্য আমাদের হাতে কোনো বেতার যন্ত্র ছিল না। আর্মি, নেভী ও এয়ারফোর্সের আলাদা আলাদা ফ্রিকোয়েন্সীর বেতার যন্ত্র ছিল সেজন্য একটার সাথে অন্যটার যোগাযোগ সম্ভব ছিল না। অনুরুপভাবে পুলিশ,ইপিআর তাদের বেতার যন্ত্রের ও একি অবস্থা ছিল। যাক ১,২,৩,৪ও৫ নম্বর সেক্টর হেড কোয়ার্টার পর্যন্ত বেতার যোগাযোগ স্থাপন করে আমি কলকাতার উদ্দেশ্য যাত্রা করে শিলং হয়ে ১১ নম্বর হেড কোয়াটার, তুরা (মেঘালয়) পৌছালাম ও সেখান থেকে জুলাই-এ মুজিবনগরে (থিয়েটার রোড) গেলাম। সেখান থেকে ৬,৭,৮ও৯ নম্বর সেক্টর হেড কোয়ার্টার পর্যন্ত যোগাযোগ স্থাপন ব্যস্ত হয়ে গেলাম। সিগনেল কোর বলতে যা বোঝায় ৭১ সালে তা ছিল না। সিগনেলম্যান্দের কোনো সেপারেট এনটিটি ছিল না কারন সবাই আর্মির লোক না তাই একক কমান্ডের আন্ডারে আনা যায়নি। ইপিআর,আর্মি,নেভী,এয়ারফোর্স, পুলিশ-যারাই কমিউনিকেশনের ব্যাপারে অভিজ্ঞ, সেট use করতে পারতো we used to take them.আমি তাদের ইনস্ট্রাকশন দিতাম how to work and they worked. তারা যে সেক্টরে থাকতো লজিস্টিক সাপোর্ট ওখান থেকেই পেত। আমাদের ভাল ইক্যুইপমেন্ট,ম্যানপাওয়ার ও ট্রেইন্ড লোক ছিল না ।আমেরিকা থেকে বাঙালিরা কিছু ওয়াকী-টকী দিয়েছিল যার কোন importance ছিল না তাই ইনফেন্ট্রীদের দিয়ে দেওয়া হয়। তবে ইন্ডিয়ানরা help করেছে প্রচুর।

আরেকটা ব্যাপার,৭১ সালের ২৫শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের প্রায়৮-১০ জন বাঙালি অফিসার সিগনেল কোরে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে আমরা ৩জন যোগ দেই- আমি, ক্যাপ্টেন হালিম( বর্তমানে কর্নেল) ও ক্যাপ্টেন শহীদুল ইস্লাম(বর্তমানে কর্নেল)। ১৩ই ডিসেম্বর আমি কুমিল্লা ক্যান্টমেন্টে আসলাম আমার পরিবারের সদস্যদের ফিরে পেলাম। ১৩ই ডিসেম্বর রাতে কলকাতা থেকে আগরতলা আসি। ফ্লাইট নারায়ণগঞ্জের উপর দিয়ে যাচ্ছিলাম প্লেন লক্ষ করে নীচ থেকে ক্ষুদ্র অস্ত্রের গুলিকরা হচ্ছিল। আমাদের অবশ্য কোনো ক্ষতি হয়নি। কুমিল্লা সেনানিবাসে মিলিটারি ইঞ্জিনীয়ারিং সার্ভিসের (MES) বাঙালি কর্মরত ও কর্মচারীদের পাকিস্তানিরা হত্যা করেনি। হত্যা করলে পাকিস্তানিদের কাজের অনেক আসুবিধা হতো। MES লোকদের মাধ্যমে আমরা কুমিল্লা ক্যান্টমেন্টের ভিতরের খবরা খবর পেতাম ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে চিঠিপত্র আদান প্রদান করতাম। যেমন আমার wife হয়তো ওদের বাসার কোনো কিছু নষ্ট হয়ে গেছে জানতো। ওরা এলে ওদের হাতে চিঠি দিয়ে দিত। পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গেছে বুজতে পেরে আমার স্ত্রী মিসেস গাফফার ও অন্যান্য জেসিওদের family ও বাচ্চাদের পুলিশের ওক্টা গাড়িতে বসিয়ে কুমিল্লা টাউনে পাঠিয়ে দেয়। ১৬ই ডিসেম্বর কলকাতা ছিলাম। দেশ স্বাধীনের খবর শিনে তেমন কিছু অনুভুতি হয়নি, তবে তৃপ্তি ছিল। ১৯৭১ সালের ২২শে ডিসেম্বর প্লেনে ঢাকায় ফিরি (মরুহুম ক্যাপ্টেন খালেক নিয়ে আসেন)। ঢাকায় এসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গঠনে আত্মনিয়োগ করলাম।মুক্তিযুদ্ধের সময় চীফ সিগনেল অফিসার পদে ছিলাম।যুদ্ধের পর সিও আর্মি সিগনেল ব্যাটালিয়ন পদে যোগ দেই। কিন্তু তখন মেজর ইরফান আমার চেয়ে সিনিয়র অফিসার ছিলেন (৭১-এ কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে EPCAF এর রিক্রটিং অফিসাএ ছিলেন।) তাই তাকে জেনারেল ওসমানীর কাছে নিয়ে ওসমানী সঙ্গে introduced করিয়ে দেই। মেজর ইরফান সিগনেল কোরের দায়িত্ব নেন ও তার অধীনে চাকরি করতে থাকি। আমি ট্রুপসদের অর্গানাইজড করতে থাকি। তকগ্ন সবকিছুই বিধবস্ত। নতুন করে গড়ে তোলার চিন্তাই সবচেয়ে বড় ছিল। আমি পুর্বে উল্লেখ্য করেছি যে আমি মুক্তিবাহিনীর প্রধান ওসমানীর সাথে আমার মিল ছিল না সেহেতু ওসমানী সাহেব আমার কনফিডেনশিয়াল রিপোর্ট খারাপ করে লিখেছিলেন এবং যতদিন জীবিত ছিলেন আমার বিরুদ্ধাচারণ করেছিলেন। ২৯শে মার্চ ১৯৭১ কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের যেসব বাঙালি অফিসার ও সিপাহীদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে তাদের কথা মনে হলে আল্লাহর কাছে এই কৃতজ্ঞতা জানাই যে তাঁর রহমতে আমি জীবিত আছি এবং স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সংসার করছি।

আমাদের সংগ্রাম চলবেই স্বাধিনতার জন্য সংগ্রাম একটা জাতির পবিত্রতম ও গৌরবময় অধ্যায়। আর সেই সাথে এর ইতিহাস সে জাতির ভবিষ্যতের প্রেরণা। আজকের প্রাণোচ্ছল কোনো যুবকের কাছে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ ঘন কুয়াশায় ঢাকা সুদূর শৈশব বা কৈশোরের আবছা কোনো স্মৃতি ছাড়া কিছু নয়। যুদ্ধের প্রকৃত পটভূমিকা ও রুপ সম্পর্কে জানবার সুযোগ তার ন্যায্য অধিকার। মূলতঃ আমরা ও এই গোত্রেরই অন্তর্গত। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভিত্তিক বিভিন্ন প্রশ্নাবলী আমাদের সারাক্ষই তাড়া করে। সেই সব প্রশ্নবোধক চিহ্নগুলো অন্তত কিছুটা হলে ও লুপ্ত হবে সে জন্যই এই প্রয়াস। তাছাড়া পরবর্তী প্রজন্মকে কিছু একটা দেবার দায়িত্ব তো আছেই কেননা আমরাই বোধ হয় মুক্তিযুদ্ধকে প্রত্যক্ষ করা সর্বশেষ প্রজন্ম। যদিও বিভিন্ন কিছু স্মৃতি ছাড়া আমাদের ও গর্ব করবার তেমন কিছু নেই। পাকিস্তানি ও তার সাম্রাজ্যবাদী দোসরদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর অগনিত প্রানের বিনিময়ে পৃথিবীর মানচিত্রে আমরা নিজেদের স্বতন্ত্র স্থান করে নিয়েছি। স্বাধীন দেশের জন্য অর্জন করেছি স্বীয় পতাকা। তবুও কি আমরা সম্পূর্ন স্বাধীন? এত কিছুর পরেও বোধহয় আমরা মুক্ত হইনি। প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করেছি স্বাবলম্বী শোষণমুক্ত একটা সমাজের জন্য। এখানে আমাদের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি আসে মাথা চাড়া দিয়ে উঠে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল মহল। এখনো তাই প্রতিনিয়ত আমরা সংগ্রামের সেই দিনের অপেক্ষায় যেদিন ‘স্বাধীনতা’, ‘মুক্তি’ শব্দগুলি একান্ত আমাদের হবে। এই সংগ্রামের প্রতি আমরা সবাইতো দায়বদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের এই সব বীরদের সাথে একই কন্ঠে আমরা ও অঙ্গীকার করি- ‘আমাদের সংগ্রাম চলবেই’।

আমাদের সংগ্রাম চলবেই- বইটির তথ্যাবলী সংগ্রহের কাজ শুরু হয় ১৯৮৫ সালের মধ্যে এপ্রিলে। ১৯৮৬ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে সংগ্রহের কাহ চলতে থাকে। সংগৃহীত ৩৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ২৬ জঙ্কে নিয়ে আমাদের সংগ্রাম চলবেই- এর প্রথম খন্ড প্রথম পর্ব গত ০৮ ফাল্গুন, ১৩৯৪, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮ প্রকাশিত হয়। উল্লেখিত সময়ে সংগৃহীত ১১ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে আমাদের দ্বিতীয় পর্ব। এই পর্বে আরো ১৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা নতুন করে সংযোজিত হল। তবে বলা বাহুল্য, সংগ্রহ নিরবচ্ছিন্নভাবে চালানো সম্ভব হয়নি। যেহেতু আমরা ছাত্র সুতরাং স্বাভাবিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা, পরীক্ষা ইত্যাদি নানা কারনে কাজে ছেদ পরে। আমরা প্রায় অর্ধ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ ও মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করি এবং প্রত্যেকেই আমাদের একটি নির্দিষ্ট প্রশ্নমালা দেই। যথাসাধ্য চেষ্টা এবং বারবার তাগাদা দেবার পর তাদের মাত্র অর্ধেকের ওকম বিলম্বে হলেও আমাদের প্রশ্নমালার উত্তর দেন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য ডা. ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম, বীর প্রতীক এর নাম। তিনি স্বতস্ফুর্তভাবে আমাদের সংঘের কার্যালয়ে এসে প্রশ্নমালার উত্তর দিয়ে যান এবং মেজর সৈয়দ মুনিবুর রহমান ও এ.কে.এম রফিকুল হক, বীর প্রতীক এরা দুজনই কোনোরকম তাগাদা ছাড়াই নির্দিষ্ট সময়ে প্রশ্নমালার উত্তর দিয়ে আমাদের কাজ অনেক সহজসাধ্য করেন। প্রশ্ন নির্বাচনে আমরা চেষ্টা করেছি যেন তা কেবল যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়ে সীমাবদ্ধ না থেকে সামগ্রিকভাবে যুক্তিযোদ্ধাদের সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও পাঠকের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠে। যদিও তথ্য সংগ্রহের জন্য বাংলা প্রশ্নমালা দেয়া হয়েছিল তবুও কয়েকজনক ইংরেজিতেই রাখা হয়েছে, তরজমা করা হয়নি। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই আমরা আমাদের সম্পাদকীয় কলম ও কাঁচির ব্যবহার যথাসম্ভব সংযত রাখার চেষ্টা করেছি যাতে তাদের ব্যক্তিত্ব অবিকৃতভাবে উপস্থাপিত হয়। এবার বিভিন্ন প্রশ্নগুলির প্রাপ্ত উত্তর সম্পর্কে কিছু লেখা প্রাসঙ্গিক মনে করি। জন্মস্থান এবং জন্ম তারিখ সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর জন্মস্থান হিসাবে কয়েকজন পুরোনো পদ্ধতিতে (গ্রাম, থানা- মহকুমা এবং জেলা) উত্তর দিয়েছেন যদিও বাকিরা দিয়েছেন উপজেলা পদ্ধতিতে।

মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব সময়ে রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কিত প্রশ্নটির উত্তর বেশ কয়েকজন দেননি বা ‘না’ বোধক উত্তর দিয়েছেন। তবে তাদের মধ্যে অনেকেই তৎকালীন প্রধান রাজনৈতিক দলের সমর্থক বা সদস্য ছিলেন বলে মৌখিক বা লিখিতভাবে আমাদের জানিয়েছেন কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা না ছাপানোর জন্য অনুরোধ করেছেন। আমরা তাদের অনুরোধ রক্ষা করেছি। ‘মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িত পরিবারের অন্যান্য সদস্য’- এই প্রশ্নের ক্ষেত্রেও কেউ কেউ একইভাবে সতর্কতা অবলম্বন করেছেন এবং এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। আমরা প্রত্যেককেই অনুরোধ করেছিলাম মুক্তিযুদ্ধে যোগাদানের কারন ও উল্লেখ্যযোগ্য সব অপারেশনেরই বিস্তারিত বিবরন দিতে। কয়েকজন আমাদের অনুরোধ রক্ষা করেছেন, তাদেরকে ধন্যবাদ। লিখিত ও মৌখিকভাবে অনেকেই রাজাকার (পাকিস্তানপন্থী)-দের বিরুদ্ধে তাদের বিভিন্ন অপারেশন –এর বর্ণনা দিয়েছেন কিন্তু বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তার জন্য তা প্রকাশ না করতে অনুরোধ করেছেন। এছাড়া যুদ্ধহত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমাদের বিশেষ অনুরোধ ছিল যুদ্ধে আহত হবার পর হতে বর্তমান পর্যন্ত তাদের প্রাসঙ্গিক অভিজ্ঞতা বিশেষ করে চিকিৎসার জন্য গৃহীত ব্যবস্থাদি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করার জন্য। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, শহীদ ও মৃত মিক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যরা যুদ্ধ সংক্রান্ত তথ্যাবলী সরবারহ করতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছেন, ফলে সঙ্গত কারণেই শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ তথ্য পর্যাপ্ত আকারে প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। মুদ্রিত সব বক্তব্যই অক্ষরে সত্যি এমন মনে করার কোনো কারন নেই।উচ্চাকাঙ্খা, ব্যক্তিগত আক্রোশ, স্বচ্ছ রাজনৈতিক ও বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টির অভাব ইত্যাদি যে কোনো ব্যক্তিকে বিভ্রান্ত করতে পারে। তবুও মুদ্রিত প্রত্যেকটি বক্তব্যই প্রণিধানযোগ্য। ভবিষ্যত গবেষকের সুক্ষ বিচার- বিশ্লেষনের মাধ্যমেই কেবলমাত্র প্রকৃত সত্য প্রকাশিত হতে পারে। বইটির সম্পাদনা করতে গিয়ে আমরা অনেকের সাহায্য ও বিপুল উৎসাহ অনুপ্রেরনা পেয়েছি। পান্ডুলিপি সম্পাদনা, পরিমার্জন এবং সংশোধনের কাজে কবি শামসুর রাহমানের আন্তরিক সহযোগিতা ও পরামর্শ আমাদেরকে বিশেষভাবে অনুপ্রেরনা যুগিয়েছেন। শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও মরহুম শিল্পাচার্যের এই স্বতঃস্ফুত সহযোগিতা বইটির মর্যাদা বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছে। বইটির প্রথম খন্ড- প্রথম পর্ব মুদ্রণ রবং প্রকাশের ব্যাপারে আমরা বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার শরণাপন্ন হই। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বেসরকারী প্রকাশনা সংস্থার স্বত্বাধিকারীর উত্তর ছিল ‘এই সব ইতিহাস টিতিহাসের বই তো কেউ পড়ে না…’। অন্য প্রকাশকেরা ও বইটি প্রকাশের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাননি। তাই একরকম বাধ্য হয়েই আমরা প্রকাশনার শুরু দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলাম । অবশেষে প্রথম খণ্ড দ্বিতীয় পর্বের প্রকাশনার জন্য জুউএল ইন্টারনেশনাল লাইব্রেরী, ঢাকা আগ্রহ সহকারে এগিয়ে আসেন । এজন্য আমরা তাদের কাছে আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ । স্বাধ্নতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকটি মানুষের প্রতি পরম শ্রদ্ধা নিবেদন করে আমাদের সীমিত সামর্থে সংগৃহিত কেবলমাত্র ২৯জম বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে আমাদের সংগ্রাম চলবেই-এর প্রথম খণ্ড-দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশিত হচ্ছে । এই স্বীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করে নিয়েই পরবর্তী খণ্ডসমূহ প্রকাশের প্রতিশ্রুতি রইল ।