You dont have javascript enabled! Please enable it!

কর্নেল শাফায়াত জামিল, বীর বিক্রম

১৯৪০ সালের ১লা মার্চ জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে আমার জন্ম হয় । আমার পিতা জানাব আবুল হাসান মোহাম্মদ করিমুল্লা একজন সরকারি চাকুরে ছিলেন (সর্বশেষ পোস্টিং অ্যাসিস্টেন্ট সেক্রেটারী, জুডিশিয়াল ডিপার্টমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান গভর্নমেন্ট) । তিনি ১৯৬৪-৬৫ সালে চাকুরি হতে অবসর গ্রহণ করেন । আমার মাতা লায়লা জোহরা বেগম একজন গৃহবধূ ।আমার ভাই-বোনদের সংখ্যা আট । ভার ভাই, চার বোন । ভাইদের মধ্যে আমি দ্বিতীয় এবং ভাই-বোনদের মধ্যে তৃতীয় । আমি ১৯৫০ হতে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত হবিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে পড়াশুনা করি । তারপর ১৯৫৭ থেকে ম১৯৫৯ পর্যন্ত ঢাকা কলেজে আরটস-এ (মাধ্যমিক ১ম ও উচ্চমাধ্যমিক ২য় বিভাগ) এবং ১৯৫৯ থেকে ১৯৬১ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন বাদ দিয়ে আমি সামরিক বাহিনীতে যোগ দেই । আমি ১৯৬১ সালের ২১শে নভেম্বর সামরিক বাহিনীতে যোগদান করি ।মিলিটারি একাডেমি (কাকুল)-এ আমি আরাই বছর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি । আমি ১৯৬৪ সালের ১৯শে এপ্রিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এর ৪র্থ ব্যাটালিয়ানে কমিশন পাই এবং একই সাথে পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রেজুয়েশন (ব্যাচেলর অফ আরটস) ডিগ্রী লাভ করি । আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের সমর্থক ছিলাম তবে কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলাম না । এবং ১৯৬১ সালে ছাত্র ইউনিয়নের পেন্নেল -এ ঢাকা হলে (ঢাঃ বিঃ) আসস্ট-আঠলেটিক সেকরেটারি নির্বাচিত হই । এক কথায় বাঙালিদের স্বাধীনতার জন্যই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেই । ছাত্রজীবনে রাজনীতি সচেতন ছিলাম । পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে বুঝতে পারি তারা কীভাবে আমাদের বঞ্চিত করছে, প্রভূত করছে । নিজেদের মধ্যে যাই থাক বাঙালিদের শোষণের বেলায় পাঞ্জাবী, সিন্দি, বেলুচ, পাঠান, বিহারী সবাই একজোট অর্থাৎ পাকিস্তানি হয়ে যেত । তারা মনে করত আমরা নীচু জাতের মানুষ, নীচু মুসলমান । তারা আমাদের জীবন ও জীবিকা সম্বন্ধে সমালোচনামুখর ছিল । বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানিদের এই আচরণ, মনোভাবের জন্য আমাদেরই কিছু মেরুদণ্ডহীন, নতজানু, অনুগত রাজনীতিবিদ, এলিট এবং বুদ্ধিজীবী দায়ী ছিলেন । এদেরই জন্য ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় বাংলাদেশ তার ন্যায্য বিরাট ভৌগলিক অংশ থেকে বঞ্চিত হয় এবং এদেরই জন্য আমরা পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত হই । ১৯৬৭ সালে আমি জয়দেবপুরে ছিলাম । একদিন এক সামরিক এক্সারসাইজ শেষে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রায় ৭/৮ জন অফিসার কাছাকাছি করাটিয়ার পন্নী সাহেবদের বাসায় বেড়াতে গেলাম । আমি ছাড়া বাকি সবাই ছিল পাঞ্জাবি । রতগুলো অফিসার দেখে ওরা খুবই খুশি হলেন । একসময় বৃদ্ধ পন্নী সাহেব ছিল পাঞ্জাবী । এতগুলো পাঞ্জাবীদের তুষ্ট করার জন্য বললেন যে তারা এখানকার না । ইরান-তুরান থেকে এদেশে এসেছেন কাজেই অফিসার ও এদের উৎস একই । বাসাতে উর্দু কথাবার্তা চলে এমনকি তাদের বিয়ে বাঙালিদের সাথে হয় না । বাঙালিরা দু-এক পুরুষ আগে মুসলমান হয়েছে । বাঙালিদের…..ইত্যাদি । বক্তা মনে করল আমিও তাদের একজন । লক্ষ করলাম পাঞ্জাবীরা কথাগুলোয় খুবই আনন্দ পেল । ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুখানের সময় পশ্চিম পাকিস্তানের ডেরা ইসমাইল খা শহরে ছিলাম (পুরো শহরে আমিই একমাত্র বাঙালি)। এ. আর. এস দোহা সম্পাদিত ‘ইন্টারউইং’ পত্রিকায় গণঅভ্যুখানের সব খবরাখবর পেতাম । শেখ সাহেব, তোফায়েল এদের বক্তৃতা আমাকে অনুপ্রাণিত করে, উজ্জীবিত করে । একাত্তরের মার্চের পূর্বে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কিন্তু পাকিস্তানি সরকার তাদের দূরভিসন্ধিমূলক পরিকল্পনা কার্যকর করার সুবিধার জন্য ব্যাটালিয়নকে মার্চের ১ তারিখে ছড়িয়ে দেয় । আমাদের কোম্পানির নাম ছিল ডেল্টা কোম্পানি এবং ১লা মার্চে ভারতীয় সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য আমাকে আমার কোম্পানিসহ পাঠানো হয় ব্রাক্ষণবাড়িয়াতে । এছাড়াও চার্লি কোম্পানিকে পাকিস্তানি মেজর সাদিক নেওয়াজের নেতৃত্বে আমার সাথে পাঠানো হয় । ২৩শে মার্চ নক্সাল অনুপ্রবেশ ঠেকানোর মিথ্যা অজুহাতে মেজর খালেদ মোশাররফকে একটি কোম্পানি দিয়ে শামসেরনগর পাঠিয়ে দেয়া হয় । হেডকোয়াটার থেকে সকল কোম্পানিকে নির্দেশ দেয়া হয় সম্ভব্য ভারতীয় অনুপ্রবেশ ঠেকানোর জন্য প্রস্তুতি থাকতে । ওরা মার্চের পর দেশের পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে যায় । সে সময় রেডিওতে একটা দেশাত্মবোধক গানের (পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে…) সুর কিছুক্ষণ পর পর বাজানো হত যার আবেদন আমার মতো অনেকেরই রক্তে আগুন ধরিয়ে ছিল দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য । মারাঠা বর্গীদের মত পাকিস্তানি তস্করদের পরাভূত করে জাতিকে শোষণ এবং শাসনের জোয়াল থেকে মুক্ত করার জন্য বহু বাঙালির মত আমিও শাসনের জোয়াল থেকে মুক্ত করার জন্য বহু বাঙালি মতো আমিও অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম । দুঃখজনক হলেও এটা সত্য যে স্বাধীনতার পর ঐ গান রেডিও, টিভি হতে সুকৌশলে উঠিয়ে নেয়া হয়, আর কখনো শুনিনি । আর সে সময়ের সবচেয়ে উদ্দীপনায় শ্লোগান ছিল_বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর; তোমার আমার ঠিকানা পদ্ম মেঘনা যমুনা । বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষনে আমরা ব্রাক্ষবাডিয়ায় ৮ই মার্চ রেডিওতে শুনি । তখন মনে করেছিলাম যে সে ভাষণে তার স্বাধীনতা ঘোষণা করা উচিত ছিল । কিন্তু বর্তমানে মনে করি ও বুঝি যে তিনি ঠিকই করেছিলেন রাষ্ট্রনায়কের পরিচয় দিয়েছিলেন । একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা না দিয়ে । এদিকে সমগ্র বাঙালির সাথে একাত্ম হয়ে আমরাও ঐ দিন অস্ত্রহাতে প্রস্তুত ছিলেন বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে যোগদান করতে । ৭ তারিখ আশাহত হয়েছিলাম । একাত্তর সালে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার চেতনা ও মানসিকতা ছিল । তবে পাকিস্তানিরাই যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছে । তারা আক্রমণ না করলেও হয়তো আমরা যুদ্ধ করতাম যদি শেখ সাহেব প্রচ্ছন্ন নির্দেশ দিতেন । শুধু একটা ঘোষণার দরকার ছিল । সাধারণ সৈন্যরাতো তৈরিই ছিল (অফিসারদের তুলনায়) । লে. কবির, লে. হারুন, আমি ও মেজর খালেদ মোশাররফতো মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম । অবশ্য আমি ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কথাই বলছি, অন্যদের কী চিন্তা চেতনা ছিল তা বলতে পারব না । তবে স্বাধীনতা উত্তর কালের কোনো চিন্তা ভচাবনা তেমন ছিল না । হয়তো যুদ্ধ আরো বেশিদিন হলে সময়ের সাথে সাথে ঐ ধরনের চিন্তা চেতনাও মাথায় আসতো । মার্চ মাসের সম্ভবত ৭/৮ তারিখের দিকে (বঙ্গবন্ধু ভাষণের পর) তৎকালীন একজন সিনিয়র বাঙালি অফিসার লে.কর্নেল সালউদ্দিন মোহাম্মদ রেজা কোনো নিকট আত্মীয়ের মৃত্যু উপলক্ষে ২/১ দিনের ছুটিতে ঢাকা হতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে আমাদের ক্যাম্প পরিদর্শন করেন । তিনি সে সময় ঢাকায় আর্মি রিক্রটিং ইউনিটের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন । একসময় তিনি ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন । আমাকে জিজ্ঞাসা লাগবে…ইত্যাদি । আমাদের অস্ত্রশস্ত্র, সৈনিকদের সতর্কতা মনোবল দেখে তিনি অত্যন্ত খুশি হন । পরে ২৮শে মার্চ তিনি ঢাকা হতে অতিকষ্টে পায়ে হেঁটে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসেন । কিন্তু শুধুমাত্র ওসমানীর ব্যক্তিগত আক্রোশের জন্য তাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে দেয়া হয়নি । ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট তখন সিলেটের খাদিম নগরে ছিল । ১১ই মার্চ আমকে নির্দেশ দেয়া হয় যে রসদ (রেশন) বোঝাই ট্রাক এসকর্ট করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমার কাছে রসদ আসতে সময় লাগে ২দিন আর ব্রাহ্মণবাড়িয়া হতে সিলেটে এই ১২০ মাইল পথ যেতে আমার সময় লাগে ৩দিন । আমার সাথে ১প্লাটুন (৩৫জন) সৈন্য ছিল । রাস্তায় ৫.৬ মাইল পর পরই বিশাল বড় বড় গাছের ব্যরিকেড সাধারণ মানুষ পাকিস্তানিদের জন্য রসদ নিয়ে যেতে দেবে না । আমি ও আমার সৈন্যরা সংগ্রাম কমিটির সদস্য ও সাধারণ লোকদের বুঝালাম যে রসদ না পৌছে দিতে পারলে আমাদের বন্দী করে কোর্ট মার্শাল করা হবে । সময় হলে আমরা আপনাদের সঙ্গে থাকব । দেখলাম যে আমার সৈন্যরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে তাদের সহজেই বুঝাতে সক্ষম হল ।

মার্চের ১৬তারিখে আমরা সিলেট পৌছে দেখি ৩১ পাঞ্জাবের অধিনায়ক তার সৈন্যদের নিয়ে রিফিং (দরবার) করছেন । সেখানে আমাদের যেতে দেওয়া হল না । আমাদের সব অস্ত্র তাদের অস্ত্রাগারে জমা দিয়ে সৈন্যদের লাইনে ও আমাদের অফিসার্স মেসে থাকার নির্দেশ দেয়া হয় । আমাদের জোয়ানরা পাকিস্তানিদের মতলব মার্চের প্রথম হতেই বুঝতে পারছিল । সিনিয়র এনসিওরা আমাকে বলল যে, স্যার আপনি বলেন যে আমরা অপারেশনাল এরিয়া থেকে আসছি । আমাদের অস্ত্র আমরা নিজেরাই ছোটখাট অস্ত্রাগার বানিয়ে রাখব । আমি পাকিস্তানিদের এ সিদ্ধান্ত জানালে তারা বেশি উচ্চবাক্য করল না । আমাকে বলা হয়েছিল যে তোমার জন্য একটা অর্ডার আসছে । আনঅফিসিয়ালি আমাকে বলা হয় যে সিলেটের বিভিন্ন চা বাগানে কর্মরত অবাঙালি অফিসারদের পরিবার এসকট করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে হবে । তবে তাদের এক জায়গায় জড়ো করতে সময় লাগছে এবং সে পর্যন্ত আমাদের ৩১ পাঞ্জাবের সঙ্গে থাকতে বলা হল । পরদিন (১৭ইমার্চ) আমার প্রতি অর্ডার চাইলাম । কিন্তু কেউই কিছু বলল না । কুমিল্লায় আমাদের ব্যাটালিয়নের অধিনায়কের সঙ্গেও আমাকে টেলিফোনে কথা বলতে দেয়া হল না । শেষে কুমিল্লায় আমাদের বাঙালি সুবেদার মেজরের (সুবেদার মেজর ইদ্রিস) সাথে টেলিফোনে বাংলায় কথা হলো (অন্যান্য বাঙালি অফিসারদের সঙ্গে কথা বলিনি) তাকে বললাম, সুবেদার মেজর সাহেব কিছু বুঝতেছেন? এরা আমাকে কোনো অর্ডারও দিচ্ছে না, যেতেও দিচ্ছে না । সুবেদার মেজর উত্তর দিলেন, স্যার সবই বুঝতেছি । আপনি কিছু বলবেন না, আমি সিও সাহেবকে বলব যেন আপনাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিয়ে আসেন । অধিনায়কের উপর একজন সুবেদার মেজরের প্রচুর প্রভাব থাকে । সিও বিভিন্ন প্রাশাসনিক আদেশ কার্যকর করার জন্য তার পরামর্শের প্রতি যথেষ্ট নির্চরশীল তাছাড়া আমাদের সিও কিছুটা দুর্বল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন ফলে সিও কুমিল্লা ব্রিগেড কমাণ্ডার ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফির সঙ্গে পরামর্শ করে আমাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ফিরে আসার নির্দেশ দেন । ১৯শে মার্চ আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ফিরে আসি । ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় ৪র্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের বাকি একটি কোম্পানি ও ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার কুমিল্লা হতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া চলে আসে তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে একটি ব্যতীত সবগুলো কোম্পানি একত্রিত করে, শুধুমাত্র মেজর খালেদ মোশাররফের কোম্পানি তখনও শমসেরনগর ছিল । আমরা ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রায় সিব বাঙালি অফিসার ও সৈন্য তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে সচেতন ছিলাম । মেজর খালেদ মোশাররফ ২৩শে মার্চ রাতে সমসেরনগর যাবার পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের রেস্ট হাউজে রাতের খাবারের সময় আমাকে বলেন যে, পাকিস্তানিরা পার্লামেন্ট বসতে দেবে না । ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না । একটা গণহত্যা চালানোর প্রস্তুতি চলছে । অস্ত্রের মাধ্যমে বাঙালির রাজনৈতিক বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা চলছে । আমাদের সর্বতোভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে । বেসামরিক পোশাকে পিআইএ-র বিমানে করে বেশ কিছু পাকিস্তানি ব্যাতালিয়ন ঢাকায় এনেছে এবং অস্ত্রশস্ত্রও এসেছে জাহাজে করে । ক্র্যাকডউন হবেই এবং তা হলে বাঙালি সৈন্যদের তাৎক্ষণিক সশস্ত্র বিদ্রোহ দেখা দেবে । তাই তারা আগেই বাঙালি সৈন্যদের অস্ত্রহীন করে ফেলার চক্রান্ত করছে । কী হবে এবং আমাদের কী করণীয় এ সম্বন্ধে তার এই চেতনাটা বাঙালাদেশে চাকুরিরত মোটামুটি সহ অফিসারদের মধ্যেই অনুপস্থিত ছিল । যার ফলশ্রুতিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্বে (২৫শে মার্চ থেকে ১৫ই জুন পর্যন্ত) মাত্র ২৫থেকে ৩০জন বাঙালি অফিসার (পাক সেনাবাহিনীতে চাকুরিরত)মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে যোগদান করেন যদিও তখন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় ১৫০-২০০ জন বাঙালি অফিসার কর্মরত (চাকুরিরত, বিভিন্ন কারণে অস্থায়ী ডিউটি, ছুটি ভোগরত ও অন্যান্য) ছিলেন । এ ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কিছু কিছু বাঙালি অফিসার বিভিন্ন কাজে তুলনায় সাধারণ সৈন্যদের মধ্যেই চেতনা বেশি ছিল । এই চেতনা ও দূরদৃষ্টির অভাবেই বহু বাঙালি অসহায়ভাবে বন্দী ও পরবর্তীতে নিহত হন । মেজর খালেদ মোশাররফ ২৩শে মার্চ রাতে শমসের নগর যাওয়ার পথে আমাকে একটা নির্দিষ্ট ও্যারলেসস দিয়ে বলেন কোনো কিছু হলে ঐ ফ্রেকুএঞ্চি তে ওয়িরলেসস সেট এর মাধ্যমে যোগাযোগ করতে । তারপর ২৫তারিখে ক্র্যাকডাউন হলো । ২৬শে মার্চ ওয়িরলেসস সেট দিয়ে রান্ডম স্কানিং করার সময় আমরা পাকিস্তানি আর্মির একটা স্টেশনের সঙ্গে আরেকটা স্টেশনের উর্দু কথপোকথন শুনতে পাই । সেখানে বলা হচ্ছিলঃ ১. আরো ট্যাঙ্ক আম্মুনিশন দরকার ২. হেলিকপ্টারে আইর লিফট দরকার । এবং ৩. হেয়াভি কেচুয়াল্লি হয়েছে ইত্যাদি । এছাড়াও সেই দিন বিকেলে রেল লাইন দিয়ে পায়ে হেঁটে এবং লঞ্চে হাজার হাজার লোক ঢাকা থেকে পালিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া চলে আসে । তখন বুঝতে পারলাম যে ঢাকাতে কোনো সাংঘাতিক কিছু একটা হয়েছে । সেদিন (২৬শে মার্চ) বিকাল ৪টা দিকে মেজর খালেদ মোশাররফের সাথে যোগাযোগ হলে তাকে সব খবরগুলি দেই । তিনি শুধু একটা কথাই বললেন, আমি রাতের অপেক্ষায় আছি । আমি বুঝতে পারলাম তিনি বিদ্রোহের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় ভাবলেশহীন ভাবে নিয়ে ফেলেছেন । শমসেরনগরে যাবার পর তার ওয়িথড্রল রউট পাকিস্তানিরা ৩১পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সৈন্য দিয়ে বন্ধ করে রেখেছিল । তাই তিনি চা বাগানের ভিতর দিয়ে বকল্প রাস্তায় পরদিন ২৭তারিখে বেলা প্রায় ২টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌছেন । পথে তার এত সময় লাগার কারণ ছিল দুটি । প্রথমত রাস্তাগুলো ছিল ভীষণ আঁকাবাঁকা এবং সেগুলি বড় বড় গাছ ফেলে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল । দ্বিতীয়, (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-শমসেরনগর) এই ১২০ মাইল রাস্তা মেজর খালেদ মোশাররফ অত্যন্ত সন্তপর্নে আসতে হয় শত্রু সাহসী এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ৩জন এনসিও আমার কাছে আসে । (হাবিলদার বেলায়েত, হাবিলদার শহিদ ও হাবিলদার মনির) ঐ ৩জন আমার কাছে এসে বলল যে তারা আজ রাতে আমার তাবু পাহারা দেবে । দেশ ও জাতির প্রয়োজনে আমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা তাদের কাছে ঐ মুহূর্তের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব বলে তারা মনে করে । আমি তাদের বারণ করতে পারলাম না এখানে উল্লেখ্য যে, হাবিলদাররা কখনও পাহারা দেয়না, এটা সিপাহীদের কাজ । আমি তাদের এর কারণ জিজ্ঞাসা করাতে তারা বলে যে, “পাঞ্জাবীদের মতিগতি ভালো না! আজ রাতে আবার যদি তারা এখানে ঘেরাঘুরি করে তবে আমরা তাদের মেরে ফেলবো”। লেফটেনেন্ট কবিরও অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন । তাদের সক্রিয় সহযোগিতা এবং পরামর্শ আমাকে সেই সংকটময় মুহূর্ত গুলোতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে প্রচণ্ডভাবে সাহায্য করে । এই দুটি অত্যন্ত জুনিয়র অফিসারের ভূমিকা এবং কর্তব্যবোধ এবং জাতির প্রতি দায়িত্ববোধ আমাকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে । সর্বোপরি আমার সহধর্মিনী রাশিদা (আমার পরিবার ৭ তারিখে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় চলে গিয়েছিল কারণ ক্যান্টনমেন্টে কোনও একটা ভয়ানক কিছু ঘটার আশংকায়) ২৪ তারিখ ঢাকা থেকে বহুকষ্টে টেলিফোনে যোগাযোগ করে আমাকে সর্তক করে বলেছিলেন প্রস্তুত থাকতে এবং প্রয়োজনে পাকিস্তানিদের প্রতিরোধ করতে । একজন গৃহবধূর এই চেতনা এবং দায়িত্ববোধের প্রতিফলন তাৎক্ষনিকভাবে আমার মনে গভীর রেখাপাত করে । আমার সিদ্ধান্ত আমি অত্যন্ত সঠিকভাবে নিয়ে ফেলি, শুধু সময়ের অপেক্ষায় রইলাম। রাতে (২৬শে মার্চ) আমি আমার সৈনিকদের বাসস্থান এলাকায় যাই । পাকিস্তান আর্মিতে অফিসার ও সাধারণ সৈন্যদের মধ্যে অনেক ব্যবধান ছিল তাই সৈন্যরা কেউ অফিসারদের সাথে সহজে কোনো মনের কথা বলত না । যাই হোক সৈন্যরা তখন সেখানে তাস খেলছিল । আমাকে দেখে তারা উঠে দাঁড়াল এবং কয়েকজন আমার কাছে এসে বলল, স্যার বাংলাদেশে যে কী হইতাছে তাতো জানেন । আমরাও সব বুঝি, জানি এবং খেয়াল রাখি । সময় মতো সিদ্ধান্ত দিয়া দিয়েন, না দিলে আমগোরে পাইবেন না । যার যার অস্ত্র নিয়া যামুগা । জাতির দুভার্গ্য যে অফিসারদের সকলে এদের মতো এত চেতনা, সতর্কতা এবং দায়িত্ববোধ সম্পন্ন ছিলেন না বা সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি । পারলে হয়তো মাত্র ২০০/২৫০ জন সৈন্য দিয়ে পাকিস্তানিদের পক্ষে চট্রগ্রামে আমাদের ২৫০০ সৈন্যকে কাবু করা সম্ভব হত না এবং এত ক্ষতিগ্রস্তও হতে হত না । এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে প্রায় সমস্ত জায়গায় পাক সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যদের প্রয়োজনীয় চেতনা, সতর্কতার এবং পরিকল্পনার অভাবে প্রথমে আক্রান্ত হয়ে অনেক ক্ষয়ক্ষতির মাঝে বিচ্ছিন্ন ভাবে প্রতিরোধ যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল । এতে আমাদের অপরিসীম ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছিল, আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম । আমাদের অনেক ভাল ভাল অফিসার এবং সৈনিকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরেই আমরা হারিয়ে ছিলাম । ২৭শে মার্চ সকাল বেলা খবর পেলাম যে, সেও সব অফিসারদের নিয়ে সকাল ৮টায় কনফারেন্স করবেন । আমার বুঝতে অসুবিধা হল না যে কী হতে যাচ্ছে কারণ শেষ রাতেই কোম্পানীগঞ্জ টেলিফোন অপারেটরের (এক অজ্ঞাত দেশপ্রমিক) কাছ থেকে খবর পেয়ে গেছি যে কুমিল্লা হতে ১৪ ট্রাক সৈন্য আসছে । তখন আমি, লে. হারুন, লে. কবীর ও সেই তিনজন (এনসিও) গিয়ে মালিক খিজির হায়াৎ খান ও সাদেক নেওয়াজকে বন্দী করলাম ও বিদ্রোহের ঘোষণা দিলাম, পাকিস্তানিদের বললাম, ইউ হ্যাভ ডিকলারড ওয়ার আগাইন্সট দ্যা উনারআরমড পিপল অফ কউন্ট্রি, ইউ হ্যাভ পেরপেরট্রাটেড জেনচাড অন ওয়ার পিপল । আন্ডার দ্যা কারকুমস্টান্সেস উয়ে অওন অউর আল্লিজিয়াঞ্চে টু দ্যা পিপল অফ বাংলাদেশ অ্যান্ড থে এলেক্টেড পিপল’স রেপ্রেস্নটাটিভে, ইউ অল্ল আর আন্ডার আররেস্ট, ইউ পেরসনাল সাফেটি ইস মাই রিস্পন্সিবিলিটি বাট ডু নট ট্রায় টু ইনফ্লুএন্স অদারস’। সিও লে. কর্নেল খিজির হায়াৎ ও মেজর সাদেক নেওয়াজ চুপচাপ চেয়ারে বসে পড়লেন । আমরা যখন সিও-র তাঁবুর এর দিকে যাচ্ছিলাম সব সৈনিকরা চুপচাপ বসে বসে তাদের আম্মুনিশন লড করছিল এবং আমাদের কর্মকাণ্ড এর উপর লক্ষ রাখছিল । আমার সৈনিকদের সেই ঘটনার পরই প্রথম জয় বাংলা শ্লোগান দিল যা তারা এতদিন বেসামরিক ব্যক্তিদের মুখেই শুনে কয়েকজন পাকিস্তানি ও বিহারী পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে কিন্তু কয়েক মাইলের মধ্যেই তারা জনতার হাতে ধরা পরে ও নিহত হয় । এর কয়েক মিনিট পর সেখানে প্রায় ১০/১৫ হাজার লোক চলে আসে । তারা বন্দি ৩জন পাকিস্তানি অফিসার ও ৩/৪ জন সিগন্যালম্যানকে হত্যা করতে উদ্যত হয় । একজন একটা বন্দুক দিয়ে আকাশে গুলি করতে করতে আমার দিকে আসতে থাকে । উদ্দেশ্য, পাকিস্তানিদের হত্যা করা । সম্ভবত তিনি ছিলেন একজন ইঞ্জিনীয়ার, আমি তাকে স্টেন গানের এর বার্ট দিয়ে প্রতিহত করি এবং তাদেরকে বলি যে এরা যুদ্ধবন্দি, সুতরাং এদেরকে হত্যা করা যাবে না । জেনেভা কনভেরশন মোতাবেক এদের প্রতি আচরণ করতে আমরা সকলে বাধ্য । দুপুরর দিকে আমি সডপও-কে (সাব-ডিভিসিওনাল পুলিশ অফিসার) ডাকলাম এবং তার হাতে এদের দিয়ে বললাম এদের যেন কেউ মারতে না পারে । এদের যদি কিছু হয় তবে আপনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে । কিন্তু তিনদিন পর তিনি আবার আমার কাছে এদের (পাকিস্তানি) নিয়ে এসে কান্না ভেজা গলায় বললেন, যে, স্যার আমাকে মারবেন না । আমি এই তিনদিন এদের তিন চারটা থানায় নিয়ে গেছি প্রটেকটাভ চুস্টডি-র জন্য, কিন্তু সেখানে যাই প্রায় ২০/২৫ হাজার লোক এদের মারার জন্য জমে যায় । এর ৩/৪ দিন পর আমরা রাদেরকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে সমর্পণ করি । বিদ্রোহের পরপর তাৎক্ষণিকভাবে সাধারণ সেপাইদের মধ্যে কোন ভাবান্তর লক্ষ করা যায়নি তবে কিছু সিনিয়র জেসিও অসুস্থ হয়ে পড়ে আবার কারো কারো তীব্র জ্বর দেখা দেয় । দুই একজন অফিসারেরও এ রকম অবস্থা হয়েছিল । অবশ্য পরবর্তীকালে তারা স্বাভাবিক হয়ে উঠেন এবং সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ পরিচালনা করেন । বিদ্রোহের বিশৃঙ্খলা অবস্থা কাটিয়ে বেলা প্রায় ১ টার দিকে পরিস্থতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসে । কিন্তু ততক্ষণে পাকিস্তানিরা সব জেনে গেছে ফলে যে কোনো মুহূর্তে বিমান হামলার সম্ভবনা ছিল । তাই আমি আমার সৈন্যদের আশে পাশের গ্রামগুলোর বাঁশঝাড়ের আড়ালে চলে যেতে বলি । এমন সময় খালেদ মোশাররফ তার অধীনস্থ একশত ট্রওপ্স সহ সেকানে উপস্থিত হন এবং আমাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে এগিয়ে আসেন এবং ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দায়িত্বভার আমার কাছে থেকে গ্রহণ করেন ।

এখানে একটা ভুল ধারণার (যা কেউ ইচ্ছায় অথবা ভুল করে সত্য বলে চালানোর চেষ্টা করছেন)নিরসন হওয়া প্রয়োজন । ২৭শে মার্চ চট্রগ্রাম রেডিওর প্রচার শুনেই ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ ঘোষণা করে (হঠাৎ করে, কোনো প্রস্তুতি ছাড়া আপনা আপনি)। ২৭শে মার্চ চট্রগ্রাম রেডিওর প্রচার আমরা শুনিইনি এবং রেডিও শুনবার মতো অবস্থাও তখন ছিল না, নিজেদের সাংগঠনিক পরিস্থিতি নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম । কখন তা প্রথম প্রচার হয় তাও জানতাম না । বস্তুত ২৭শে মার্চ সকালে আমরা অস্ত্র হাতে তুলে নেই এবং বাংলাদেশের প্রতি আনিগত্য ঘোষণা দেই । চট্রগ্রামের সশস্ত্র প্রতিরোধের খবর ২৮/২৯শে মার্চ টেলিফোন অপারেটরের মাধ্যমে শুনি । মেজর জিয়ার বিদ্রোহের ঘোষণা আগে শুনলে হয়তো আরো বেশি অনুপ্রানিত হতাম । মুক্তিযুদ্ধকালের পুরো নয় মাস নিয়মিত বাহিনীতে ৪র্থ বেঙ্গল এবং ৩য় ইস্ট বেঙ্গলে ছিলাম । এপ্রিলের ১৭/১৮ তারিখ পর্যন্ত আম ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় ছিলাম এবং তারপর বর্ডার এলাকায় চলে গিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি । মে মাসের ১৫ তারিখে আমাকে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার ও ব্যাটালিয়নটি পুনগঠিত করার দায়িত্ব দেয়া হয় । ৩য় ইস্ট বেঙ্গল জুলাই মাসের শেষর্ধে ‘য ফরস’ এর অন্তভুর্ক্ত হয় এবং আমি ৩য় বেঙ্গলের কমান্ডার হিসাবে রংপুর, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট জেলার বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি । ২৭শে মার্চ- ১০ই মে তেলিয়াপাড়া চা বাগানে ২য় ও ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের হেডকোয়াটার স্থাপন করা হয় । সম্ভবত এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে কর্নেল ওসমানী তেলিয়াপাড়ায় এক সামরিক সম্মেলনে আসেন (আসলে ঠিক সম্মেলম না, অনেকটা সমাবেশের মত) আমাদের অনেক অফিসারই সেই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন । সম্মেলনের প্রথমেই কর্নেল ওসমানির নিকট হতে পাকিস্তানি কমেণ্ডো কর্তৃক তার বাড়ি আক্রমণ, কুকুর হত্যা এবং ঢাকা হতে ভারত আগমন ইত্যাদি বিষয় সবিস্তারে শুনতে থাকি । এক সময় পাক বিমান হামলার আশঙ্কায় তিনি দ্রুত সম্মেলন ত্যাগ করেন । আমরা এপ্রিল মাসের ১৭/১৮ তারিখ পর্যন্ত ব্রাক্ষণবাড়িয়া ছিলাম । ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের সাথে ব্রাক্ষণবাড়িয়া সিঙ্গারবিল, গঙ্গাসাগর প্রভৃতি এলাকায় পর পর বেশ কিছু প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি । এখানে আমাদের জনবল ও রসদপত্রাদির প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি ঘটে । ২৪/২৫ তারিখে পাকিস্তানিরা আখাউড়া, সিঙ্গারবিল, গঙ্গাসাগর দখল করে নিলে আমরা রনকৌশলগত পশ্চাদপসরণ করে সীমান্ত এলাকায় চলে গিয়ে উত্তরে তেলিয়াপাড়া থেকে দক্ষিণে কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম পর্যন্ত প্রায় ৮/৯টি অপারেশনাল ক্যাম্প স্থাপন করি । এই প্রতিরোধ যুদ্ধগুলোর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল গঙ্গাসাগর-আখাউড়া যুদ্ধ । এই যুদ্ধেই সিপাই মোস্তফা কামাল শহীদ হন এবং বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত হন । তাকে বীরশ্রেষ্ঠ সম্মানে ভূষিত করার জন্য অধিনায়ক হিসেবে আমিই সুপারিশ করি । মে মাসের তিন বা চার তারিখ যখন আমি মতিনগর (ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা জেলার সোনামুড়া মহকুমার অন্তর্ভক্ত) ছিলাম তখন একজন ধোপদুরস্ত পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোক আমার সাথে দেখা করতে আসেন । পরে জানতে পারি যে তিনি ফ্লাইট লেফেটেনেন্ট নুরুল কাদের । আমাদের বিভিন্ন খোঁজখবর নিয়ে তিনি আমাকে জানালেন যে তিনি ওপারে(পূর্ব পাকিস্তান)ফেরত গিয়ে আরো কয়েকজনকে বিমান বাহিনীর বাঙালি অফিসার তার সাথে করে নিয়ে আসবেন । তিনি বললেন, “ট্রাস্ট মি, ইউ উইল গেট এইট টু টেন এয়ারফোর্স অফিসার্স”। যদিও এরকম অনেকেই আসতেন কিন্তু যুদ্ধে যোগদান না করে আবার ফেরত চলে যেতেন । তাই তাকে ফেরত যাবার অনুমতি দেইনি । কিন্তু মেজর খালেদ মোশাররফ আমাকে বললেন, দাওনা পাঠিয়ে । তার এই কথায় আমি ফ্লাইট লেফেটেনন্ট কাদেরকে ফেরত যেতে দিলাম এবং এর প্রায় দু’দিন পর বিমান বাহিনীর অফিসারদের একটি বড় দল নিয়ে এলেন ফ্লাইট লে. নূরুল কাদের । ফ্লাইট লেফেটেনন্ট কাদেরই প্রথম বিমান বাহিনীর অফিসার যিনি মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সাথে যোগদান করেন , গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার, উইং কমান্ডার বাশার, ফ্লাইট লে. সদরুদিন এবং ফ্লাইট লে. সুলতান মাহমুদ এই গ্রুপেই আসেন । খন্দকার সাহেবই কাদেরকে পাঠিয়েছিলেন খোঁজখবর নেওয়ার জন্য তাদের চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণের সানসে । ১০ই মে-১৫ই জুলাইঃ উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ১০ই মে আমি আগরতলা হতে কলকাতা যাই ও কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে জীপ চালিয়ে হিলি যাই । পথে আমরা বহু ক্যাম্প পরিদর্শন করি ২/৩ দিনের এই পরিদর্শন কর্মসূচির যাত্রাপথে জীপে যাবার সম্পূর্ণ সময়টাতে জেনারেল ওসমানী আমার কাছে আমাদের ব্যাটালিয়নে কয়টা পিস্তল ও কয়টা স্টেনগান আছে সে সম্পর্কে খোঁজ খবর নেন । তাছাড়া এম বি এম এল (ম্যানুয়াল অফ বাংলাদেশ মিলিটারি ল) কীভাবে নতুন করে সাজানোহবে সে সম্পর্কেও আমাকে বলেন । যুদ্ধ পরিচালনা এবং পরিকল্পনার কোনো সূত্রও ঐ কয়দিনের আলোচনার বিষয়বস্তু হতে পারেনি । ওসমানী সাহেবের আচার-আচরণে আমি অত্যন্ত নিরাশ হয়েছিলাম । তাকে মনে হয়েছিল একজন বাতিকগ্রস্ত, ভীত সন্ত্রস্ত (পাকিস্তানি কমাণ্ডোদের ভয়), মৃত্যুভয়ে ভীত একজন পলায়নকারী সৈনিক । প্রতিমুহূর্তেই তিনি ছিলেন উত্তেজিত এবং ভয়ানক রকমের আক্রমনাত্মক একজন সৈনিকের আসল রূপ প্রকাশ পায় চূড়ান্ত সঙ্কটময় মুহূর্তে । কাণ্ডজ্ঞান বিবর্জিত এই ভদ্রলোক এই তিনদিনেই অসংখ্যবার পদত্যাগ করেছিলেন জনসমক্ষে (আমরা প্রায় শতাধিক কাম্প পরিদর্শন করি ও কর্নেল ওসমানী প্রায় ত্রিশটি ক্যাম্পে বক্তৃতা করেন । প্রতিটি কাম্পেই খাওয়া-দাওয়া, নেতৃত্বের কোন্দল, ট্রেনিং ইত্যাদি হাজারো সমস্যা ছিল । ক্ষুদ্র থেকে জটিল যে কোনো সমস্যা তার সামনে তুলে ধরলেই উচ্চারিত হত -আই রিজাইন। ফলে এরপর ভয়ে আর কেউ কোনো কথা বলার সাহস পেতনা । এই তিনদিনের কমপক্ষে হলেও ৩০ বার তাকে রিজাইন করতে শুনেছি । ১৫ই মে আমরা হিলি পোছি । এসময় কর্নেল ওসমানীর কাছে প্রথম জানতে পারি যে আমাকে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে । তখন ৩য় বেঙ্গল মাত্র ১২১ জন সৈনিক ছিল । আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয় যেন উত্তরবঙ্গ ঘুরে ইপিআর, পুলিশ, ছাত্র বেছে নিয়ে এই ব্যাটালিয়য়ানটিকে পুনগঠিত করি । আমি সমস্ত উত্তরবঙ্গ ঘুরে মোট এক হাজার লোক সংগ্রহ করে এই জনবল কমে যাওয়া ব্যাটালিয়ানকে একটা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের উপযোগী ইউনিট (১১০০ জন) সংগঠিত করি ।

দিনাজপুর-হিলি সীমান্ত এলাকায় পাক প্রতিরক্ষা অবস্থানের উপর পেট্রোলিং, রেইড ও এ্যাম্বুশের মাধ্যমে ৩য় ইস্ট বেঙ্গলের ট্রেনিং শুরু হয় । ১৫ জুলাই-১০ই অক্টোবর আমরা ভারতের তুরা পাহাড়ে হেডকোয়াটার জেড ফোর্সের অধীনে সমবেত হই । জেড ফোর্সের এর কমাণ্ডার ছিলেন লে. কর্নেল জিয়াউর রহমান । এসময়ে ৩য় ইস্ট বেঙ্গলের উল্লেখযোগ্য অপারেশনগুলো_ ৩১শে জুলাই-২রা আগস্টঃ প্রায় ৪০০ সৈন্যসহ বাংলাদেশের অনেক অভ্যন্তরে ঢুকে আমরা বাহাদুরাবাদ ফেরীঘাট ও দেওয়ানগঞ্জ শত্রু অবস্থান রেইড করি তিনদিনের এই অভিযানের আমাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল অতি সামান্য । ৫ই আগস্ট-১০ই অক্টোবরঃ রৌমারী থানা এবং দেওয়ানগঞ্জ থানার কিছু অংশ মুক্ত করি । এখানে শত্রুর সঙ্গে বেশ কিছু পাল্টাপাল্টি যুদ্ধে আমাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয় । এটাই বাংলাদেশের একমাত্র অঞ্চল যেখানে পাকিস্তানিরা আর কখনো ঢুকতে পারেনি । ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত এটা মুক্তাঞ্চল ছিল এবং বাংলাদেশ প্রবাসী সরকারের প্রশাসনিক কাঠামো স্থাপিত হয় । ২রা অক্টোবর-৫ই অক্টোবর প্রায় ৪০০ লোকসহ ময়মনসিংহের বকশীগঞ্জ পাকিস্তানি অবস্থান রেইড করি । ৮ই অক্টোবর__প্রায় ২০০ সৈন্যসহ রংপুরের চিলমারী ঘাট রেইড করি । ১৩ই অক্টোবর-১৮ই অক্টোবর প্রায় ৮০০ সৈন্যসহ সিলেটের ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরী ও দোয়ারা বাজার দখল করি । এখানে মেজর মীর শওকত আলী এবং অধীনস্ত ৫ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের সহায়তা করে । ২২শে অক্টোবর-২৭শে নভেম্বর প্রায় ৪০০ যোদ্ধাসহ আমরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সিলেটের সালুটিকর বিমান বন্দর এবং গোয়াইনঘাটের আশে পাশে অবস্থান গ্রহণ করি এবং অনবরত রেইড এও এম্বুশ পরিচালনা করি । ২৮শে নভেম্বরঃ আমরা সিলেটের ছোটখেল (গোয়াইন ঘাটের উত্তরে) আক্রমণ চালাই ও দখল করি । এই যুদ্ধে আমি গুলিবিদ্ধ হই ও আমাকে শিলং মিলিটারী হাসপাতালে ভর্তি করা হয় । এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অপারেশন । ২৮শে নভেম্বর-১৩ই ডিসেম্বর শিলং মিলিটারী হাসপাতালে অস্ত্রপ্রচার উত্তর চিকিৎসায় ছিলাম । ১৩ই ডিসেম্বর-১৬ই ডিসেম্বর ১৩ই ডিসেম্বর হাসপাতাল থেকে থেকে বেরিয়ে আমার অগ্রগামী ব্যাটালিয়নকে খুঁজতে থাকি । অবশ্য তখনও আমার ক্ষত পুরোপুরি ঠিক হয়নি । ১৫ তারিখে সিলেটের লামাকাজী ফেরীঘাটের কাছে আমার ব্যাটালিয়নকে পাই এবং আবার ৩য় ইস্ট বেঙ্গলের কমান্ড গ্রহণ করি । আমরা পলায়নরত পাকিস্তানিদের ধাওয়া করে সিলেটের পশ্চিম অক্ষ হয়ে ১৬ তারিখ সকালে শহরের পশ্চিমাঞ্চল দখল করি । ১৬ই ডিসেম্বর আমি খুব আনন্দিত ছিলাম কারণ সর্বস্তরের জনগণের দুঃখ-কষ্ট শেষ হয়েছে । অবশ্য তাত্ত্বিকেরা (যারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অনেক দূরে বসে যুদ্ধরত ছিলেন এবং আমাদের যুদ্ধরত রনক্লান্ত সৈনিকদের মনোবল এবং মনোভাব জানতেন না) অন্যান্য জাতির উদাহরণ টেনে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের কথা বলে থাকেন ।

মুক্তিযুদ্ধের পর আমি যখন সিলেট শহরে ছিলাম তখন সিলেট শহরে আমার জানা মতে কোনো চুরি, ডাকাতি, খুন বা রাহাজানির মতো ঘটনা ঘটেনি যদিও সেখানে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার সমাবেশ ঘটেছিল এবং এরা প্রত্যেকেই ছিল সশস্ত্র । স্বাধীনতার পর দেশের অন্যান্য স্থানেও এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি । অথচ সকল মুক্তিযোদ্ধারা যখন তাদের অস্ত্র জমা দিয়ে দিলেন ঠিক তখন থেকেই এইসব হাইজ্যাকিং, খুন এবং ডাকাতির মতো সমাজবিরোধী কাজ ভোষণভাবে প্রকট হয়ে উঠে । সেই সময় সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের এইসব কাজের জন্য দায়ী করা হতে থাকে । শুধু তাই নয় বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে (যেমন নাটক, চলচ্চিত্র) সুকৌশলে দেখানো হতে থাকে যে মুক্তিযোদ্ধারা হতাশাগ্রস্ত এবং তারাই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী । এমনকি কিছু কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, স্বাধীনতা যুদ্ধে যার বা যাদের ভূমিকা ছিল বিতর্কিত তারা মুক্তিযোদ্ধাদের আবার মানুষ হবার আহবান জানানোর ধৃষ্টতা প্রকাশের সাহস পায় । সমাজের বিভিন্ন স্তরে দুএকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমগ্র মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে কালিমা লেপনের এক ঘৃনা চক্রান্ত চলতে থাকে । এই চক্রান্তের রেশ আজও শেষ হয়ে যায়নি । আমার দেখা মতো বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ছাত্রসমাজ সম্পূর্ণভাবে স্বাধীনতার জন্য নিবেদিতা ছিল । অন্য যে কোনো বাহিনী বা গোষ্ঠী থেকে ছাত্রদের ত্যাগ ও অবদানের অনেক শীর্ষে । আগস্টের একটা ঘটনা । তখন ৩ ইস্ট বেঙ্গল রৌমারী এবং পাস্ববর্তী এলাকাসমূহে অপারেশনে ছিল । ইপিআর এর ৩টা লঞ্চ আমাদের দেওয়া হয়ছিল । লঞ্চে যমুনার চর রাজীপুরের পাশ দিয়ে যাবার সময় আমরা দেখলাম যে চরে প্রায় ৫০০-৭০০ ছেলে এক ইন্সট্রোকটরের অধীনে শুধু—করছে । তখন প্রায় দুপুর ১২টা । তীরে লঞ্চ ভিড়ানো হলে দেখলাম ছেলেদের বয়স ১৫ থেকে ২২ বছরের ভিতর । ইন্সট্রোকটর (হয়তো কোনো স্কুলের ড্রিল শিক্ষক) বললেন যে ছেলেদের সবাই স্কুল কলেজের ছাত্র । পাবনা-সিরাজগঞ্জ এলাকা থেকে এসেছে । এরা ইয়উথ চ্যাম্প এ ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে । জিয়া ছেলেদের খাওয়া দাওয়ার কোনো বন্দোবস্ত নেই, অনেকেই ৩/৪/৫ দিন ধরে না খেয়ে আছে কিন্তু ইয়ুথ ক্যাম্পের ভর্তিতে যেন বাদ না পড়ে তাই এই চরম কষ্ট স্বীকার । বাঙালি যুব সমাজের এত আত্মত্যাগ, তীতিক্ষা, এত মনোবল! আমরা ফেরত গিয়ে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়াটার এবং জেড ফোর্স হেডকোয়াটার থেকে কিছু রেশন পাঠিয়ে দিলাম যেন অন্তত বেঁচে থাকে তারা । পরে জেড ফোর্স হেডকোয়াটার থেকে তাদের জন্য আরো কিছু রেশন দেওয়া হয়েছিল । [ইয়ুথ ক্যাম্পে প্রাথমিক ট্রেনিং এর পর ট্রেনিং ক্যাম্প পাঠানো হতো । সেখানে এদের অস্ত্র শস্ত্র গেরিলা ট্রেনিং দেওয়া হতো।] অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের আরোকটা ঘটনা । মহেন্দ্রগঞ্জ থেকে জিয়া আর আমি যাচ্ছিলাম হালুয়াঘাটের বিপরীতে আমাদের অবস্থান ঢালুতে । প্রায় ৪০ মাইল পাহাড়ি পথ । জীপ আমি চালাচ্ছিলাম । দেখলাম মহেন্দ্রগঞ্জ থেকে বহু যুবক লাইন করে পায়ে হেঁটে ঢালুর দিকে যাচ্ছে । তাদের জিজ্ঞাসা করাতে বলল যে তারা ভর্তির জন্য মহেন্দ্রহঞ্জ ইয়ুথ ক্যাম্পে গিয়েছিল কিন্তু ওখানকার কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিয়েছে যে মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পে আর লোক নেবার মতো অবস্থা নেই, ঢালু ক্যাম্পে গেলে হয়তো নিতে পারে । তাই ইয়ুথ ক্যাম্পে ভর্তির আশায় তারা ঢালু যাচ্ছে । এদের বহুদিন কোনো খাওয়া-দাওয়া নাই শরীর খুবই দুর্বল । বেশ কয়াকজনের প্রচণ্ড জ্বর-অন্যেরা এদের কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে । এরকম কয়েকজনকে আমাদের জীপে তুলে ঢালুতে পৌছে দেই । [তখন ইয়ুথ ক্যাম্পগুলোতে ভর্তির জন্য প্রচণ্ড ভিড় লেগে থাকত । কোনো ক্যাম্পে যদি ১০০০ জনের ট্রেনিং এর ব্যবস্থা, দেখা যেত ১৫০০ জন ট্রেনিং নিচ্ছে । কিন্তু ১০০০ জনের রেশনেই ১৫০০ জনকে চলতে হতো । ফলে ভর্তিচ্ছু অতিরিক্তদের বিদায় করে দেয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকত না । আমার ব্যাটালিয়নে সবসময়ই ১৩০০-১৩৫০ জন লোক ছিল এবং একসময় তা প্রায় ১৮০০ জন অতিক্রম করে যদিও আমি মাত্র ৯০০ জনের রেশন পেতাম।] আমার ব্যাটালিয়নেও বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সিপাই হিসেবে যুদ্ধ করেছে । জানতাম না । তারাও কোনোদিন নিজেদের পরিচয় বলেনি, পাছে বের করে দেওয়া হবে-সম্ভবত এই ভয়েই । স্বাধীনতার পর কারা কারা আর্মিতে থাকতে চায় অথবা চায়না জানতে চাইলে তখন শুনি কেউ বলে, স্যার, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমুক বিষয়ের অমুক বর্ষের ছাত্র ।‘আবার কেউ বলে, ‘স্যার, আমি অমুক এমএসসি ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র ছিলাম । পরীক্ষাটা দিতে চাই ।‘ ওয়াহিদ (পরবর্তীতে ডা. ওয়াহিদ) ৩য় ইস্ট বেঙ্গলের রেজিমেন্টাল মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিল । ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের তদানীস্তন ৩য় বর্ষের ছাত্র ওয়াহিদ আমাদের অসাধারণ সেবা দিয়েছিল । দিন রাত প্রতিটি সময় যে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে, চিকিৎসা দিয়েছে । যুদ্ধের পর আবার পড়াশুনায় ফিরে যায় । মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে টেলিফোন অপারেটরদের গৌরবজনক ভূমিকা জনগণের কাছে অজ্ঞাতই রয়ে গেছে । তাদের ভূমিকার মূল্যায়ন কখনই করা হয়নি এবং মূল্যায়নের চেষ্টাও হয়নি । আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সেই প্রথম প্রহরে যখন অন্যান্য সব যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন ছিল তখন টেলিফোন অপারেটরগণ জীবনের অসামান্য ঝুঁকি নিয়ে খবরাখবর আদান-প্রদান করে প্রতিরোধ সংগ্রামকে জোরদার সমল্বিত করতে অতুলনীয় সাহায্য করেন । দেরীতে হলেও এখন তাদের অবদান কৃতজ্ঞ চিত্তে আমাদের স্বীকার করে নেওয়া উচিত । মে মাসের ৯/১০ তারিখে আগরতলায় কর্নেল রবের রুমে (হেডকোয়ার্টারে) মেজর জিয়াকে প্রথম দেখি । ইউনিফর্ম পরিহিত, খোঁচা-খোঁচা দাড়িওয়ালা এক অফিসার স্যালুট করে কর্নেল রবের কাছে ক্ষুব্ধ স্বরে তারা বদলীর জন্য অসন্তোষ প্রকাশ করেন । তখন জানতে পারি ইনিই মেজর জিয়াউর রহমান । জেড ফোর্স কামান্ডার তৎকালীন লে. কর্নেল জিয়া (৮ম ইস্ট বেঙ্গল) সাহসী এবং সক্রিয় । মে থেকে অক্টোবর প্রায় সাড়ে চার মাসে তার সাথে ছিলাম । তিনি আমাদের সমস্যাগুলো বুঝতেন যুদ্ধের ক্রান্তিকালেও তিনি সৈনিকদের সাথে থাকতেন । জিয়া যে কোনো ঝুকি নিতেন । মেজর আমিনুল হকের ব্যাটালিয়ান (৮ম ইস্ট বেঙ্গল)দিয়ে নকশী বিওপিতে যে আক্রমণ চালানো হয় সে সময় আমি জিয়ার কাছে ছিলাম । আমাকে বললেন, Let us go to see 8 East Bengal attaking Noksi BOP at night. আমরা যেখানে ছিলাম সেটা যুদ্ধক্ষেত্রের আওতার মধ্যে ছিল । He could have been seriously wounded/ killed at any time during the course of attack, since enemy shelles ang MG fire were falling all around us. আমরা মাটিতে আশ্রয় নেই । In fact as a brigade commander he need not have come at all to participate in a attack or share the fate of a attacking troops comprising of a company strength only. আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে যুদ্ধ অনেকদিন হবে । তাই যুদ্ধের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সৈনিকদের রক্ষা করা ও তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করার প্রয়োজন হয় । তখন বাংলাদেশে পাকিস্তান আর্মির সাড়ে চার ডিভিশন, প্রায় ৩৬ টার মতো ব্যাটালিয়ন ছিল । এদের সাথে সরাসরি যুদ্ধ (conventional war) করতে হলে আমাদের কমপক্ষে সমপরিমান নিয়মিত বাহিনী দরকার ছিল । অথচ আমাদের তখন ৮টা ব্যাটালিয়ন ছিল । গেরিলারা ক্রমাগত গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তান আর্মিকে দুর্বল ও পর্যুদুস্ত করে দেবে, তাদের morale নষ্ট করে দিবে এবং যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে আমাদের নিয়মিত সেনাবাহিনী বাংলাদেশে ঢুকে পড়বে (যেমন ভিয়েতনাম যুদ্ধে হয়েছে)। এজন্য কম করে হলেও আমাদের ৪০টা (চল্লিশ) ব্যাটালিয়নের দরকার ছিল । আমরা তাই প্রচলিত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে নিয়মিত সৈন্য হারাতে চাইতাম না । প্রচুর সৈন্য নিহত এবং আহত করে একটি শত্রু অবস্থান কয়েকদিনেরজন্য দখলে রেখে আবার তা পরিত্যক্ত অবস্থায় শত্রুর নিয়ন্ত্রণে রেখে আসার কোনো অর্থই ছিল না । কিন্তু ভারতীয় অফিসাররা ঠিক এটাই চাইতেন । আমি প্রচলিত যুদ্ধ করি । তারা এটা চাইতো যেন প্রাপ্তিটা তাদের হয় । তাদেরতো এ ক্ষেত্রে হারানোর কিছু ছিল না আর পরাজিত হলে ব্যর্থতার দায় মুক্তিবাহিনীর । ছাতক অপারেশনে ৩য় ইস্ট বেঙ্গলের ১৭জন সৈন্য শহূদ হয় । পাকিস্তানিরা নদীর ওপার পালিয়ে যায় এবং এপারের সিমেন্ট ফ্যাক্টরি আমাদের দখলে চলে আসে । একটা যুদ্ধে নিয়মিত বাহিনী কোনো জায়গা তখনই দখল করে যখন সে জানে যে সেটা ধরে রাখতে পারবে । ছাতক হলো সীমান্ত থেকে ১২ মাইল ভিতরে । আমরা জানতাম যে ছাতক ধরে রাখার মতো শক্তি আমাদের নাই-ধরে রাখতে পারব না । তবুও বাধ্য হয়ে আক্রমণ করতে হয়েছিল । অবশ্য বিদেশে খুব প্রচার হয়েছিল যে দেশের সিমেন্ট ফ্যাক্টরিটা মুক্তিবাহিনী দখল করে নিয়েছে । আমি খুব রেগে গিয়েছিলাম-শুধু শুধু কিছু ভাল সৈন্য হারাতে হল । এদের পূরণ করার মতো কোনো ব্যবস্থাই ছিল না ব্যাটালিয়ন জনবল অনেক কমে গিয়েছিল । জিয়াউর রহমান তখন আগরতলায় ছিলেন । জিয়া ফিরলে তাকে কথাগুলো বলেছিলাম । জিয়া আমার সাথে একমত ছিলেন । তিনি থাকলে হয়ত আমাদের এই অপারেশন করতে দিতেন না । পাকিস্তানি মেজর সিদ্দিক সালিক তার বই, Witness to Surrender- এ ছাতক আক্রমণের কথা লিখেছেন এবং বলতে চেয়েছেন যে ভারতীয় এ আক্রমণ করেছিল এবং ৩য় বেঙ্গল তাদের সহায়তা করেছিল মাত্র । কিন্তু সত্য এই যে আক্রমণ একমাত্র ৩য় ইস্ট বেঙ্গলই করেছিল, একটি ভারতীয় সৈন্যও আমাদের সহায়তায় ছিল না । মেজর শওকত আলী, সেক্টর কমাণ্ডার আমাদের সাথে এই যুদ্ধে ছিলেন তার তিনটি এফ. এফ. কোম্পানি নিয়ে, অসামান্য বীরত্বের জন্য তিনিও স্মরণীয় হয়ে থাকবেন । ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের সাথে বেশ কিছু বাঙালি অফিসারও (পাকিস্তানিদের সাথে কর্মরত) আত্মসমর্পণ করে । কিন্তু আমাদের সর্বোচ্চ সেনাপতির নেক নজরের ফলে এক মাসের মধ্যে এদেরই একজনকে (উভয়েই একই ইউনিটে কর্মরত ছিলেন) জেল হাজত থেকে বের করে এনে রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব পদে বসানো হয় (৭১) সালে মেজর পদে ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্স (ইপসআফ)এর রিক্রটিং অফিসার ছিলেন । পরে এই অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন । একইভাবে অন্যান্য প্রায় সকলকেই অত্যন্ত অল্প সময়ের ভিতর গুরুত্বপূর্ণ উচ্চপদে পুনর্বাসিত করা হয় । ছোটখেল অপারেশনের বর্ণনা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনীর সঙ্গে আমাকে বহুবার বড় ধরনের সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয় । এরমধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় যুদ্ধ ছিল, ছোটখেল অপারেশন । বাংলাদেশ সীমান্তে পাকিস্তানি বাহিনীর যে কটি দুর্ভেদ্য ঘাঁটি ছিলো তার মধ্যে সিলেটের ছোটখেল ও রাধানগর ছিল অন্যতম । মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী মাঝে মাঝে ছোটখেল ও রাধানগরে আক্রমণ চালাতে বলে পাকিস্তানিরা দিনে দিনে ওদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করে তোলে । কাঁচা মাটির বাংকার রূপান্তরিত করে কংক্রিটের বাংকারে । অর্থাৎ দুর্ভেদ্য ঘাঁটিতে আমরা বহুবার হামলা চালিয়েছি । এতে আমাদের যথেষ্ট ক্ষতি স্বীকার তথা বেশ কয়েকটি মূল্যবান জীবনও হারাতে হয় । যাহোক, ছোটখেলের ওপর আমরা চরম আঘাত হানি ২৮শে নভেম্বর ভোরে । আমি ৩য় ইস্ট বেঙ্গলকে কমান্ডিং অফিসার হওয়া সত্ত্বেও আমাকে না জানিয়ে ভারতীয় বাহিনীর সেক্টর কমাণ্ডার কর্নেল রাজ সিং ২৬শে নভেম্বর আমার কোম্পানি কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন নূরুন্নবী খানকে ছোটখেলে পাকিস্তানের সুদৃঢ় ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালাতে নির্দেশ দেন । যুদ্ধ পরিচালনা নিয়ে কিছুদিন থেকেই কর্নেল রাজ সিংয়ের আমাএ মতবিরোধ চলছিল । শুধুমাত্র জেদের বশবর্তী হয়েই রাজ সিং মুক্তিবাহিনীকে ছোটখেলে হামলা চালিয়ে ভারতীয় ৪/৫ গুর্খা রেজিমেন্টে চরম ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে পিছু হটে এসেছে, সেখানে একদিন পরেই মুক্তিবাহিনীকে আক্রমণ চালাতে বলার কোনো যুক্তি নেই । ২৬শে নভেম্বর রাতে গুর্খা রেজিমেন্ট রাধানগর ও ছোটখেলের ওপর হামলা চালায় । গুর্খা রেজিমেন্টের সঙ্গে আমাদের দুটো প্লাটুনকে আক্রমণে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয় । ভোর রাতে আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করা আর্টিলারি ফায়ারের আশ্রয়ে গুর্খাদের একটি কোম্পানি রাধানগর হাইস্কুল ও অন্য কোম্পানি ছোটখেলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে । আমাদের দুটো প্লাটুনের মধ্যে একটির নেতৃত্বে দিচ্ছিলেন সুবেদার বদিউওর রহমান, অন্য প্লাটুনটি ছিলো ক্যাপ্টেন নুরুন্নবীর নেতৃত্বে । প্রচণ্ড ক্ষতি স্বীকার করে গুর্খারা ছোটখেল হামলায় সফলকাম হয় । এ যুদ্ধে গুর্খাদের পক্ষে নিহত হন ১৭জন এবং আহত হন প্রায় ৪০জনের মতো । রাধানগর হামলায় গুর্খা রেজিমেন্ট সফল হতে পারেনি । যে কোম্পানিটি হামলা চালিয়েছিল, সে কোম্পানির কমাণ্ডার মেজর এসপি সিংসহ প্রায় সবাইকে প্রাণ হারাতে হয় । অবশ্য ছোটখেলেও গুর্খারা ছয় ঘন্টার বেশি দখল করে রাখতে পারেনি । পাকিস্তানিদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে ছোটখেল ছেড়ে গুর্খাদের পালিয়ে আসতে হয় । পৃথিবী বিখ্যাত গুর্খা রেজিমেন্টের এমনিভাবে মার খাওয়ার মাত্র একদিন পরই ছোতখেলে হামলা চালানোর জন্য ভারতীয় বাহিনীর কর্নেল রাজ সিং নির্দেশ পাঠান । তার এ নির্দেশ পালন করতে যাওয়ার অর্থই হচ্ছে নিশ্চিত মৃত্যু । এটা জেনেও কর্নেল রাজ সিং নিশ্চয়ই মনে মনে চাইছিলেন আমাদেরও একটা কোম্পানি তাদের মতোই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক । তার এ ধরনের নির্দেশ আমার রক্তে আগুন ধরিয়ে দেয় । মনে মনে শপথ করলাম নির্দেশ যখন এসেছে, তখন হামলা চালাবোই হয় সফলকাম হবো, নয়তো মৃত্যুকে বরণ করে নেব । ভারতীয় বাহিনীর কর্নেলকে বুঝিয়ে বলবো, বাঙালি বীরের জাত । তারা মরলেও বীরের মতই মরবে । পালিয়ে জীবন বাঁচাবে না । আমি ছুটে গেলাম আমার ডেলটা কোম্পানির কমান্ডার কযাপ্টেন নূরুন্নবী কাছে যাকে কর্নেল রাজ সিং ছোটখেল আক্রমণ চালানোর নির্দেশ পাঠিয়েছেন । একজন ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার হিসেবে একটা কোম্পানির ছেলেদের নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে আমি তো নিরাপদ দূরত্বে বসে থাকতে পারি না । তাই সিদ্ধান্ত নিলাম ক্যাপ্টেন নূরুন্নবীর কোম্পানির নেতৃত্ব দেবো আমি নিজে । আমি ক্যাপ্টেন নূরুন্নবীর কাছে জানতে চাইলাম আমাদের সৈন্যরা এ অপারেশনে যেতে রাজি কি-না, আর ওদের মানসিক অবস্থাই বা কেমন? নূরুন্নবী জানাল মাত্র একদিন আগের মারাত্মক অপারেশনের পরে সৈন্যরা খুবই ক্লান্ত । কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি সব প্লাটুন কমাণ্ডার ও কোম্পানির সিনিয়র জেসিও সুবেদার আলী নেওয়াজকে ডেকে আনলাম । তারপর বললাম, ‘মিত্রবাহিনীর কমাণ্ডার আমাদের জেনে শুনেই আগুনে ঝাঁপ দিতে বলেছেন । তবে আল্লাহ যদি সহায় থাকে তবে আগুনও পানি হয়ে যায় । এ অপারেশনে আমাদের না গিয়ে উপায় নেই । এটা মুক্তিবাহিনী তথা বেঙ্গল রেজিমেন্ট তথা বাঙালিদের একটা মান সম্মানের প্রশ্ন । আমাদের প্রমাণ করতেই হবে যে, আমরা মাতৃভূমির জন্য হাসতে হাসতে প্রাণ দিতে পারি । আমি অন্য পাঁচটি কোম্পানি ছেড়ে আপনাদের ডেল্টা কোম্পানির সঙ্গে অপারেশনে যাব । সৈনিকদের উদ্দেশ্য করে আগের মত বক্তব্য রাখলাম । বললাম, তোমাদের মরতে পাঠিয়ে তোমাদের ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডারের নিজ নিজ প্লাটুন নিয়ে রাত তিনটায় উপস্থিত হতে বললাম । এক পর্যায়ে সৈনিকদের আরও বললাম, অন্য কেউ না গেলেও আমরা তিনজনই (আলী নেওয়াজ, নূরুন্নবী ও আমি) রওয়ানা দেব । এক সারিতে আমরা রওয়ানা হলাম । শত্রুর অবস্থান মাত্র ৭/৮ শত গজ দূরেই ।

পাকা ধান ক্ষেতের ওপর দিয়ে আমরা একশ জন চুপি চুপি এগিয়ে যাচ্ছি । ভোরের আলো তখনও ভাল ভাবে দেখা দেয়নি । শত্রুর অবস্থানের তিনশ গজের মধ্যে এসেই আমি ‘জয় বাংলা’ বলে সামনের দিকে দৌড় দিলাম । আমার সঙ্গে সবাই একই ধ্বনি দিয়ে বাঘের ন্যায় হুংকার দিয়ে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল । একশটি এসএলআর পেছনের গোরা গ্রামের অবস্থান হতে দু’টি মেশিনগান ও একটি রিকয়েলস রাইফেলের বিকট আওয়াজ এবং সবার ‘ইয়া আলী’ আল্লাহু আকবর ও ‘জয় বাংলা’ চিৎকার এক অবর্ণনীয় অবস্থার সৃষ্টি করল । সবার মধ্যে এসে গেলো এক অশরীরি শক্তি । আমরা প্রচণ্ড দাপটে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি । অন্যদিকে পাকিস্তানি বর্বর সেনারা সর্বশক্তি দিয়ে আমাদের রুখে দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছে । কিন্তু আল্লাহ আমাদের সহায় । ইতোমধ্যেই গ্রামে আমাদের লোকজন উঠে গেছে । তারা খড়ের স্তূপে, ছনের ঘরে আগুন ধরিয়ে দিল । একদিকে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে, অন্যদিকে পাকিস্তানিদের সঙ্গে আমাদের চলছে হাতাহাতি যুদ্ধ । আস্তে আস্তে আমরা সম্পূর্ণ গ্রাম দখল করে নিলাম । চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আছে পাকিস্তানি সোইন্যদের লাশ । আহত কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্যও অসহায়ভাবে কাতরাচ্ছে । পাকিস্তানিরা সবকিছু পেছনে ফেলে জান নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে । হঠাৎ একটা গুলি এসে আমার কোমরে বিদ্ধ হলো । আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম । দু’জন সৈন্য এসে আমাকে তাড়াতাড়ি কাঁধে করে পেছনে সরিয়ে নিল চিকিৎসার জন্য । পৃথিবীর বিখ্যাত গুর্খা সৈন্যরা সেখান থেকে পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেছে সেখানে আমরা বাংলা অগ্নিসন্তানেরা বুকের রক্ত ঢেলে বিজয় পতাকা উড়ালাম । আমাদের এ বিজয়ের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে বাঙালিরাও পৃথিবীর একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহসী জাতি । যাহোক, কর্নেল রাজ সিং তার হেডকোয়ার্টার থেকে ওয়ারলেস আমাদের অভিনন্দন জানালেন । পাকিস্তানিদের মাটির নিভের তিনতলার বাংকারে ৫/৭টা নেয়ের লাশ পাওয়া যায় । ছোটখেলের যুদ্ধে পাকিস্তানিরা কয়েকশ গোলাগুলির বাক্স, তিনশ’টি বেডিং কিছু আটা, চাল ও ডালের বস্তা, ৪৫টি ছোলা মুরগী, ৩টি মেশিনগানের ব্যারেল, ২টি টেলিফোন সেট, বাইনোকুলার, ক্যাম্পাস, ম্যাপের সীটসহ বিপুল পরিমাণ জিনিসপত্র ফেলে পালিয়ে যায় । এমনকি পাকিস্তানিরা সকালে নাস্তার জন্য তৈরি করা গরম পরাটা, সব্জি এবং চা-ও ফেলে রেখে যায়-যা দিয়ে আমাদের সৈন্যরা সকালের নাস্তা সেরে নেয়। ১৯৭৩ সালে আমাকে তৃতীয় সর্বোচ্চ পদক ‘বীর বিক্রম’ দেওয়া হয় । তবে কোন যুদ্ধের জন্য এটা পেয়েছি তা নিজেও জানি না । আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতাম এবং এখনও করি যে এই রকম জনযুদ্ধে যেখানে ফোর্স/সেক্টর কমাণ্ডার কদাচিৎ বাংলাদেশে ঢুকে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন তারা কীভাবে প্রকৃত সাহসী যোদ্ধা কারা তা জানতে পারবেন? সুতরাং এই ধরনের যুদ্ধে কোনো পদক দেয়াই উচিৎ ছিল না । পদক বিতরণী কার্যক্রমটি ছিল ওসমানী সাহেবের খামখেয়ালীপনার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ । এর মাধ্যমে তিনি অনেকের প্রতি তার ব্যক্তিগর আক্রোশের ঝাল মিটিয়েছিলেন । পদক বিতরণের পর একটা কথা প্রচলিত হয়েছে যে, শত্রু থেকে যে যত দূরে ছিল সে তত বড় পদক পেয়েছে। যেমন দেখা যায় যে,দুজন ছাড়া বাকি সব সেক্টর কমান্ডার বীর উত্তম পদক পেয়েছে।জিয়া, শফিউল্লাহ ও খালেদ মোশাররফ ছায়া বাকি সব সেক্টর কমান্ডাররা কেব্ল ডাক বাক্সের কাজ করেছেন। সংশ্লিষ্ট ভারতীয় সেক্টর কমান্ডারগন (যারা সবাই ছিলেন ব্রিগেডিয়ার র্যা ঙ্কের)ও তাদের স্টাফ্রাই প্রকৃত যুদ্ধ পরিকল্পনা ও অন্যান্য সবকিছু তদারকি করতেন। সোজা কথা বলতে গেলে উপরোক্ত তিন জন ছাড়া আমাদের বাকি সেক্টর কমান্ডাররা প্রশাসনিক, লজিস্টিক ও প্রশিক্ষনের দায়িত্ব পালন করেছেন। সুতরাং এই অপারেশনাল পদকগুলো প্রশাসনিক লোকদের উপর অর্পন করায় তা এক হাস্যকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।এছাড়া মাত্র সামান্য কয়েকদিন সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করে বেশ কয়েকজন ‘বীর উত্তম’ উপাধিতে ভূষিত হন যারা কোন ও যুদ্ধেই অংশগ্রহন করেননি। যেমন, জেনারেল ওসমানীর অত্যন্ত প্রিয়পাত্র এমনও একজন ‘বীর উত্তম’ আছেন যিনি এপ্রিলে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে জেনারেল ওসমানীর নিষেধ সত্ত্বেও দুই দিন পর পালিয়ে দেশে চলে যান। অক্টোবরে আবার ফিরে আসেন এবং একজন সেক্টর কমান্ডারের অনুপস্থিতির সুযোগে সেক্টর কমান্ডার বনে যান এবং পরবর্তীতে ঢালাও উপাধি পান। এই বীর উত্তম সাহেবটি একদিনের জন্যও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে শত্রু মোকাবেলার জন্য ঢুকেননি শুধুমাত্র পালিয়ে থাকার সময়টুকু ছাড়া। আর ও কিছু পদক দেওয়া হয়েছে লক্ষহীন গুলিতে আহত ব্যক্তিদের বীরত্বপূর্ন কোনো যুদ্ধের জন্য নয়- যা নাকি সেই যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি পরিবর্তনের সহায়তা করতে পারতো। উচ্চ পদক পেয়েছেন কয়েকজন ওসমানীর অতি প্রিয়জন হিসেবে কয়েকজন পেয়েছেন যারা নিজেরা নিজেদের কল্পিত Citation লিখে, সেক্টর কমান্ডারদের কাছ থেকে সুপারিশ করিয়ে উপরে পাঠাতে সক্ষম হয়েছিলেন। উল্লেখ্য এইসব ‘বীর উত্তম’দের অনেকেই একদিনের জন্য ও বাংলাদেশে ঢুকে শত্রুর মুখোমুখি হননি। একমাত্র জেনারেল ওসমানী সেক্টর কমান্ডার হবার যোগ্যতাগুলি জাবতেন অথবা তিনি কিছুই জানতেন না। সবকিছু যেন চলছিলে আপন তালে। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমাদের কাউকেই জানতে দেওয়া হয়নি যে ফোর্স কমান্ডাররা সেক্টর কমান্ডারের সমতুল্য। পদক বিতরণের সময় (১৯৭৩ সালে) আমরা সবিস্ময়ে জানতে পারি যে ফোর্স ও সেক্টরকে একই মর্যাদায় ধরে পদক বিতরনে একই নীতিমালা অনুসরন করা হয়েছে। যদি সেক্টর ও ফোর্স কমান্ডার হবার সুবাদে কেউ ‘বীর উত্তম’ উপাধি পান তবে তার ও উচ্চ পদমর্যাদার অফিসারগণের ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত হওয়াই যুক্তিসঙ্গত, তবে কি কেউ একমাত্র জীবিত ‘বীরশ্রেষ্ঠ’হবার ইচ্ছা পোষন করতেন? মুক্তিযুদ্ধকালীন তিনটি নিয়মিত পদাতিক ব্যাটালিয়নের (১ম,২য় এবং ৩য় এই তিনটি ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন) কমান্ডিং অফিসাররা দুজন সেক্টর কমান্ডার (এবং পরবর্তীতে চারজন সেক্টর কমান্ডার ) থেকে অনেক সিনিয়র ছিলেন। জুনিয়র, নন-ইনফেন্ট্রী এই সেক্টর কমান্ডারদ্বয়ের পরিবর্তে এখানে উপরোক্ত তিনজনের যে কোনো দুজনকে ঐ দুটি সেক্টরের কমান্ডের দায়িত্ব দেওয়া উচিত ছিল। তাছাড়া ও আর ও দুটি সেক্টরের একটির দায়িত্ব দেওয়া হয় একজন অবসরপ্রাপ্ত অফিসারকে এবং অন্যটির দায়িত্ব দেওয়া হয় একজন বিমান বাহিনীর বৈমানিকের উপর । সিনিয়র ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডারদের সেক্টরের দায়িত্ব না দিয়ে তাদের উপর অবিচার করা হয় । পদকপ্রাপ্তিতেও তারা পিছিয়ে পড়েন । পদক বিতরণে রাজনীতিও একটা বিরাট ভূমিকা পালন করে । যেসব অফিসার সৈনিক জিয়ার অধীনে কাজ করেছিল তাদের উপর অবিচার করা হয় যেহেতু ওসমানী জিয়ার ছায়াকেও ঘৃণা করতেন । (প্রধানত জিয়ার ২৭শে মার্চের রেডিও ঘোষণা ও অন্যান্য কারণে) । একই ভাবে বীরত্ব উপাধি প্রদানের জন্য গঠিত বোর্ডের (যার চেয়ারম্যান ওসমানী) সদস্য শওকত ও মঞ্জুরের প্রভাবের ফলে খালেদ মোশাররফের অধীনস্ত অফিসার ও জোয়ানদের ন্যায্য পদক থেকে বঞ্চিত করা হয় । মঞ্জুর এবং শওকত সব সময়ই খালেদ মোশাররফের প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিলেন । কারণ তারা কেউওই তেজদীপ্ত খালেদ মোশাররফের সমতুল্য ছিলেন না । তাই ভারসাম্য রক্ষার জন্য তারা তাদের অধীনস্তদের এমন সব যুদ্ধের জন্য উপাধি দেয়া হয় যেগুলি জিয়া, শফিউল্লাহ বা খালেদ মোশাররফের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতো । পদক বিতরণী নিয়ে এহেন ন্যক্কারজনক ঘটনাবলী সমস্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করেছিল । আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি ছিল এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য । আমি মনে করি এই ইচ্ছাকৃত ভুলের সংশোধন হওয়া উচিত এবং অবিলম্বে এটা প্রত্যাহার করে নেওয়া উচিৎ । আমি ১৯৬৪-৬৮ সাল পর্যন্ত পদাতিক বাহিনীর বেঙ্গল রেজিমেন্টের চতুর্থ ব্যাটালিয়নে কর্মরত ছিলাম । তারপর ঊনসত্তরে পাকিস্তানের ডেরা ইসমাইল খাঁতে মিলিট্রারি পুলিশ স্কুল-এ ইন্সট্রাকচর এবং সত্তরে মুলতানে ১০ মিলিট্রারি পুলিশ উনিট-এর উপ-অধিনায়ক ছিলাম । ঐ বছর এপ্রিল মাসে মেজর পদে উন্নীত হই । সত্তরের শেষ দিকে কুমিল্লাতে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে আবার বদলী হই । একাত্তরের মে হতে বাহাত্তরের জুলাই মাস পর্যন্ত ৩য় ইস্ট বেঙ্গল কমাণ্ড করি । দেশ স্বাধীন হবার কিছুকাল পর ৩য় ইস্ট বেঙ্গলকে কক্সবাজার- আলীকদমে মোতায়েন রাখা হয় । আমি ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে লে. কর্নেল ও ১৯৭৩ সালে কর্নেল পদে উন্নীত হই । বাহাত্তরের জুলাই হতে চুয়াত্তরের মার্চ মাস পর্যন্ত রংপুর ব্রিগেড এবং চুয়াত্তরের মার্চ হতে পচাত্তরের নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকা বিগ্রেড কমাণ্ড করি । এক অবৈধ, অসাংবিধানিক সরকার উৎখাতের অভিযোগে আমাকে ১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে সেনাবাহিনী হতে বরখাস্ত করেছিলেন তার নিয়োগে আমার ভূমিকা ছিল একক এবং মুখ্য । পরবর্তীকালে ১৯৮০সালের ৭ই মার্চ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী হতে অবসরগ্রাহণ করি । বর্তমানে ব্যবসা বাণিজ্যেরত আছি ।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!