You dont have javascript enabled! Please enable it!

ব্রিগেডিয়ার এম.এ. মতিন, বীর প্রতীক

আমার জন্ম মৌলভীবাজার জেলার রসুলপুর গ্রামে ১৯৪২ সালের ২৭শে জানুয়ারি । পিতা মরহুম মৌলভী এম.এ.মিয়া ছোট-খাট জোতদার ছিলেন । মাতা সফিনা খাতুন গৃহিণী । আমার দুই ভাই, এক বোন । আমিই সর্বকনিষ্ঠ । আমি গভর্ণমেন্ট জুবলী হাইস্কুল, সুনামগঞ্জ (১৯৫২-৫৯) থেকে ম্যাট্রিক এবং সুনামগঞ্জ কলেজ থেকে আই.এ পাশ করি (১৯৬১) । তারপর চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে বি.এ পড়ার সময় ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে যোগদান করি । ১৯৬৫ সালের ১৮ই এপ্রিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৪র্থ ব্যাটেলিয়ানে (৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল) কমিশন লাভ করি । আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলাম না । তবে আওয়ামী লীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদের মনে প্রাণে সমর্থক ছিলাম । আমার বড় ভাই এম.এ মুনীর সাবরুমের কাছাকাছি কোনো এক যুব শিবিরের রিলিফ অফিসার ছিলেন । আপন চাচাত ভাই সিরাজুল হক ৭নম্বর সেক্টরে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন । স্বাধীনতার আগে ও পরে তিনি বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন । আরেক ভাই এর ছেলে মুজিবুর রহমান ৪নম্বর সেক্টরে কর্মরত ছিলেন । তিনি বামপন্থী আন্দোলনের সঞ্জে জড়িত ছিলেন । আমি ১৯৭১ সালের ২৩ শে মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানের ভাওয়ালপুর ক্যান্টন্মেন্ট হতে বদলী হয়ে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের একটি কোম্পানি কমান্দার হিসেবে কুমিল্লা সেনানিবাসে যোগ দিই । তখন আমি ক্যাপ্টেন ।আমাদের সাথে এই ব্যাটেলিয়ানে অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ,মেজর শাফায়াত জামিল ক্যাপ্টেন আইনুদ্দিন, ক্যাপ্টেন আবদুল গাফফার হাওলাদার, লে. মাহবুবুর রহমান, লে. ফজলুল কবীর ও লে. হারুনের রশীদ । ২৩শে মার্চ দিবাগত রাত ১১/১২টার দিকে আমার ব্যাটম্যান আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে বলল যে মেজর খালেদ মোশাররফ আমাকে ডাকছেন । অফিসারস্ মেস থেকে তার সাথে বেরিয়ে এলাম, অন্ধকারের মধ্যে সে আমাকে হাঁটিয়ে একটা কাঁঠাল গাছের নীচে নিয়ে গেল । সেখানে যেসব অফিসার ও জেসিও উপস্থিত ছিলেন তারা হলেন, খালেদ মোশাররফ, শাফায়াত জামিল, আবদুল গাফফার হাওলাদার, সুবেদার মেজর ইদ্রিস মিয়া, হাবিলদার মিনীর, হাবিলদার শহীদ হাবিলদার আবু শামা, হাবিলদার বেলায়েত । এরাই ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলকে একত্রিত করে বিদ্রোহ ঘোষনা করার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন । আমি ১৯৬৯ হতে দু’বছর পশ্চিম পাকিস্তানে ছিলাম বলে এই ব্যাটেলিয়ান (৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল) হতে বিছিন্ন ছিলাম । মেজর খালেদ সেখানে আমাদের ২/৩টা কথা বললেন । যেমন, শেখ সাহেবের সাথে পাকিস্তানিরা যে আলোচনা চালাচ্ছে তা সম্পূর্ণ ভাঁওতা…পাকিস্তানিরা জনগণের আন্দোলনকে দমিয়ে দেবার জন্য সময় নিচ্ছে to build ap deyar army here. যদি আমাদের জাতীয় সত্ত্বাকে বাঁচিয়ে রাখতে হয় তবে সশস্ত্র আন্দোলন ছাড়া পথ নেই । পরিস্থিতি যদি আরও খারাপ হয় তবে অস্ত্রাগার খুলে অতিরিক্ত অস্ত্র জনগণকে দিয়ে দেয়া হবে । তিনি সঙ্গক্ষেপে বুঝিয়ে দিলেন যদি পাক আক্রমণ হয় তবে কী করতে হবে । তবে আমি ছাড়া বাকি সবাই বোধ হয় তা আগে থেকেই জানতেন । কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানিদের নাকের ডগায় বসে ঠাণ্ডা মাথায় এ ধরনের সিদ্ধান্ত একমাত্র খালেদ মোশাররফই দিতে পারতেন । পাক ব্রিগেড কমাণ্ডার ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি এটা টের পেয়ে আমাদের বিছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নেন । পাকিস্তানিরা জানত মেজর খালেদ মোশাররফ মনে প্রাণে জাতীয়বাদী ছিলেন । তাই তাকে একটা কোম্পানি নিয়ে শামসেরনগর যাবার নির্দেশ দেয়া হয় । ২৫ শে মার্চ দুপুরে তিনি শামসেরনগর রওনা দেন । তার সাথে ছিলেন লে. মাহবুবুর রহমান । বাকি ব্যাটেলিয়ান ঐ রাতে কুমিল্লা হতে ব্রাক্ষণবাড়িয়া রওনা হয় । খালেদ মোশাররফ রওনা হবার আগে চুপচাপ আমাদের বলে যান যেন অতিরিক্ত সমস্ত অস্ত্র ও গোলাবারুদ রসদপত্র (খাবার, জ্বালানী) বহনের ট্রাকের ভিতর লুকিয়ে নিয়ে যাই । কোনো কিছুই যেন বাদ না থাকে । এছাড়া উনি একটা সাংকেতিক বার্তা দিয়ে গেলেন । বাক্যটা মনে নেই তবে তা বিচিত্র ধরনের বাক্য ছিল । আমরা কোনো কিছু করে ওয়্যারলেসে ঐ সংকেত জানালে তিনি যেন আমাদের সাথে যোগদান করতে পারেন । ২৬শে মার্চ সকালে আমরা যখন ব্রাক্ষণবাড়ীয়া শহরের কাছে আসি তখন দেখলাম জনগণ রেলওয়ের বগি, গাছ ইত্যাদি দিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছে । তখন যাদের এসব কাজে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে দেখেছি তারা হলেন তাহের উদ্দিন ঠাকুর, আব্দুস কুদ্দুস মাখন, সাচ্চু মিয়া (স্থানীয় নেতা)। ওরা কিছুতেই ব্যারিকেড সরাচ্ছিলন না । আমরা কয়েকজন বুঝলাম যে, আমরা বাঙালি মারতে আসিনি । দরকার হলে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করব । আমাদের এক সেন্ট্রীর নাম ছিল মুনীর । তার একটি ট্রানজিস্টর ছিল । ১৭শে মার্চ চট্রগ্রাম বেতার মেজর জিয়ার ঘোষনা শুনে সে এবং আরও ২/১ জন সৈনিক উত্তেজিত হয়ে দৌড়ে আমাদের কাছে এসে যা বলেছিল তা আজো স্পষ্ট মনে আছে –“স্যার, আর অপেক্ষা করার সময় নাই । যদি আপনারা কোনো সিদ্ধান্ত না নেন তবে আমরা নিজেরাই বেরিয়ে গিয়ে কিছু করার চেষ্টা করব ।“ ব্যাটেলিয়ান কমাণ্ডার লে. কর্নেল মালিক খিজির হায়াত খান (অবাঙালি) ও মেজর সাদেক (অবাঙালি) নেওয়াজকে বন্দি করা হয় । নিরাপত্তার জন্য প্রথমে তাদের ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলে রাখা হয় । জনগণ তাদের উপর ক্ষেপে ছিল তাই পরে তাদের ভারত পাঠিয়ে দেয়া হয় । মেজর খালেদ মোশাররফ ঐ বার্তা শোনার পর দুপুরের দিকে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার বিভিন্ন জায়গায় (প্রধানত দুইটা অবস্থান ও একটা ব্রীজে)প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল । শহরের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেয়া হয় যেন কুমিল্লা হতে পাক বাহিনী আক্রমণ করতে না পারে আর গোকর্ণঘাটে প্রতিরক্ষা নেয়া হয় যেন ঢাকা হতে কোনো আক্রমণ না আসে । ব্রাক্ষণবাড়িয়াতে থাকার সময় ২য় ইস্ট বেঙ্গলের সাথে যোগাযোগ হল । তখন তার সিও ছিলেন মেজর শফিউল্লা । মেজর সিআর দত্ত ছুটিতে সিলেট ছিলেন । তার সাথেও যোগাযোগ হয় । তবে চট্রগ্রামের সাথে কোনো সরাসরি যোগাযোগ হয়নি । ব্রাক্ষণবাড়ীয়ায় কয়েকদিন কেটে যায় আলোচনায় । কীভাবে সুশিক্ষিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা উচিত তা খালেদ মোশাররফ জানতেন । তিনি তার বাহিনীর হেডকোয়ার্টার তেলিয়াপাড়া চা বাগানে স্থাপন করেন । খালেদ মোশাররফ বুঝতে পেরেছিলেন নিয়মিত বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ করতে হবে । গেরিলা যুদ্ধ শুরু করার পরিকল্পনা তিনি এখান থেকেই নেন । সেই সাথে দেশের ভিতর বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেন । সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালীর বিওপিতে অবস্থানরত ইপিআর জোয়ানরা নেতৃত্বের অভাবে যুদ্ধে যোগদানের প্রশ্নে কনফিউসড ছিল । মেজর খালেদের নির্দেশে প্রচুর পরিশ্রম করে এই ইপিআরদের একত্রিত করার একক কৃতিত্ব লে. মাহবুবের । ৪ঠা প্রিল হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজারের বাংলোয় এক সম্মেলন হয় । তাতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, মেজর জিয়ার সাহায্যের জন্য ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল হতে কিছু অফিসার ও সৈন্য চট্রগ্রাম যাবে । কর্নেল ওসমানী সেই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন । ২য় ইস্ট বেঙ্গল থেকেও একটি কোম্পানি পাঠানো হয় । এপ্রিলের ৩/৪ তারিখের দিকে খবর এলো যে, মেজর জিয়ার পক্ষে চট্রগ্রামের বিভিন্ন এলাকা রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না ও যেহেতু আমরা পুরো ব্যাটেলিয়ান ছিলাম তাই তিনি আমাদের সাহায্য চেয়ে পাঠান । তখনই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় আমাকে আমাদের ব্রাভো কোম্পানিসহ পাঠানো হবে । সঙ্গে কিছু ইপিআর সেনাও থাকবে । আমি মার সৈন্যদের নিয়ে আগরতলা সাবরুম হয়ে রামগড় পৌছালাম । সেদিন এপ্রিলের ৭ তারিখ । সময় বিকেল ৩/৪টা । রামগড় এসে দেখা হলো মেজর জিয়া, ক্যাপ্টেন রফিক, মেজর মীর শওকত আলী, ক্যাপ্টেন কাদের , এইচ. টি. ইমাম প্রমুখের সাথে । নীল প্যান্ট, সাদা হাফ শার্ট পরিহিত মেজর জিয়া, ক্যাপ্টেন রফিক নদীর পাড়ে বসে ম্যাপ দেখছিলেন । আমরা সে রাত কাটাই রামগড় স্কুলে । পরদিন আমার অধীনস্থ সৈন্যদের দু’ভাগ করা হয় । সুবেদার মেজর আব্দুর রহমান ভুঁইয়ার অধীনে রাউজান এলাকায় পাঠানো হয় এক প্লাটুন সৈন্য । কারণ মেজর জিয়ার কাছে খবর আসছিলো যে, ফকলুল কাদের চৌধুরী ও তার ছেলে সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরীর অত্যাচারে কোনো মুক্তিকামী লোক ঐ এলাকায় থাকতে পারছে না এবং ফ. কা. চৌধুরী ঐ এলাকায় পাক সৈন্য আনার চেষ্টা চালাচ্ছে । যে সব সগরণার্থী ভারতের দিকে যাচ্ছিল তাদের কাছ হতে এসব সংবাদ পাওয়া যায় । পরবর্তী কালে সুবেদার আবদুর রহমান ভূঁইয়া রাউজান হতে ফিরে এলে তার ও তার অধীনস্থ সৈন্যদের মুখে ফ. কা. চৌধুরী, সা. কা. চৌধুরী ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের যে রোমহর্ষক অত্যাচারের কাহিনী শুনি তা যে কোনো বাঙালির জন্য কলঙ্কজনক । তাদের অপরাধ শাহ আজিজ হতেও বেশি বলে আমি মনে করি । এ প্রসঙ্গে আরো দুজন লোকের নাম উল্লেখ করা পেয়োজন যাদের অত্যাচারের কাহিনী আমরা ভারতে থেকেও শুনতে পেতাম । তারা হচ্ছে মওলানা আবদুল মান্নান, কুমিল্লা ও আবদুল আলীম, জয়পুরহাট । আমাকে পাঠান হয় ঢাকা-চট্রগ্রাম রেল_সড়ক বন্ধ করে দেবার জন্য । আমরা প্রথমে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেই কুমিল্লা আর ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের মাঝামাঝি জায়গায় । সীতাকুণ্ডের ভেতর দিয়ে এই স্থানে আসার পথে (তখন সন্ধ্যা রাত) অন্তত কুড়িটার মত মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখতে পাই । তাদের রাস্তা হতে তুলে অন্যত্র কবর দেই । হয়তো পাকিস্তানিরা আমাদের আসার খবর আগেই পেয়েছিল তাই ঐ দিন বিমান হতে বোমাবর্ষন করে । আমাকে চট্রগ্রামে মেজর জিয়ার সাহায্যার্থে পাঠানোর সময়ই মেজর খালেদ মোশাররফ সেখান (চট্রগ্রাম) কীভাবে যুদ্ধ করতে হবে তার ব্রিফিং দিয়ে দেয় কারণ আগেই জানা ছিল যে, প্রয়োজনে আমাকে পুরো কোম্পানি নিয়ে ঢাকা-চট্রগ্রাম রেল ও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পাঠান হবে । মেজর খালেদ বলেছিলেন যে, সমুদ্রের দিক হতেই ওরা (পাক বাহিনী)আসার চেষ্টা করবে । কারণ বাঙালিদের কোনো নৌযান নেই তাই সমুদ্র পথে বাঙালিদের কাছ হতে বাঁধা পাবার কোনো সম্ভাবনাই নেই । পাহাড়ের দিক হতে পাক হামলা হবার সম্ভবনা কম কারণ অচেনা পথঘাট ও সেখানে কী রকম পরিস্থিতি তা ওদের জানা নেই । সামনের দিক হতে ওরা ভান করবে তারা সামনে থেকে আক্রমণ করবে তবে মূল আক্রমণ আসার সম্ভবনা সমুদ্রের দিকে হতে । সত্যি সত্যিই তাই ঘটেছিল । প্রথম ডিফেন্স চার দিন ধরে রাখতে পেরেছিলাম। পিছিয়ে গিয়ে সীতাকুণ্ডে পরবর্তী ডিফেন্স নেই । সীতাকুণ্ডে সপ্তাহ খানেক ছিলাম । সীতাকুণ্ডে থাকাকালীন এক দুপুর বেলায় আম গাছের নীচে বসে আকাশবানীতে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠনের সংবাদ প্রথম শুনলাম । এ সংবাদ প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধার ভেতর নতুন আশার সঞ্চার করে । সীতাকুণ্ডের পর মাস্তান নগরে ডিফেন্স গ্রহণ করি এটাই আমার জীবনের স্মরণীয় ডীফেন্স । মাস্তান নগরে সাত দিন ছিলাম । এই ডিফেন্স থাকার সময়, সূর্য ওঠার আগে খুব ভোর বেলায় কিছু গোলাগুলির শব্দ শুনতে পেয়ে হাবিলদার নজরুল ইসলামকে নিয়ে আমাদের মেশিন গান পোস্টে গেলাম । তার চার্জে ছিলেন হাবিলদার আবু শামা । একটা দীঘির উঁচু পাড়ের ওপর মেশিন গান পোস্টের অবস্থান ছিল যার ফলে সামনের বিরাট এলাকা পোস্ট হতে দেখা যেত । আমি যাবার পর গোলাগুলির প্রচণ্ডতা বেড়ে যায় ও সারাদিন চলার পর সন্ধ্যার দিকে ট্রেঞ্চে বসে মনে হল যে, আমাদের পেছনেও গোলাগুলি হচ্ছে । আম্র ডান ও বামে আমাদের অবস্থান ঠিক আছে কিনা তা জানার জন্য ইপিআর-এর একজন সৈনিককে পাঠালাম ডান দিকে । সে ক্রলিং করে গিয়ে ফিরে এসে জানান যে, ডান দিকে আমাদের অবস্থানে পাকিস্তানিরা এসে গেছে । তারপর তাকে বাম দিকের অবস্থান দেখতে পাঠালাম । আমার অবস্থানের ৫০/৬০ গজ দূরে বাম দিকে ঢাকা-চট্রগ্রাম মহা সড়ক । সেই সৈনিকটা ২০/২৫ গজ দূরে গিয়ে আবার ফিরে এসে জানাল যে ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের ওপর পাকিস্তানিরা এসে গেছে । আমার পকেটে ভারতীয় সিগারেট, মানি ব্যাগে কিছু পাকিস্তানি টাকা ও একটা গ্রুপ ফটো ছিল । ফটোটা বের করে বুক পকেটে রাখলাম । তাতে আমার স্ত্রী, ছেলে ও মেয়ের ছবি ছিল । কিন্তু মনে মনে কারো চেহারা মলাতে পারছিলাম না । মার কথা মনে হয়েছিল কিন্তু তারও চেহারা মনে করতে পারছিলাম না । নিশ্চিত ধরে নিয়েছিলাম যে মারা পড়ব । তিনটা সিগারেট ধরিয়ে খেলাম__মানে দু’এক টান দিয়ে ফেলে দেয়া । আবু শামাকেও একটা সিগারেট সিলাম যা কখনো কোনো অধীনস্থকে দিইনি । আমি তৃতীয় সিগারেটে টান দেবার সময় আবু শামা বলল, “স্যার দেখি পেছনে যেতে পারি কি না?” এমন সময় ট্যাঙ্কের একটা লাল গোলা এসে আমাদের বাঙ্কারের ছাদ উড়িয়ে নিয়ে যায় । মৃত্যু নিশ্চিত । আবু শামার মতো সাহসী সৈন্য আর দেখিনি । সে বলল, “স্যার আবু শামা বেঁচে থাকতে আপনার কিছু হবে না ইনশাল্লাহ ।“সে আমাকে একটা পিস্তল দিল যেন ধরা পড়লে আত্মহত্যা করতে পারি আর নিজের একটা সাব-মেশিনগান (এসএমজি) নিয়ে আমাকে কভারিং ফায়ার দিতে লাগল । আমি পিছনে দৌড় দিলাম । পেছনে ৪০০/৫০০ গজ দূরে ফেলছিল । আমি দৌড়ে নালাতে পড়ে গিয়ে ৪/৫ মিনিট জ্ঞান হারিয়ে ফেলি । ইতোমধ্যে আমার সৈন্যরা পিছিয়ে এসে নতুন জায়গায় ডিফেন্স নিচ্ছিল । কিন্তু আমার ড্রাইভার আবুল বশর (সিভিলিয়ান, গান্ধা ইণ্ডাষ্ট্রীতে চাকরি করত) জীপ গাড়িকে মহাসড়কের ওপর একটা বিরাট বটগাছের আড়ালে রেখে আমার সন্ধানে আসছিল । আমাকে নালাতে পড়তে দেখে বশর ও আরেক সৈনিক (নাম মনে নেই, তার বাড়ি সন্দ্বীপ) দৌড়ে এসে আমাকে ধরে জীপে তুলে নিয়ে যায় । ততক্ষণ চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেছে তাই পাকিস্তানিরা আমাকে আর দেখতে পায়নি । পরে শুনেছিলাম যে, প্রচুর পাক সৈন্য মাস্তাননগরে মারা পড়েছিল । এরপর মীরেশ্বরাই ডিফেন্সে ৪/৫ দিন ছিলাম । এখানে আমাদের বেশ কয়েকজন নিয়ে ২০/২৫ মাইল দূরে গিয়ে বাশঁ কেটে নিয়ে আসাতেন। কিন্তু সার্জিকাল ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি যোগাড় করার ব্যাপারে ডা জাফরউল্লার আবদান বেশি। তিনি ইংল্যান্ড হতে অনেক জিনিস নিয়ে আসেন। অক্টোবর মাসে আমার যক্ষা রোগ ধরা পড়ে।হেডকোয়ার্টারে ৩/৪ মাস রাতে ঘুমাতে পারিনি। খাবার,বিশ্রামের অভাবের জন্য শরীর খুব দুর্বল ছিল । রোগ ধরা পড়ার পর হাসপাতালে ভর্তি হই । ১৬ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনের খবর হাসপাতালেই পাই । ১৬ই ডিসেম্বর আনন্দ দিয়েছে কিন্তু পুরোপুরি তৃপ্তি দেয়নি আমরা হিসেব করেছিলাম যে, তিন বছর যুদ্ধ করে আমরাই দেশ স্বাধীন করব । আমরা চাইতাম ভারত সাহায্য করুক কিন্তু সরাসরি হস্তক্ষেপ করুক তা চাইতাম না । আমাদের (নিয়মিত বাহিনীর) সম্মানে একটা ঘা লাগে । জেনারেল জিয়া মাস্তান নগর ডিফেন্সের কারণে আমার জন্য সর্বোচ্চ বীরত্ব উপাধি সুপারিশ করেছিলাম । কিন্তু পরে ‘বীর প্রতীক’ উপাধি দেওয়া হয়েছে কিনা তা জানা নেই । তবে মনে হয় মাস্তান নগর ডিফেন্সের কারণেই এ উপাধি দেওয়া হয় । একাত্তর সালে আমি কোনো প্রমোশন পাইনি । কারণ আর্মিতে নিয়ম যতদিন স্বাস্থ্য ক্যাটাগরি ‘এ’ না হবে, মানে হাসপাতালে থাকতে হবে ততদিন প্রমোশন বন্ধ থাকবে । ১৯৭২ সালে মেজর পদে প্রথমে কুমিল্লায় ব্রিগেড মেজর মেজর ও পরে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে ১০ম ইস্ট বেঙ্গলের কমাণ্ডিং অফিসারদের (CO) দায়িত্ব পালন করি । ১৯৭৩-৭৪ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এডজুটেন্ট জেনারেল ছিলাম । ১৯৭৪ সালে লে. কর্নেল পদে উন্নীত হই ও ভারতে Staff College-এ Higher Command বিষয়ে পড়াশুনা করি । ১৯৭৫-৭৬ সালে আমি আর্মি হেডকোয়ার্টারে ডিরেক্টর, স্টাফ ডিউটি পদে কর্মরত ছিলাম । ১৯৭৬ সালে কর্নেল পদে উন্নীত হই ও ৭৬’সাল হতে ৭৮’-এর মধ্যভাগ পর্যন্ত চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের কমান্ড্যান্ট ও চট্টগ্রম ক্যান্টনমেন্টের স্টেশন কমান্ডার ছিলাম । ১৯৭৮ সালে ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নীত হই ও ’৭৮-’৮১ (মাঝামাঝি) সালে বার্মা, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাসের সামরিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করি । জেনারেল জিয়ার মৃত্যুর কয়েকদিন পর আমাকে রিটায়ার করানো হয় । তারিখ মনে নেই, মনে করার চেষ্টাও করি না । কাগজপত্রে লেখা আছে । কিছু স্মরণীয় ঘটনাঃ *একদিন মেজর মোশাররফ বললেন, “মতিন, তোমার স্ত্রীকে কি বলেছ, যে আমরা যদি মরে যাই তবে তোমার ছেলেকে মুক্তিযোদ্ধা করতে হবে?” বললাম, “স্যার ওটা বলার দরকার হবে না, না বললেও আমার ছেলে আমার ছেলে বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করবে”। *অনেক মহিলা, অনেক মেয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন । তার মধ্যে একজন ভদ্রমহিলা, (’৭১ এ তার বিয়ে হয়নি, ১৮/২০ বছর বয়স) । এক রাত আমরা বসে চিন্তা ভাবনা করছি মেয়েদের দিয়ে কী করানো যায়?

এদের অনেকেরই প্রবল ইচ্ছা ছেলেদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার । বিভিন্ন কারণে তা সম্ভব নয় । প্রশ্ন দেখা দিল তাহলে কীভাবে তাদের অবদান গ্রহণ করা যায় । তাদের বাসস্থান, নিরাপত্তা, টয়লেট, শারিরীক জটিলতা । এসব তাদের জীবনের স্বভাবিক বিষয় হলেও এ অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সমস্যাটি প্রকট হয়ে দেখা দিল । এক রাতে মেজর খালেদ এবং আমরা কয়েকজন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছিলাম । বোধকরি আমাদের সমস্যাটি তারাও উপলব্ধি করছিল । এক মেয়ে, বয়স ১৮/১৯ তখনো তার বিয়ে হয়নি এগিয়ে এল । সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘স্যার বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য নিজেদের প্রাণসহ সব দিচ্ছেন । স্বাধীনতার জন্য আমরাও সব দিতে প্রস্তুত আছি । মেয়েটি এবার চোখের দৃষ্টি নিচে করে ক’সেকেন্ড চুপ করে রইল । টপ টপ করে চোখ থেকে পানির ফোটা মাটিতে পড়ছে । বলল আবার, ‘আমাদের সম্ভ্রমও’ । *জুন মাসে খবর পেলাম যে আমার স্ত্রী এক জায়গায় আছে । তাকে আনবার জন্য পাঠালাম শিল্পী শাহাবুদ্দিন (এখন ফ্রান্সে নাম করা চিত্রশিল্পী) ও আরেক জনকে আমার স্ত্রী চট্টগ্রাম হতে ছাগলনাইয়া দিয়ে ভারত আসে, ১৪/১৫ মাইল এক নাগাড়ে হেঁটে । তাতে আমার চেয়ে যে আমার বড় ছেলের ছোট ছিল, অসুস্থ হয়ে যায় ও ভারতে কিছুদিন পর মারা যায় । *জুলাই মাসে নারায়ণগঞ্জ টানবাজার থানা অপারেশন করা হয় । সেই অপারেশনে নারায়ণগঞ্জেরই এক হিন্দু ছেলে (টানবাজার বাড়ি) ছিল ফিরে আসার সময় এক রাজাকারের গুলিতে মারা যায় । ছেলেটার বাবার নারায়ণগঞ্জে ছোটখাটো ব্যবসা ছিল । তিনি আমাদের ক্যাম্পের পাশে এক রিফিউজী ক্যাম্পে থাকতেন । মেজর খালেদ মোশাররফ আমাকে বললেন যেন ওকে কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করি আর তাকে সান্ত্বনা বাণী শোনাই । ভদ্রলোককে মেলাঘরে ডেকে পাঠালাম । ওকে সান্ত্বনা দিলাম, তবে লক্ষ করলাম উনি আমার কথাগুলো ঠিকমত শুনছেন না । জিজ্ঞসা করলাম, “দাদা কী চিন্তা করছেন?” তিনি বললেন, “আমি চিন্তা করছি ভগবান কেন আমাকে একটা ছেলে দিল, আরেকটা দিলে তো মুক্তিযুদ্ধে পাঠাতাম”। *অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে । রাত প্রায় ১২টা, অফিসে বসে কাজ করছি । এমন সময় মেজর খালেদ মোশাররফ বেলুনিয়া হতে ফিরলেন । আমি তার জন্য অপেক্ষা করছিলাম । তখন টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল । উনি বলেলেন, মতিন, ‘হারিকেন নিয়ে আস, বাথরুম পাহাড়ের নিচে প্রায় ১০০গজ দূরে ছিল । ঘরের ভেতর লোক বসে ছিল তাই আমার মনে হলো তিনি আমার সাথে নির্জনে কথা বলতে চান । তার সঙ্গে যাচ্ছি, আমার হাতে হারিকেন । হঙ্গলের মতো এক জায়গায় থেকে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মতিন, বাংলাদেশ যদি স্বাধীন হয় তবে কে আমাদের শত্রু হবে?’ আমি বললাম, ‘ভারত তো বাংলাদেশের তিন দিকে ঘেরা, ভারত এখন আমাদের আশ্রয়, অস্ত্র, সাহায্য এবং সহায়তা করছে । ভারত তো আমাদের শত্রু হতে পারে না’। তিনি সিগারেট খাচ্ছিলেন । সিগারেটটা মাটির ওপর ফেলে দিয়ে বুট দিয়ে মাটিতে কয়েকটা আঘাত করে বললেন, ‘This is the country which will be our greatest enemy.’ অক্টোবরের শেষ দিকে বিবির বাজারে এক হিন্দু ভদ্র মহিলা পাকিস্তানিদেওর গুলিতে ভীষণ ভাবে আহত হন । তাকে বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতালে আনা হয় । কিন্তু ভদ্র মহিলার অত্যাধিক রক্তক্ষরণ হচ্ছিল । যে ডাক্তার তার পাশে ছিলেন তিনি ভদ্র মহিলাকে সান্তনা দিচ্ছিলেন, কারণ অপারেশন বা রক্ত দেয়া সম্ভব ছিল না । আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলাম । ভদ্রমহিলা ডা. মোবিনের হাত ধরে বলেছিলেন, ‘দাদা, আমিতো মরে যাব কিন্তু আপনারা দেশটাকে স্বাধীন করে যাবেন’।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!