You dont have javascript enabled! Please enable it! কর্নেল সালাউদ্দিন মোহাম্মদ রেজা, পিএসসি - সংগ্রামের নোটবুক

কর্নেল সালাউদ্দিন মোহাম্মদ রেজা, পিএসসি

১৯২৫ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম শহরে আমার জন্ম হয় । আমার পৈত্রিক নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাঞ্ছারামপুর অঞ্চলের রূপদী ভোলানগর (দেওয়ানবাড়ি) ও পরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মোলভীপাড়ায় । আমার পিতার নাম মো. আবদুল্লাহ । তিনি বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে ছিলেন- প্রথমে ১৯০৭ সালে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে চাকুরিতে যোগদান করে সর্বশেষ ১৯৩৭ সালে রাজশাহী ডিস্ট্রিক্ট হিসেবে অবসরগ্রহণ করেন । তিনি ১৯৭১ সালের ১৮ই মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ইন্তেকাল করেন । আমার মাতার নাম রাহাতুননেসা । তিনি ১৯৬৭ সালে ইন্তেকাল করেন । আমরা মোট ৬ভাই, ২বোন । আমার স্থান ৭ম । আমার ছোট এক ভাই । আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া অন্নদা হাই স্কুলে লেখাপড়া আরম্ভ করি । পরে বরিশাল জেলা স্কুল, চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুলে পরাশুনা করি ১৯৩৯ সালে শ্রীরামপুর ইউনিয়ন ইন্সটিটিউসন স্কুল, হুগলী হতে আর্টস বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করি (৫টি বিষয়ে লেটারসহ মস্টার) । ম্যাট্রিক পরীক্ষায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বেঙ্গল ও আসাম প্রদেশে ইংরেজিতে সর্বোচ্চ নাম্বার পাওয়াতে দুটি স্বর্ণ পদক লাভ করি । ১৯৪১ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ হতে আই. এ পরীক্ষায় ৫ম স্থান অধিকার করি । ১৯৪৪ সালে একই কলেজ হতে ইতিহাস বিষয়ে অনার্স পরীক্ষায় সম্ভবত Second class 1st স্থান লাভ করি । যতদূর স্মরণ হয় সেবছর কেউ উক্ত বিষয়ে ১ম শ্রেণী লাভ করেনি । বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকা সিটি ল কলেজ হতে তিয়াত্তর অথবা চুয়াত্তর সালে (আমার রিটায়ারমেন্টের পর) এলএলবি ডিগ্রী লাভ করি । মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে আমি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন চাকুরিরত অফিসার ছিলাম । আমি ১৯৪৭ সালের শেষ দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করি এবং ১৯৪৮ (২৫নভেম্বর ১৯৪৮-সম্পাদক) সালে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি (PMA), কাকুল থেকে সেকেণ্ড লেফটনেন্ট হিসেবে পদাতিক বাহিনীতে রেগুলার কমিশন লাভ করি ।

বাঙালি মুসলমানদের ভিতর প্রথম আমিই PMA হতে পাশ করি এবং পাকিস্তান সেনা বাহিনীতে পার্মানেন্ট পোস্টিং পাই। ১৯৪৭ সালে সেকেন্ড লেফটেনেন্ট হিসেবে প্রথম 1st ও পরে 2 nd East Regimentএ কর্মরত ছিলাম। পরে ১৯৫৯ সালে Command & Staff College হতে pse ডিগ্রী লাভ করি। ১৯৪৭ সালের শেষ দিকে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমী, কাকুলে ভর্তির জন্য সার্ভিস সিলেকশন র্বোড ঢাকায় আসে।তেজগাঁয় তাদের হেডকোয়াটার ছিল। প্রায় হাজার খানেক ছেলে পরীক্ষায় অংশগ্রহন করে। বাঙালি ছাড়া ও ইউপি, পাঞ্জাব, করাচীও অন্যান্য জায়গা হতে ও অনেকে পরীক্ষা দিতে ঢাকা এসেছিল। তাছাড়া অনেকে বিহারীও ছিল। অবাঙালিদের যুক্তি ছিল যেহেতু পূর্ব- পশ্চিম পাকিস্তান একই দেশ তাই যে জায়গাতেই বোর্ড বসুক এতে যেকোনো পাকিস্তানিরা অংশ নিতে পারবে। শত শত ছেলের মধ্যে প্রায় ৬০/৭০ জনকে select করা হয়। এদের মধ্যে মাত্র চারজন বাঙালি ছিল। আমি ছাড়া বাকি ৩জন- আগা ইউসুফ (আমার কলেজ বন্ধু,মেজর), মাহফুজুর রহমান(মেজর), মাহমুদুর রহমান মজুমদার (ব্রিগেডিয়ার)। Seiection -এর সময় প্রচন্ড পরিশ্রম করতে হত অথচ খেতে দেওয়া হতো ঠান্ডা ডাল আর রাবারের মত রুটি। এই খাবার নিয়ে আমাদের গ্রুপ ট্রেনিং অফিসারের নিকট আপত্তি করায় তিনি উদ্ধত স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি ঢাকার নবাবের ছেলে যে এখাবার খেতে আপত্তি করছ? উত্তরে বললাম, আমি আমার বাপেরই ছেলে, আশা করি তুমি নিজ সম্বন্ধেও অনুরুপ দাবি করতে পারবে। রাগে উন্মত্ত হয়ে তিনি আমাকে সোজা করার শাসানি দিয়ে হয়ত চেয়ারম্যান, জেনারেল হাবিবুল্লাহর অফিসের দিকেই গেলেন। এটা নিয়ে কেউ আমাকে আর কিছু বলেনি। সে সময় এই ব্যাপারে (seiection) নিয়ে তৎকালীন পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে দেখা করি। তাকে বললাম মাত্র চারজন বাঙালি নেওয়া হয়েছে।তিনি বললেন, “আর্মিকা standard তো lower নেহি কিয়া যা সাকতা। বললেন পাকিস্তান আর্মিতে বাঙালিদের প্রতি কোনো বৈষম করা হয় না এই কিছুদিন আগেই তার ভাতিজা খাজা ওয়াসিউদ্দিন কর্নেল পদে প্রমোশন পেয়েছেন। মজার কথা এই বাঙালি ভ্রাতষ্পুত্র পরে লেফন্টানেন্ট জেনারেল পদে উন্নীত হন। ১৯৬৯ সালের promotion Conferance –এ আমার বিরুদ্ধে তিনি একমাত্র ভেটো দান লরেন। যদিও আমার সঙ্গে তার কোনো পরিচয়ই ছিলো না, হ্নদ্যতা ছিল কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যেসব বাঙালি জেনারেল,এয়ার মার্শাল যেমন, চৌধুরী, রুদ্র, মুখার্জী, মজুমদার সুনাম অর্জন করেছিলেন তাদের নাম উল্লেখ করে বললাম যে বাঙালিদের standard এত তাড়াতাড়ি কীভাবে নষ্ট হয়ে গেল। তকখ বললেন, ইয়ে তো সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট কা মামলা হ্যায়, হামতো ইস্ট বেঙ্গলকা প্রাইম মিনিস্টার। তো ফের আগর আপকা লিয়ে কোই সুপারিশ কা জরুরাত হ্যায় ম্যায় উনলোককো বোল দেঙ্গে….। তবে কাকুলে traning period –এ কখনো (৪৭-৭১) বাঙালিদের প্রতি কোনোরকম উৎকট বৈষম করা হয়নি। অন্তত তাই আমার বিশ্বাস যদিও একাডেমীতে আমার সাথে মারামারিও হয়েছে। বাঙালি ক্যাডেট কাকুলে Sword of Honour পেয়েছে (যেমন কর্নেল কাইয়ুম চৌধুরী)। যারা বাঙ্গালী ক্যাডেটদের প্রতি একাডেমী instructor – দের বৈষম্যমূলক আচরণের কথা বলে তারা হয় অতিরঞ্জন করে অথবা নিজেদের অযোগ্যতা ঢাকার প্রয়াসে এই মিথ্যার আশ্রয় নেয়। যারা পরীক্ষায় ফেল করত বা যাদের অন্য কোনো দোষের জন্য বের করে দেওয়া হয়েছিল তাদের মুখেই শোনা যায় যে, হাবিলদার রাইফেলের বাটঁ দিয়ে কাঁ ধে মেরেছে… বাঙালি বলে অকথ্য ভাষায় গালি দিয়েছে…. আমার এইসব (দৈনিক পেশা) ভাল লাগে না….. ইত্যাদি। অতঃপর একজন নবীন সামরিক অফিসার হিসেবে আমার দুটি অভিজ্ঞতার কথা এখানে উল্লেখ করছি- ১৯৪৯ সালের ঘটনা। পূর্ব পাকিস্তানে ১৪ ডিভিশনের (একমাত্র ডিভিশন) নতুনGOC (General Officer Commanding) মেজর জেনারেল আয়ুব খান তেজগাঁ সিপাইদের স্কুলে একটা মিটিং ডাকেন ( আয়ুব খান, লোকাল মেজর জেনারেল Boundary commission থাকার সময় দুষ্কর্মের জন্য মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাকে দুচোখে দেখতে পারতেন না এবং তার চাকরি চলে যাবার অবস্থা হয়।‘আলীগড় গ্রুপ’- এর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খানের হাতে পায়ে ধরে আয়ুব সে যাত্রা রক্ষা পান and he came here on a punishment posting as a commander of a nominal division with a local Major General’s rank.শুধু আয়ুবই না ১৯৭০ পর্যন্ত বেঙ্গল রেজিমেন্ট অথবা পূর্ব পাকিস্তানে কারো পোস্টিং হলে সাধারনভাবে ধরে নেওয়া হতো যে তাকেpunishment হিসেবে পাঠানো হয়েছে।East paskistan was the dumping ground of Pakistan Army. যাক, একটা ডিভিশনে সাধারনত ন’টা পদাতিক ব্যাটালিয়ান থাকে। তখন মাত্র ২টা ব্যাটালিয়ন ছিল –4 punjab and newly formed 1st East Bengal Regiment. সেই মিটিং- এ সব আর্মি অফিসার, পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সেক্রেটারি ও কিছু সিভিলিয়ান উপস্থিত ছিলেন। সর্বকনিষ্ঠ লেফটেনেন্ট হিসেবে আমি ও সেইclose door meeting –এ ছিলাম। উপস্থিত Civil Service Officer –এর মধ্যে ফারুক(ICS) এবং বাঙালিcivilian –দের ভেতর মৌলানা আক্রাম খাঁ ছাড়া অন্য কারো নাম মনে নেই এবং এই মিটিং ডাকার উদ্দেশ্য কী ছিল তা এতদিন পর স্মরণ নেই। সম্ভবতpolitical কারন ছিল। প্রথমে আইয়ুব খান অনেকটা এই ধরনের বক্তৃতা দিলেন… এই দেশের অবস্থা মোটেও ভাল না। বাঙালি মুসলমান –যাদের পূর্ব পুরুষ হিন্দু, কলকাতার দিকে তাকিয়ে আছে। আর থাকবেই না বা কেন? এদেশেতো কোনো ভদ্রলোক নেই। অনেক আগে পাঠানেরা যখন বাংলা দখল করেছিল তখন তারা অল্প সংখ্যা ছিল। তাদের রক্ত বর্তমানে বাঙালিদের সাথে মিশে গিয়ে ক্ষীণ হয়ে গেছে-you are bleeding us ehite, এই ধরনের চলতে থাকলেwe will drop you like a hot potato” অনেকটা এই ধরনের বাঙালী বিদ্বেষীnonsense কথা বার্তা। (আয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তান সম্পকিত যে কোনো বক্তৃতায় এ ধরনের কথাই বলতেন)। ফারুকী তার বক্তৃতায় বললেন, আমি জেনারেল আয়ুবের কথা confirm করি।

Gentiemen আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন যে এদেশের মুসলমানেরা পাকিস্তানকে পাকিস্তান উচ্চারণ না করে ‘হিন্দুস্থানের’ মতো ‘পাকিস্থান’ উচ্চারন করে। এদের নজর কলকাতায় দিকে। সময় হলেই এরা ….They are unreliable and are not really in the favour of the establishment of pakistan’. আক্রাম খাঁ বক্তৃতার প্রথমেই বললেন, “আমি আমার বড় ভাই জেনারেল আয়ুব খানকে বলতে চাই পাথান্দেরকথা সত্যি। আমার পাঠান পূর্ব পুরুষ বোগ্রা খাঁ, ছোগরা খাঁ ফ্রন্ট্রিয়ার থেকে এদেশে settleকরেছিলেন। বাঙ্গালিদের বিরুদ্ধে এধরনের কথা বলে আয়ুব খান্দের খুশি করার চেষ্টা করলেনand the funny thing is that বোগরা খাঁ কোনো মানুষের নাম হলে ও বোগরা খাঁ- ছোগরা খাঁ নাম দুটি উর্দু রুপকথাতেই(বাচ্চাদের ভয় দেখানোর জন্য) একত্রে উচ্চারিত হয় যেমন বাংলা রুপকথার হবুচন্দ্র –গবচন্দ্র বাস্তবে কারো কারো নাম হয় না। আর পরে জেনেছি আক্রাম খাঁর পূর্ব পুরুষেরা এদেশেরই রবিঠাকুরের পরেবারের পতিত ব্রাক্ষণ ছিলেন। কয়েক বছর পরের অভিজ্ঞতা। পূর্ব পাকিস্তানের সবGOC ই civil administration–এর ওপর প্রত্যেক মাসে মাসে রাওয়াল্পিন্ডিতে political রিপোর্ট দিতেন।কেন দিতেন তার কারন আমার জানা নেই। চীফ সেক্রেটারীGOC –র নিকট তার রির্পোট দেবার পর তাতে নিজস্ব বক্তব্য প্রদান করে পাঠিয়ে দিত। জেনারেল ইউসুফের (আয়ুবের পর14 Division –এরGOC )ADC থাকাকালে এসবsecret paper পড়ে দেখার সুযীহ আমার হয়েছিল।East Pakistan was always rued by the army আমি মুক্তিযুদ্ধের আগে আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলাম এবং ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের পূর্বে I was in touch with sheikh Mujib in connection with the preparations for an armed rising against what we considered to be an alien and hostile occupation gorce. আমার ছেলে তালাল রেজা (১৫ বছর) মুক্তিযোদ্ধা ছিল।বাংলাদেশ সরকার পরিচালিত কোনো ট্রেনিং ক্যাম্পে তাকে ট্রেনিং-এর জন্য ভর্তি নেও্যা হয়নি।CPB ও মুজাফফর ন্যাপ পরিচালিত ট্রেনিং ক্যাম্পে(আসাম) সে কমেন্ডো ট্রেনিং গ্রহন করে। আমার তের বছরের অন্য ছেলেটি (সাদ রেজা) আগরতলাস্থ কোনো এক ক্যাম্পে গিয়ে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তাকে বলা হয়, তোমাকে ট্রেনিং- এর জন্য নেওয়া যাবে না, তোমার বাবাতো আওয়ামী লীগে নেই। ছেলে বলেছিল, আমার বাবাতো আর্মি অফিসার তিনি তো কোনো রাজনৈতিক দলেই থাকতে পারেন না। আমার বড় মেয়ে ইফফাত রেজাpresidency college –এর ভর্তি হয়ে লেখাপড়া টিকিয়ে রাখার সুযোগ ছেড়ে শরৎ বোসের বাসায় Collation & propaganda Office–এ মাসে ত্রিশ টাকা নিয়ে কর্নেল এসি ভোরার অফিসে –এ কাজ করত। আমার ছোট ভাইও একজন মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তেরর সালের এপ্রিল মাসে তিনি বর্ডার ক্রস করে আগরতলায় আমার কাছে আসেন। কিন্তু আমাকে না পেয়ে ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় ফিরে যান। ভারতে যাবার অপরাধে, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে থাকায় ও আমার ভাই হওয়াতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাকে বন্দী ও নির্বাচন করে । ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাশের বাসায় পূর্ব পাকিস্তানের কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের আমীর বাস করতেন । তারাই ভদ্রতা করে তাকে পাকিস্তানিদের কবল হতে উদ্ধার ও আমাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা ব্যাহত করে । এবং মুক্তিযুদ্ধের পর ওসমানীর স্বাক্ষরিত সার্টিফিকিট (লক্ষ লক্ষ সংখ্যায় যা বাজারে কিনতে পাওয়া যেত) ও মাখন কুদ্দুসের সাহায্য ও তদবীরের বদৌলতে তিনি সরকারিভাবে একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সুনাম অর্জন করেন ও ভাল চাকুরি পান । বাঙালি প্রীতিতে ও পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে জেহাদ হিসেবেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি । আমরা অল্প কয়েকজন একাত্তরের বহু বছর আগে থেকেই এ ধরনের চিন্তা করতাম । আমরা চেয়েছিলাম পাকিস্তানের শোষণ থেকে মুক্ত হয়ে এদেশে some sort of socialist economy কায়েম করতে । এদেশ হতে শ্রেণীবৈষম্য দূর করতে । ইণ্ডিয়া, পাকিস্তান, আমেরিকা ইত্যাদি শক্তির প্রভাব থেকে মুক্ত রেখে এদেশকে একটা আদর্শ নিরপেক্ষ তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে গড়ে তোলার চিন্তা আমাদের ছিল । দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলিম প্রধান দেশগুলি অর্থাৎ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ইত্যাদির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি সাধন করা যাবে বলে আমার বিশ্বাস ছিল । সম্ভবত সত্তরের ডিসেম্বরের শেষ দিকে অথবা একাত্তরের জানুয়ারিতে প্রথম দিকে আওয়ামী লীগের ২জন এম. পি লে. কমাণ্ডার এমএম ইসলাম এবং লেফটেনেন্ট মতিউর রহমান আমাকে ধানমণ্ডিতে শেখ সাহেবের বাসায় নিয়ে যান । তখন রাত ৭/৮টা বাজে । তোফায়েল আহমেদ সেখানে ছিলেন । শেখ সাহেব তোফায়েলকে সেখান থেকে সরিয়ে দেন । কিছু বাক্যালাপের পর শেখ মুজিব বললেন, আপনারা ৪৮ ঘন্টার মতো পাকিস্তান আর্মিকে আটকিয়ে রাখতে পারবেন কি? ততক্ষণে নাকি বর্ডার দিয়ে ইণ্ডিয়ান আর্মি ঢুকে পড়বে । অস্ত্র-শস্ত্র, টাকাপয়সা, বেতার যন্ত্র জাতীয় কম্যুনিকশনের যন্ত্রপাতি ইত্যাদি সবই নাকি ওরা দিবে । শেখ সাহেব তার মাথার উপর হাত ঘুরিয়ে বললেন, আমি ঐ দিকে চলে গিয়ে হাজার হাজার লোকজন সহ নেমে আসব । এমনভাবে বললেন যে আমার মনে হলো তিনি সম্ভবত গাড়ো পাহাড়ের দিকে চলে যাবেন । মূলকথা-বর্ডার দিয়ে ভারতীয় বাহিনী ঢুকে পড়লে নাকি ঢাকা, যশোর, চট্রগ্রাম ইত্যাদি ক্যান্টনমেন্টের পাক সৈন্যরা বর্ডারে ছড়িয়ে পড়বে ফলে ভারতীয় অস্ত্রের সাহায্যে ঢাকা দখল করা বাঙালিদের জন্য সম্ভব হবে । আমি তাকে বললাম যে পাকিস্তান আর্মি এত বোকা নয় যে তাদের nerve centre ঢাকা ফেলে সবাই বর্ডারে চলে যাবে । তাকে জিজ্ঞাসা করলাম এই যে অস্ত্র-শস্ত্র, অফুরন্ত টাকা পয়সা, বেতার যন্ত্র এগুলো কারা কোথায় দেবে আর কারাইবা কোথায় গ্রহণ করবে? কারা ইনস্ট্রাক্টর, লিয়াজোঁ হিসেবে আছেন আর এগুলো নিয়ে কোথায় রাখা হবে অর্থাৎ আগে থেকে তৈরি করা cache’s entry points, safe house -এর ব্যবস্থা আছে কিনা এবং এগুলো কোন প্রশিক্ষিত দল ব্যবহার করবে ইত্যাদি __এগুলো সব ঠিক আছে? Chain of command, leadership structure কম্যুনিকেশন নেটওয়ার্ক গঠন করা হয়েছে? শেখ সাহেব বললেন, হ্যাঁ সব সব রেডি আমি নিরাপত্তার খাতিরে আর বেশি প্রশ্ন করলাম না । পরে জেনেছি এগুলো সত্য ছিল না । যাক, শেখ মুজিব বললেন, আপনি যে এগুলো (armed restistance) organize করতে হবে কর্নেল ওসমানীকে সঙ্গে রাখলেই তো ভাল হয় । বললাম, উনিতো এখন সিলেটে তার নির্বাচনী বিজয় উদযাপন করছেন । শেখ মুজিব আমাকে নির্দেশ দিলেন ওসমানীর সঙ্গে একত্রে কাজ করার জন্য । এর কিছুদিন পর উপরোক্ত দুজন এম.পি বনানীতে (ওসমানী যেখানে থাকতেন) বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ নিয়ে গেলেন যে এসব ব্যাপারে একত্রে কাজ (detailed plan programme) করব । আমি আমার বাড়িতে বসে ওদের (MP) জন্য অপেক্ষা করছি অনেকক্ষণ পর তারা আমার বাড়িতে এলেন । একজন ক্ষুব্ধস্বরে বললেন, স্যার আপনি ঠিক বলেছিলেন ওসমানী একটা….। কর্নেল ওসমানী নাকি সব শুনে এদের বলেছেন, আমি এ সবের মধ্যে নেই । ওরা (পাকিস্তান আর্মি) এসব কিছু করলে আল্লাহর বিচারে শাস্তি পাবে এবং ওসমানী সাহেবের করণীয় কিছু নেই । মোট কথা উনি আমার সঙ্গে কাজ করতে রাজি নন এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র কেইসের সওয়াল জবাবের ধাক্কা উনি তখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি । প্রথম সাক্ষাতের ১৫/২০ দিন পর শেখ সাহেব আবার একদিন আমাকে খবর দিলেন । দিনের বেলায় তার বাসায় গেলাম । উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন যে জয়দেবপুরে নাকি পাকিস্তানিরা সমস্ত বাঙালি সৈন্যদের ঘিরে মেরে ফেলেছে । অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, জয়দেবপুর ঢাকার এত কাছে কাউকে পাঠিয়ে খোঁজ নিলেইতো সব জানা যেত । আপনার কাছে কি পাঠিয়ে খোঁজ নেবার মত কোনো লোক নেই? বললেন, না নেই । তাকে বললান যে, পাকিস্তানিরা একটা ব্যাটালিয়ন আক্রমণ করে তাদের হাত দেখাবে না । যদি মিলিটারি অ্যাকশন  শুরু করে তবে সারাদেশে একই সময় একই সঙ্গে আরম্ভ করবে । আমার আর্দালীকে পাঠিয়ে দিলাম খোঁজ নেবার জন্য । সে জানাল কোনো রকম অঘটনই দেখেনি । আমি শেখ সাহেবকে আমার বিস্তারিত লিখিত পরিকল্পনা দিলাম । কাগজগুলো নিয়ে তিনি বললেন, তাজউদ্দিন সাহেবকে দিতে পারতেন”। তখন ইস্ট পাকিস্তানে –এ বাঙালি সৈন্যদের হাতে প্লেন ট্যাঙ্ক না থাকলেও ফায়ার পাওয়ার -এ আমরা পাকিস্তানিদের চেয়ে ৪/৫ গুণ বেশি ছিলাম । বাঙালি অফিসার্স অ্যান্ড ট্রুপস আর্মড পুলিশ, ইপিআর, আনসার, পুরনো পিএনজি (পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ড সম্পাদক) ও মুজাহিদ পার্সোনেলদের যদি ঠিকমত মোটিভেট করিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে নামাত যেত তাহলে পাকিস্তানিদের পরাজিত করা কোনো কঠিন কাজ ছিল না (আমার প্ল্যান-এ এসব ব্যাপারই ছিল)। একাত্তর ও পরবর্তীকালের অভিজ্ঞতার আলোকে এখন বলতে পারি আমার সেই পরিকল্পনা কার্যকর হবার বিন্দুমাত্র সম্ভবনা ছিল না । কারো লড়বার মনোবল, অর্গানাইজেশন, ইচ্ছাও ছিল না নিজের গা বাঁচাতেই সবাই ব্যস্ত ছিল । আর প্রস্তুতির লেশমাত্রও ছিল না মৃত্যুঝুঁকি মাথায় নিয়ে আমি ইপিআর, ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়ানগুলিকে চিঠি পাঠিয়েছি । সতর্ক থাকতে বলেছি পারসোনাল আর্মস, ব্যাটালিয়ন উইপনস কখনো না ছাড়তে । আমি নিজে কয়েকটা ব্যাটালিয়নের অফিসার এবং জেসিওদের সদা সতর্ক থাকার জন্য বলেছি । এমনকি বাঙালিদের সতর্ক করে দেবার জন্য কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে মেসেঞ্জার হিসেবে আমার স্ত্রীকে পাঠাতে বাধ্য হয়েছিলাম কারণ কোনো রাজনৈতিক দল আমাকে একটি মেসেঞ্জার-ও দিতে সক্ষম হয়নি । তৎকালীন একজন ছাত্রনেতাকেও সতর্ক করে দিয়েছিলাম এবং মিলিটারী অ্যাকশন হলে কীভাবে রেসিস্ট করতে হবে তাও লিখিতভাবে তাদের দিয়েছিলাম । কেউই আমার কথা শোনেনি । ইপিআর পিলখানায় (হেডকোয়ার্টার উইং) দুজন বাঙালি জুনিয়র ক্যাপ্টেনকে বহুবার সতর্ক করে দিয়েছি ও কী করা উচিৎ যে সম্পর্কেও উপদেশ দিয়েছি । হয়ত সুযোগের অভাবেই তারা নিষ্কৃত রইলেন । আল্লাহই অধিক জ্ঞাত। ইপিআর ট্রুপস, যারা আজ এখানে কাল ওখানে ক্যাম্প করে থাকতো (২৫শে মার্চের আগে) তাদের বলেছি, বেশিরভাগই আমার দুএকটা কথা শুনে এদিক সেদিক তাকিয়ে সরে পড়ত । ভাবখানা যেন, আই হিয়ার নো ইভিল-এরাও কিছু করেনি তবে নিজেরা প্রাণে বেঁচেছে হয়ত । ঢাকা থেকে ব্রাক্ষণবাড়িয়া নিজে গিয়েছি । সেখানে আমার প্রিয় জুনিয়র অফিসার শাফায়াত জামিল আমাকে আশ্বাস দিল কুমিল্লার কমাণ্ডো গ্রুপকে অনায়াসেই কাবু করা যাবে! আমি বেশিরভাগ জেসিও লেভেল-এ চেষ্টা করেছি সতর্ক হয়ে সিপাইদের সাথে সংগ্রামী ভূমিকা পালন করার জন্য, তাছাড়া জেসিওরা সৈন্যদের সঙ্গেই থাকে । এদের মনোভাব আগেই উল্লেখ করেছি । সহযোগীদের সাথে তত যোগাযোগ করিনি । প্রমোশন, নেকদৃষ্টি নিরাপত্তাই এদের প্রধান কাম্য ছিল….। পাকিস্তানিরা যত খারাপই হোক যে কোন মূল্যে বন্ধুত্বের মর্যাদা রাখতে জানত ও সামান্য লোভে আপনজকে বিট্রে করত না । মেজর মালেকের পরামর্শে এক বাঙালি লে. কর্নেলের ঢাকার বাসায় গিয়ে সংগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য তাকে অনুরোধ করায় তিনি সন্ত্রস্তভাবে বলে উঠলেন, “স্যার আমি নতুন কর্নেল (লে. কর্নেল) হইছি, আমার চাকরিটা নষ্ট করার জন্য বুঝি লোকে আমার সম্বন্ধে বলতেছে যে আমি রিভোল্ট করব । মনে পড়ল এই অফিসারের প্রমোশনের জন্য তার অনুরোধে আমি মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে (স্টাফ কলেজে -এ আমার ইনস্ট্রাক্টর ছিলেন) ধরেছিলাম। কার্জন হলের দক্ষিণ দিকে যে হলগুলো ছিল তারই কোনো একটাতেই (নাম মনে নেই) ছাত্রনেতা আবদুল কিদ্দুস মাখন থাকতেন । তাকে এ সম্বন্ধে একটা চিঠি লিখে আমার ব্যাটম্যানকে দিয়ে পাঠিয়েছিলাম (বোধ করি মার্চ মাসে)। ২৫শে মার্চের পর ব্রাক্ষণবাড়িয়া এসডিও-র বাড়িতে দেখা হতেই তাকে বললাম, তোমরাতো কোনো ব্যবস্থাই নাওনি । তুমি কি আমার চিঠি পাওনি? বেশ ত্রুদ্ধস্বরে উত্তরে বলল, না, আমি কোনো চিঠি ফিঠি পাইনি । অন্যদের কাছে পরে শুনেছি তুমি বলে সম্বোধন করাতে নাকি অত্যন্ত আপমানিত বোধ করেছেন , অথচ তার বাবা আবদুল আলীর সাথে আমি ছোটবেলায় ফুটবল খেলেছি । যাক, দেশ স্বাধীন হবার প্রায় ছয় মাস পর আমার বাড়িতে সাচ্চু মিয়া, কুদ্দুস মাখন এলেন । আমাকে দেখিয়ে সাচ্চু মিয়াকে ইনি বললেন, চিঠি লিখে ইনিইতো আমাকে আগে থেকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন । ইনার জন্যইতো…!! স্বাধীনতার পর মাখন কুদ্দুসের সাহায্যেই আমার ছোট ভাই চাকরি পায় । যেদিন সাহেবজাদা ইয়াকুব লে. জেনারেল টিক্কা খানকে চার্জ দিয়ে চলে যান, আমি শেখ মুজিবের বাসায় যাই । প্রথমেই তাজউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে দেখা হওয়ায় তাকে অশুভ সংবাদ দেওয়াতে তিনি অভদ্রভাবে বলে উঠলেন, আমার কথা কখনো সত্য হতে পারেনা__ আমি কোনো খবরই রাখিনা- সাহেবজাদা ইয়াকুবই ইস্টার্ন কমাণ্ডের অধিনায়ক হিসাবে আছেন । আমি বললাম শেখ মুজিবের বাড়ি হতে তিন চার মাইল দূরের শত্রু শিবিরের প্রধান কার্যাবলীর সঠিক সংবাদ রাখতে যারা অক্ষম তারা যেন দেশকে অস্ত্রের সংগ্রামের হঠকারিতায় না ফেলেন । তাজউদ্দিন সাহেব কথাটা ভুলে যাননি ও পরবর্তীকালে প্রভিশনাল গভর্ণমেন্ট এর প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম যখন কলকাতায় তাদের কেবিনেট মিটিং-এ আমাকে তার  মিলিটারি সেক্রেটারী করার সিদ্ধান্ত নিয়ে দস্তখত করেন, তাজউদ্দিন সাহেব প্রেসিডেন্ট-কে উপেক্ষা করে আমার এই পদ কার্য্যকরী হতে দেননি । সৈয়দ সাহেবকে বলায় তিনি বললেন, আপনি তাজউদ্দিন সাহেবকে ধরুন । আমি এই হাস্যকর প্রস্তাবে রাজী হতে পারিনি । পাকিস্তানিরা যখন জাহাজে করে অস্ত্র আনছিল তখন আমি রিয়ার এডমিরাল এম, এইচ, খানের ছোট ভাই খসরুকে (চাটগাঁয়ে ওদের কয়েকটা জাহাজ ছিল) বলেছিলাম যেন দেশের জন্য ওদের কিছু জাহাজ স্যাক্রিফাইস করে । দেশ বাঁচলে পরে পুষিয়ে দেয়া যাবে । পোর্টের কাছে জাহাজ ডুবিয়ে দিলে পাকিস্তানিদের অস্ত্র বোঝাই জাহাজ পোর্টে ভিড়তে পারত না (হয়তো অস্ত্র খালাস রোধ করা সম্ভব ছিল না তবে দেরি করিয়ে দেওয়া যেত) । খসরু এটা শেখ মুজিবকে বলে মুজিবের অনুমতি চাইলেন । কর্নেল ওসমানী সেখানে ছিলেন অ্যান্ড হি ভায়োলেন্টলি অপোজড ইট (খসরুল মুখে শুনেছি) । এটা খুবই বিশ্বাস্য কারণ কুমিল্লার কসবা অঞ্চলে কোনো এক আওয়ামী লীগারের বাড়িতে আত্মগোপনকারী (গোঁফ কামানো অবস্থায়) কর্নেল ওসমানীকে যখন সিগন্যালের কর্নেল বাহার খোলাখুলিভাবে মুক্তিযুদ্ধে শামিল হওয়ার জন্য বলেন আমাদের সাথে আছেন । ওসমানী সাহেব আকুলস্বরে বলেছিলেন, বাহার প্লিজ সি দ্যাট রেজা ডাজ নট টেক এ লিড ওভার মি।

 ২৫শে মার্চের বেশ কয়েকদিন আগে রাজারবাগে বাঙালি পুলিশের রাইফেল ইত্যাদি নিয়ে ডিউটি ছেড়ে গোশাঘরে ছিল । তখন ইস্টার্ণ কমান্ড জিএইচকিউ এর নিকট অ্যাডভাইস চাইল কীভাবে টযাকল করা উচিত । জিএইচকিউ থেকে যে নিওর্দেশ এসেছিল তাতে এই ধরণের বলা হয়েছিল, স্ম্যাশ দেম টু পিসেস উইথ অল এভেইলেবল ফোর্স। এটা জেনে আমার বন্ধু একেএম সিদ্দিকীকে (ভাসানী ন্যাপ করতেন, ডিসেম্বর আল বদরদের হাতে শহীদ হন) বললাম যেন ভাসানীর সঙ্গে আমার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেন (শেখ মুজিবের সাথে আলাপের পর আওয়ামী লীগের উপর আর আস্তা রাখতে পারছিলাম না) ভাসানী সাহেব তখন তার কোন এক ব্যবসায়ী সাগরেদ, জলিলের ওয়ারীস্থ বাসায় অবস্থান করছিলেন । সিদ্দীকী ভাসানীকে আমার কথা বললেন….পুলিশদের যেন অস্ত্রসহ ছোট ছোট দলে বের হয়ে যাবার জন্য বলা হয় নাহলে পাকিস্তান আর্মি চারদিকে মেশিনগান ইত্যাদি বসিয়ে বের হবার সব পথ বন্ধ করে প্রচণ্ড আক্রমণ করবে, কেউই বাঁচতে পারবে না । ভাসানী সব শুনে সিদ্দীককে (হেনা) বললেন, ওকে এখানে এনোনা, চারদিকে সিয়াইডির-র লোকে ভরা । পাকিস্তান আর্মি একটা গণহত্যাযজ্ঞ শুরু করবে, এটা ভাবিনি । তবে কিছু মিলিটারি অ্যাকশন নিতে পারে তার আশঙ্কা হয়েছিল বাঙালি পুলিশদের ব্যাপারে জিএইচকিউ থেকে যে নির্দেশ এসেছিল তা শুনে । তাছাড়া সেই সময় আমার পাকিস্তান (অবাঙালি) উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক দুই একজন বন্ধু-বান্ধবেরা কথা প্রসঙ্গে বলতো__তোমরা যদি মনে করো যে লড়াই করতে পারবে তবে কর, না হলে শুধু শুধু খোঁচাখুচি করোনা, এক পাঠান অফিসারের বক্তব্য ছিল, ফ্রন্টিয়ারে সারাজীবন বন্দুক নিয়ে আমরা চলি তবুও পাকিস্তান আর্মির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে সাহস পাইনি । তোমরা যদি মনে কর যে জিততে পারবে তাহলেই লড়াই কর….। আর সে সময় বেসামরিক পোশাকে সৈন্য এবং যে সব উচ্চপদস্থ বিশেষজ্ঞ অফিসারদের (যেমন কমান্ডো এক্সপার্ট মেজর জেনারেল আবুবকর ওসমান মিঠঠা, ব্রিগ্রডিয়ার আরবার প্রমুখ) পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হচ্ছিল যাদের বেশিরভাগই আগে এখানে চাকরি করেছিল এবং পূর্ব পাকিস্তান সম্বন্ধে পরিচিত ছিল।

ক্রাক ডাউন আসন্ন মনে করে ও কোনোরকম জাতীয় অবরোধের লক্ষণ না দেখে আমি ২২ বা ২৩শে মার্চের সন্ধ্যায় মুসলিম লীগের সুপণ্ডিত শাহ আজিজুর রহমান (জিয়ার প্রধানমন্ত্রী, তার সাথে আমার কৃষ্ণনগরেই পরিচয় ছিল) ও ডি আই জি কিবরিয়া সাহেবকে ফোন করে অনুরোধ করলাম যেন অন্তত সমস্ত আনসারকে ট্রেনিং-এর নামে রাইফেলসহ প্রত্যেক শহরের আশে পাশে মোতায়েন করা হয় যাতে পাকিস্তানিরা বুঝতে পারে যে সারপ্রাইজ আক্রমণ করা যাবে না । ২৫শে মার্চের ২/৩ দিন আগে থেকেই রাতে নিজের বাসায় থাকতাম না । ওয়ারীতে আমার বন্ধু এডভোকেট সিদ্দীকের বাড়িতে থাকতাম । ২৭শে মার্চ কারফিউ কিছুক্ষণের জন্য লিফট করাতে আমি গাড়ি করে গুলশানে আমার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই । এয়ারপোর্টের (তেজগাঁ) দেয়ালের উপর কয়েকজন পাক সৈন্য দাঁড়িয়ে ছিল । তারা হাত নেড়ে আমাকে অভিনন্দন জানায় । হয়তো ভেবেছিল (আমাকে দেখে)যে কোন লয়্যাল পাকিস্তানি/অবাঙালি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ক্যান্টনমেন্টের দিকে যাচ্ছে । গুলশান পার্কের ভিতর একটা ইপিআর ক্যাম্প ছিল । সেখানে খালি হাতে সৈনিকদের এদিক সেদিক ঘোরাফিরা করতে দেখলাম । গাড়ি থেকে নেমে ইপিআরের একজন সুবেদারকে বললাম, আপনারা খালি হাতে কেন ঘোরাঘুরি করছেন? যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে সব উইপন নিয়ে নদী পার হয়ে জয়দেবপুরের দিকে চলে যান, আমাদের সৈন্যরা আছে সেখানে পথে তাদের সাথে যোগ দিন । আমি সিভিল ড্রেসে-এ ছিলাম । আমাকে চিনতে পারেনি । সে বেশ একটা ডাটের সাথে উত্তর দিল, উই হ্যাভ বিন ডিজ আর্মড। আমি অবাক হয়ে গেলাম এদের কাণ্ডজ্ঞান দেখে । বাঙালি সৈন্যদের সাথে যোগ দেওয়া ওদের পক্ষে খুবই সহজ ছিল কারণ তাদের ওপর কোনো গার্ড ছিল না ।

একটু সামনে ডিআইটি মার্কেটে গেলে পরিচিত দোকানদারদের প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম__ স্যার আপনি ওদের (ই আর পি) সাথে কোন সাহসে কথা বললেন? ওরা যে আপনাকে পাকিস্তানিদের কাছে ধরিয়ে দেয়নি আপনার ভাগ্য! পুরো ব্যাপারটা প্রতক্ষ্যদর্শী দোকানদারেরা খুলে বলল । ২৬শে মার্চ সকালে ২/৩ গাড়ি পাকিস্তানি সৈন্য এখানে আসে । তাবুর ভিতর অনেকক্ষণ দুপক্ষের কথাবার্তার পর পাকিস্তানিরা এসে তাবুর এককোনায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে কয়েক রাউণ্ড গুলি ছোড়ে (কাউকে আঘাত করার উদ্দ্যেশ্যে না) সঙ্গে সঙ্গে সব ইপিআর হাত তুলে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে সারেণ্ডার করে । পাকিস্তানিরা সমস্ত অস্ত্রগুলো তাদের গাড়িতে করে নিয়ে যায় । অর্থাৎ সকালে ঠিকঠাক করেই বিকেলে নাটকের অবতারণা করা হয় যাতে পরবর্তীতে কেউ দোষ দিতে না পারে । পরে শুনেছিলাম ২/১ দিন পর এই ইপিআরদের তুলে নিয়ে মীরপুর/টঙ্গীর ওদিকে কোনো এক ব্রীজের কাছে গুলি করে নাকি হত্যা করা হয় । সেই রাতেই পরিবারসহ লেক পার হয়ে গুলশান ডিআইটি মার্কেটের সরকার স্টোর্স এর মালিকের বাড়িতে উঠি । তার ছেলেকে গাইড হিসেবে নিয়ে সেই রাতে জয়দেবপুরের দিকে রওয়ানা দেই । গুলশান লেক পার হয়ে রাস্তায় পৌছে সরকার সাহেব প্রমুখ কয়েকজন আওয়ামী লীগের লোক খুশি হয় আমাকে বলল তারা নাকি কিছুক্ষণ আগেই ড. কামাল হোসেনকে পথ দেখিয়ে নিরাপদ জায়গায় পৌছে দিয়েছেন । পরে ২৫শে মার্চের সন্ধ্যায় ড. কামাল হোসেনের গতিবিধি সম্বন্ধে কিছু কথা শুনেছিলাম । যাক, জয়দেবপুর ভৈরব বাজার এবং সেখানে হতে ট্রেনের ট্রলী যোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌছি । মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর শফিউল্লাহ তখন তেলিয়াপাড়াতে (ভারতীয় বর্ডারের ৫০ গজের মধ্যে) থাকত। যতদূর মনে পড়ে শাফায়েত জামিল স্টেশনে এসে দেখা করে। খালেদ যদিও সেই সময় ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া এস ডি ও এর বাসায় বসে ছিলেন, স্টেশনে আসেননি ও তাকে আমি বললাম যে আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই থাকব কারণ সিংহভাগ বাঙালি সৈন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলে আছে (এটা এক আশ্চর্যের কথা! প্রায় সব সৈন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলে থাকত কিন্তু অফিসারেরা সৈনিকদের সঙ্গে থাকতেন না, তেলিয়াপাড়ায় চলে যেতেন) তিনিও দেখলাম আমার  তেলিয়াপাড়া যাওয়া পছন্দ করছেন না। কারণটা পরে বুঝলাম যখন তিনি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও ইন্ডিয়ান আর্মি অফিসারদের সাথে দহরম মহরম করার ব্যাপারটা আমার নিকট অস্বীকার করেন।

পরে তেলিয়াপাড়ায় এক কনফারেন্সে(৪ঠা এপ্রিল) রিটায়ার্ড কর্নেল ওসমানী, এমএনএ আমার প্রস্তাবিত প্ল্যানকে (সিলেট চিটাগাং বেল্ট এর পাকিস্তান আর্মির পকেটগুলো এলিমিনেট করা – ফর কন্টিনিয়াস ফ্রি জোন অ্যান্ড ফার্ম বেজ ফর ফারদার অপারেশনস অ্যান্ড দ্য শো দ্য ওয়ার্ল্ড দ্যাট উই আর ইন এফেক্টিভ স্টেট অফ ফরমিং এ গভর্ণমেন্ট। এটা বোধ করি আমাদের সাধ্যের বাইরে ছিলনা। অশিষ্ট ভাষায় নাকচ করে সর্ব   মেজর শফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফ, নূরুল ইসলাম প্রমুখকে নেপোলনীয় হুকুম দেন দূর্গবৎ সুরক্ষিত কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করার জন্য । বলাবাহুল্য আমার অনুজপ্রতীম দূরদর্শী রেজিমেন্টাল কমরেডরা অ্যাকটিভ সার্ভিস-এ তাদের সিনিয়রকে সমর্থন না করে আওয়ামী লীগের এমএনএ প্রাক্তণ কর্নেল ওসমানীর দিকে থাকাই নিরাপদ মনে করেন । বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপস্থিত সমস্ত অফিসারদের কোনো সাপোর্ট না পেয়ে আমি বিরক্তির সাথে এই কনফারেন্স ত্যাগ করি, কর্নেল ওসমানী ও তার দলের লোকদের প্ররোচনায় ভারতীয় অফিসাররাও আমাকে সন্দেহের চোখে দেখত । এই কনফারেন্সে তিনি আমাকে র‍্যাঙ্ক উপেক্ষা করে আমাকে মিস্টার সম্বোধন করেন । দৃষ্টান্তস্বরূপ তেলিয়াপাড়ায় এদেরই একজন সিভিল ড্রেসে স্যুইসাইডাল ভঙ্গিতে (আরো অনেকের মতো এই বীর যোদ্ধা পরিবার পাকিস্তানিদের হাতে রেখে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করতে এসেছেন!) সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আমাকে বললেন স্যার, “এই যে পাকিস্তানিরা রেডিওতে বলছে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসার কথা এবং কোনো শাস্তি দেওয়া হবে না, আপনি কী বলেন? ফিরে যাওয়াটা কি ঠিক হবে?” তাকে বললাম, “আমি ফিরে যাবার জন্য আসিনি । তোমাকেও উপদেশ দিচ্ছি ফিরে না যেতে । গেলে হয়তো পাকিস্তানিরা তোমার মুণ্ডই রাখবে না । কথাপ্রসঙ্গে আবার স্বীকার করিনা, কেউ আমাকে যুদ্ধ করার জন্য হুকুম দিতে পারে না । এই অফিসার মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস কলকাতায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেই কাতিয়েছিলেন । বস্তুত বেঙ্গল রেজিমেন্টের আমার এই কমরেডরা সমস্ত বিষয়ই আমার নিকট হতে গোপন রাখত, বোধ হয় কারো পরামর্শে । আশুগঞ্জে আমাদের হেভি কনসেনট্রেশন অফ ট্রুপস অ্যান্ড উইপনস থাকা সত্ত্বেও কোনো প্রকার রেসিস্ট্যান্স না দিয়ে (একটা গুলিও না ছুড়ে) পালিয়ে সরাসরি ইণ্ডিয়ান বর্ডারে পশ্চাদপসরণ কেন করা হল… অফিসারস লিনিং দ্য রাউট –ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কর্নেল রবের উপস্থিতিতে শফিউল্লাহকে এটা জিজ্ঞাসা করায় তিনি আমাকে বললেন যে তাদের ইন্ডিইয়ান আর্মির মুরুব্বীদের নির্দেশেই এই কাপুরুষোচিত কাজ করা হয়েছে । ইণ্ডিয়ানরা নাকি হুকুম দিয়েছে যে লড়াই-বিগ্রহ ভারতীয় ভূমি হতেই করা হবে । এটা সত্য নয় যে আশুগঞ্জ থেকে বিনাযুদ্ধে প্রস্থান করার সময় কোনো অফিসার আহত হয়েছিলেন । কোনো কোনো বইতে আরও অনেক অসত্য কথার সাথে উল্লেখ করা হয়েছে যে দুইজন অফিসার আহত হয়েছিলেন । আমি মাত্র তিনজন  ওয়াকিং উন্ডেড-একজন নায়েব সুবেদার ও দুইজন আদার র‍্যাঙ্কস-কে অতি সামান্য যখন অবস্থায় দেখি । কয়েকঘন্টা পর মাধবপুরে আমাদের লোকদের একত্র করি ও ইণ্ডিয়ান ব্রিগেডিয়ার ভিসি পাণ্ডেকে জিজ্ঞাসা করি এই রকম অসামরিক পলায়ন কি তারই হুকুমে হয়েছে? তিনি বললেন যে অবশ্যই একটা নিয়মিত ফাইটিং উইথড্রল  -এর কথাই বলেছিলেন এবং সমস্ত ভারি অস্ত্র- medium and heavy machine gun, antitank recoilless weapons, mortar ইত্যাদি ফেলে উর্দ্ধাশ্বাসে পালানোর পরামর্শ দেন নাই । ঠাট্টা করে আরও বললেন, you see colonel, these are young officers and they want to live.  আমি যখন প্রস্তাব করি যে সেই রাতেই আমি নিজে lead করে আশুগঞ্জ এলাকা কাউন্টার এটাক করব (ফেলে আসা ভারতীয় অস্ত্র উদ্ধারের জন্য) শফিউল্লাহ বললেন, স্যার আপনার বয়স হয়েছে । আমরাইতো আছি । আমিই যাব । ব্রিগেডিয়ার পাণ্ডের সঙ্গে কথা বলছিলাম, একটু পরেই শফিউল্লাহ এসে বললেন যে মাত্র একজন জোয়ান এই নৈশ আক্রমণে অগ্রসর হবার জন্য ভলান্টিয়ার করেছে। এই অদ্ভুত কথা শুনে ইন্ডিয়ান ব্রিগেডিয়ারের সামনে মাথা হেট করে রইলাম ও রাগে আমার রেজিমেন্টাল ব্যাজ অফ র‍্যাংক খুলে ফেললাম । একটু পরেই পাণ্ডে সাহেব তার  ইন্ডিয়ান ডেমোলিশন টিম নিয়ে সরাইল ও মাধব পুরের কাছে পুল উড়িয়ে দিয়ে চলে গেলেন অথচ এই ব্রিজ উড়ানোর কথাটা আমার নিকট চেপে রেখেছিলেন।

আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসার পর রিটায়ার্ড কর্নেল রব আগরতলা হতে আমাকে বলে পাঠালেন, মুক্তিযুদ্ধ চলছে, টাকা পয়সার দরকার”। আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ব্যাঙ্ক হতে দেড় কোটি টাকার উপর উঠিয়ে তৎকালীন ক্যাপ্টেন আইনুদ্দিনের উপর ভার দিয়ে টাকাগুলো আগরতলা পাঠাবার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কলকাতায় বাংলাদেশ হাই হয়েছে । দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কলকাতায় বাংলাদেশ হাই কমিশনার হোসেন আলী সাহেবের কাছে রিপোর্ট দিয়েছিলাম । কিন্তু ‘ভাগ’ অনেক উপরে পৌছায় বা অন্য কোনো কারণে কোনো পদক্ষেপেই গ্রহণ করা হয়নি । আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে আসার মাহাবুব, জাহাঙ্গীর (আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্রনেতা) এরা প্রচার করে আমি লেফটিস্ট। ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া পৌঁছে কিছু ছেলেকে অ্যাক্টিভ দেখতে পাই। এরা আমার কাছে অস্ত্র শস্ত্র চায়। আমি এস ডি পি ও (সাব ডিভিশনাল পুলিশ অফিসার) সম্পাদককে বললাম যদি এদের চরিত্র সম্পর্কে অভিযোগ না থাকে তাহলে যেন ট্রেনিং এর জন্য রাইফেল ইস্যু করা হয়।  । তখন জানতাম না ছেলেগুলো ন্যাপ সমর্থক ছিল । আর জানলেও আমার সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হত না । কে কোন পার্টির তা আমার কাছে বড় ছিল না, কে স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক তাই বড় ছিল । ব্রাহ্মণবারিয়ার তাউন হলে যে মিটিং ডেকেছিলাম-বোধ করি এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে, তাতে মাহবুব আমাকে সরাসরি বলল, এই ছেলেদের যে আপনি অস্ত্র দিয়েছেন সেগুলি আমাদের বুকের উপর তাক করা হবে, কেননা এরা বামপন্থী ও আওয়ামী লীগের নয় । আমি বললাম, তোমরা চাইলে নিশ্চয়ই তোমাদেরকেও অস্ত্র দেওয়া হবে কারণ দেশের জন্য লড়ার অধিকার প্রত্যেকেরই দল নির্বিশেষে আছে । কিন্তু তোমরাতো রিভলবার ছাড়া চাওনা । পরে দিল্লিতে মিসেস গান্ধীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি  ) শ্রী হাকসারও আমাকে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগত চায় ভারতীয় সরকারই যুদ্ধ বিগ্রহ করে তোমার দেশ স্বাধীন করে ওদের হাতে উঠিয়ে দিতে । ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটা ঘটনা যা সারাজীবন আমার মর্মপীড়ার কারণ হয়ে থাকবে, না উল্লেখ করে পারছি না । ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে খালেদ-শফিউল্লাহর মুখে শুনলাম যে নিরাপত্তার জন্য ভৈরববাজার আশুগঞ্জ এসব অঞ্চলের বিহারি (অবাঙালি) ব্যবসায়ীদের পরিবারসহ রেলওয়ে গোডাইন এনে আটকে রাখা হয়েছে । তাদের টাকা পয়সাও আটকিয়ে রাখা হয়েছে । পাকিস্তান আর্মি যেদিন আশুগঞ্জ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলে (মাত্র ২টা প্লেন দিয়ে) স্ট্র্যাফিং ও রকেটিং করছিল তখন খালেদ-শফিউল্লাহ এবং স্থানীয় নেতারা আমার কাছে পরামর্শ চাইল কী করা যায়? বললাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলের ছোটখাট হাজতীদের ছেড়ে দিয়ে বিহারীদের আপাততঃ সেখানে রেখে পরে সেখান থেকে ইণ্ডিয়াতে পাঠিয়ে দেওয়া হোক । যেদিন আমাদের সব লোকজন আশুগঞ্জ-ব্রাহ্মণবাড়িয়া হতে কোনোরকম যুদ্ধ না করেই পালিয়ে যায় এটা সেদিনের ঘটনা । ওরা পালিয়ে যাবার ঘন্টা দুই পরে জীপে যাবার সময় দেখলাম ২টা ছেলে (সম্ভবত ন্যাপের ছাত্র সংগঠনের সদস্য) তলতে টলতে এগিয়ে আসছে তাদের চোখ রক্তলাল । আমাকে দেখে বলল, আপনার আদেশ মান্য করেছি”। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কি আদেশ?বলল, আপনি যে হুকুম দিয়েছেন বিহারীদের শেষ করে দিবার জন্য…..। লাশ সরিয়ে রক্ত ধুয়ে মুছে ফেলনি? ওরা না সূচক উত্তর দিল । স্পষ্ট বোঝা গেল ছেলে দুটো চরম ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করেছিল । এ সব শিক্ষিত ছেলেকে মিথ্যা করে আমার নাম না বললে তারা এ ধরনের পৈশাচিক কাজ কখনও করতনা । ওদের আর কিছু না বলে অন্য দিকে চলে গেলাম । শহরে আমার বন্ধুবান্ধবেরা বলল যে, আমরা শুনে প্রথমেই বুঝেছিলাম তুমি এধরনের কোনো অর্ডার দিতে পারনা, এটা তোমার অর্ডার না । কিন্তু ওরাতো (নেতা) তোমার নাম ভাঙিয়ে এই ধরনের জঘন্য কাজ করিয়ে নিল । সেদিন শিশু, মহিলা বৃদ্ধসহ প্রায় দেড়শ নিরপরাধ অবাঙালিকে সেখানে হত্যা করা হয়েছিল । যাক যা হবার হয়ে গেছে । পাঞ্জাবীরা এসে এই দৃশ্য দেখল ও তাৎক্ষণিক রাগে বেশ কিছু লোক খুন ও স্টেশনে আশেপাশে আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দিল । পরে শুনেছি ব্রিগেডিয়ার সাদুল্লাহ খান (পাঠান, যে নিজের চেষ্টায় বাংলা শিখেছিল, ৪/৫টা রবীন্দ্রসংগীতও গাইতেও পারত-মেঘের কোলে রোদ হেসেছে…..ইত্যাদি) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৌলভীদের ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, কে এর জন্য দায়ী? তোমলোগ কিউ রোখা নেহি, তোমলোগ কেয়া কিয়া-জানাজা পাড়াহায়থা?….এরা নাকি চোরের মতো উত্তর দিয়েছিল, জ্বী হুজুর হামলোতা গায়েবী জানাজা পাড়াহায়থা । দেশ স্বাধীন হবার উত্তর পরপরই পাকিস্তান সরকারের শ্বেতপত্র পড়েছিলাম । যতদূর মনে পড়ে অন্যান্য জায়গার অবাঙালি হত্যার কাল্পনিক অভিযোগ থাকলেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এই সত্য ঘটনার উল্লেখ সেখানে ছিল না । এপ্রিলের শেষ দিকে আগরতলা শহরে থাকাকালীন শফিউল্লাহ এবং আরও কয়েকজন অফিসারের সঙ্গে রাস্তায় দেখা । শফিউল্লাহ জিজ্ঞাসা করল, স্যার কেমন আছেন? বললাম, দেখতেই তোমরা জীপে করে ঘুরে বেড়াচ্ছ আর আমি পায়ে হেঁটে । আচ্ছা, শফিউল্লাহ বলতো তোমরা আমার রেজিমান্টাল কমরেড হওয়া সত্ত্বেও আর্মি হতে অনেক আগে রিটায়ার্ড করা কর্নেল ওসমানীর মতো একজন আওয়ামী লীগের এমএনএর সঙ্গে মিলে আমার বিরুদ্ধচরণ কেন করছ? আমিইতো তোমাদের মধ্যে সিনিয়রমোস্ট আর্মি অফিসার । তোমরা কি জেনারেল-টেনারেল হবে ভাবছ নাকি? শফিউল্লাহ উত্তরে বলল, “তাতো হবোই স্যার । শফিউল্লাহ এই দূরদর্শী উক্ত তখন আমার কাছে বাতুলতা মনে হলেও অদৃষ্টের পরিহাসে দেড় বছরের মধ্যে তা সত্যিই ঘটেছিল । আগরতলা জিয়াকে পাগলের মতো ঘুরে বেড়াতে দেখলাম । অবশ্য সেই বিশৃঙ্খলা অবস্থায় কারো উপর কারো নিয়ন্ত্রণ ছিল না । কতগুলো অভিযোগের ফলে জিয়াকে তুরাতে posting   এ পাঠানো হয়।

 ওসমানী কলকাতা গিয়ে আমার সম্বন্ধে প্রচার শুরু করলেন- হি ইজ এ পাকিস্তানি স্পাই। হিজ ওয়াইফ ইজ উর্দু স্পিকিং। হি ইজ প্লান্টেড অ্যাজ অ্যান ইন্টেলিজেন্ট এজেন্ট। ইন্ডিয়ান গভমেন্ট ভেরিফাই করে তা নাকচ করে দেয়। এটা এপ্রিলের ঘটনা। ভারত সরকারের কোন কোনো সংস্থার কর্মকতৎপরতা ও দক্ষতার নমুনা অবাক হই । এমনকি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ইউনিয়ন পর্যায়ের যে কোনো অতি সাধারণ নেতা সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্যাদিও তাদের জানা ছিল । আগরতলা হতে কলকাতা এসে আমি পার্টির(মুজাফফর ন্যাপ ও কমুনিস্ট পার্টি কম্বাইণ্ড) মিলিটারী এডভাইজার হিসেবে পার্টির সামরিক দিক সংগঠিত করি । আগেই বলেছি জুন/জুলাই মাসে সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে এক ক্যাবিনেট মিটিং-এ আমাকে প্রেসিডেন্টের মিলিটারী সেক্রেটারী পোস্ট-এ নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় কিন্তু তাজউদ্দিন সাহেব তা ব্লক করে দেন । ইন্দিরা সরকার সমর্থক সিপিআই এর প্রচেষ্টায় জনাব মনি সিং ও প্রফেসর মুজাফফরকে (সি পি বি এবং এন এ পি নেতা) জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটিতে আওয়ামী লীগের সাথে নেওয়া হয় ও মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে এই সুগ্মপাটি প্রায় কুড়ি হাজার সুশিক্ষিত যোদ্ধা ময়দানে পাঠায় যার মধ্যে আমার পনের বছরের ছেলেও ছিল । বাংলাদেশ সরকার পরিচালিত ক্যাম্পে আওয়ামী লীগের বাইরের ছেলেদের প্রতি চরম বৈষম্য ও মারাত্মক দুর্ব্যবহারের অভিযোগ শুনেছিলাম তবে সত্যাসত্য যাচাই করতে পারিনি । সল্ট লেক সিটির শরনার্থী শিবিরগুলোতে গিয়েছিলাম । সেখানকার অমুসমান শরনার্থীরা নিজেদের শুধু হিন্ধু বলেই পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করত ন্ব ভারতীয়দের সহানুভুতি আকর্ষণ করার জন্য মুসলমানদের দ্বারা কাল্পনিক জুলুমের ঘটনা শোনাত । এক ক্যাম্পের মুসমান মেয়েদের উপর পাইকারী পাশবিক অত্যাচারের দৃষ্টান্তও ছিল। সিপিএমএল এবং সিপিএম এই মুক্তিযুদ্ধকে সত্যিকারের পিপলস ওয়্যার মনে করতনা যদিও কাজী জাফর সাহেব সিপিএম অফিসেই বেশিরভাগ সময় থাকতেন। বেশ সংখ্যক পশ্চিম বঙ্গবাসীর আন্তরিকতা, শুভেচ্ছা ও সাহায্য অত্যন্ত প্রশংসনীয় ছিল । ৯ই আগস্ট ভারত-রাশিয়ার চুক্তি সম্পাদনের পূর্ব পর্যন্ত ভারতীয় সরকার আমাদের বিশেষ কোনো সাহায্য করেনি । তারপর আমাদের কিছু কিছু অস্ত্র দিতে লাগল।

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস আমার আর্থিক সহায়তা পার্টিই দিয়েছিল তাই কিছু উল্লেখ করলাম না । বাংলাদেশ সরকার এক পয়সাও দেয়নি । প্রফেসর মুজাফফরের মারফত ভারতীয় সরকার আমাকে সেম র‍্যাংক এ (লে. কর্নেল) চাকরিতে যোগ করার প্রস্তাব দেয় ও আমার পার্টিও সেটা মেনে নেয় কিন্তু আমি তা প্রত্যাখ্যান করি । মে,জুন,জুলাই আগস্টে মূলত কলকাতায় এবং কিছু সময় বর্ডারের দিকে ছিলাম । ডিসেম্বরে ইণ্ডিয়া-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হবার পর বাংলাদেশ সরকার যে যেখানে আছে-সব আর্মি পার্সোনেল কে রিপোর্ট করতে বললে আমি কলকাতায় বাংলাদেশ আর্মি হেডকোয়ার্টারে রিপোর্ট করি । ডিসেম্বরের ২০/২১ তারিখে প্রফেসর মিজাফফর আহমেদসহ আগরতলা থেকে কুমিল্লা হয়ে জীপে করে ঢাকায় আসি । দেখলাম ভারতীয়রা কোনো ক্যান্টমেন্টেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না । তাদের যুক্তি ছিল এরা ঢুকলে উত্তেজনার সৃষ্টি হবে, প্রিসিওনারস অফ ওয়ার-দের সঙ্গে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে । আমার ধারণা লুটপাটের সুবিধার জন্যই এটা করা হয়েছিল । ওসমানী সাহেব ঢাকায় এসে মিন্টু রোডে তার হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে প্রচণ্ড কড়া ব্যক্তিগত নিরাপত্তা (বিভিন্ন মহলে যা বিস্ময় ও প্রচুর হাসির খোরাক জুগিয়াছিল!) সহ সেখানেই বসে রইলেন । ক্যান্টনমেন্টে ঢোকার সাহস, ঝুঁকি কেউ নিলনা । জানুয়ারী মাসে আমি প্রথমে গিয়ে স্টেশন হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেন আমার যতটুকু মনে পড়ে । ১৯৭২ সালে আমার ৮ বছরের জুনিয়র শফিউল্লাহকে আর্মি শেইফ অফ স্টাফ পদে নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং স্বভাবতই আমি পদত্যাগ করি । কারণ আর্মি সার্ভিস আমি কোনোদিনই বেতনভোগী পেশা হিসাবে গণ্য করি নাই, সেলফ-রেসপেক্ট ও হনউর বিহীন উর্দিধারী নিজেকে আন অফিসার অ্যান্ড আ জেন্টলম্যান বলতে পারে না বলেই আমার বিশ্বাস । আমি ১৯৫২ সালে ক্যাপ্টেন, ১৯৫৭ সালে মেজর, ১৯৬৫-তে লে. কর্নেল এবং ১৯৭২ সালে কর্নেক পদে উন্নীত হই এবং একই বছর এপ্রিল/মে মাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী হতে পদত্যাগ করি । বর্তমানে অবসর জীবন যাপন করছি । (কর্নেল সালাউদ্দিন মোহাম্মদ রেজা ১৮ই মার্চ ২০০৩সালে ইন্তেকাল করেন।)