You dont have javascript enabled! Please enable it!

মেজর এম.এ.মুত্তালিব

নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা থানার কাজলাবৈরাঢী গ্রামের বাড়িতে ১৯৩৬ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর আমার জন্ম হয় । কর্নেল তাহের এবং আমি একই গ্রামের সন্তান । আমার পিতার নাম মৌলভী হাফিজউদ্দিন, পেশায় কৃষক ছিলেন । তিনি ১৯৮০ সালে ইন্তেকাল করেন । মাতার নাম হাফিজা বেগম । তিনি গৃহণী ছিলেন । ১৯৭৫ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন । আমরা মোট ৫ভাই, ২বোন । ভাই-বোনদের মধ্যে আমি সবার বড় । আমি আমাদের গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করি । তারপর নেত্রকোনা আঞ্জুমান হাইস্কুলে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করি ও একই স্কুল হতে ১৯৫১ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাশ করি ও ৫৪ টাকার মোহসীন স্কলারশিপ পাই । আমি পঞ্চম শ্রেণী হতে দশম শ্রেণী পর্যন্ত আমার ক্লাসের ফার্স্টবয় ও স্কুলের ক্যাপ্টেন ছিলাম । তারপর নেত্রকোনা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে ভর্তি হই । মুক্তিযুদ্ধের আগে সিলেটে সাধারণ ব্যবসা করতাম । আমি যে বছর নেত্রকোনা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ার-এ পড়াশুনা করি সেই বছর ইস্ট বেঙ্গল রাজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা মেজর আবদুল গণি আমাদের কলেজে এসে বাঙালি ছেলেদের আর্মিতে ভর্তি হবার আহবান জানিয়ে একটা ভাষণ দেন । আমরা অনেক ছাত্র ছিলাম । ভাষণ শেষে উনি আহবান জানালেন, তোমরা কেউ আর্মিতে যাবে? কেউ দাঁড়াল না । আমরা দুইজন মাত্র দাঁড়ালাম । আমার সাথে ছিল আবদুর রহমান । সে অবশ্য আর্মিতে ঢুকতে পারেনি, ভর্তি পরীক্ষায় বাদ পড়ে যায় । মেজর গণি আমাদেরকে আর্মিতে ভর্তি হবার জন্য যে পড়াশুনা ও …………. নিতে হয় সে সম্পর্কে বললেন । বললেন যে তার জন্য উনি আমাদের কাছে লোক পাঠিয়ে দিবেন, ট্রেনিং দেবার জন্য কীভাবে ভর্তি হওয়া যায় তার প্রস্তুতির জন্য এবং পরে লোক পাঠিয়েছিলেন । কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের মাঝামাঝি আমাকে আর্মির তরফ থেকে ইন্টারভিউর জন্য ডাকল । কাজেই পড়াশুনায় বাধা পড়ল । তারপর প্রাথমিক ট্রেনিং-এর জন্য গেলাম ঢাকার পিলখানায় । সেখানে প্রায় তিন মাস ট্রেনিং নিলাম সেখানে আমরা বাঙালি ছিলাম ০০১% অর্থাৎ অতি নগণ্য । তিন মাস ট্রেনিং এর পর ৪/৫ জন বাঙালির মধ্যে পরীক্ষায় টিকলাম মাত্র দুই জন । অন্যজন নূরুদ্দিন খান (সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান)। পিলখানার ট্রেনিং শেষে ঢাকার সোইয়ারীঘাটে এক খড়মের দোকানে (তখন সোয়াঘাটে শত শত খড়মের দোকান ছিল) পার্ট টাইম চাকরি করতাম । সোয়ারীঘাটে আমাদের দোকানের কাছাকাছি মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান সাহেব এক ভাড়া করা সাধারণ বাসায় থাকতেন তখন (তখনকার অবস্থা বর্তমান সময়ের মতো ছিলনা । তখনকার মন্ত্রীরা মোটামুটি সাধারণ বাসায় বাস করতেন)। এটা ১৯৫৪ সালের কথা । শেষ মুজিবের সঙ্গে এখানেই ১৯৫৪ সালে প্রথম দেখা হয় । তার তখন খুব নাম ডাক । তাকে আমার দেখার খুব ইচ্ছা । মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে প্রচুর লোকজন আসে যায় । একদিন বিকালে আমিও গেলাম । আতাউর রহমান, শেখ মুজিব, আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী, লোকজন সেখানে ছিল । শেখ মুজিবের তখন পূর্ণ যৌবন । লস্ফ-ঝস্ফ দিয়ে কথা বলেন । আমি তাকে বললাম, আপনিতো মন্ত্রী হইলেন দুর্নীতির, আমাদের (বাঙালির) জন্য কি রাখলেন?’ বললেন, স্বাধীনতা, আমার মুখ সব সময়ই খারাপ, মুখের উপর কথা বলি । তাকে বললাম, কিসের স্বাধীনতা? চুরি চামারীর স্বাধীনতা? বললেন, না, না… দেখ তোমরা এখন বুঝবা না, একদিন দেখবা । তুমি কী কর? বললাম, আপনাদের খড়ম সাপ্লাই দেই । (আমি আর্মিতে ভর্তি হবার প্রাথমিক ট্রেনিং নিয়েছি, ফলাফল-ফাইনাল সিলেকশন বাকি এই সমস্ত কিছুই তাকে বলিনি । সেদিনই তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়) । শেখ মুজিব বললেন, এই কাজ কর কেন, আর্মিতে যেতে পারনা? বললাম, আর্মিতে শতকরা কয়জন বাঙালি নেয় জানা আছে আপনার? কেরানী ছাড়া কাউকেই নেয়না-জানেন আপনি? মুজিব বললেন, আর্মিতে তোমারে নেয়না, এইবার পল্টনে চিৎকার করব । উঠে আসার আগে বললাম, আপনার সঙ্গে দেখা হল সেজন্য ধন্যবাদ, পরে আবার দেখা হলে সেজন্যও ধন্যবাদ । তবে উনি দাঁড়িয়ে আমার সাথে হাত মিলিয়েছিলেন । এরপর একদিন গ্রামে আমার নামে চিঠি গেল তোমাকে কোহাট যেতে হবে । আমার চৌদ্দ পুরুষে কোহাটের নাম শুনি নাই । ম্যাপেও নাই । এক অবাঙালি সার্জেন্টকে জিজ্ঞাসা করলাম, কোহাট কোন দেশে? বলল, এ দুনিয়াতেই কোথাও আছে- ‘চিন্তা মাত করো’ । কোহাটে ISSB ফাইনাল সিলেকশন বোর্ড বসেছিল । আমি বোর্ড কর্তৃক নির্বাচিত হই । আমাদের মূল ট্রেনিং হয়েছিল কাকুলে । ১৯৫৪ সালের জুলাইয়ের দিকে কাকুলে ট্রেনিং এর জন্য গেলাম । ১৯৫৭ সালের ৭ই মে ২১ বালুচ রেজিমেন্ট-এ কমিশন লাভ করি । তখন এই রেজিমেন্ট পেশোয়ারে ছিল । ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় এই রেজিমেন্ট সিলেটের লাঠিটিলায় ছিল । তখন এই রেজিমেন্টের সঙ্গে ভারতীয়দের যে সমস্ত ছোট ছোট সংঘর্ষ হয় তাতে আমি উপস্থিত ছিলাম । ১৯৬৫ সাল হতে গ্রেফতার (আগরতলা মামলায়-সম্পাদক) হবার আগ পর্যন্ত আমি ক্যাপ্টেন পদে ২১বালুচ রেজিমেন্টের এ্যাডজুটেন্ট ছিলাম । শুনেছি একাত্তর সালে এই রেজিমেন্ট পেশোয়ারেই ছিল ।

২২শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ আগরতলা মামলা তুলে নেবার পর ১৪ ডিভিশনের এ্যাডমিনিসস্ট্রেটিভ অফিসার আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এখন তুমি কোথায় যাবে? (কোথায় বদলী নিতে ইচ্ছুক) । তার কাছ থেকে একটা সাদা কাগজ চেয়ে নিয়ে প্রেসিডেন্ট আয়ুব খনকে উদ্দেশ্য করে লিখলাম (কারণ কমিশনপ্রাপ্তি বা পদত্যাগ প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষর লাগে)-

Honourable President,

I hereby resign my commission and I hope it will be accepted.

তখন মহামান্য লিখতে হত না বা না লিখলেও চলত । Honouarble লিখলেই যঠেষ্ট হত)

 তিন মাস পর আমার আবেদন গ্রহণ করা হল ।

আগরতলা মামলা সম্বন্ধে একটু বলব । এটা ২০০ ভাগ (২০০%) সত্যি ছিল । এই ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যাওয়া বাঙালি জাতির ইতিহাসের এক কলঙ্কময় অধ্যায় । উল্লেখ্য কোনো ষড়যন্ত্র মামলা ফৌজদারী ধারায় সংঘটিত হলে Penal Code -এর ১২১ ধারা আর যদি সংঘটিত না হয় তবে ১২১- A ধারা মতে হয় । এখন প্রশ্ন, যদি কর্নেল ওসমানী আমাদের আলোচনা শ্রবণ করেন (যা পাকিস্তানরাই মামলার দলিলপত্র উল্লেখ করেছে)-তাহলে এই মতে ওসমানী কোন ধারায় পড়েন এবং পাকিস্তানিরা আমাদের মত তাকে কেন গ্রেফতার করেনি? এছাড়া আমরা সবাই গ্রেফতার হবার পর পাকিস্তানিরা যখন কোনো সাক্ষী খুঁজে পাচ্ছিল না তখন যিনি (আসামী) রাজসাক্ষী হতে ইচ্ছুক ছিলেন, সংহতির নামে আগরতলা মামলা বেচে খাচ্ছেন । ঊনসত্তরের ২২শে ফেব্রুয়ারী আগরতলা মামলা তুলে নেয়া হল । তারপর ৫/৬ মাস পর্যন্ত বেকার রইলাম । ঘোরাঘুরি করতাম । তারপর আমি সিলেটে আসলাম । সিলেটে এসে ধারকার্জ করে লাকড়ি জ্বালানী কাঠ খরিদ করে বিক্রি করতাম । এরপর একটা জমি খরিদ করে ধানচাষ করাতাম । স্ত্রী, পাঁচ ছেলেমেয়ে নিয়ে কষ্ট করে চলতে হত । এ সময় কিছু কিছু মানুষ আমার (আগরতলা মামলার আসামী) সঙ্গে দেখা করতে আসত বা দেখতে আসত । কেউ করুণা, কেউ ঠাট্টা, কেউ তিরস্কার করত-তোমরা দেশটা ডুবায়ে দিলা । তখন কোনো উত্তর দিতাম না । কেউ বলত এখন আর্মিতে থাকলে কত কী করতে পারতি…। আমি সমর্থক ছিলাম স্বাধীনতার । কোনো পদলেহী দলের সদস্য বা সমর্থক ছিলাম না । আমি মোহাম্মদের (সা.) মতো একজন কমিউনিস্ট । উনি যেমন একটা খেজুর ভাগ করে খেতেন আমিও অনুরূপ ভাবে খেজুর ভাগ করে খাওয়ায় বিশ্বাসী । আমার আপন দুই ভাই মুক্তিযোদ্ধা ছিল । আবদুস সাত্তার একাত্তর সালে আর্মি মেডিকেল কোরের সৈনিক ছিল । মুক্তিযুদ্ধে একজন সাধারণ সৈনিক হিসাবে রংপুর, ময়মনসিংহ বাঘমারা অঞ্চলে যুদ্ধ করে । আবদুর রফিক-আমার তত্ত্বাবধানে মেঘালয় সেক্টরে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে যুদ্ধ করেছে । বর্তমানে এরা দুজনেই সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা যা করে তাই করে (কৃষিকাজ-সম্পাদন)। আমার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের একটাই মাত্র কারণ তাহলো এদেশের সাধারণ মানুষের মুক্তি । ২৫শে মার্চের ২/১ মাস আগেই স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, জনগণ-সবাইকে আসন্ন বিপদের কথা বলেছি যে যুদ্ধ হবে । মিটিং, মিছিল বাদ দাও-যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নাও । আমার কথায় কেউ কান দেয়নি । কিছু যুবক ছেলে বলল, আপনি যে বলেন যুদ্ধ হবে যুদ্ধতো বুঝি না । একজনের হাতে একটা লাঠি দিলাম তারপর তাকে বললাম তুমি আমাকে বাড়ি দাও । ও বাড়ি দিবার পর আমি তাকে একটা বাড়ি দিলাম । বললাম, এভাবেই যুদ্ধ করে তবে আরো আধুনিক উপায়ে । আওয়ামী লীগ অফিসে (সিলেট শহর) গেলাম মার্চের ৭তারিখে । দেখলাম নেতা, পাতিনেতা, জাগী নেতা, আর কিছু ইট ব্যারিষ্টার বসে বসে চা পান করছেন । আমি দাঁড়িয়ে বললাম, সাহেবরা কী করেছেন? এখানে দেখা যায় উৎসব হচ্ছে । আমি একটা কথা বলে যাচ্ছি-আজকে ৭তারিখ, সময় ঘনিয়ে আসছে-যুদ্ধ হবে । তখন বোধহয় কোনো নেতা, পাতিনেতা, কাউকেই পাওয়া যাবে না’। ঘুরে ফিরে যাচ্ছি । এক ইট ব্যারিষ্টারের কন্ঠ কানে আসল আগরতলায় ছিলতো, স্ক্র নাই (হাত মাথার কাছে নিয়ে ইঙ্গিত দিয়ে দেখাল) । কিন্তু সামরিক বাহিনীর কিছু রক্ত শরীরে ছিল তাই আবার ফিরে আসলাম । তাকে বললাম, এই শোন-তুই যদি বেঁচে থাকিস আর আমি যদি বেঁচে থাকি তবে এই সিলেটের মাটিতেই আবার দেখা হবে । তখন জিজ্ঞাসা করব কার স্ক্র ছিল । যুদ্ধ শেষ হলে সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যাই হোক সিলেট ফিরে আসলাম । লোক্মুখে শুনলাম যে ইট ব্যারিস্টার আর এক ঘুষখোর ম্যাজিস্ট্রেটের রুমে বসে তার সাথে আলাপ করছে । আমি তার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম । আমার ওয়াল্টার রিভলবার হাতে নিয়ে বললাম-এই কি সেই ইট ব্যারিস্টার? সে ঘাড় শুরালো । বললাম এই কুকুরের বাচ্চা, এটাতে ১০টা গুলী আছে, তোর জন্য কয়টা লাগবে? এই ৯টা মাস যখন পাঞ্জাবীরা তোর মা বোনদের নিয়ে টানাটানি করেছে তখন তুই কই ছিলি? ম্যাজিস্ট্রেটও ভয়ে কাঁপতে লাগল । বললাম, তোরও টাইম আসতেছে, তবে একটু পরে । ২৫শে মার্চের সারা দিন মধ্যরাত পর্যন্ত সিলেট শহরের বিভিন্ন অংশে অবস্থানরত নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দেখা করে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করার আহবান জানাই । রাতে আমার বালুচরের বাসায় ভাত খেতে বসলে আমার ঘরের চালে গুলী পড়ে । ঘর থেকে বের হয়ে সাদীপুর হয়ে টিলাগড় চৌরাস্তায় উঠি । সাথে একটা ব্যাগে আমার রিভলবার ছিল । তখন রাত প্রায় আড়াইটা । পূর্বদিক থেকে একটা জীপ দ্রুত বেগে আসছিল । রিভলবার হাতে নিয়ে দ্রুত রাস্তার পাশে আত্মগোপন করলাম । গাড়িটার গতি হ্রাস হয়ে আসে । এরপর উত্তর দিকে মোড় নিয়ে আবার গতি বাড়ার আগেই দ্রুত আরোহীর প্রতি গুলী ছুড়লে তা চালকের মাথায় বিদ্ধ হয় এবং গাড়ি উল্টে যায়, অপর আরোহী আহত হয় । দৌড়ে গিয়ে জীবিত হানাদারের প্রতি আরো একটা বুলেট ব্যয় করে তাদের একটা চাইনীজ স্টেনগান ও একটা রাইফেল তুলে নিয়ে ডিগ্রী কলেজের সীমানা দেয়াল টপকে পালাই । পরে অনেক স্থান ঘুরে বিভিন্ন ঘটনাবলীর মধ্যে দিয়ে ২৭শে মার্চ ভারত পৌছি । পরে যে অঞ্চল ৫ নম্বর সেক্টর হয় সেটা আমি প্রথম সংগঠিত করি । সিলেট, সুনামগঞ্জ মহকুমার (যা পরবর্তীতে ৪ ও ৫নম্বর সেক্টর হয় বা পরিস্কার করে বলতে গেলে ভারতের আগরতলা থেকে মহিষাকলা পর্যন্ত কোনো বাঙালি অফিসার এ অঞ্চলে ছিল না । আমি ও বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলাম । তারপর কয়েকজন আসেন, আসেন মানে বর্ডার পর্যন্ত এসে চেহারা দেখিয়ে যাওয়া । যুদ্ধ চলাকালে আমি মেজর পদে প্রমোশন পাই । হরিপুর, শ্রীপুর, হেমু, ডাউকীসহ ৪ ও ৫ নং সেক্টর এলাকায় আমি অসংখ্য অপারেশন করেছি । এরমধ্যে জুলাই মাসে করা জৈন্তা অপারেশন আমার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অপারেশন । জৈন্তা অপারেশনের বর্ণনা তখন জুলাই মাসের মাঝামাঝি । জৈন্তাপুর আক্রমণ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে । আমার পরিবার তখন তামাবিল সীমান্ত থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার ভিতরে সকাপুঞ্জিতে । প্রায় ৮০০ সৈন্য মুক্তাপুরের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে আমি বাসাতে যাই । রাত তিনটায় গুলীবিদ্ধ হয়েছি-স্বপ্ন দেখে জেগে উঠি । এরপর স্ত্রীকে জাগলে রান্না করে খাওয়ান । যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে একটা গাছের আড়ালে থেকে আমি মেশিনগান চালাচ্ছিলাম । সাথে একজন নেপালী । গাছ ভেদ করে একটি গুলি আমার গলায় আর নেপালীর দুই উরুতে দুটি গুলী লাগে । তাকে কাঁধে করে বহন করে নিচ্ছি এক হাত দিয়ে, আমার নিজের ক্ষতস্থান ধরে রেখেছি অন্য হাতে । সীমান্তের কাছাকাছি এলে ভারতীয় সৈন্যরা এসে সাহায্য করে । আমি তখন অজ্ঞান হয়ে যাই । আমাকে শিলং হাসপাতালে পাঠানো হয় । এটাই আমার কাছে স্মরণীয় অপারেশন । বক্তব্য শেষ করার আগে ‘বীরত্ব উপাধি’ প্রদান নিয়ে দুয়েকটি কথা না বললে বক্তব্য অসম্পূর্ণ থাকবে বলে আমার বিশ্বাস । আমি কোনো উপাধির জন্য যুদ্ধ করিনি । যারা আমার আশে-পাশে ছিল তাদের কমাণ্ড আমি মানিনি কারণ তারা সবাই অসৎ ছিল । অসৎ ব্যক্তিদের রিকমেণ্ডেশনে কিছু পাওয়া আল্লাহর কাছে অন্যায় । এবং পাইনি বলে আমার কোনো দুঃখ নাই কারণ বহু মুক্তিযোদ্ধাই উপাধি পায়নি । আমার অধীনে যারা ছিল তাদের মধ্যে আমি যাদের রিকমেণ্ড করেছিলাম তারা প্রায় কেউই উপাধি পায়নি । কিছু চাটুকার উপাধি পেয়েছে, কীভাবে পেল তা আমি জানিনা যেহেতু আর্মির নিয়মানুসারে যে কমাণ্ডার থাকে তার অনুমতি বা অনুমোদন লাগে । আমি যে অঞ্চলে ছিলাম সে অঞ্চলে যেসব যোদ্ধা উপাধি পেয়েছেন তারা যদি আমার দস্তখত করা কাগজ (citation) দেখাতে পারেন তবে আমি সেটা স্বীকার করে নেব । আর এর পরিবর্তে যারা এই উপাধি পেয়েছে তাদের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ যেমন খুন, রাহাজানি, বিচারাধীন মানুষকে বিনা বিচারে বারুদ দিয়ে উড়িয়ে দেও্যা, অন্যান্য নানা প্রকার লুটতরাজ ইত্যাদি নানা অভিযোগ মুজিব নগর সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে (এমনকি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের কাছেও)আছে । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ লোকের জীবন গেল । এদের সবাই সিভিলিয়ান ছিল । একটা সিভিলিয়ানও কি বীর শ্রেষ্ঠ খেতাব পাবার উপযুক্ত ছিল না? এতবড় অন্যায় এই জাতির কোনোদিন সহ্য করা উচিত না । এ নিয়ে এখন অনুসন্ধান করা উচিত যে কে বা কারা এ সমস্ত উপাধি পাবার যোগ্য ছিল এবং কারা রিকমেণ্ডেশন করার যোগ্য ছিল । (মেজর এম এ মোত্তালিবের এ বক্তব্য ১৯৮৭ সালের । এ দ্রোহী সৈনিক ১৯শে অক্টোবর ১৯৯১ মৃত্যুবরণ করেন।)

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!