হাবিলদার আরন আলী, বীর বিক্রম
সিলেট জেলার কোতয়ালী থানার লতিফুর গ্রামে ১৯৩৪ সালের ১লা জুলাই আমার জন্ম হয় । আমার পিতার নাম মো. মাহমুদ আলী ও মাতা হারিজা খাতুন, গৃহস্থী তাদের পেশা ছিল । আমরা মোট সাত ভাই বোন । সকলের মধ্যে আমি তৃতীয় । আমি সিলেটের রাজা জি.সি. স্কুলে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন করেছি । মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে প্রাক্তন ইপিআর বাহিনীতে চাকুরিরত ছিলাম । এরও আগে পুলিশ বাহিনীতে ছিলাম । ১৯৫৮ সালে ইপিআর এ যোগ দেই । মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত কোনো পদোন্নতি পাইনি । মুক্তিযুদ্ধের আগে কোনো হাবিলদার পদবী পাই । আমি মুক্তিযুদ্ধের আগে কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলাম না বা সমর্থকও ছিলাম না । আমার বড়ভাই মকবুল আলী (প্রাক্তন ইপিআর এর হাবিলদার) মুক্তিযুদ্ধে জড়িত ছিলেন । দিনাজপুরে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন । এখনও দিনাজপুরে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছেন । ২৫শে মার্চ চুয়াডাঙ্গায় ৪র্থ উইং-এর ডি কোম্পানির ১২ প্লাটুনের সেকশন কমাণ্ডার হিসেবে বর্ণি BOP তে ছিলাম । ২৬শে কোর্ট চাঁদপুর ডিফেন্স ছিলাম । ৩১শে মার্চ পিছু হটে রাজাপুর ও দর্শনায় প্রায় ১৪ দিন পর্যন্ত দীফেন্সে ছিলাম । ১৬ই এপ্রিল চুয়াডাঙ্গার মুজিবনগরে উপস্থিত হই । ২৭শে এপ্রিল বেনাপোল ডিফেন্সে যোগ দেই । সেখানে আমরা সব ইপিআর একত্রিত হই । এরপর পাক হামলার পর আমরা ভারতের মধ্যে বনগাঁও ক্যাম্প করি । বনগাঁয়ে প্রায় ৭/৮ দিন থাকার পর ডিফেন্সের জন্য সেক্টর ভাগ করে দেয়া হয় । এরপর ৮ নম্বর সেক্টরের বয়রা সাব-সেক্টরে যোগ দেই ও কর্তব্যরত থাকি । আমার প্রশিক্ষণদাতারা ছিলেন প্রাক্তন ইপিআর কর্নেল আব্দুল লতিফ ও (ইপিআর) উইং কমাণ্ডাত মেজর আতাউর রহমান চৌধুরী (কুমিল্লায় বাড়ি) । ৮নম্বর সেক্টরের অধীনে বয়রা ও কাশীপুর (ভারর ও বাংলাদেশ) এই দুই জায়গা হতেই মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি । একাত্তরের মে মাসের ৮তারিখ সকাল আটটার সময় বাংলাদেশের কাশীপুর এলাকায় যখন পাক বাহিনী এসে অত্যাচার আরম্ভ করে তখন ঐ এলাকার জনসাধারণ ভারতের দিকে আশ্রয়ের জন্য চলে যেতে থাকে । এই জনসাধারণ তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা আমারে জানায় । আমাদের ব্যাটেলিয়ান কমান্ডার ক্যাপ্টেন খন্দকার নজমুল হুদা আমাকে ডেকে পাক ফৌজ যে কাশীপুরে হামলা করেছে এটার কী প্রতিকার করা যায় তার পরামর্শ দিতে বলেন । উত্তরে আমি আমার কমাণ্ডারকে বলি যে আমি আমার অধীনস্থ সবাইকে রেখে আমি ল্যান্স নায়েক আবুল হুসেনকে সাথে নিয়ে পাক ফৌজের গতিবিধি দেখার জন্য দখলাদারদের এলাকায় চলে যাই । কাশীপুর যাবার পর দেখতে পাই যে একটা পাকা বাড়ির চারদিকে পাকবাহিনী আনাগোনা করছে । তখন আমি চিন্তা করলাম যে আমরা মাত্র দুইজোন লোক এবং আমাদের কাছে হাতিয়ারও দুইটা, কিছু হ্যাণ্ড গ্রেনেড আর দুইটা মাত্র পিস্তল । দুশমনের মোকাবিলায় এগুলে যৎসামান্য । আর আমাদের সাথীদের খবর দেবার মতো অবস্থাও ছিলনা, কেননা পাক হানাদার বাহিনী তখন যশোর ক্যান্টনমেন্টের দিকে রওয়ানা দিয়েছে । সুতরাং কোনো বিকল্প রাস্তা না দেখে তাদের পিছু পিছু পাটক্ষেতের ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে অনুসরণ করতে থাকি । হানাদার বাহিনী তখন বেলচা গ্রাম অতিক্রম করে সামনের দিকে যেতে থাকে । সামনে তিন মাইলে দূরে ছুটিপুর গ্রাম । এর আগেই আমরা আমাদের সুবিধার জন্য খালপার পাড়ার কাছে যশোর যাবার রাস্তাটা কেটে রেখেছিলাম । হানাদার বাহিনী যখন কাতা রাস্তার উপর চলে আসে তখন আমি ও আমার সাথী অপারেশনের জন্য বেলচা গ্রামের একটা ভিটা বাড়ির আড়ালে প্রস্তুত হই । আমার সাথীকে রাস্তার অন্যপাশ হতে পজিশন নেবার জন্য বলি । আর তাকে এই বলে উপদেশ দেই যে ওরা কোনো হামলার আশংকা না করে অপ্রস্তুত অবস্থায় চলছে । আমরা তাদেরকে এই রকম অপ্রস্তুত অবস্থায় আর পাবনা তাই আমি গুলি করার সাথে সাথে তুমিও গুলি চালিও । সাথে সাথে একজন রাজাকার ও একজন পাকফৌজ ঢলে পড়ে । আমার সাথীও সঙ্গে সঙ্গে গুলি ছুড়তে শুরু করে । পাকবাহিনী কোনোরকম আড়াল না পেয়ে প্রাণভয়ে সামনের দিকে দৌড় দিতে থাকে । সাঁতার না জানতে অনেকে প্রাণ বাঁচানোর জন্য পানিতে ডুবে মরে ও অনেকে পাটক্ষেত দিয়ে সামনের দিকে ছূততে থাকে । আমাদের কোনো খবর না পাওয়া সত্ত্বেও আমার গুলির আওয়াজ শোনা মাত্র আমার কোম্পানির জোয়ানরা দৌড়ে আসতে থাকে ও আমাদের ওপর দিয়ে গুলি শুরু করে । আমি মনে মনে ভাবতাম লাগলাম যে আমার লোকজন না পাকফৌজ গুলি আরম্ভ করেছে । ইতস্ততঃ করে আমরা দুজন পাটিক্ষেতে লুকিয়ে কারা গুলি করছে তা দেখার জন্য সচেষ্ট হই । দেখি যে আমাদের রশিদ হাবিলদার গুলি চালাচ্ছে । তখন আমি আমার সাথীকে নিয়ে তাদের দিকে অগ্রসর হয়ে জোরে আওয়াজ দিয়ে তাদেরকে এগিয়ে যেতে বলি ।
তারা পাক বাহিনীকে ধরার জন্য এগিয়ে যায়, তাদের সাথে আমিও যাই । কাটা রাস্তা অতিক্রম করে পানি পার হয়ে পাকফৌজ যখন ছুটিপুরের দিকে পালাচ্ছিল তখন পজিশন নিয়ে গুলি শুরু করি এবং খাল পাড় হয়ে তাদেরকে তাড়িয়ে নিয়ে ছুটিপুর পর্যন্ত যাই । ছুটিপুর পৌছে পাকফৌজ তাদের গাড়িগুলো নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হয় । কিন্তু গাড়ি তিনটা কাদামাটিতে দুবে যায় । তারা সেখানে পজিশন নিয়ে আমাদের উপর হামলা করে । আমার সাথীরা পজিশন নেবার পর পেছন দিকে ক্লিয়ার কি না দেখার জন্য আমি পিছনে চলে আসে । বেলচা গ্রামে আসার পর দেখতে পাই যে সুবেদার মনিরুজ্জামান আমাদের সাহায্য করার কন্য আরও এক প্লাটুন জোয়ান নিয়ে আসছেন । আমি তাকে নাভাবনের রাস্তায় একতা সেকশনকে ডিফেন্স বসাতে বলি এবং কবিপুর মাঠে অন্য একটা সেকশনকে ডিফেন্স বসাতে বলি । তাকে কাশীপুর স্কুল থেকে অ্যামুনিশন সাপ্লাই দিতে বলি । আমি গ্রামের ভিতর দিয়ে রেকি করে আমার অগ্রবর্তী দলের সাথে মিলিত হবার সময় পথে দেখতে পাই যে বেলচা গ্রামের পূর্বদিক থেকে পাক বাহিনী পশ্চিম দিকে পজিশন নিয়ে আছে । তাদের কাছ থেকে প্রায় ২০গজ দূরে দুটো খেজুর গাছের আরাল থেকে বাংলায় পরিচয় জিজ্ঞাসা করি । কোনো জবাব না পাওয়াতে আবার উর্দুতে জিজ্ঞাসা করি । জবাবে তারা পাক বাহিনী বলে জানায় । তখন আমি পজিশন নিয়ে তাদের আত্মসমর্পণ করতে বলি । উত্তরে তারা আমার দিকে গুলি ছোড়ে । এতে আমার বাম হাতে একতা গুলি লাগে । আমিও গুলি ছোড়া আরম্ভ করি । আমার গুলি তারা পালাতে থাকে । পরে তাদের কেউকেই দেখতে পাইনি । না পাওয়াতে আবার তাদের খোঁজ করতে থাকি । কিছুক্ষণ পর দেখতে পাই যে সামান্য দূরে একটা পাকা বাড়িতে একজন লোক থাকি । কিছুক্ষণ পর দেখতে পাই যে সামান্য দূরে একতা পাকা বাড়িতে একজন লোক একটা স্টেনগান ও একটা ২//মর্টার নিয়ে ঢুকছে । তা দেখে আমিও দৌড় দিয়ে ঐ বাড়ির দেয়ালের বাইরে পজিশন নিলাম । আমি তার খোঁজ নেবার জন্য ঘানের গোলার আড়াল গিয়ে দেখতে পাই যে তার হাতিয়ার আমার গুলিতে খারাপ হয়ে গেছে । আমি মনে মনে ভাবলাম যখন তার হাতিয়ার নষ্ট হয়ে গেছে ও সে আমাকে আমাকে গুলি করতে পারবে না তাই তাকে জীবিত ধরার ইচ্ছায় বারির ভিতর ধুকে দেখতে পাই যে সে মরার মত পড়ে আছে, তার হাতিয়ারও তার পাশে পড়ে আছে । আমি তাকে মৃত ভেবে তার কোমড়ে আটকানো গ্রেনেডের বেল্ট বাম হাত দিয়ে খোলার চেষ্টা করার সময় হঠাৎ সে উঠে আমার ঘাড় ধরে হাতিয়ার কেড়ে নেবার চেষ্টা করলে আমার হাতিয়ার দূরে ফেলে দেই ও তার সাথে মল্লযুদ্ধ আরম্ভ করি । প্রায় আধঘন্টা হাতাহাতি করার পরও কোনোভাবেই আমাকে তার আয়ত্তের মধ্যে পাচ্ছিল না ।দুজনেই যখন ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌছে গেছি তখন আমি ঐ বাড়ি থেকে আমার কোম্পানির আবুল কালামকে রাস্তা দিয়ে যেতে দেখি ও তাকে জোর গলায় ডাক দেই । কামাল এসে রাইফেল দিয়ে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন ঝটকা মেরে কামালের হাত হতে রাইফেল কেড়ে নিয়ে কামালকে গুলি করার সুযোগ খুঁজতে থাকে । কিন্তু কামাল এসে আমার পেছনে লুকায় তাই হানাদার ক্যাপ্টেন গুলি করতে পারছিল না । আমি এক
সময় হঠাৎ করে আমার হাত দিয়ে ঝটকা মেরে তার হাত হতে রাইফেল ফেলে দেই আর কামালকে সামনে এসে ওকে ধরার জন্য বলি । কামাল এগিয়ে এসে ওকে ধরতে গেলে হানাদার ক্যাপ্টেন রফিক কামালের আঙ্গুল কামড়িয়ে ধরে । তখন আমি উক্ত ক্যাপ্টেনের বাম কান দাঁত দিয়ে কামড়িয়ে কেটে ফেলি ফলে সে কামালের আঙ্গুল ছেড়ে দেয় । কামাল এসে তাকে ধরে আর আমি আমার ব্যাগে রাখা দড়ি একহাত দিয়ে কোনোরকমে বের করে দুজনে অতিকষ্টে তাকে বেঁধে ফেলি । এরমধ্যে স্থানীয় জনসাধারণ ও আমার কোম্পানির লোকেরা এসে পৌছে ও জয়বাংলা শ্লোগান দিতে থাকে । আমাদের লোক ও জনসাধারণ পরিবেষ্টিত অবস্থায় উক্ত ক্যাপ্টেনকে ভারতের বয়রা ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেই । তারপর আমি ছুটিপুরের দিকে রওয়ানা হই । রাস্তায় আমাদের হাওলাদার আলাউদ্দিনকে দেখতে পাই । তার সঙ্গে আরও ৬০/৭০ জন সৈন্য দেখতে পাই । তাদের সবাইকে সাথে নিয়ে আমি ছুটিপুর উপস্থিত হই । সেখানে আগে থেকেই আমাদের জোয়ানরা পাক সেনাদের সাথে যুদ্ধরত ছিল । কাদায় ডেবে যাওয়া গাড়ি তিনটা নেবার জন্যই হানাদাররা আমাদের সাথে যুদ্ধ করছিল । আমি হাওলাদার আলাউদ্দিনকে তার লোকজন নিয়ে পজিশন নিতে এবং হামলা চালাতে বলি । কিন্তু হানাদার বাহিনীর মেশিনগানের জন্য আমরা অগ্রসর হতে পারছিলাম না । তাই আমি আবুল হাওলাদারের পার্টি উঠিয়ে তাদের নিয়ে হানাদার বাহিনীর ডান দিকে গিয়ে দুইটা ব্রেন গান দিয়ে তাদের মেশিনগানের অবস্থায় ওপর ফায়ার করতে থাকি । এতে হানাদার বাহিনী নাভারণের দিকে পালিয়ে যায় । পরে শত্রুকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে আমি ওয়ারলেসের মাধ্যমে বয়রা ক্যাম্পের কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন খন্দকার নজমুল হুদাকে কিছু লোক নিয়ে এসে গাড়িগুলো নিয়ে যাবার জন্য খবর দেই । তারপর আমি ছুটিপুর থেকে আমাদের মূল ক্যাম্পের দিকে রওনা হই । কিছুদূর আসার পর পরপর কয়েকটা শব্দ শুনতে পাই আগুন দেখতে পাই । তখন আমি আবার দৌড় দিয়ে ছুটিপুর ফিরে এসে দেখি সে গাড়িগুলো জ্বলছে । এই বিষয়ে জানতে চাইলে আমাদের জোয়ানরা জানায় যে আলাউদ্দিন হওলাদার পেট্টোল ট্যাঙ্কে আগুন দিয়েছে আর গাড়িতে গ্রেনেড চার্জ করেছে । তখন আমি তাকে তিরস্কার করি ও গাড়িতে আগুন লাগানোর জন্য কৈফিয়ত তলব করি । এর মধ্যেই জনসাধারণ ও আমাদের লোকসহ প্রায় ২০০/২৫০ জন লোক নিয়ে ক্যাপ্টেন খন্দকার নাজমুল হুদা সাহেব বচসাস্থলে এসে পৌছান এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করেন যে, আরব আলী, গাড়িগুলো কোথায় । তখন তাকে আমি হাওলাদার আলাউদ্দিনের ঘটনাটা ব্যক্ত করি । তিনিও আলাউদ্দিনকে তিরস্কার করেন ও কৈফিয়ত তলব করেন । আমরা তারপর হানাদারদের ১৪টা লাশ পিছনে রেখে প্রতিরক্ষা অবস্থান ত্যাগ করে বয়রা ক্যাম্পের দিকে রওনা হই । মধ্যপথে বটতলা গ্রামে গিয়ে শুনতে পাই যে, সুবেদার মনিরুজ্জামান সাহেবকে পাওয়া যাচ্ছে না । তখন ক্যাপ্টেন সাহেব আমাকে তার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন । উত্তরে আমি কযাপ্টেন সাহেবকে জানাই যে তাকে আমি কাশিপুর রেখে গিয়েছিলাম অ্যামুনিশন সাপ্লাই দেবার জন্য । বোধহয় পেটের অসুখের জন্য তিনি মেইন ক্যাম্পে ফিরে গিয়েছেন । আরও কিছুদূর যাবার পর (যে জায়গায় পাক হানাদার ক্যাপ্টেনকে ধরেছিলাম সেখানে) সুবেদার মনিরুজ্জামান সঙ্গী আনসারকে দেখতে পাই । তাকে সুবেদার সাহেবের কথা জিজ্ঞাসা করলে উত্তরে সে জানায় যে, এখানে বটগাছের কাছে তিনজন হানাদার সৈন্যের কথা
লোকমুখে শুনতে পেয়ে তাদের ধরার জন্য তারা আসে ও বটগাছের নীচে জঙ্গলের মধ্যে তিনজন উর্দি ছাড়া লোককে বসে থাকতে দেখতে পায় । সুবেদার সাহেব তাদের ধরার জন্য অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে স্টেন বাগিয়ে ধরে অগ্রসর হয়ে তাদের সারেণ্ডার করতে বলেন । তিনি ভেবেছিলেন যে তারা নিরস্ত্র হবে । কিন্তু তাদের মধ্যে হতে হঠাৎ একজন সুবেদার সাহেবকে গুলি করে ও তিনি পানিতে পড়ে যান ও আমরা পালিয়ে যাই । এই কথা শুনে আমি আমার কোম্পানির সবাইকে চারদিক ঘিরে তল্লাসী চালাতে বলি । তল্লাসী চালিয়ে কোনো পাক ফৌজকে পাইনি শুধু সুবেদার সাহেবকে মৃত অবস্থা দেখতে পাই । দুটো গুলি তার সিনায় একটা পেটে লেগেছিল । পরে তার লাশ যথাযোগ্য সম্মানের সাথে সেই রাতে দাফন করা হয় । সুবেদার সাহেবের লাশ উদ্ধারের পর আমি ক্যাপ্টেন সাহেবকে এখানে কিছু লোক রেখে বাকিদের খাবার জন্য ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিতে অনুরোধ করি । অন্যান্যরা এসে এখানে পজিশন নেয় । আমি রাতে মেইন ক্যাম্পে অবস্থান করি ও আমার হাতে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দেয়া হয় । পরদিন ভোর বেলায় ক্যাপ্টেন সাহেবসহ পুরো কোম্পানি ডিফেন্সে চলে যায় শুধু আমি ক্যাম্পে থেকে যাই । আমি বয়রা বাজারে চা খাবার সময় ডিফেন্সে পায়ার শুনতে পেয়ে চা ফেলে কাশীপুর দীফেন্সের দিকে দৌড়ে যাই । যেতে যেতে হঠাৎ ফায়ার বন্ধ হয়ে যায় । এবং দেখতে পাই যে জনসাধারণ সহ আমাদের লোক পিছনে চলে আসছে । তারা আমাকে জানায় যে, পাকফৌজ আমাদের বটতলা ডিফেন্স দখল করে নিয়েছে । আমি সত্যি-মিথ্যা যাচাই-এর জন্য সিপাহী জাকির ও একজন সাধারণ পাবলিক মক্কেল আলী মোল্লাকে সাথে নিয়ে ডিফেন্সের দিকে যাই ও গিয়ে দেখতে পাই যে আমাদের অনেক অ্যামুনিশন ডিফেন্সের উপর ও রাস্তায় পরে আছে । সব অ্যামুনিশন জড়ো করে মসজিদের ভিতর নিয়ে যাই । তারপর আমাদের লোকদের খোঁজ করার জন্য পিছন দিকে যাই । খেজুর-বাগান গিয়ে ক্যাপ্টেন হুদাসহ ৫০/৬০ জনকে দেখতে পাই । তাকে জিজ্ঞাসা করি, স্যার, আপনারা কেন দীফেন্স ছাড়লেন? তিনি বললেন যে, পাকফৌজ এর আর্টিলারি ও বিমান হামলাতে আমরা টিকতে না পেরে পিছনে চলে এসেছি । মনে হয় তারা ডিফেন্স দখল করে নিয়েছে । তখন আমি বললাম যে, আমি দীফেন্সে নিজে গিয়েছি ও সমস্ত অ্যামুনিশন জড়ো করে মসজিদে রেখে এসেছি কোনো পাকফৌজ দেখতে পাইনি । কিন্তু ক্যাপ্টেন সাহেব আমাকে বিশ্বাস করতে পারলেন না । তাকে নিয়ে সেই স্থানে যাই ও কোনো পাকফৌজ না দেখতে পেয়ে তার বিশ্বাস হয় । হঠাৎ করে ছুটিপুরের দিক থেকে একটা বার্স্ট ফায়ার আসে । আবার সবাই পিছনে হাটতে থাকে । আমি রাগ করে সিপাহী জাকিরকে নিয়ে ছুটিপুরের ফায়ার ওপেন করি । উত্তরে পাকফৌজ কোনো জবাব দেয়নি । আমি কয়েকটা গ্রেনেডও ছুড়ি । কোনো সাড়া পাইনি । তখন অনুমান হয় যে, পাকফৌজ ছুটিপুরেই অবস্থান নিচ্ছে, এদিকে আসবে না । তখন আমরা বটতলাতে পুরোপুরি ডিফেন্স নেই । পরবর্তীতে আমি আরো অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি । সরকার আমাকে ‘বীর বিক্রম’ উপাধিতে ভূষিত করে । তারপরের ইতিহাস অভাবের, কষ্টের আর অপমানের । এ কষ্ট বড় কষ্টের ।