You dont have javascript enabled! Please enable it! শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূইয়া, বীর উত্তম - সংগ্রামের নোটবুক

শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূইয়া, বীর উত্তম

খাজা নিজামউদ্দিন ১৯৪৯ সনের ১৯শে ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জনুগ্রহণ করেন। নিজামউদ্দিনের গ্রামের বাড়ি ছিল কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার মালাপাড়া গ্রামে। পিতা আবদুল লতিফ ভূঁইয়া একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি সাব ডিভিশনাল ম্যানেজার, গভঃ একোয়ার্ড এস্টেটস পদে ছিলেন, চাকুরি জীবনে অত্যন্ত সৎ ও দক্ষ অফিসার হিসেবে তার সুনাম ছিল। মাতা মরহুমা তবেন্দা আখতার খাতুন গৃহিণী ছিলেন। উভয়েই ১৯৭১ সালের পর মৃত্যুবরণ করেন। ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে নিজাম ছিলেন দ্বিতীয়। শহীদ নিজামের পিতা একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন বিধায় তার শিক্ষাজীবন। দেশের বিভিন্ন জেলায় সম্পন্ন হয়েছে। কুমিল্লা গিরিধারী প্রাইমারী স্কুলে তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। অরুন চন্দ্র হাইস্কুল-ননায়াখালী, ফেনী জুনিয়র হাই স্কুল, নারায়ণগঞ্জ বার একাডেমী, নুরুল হক চৌধুরী হাই স্কুল-কাটলী, চট্টগ্রামে বিভিন্ন সময়ে পড়ালেখা করেছেন। পরে ১৯৬৪ সনে চট্টগ্রাম জে. এস. সেনস ইনস্টিটিউট থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করেন। উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষ চট্টগ্রাম সরকারি বাণিজ্য মহাবিদ্যালয়ে পড়েছিলেন, পরে ১৯৬৬ সনে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি মহাবিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৬ সনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনায় সম্মানে ভর্তি হন। ১৯৬৯ সনে সম্মান কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। পরে দিবাতে এম. কম. আর নৈশতে এম. বি. এ. পড়তেন। ১৯৭০ সনে তিনি এম. কম পরীক্ষা শেষ করেন। উপরোক্ত সব পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় বিভাগ/শ্রেণী লাভ করেন। সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি তার যথেষ্ট অনুরাগ ছিল। যখন তিনি দশম শ্রেণীতে পড়তেন (জে. এম. সেনস ইনস্টিটিউট) তখনও তার কয়েকটি লেখা বিচ্ছিন্ন বার্ষিকী ও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে তার সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অনুরাগ আশাতীতভাবে বেড়ে যায়। কালচক্র নামে একটি অনিয়মিত সাহিত্য সংকলন ইব্রাহিম রহমান ও খাজা নিজামউদ্দিনের যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়।

বাণিজ্য অনুষদে সাহিত্য, সংগীত ও ক্রীড়ায় তার যথেষ্ট নৈপুণ্যের ছাপ ছিল। একজন গীটার বাদক হিসেবে তার সুনাম ছিল। অনেক অনুষ্ঠানে তিনি পীটারের সুরে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন। তার গীটার শিক্ষক ছিলেন বোরহান আহমেদ। ১৯৬৯ সালের ‘কালচক্র’ এর ২১শে সংকলনটিতে (সম্পাদনা ইব্রাহিম রহমান ও খাজা নিজামউদ্দিন) তার নিম্নোক্ত কবিতাটি প্রকাশিত হয়। প্রিয়তমাসু আমার সময়ের রাজ্যে তোমার সংগীত ঐকতান তোলে মিছিলের উচ্চকিত ধ্বণির মতো আমার নিভৃত জাগ্রত করে আমি শুনি, কান পেতে শুধু শুনি। অনবরত ভাবনার পাহাড়ে ইচ্ছার দ্যুতিময় স্রোতে তোমার সোহাগী দৃষ্টির দংশিত প্রসাদ। সম্পন্ন প্রভাব অনায়াস প্রলুব্ধ করে কাব্যিক রঙে নিজেকে প্রেমিক রাখি। কিন্তু রক্তের বিপন্ন উচ্ছাসে যখন উদ্দাম ফাগুনের পরশ লাগে করবী আর পলাশের লালে মৃত ভায়েরা এসে দাঁড়ায় তৃষ্ণার নির্যাতনে ক্লিষ্ট ছায়া ফেলে আমি অস্থির হই দংশিত বিবেক নির্ভীক চেতনায় প্রজ্বলিত হয়। প্রচণ্ড নিয়ন্ত্রণে তাই তোমাকে দেয়া প্রতিশ্রুতির ন্যায় ভাইদের ক্ষুধিত আকাক্ষা বাস্তবে নিশ্চিত সংগ্রামের শপথ নিলাম। ১৯৭১ সনের জানুয়ারিতে তিনি তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (বর্তমানে ঢাকা শেরাটন)-এ কন্ট্রোলার অফ একাউন্টস’ হিসেবে যোগদান করেন। ২৫শে মার্চ পর্যন্ত তিনি সেখানে চাকুরি করেন।

১৯৬৯ সালের ২৭শে জুন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায় । সংগঠনের কিছু সদস্য সন্ধ্যায় এলিফেন্ট রোডস্থ হোটেল কামপালায় এক সম্মেলন অনুষ্ঠান করে। শইদি খাজা নিজামউদ্দিন ছিলেন সেই সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা। হোটেল কামপালার সম্মেলনের এক মাসের মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের (একাংশ) নাম পরিবর্তন করে বাঙলা ছাত্রলীগ” রাখা হয়। খাজা নিজামউদ্দিন বাঙলা ছাত্রলীগ জাতীয় কার্যকরী সংসদের প্রমোদ-সম্পাদক নিযুক্ত হন। মুক্তিযুদ্ধে ৯ জন গণযোদ্ধাকে বীর উত্তম’ বীরত্ব উপাধীতে ভূষিত করে সরকার। খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া তাদেরই একজন।-সম্পাদক শহীদ নিজামউদ্দিনের ছোট ভাই (তৃতীয়) শাহজালাল উদ্দিন ভূঁইয়া কুমিল্লায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তার অপর ভাই (ষষ্ঠ স্থান) আল্লামা ইকবাল উদ্দিন ভূঁইয়া যশোরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। একাত্তর সনের ২৫শে মার্চের কালো রাতে খাজা নিজাম মহসিন হলেই ছিলেন, পরে তুমুল উত্তেজনা ও সবার ছুটাছুটিতে হল থেকে তিনি বেরিয়ে পড়েন। কিছু দিনের মাঝেই কুমিল্লায় চলে আসেন। ভারতে যাবার পূর্বে তিনি গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মালাপাড়ায় এসেছিলেন। সেখানে গ্রামের তরুণদের সাথে কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, বর্বরদের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ালে তারা এদেশের কাউকে রেহাই দেবে না। কয়েকজনকে সাথে নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন। ভারতে আগরতলায় ইন্দ্রনগরে খাজা নিজাম দুমাসের ট্রেনিং গ্রহণ করেন। প্রথম ট্রেনিং ক্যাম্প সিমানা নামক স্থানে হয়েছিল। ট্রেনিং শেষে সীমান্ত পার হয়ে নিজাম তার বাহিনী নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। জালালপুরে তাদের ছাউনি স্থাপিত হয়। নিজাম গণবাহিনীর যোদ্ধা হিসেবে ৪ নম্বর সেক্টরের জালালপুর সাব-সেক্টরের সেকেন্ড ইন কমান্ত পদে ছিলেন। তার অধীনে ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ছিল ৪৮৬ জন এবং দায়িত্ব ছিল সিলেটের তেলিয়াপাড়া থেকে শেরপুর নদীঘাট অঞ্চল। ছোট ছোট দলে বিভক্ত এই মুক্তিযোদ্ধাদের উপর দায়িত্ব ছিল কয়েকটি ঘাঁটির-কানাইঘাট, মমতাজগঞ্জ, ভরামহিদ, নজিপাড়া, মনিপুর ও সড়কের বাজার। প্রধানত সড়ক সেতুর উপর তারা আঘাত হানেন। সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভিযান ব্যহত হয়। নিজেদের গোপন করে শত্রুকে নির্মূল করার গেরিলা পদ্ধতির লড়াইয়ে কমাণ্ডার নিজামের বাহিনী দক্ষতার পরিচয় দেয়। তাদের অভিযানে অনেক পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। সিলেটের টেলিফোন টাওয়ারও এই বাহিনীর বোমায় উড়ে যায়। সামরিক বাহিনীর যোগাযোগ ব্যহত হয়। পাক অগ্রাভিযান রোধের জন্য ৪ই সেপ্টেম্বর রাতের আঁধারে নিজামের বাহিনী সড়কের বাজারের নিকটস্থ পাকা পুল উড়িয়ে দেবার সংকল্প নিয়ে এগিয়ে যায়। নিজাম ছিলেন তার বাহিনীর পুরোভাগে। যথাসময়ে সতর্কতার সঙ্গে নির্দিষ্ট জায়গায় পেীছে পুলের সঙ্গে বিস্ফোরক স্থাপন করে তারা নিরাপদ দূরত্ব সরে যান। পুল ভাঙার ভীষণ শব্দ রাতের নিস্তব্ধতাকে চুরমার করে দেয়। পাক বাহিনী আশেপাশেই ওৎ পেতে ছিল। সম্মুখ সমর, এলোপাথারী গোলাগুলি

সঙ্গে সঙ্গেই শুএউ হয়ে যায় । নিজাম ক্ষিপ্রগতিতে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করে আদেশ তদারক করছিলেন । নিজেও ছুড়ছিলেন । হঠাৎ ওপার থেকে তার উপর একটা গোলা এসে পড়ে । আস্তে আস্তে মৃত্যুর কোলে ঢোলে বপড়েন নিজাম । উভয় পক্ষেই হতাহত হয় । তবে ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ তখনও জানা যায়নি । দীর্ঘ ছয় ঘন্টা যুদ্ধের পর যখন পাক বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হয় । তারপর মুক্তিবাহিনী নিজামের লাশ নিয়ে নিজ শিবিরে ফিরে । মোকামটিলার তিন কামেল পীর হযরত পাতা শাহ (রঃ), হযরত ঙ্গুল শাহ (রঃ) ও হযরত নীল শাহ (রঃ), তাদের সমাধির পাশেই তাকে দাফন করা হয় । তার স্মরণে ভরামহিদ, নক্তিপারা, উজানপুর, মোকামটিলা, সড়কের বাজার ইত্যাদি স্থানগুলোর নাম এলাকাবাসী ‘নিজামনগর’ রাখেন (বেসরকারী ভাবে প্রচলিত, সরকারি তরফ থেকে ঘোষণা হয়নি) । সিলেট জেলা পরিষদ ও এলাকাবাসী খাজা নিজামের কবরটি পাকা করে দেন । শহিদ নিজমউদ্দিন সম্পর্কে ৪নম্বর সেক্টরের জালালপুর সাব-সেক্টর কমাণ্ডার মাহবুবুর রব সদী, বীর প্রতীক বলেন, প্রথম দেখাসাক্ষাতের পর ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠে কিছুটা অভিনব পন্থায় । বলাবাহুল্য ঐ সময় আমাদের সম্পর্কে রূপে সোপর্দ্দ করা হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে । বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক নেতা বা সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে আমাদের আর কোনো যোগাযোগ রইল না । দেশের ভিরতে রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীন কোন্দল মীমাংসার কাজে আমাকে প্রায়ই নিয়োজিত থাকতে হত । আমার মনে পড়ে ২৫শে মার্চ বিকালেও হবিগঞ্জ থেকে নবীগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের একটি অভ্যন্তরীন কোন্দল মীমাংসার দায়িত্ব নিয়ে আমি নবীগঞ্জে যাই । এবং নবীগঞ্জেই ২৬শে মার্চ সকালে ঢাকার ঘটনা সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধুর নামে প্রেরিত টেলিগ্রামটি পাই । দেশের ভিতর রাজনৈতিক কোন্দল যে পর্যায়েই থাক না কেন, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হতেই সকলের চোখে মুখে একটি লৌহ দৃঢ় ঐক্যের ইঙ্গিতই দেখেছিলাম । মুক্তিযুদ্ধে ট্রেনিংএ এসে আবার ওই ধরনের কোন্দলের মোকাবেলা করতে হবে এবং সেই কোন্দলের মধ্যমনি আমাকেই সাজতে হবে এই ধরণের কোনো সন্দেহ ঘুণাক্ষরেই আমার মনে হয়েছিল অত্যন্ত আপনজন এবং শত্রু বলতে চোখের সামনে ছিল একমাত্র পাকিস্তানিরা । অবশ্য পরে জানতে পেরেছিলাম স্বল্প সংখ্যক ব্যক্তিত্বকে বাদ দিলে বাগ্লাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃবৃন্দের অনেকেই বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন নানারকম কোন্দলের মধ্যে । এবং সে সব কোন্দলের তুলনায় আমাদের ক্যাম্পে প্রথম এবং শেষ একমাত্র কোন্দলটি অত্যন্ত সামান্য ব্যাপার ছাড়া কিছুই নয় । যাই হোক, আমাদের সেই নাম না জানা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে সিলেট জেলার ছেলেদের সঙ্গে কুমিল্লা জেলার বিরাট দলও যোগ দেয় । আমরা ক্যাম্পে উপস্থিত হওয়ার দ্বিতীয় দিনে ট্রেনিং শুরু হওয়ার আগেই দুইটি ছেলের মধ্যে ঝগড়াকে কেন্দ্র করে সিলেট বনাম কুমিল্লা দলাদলি শুরু হয়ে যায় । উত্তেজনা যখন তুঙ্গে ঠিকই তখমই সেই ক্যাম্পের

দায়িত্বে নিয়োজিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর সেনানায়করা আমার কাঁধে ক্যাম্প কমাণ্ডারের দায়িত্বটি চাপিয়ে দেন । নিজে সিলেটের বাসিন্দা হওয়ায় স্বভাবতঃই কুমিল্লার ছেলেদের আস্থা অর্জন আমার পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার ছিল । কাজেই নানারকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়েই কমাণ্ডারের দায়িত্ব নিয়ে হয় আমাকে । আমি দায়িত্ব নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কুমিল্লার ছেলেদের মধ্যে ক্ষোভ ধূমায়িত হতে থাকে । এবং পরদিনই ভারতীয় বাহিনীর কমাণ্ডারদের উপস্থিতিতে আমাদের সকলকে এক জায়গা জড়ো করা হয় । সেই সমাবেশ কুমিল্লার আলাদা করা হয় । এবং ঐ ক্যাম্পের দায়িত্বে নিযুক্ত ভারতীয় বাহিনীর কমাণ্ডার (যিনি এককাল বাংলাদেশেরই ফরিদপুরের অধুবাসী ছিলেন) কর্নেল বাগচী কুমিল্লার ছেলেদের প্রশ্ন করেন আমার কমাণ্ড মেনে নিতে তাদের আপত্তি আছে কিনা? এই প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া, কুমিল্লার বীর যোদ্ধা আশরাফ বলেন তারা কোনো অবস্থাতেই অনৈক্যের কারণ হতে রাজি নন । পরবর্তীকালে কুমিল্লা থেকে অবগত ছেলেদের প্রায় সকলেই ঘটনার গুরুত্ব উপলব্ধি করে এবং ট্রেনিং অথবা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমাদের মধ্যে আর কখনো জেলাভিত্তিক কোনো দ্বন্দ্ব দেখা দেয়নি । সকল জেলার এক সঙ্গে মিলেমিশে একে অপরের জন্য জীবন দিয়েছে । ওই ঘটনার আগে নিজামউদ্দিনের সঙ্গে আমার বেতন কোনো হৃদ্যতা গড়ে উঠেনি । সুতরাং বলাই বাহুল্য আমার কমাণ্ড রক্ষার জন্য বরং দেশ ও জাতির স্বার্থে একজন নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক হিসাবে যে ভূমিকা গ্রহণ করা প্রয়োজন ছিল,সেই ভূমিকাই নিজাম সেদিন গ্রহণ করেছিলেন । এবং তাদের সঠিক ভূমিকা গ্রহণের মধ্যদিয়েই ঘটনাটি অতি অল্পে শেষ হয়েছিল । না হলে এই ঘটনা ক্রমশঃ বিরাট আকার ধারণ করে অন্যান্য ক্যাম্পেও ছড়িয়ে পড়তে পারত । এবং এতে আর কিছু নাহোক অন্ততঃ সিলেট অঞ্চলে স্বাধীনতা যুদ্ধ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হত । শুধু সেই ঘটনাই নয়, প্রয়োজনের মুহূর্তে নিজাম সব সময়েই একজন নিঃস্বার্থ দেশ প্রেমিকের ভূমিকা পালন করেছেন এবং জীবনের শেষ যুদ্ধে দেশের প্রয়োজনে নিজে জীবনটাকে খোলাম কুচির মতো ছুড়ে ফেলে দিয়ে বাংলা মায়ের এই দুর্দান্ত দুর্বার সন্তানটি চিরজীবী হয়ে রইলেন । ট্রেনিং শেষ হওয়ার পর মাসিমপুর ‘ইকো সেক্টর’ হেডকোয়ার্টারে অফিসার্স ট্রেনিং-এর জন্য ইন্টারভিউ ঢাকা হয় । আমরা কয়েকজন এই ইন্টারভিউতে যোগ দিতে অস্বীকার করি । এখানে বলে রাখা ভাল সিলেট জেলার বিশাল অঞ্চলকে স্বাধীনতা যুদ্ধে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা হয় । মেজর শফিউল্লার নেতৃত্বে কুমিল্লার একটি অংশ এবং সিলেটের দক্ষিণাঞ্চলে নিয়ে গঠিত হয় সেক্টর ৩, মেজর চিত্তরঞ্জন দত্তের নেতৃত্বে সিলেট জেলার মধ্য অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় সেক্টর ৪ এবং সিলেট জেলার উত্তর পশ্চিম অঞ্চল নিয়ে মেজর মীর শওকতের নেতৃত্বে গঠিত হয় সেক্টর ৫ । আমাদের প্রতিটি সেক্টরের সঙ্গে ট্রেনিং, অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ এবং প্রয়োজন হলে উপদেশ পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা প্রদানের জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি করে সেক্টর স্থাপন করা হয় ।

আমরা ছিলাম ৪নম্বর সেক্টরের সঙ্গে শিলচরের কাছাকাছি মাসিমপুর ভারতীয় বাহিনী যে সেক্টর হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে তার নাম ছিল ‘ইকো সেক্টর’ । আমাদের সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের অফিসার্স ট্রেনিং এর প্রথম ব্যাচের ইন্টারভিউ পরিচালনা করেন ইকো সেক্টরের কমাণ্ডার ব্রিগডিয়ার এমবি ওয়াকে । অফেসার্স ট্রেনিং-এ যোগ দিতে অস্বীকার করার পর আমি অবিলম্বে কমাণ্ডার ব্রিগেডিয়ার ওয়াটকের কাছে হাজির হওয়ার নির্দেশ পাই সেখানে পৌছলে ব্রিগেডিয়ার ওয়াডকে আমাকে অফিসার্স ট্রেনিং এ যোগ দেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করেন । আমি তাকে আমাদের মতামত স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেই । আমি বলি, আমরা যখন প্রথম ট্রেনিং নিতে আসি তখন বলা হয়েছিল এক সপ্তাহ ট্রেনিং-এর পরই আমরা যুদ্ধে যোগ দিতে পারব । অথচ বিশ দিন বিএসএফ এর কাছে এরপর একমাস আর্মির কাছে ট্রেনিং গ্রহণ করার পর এখন আবার তিন মাসের জন্য অফিসার্স ট্রেনিং এ যেতে বলা হচ্ছে । অপরদিকে আমাদের দেশে শত্রু দিন দিন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, দেশের মানুষের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে । আমাদের আর ট্রেনিং এর প্রয়োজন নেই । আমরা অবলম্বে যুদ্ধে যোগ দিতে চাই । এই বক্তব্যের যুক্তিকে এড়িয়ে যাওয়া কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না । অবশেষে আমরা অফিসার্স ট্রেনিং থেকে রেহাই পাই । নিজাম এই ব্যাওয়ারে অত্যন্ত দৃঢ় ভূমিকা গ্রহণ করেন । তিনিএ অফিসার্স ট্রেনিং এ না গিয়ে যুদ্ধে যোগ দেন । ৪ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমাণ্ডার মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত আমাকে ৪ নম্বর সেক্টরের জালালপুর সাব সেক্টরের সাব-সেক্টর কমাণ্ডার নিযুক্ত করলে আমি নিজামউদ্দিন ভূঁইয়াকে জামালপুরের সেকণ্ড-ইন-কমাণ্ড নিযুক্ত করি । নিজাম উদ্দিন ছিলেন একজন সুপুরুষ । তার উচ্ছতা ছিল মাঝারি, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, কখনো কোনো অসুখ বিসুখ হতে দেখিনি । তৎকালীন সময়ে আমাদের আরো অনেকের মতো তারও মুখ জুড়ে গজিয়েছিল কালো দাঁড়ি। তার চোখ দুটিতে ছিল এক ধরনের অদ্ভুত দ্যুতি । চোখে মুখে বাঁধভাঙ্গা তারুন্যের ছাপ । নিজামের হাসি ছিল অদ্ভুত রকমের সুন্দর । হাসলে তাকে খুব কোমল মনে হত । এই কথাগুলো নিজামউদ্দিনকে অন্য সকলের চেয়ে আলাদা করে দেখানোর উদ্দেশ্যে বলিনি । নিজাম শহীদ হওয়ার পর তার কথা ভাবতে গিয়ে আমরা যা যা মনে পড়েছিল সে কথাগুলোই শুধু তুলে ধরার চেষ্টা করলাম মাত্র । নিজাম কথা বলতে খুব কম । কথা যা বলার ভেবে চিন্তেই বলতেন । স্বভাবের দিক থেকে তিনি ছিলেন খুব শান্ত । কখনো রাগ করতে দেখিনি, মতামতের দিক থেকে তিনি ছিলেন নমনীয় । তার মতের বিপক্ষে সঠিক যুক্তি তুলে ধরতে পারলে গ্রহণ করতে কখনও দ্বিধা করেননি । তবে এ কথাটাও অস্বীকার করা যায় না যে নিজামের চরিত্রে কিছুটা অন্তর্মুখী ছিলেন । যে কারণে নিজামকে আমি পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি । অন্তত তার জীবনের শেষ যুদ্ধে যে চরম সাহসিকতা প্রদর্শন করে নিজাম নিজেকে উৎসর্গ করলেন, অত্যন্ত লজ্জা এবং অপরাধবোধের সঙ্গে হলেও স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি সেই বীর নিজামকে আমি সেইভাবে আগে চিনতে পারিনি । যদি তখন তাকে ঠিকভাবে চিনতে পারতাম তাহলে হয়তো জালালপুর সাব-সেক্টরের অনেক বীরত্বপূর্ণ ঘটনার (যেগুলোর কথা কেউ কখনও কোথা লেখেনি এবং ভবিষ্যতে কেউ লিখবে কিনা জানি না) সঙ্গে আরও অনেক চমকপ্রদ ঘটনার সংযোজন ঘটত ।

জালালপুর সাব-সেক্টরের মুক্তি সেনারা বেশি দিন ভারতের মাটিতে অবস্থান করেনি । সাব-সেক্টর স্থাপিত হওয়ার এক মাসের মধ্যে আমরা বাংলাদেশের ভিতরে প্রবেশ করি । এবং কানাইঘাট থানার লুতাছড়া চা বাগান, মন্তাজগঞ্জ মনিপুর টিলা, জকিগঞ্জ থানার কারবালা, রবুর চর, আটগ্রাম, আমলসিদ ইত্যাদি জায়গায় সাতটি অ্যাডভান্স ক্যাম্প স্থাপন করি এবং খগুব সম্ভবত জুলাই মাস থেকেই ঐ সব এলাকায় বাংলাদেশের পতাকা উড়তে থাকে । লুতাছড়াতে স্থানীয় অধিবাসীদের নিয়ে একটি প্রশাসনিক কমিটিও গঠন করে দিয়েছিলান । এই ক্যাম্পগুলো স্থাপন করে ভারতের জালালপুর থেকে সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টার লুতাছড়াতে স্থানান্তরিত করে আমি লুতাছড়া কাম্পের দায়িত্ব গ্রহণ করি । নিজামউদ্দিন কে সাব-সেক্টর টুআইসির পদে বহাল রেখে মন্তাজগঞ্জ ক্যাম্পের দায়িত্ব দেওয়া হয় । সেই মন্তাজগঞ্জেই শহীদ নিজাম এখন শান্তিতে ঘুমোচ্ছেন । বাংলাদেশের ভিতরে ক্যাম্প স্থাপনের ব্যাপারে ভারতীয় সেনানায়কদের তরফ থেকে প্রথমে খুব আপত্তি উঠে । পরে বহু রকম তর্ক বিতর্কের পর তারা রাজি হন । এই বিষয়েও শহীদ নিজাম আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেন । শহীদ নিজাম যে যুদ্ধে শহিদ হন সেই যুদ্ধের সম্পর্ক বিচার করতে হলে আরেকটি বিষয় সুস্পষ্ট করে বলা প্রয়োজন যে, বাধ্য হয়ে ভারতীয় বাহিনীর কাছে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারতে গেলেও আমি ভারতীয় বাহিনী সম্বন্ধে কখনো সম্পূর্ণ সন্দেহ মুক্ত হতে পারিনি । আমার সব সময়ই মনে হত পাক সেনারা পরাজিত হওয়ার পর আমাদেরকে আরেকটি সুদীর্ঘ গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হবে এবং সেই যুদ্ধ হবে ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে । যদিও ভারতীয় সরকারের-পরবর্তী আচরণ আমার এই সন্দেহকে সম্পূর্ণ অমূলক প্রমাণ করেছে, তবুও তৎকালীন অবস্থায় মনের গভীরে এই সন্দেহ পোষণ না করে আমি পারিনি । বাংলাদেশের ভিতরে যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে ক্যাম্প স্থানের জন্য আমার এত উৎসাহের পিছনে প্রধান কারণ ছিল যতদূর সম্ভব ভারতীয় বাহিনীর আওতার বাইরে থাকা । যদিও ভারতীয় বাহিনীর কম্যাণ্ডারবৃন্দ ব্রিগেডিয়ার ওয়াটকে, কর্নেল বাগচী, মেজর মুখার্জি, মেজর দাস, কাপ্টেন কুমার, ক্যাপ্টেন চান, এদের সকলের সহৃদয় ব্যবহার এবং সহযোগিতার কারণে আমাদেরকে ব্যক্তিগতভবে চিরকালের জন্য তাদের কাছে ঋণী থাকতে হবে । তবুও রণনীতি ও রণকৌশলগত নানারকম ব্যাপারে তাদের অনেক পরামর্শই আমি মন দিয়ে গ্রহণ করতে পারতাম না । স্বভাবতঃই কার্যক্ষেত্রে আমি তাদের অনেক পরামর্শ পাশ কাটিয়ে চলার চেষ্টা করতাম । প্রধানতঃ যে বিষয়টিতে জটিলতা সৃষ্টি হয় । সেটি হচ্ছে শত্রু সেনার কার্যকর ক্ষতিসাধন করতে পারার সম্ভাবনা না থাকলে আমি আমার ছেলেদের কোনো ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিতে রাজি হতাম না । ওদের পরামর্শে আমার মনে হত ওরা চায় আমাদেরকে নিয়ে পাকসেনার যতটুকু সম্ভব ক্ষতিসাধন হবার হোক, আমরাও যেন ধ্বংস হতে থাকি । নিজামউদ্দিনের আত্মোৎসর্গ ঘটনার সাক্ষাৎদর্শী হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি । সেদিনের যুদ্ধে তার সঙ্গের মুক্তিযোদ্ধাদের যারা জীবিত ফিরে এসেছিল তাদের কাছে শোনা বর্ণনার যেটুকু মনে করতে পারছি তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে বাধ্য হচ্ছি । ঠিক

আগের মতই একটি চরম সংকটময় মুহূর্তে দেশ ও জাতির স্বার্থে যে বিশেষ ভূমিকা পালনের প্রয়োজন ছিল, নিজের জীবনকে বাজী রেখে সেই ভূমিকা পালন করতে গিয়ে ব্যক্তিগত জীবনের প্রশ্নে নিজাম হেরে গেলেন । আর মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিসাহে একটা দুর্বার দূরন্ত প্রেরণা হয়ে নিজাম জিতে গেলেন চিরদিনের মত । আর কেউ কোনোদিন কোথাও তাকে হারাতে পারবে না । নিজামের ছোট দলটি সংখ্যার দিক থেকে প্রায় দশগুন একটি নিয়মিত পাক সেনাবাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হয় । পাক বাহিনীর তুলনায় তাদের অস্ত্র-শস্ত্রও ছিল নিম্নমানের । তুমুল গুলিবর্ষণের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা হতাশ হয়ে পড়ে এবং পিছু হটতে শুরু করে । ঠিক এই সময় নিজাম এলএমজি ম্যানের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে সামনে ঝাপিয়ে পড়েন এবং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শত্রুর উপর গুলি চালাতে থাকেন । পিছন থেকে সঙ্গীরা তাকে বসে পড়ার জন্য অনুরোধ করলে নিজাম জবাব দেন, ‘আমার গায়ে পাঞ্জাবীর গুলি লাগবে না । তোরা সব সামনে এগিয়ে আয়, মার দুশমনদের’ । আমাদের ছেলেরা আবার নতুন উদ্যমে আবার এগিয়ে যায় । অল্পক্ষণের মধ্যেই নিজামের গায়ে গুলি লাগে । বেপরোয়া নিজাম এর পরও গুলি চালাবার চেষ্টা করেন, কিন্তু পারেননি, মাটিতে ঢলে পড়েন । মাটিয়ে শুয়ে শুয়েও তিনি যুদ্ধের নির্দেশ দিতে থাকেন । আর সঙ্গীদের অনুরোধ করেন তার লাশ যেন ফেলে আসা না হয় । সকল দিককে সম্পৃক্ত করে নিজামউদ্দিনের বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগের মূল্যায়ন এই পরিসরে বর্ণনা করা সম্ভব নয় । কারণ নিজাম শুধু একজন ব্যক্তিই নন । নিজামউদ্দিন একটি প্রতীক । যে লক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল সে লক্ষ আজো বাস্তবায়িত হয়নি । প্রতিক্রিয়া নামক অক্টোপাসের অসংখ্য হাতের বাঁধনে আবদ্ধ আজকের বাংলাদেশের বিকৃত সমাজে শহীদ নিজামের সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব নয় । নিজাম একটি জনগোষ্ঠীর মুক্ত মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার ইচ্ছার প্রতীক । সফল সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সেই লক্ষ, সেই ইচ্ছা যেদিন বাস্তব রূপলাভ করবে, সেদিন সে সমাজের বিকাশের মধ্য দিয়েই কেবল শহীদ নিজামউদ্দিনের সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব হবে । তবু অপ্রিয় হলেও একটি সত্য ঘটনা তুলে না ধরে পারছিনা যে, শহীদ নিজামকে বীর উত্তর উপাধিতে ভূষিত করে কর্তৃপক্ষ তাকে সম্মানিত করতে পারেননি । বরং তারা তাদের নিজেদের হীনমন্যতাই প্রকাশ করেছেন । শুধু নিজামের বেলাতেই নয় গ্যালান্ট্রি এওয়ার্ডে’র তালিকাটি দেখলে যে কোনো বিবেকবান ব্যক্তির চোখেই একটি বৈষম্য অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ধরা পড়বে যে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বাইরে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা শহীদদের মধ্য থেকে একজনকে মরনোত্তর এবং সর্বোচ্ছ উপাধি ‘বীর শ্রেষ্ঠ’ প্রদান করা হয়নি । এফ.এফ. (Freedom Fighters) এম, এফ (মুক্তি ফৌজ), বিএলএফ (Bangladesh Liberation Force), C-in-C Special  ইত্যাদি সকল রকম বাহিনীর শহীদদের মধ্যে মরনোত্তর বীর উত্তম দেওয়া হয় মাত্র একজনকেই । তিনি হচ্ছেন শহীদ নিজামউদ্দিন । শুধুমাত্র কাদের সিদ্দীকির বাহিনীকেই গণবাহিনী নামে স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করে কাদের সিদ্দীকিসহ কয়েকজনকে বীর উত্তম উপাধি দেওয়া হয়েছে । কাদের সিদ্দীকি যদি বঙ্গবন্ধু না আসা পর্যন্ত

অস্ত্রসমর্পন বন্ধ রেখে এবং পরে বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে তার নিজের এবং তার বাহিনীর স্বতন্ত্রের স্বীকৃতিটুকু আদায় না করতেন তাহলে তিনি নিজেও এই উপাধি পেতেন কিনা সন্দেহ । যাই হোক মুক্তিযুদ্ধে, গ্যালান্ট্রি এওয়ার্ড বিতরণে স্বজনপ্রীতির এই নমুনা সমগ্র জাতির জন্য চরম লজ্জাকর হলেও এই সত্যটি উল্লেখ না করে পারলাম না । আমার জানা নেই গ্যালান্ট্রি এওয়ার্ড বিতরণে প্রধান কর্তৃপক্ষ কারা ছিলেন । যদি বেসামরিক কর্তৃপক্ষ হয়ে থাকেন তাহলে বলতে হয়, সামরিক বাহিনীকে খুশি রাখার জন্যই এরকম করা হয়েছে । আর যদি সামরিক কর্তৃপক্ষ করে থাকেন তাহলে বলতে হয় তাদের মধ্যে এক ধরনের সামরিক অভিজাত্য বোধজনিত পক্ষপাতিত্ব কাজ করছে । ১৯৭৩ সালে গণপেজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়াকে মরণোত্তর ‘বীর উত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করেন । এ সম্বন্ধে মুক্তিযুদ্ধকালীন ৪ নম্বর সেক্টর কমাণ্ডার মেজর (অবঃ) মেজর জেনারেল সি, আর দত্তের বক্তব্যঃ সাহসিকতাপূর্ণ অবদান ও বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে বীর শ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করার জন্য ৪নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে সরকারের কাছে আমি সুপারিশ করেছিলাম । শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়াসহ এসব অমন সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের বীতত্বগাথা পাঠ্যসূচিতে স্থান দিলে আগামী দিনের বংশধররা দেশপ্রেমের শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা লাভ করবে । এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি ।