You dont have javascript enabled! Please enable it!

আবুল কাশেম মো. রফিকুল হক, বীর প্রতীক

বাংলা ১৩৫৭ সালের ১০ই বৈশাখ ময়মনসিংহ জেলার অষ্টগ্রাম থানায় (বর্তমানে উপজেলা) আমার জন্ম হয়। পিতা একেএম নূরুল হক সরকারি চাকুরি করতেন। ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি তিনি সরকারি চাকুরি (সি. ও রেভিনিউ নান্দাইল, ময়মনসিংহ) হতে অবসর নেন। মাতা হাসিনা হক একজন সাধারণ গৃহিণী ছিলেন। আমরা পাঁচ ভাই, এক বোন। সবার মাঝে আমার স্থান চতুর্থ। আমি কিশোরগঞ্জ আজিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রাথমিক থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন করার পর ১৯৬৮ সনে কিশোরগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কলা বিভাগে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট এবং ১৯৭০ সনে কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল মহাবিদ্যালয় থেকে কলা বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে উক্ত কলেজে বিএ ক্লাসে এডমিশন নেই। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক উভয় পরীক্ষাতেই ২য় বিভাগ লাভ করি। পরবর্তীতে (দেশ স্বাধীন হবার পর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে (সম্মানসহ) স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করি। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের পূর্বে কিশোরগঞ্জ রাইফেল স্যুটিং ক্লাবে বালক গ্রুপের সদস্য ছিলাম। ছাত্র জীবনে আমি ছাত্র ইউনিয়নের সমর্থক এবং একজন সাধারণ কর্মী ছিলাম। আমার দ্বিতীয় ভাই একেএম মুর্শেদুল হক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং ৩ নম্বর সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেন। ছাত্রজীবনে উপলব্ধি করেছিলাম ১৯৪৭ হতে ১৯৬৯ সন পর্যন্ত পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী বাংলাদেশকে কেবল শশাষণ আর বঞ্চনা করে আসছিল। ফলশ্রুতিতে ১৯৬৯ সনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৬ দফার উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে গড়ে উঠে এক দুর্বার গণআন্দোলন। ইয়াহিয়া খান বাধ্য হয়ে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করেন। ১৯৭০ সনের এই নির্বাচনে অংশ নেয় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ। ৬ দফার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ জয়ী হয় পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে। স্বভাবতই আশা করেছিলাম ভবিষ্যতের শাসনতন্ত্র তৈরি হবে ৬ দফার উপর ভিত্তি করে। কিন্তু জনাব ভুট্টো ২৭শে ডিসেম্বর জানালেন সংখ্যাগরিষ্ঠ

দল ইচ্ছামত শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করলে তিনি সরে দাঁড়াবেন এবং পরবর্তী পরিস্থিতির জন্য তিনি কোনোভাবেই দায়ী হবেন না। এতে এটাই স্পষ্ট হয় যে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী নির্বাচনের রায় মানতে রাজি নন। ফলে আরম্ভ হয় বৈঠকের ষড়যন্ত্র এবং এদেশে বাঙালি হত্যার জন্য গোপন সৈন্য ও অস্ত্র প্রেরণ। অতঃপর রমনা রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত লক্ষ লক্ষ মানুষের মাঝে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শুনতে পেলাম পরদিন ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে। যার মূল কথা ছিল— এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল সকল স্কুল, কলেজ, অফিসআদালত। বাংলাদেশ ব্যাপী শুরু হলো ব্যাপক অসহযোগ গণআন্দোলন। ২৫শে মার্চ পর্যন্ত বিরাজ করছিল বাংলার মানুষের মাঝে থমথমে ভাব। সকলের মুখে বিষ্ময়ের ছাপ, একটা আতঙ্কের ভাব। ২৫শে মার্চ, ১৯৭১ সন। আমি ছিলাম কিশোরগঞ্জ শহরের বাড়িতে পরদিন সকালে ঢাকা বেতার থেকে শুনতে পেলাম দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। অল্পক্ষণ পরই দিল্লির খবরে জানা গেল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার খবর। অন্যদিকে ঢাকা থেকে সংবাদ আসল পাক বাহিনী ২৫শে মার্চের রাত্রে ঢাকা সেনানিবাস, পিলখানা এবং রাজারবাগে বাঙালি সৈন্য, পুলিশ এবং আনসারসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে হামলা চালিয়ে বহু ছাত্রকে হত্যা করেছে। ২৮/২৯শে মার্চ সন্ধ্যায় রেডিও খুলতেই একটা নতুন কেন্দ্র ধরা পড়ে নাম-স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। তাতে শুনতে পেলাম মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠ— বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অস্থায়ী সেনাপতি হিসাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণার ভাষণ, সেই সঙ্গে স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র ধরার আহবান। স্বাধীনতা একটা জাতির আত্মার আলোক। স্বাধীনভাবে বাঁচার আকাক্ষা কখনো নিষ্প্রভ হয় না। এমন কোনো মূল্য নেই যা স্বাধীনতার জন্য দেওয়া যায় না। আর তাই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মেজর জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার সত্যটি নিজের চেতনায় প্রখরভাবে অনুভব করেছিলাম বলেই মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিলাম। বাংলার বিপ্লবীসন ১৯৭১ সালের ১৬ই এপ্রিল আমি প্রথম সিমনা মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগদান করি। এ স্থানটি মাতৃভূমি বাংলাদেশের সিলেট জেলার তেলিয়াপাড়ার অতি নিকটস্থ। এ কেন্দ্র হতে প্রাথমিক ট্রেনিং এর পর ইন্দ্রনগর ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগদান করি বিশেষ উপযুক্ত ট্রেনিং গ্রহণের জন্য। ইন্দ্রনগর জায়গাটি আসামের কাছাড় জেলায় অবস্থিত। আমরা পাঁচশ জন বাংলার দামাল ছেলে এ কেন্দ্র থেকে মে মাসে ট্রেনিং গ্রহণ করি। ভারতের সামরিক অফিসারগণ আমাদেরকে বিস্ফোরক, বিভিন্ন ধরনের ছোট আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার ও গেরিলা পদ্ধতিতে শত্রুর উপর আক্রমণ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। আমাদের প্রতি ভারতীয় অফিসারদের মার্জিত ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করে। ইন্দ্রনগরের প্রায় পাঁচশত বিপ্লবী যোদ্ধাদের মাঝে বাছাই করা আমাদের ২৫ জন যেমন শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া (বীর উত্তম), আশরাফুল হক (বীর প্রতীক),

মনির, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জসিম উল্লেখযোগ্য J.L.W (Junior Leader Warefare) ট্রেনিং প্রদান করা হয়। ট্রেনিং এর পর প্রথমে অনিয়মিত কিন্তু সেপ্টেম্বর থেকে নিয়মিত ভাবে ভারতীয় ৭৫ টাকা করে বেতন পেতাম। এটা যথেষ্ট ছিল। মাসিমপুর ক্যান্টমেন্টের দোকান থেকে কাপড় কিনে তাদের টেইলার দিয়ে পোশাক (যেমন লম্বা কলারসহ জামা) বানাতাম। মোজা, জুতা কিনতাম। জোক, মশা তাড়াবার মলম কিনতাম। নভেম্বর পর্যন্ত এই ভাতা পেয়েছি মনে আছে। ভারতের ইন্দ্রনগর প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের সমস্ত প্রশিক্ষণদাতাই ছিল ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সদস্য। উক্ত প্রশিক্ষণদাতাদের মাঝে যাদের নাম মনে পড়ে তারা হলো ক্যাপ্টেন ধীরেন, ক্যাপ্টেন চৌহান (শিখ) ও সুবেদার মেজর ছাব্বির (ভারতীয়)। প্রশিক্ষণ শেষে মে মাস থেকে ৪ নম্বর সেক্টরের সদস্য হিসাবে অতঃপর অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি। প্রশিক্ষণ চলাকালীন সময়ে (মে মাস) আমরা ৩০ জন সিলেটের বড়লেখা নামক চা বাগানে প্রতিষ্ঠিত শত্ৰু ছাউনীতে অতর্কিতে আঘাত হানি। ট্রেনিং শেষে জুন মাসের প্রথম দিকে মাহবুবুর রব সাদীর নেতৃত্বে ভারতের বদরপুরের অদূরে জালালপুর মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা ঘাঁটি স্থাপিত হয়। উক্ত ঘাঁটি হতে ৪ নম্বর সেক্টরে (ইকো – ৪) আমি যে সমস্ত অপারেশনে যোগদান করি সেগুলোর মাঝে যেগুলি স্মরণ আসে, তা হল— প্রথম অপারেশনটি হয় সম্ভবত আশরাফ ভাইয়ের (বীর প্রতীক) নেতৃত্বে সিলেট জকিগঞ্জ রাস্তার উপর কালিগঞ্জ পুলে। রাত তিনটার দিকে পুলের অদূরে তিনটা ট্যাঙ্ক ধ্বংসকারী মাইন আমরা পুঁতে রাখি এবং কিছুক্ষণের মাঝেই বিস্ফোরক দিয়ে পুলটি উড়িয়ে দেয়া হয়। উক্ত অপারেশনে আমরা ১৫/২০ জন ছিলাম। বিস্ফোরক লাগানোর কাজে আমার সাথে ছিল সামসু, জসিম ও আতাউর। আমাদের কাজে সাফল্য অর্জনের জন্য অন্য সবাই পুলের দুই দিকে নিজ নিজ পজিশনে পাহারারত ছিল। পুলটি ধ্বংস করার সঙ্গে সঙ্গে শত্রু সৈন্য নিকটবর্তী ছাউনী ও বাংকার থেকে আমাদের লক্ষ করে গুলি ছুড়তে থাকে। আমরা তাদের গুলির জবাব না দিয়ে দক্ষতার সাথে কাজ সমাধা করে ঘটনাস্থল থেকে সরে আসি। এ অপারেশনে আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা সামান্য আহত হয়। রাস্তায় পুঁতে রাখা ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন বিস্ফোরিত হয়ে পরদিন সকালে পাক বাহিনীর সামরিক জীপ ধ্বংস হয় এবং তিনজন দখলদার পাক সেনাসহ নরপিশাচ বেলুচ রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন বসারত আলীর মৃত্যু ঘটে। মাইনের শব্দ আমরা নিজেরাই দূর হতে শুনেছিলাম। ক্যাপ্টেন মারা যাবার পর তারা পাশ্ববর্তী তিনটা গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। পরবতীতে গ্রামবাসীদের কাছে এসব তথ্য (পাকদের নিহত হবার খবর, গ্রাম পোড়ানো ইত্যাদি) জানতে পারি। দ্বিতীয় গেরিলা আক্রমণটি হয় লাতু রেলওয়ে স্টেশনের পাশে পুলের ওপর আনুমানিক রাত ৩-৩০ মিনিটের সময়। জসিম, মুর্তজা, সালাম ও ইলিয়াস সহ ২৫/২৬ জন মুক্তিযোদ্ধা এতে অংশ নেই। আমরা চার জন বিস্ফোরক লাগানোর কাজে ছিলাম বাকি সবাই পাহারারত ছিল। এক্সপ্লোসিভের আঘাতে পুলটি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায়। তৃতীয় অপারেশনটি জকিগঞ্জ থানার অন্তর্গত কালীগঞ্জ বাজারের উপর সংঘটিত

হয়। উক্ত অপারেশনটির কমান্ডার ছিলেন আশরাফুল হক (বীর প্রতীক)। জসিম, প্রদীপ, সামসু, বদিউদ্দিনসহ আরও প্রায় ১৫/২০ জন মুক্তিযোদ্ধা এতে অংশ নেই। ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে বাজারে অবস্থিত শত্রুর ক্যাম্প থেকে ১৭টি রাইফেল ছিনিয়ে আনতে আমরা সক্ষম হই। (রাজাকারদের ক্যাম্পে মাঝে মাঝে পাক আর্মিরা আসত তবে রাতে থাকত না। ঐদিন পাকিস্তানিরা আসেনি।) চতুর্থ জকিগঞ্জ রাস্তার উপর সরিপপুর বাজারের পাশে অবস্থিত সেতু এবং বরাক নদীর মাটির বাঁধ ২১শে জুন বিস্ফোরক দিয়ে উড়োনো হয়। এতে জকিগঞ্জের সাথে সিলেটের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পঞ্চম অপারেশন= ২৯শে জুন জকিগঞ্জের আটগ্রামে অবস্থিত পাক বাহিনীর তিনটি ঘাঁটিতে সন্ধ্যায় একযোগে আক্রমণ চালানো হয়। এতে আমরা আটগ্রামের মসজিদের ঘাটি হতে দুইজন পাকসেনা জীবিত ধরে আনতে সক্ষম হই। আটগ্রাম মসজিদের ঘাঁটি অপারেশনের বর্ণনা একাত্তরের আমার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অপারেশন হলো ২৯শে জুন সিলেটের জকিগঞ্জ থানার অন্তর্গত আটগ্রামে অবস্থিত পাকবাহিনীর তিনটি ঘাটিতে একযোগে আক্রমণ। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই আমরা তিনটি দলে ভাগ হয়ে পড়ি। আটগ্রামের বাস স্ট্যান্ডে অবস্থিত ঘাঁটিতে আশরাফুল হক (বীর প্রতীক), ডাক বাংলোর ঘাটিতে মাহবুবুর রব সাদী এবং মসজিদের ঘাঁটিতে নেতৃত্ব দেন মনির ভাই। আমি ছিলাম মসজিদের ঘাঁটি আক্রমণকারী দলে। প্রথমে নদী পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতের নাতানপুর বিএসএফ থেকে দেয় আর্টিলারি সাপোর্টের নীচ দিয়ে মসজিদ সংলগ্ন পাকবাহিনীর ঘাঁটির কিছু দূরে পজিশন নিয়ে একত্রে ফায়ার আরম্ভ করি এবং একঘন্টা ফায়ারিং এর পর হঠাৎ করে আমরা প্রায় ১৪/১৫ জন জয় বাংলা ধ্বনি তুলে শক্রর বাংকার অভিমুখে ফায়ার করতে করতে ছুটে চলি। এতে নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে শক্রর এলএমজি। একটি বাংকার থেকে দুইজন পাঠান সৈন্যকে জীবন্তু ধরে ফেলি। বাকিরা রাতের আঁধারে পিছন দিকে পালিয়ে যায়। উল্লেখ্য যে, একাত্তরের জুন মাসে ৪নম্বর সেক্টরে জীবন্ত পাকসেনা ধরে আনি। আমরাই প্রথম। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অগ্রগামী ক্যাম্প স্থাপন অতঃপর জুলাই মাসে সিলেট জেলার কানাইঘাট থানার অন্তর্গত মাদারীপুর সালামটিলায় (অনেকে সালামতটিলা বলেন। একটা টিলার উপর বাড়িটা ছিল আর মালিকের নাম সালাম তাই এই নামকরণ। একাত্তরে জনাব সালাম ভারতে চলে গিয়েছিলেন। উনি মাঝে মাঝে এসে আমাদের দোয়া করতেন আর বাড়ির জিনিসপত্র ঠিকঠাক রাখতে বলতেন।) অগ্রগামী ঘাঁটি স্থাপনের জন্য ভারতের সামরিক বাহিনীর মেজর কুমার আমাকে নির্দেশ দেন। এই শিবিরে আমার অধীনে ৪২ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিল। তাদের সহযোগিতায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সর্বপ্রথম ছাউনিটি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলাম। বর্বর পাক বাহিনী আমাদের অগ্রগামী ছাউনিতে প্রায়ই আক্রমণ করতে আসত। কিন্তু বাংলার অকুতোভয় বীর সৈনিকের কাছে তাদেরকে সর্বদাই পরাজয় বরণ করতে হতো।

আমার সহযোদ্ধারা যেভাবে তাদের জীবন উপেক্ষা করে সম্মুখ সমরে লিপ্ত হয়ে পাকসেনাদের পিছপা করেছে সেজন্য সত্যিই আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। আমাদের সাথে হাতিয়ার ছিল দুইটি দুই ইঞ্চি মর্টার, চারটি এলএমজি, পাঁচটি স্টেনগান ও বাকি সব রাইফেল ও এসএলআর। ক্যাম্পে প্রতি সন্ধ্যায়ই রাতের জন্য পাসওয়ার্ড (সাংকেতিক নাম, যা দ্বারা শত্রুর আক্রমণে নিজেদের চিহ্নিত করা যায়) নির্ধারণ করা হত। | আমার উক্ত ছাউনীর অদূরে মমতাজগঞ্জে ছিল খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া (বীর উত্তম)- এর অগ্রগামী ছাউনী। আমি কোনো বিশেষ অপারেশনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে তার সাথে পরামর্শ করতাম। প্রয়োজনে তিনি আমাকে তার মুক্তিযোদ্ধা দিয়ে সাহায্য করতেন এবং বিশেষ প্রয়োজনে তিনিও আমাদের কাছ থেকে অস্ত্রসহ যোদ্ধা নিতেন। এ বিষয়ক দুটি চিরকুট যা প্রয়াত সাংবদিক মাহবুবউল আলম রচিত বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত’-তে মুদ্রিত তা হলো—৮ই আগষ্ট বাহকের মাধ্যমে প্রেরিত পত্রে খাজা নিজামউদ্দিন আমাকে লিখেছেন, আজ এক জরুরি কাজের জন্য আতাউর ও সামসুসহ ভাল ৬ জন যোদ্ধা পাঠাবে সান্ধ্য আহারের পর। তাদের সঙ্গে দেয়া হবে একটা অটোমেটিক ও বাকি সব রাইফেল। এরা ইন্শাল্লাহ কাল সকালে ফেরত যাবে। আগের পাসওয়ার্ড থাকবে (বিশেষ দ্রষ্টব্য) কিছুক্ষণ আগে এক গাড়ি পাক সৈন্য আটগ্রাম গিয়েছে। এরা আচমকা আমাদের আক্রমণ করতে পারে। আটগ্রামে খবর পাঠিও। আর আমার একপ্লোসিভ (বিস্ফোরক) চাই। পরদিন অর্থাৎ ৯ই আগস্ট লিখলেন, “রফিক এই মাত্র খবর পেলাম রাজপুর স্কুলে ও রামপুরে পাঞ্জাবীরা বাংকার করছে। আমি আজকে সে দিকে যাব। তোমার গ্রুপ রাতে নদীর পার থেকে আমাদের গ্রুপের পর পরই ফায়ার খুলবে (গুলি চালাবে)।” বাংলার সেই বীর সন্তান খাজা নিজামউদ্দিন ভুইয়া (বীর উত্তম) পরবর্তীতে ৪ঠা সেপ্টেম্বর পাক বাহিনীর সাথে দীর্ঘ ছয় ঘন্টা ধরে সম্মুখ যুদ্ধ চালিয়ে বীরদর্পে শাহাদৎ বরণ করেন। খাজা ভাই আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাকবাহিনীর কবল থেকে ছিনিয়ে এনেছিলেন মোকামটিলা, মনিপুর, উজান, মমতাজগঞ্জ এলাকা। উক্ত মুক্ত এলাকার মমতাজগঞ্জের মোকামটিলার উপর এই বীর সন্তানের শেষ শয্যা রচিত হয়েছে। আগস্ট মাসের ১ম সপ্তাহে আমাকে বাহিনীসহ বাংলাদেশের সর্বপূর্ব সীমান্ত সিলেটের জকিগঞ্জ থানার অমলসিদ নামক স্থানে অগ্রবর্তী শিবির স্থাপনের জন্য আদেশ করা হয়। স্থানটি ভারতের টুকুর গ্রামের নিকটবর্তী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। প্রথমে ৫৩ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে অমলসিদে অবস্থিত সাবেক ইপিআর ক্যাম্পে মূল শিবির স্থাপন করি। পরবর্তীতে পাক বাহিনীর আক্রমণের চাপ বৃদ্ধির জন্য ও আমাদের প্রতিআক্রমণ। বাড়ানোর কারণে বাহিনীর সংখ্যা ১২২ জনে উন্নিত করা হয়। ক্যাম্পের ডিফেন্স এলাকাটি ছিল প্রায় এক মাইল জুড়ে। বাংকার ছিল ১৯টি। ১৫টি এলএমজি, ৫টি স্টেনগান, ৪টি দুই ইঞ্চি মর্টার, বাকি সব রাইফেল ও এসএলআর। অ্যামুনিশন, বিস্ফোরকসহ এন্টিপারসোনাল মাইন ছিল ৮০০টিরও বেশি। আমার উক্ত ক্যাম্পের সঙ্গে ভারতের ভাঙ্গাটুকুর গ্রামে অবস্থিত বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) হেডকোয়াটারের টেলিফোন যোগাযোগ ছিল (লন্ডন-আমন্ট্রাডাম সাংকেতিক নামে)। টেলিফোনে আমার নির্দেশ পেলে তারা তাদের ছাউনি থেকে

আমাদের আর্টিলারি ফায়ার দ্বারা সাপাের্ট দিত। কোম্পানিকে তিনটি ডিফেন্সে ভাগ করি ও আতাউর (বিএ), আবু সাইদ (বিএ) ও জসিম (আইএ)কে তিনটির দায়িত্ব প্রদান করি। মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম ছিল আমার সহকারী। শক্রর ঘাটি ছিল আমাদের ছাউনি থেকে প্রায় দেড় মাইল দূরে সিলেট জকিগঞ্জ রাস্তার উপর সরিফপুর বাজারে। দূরুত্ব কম বলে আমাদের বাংকার থেকে তাদের বাংকার দেখা যেত। পাক বাহিনী প্রায়ই উপর্যপুরী ৫ থেকে ৮ ঘণ্টাকাল একনাগাড়ে আমাদের ডিফেন্সের উপর আক্রমণ চালাতে কিন্তু তাদের আক্রমণে আমাদের অসীম। সাহসী মুক্তিযোদ্ধা সঙ্গীরা মোটেই বাংকার পজিশন ছেড়ে উঠত না। উপরন্তু আমরা বর্বর বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করে তাদের উপর মাঝে মাঝে বিপুল বিক্রমে ঝাপিয়ে পড়তাম। এতে ভারতীয় বাহিনীর আর্টিলারি সাপোর্টও কখনো কখনো নিতে হত। অব্যাহত আক্রমণের মুখে বিভিন্ন দিকে ৫ জন রাঙ্গাকরিসহ ৬ জন খানসেনা খতম। হয়। আগস্টের শেষ দিকে মুক্ত এলাকার পরিমাণ হয় প্রায় ৬ বর্গমাইল। উক্ত সময়ে আমাদের একজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লা জেলার পাঁচপুকুরিয়ার সিরাহুল ইসলাম আগস্ট মাসের ১২ তারিখ দিবাগত রাত এগারেটায় শহীদ হয়। ডিফেন্স এলাকার আক্রমণ প্রতিহত করার সময় ট্রেঞ্চ থেকে উঠে ট্রেঞ্চ এর উপরে এলএমজি রেখে দাঁড়িয়ে নির্ভিক চিন্তে অনবরত গুলি চালাতে থাকে, আর তখনই আসে বিপর্যয়। পাক বাহিনীর মর্টারের গোলা এসে পরে তার উপর। ছিটকে পড়ে সিরাজ, কাছেই এলএমজি টি পরে থাকে একজন বিশ্বাসী বন্ধুর মত। অমলসিদে মুক্ত এলাকার নাম রাখা হয় সিরাজনগর। (মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম ১২-৮-৭১ তারিখে রাত আনুমানিক ১১টায় শহীদ হয় । তার শরীরের গঠন ছিল মাঝারী ধরনের। গায়ের রং শ্যামলা। উচ্চতা পাঁচ ফুট ২/৩ ইঞ্চি হবে। সে ভাল গান গাইতে পারত। পল্লীগীতি ও স্বাধীনতার গান গেয়ে ন্যাম্পের সবাইকে সে আনন্দ দিত। তার স্বভাবও ছিল নম্র প্রকৃতির।)। আমার জানামতে শহীদ সিরাজুল ইসলামের গ্রামের বাড়ি ছিল কুমিল্লা জেলা পাঁচপুকুরীয়ায়। উল্লেখ্য যে স্বাধীনতার পর উক্ত ঠিকানায় পত্রও লিখেছিলাম, কিন্তু দুঃখের বিষয় তার পরিবারের কারো কাছ থেকে কোনো উত্তর পাই নাই। শহীদ সিরাজুল ইসলামকে অমলসিদ ক্যাম্পের পাশে দাফন করা হয়েছিল যথাযোগ্য ধর্মীয় ও সামরিক মর্যাদায়। এই ছয় বর্গমাইল এলাকা দেখার অভিপ্রায়ে ক্যাপ্টেন রব, সেক্টর কমান্ডার কর্নেল সি আর দত্ত, ভারতের সাংবাদিকগণ প্রায়ই আসতেন। উক্ত মুক্ত এলাকা সমন্ধে ভারতীয় দৈনিক আনন্দ বাজার পত্রিকায়ও খবর উঠেছিল। আমি আমার বাহিনীসহ প্রায় দেড় মাস কাল এই এলাকা মুক্ত রাখি এবং কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এ মুক্ত এলাকাটি তদানীন্তন ইপিআর ও মুজাহিদ মুক্তিযোদ্ধা কোম্পানির নিকট অর্পণ করে ৩নম্বর সেক্টরে যােগদান করি। (জকিগঞ্জস্থ অমলসিদ অগ্রগামী ক্যাম্পের কয়েকজন ছাড়া অন্য সকল মুক্তিযোদ্ধাই ছিলাম ঢাকা, কুমিল্লা এবং ময়মনসিংহ জেলার বাসিন্দা। স্বভাবতই আমাদের আগ্রহ ছিল নিজ জেলা/সেক্টরে শক্রর সঙ্গে যুদ্ধ করার। আর তাই কর্তৃপক্ষ ভারতীয় সামরিক বাহিনীর গাড়িতে করে উক্ত জেলাসমূহের সকল মুক্তিযোদ্ধাকে ৩নম্বর সেক্টরে পাঠিয়ে দেন। উল্লেখ্য যে, ৪ নম্বর সেক্টরটি সিলেট এলাকা জুড়ে হলেও সিলেটের মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল খুবই

নগন্য আর তাই আমি ৩ নম্বর সেক্টরে আসার সময় অমলসিদ অগ্রগামী ক্যাম্পের দায়িত্ব অর্পন করে আসি তদানীন্তন ইপিআর ও মুজাহিদ মুক্তিযোদ্ধা কোম্পানির নিকট। এখানে (৩ নম্বর সেক্টরে) ক্যাপ্টেন এমএ মতিন সাহেবের নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে বেশ কয়েকটি অপারেশনে অংশ নিই। সর্বশেষে ৩রা ডিসেম্বর আগরতলা বিমানবন্দর বরাবর আখাউড়া সীমান্তে পাক বাহিনীর থাটির বিপরীতে রাত ১০টায় ক্যাপ্টেন মতিনের নেতৃত্বে আমার সম্মুখ যুদ্ধের জন্য ছোট ছোট ম্যানহোল খুঁড়ে অবস্থান নেই এবং কিছুক্ষণ পরই পাক বাহিনীর ঝংকার ও ঘাঁটি লক্ষ করে সবাই এক সাথে গুলি ও গোলা ছুড়তে থাকি। সম্পূর্ণ রাত গোলাগুলির পর শেষ রাতে মিত্র বাহিনী (ভারতীয়) আমাদের সাথে অংশ নেয়। দুইদিন তুমুল যুদ্ধের পর আখাউড়া পাক বাহিনীর পতন হয় এবং প্রচুর হতাহতের মাঝে পাক বাহিনী পিছনে হটে যায়। ৬ই ডিসেম্বর আখাউড়ার যুদ্ধ শেষ হলে পাকিস্তানিরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে প্রথমে আশুগঞ্জ ও সর্বশেষে ভৈরব বাজারে সমবেত হয়। আশুগঞ্জে তুমুল যুদ্ধ হয় কিন্তু ওখানে আমরা ছিলাম না । আমাদের কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমাদেরকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থামিয়ে রাখা হয়। ৩রা ডিসেম্বর থেকে মিত্র বাহিনীর একাত্মতায় বুঝতে পেরেছিলাম সার্বিক যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেছে। ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা তার সেনাদল নিয়ে মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে দুর্বার বেগে সকল দিক থেকে ঝাপিয়ে পড়েছে পকি হানাদার বাহিনীর উপর। যৌথ বাহিনীর আক্রমণে পাক বাহিনী বাংলার সর্বত্রই পর্দন্ত হয়ে পিছু হটতে থাকে। ফলে এও বুঝতে পেরেছিলেন বাঙালির চেতনার সমন্বিত ধারা সংগঠিত হওয়ার মুহূর্তেই যুদ্ধ শেষ। | এল ১৬ই ডিসেম্বর। দীর্ঘ চব্বিশ বছরের শাসন ও শোষন থেকে মুক্তির আনন্দে ভরা এই দিন। বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লো বিজয়ের আনন্দ। ৯ মাসের যুদ্ধজীবন শেষ হলো। পুরো ৯ মাসই আপনজনদের নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় পরিচিত আঙ্গিনায় ফিরে যাওয়ার জন্য মন হয়ে উঠল উতালা। তাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় (ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্কুলে আমাদের ক্যাম্প করা হয়েছিল) ১৮/১৯ তারিখে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার ক্যাপ্টেন মতিন সাহেবের নিকট থেকে অনুমতি নিয়ে কিশোরগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা নাজিমুদ্দিন ও বাজুসহ সরাইল দিয়ে নদী পার হয়ে কটিয়াদী পর্যন্ত পায়ে হেঁটে ও পরবর্তীতে কিছু পথ রিকশায় ও কিছু পথ হেঁটে ডিসেম্বরেই কিশোরগঞ্জে শহরের বাসায় পেীছি। বাড়িতে পৌছার আগ পর্যন্ত আমি বা আমার আত্মীয়স্বজন কেউ কারো সংবাদ জানতাম না। | ভেবেছিলাম ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই দেশে কেউ বঞ্চিত হবে স্বাধীনতার সুফল থেকে। গ্রাম বাংলার দরিদ্রতম নাগরিকও সুখের মুখ দেখবে, শরীক হবে সমৃদ্ধিতে। সকলেই ভোগ করবে গণতান্ত্রিক ন্যায় বিচার। শোণিতের নক্ষত্র জ্বেলে যারা আমাদেরকে পথ দেখিয়েছে অথচ নিজেরা ঘরে ফিরতে পারেনি সেই শহীদ যোদ্ধারাও এখানে বিয়োগান্ত চরিত্র। তারা অনেকেই জাতীয় বীরমাল্য পায়নি, পেয়েছে কেবল স্বজনের আপনজন হারানোর কান্না।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!