You dont have javascript enabled! Please enable it!

মোহাম্মদ সামসুদ্দিন, বীর প্রতীক

১৯৪৭ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার বিষ্ণপুর গ্রামে আমার জন্ম হয়। আমার পিতার নাম আজগর আলী, তিনি কৃষিকাজ করতেন। মাতা লাবনী খাতুন একজন সাধারণ গৃহিণী ছিলেন। আমরা মোট তিন ভাই, এক বোন। সবার মাঝে আমার স্থান চতুর্থ। বিষ্ণুপুর প্রাইমারী স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করার পর ১৯৫৯ সনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মিরামানি পলিটেকনিক একাডেমিতে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হই এবং ৭ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করি। তারপর কর্মহীন ছিলাম। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হওয়ার পূর্বে ৭ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে গ্রামের ছেলে গ্রামেই থাকতাম। মধ্যবিত্ত ঘরে জন্মেছি বলে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ না পেয়ে কিছু একটা করে ভবিষ্যতের জীবিকা নির্বাহের আশায় তৎকালীন মহকুমা শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বড় ভাই এর নিকট মটর ড্রাইভিং শিক্ষার প্রায় শেষ মুহুর্তে ডাক পড়ল রক্তক্ষয়ী সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের। আমি আওয়ামী লীগের সমর্থক এবং গ্রাম পর্যায়ের কমিটির একজন সদস্য ছিলাম। পরিবারের অন্য কেউ প্রত্যক্ষভাবে হাতিয়ার তুলে না নিলেও বর্ডার এলাকায় বাড়ি ছিল বলে সবাই মুক্তিযোদ্ধাদেরকে বিভিন্ন কাজে কর্মে সহায়তা করতো। যদিও আমি রাজনীতি সমন্ধে কিছুই বুঝতাম না তবুও স্বাধীনতার সগ্রামে সাড়া না দিয়ে চুপ করে বসে থাকার মত কাপুরুষতা হয়ত সেদিন আমার মধ্যে ছিল না। তাই আমি স্বাধীনতাকামী জনতার সারিতে মিশে যাই এবং সংগ্রামী জননেতাদের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালনে বাধ্য হই। এই মুহূর্তে আমি আমার একটি স্মরণীয় দিনের কথা উল্লেখ না করে পারলাম না। দিন তারিখ মনে পড়ে না তবে যতটুকু স্মরণ হয় এপ্রিল মাসের প্রথম দিকেই হবে। ভাইয়ের বাসার জন্য বাজার থেকে সদায় পাতি কিনে যখন বাসায় ফিরছিলাম ঠিক তখনই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাক হানাদার বাহিনীর ৩টি জেট বিমান কর্তৃক বিভিন্ন শিক্ষা

প্রতিষ্ঠান ও সরকারী বড় বড় অফিস ভবনে শুরু হয় বেপরোয়া বোমা বর্ষণ। আর যে অফিসটি আমার সবচাইতে নিকটবর্তী সেটি হল ব্রাহ্মণবাড়িয়া কোর্ট, দূরত্ব আনুমানিক ৫০০ গজ। ঠিক সেই মুহুর্তে আমি আত্মরক্ষার জন্য পৌর সভার ময়লা পানি নিষ্কাশনের ড্রেনের ভিতর ঢুকে প্রথম বারের মত সংগ্রামী চেতনায় আত্মরক্ষার শিক্ষা পাই। ১৫/২০ মিনিট বোমা বর্ষণের পর যখন বর্বরদের বিমানগুলি চলে গেল। তখন আমার মনে হল যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর এখন কিছুটা শান্ত। আর অন্য কোনোদিকে চিন্তা না করে বাসার দিকে রওয়ানা হই। অল্প কিছুদূর গিয়েই দেখি রাস্তার পাশে এক হিন্দু বাড়ির একটি ঘরের দরজায় ও জানালায় অনেক লোক কান পেতে কী যেন শুনছে। আমিও শোনার জন্য দাঁড়িয়ে গেলাম। যখন বুঝলাম যে লোকগুলি রেডিও শুনছে। ঠিক তখনই আমি.শুনলাম যে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া বলছি। আর যা বলল সবকিছু বোঝার মতো মন মানসিকতা তখন আমার ছিল না। ঐ সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর সগ্রামী ছাত্র জনতা এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের দখলেই ছিল। যার অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন আইনুদ্দিন। আইনুদ্দিন সাহেবকে আমি প্রথম দেখলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর থেকে এক মাইল উত্তরে সুহীলপুর গ্রামে তিতাস গ্যাস কোম্পানির সামনে। তারপর হঠাৎ করে যখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর হানাদারদের দখলে চলে গেল আমরা তখন খানদের উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার জন্য ১৯৭১ সনের ২২শে এপ্রিল সিলেট জেলার তেলিয়াপাড়া সীমান্তের বিপরীতে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সিমলা নামক স্থানে মুক্তি বাহিনীর এক অস্থায়ী ক্যাম্পে যোগদান করি। সেই ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন। লেফটেনেন্ট ইব্রাহিম। আমি মনে করি লে. ইব্রাহিম আমাকে দেখলে আজও চিনতে পারবেন। আমি লে. ইব্রাহিম সাহেবের অধীনে প্রাথমিক ট্রেনিং-এ ছিলাম মাত্র ৭ দিন। এই ৭ দিনের একটি প্রশ্নের উল্লেখ না করে এ মুহূর্তে আর কিছুই লিখতে পারলাম না। একদিন আমার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে লে, ইব্রাহিম সাহেব প্রশ্ন করলেন আমরা এখানে কেন এসেছি। এ কথাটা যখন যত সহজ তখন তত কঠিন ছিল। উত্তর আমরা মাতৃভূমিকে মুক্ত করার ট্রেনিং নিতে এখানে (ভারতে) এসেছি। আমার যতটুকু মনে পড়ে উচ্চ শিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারাও এত সহজ প্রশ্নটা ভালোভাবে বুঝিয়ে বলতে পারতনা বা। উত্তর দিতে পারতনা। কারণ ইব্রাহিম সাহেব এই প্রশ্নটা করলে আমার মনে হত যে, এই বুঝি সুন্দরবন থেকে একটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার গুলিবিদ্ধ হয়ে আমাদের মাঝে হাজির হল। এমনিভাবে ৭ দিন গত হল। ৮ দিনে সময় হঠাৎ করে দেখলাম ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৪৮টি ট্রাক ও একটি জীপ। জীপে বসা একজন ক্যাপ্টেন, জাতিতে শিখ। নাম জানার সুযোগ পেলাম না। আর এই গাড়িতে করে আমাদেরকে হায়ার ট্রেনিং-এর জন্য নিয়ে যাবে। কিন্তু কোথায় নিবে তা আমাদের কিছুই জানায় না। আমি যতটুকু জানি ৪৮টি ট্রাকের প্রত্যেকটিতে ৪৮ জন করে মুক্তিযোদ্ধা থাকবে আর এদের মধ্যে একজন থাকবে কমাণ্ডার। আমি এই ৪৮টি ট্রাকের ৩নং ট্রাকের কমাণ্ডারের দায়িত্ব পেলাম। তার

পরদিন ক্যাপ্টেন সাহেবের জীপকে সামনে রেখে সমস্ত ট্রাক বহর চলতে লাগল। এ সময় আমার কাছে মনে হল যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জেনারেল ওসমানীর নির্দেশে বার্মা রণাঙ্গনের দিকে চললাম। এমনিভাবে ৩ দিন ৩ রাত গাড়ি চলার পর হায়ার ট্রেনিং-এর ট্রেনিং সেন্টার, আসামের কাছাড় জেলাস্থ ইন্দ্রনগরে এসে পৌছালাম। তখন সূর্য উঠেনি। এই প্রায় অন্ধকারের মধ্যে শুনলাম শত কোটি বানরের কিচির মিচির শব্দ আর ভাবছিলাম যে এই পাহাড়ের উপরেই বুঝি রাম তার লক্ষ লক্ষ অনুরাগীদের নিয়ে লংকা আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। সূর্য যখন উঠল তখন চার দিকে দেখি পাহাড় আর পাহাড়, আর গভীর অরণ্য। আমার গাড়ির সামনেই দেখলাম ছোট ছোট বেশ কয়েকটি তাবু। প্রত্যেকটিতে ২/৩ জন করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্য। আর চারিদিকের পরিস্থিতি দেখে মনে হল আমরাই ইন্দ্রনগর প্রথম ট্রেনিং নিতে এসেছি। এরপর যখন আমি গাড়ি থেকে নামলাম তখন দেখলাম আমার ধারণা সম্পূর্ণ সত্যি। নাম, পিতার নাম, গ্রাম, থানা, জেলা ইত্যাদি লিখার পর আমি ও আমার সহযোদ্ধাদের নিয়ে রাস্তা থেকে প্রায় হাজার গজ উপরে উঠলাম। সেখানে কিছু তাবু ও বাকি সব উপজাতীয়দের ছোট ছোট কুড়েঘর। একটা বড় তাবু আমি ও আমার সহযোদ্ধারা পরিষ্কার করে গাছের পাতা দিয়ে বিছানা করলাম। অনেক রাস্তা পাড়ি দিয়ে যাওয়াতে আমাদের সবাইকে ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। এমনি ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেখে ইন্দ্রনগর ট্রেনিং সেন্টারের অধিনায়ক কর্নেল বাগচী (ভারতীয়) আমাদের সবাইকে ৩ দিন আরামের অনুমতি দিলেন। একদিন কথাপ্রসঙ্গে কর্নেল বাগচী আমাদের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন যে, আমার বাড়িও একদিন তোমাদের দেশেই ছিল, ফরিদপুরে, আর শেখ মুজিব ছিল আমার ক্লাস ফ্রেন্ড। এ জন্য আমি অত্যন্ত আনন্দিত ও গর্বিত কারণ যে বাংলা একদিন আমার মাতৃভূমি ছিল সে বাংলারই ছেলেদের মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে গড়ে তোলার দায়িত্ব আমি পেলাম। উপরে উল্লিখিত ট্রেনিং সেন্টারে যে সব মুক্তিযোদ্ধারা ছিলাম এর মধ্যে দলনেতা ছিলেন জনাব মাহবুবুর রব সাদী। আমি যখনই সাদী ভাইকে দেখতাম তখন মনে মনে ভাবতাম যে উনার মতো ব্যক্তিরাই সবচাইতে বেশি দেশপ্রেমিক। এছাড়াও মনির, নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া (শহীদ ও বীর উত্তম), আশরাফ, আশরাফুল হক (বীর প্রতীক), যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জসিম ও একেএম রফিকুল হক (বীর প্রতীক) ছিলেন উল্লেখযোগ্য। শুরু হল নাম জানা অজানা শত সহস্র বাংলা মায়ের দামাল ছেলের মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ। মাত্র এক মাস তের দিনের প্রশিক্ষণেই আমরা মোটামুটি সব কিছু আয়ত্ব করে নিলাম, যেমন হাই এক্সপ্লোসিভ, ৩৬ হ্যাণ্ড গ্রেনেড, স্টেন গান, রাইফেল, এসএলআর, এসএমজি ইত্যাদি। ইন্দ্রনগর ট্রেনিং ক্যাম্পের সমস্ত প্রশিক্ষকই ছিলেন ভারতীয় সামরিক বাহিনীর লোক। তাদের মাঝে যাদের নাম এই মুহূর্তে মনে আসে তারা হলো ক্যাপ্টেন চৌহান, সুবেদার মেজর ছাব্বির, ক্যাপ্টেন ধীরেন প্রভৃতি। কর্নেল বাগচী ছিলেন উক্ত ক্যাম্পের প্রধান। এক মাস তের দিন প্রশিক্ষণের পর মে মাসের শেষ দিকে আমাকে ৪ নম্বর সেক্টরে (সিলেট এলাকায়) সাদী ভাইয়ের অধীনে নিয়ােজিত করা হয়। উক্ত ৪ নম্বর সেক্টরের

কমাণ্ডার ছিলেন মেজর সিআর দত্ত। উল্লেখ থাকে যে সাদী ভাইয়ের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে আমি ছিলাম পাঁচ মাস। এই পাঁচ মাসে ৪ নম্বর সেক্টরে কম করে হলেও ১০ বার গেরিলা পদ্ধতিতে বেশ বড় ধরনের আক্রমণে আমি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি। এবং অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ নম্বর সেক্টরে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে আমি অংশগ্রহণ করি। জুন মাসে মাহবুবুর রব সাদীর নেতৃত্বে ভারতের জালালপুরে যে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি স্থাপিত হয় এতে আমি যোগদান করি। উক্ত ক্যাম্প থেকে প্রধান যে গেরিলা আক্রমণে অংশ নেই, তা হলো: ১. জুন মাসের শেষ দিকে সিলেট-জকিগঞ্জ রাস্তার উপর সরিফগঞ্জের নিকট পুল এবং মাটির বাঁধ বিস্ফোরক দিয়ে ধ্বংস করি। উক্ত আক্রমণটি পরিচালিত হয়েছিল মনিরের নেতৃত্বে। পুলটি ধ্বংস হওয়ার ফলে সিলেটের সঙ্গে জকিগঞ্জের যোগাযোগ একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ২. জুন মাসে আটগ্রামে অবস্থিত ডাকবাংলো, মসজিদ ও বাসস্ট্যান্ডে পাক বাহিনীর ঘাঁটিতে যে আক্রমণ হয় উক্ত আক্রমণে আমি ছিলাম মাহবুবুর রব সাদীর দলে। ৩. এর মধ্যে যে অপারেশনটি আমার জন্য সবচেয়ে বেশি স্মরণীয় তা হলো ৩রা জুলাই ১৯৭১ এ সিলেটের কানাইঘাট থানা বর্তমানে উপজেলা রেইড করা। গ্রুপ কমাণ্ডার ছিলেন মাহবুবুর রব সাদী নিজে। সব মিলিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম ৩০ জন। মাহবুবুর রব সাদীর নেতৃত্বে আমরা ৩০ জন অতর্কিতে কানাইঘাট থানায় আক্রমণ করি ও তুমুল গোলাগুলির পর উক্ত থানা থেকে ৬০/৬২টি রাইফেল ছিনিয়ে আনি। উক্ত আক্রমণে আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা নিজেদের গুলিতে মারাত্মক ভাবে আহত হয়। তার নাম রেবুতী মোহন দাস বাড়ি নবীনগর উপজেলা, জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া। রেবুতীর পেটে গুলি লাগে। পরবর্তীতে জুলাই মাসে খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া (বীর উত্তম)-এর নেতৃত্ব কানাইঘাট থানার অন্তর্গত মমতাজগঞ্জে মুক্তিযযাদ্ধাদের যে অগ্রগামী ক্যাম্প স্থাপিত হয় তাতে অংশগ্রহণ করি। এই অগ্রগামী ক্যাম্প থেকে আমরা উক্ত এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্নসহ রাজাকার, আলবদরের ঘাটিতে প্রায়ই গেরিলা আক্রমণ চালাতাম। আমাদের ক্যাম্পের কিছু দূরেই সালাম টিলায় একেএম রফিকুল হক (বীর প্রতীক) এর নেতৃত্বে ছিল মুক্তি বাহিনীর অন্য আর একটি অগ্রগামী ক্যাম্প। কখনো কখনো আমরা দুই ক্যাম্পের যযাদ্ধারা মিলে শত্রুর উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালাতাম। ভারতের মেজর কুমার প্রায়ই আমাদের যুদ্ধ বিষয়ক পরিকল্পনায় সহায়তা করতেন। অতঃপর আগস্ট মাসে সিলেটের জকিগঞ্জ থানার অমলসিদ নামক স্থানে আমরা মুক্তি বাহিনীর অগ্রগামী ক্যাম্প স্থানান্তর করি। উক্ত ক্যাম্পের কমাণ্ডার ছিলেন একেএম রফিকুল হক (বীর প্রতীক)। আবু সাঈদ, জসিম, আতাউর, মনিরসহ আমরা প্রায় ১২০/১২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা উক্ত ক্যাম্পে ছিলাম। প্রায় প্রতিদিনই আক্রমণ ও প্রতি

আক্রমণ চলত। পাক বাহিনীর ক্যাম্প ছিল আমাদের ক্যাম্প থেকে প্রায় দেড় মাইল দূরে, সিলেট জকিগঞ্জ রাস্তার উপর রসিদপুর বাজারে। আর আমাদের ডিফেন্স থেকে তাদের ডিফেন্সের, বাঙ্কার দেখা যেত। ভাঙ্গাটুকুর গ্রামস্থ ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি বাহিনীর ঘাঁটির সঙ্গে আমাদের অগ্রগামী ক্যাম্পের টেলিফোন যোগাযোগ ছিল। তারা আমাদেরকে আর্টিলারী ফায়ার দিয়ে সাহায্য করত। উক্ত ক্যাম্পে শত্রুর গোলার আঘাতে আমাদের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম শহীদ হন। আমাদের আক্রমণে বিভিন্ন দিন। ১০ থেকে ১১ জন শত্রু সৈন্য খতম হয়। এ এলাকাকে প্রায় দেড় মাস মুক্ত রাখার পর। হাই কমাণ্ডের নির্দেশে আমরা কুমিল্লা, ঢাকা এবং ময়মনসিংহের সকলেই ৩ নম্বর সেক্টরে বদলী হয়ে আসি ২২শে সেপ্টেম্বর ধর ১৯৭১। ৩ নম্বর সেক্টরের কমাণ্ডার ছিলেন লে. কর্নেল কেএম শফিউল্লাহ। আমি যে কয়মাস ৩ নম্বর সেক্টরে লড়াই করি তখন আমার যুদ্ধের ধরণ ছিল আলাদা। অর্থাৎ আমি নিয়মিত বাহিনীর সাথে সেক্টর টুপসে। উক্ত সেক্টর ট্রপসের কোম্পানি কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন এমএ মতিন স্যারের অধীনস্ত বাহিনীতে যোগদান করি ও ডিসেম্বর মাসে আখাউড়া সীমান্ত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। উল্লেখ্য যে উক্ত যুদ্ধেই শক্রর মর্টার গোলার আঘাতে বাংকার ধ্বসে আমি আহত হই। স্বাধীনতায় আমার উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ হল আখাউড়া সীমান্তে সংঘটিত লড়াই। ১৯৭১ সনের ১লা ডিসেম্বর রাত দশটায় ক্যাপ্টেন মতিন স্যারের নেতৃত্বে আমরা আগরতলা বিমানবন্দর বরাবর আখাউড়াস্থ পাক বাহিনীর ঘাঁটির বিপরীতে চুপিসারে এসে ম্যানহোল খুঁড়ে সম্মুখ যুদ্ধের জন্য পজিশন নেই এবং একত্রে ফায়ার আরম্ভ করি। সারারাত্র গোলাগুলির পর শেষ রাতের দিকে ভারতীয় মিত্র বাহিনীও আমাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয়। এখানে উভয় পক্ষেরই প্রচুর সৈনিক হতাহত হয়। উক্ত যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ৪ঠা ডিসেম্বর আমি যখন বাংকারে পজিশনরত অবস্থায় শত্রুপক্ষের উপর এলএমজি দিয়ে ফায়ার করছিলাম তখন হঠাৎ করেই শত্রুর একটা মর্টারের গোলা এসে পড়ে আমার বাংকারের উপর। ফলে সম্পূর্ণ বাংকার ধ্বসে পড়ে আমার উপর। সহযোদ্ধারা অনেক চেষ্টা করে আমাকে পরিশেষে বাংকার থেকে টেনে বের করলেও মেরুদণ্ডে আঘাত পাই। চিকিৎসার জন্য ১৯৭৮ সনের মে মাসে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সাহেব আমাকে হাঙ্গেরীতে পাঠান কিন্তু ওখানকার মেডিকেল বোর্ড জানায় সময় শেষ, এখন আর চিকিৎসা করে কোনো ফল হবে না তাই ২৮ দিন পরেই বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেন। আর তখন থেকেই আরম্ভ হয় আমার এই হুইল চেয়ারের অভিশপ্ত জীবন। স্বাধীন দেশ আমাকে এমন অবজ্ঞা আর অসম্মান করবে এ দুঃখ মানি কী করে?

Ref: স্বাধীনতা মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!