You dont have javascript enabled! Please enable it!

মোহাম্মাদ আব্দুল আজিজ, বীর প্রতীক

আমার জন্ম হয় চট্টগ্রামের দেওয়ানবাজার ১৯৫০ সনের ৯ই সেপ্টেম্বর, রোজ শনিবার। পিতা আলহাজ্ব এম এ মজিদ একজন সরকারী চাকুরে ছিলেন (তখন Asst. Director, Directorate of supply and Inspection পদে ছিলেন ১৯৭৩ সালে অবসর গ্রহন করেন)। মাতা মরহুমা সুফিয়া মজিদ গৃহিনী এবং সমাজ সেবিকা ছিলেন। তিনি আপওয়ার (Apwa-All Pakistan Women’s Association) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যা, ধানমন্ডী মহিলা সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। যার কার্যক্রম ছিল ধর্মীয় বিকাশের গবেষণা, সেবামূলক কাজ পরিচালনা করা এবং সিলাই প্রশিক্ষণ দান)। ১৯৭৫ সালের ১৬ই ডিসেম্বর তিনি ইন্তেকাল করেন। আমরা ৫ ভাই ২ বোন। এদের মধ্যে আমার স্থান চতুর্থ।

শুরুতে চট্টগ্রাম এম ই স্কুলের ছাত্র ছিলাম। পঞ্চম শ্রেনী থেকে অষ্টম শ্রেনী ঢাকার গভর্ণমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের ছাত্র। নবম/দশম শ্রেনী ধানমন্ডি সরকারী উচ্চ বালক বিদ্যালয়ের ছাত্র এবং স্কুল ক্যাপ্টেন। (ফুটবল, ক্রিকেট, হকিতে ইন্টার স্কুল প্রতিযোগিতায় স্কুলের ক্যাপ্টেন ছিলাম। স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত শান্তিনগর ক্লাবের নিয়মিত ক্রিকেটার)। ১৯৬৭ সনে ১ম বিভাগে ম্যাট্রিক (আর্টস) পাশ করি। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ঢাকা কলেজে বিএ ক্লাসে পড়ার সময় ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের সহ সভাপতি পদে নির্বভাচিত হই এবং গণ আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ি। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হই সত্তরে।

মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে আমি ঢাকা কলেজের বিএ (পাশ) ক্লাসের ২য় পর্বের ছাত্র ছিলাম। ছাত্রাবস্থায় সরাসরি রাজনীতির সাথে কোন অবস্থাতেই জড়িত হওয়া যায়না, তবুও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের একজন একজন সক্রিয় সমর্থক এবং ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত দাবীকে বাঙালি জাতীয় সত্তার সনদপত্র ধরে নিয়ে আন্দোলনের একজন সক্রিয় এবং একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে দ্বায়িত্ব নিয়ে কাজ করেছি। ছাত্র আন্দোলনে প্রথম দিকের সারিতেই ছিলাম।

১৩

আমার প্রথম ভাই মো. আব্দুস সালাম আমারই গ্রুপের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। বর্তমানে ব্যবসায় জড়িত।

আমার তৃতীয় ভাই মো. আব্দুর রউফ ২ নম্বর সেক্টরের মেলাঘরে ট্রেনিং গ্রহন করে আমারই গ্রুপে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অংশগ্রহন করে। পরে ‘৭৩ এ বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পুলিশ সার্ভিসে যোগ দেয় এবং বর্তমানে সে পুলিশের এস পি হিসেবে কর্মরত আছে।

আমার চারজন চাচাত ভাই এবং দুইজন ভ্রাতুষ্পুত্রও মুক্তিযুদ্ধে কসবা বুড়িচং এ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করে।

সত্তরের মাঝামাঝি এক্সকার্শন প্রোগ্রামে স্টুডেন্ট ডেলিগেট হিসেবে ৮ জন স্টুডেন্ট পাকিস্তানে গেলাম। প্রফেসর মহসীন (ঢাকা কলেজের পলিটিক্যাল সায়েন্সের লেকচারার ছিলেন বর্তমানে ফরেন সার্ভিসে চাকরিরত) লিডার হিসেবে ছিলেন।

আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকা সফর করি। সেসময় আমাদের রাওয়ালপিন্ডিতে কেন্দ্রের রাজধানী দেখানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। ইসলামাবাদ থেকে কয়েক মেইল দূরে শাক্কারপাড়িয়া বলে একটা পাহাড় আছে। সেই পাহাড়ে সন্ধ্যার পর নিয়ে যাওয়া হয় ইসলামাবাদ দেখানোর জন্য।

সেখান থেকে ইসলামাবাদ এতো সুন্দর দেখা যাচ্ছিল যাতে মনে হচ্ছিল যেন স্বর্গের কোন উদ্যান। সাথে সাথে আমার ঢাকার সেকেন্ড ক্যাপিটালের (বর্তমানে শের এ বাংলা -নগর সম্পাদক) কথা মনে পড়ে এবং তখন অনুভব করি আমাদের মাঝে ব্যবধান। পরিষ্কার অনুধাবন করতে পারি আমাদের কিভাবে শোষণ করা হচ্ছে। এ অনুভূতিটা আসার পরে ওদের আর আমাদের প্রভেদ দেখে চোখের পানি সম্বরণ করতে পারিনি, কেঁদে ফেলি।

আমার অবস্থা দেখে পশ্চিম পাকিস্তানি যে গাইড ছিল সে অবাক হয়ে আমাকে প্রশ্ন করে আমি কেন কাঁদছি। আমি তাকে ওদের আর আমাদের প্রভেদ টা বুঝাতেই সে আমাকে ইংরেজিতে উত্তর দিয়েছে, As a student noboby must have a ill feelings for their country’s capital, rather a student must be proud of his capital. আমার উত্তর ছিল, ‘May be it’s yours, not mine.’

সেই সফরকালেই দেখতে পাই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের দূরত্ব বা প্রভেদ কতোটুকু। আর আমরা বাঙালিরা কিভাবে শোষিত হচ্ছি। স্ট্যাটিস্টিকস দিয়ে প্রভেদ বুঝতে পারিনি। যতটুকু প্রভেদ বুঝতে পেরেছি তা ছিল তাদের ও আমাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থার বিভেদ, তাদের এবং আমাদের জীবনযাত্রার মানের প্রভেদ।

সত্তরের নির্বাচন ছিল বাঙালি জাতির একাত্মবোধের আর চৈতন্যদয়ের নির্বাচন। এরপর আলোচনার প্রহসন যখন চলছিল, তখনই আমরা ইকবাল হলে (বর্তমান জহুরুল হক হল) গঠন করি পূর্ব পাকিস্তান কলেজ ছাত্র সংসদ সহ সভাপতি পরিষদ। যার কার্যক্রম ছিল সমগ্র বাংলাদেশে একসাথে ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা। আমি উক্ত সংগঠনের যুগ্ম আহবায়ক নির্বাচিত হই।

১৪

একাত্তরের ফেব্রুয়ারীর মহান শহীদ দিবস উদযাপন ছিল সমগ্র বাঙালি জাতির ইতিহাসে একাত্মতা ঘোষণার এক ঐতিহাসিক দিন। শহীদ দিবস এত জাঁকজমক আর কোনদিন হয়নি। এরপর ইকবাল হলে সকাল বিকাল U.O.T.C. ক্যাডেটদের কাঠের রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণ। সেই উদ্দীপনা, সেই জাতীয়তাবাদের উন্মাদনা আজ আমাদের জাতির ভিতর দেখিনা।

৭৮ ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার দিন থেকেই আরম্ভ হয় একটা রণউন্মাদনা। আরম্ভ হয় প্রশিক্ষণ U.O.T.C. রাইফেল দিয়ে। V.P. কনফারেন্সে সিদ্ধান্ত হল ছাত্রদের প্রশিক্ষণের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সেই অনুযায়ী আরম্ভ হল কাজ।

২৪ মার্চ ক্রিকেট খেলতে গিয়ে আহত হই। এল ২৫শে মার্চ। বিকেলে অনেক কেন্দ্রীয় নেতারা আমার অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে দেখতে এলেন। রাত্রি ১১ টার সময় বঙ্গবন্ধুর ফুফাত ভাই ধানমন্ডি ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য শাখাওয়াত ভাই এসে বললেন আলোচনা ভেঙে গেছে। তাই সংগ্রাম করেই অধিকার আদায় করতে হবে। রাস্তায় আর্মি নেমেছে, ব্যারিকেড দাও। অসুস্থাবস্থা সত্তেও মা আমায় ধরে ধরে বাইরে নিয়ে এলেন। ফারুক (যার পরিচিতি ছিল চিকা গারুক নামে) সবাইকে ডেকে নিয়ে এলো। আমি গ্রীনরোড স্টাফ কোয়ার্টারের সিঁড়িতে আমার মায়ের সাথে বসে আছি। আমার নির্দেশে গ্রীনরোডের ছেলেরা ব্যারিকেড তৈরিতে ব্যস্ত। তিনটা ব্যারিকেড তৈরি হবার পর আরম্ভ হল সেই কাল রাত্রির ভীষণ গোলাগুলি। সবাইকে চলে যেতে বললাম। তারপর অপেক্ষার পালা। শেষ রাত্রিতে আর্মি এল গ্রীনরোডে। ঠেলাগাড়িওয়ালা, রিক্সাওয়ালা, দিনমজুর ধরে ধরে ব্যারিকেড সরালো ওরা, যাবার সময় ৪ জনকে সেই বযারিকেডের আবর্জনার স্তুপের উপর গুলি করে মেরে রেখে চলে গেল। ২৭ মার্চ সকাল পর্যন্ত ছিল কারফিউ। সকালবেলা কারফিউ কয়েক ঘন্টার জন্য তুলে নেওয়ার পর আরম্ভ হল আমার জীবনের নতুন এক অধ্যায়।

২৭ মার্চ সকালে কারফিউ তুলে নেওয়া হলে আমার মা, আমি, আমার ছোট দুই বোন আর এক ভাইকে নিয়ে শহীদ লেফটেন্যান্ট খন্দকার আজিজুল ইসলাম (বাবুল) বীর বিক্রমদের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানার বানিয়ারা গ্রামে পালিয়ে চলে যাই। বাবুল আমার স্কুল বন্ধু তাছাড়া ওদের পরিবারের সঙ্গে আমার পরিবারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা ছিল। বাবুলদের পরিবার/মন্টুদের পরিবারও সেই সাথে আমাদের সঙ্গী হয়েছিল। সেই অবস্থায় আমরা ১লা এপ্রিল পর্যন্ত বানিয়ারা থাকি। ২ এপ্রিল শুধু আমি, আমার মা ও ভাইবোনদের নিয়ে একটা ছোট গাড়িতে করে ঢাকা রওনা হই। মির্জাপুরে আসার পরে আর্মি কনভয়ের সামনাসামনি হই। আমার মা অনর্গল পাঞ্জাবী ভাষায় কথা বলতে পারতেন। আর্মির এক ক্যাপ্টেনের সাথে আম্মা কথা বলায় তারা আমাদের ছেড়ে দেয়, সেই সাথে একটা পাশ দিয়ে দেয় যাতে রাস্তায় কোন অসুবিধা না হয়। সেই পাশের সুবাদে অবশ্য রাস্তায় দুতিনবার আর্মি চেকপোষ্টের থামানো সত্তেও কোন অসুবিধায় পড়তে হয়নি। অবশ্য এই নিরাপদে আমাদের ঢাকায় আসতে পারার মূল কৃতিত্বটাই ছিল আমার মায়ের পাঞ্জাবী ভাষায় অনর্গল কথা বলার পারদর্শিতা।

১৫

যাই হোক সেই রাত্রিটা ঢাকাতে অন্য বাসায় অতিবাহিত করে পরের দিন ৩ এপ্রিল নরসিংদী হয়ে কুমিল্লা জেলার নবীনগর থানার বিটগড় গ্রামে মামার বাড়িতে চলে যাই। আমার এভাবে পালিয়ে বেড়াবার কারণ ছিল, যে কোন আমার এন্টি পাকিস্তান অ্যাক্টিভিটির কারণে আর্মির হাতে গ্রেফতার হবার ভয়।

গ্রামের বাড়ি যাওয়ার পথে দেখেছি হাজারো জনতার শহর ছেড়ে পালানোর হিড়িক। আর পথে পথে দেখেছি শত শত শবের স্তুপ। শবদেহ নিয়ে শকুনের কাড়াকাড়ি। পাশাপাশি মানুষের প্রাণ বাঁচানোর সে কি আর্তি। আবার বিস্ময় নিয়ে দেখেছি গ্রামের মানুষ কিভাবে অসহায় ভিটেছাড়া মানুষকে সর্বস্ব দিয়ে সাহায্য করছে। বাঁচবার আর বাঁচাবার সেই ছবি বাঙালি জাতির জীবনে দেশাত্মবোধের এক নজিরবিহীন অবিস্মরনীয় ঘটনা। জায়গায় জায়গায় মানুষের জন্য শেল্টার তৈড়ি করে ক্ষুধার্তকে অন্ন, তৃষিতকে জল আর আশ্রয়হীনের জন্য রাতের আশ্রয়- সে ছিল আমাদের জাতির ক্রান্তিলগ্নে এক একাত্মবোধের চরম দৃষ্টান্ত।

৩রা এপ্রিল গ্রামে পৌঁছানোর সংবাদ পেয়ে সমস্ত আত্মীয় স্বজন সকলেই এলেন দেখা করতে। সবার মুখে একটাই কথা ঢাকার খবর কি? অনেক রাত্রি পর্যন্ত সবার সাথে আলাপ আলোচনা হল। স্থির হল, আগামি দিন থেকে আমরা কাজে নামব। কাজটা হল গ্রামে গ্রামে যুবক/এক্স সার্ভিস মেন সমন্বয়ে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা এবং সবার মধ্যে একটা ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের সেতু গড়ে তোলা। সেই সাথে সবাই প্রস্তুত থাকা, যাতে কোন সময় কোন নির্দেশ এলে সেই মোতাবেক কাজে লেগে যাওয়া। আরো কর্মসূচী হল প্রতি বিকেলে কিছু কিছু শরীরচর্চা সেই সাথে সিভিল ডিফেন্স, আর শহর থেকে পালানো মানুষদে সহায়তা করা।

সেই সময়টা ছিল অবিরাম পরিশ্রম আর উন্মাদনার সময়। সারা এপ্রিল মাসটাই একইভাবে কাজ করে গেছি। সেই সময় আমার সাথে যারা কাজ করেছেন, তাদের মধ্যে আজো মনে পড়ে রুপন মাস্টার, মানিক ডাক্তার, খুরশীদ ভাই, নসু ভাই এদের কথা। পরবর্তীতে এরা সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এই রুপন মাস্টার যদি না থাকত, তবে অনেক অনেক মুক্তিযোদ্ধারই হয়তোবা ভারতের মাটিতে যাওয়া হতনা বা মুক্তিযোদ্ধা হবার সাধটাই মিটত না। রুপন মাস্টারের লোকেরাই নৌকা করে মুক্তিযোদ্ধাদের সি অ্যান্ড বি রোড পার করে দিত। আবার রাজাকারদের সাথে যোগাযোগ করিয়ে সি অ্যান্ড বির ওপার থেকে আরেক গ্রুপ রাতের আঁধারে একেবারে ভারতে পৌঁছে দিত। এভাবেই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে অনেক বড়ো আর মহৎ কাজ করেছেন। বিনিময়ে চান নাই বিন্দুমাত্র প্রতিদান। অথচ আজ তাঁরই ত্যাগী কর্মীরা বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছেন। এইসব কিছু নিবেদিত প্রাণ কর্মীর কারণেই আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম এতো সফলতা পেয়েছে। অনেক বীর যোদ্ধা নিয়ে গড়া হয় ইতিহাস আর রচনা হয় পালাগান। কিন্তু এদের কথা, যাদের জন্য বীরেরা তাদের সাফল্য পায়, তাদের ত্যাগ থেকে যায় সবার অগোচরে। এটাই নির্মম বাস্তবতা।

যাই হোক, গ্রামে গ্রামে সংগঠনের কাজ যখন করে চলেছি, তখন শরণার্থীরা জীবন বাঁচানোর জন্য পার্শ্ববর্তী রাজ্যের আগরতলার দিকে ছুটে চলেছে। আমার মামাবাড়ি

১৬

বিটগড় থেকে আগরতলার দূরত্ব প্রায় ১০/১২ মাইল। এই পথটুকু শরণার্থীরা যাতে নিরাপদে যেতে পারে, রাস্তা চেনার যাতে ভুল না হয় তার সমস্ত আয়োজন আমাদেরকেই সংগঠনের পাশাপাশি করতে হত। এরই মাঝে ঢাকা কলেজের ছাত্র হাসান মাহমুদের সাথে গ্রামের বাজারে দেখা। সময়টা বোধকরি এপ্রিলের শেষভাগ। ও আমাকে ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক মাখন ভাইয়ের একটা চিঠি দিল। চিঠিটা আমার উদ্দেশ্যে আগরতলার কলেজটিলা ছাত্রাবাস থেকে লেখা। আমাকে ফিরে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। যাই হোক, হাসানকে নিয়ে বাড়ি এলাম। রাত্রিবেলা মা কে সবকথা খুলে বলতেই তিনি নির্দেশ দিলেন যাওয়ার জন্য।

পরদিন কসবার মনিঅন্দ গ্রামের ছেলে নাসিম কে নিয়ে চারগাছ-রাওথাট-মনিঅন্দ-কসবা হয়ে আখাউড়া চেকপোস্টে গেলাম। ওখানে দেখা হল এম এন এ দেওয়ান আবুল আব্বাসের সাথে তিনি আমাকে খাওয়া দাওয়া করিয়ে একজন লোক সহ পাঠালেন আগরতলার শ্রীধর ভিলায়। ওখান থেকে চলে এলাম কলেজ টিলার ছাত্রাবাসে আমাদের থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত হল।

৮/১০ দিন সেই ছাত্রাবাসে থাকাকালীন সময়ে অনেকের সাথেই দেখা সাক্ষাত হয়েছে। এবং অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখগি হয়েছি। একদিকে দেখেছি সাধারণ গ্রামের অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত ছেলেদের মুখে নিরন্তর একটাই প্রশ্ন এখন আমাদের কী করনীয়, আমাদের দেশের কী হবে, আবার পাশাপাশি দেখেছি একদল ছেলে যারা শিক্ষিত এবং অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে, পারফিউম মেখে, দামী জামাকাপড় পরে, ছবি পাড়ায় গিয়ে ছবি দেখে গল্প গুজবে নিরুদ্বিগ্ন সময় কাটাতে। দেখে মনে হত যেন তারা আনন্দ ভ্রমণে এসেছে। অবাক হতাম এদের দেখে। মজা লাগত মাখন ভাইকে দেখে। উনি না তাদের ঠিকমত সামাল দিতে পারছেন, না সাধারণ ছেলেদের জন্য কিছু করতে পারছেন।

৮/১০ দিন পর মেজর খালেদ মোশাররফ এলেন লে. কবিরকে সাথে নিয়ে কলেজ টিলায় মাখন ভাইয়ের রুমে। মাখন ভাই আমায় ডেকে পাঠালেন। আমি তাদের সব আলাপ আলোচনা শুনলাম। তখনই জানতে পারলাম ছাত্র/যুবকদের সমন্বয়ে মুক্তিযোদ্ধা/গেরিলা দল গঠন করা হবে। আমি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যোগ দেবার আগ্রহ দেখানোতে খালেদ মোশাররফ সাহেব মাখন ভাইকে বলে গেলেন আমাদের পাঠিয়ে দেবার জন্য।

পরদিন (দিন, তারিখ,ক্ষণ মনে নাই। আনুমানিক মে মাসের মাঝামাঝি) সকালবেলা কলেজটিলায় অবস্থানরত সবাইকে ডেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যোগ দেওয়ার জন্য আহবান জানানো হল। তখন কলেজ টিলায় আশ্রয় গ্রহনকারী আমাদের সংখ্যা প্রায় ৮০/৯০ জন। তাদের মধযে ৪০/৪৫ জন তাদের আগ্রহ ব্যক্ত করল মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ নিতে। অবাক হলাম, এরা সবাই অরাজনৈতিক, গ্রাম্য, অর্ধশিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত এবং অশিক্ষিত ছেলে। যারা যেতে চাইলনা তারা সবাই শহুরে, শিক্ষিত, অবস্থাপন্ন ও রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ। পরে এদের কেউ কেউ মুজিব বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল বলে জানতে পারি।

১৭

যাই হোক মাখন ভাই আমার সাথে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর সেদিন সন্ধ্যার পর একটা ট্রাকে করে আমরা বিএসএফ ক্যাম্প এর উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে রাত্রি প্রায় ১০ টায় পৌঁছাই। রাত্রি বলে আমাদেরকে পরেরদিন যাবার কথা বলে বিদায় দেওয়া হল। চলে এলাম সোনামূড়া। সারারাত সোনামূড়া হাইস্কুল মাঠে শুয়ে বসে সময় কাটিয়ে পরদিন ৬ মাইল পথ হেঁটে আমরা সবাই মতিনগর বি এস এফ ক্যাম্পে পৌঁছালে ওখান থেকে পথনির্দেশক নিয়ে পাহাড়ের ভিতর দিয়ে হেঁটে বাংলাদেশ আর্মির ক্যাম্পের আউটপোস্টে এলাম। বেলা প্রায় ৩ টার দিকে লে. দিদারুল আলম এলেন, এবং সবার সাথে আলোচনা শেষে বাছাই পর্ব শেষ করলেন। আমার নিয়ে যাওয়া ছেলেদের মাঝ থেকে ৬/৭ জন বাদ পড়ল। ওদের আহাজারিতে অনুরোধ করতে গিয়েও কোন কাজ হলোনা। শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যার সময় পাহাড়ের মাঝ দিয়ে উপর দিয়ে হেঁটে ক্যাম্পে পৌঁছালাম। সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল আরেক বিস্ময়। আমার ছোটবেলার খেলার সাথি নজরুল, হেলাল, মন্টু, হায়াত এরা সবাই সেই ক্যাম্পে আগে থেকেই আছে। ঠিক তখনকার সেই ত্যক্ত বিরক্ত পরিস্থিতিতে ওদেরকে পেয়ে আমি আত্মহারা। ওরাই তখনকার মত নিজ থেকে আমার থাকা আর খাওয়ার দ্বায়িত্ব নিয়ে নেয়। ফলে আমার দিশেহারা অবস্থায় পড়তে হয়নি।

পরদিন সকাল থেকেই আরম্ভ হল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণকালীন জীবনের। সকালবেলা চা আর পুরি খাওয়া শেষ হতে না হতেই ফল ইন (লাইন করে কাতারে দাঁড়ানো) এর ডাক। সবাই গিয়ে দাঁড়াতেই আরম্ভ হলো মাথা গোনা। এর মধ্যে এলেন মেজর শাফায়েত জামিল। এক এক করে আমাদের সাথে পরিচিত হয়ে সবাইকে সংক্ষিপ্তভাবে বুঝিয়ে দিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বায়িত্ব, প্রশিক্ষণ ও কর্তব্য সম্পর্কে। তারপর এলো গ্রুপ ভাগের পালা। তখন আমাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০০ জন (নন রেগুলার ফোর্স/সিভিলিয়ন)। মেজর শাফায়েত জামিল জানতে চাইলেন, আমাদের মাঝ থেকে কে কে কমান্ডার হতে ইচ্ছুক। এটা শুনে কয়েকজন হাত উঠালো। উনি তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে বললেন। আমি হাত উঠাইনি, কিন্তু আমার বন্ধুরা, আর যাদের আমি সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম, সেই ছেলেরা সবাই সমস্বরে আমার নাম বলে আমাকে ধাক্কায় লাইনের সামনে ঠেলে দেয়। মেজর শাফায়েত আমার সমস্ত পরিচয় আমায় কোম্পানী কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ করেন। আমার টুআইসি নিযুক্ত করেন ক্যান্টনমেন্টের সালাউদ্দিনকে আর অ্যাডজুটেন্ট নিযুক্ত হয় মঞ্জুর মওলা। এছাড়া সমস্ত ছেলেদের চার ভাগে ভাগ করে গঠন করা হল ৪ টা প্লাটুন। এবং সেই সাথে ৪ টা প্লাটুনের ৪ জন কমান্ডার নির্বাচন করা হল। এরপর আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল মনির উস্তাদের সাথে যিনি প্রাথমিক আমাদের প্রশিক্ষণ দেবেন।

পরদিন থেকে শুরু হল আমাদের গ্রেনেড আর এক্সপ্লোসিভ নিয়ে প্রশিক্ষণ। এভাবে ১০/১২ দিন কেটে যাবার পর আমাদের গ্রেনেড আর এক্সপ্লোসিভ ট্রেনিং শেষ হবার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে মুক্তিযোদ্ধাদের কিছু কর্মকান্ড আরম্ভ হবার প্রয়োজন আছে দেশের অভ্যন্তরে। কেননা মোটামুটি পাক বাহিনী তখন বর্ডার এলাকা গুলোতেই কিছু কিছু কর্মকান্ডের সম্মুখীন হচ্ছে। ঢাকা শহর বা এর আশে পাশে তখনো পর্যন্ত কোন

১৮

প্রতিরোধ কার্যক্রম গড়ে ওঠেনি। সেই সাথে মুক্তিযোদ্ধা যারা প্রশিক্ষণ শেষে দেশের অভ্যন্তরে ফিরে যাবে, তাদের আশ্রয়, আহার যোগান, অগ্রীম তথ্য সরবরাহের জন্য দেশের অভ্যন্তরে পকেট সৃষ্টি করবার চিন্তার ফলে জন্ম হল ভিত্তি ফৌজ। এদেরকে সরবরাহ করা হল গ্রেনেড, কিছু এক্সপ্লোসিভ আর প্রত্যেকের জন্য দেওয়া হল কমান্ডো নাইফ (ছুরি)। মতিনগর থেকে যে দলটা বাংলাদেশে গেল সেই দলে ছিল নজরুল, হায়াত, জলিল, হেলাল, মন্টু আরো প্রায় ২০/২২ জন। এদের সনবাইকে এদের দ্বায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে পাঠানো হল। পরবর্তীতে এরা আমাদের অনেক কাজে আসে।

এর মাঝে এলেন আমাদের (ছাত্রদের) সার্বক্ষণিক দ্বায়িত্ব নিয়ে ক্যাপ্টেন হায়দার। পরবর্তীতে যুদ্ধ চলাকালীন শেষ পর্যায়ে মেজর পদে উন্নীত হন। উনি আসার পর আমাদের ট্রেনিং আরো সুসংগঠিত ও আরো গতিবেগ অর্জন করে। উনার সাহায্যে কাজে হাত দেন পিডিবির ইঞ্জিনিয়ার মমিনুল হক ভূঁইয়া। এর মাঝে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে খবর এলো আমাদের ঢাকায় কিছু অপারেশন করতে হবে। কেননা জাতিসংঘ থেকে ৭ ই জুন পর্যবেক্ষণ দল ঢাকায় আসবে অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য। ওদের সামনে প্রমাণ করতে হবে যে আমরা আমাদের জাতীয় স্বাধীকার আদায়ের জন্য লড়ছি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে এদেশের মাটিতে, এটা বিশ্ববিবেকের কাছে আমাদের প্রমাণ করতে হবে। সেই মোতাবেক ৪ জন করে এক একটি দল মোট ১০ টি দল গঠিত হল। ভূঁইয়া সাহেব হায়দার সাহেবের প্ল্যান অনুযায়ী ঢাকার বিদ্যুৎতসরবরাহ বন্ধ করে দিতে হবে। আমাদের প্রত্যেক গ্রুপকে ৪ টা গ্রেনেড, ৩০ পাউন্ড প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ আর একটি করে স্টেনগান দেওয়া হল।

আমরা ৪২ জনের দল ৬ তারিখ (জুন) মনতলি ক্যাম্প হয়ে আমার মামাবাড়ি হয়ে আড়াইহাজার থানার গোপালদিতে এম. পি. সফর আলী সাহেবের বাসায় খাওয়া দাওয়ার পর ১০ টা দলে বিভক্ত হয়ে যার যার অপারেশন স্থলের দিকে রওনা দিলাম। অপারেশনের সময় নির্ধারণ করা হল রাত্রি দুইটা। প্রত্যেককে ১ টা করে টার্গেট আবার একটা বিকল্প টার্গেট দেওয়া হয়েছিল। আমার দলে এল মাতুয়াইলের অলি, ঢাকার বাবুল (আজিজুল ইসলাম বাবুল, পরবর্তীতে লেফটেন্যান্ট পদে যোগ দেন এবং কসবায় শহীদ হন) আরো একজন যার নামটা ঠিক এ মুহুর্তে মনে পড়ছেনা। আমাদের উপর নির্দিষ্ট করা ছিল যাত্রাবাড়ির ইলেক্ট্রিক সাব স্টেশান ধ্বংস করা।

রাত্রি ১২ টার দিকে যাত্রাবাড়ি সাব স্টেশনে পৌঁছে দেখতে পেলাম আর্মির ক্যাম্পে প্রায় ২০ জন আর্মি আছে। আরো আছে দুইটা দুইটা মেশিনগান পোস্ট। আমাদের কাছে মাত্র ১ টা স্টেনগান। বাধ্য হয়েই যেতে হল বিকল্প টার্গেট সায়েদাবাদ ব্রীজের নিচ দিয়ে নিয়ে যাওয়া মেইন ইলেক্ট্রিক কেবল লাইন ধ্বংস করতে। টার্গেটে গিয়ে পৌঁছাতে আমাদের সময় ঘনিয়ে গেল। ব্রীজের নিচে যখন আমরা এক্সপ্লোসিভ কেবলে লাগাতে ব্যস্ত তখনই প্রথম আওয়াজ (বিস্ময়কর বিস্ফোরণ) শুনতে পেলাম। যাই হোক অভিজ্ঞতার অভাবে সমস্ত এক্সপ্লোসিভ (৩০ পাউন্ড) লাগিয়ে দিয়ে সেফটি ফিউজে আগুণ দিয়ে ছুট। অনেকদূর ছুটে এলাম, তবুও বিস্ফোরণ হচ্ছেনা। ফিরে যাব কিনা ভাবছি এমনি সময়

১৯

বিদ্যুত চমকের আলো দিয়ে ঘটল প্রচন্ড বিস্ফোরণ যার ধাক্কায় আমরা ৪ জনই প্রপাত ধরনীতল। ৫ পাউন্ড হলেই কাজ হত অথচ দিলাম ৩০ পাউন্ড। অবস্থা সহজেই অনুমেয়। সায়েদাবাদ ব্রীজে মারাত্মক ফাটল ধরে যায় ঐ এলাকার বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন হল। এরপর আমরা পালিয়ে যাই। পরদিন ঢাকায় ঢুকতে গিয়ে টের পাই, ব্রীজের উপর দিয়ে যান চলাচল বন্ধ। ব্রীজ ফেটে গিয়েছে আর ৩টা মারাত্মক ছিদ্র হয়ে গেছে। ঢাকায় দুইদিন থেকে আবার ফিরে যেতে হল ক্যাম্পে।

ক্যাম্পে আসার পর থেকে আমাদের অবস্থার উন্নতি হতে থাকল। এর মাঝে আমাদের জন্য ভারত সরকার অস্ত্র গোলাবারুদ সরবরাহ করল। মাঝখানে আমাদের এক রাতের মধ্যে পাক বাহিনীর হামলার ভয়ে এবং দুই নম্বরের পার্মানেন্ট হেডকোয়ার্টার গঠন করবার জন্য মতিনগর থেকে রুদ্র সাগরের কাছে মেলাঘরে ক্যাম্প স্থানান্তর করতে হল। অনেক খাটাখাটনির পর জঙ্গল পরিষ্কার করে (জঙ্গল আমরা পরিষ্কার করেছিলাম) ভারতীয় ঠিকাদারের সহায়তায় নির্মিত হল মেলাঘর ক্যাম্প।

এই ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকেই সমস্ত পরিস্থিতি সুশৃংখল হয়ে উঠল। অস্ত্র সরবরাহ, খাওয়ার মান, অ্যাডমিনিস্ট্রেশান সবকিছুতেই বিশৃংখল ভাব কেটে গিয়ে একটা সুশৃংখল অবস্থা ফিরে এলো। ছেলেদের থাকার জন্য ব্যারাক তৈরি হল (ভারতীয় ঠিকাদারের সহায়তায়)। ট্রেনিং প্রোগ্রামেও অনেক পরিবর্তন এল। ট্রেনিং তখন পুরোদমে এগিয়ে যাচ্ছে। রাত্রি বেলায়ও আমাদের ট্রেনিং চলছিল। এর মধ্যে অবশ্য কিছু বৈসাদৃশ্যের অবতারনা যে হয়নাই এমন নয়। ক্যাম্পে অনেক নতুন ছেলে যোগ দেওয়াতে আমাদের প্লাটুন সংখ্যা বাড়িয়ে ১৬ তে উন্নীত করা হল। এর মধ্যে ৭ নং প্লাটুন, যেটার কমান্ডার ছিল মায়া (বীরবিক্রম), যার মধ্যে সবই ছিল ঢাকা শহরের ছেলে, আর কিছুটা অবস্থাপন্ন পরিবারের ছেলে, এছাড়াও ছিল স্পীকার জাব্বার খান সাহেবের ছেলে বাদল ভাই, রুমী, মুনীর চৌধুরীর ছেলে ভাষণ, সাহিত্যিক খন্দকার ইলিয়াসের ছেলে সানি, আলম, সাইদ, গাজী দস্তগীর, মাশুক, বকুল, নজীব এবং আরো অনেকে। এদের পোষাক-আশাক, চালচলনে ছিল কিছুটা অহংবোধ, আর তাদের আমিত্ব আর আভিজাত্যের সামনে অন্য সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থা ছিল ম্লান। ফলশ্রুতিতে ছিল তাদের প্রতি সেক্টরের অফিসারদের কিছুটা পক্ষপাতদুষ্টতা। শ্রদ্ধেয় হায়দার ভাইও এর বাইরে আসতে পারেননি। এককথায় They were the priviledged class freedom fighters. পরবর্তীতেও দেখা গেছে তারাই সবচেয়ে উন্নত মানের অস্ত্র এবং অন্যান্য সুবিধা সবচাইতে বেশি ভোগ করত। সবার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই ভাবি, এই বৈষম্য কী লাভ দিতে পেরেছে আমাদের জন্য জাতিগতভাবে, আমি জানিনা। পরবর্তীতে দেখেছি এই প্রিভিলেজড ক্লাস টার প্রচার অত্যন্ত প্রকট।

আমি সবসময়ই একটু বিচলিত। কেননা আমি বোধ হয় ছাত্রলীগের ছেলে হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম, মুজিব বাহিনীতে না গিয়ে। এজন্য হয়তবা কিছুটা উপেক্ষিতও ছিলাম। তবে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আমি ছিলাম সবচাইতে আদরনীয় আর গ্রহনযোগ্য। কেননা যখনই খাবার জন্য পানি আনা বা লাকড়ি আনতে যেতে লোক পাওয়া যেত না, তখন হয়তো আমি একাই গেছি কাজ করতে, ভীষণ বৃষ্টির মধ্যে

২০

(কাজগুলো ছিল ভীষণ কঠিন আর কষ্টসাধ্য) তখন লজ্জায় পড়ে ৫০/৬০ জন ছেলে সব উপেক্ষা করেই কাজে লাগত, দরকার ১০/১৫ জন, কিন্তু হয়ত ৫০/৬০ জনই কাজে হাত লাগাত, আমি হাত লাগিয়েছি বলে। এভাবেই আমাদের ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন কাজে ফেটিগ (সাহায্যকারী) হিসেবে কাজ করতে হয়েছে।

আমি আমার এই সাধারণ ট্রেনিং এর পাশাপাশি নৌ কমান্ডো (মেলাঘরে ২০ জন ট্রেনিং নিয়েছিলাম) ট্রেনিং চালিয়ে যাচ্ছিলাম। প্রতিদিন মেলাঘর হতে সোনামুড়া দৌড়ে যেতে হত আর দৌড়ে ফিরে আসতে হত প্রায় ১৪ মাইল পথ। রোদ গলা পীচের রাস্তায় মাঝে মাঝে খালি গায়ে শুয়ে বিভিন্ন প্রকার ব্যায়াম।

তারপর রুদ্রসায়রে মাঝখানে আগরতলা রাজার (জরাজীর্ণ বাগানবাড়ি) সাঁতার/ডব সাঁতার সেই সাথে এক্সপ্লোসিভ আর মাইন নিয়ে ট্রেনিং। অবশ্য ওস্তাদ দের কাছ থেকে চুরি করে এক্সপ্লোসিভ ফাটাতাম রুদ্রসায়রে। অনেক ছোট ছোট মাছ পেতাম। গামছা দিয়ে ছেঁকে সব ধরে নিয়ে ফিরতাম ক্যাম্পে। কেননা ক্যাম্প থেকে কোনদিন মাছ খেতে পেতাম না। রাতের বেলা চুরি করে সেই মাছ রান্না করা এর মাঝে ছিল অবৈধ কাজ করবার একটা রোমাঞ্চকর সুখানুভূতি। তারপর সবাই মিলা খাওয়া। এই আনন্দময় অভিজ্ঞতা আজ শুধু স্মৃতি রোমন্থন করবার মতোই ঘটনা আমার জীবনে।

এভাবেই একদিন আমাদের ট্রেনিং পর্ব সমাধা হল। এবার সত্যিকারভাবে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমাদের পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে সার্বক্ষণিক যুদ্ধের জন্য দেশে ফেরার পালা। অনেকদিন অনেক জানা অজানা মুক্তিকামী ছেলের সাথে সুখে দুঃখে নানা অভিজ্ঞতায় সময় কাটিয়ে অলিখিত আর সম্বন্ধহীন সম্পর্ক স্থাপন করে অবশেষে আমাদের দেশ মাতৃকার স্বাধীকার আদায়ের জন্য নিজ জীবনকে দেশের জন্য উৎসর্গ করতে দেশে ফেরার সময় হল। মুক্তিযোদ্ধা (প্রশিক্ষণ) জীবনের হাসি, আনন্দ, কান্নার সময়ের ইতি ঘটিয়ে এখন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে আমরা প্রস্তুত হলাম। আমাদের জীবনের প্রধান অধ্যায় শুরু করবার সময় এসে গেছে। আমরাও সর্বোতভাবে প্রস্তুত।

ট্রেনিং শেষে এবার দেশে ফেরার বা ক্যাম্প থেকে বিদায় নেবার পালা। একদিন রাত্রিবেলা (আমার আজ আর তারিখগুলো সঠিক মনে নেই। সম্ভবত জুলাই মাসের শেষদিকে) ভারতের ওম্পিনগর থেকে ৩০০/৪০০ ছেলে তাদের ট্রেনিং শেষে বাংলাদেশে ঢুকবার জন্য এবং আর্মস নেবার জন্য মেলাঘরে এলো। ওদের থাকা এবং খাবার বন্দোবস্ত হঠাত করতে গিয়ে বেশ বিশৃংখলার সৃষ্টি হয়। যাহোক ওম্পিনগর ছেলেদেরসহ আমাদের ছেলেদের নিয়ে ১৫/২০ জনের এক একটা গ্রুপ তৈরি করে ঢাকা জেলা, নোয়াখালী জেলা, কুমিল্লা জেলা এবং ফরিদপুর জেলার বিভিন্ন থানায় পাঠানো শুরু হল।

আমাদের ট্রেনিং চলাকালীন সময়ে যেই ছেলেগুলো আমার সার্বক্ষণীক সঙ্গী ছিল, তারা সবসময় ভাবত যে, যুদ্ধকালীন সময়েও তারা আমার সাথে থাকবে। এদের মাঝে কিছু বাচ্চা ছেলেও (ফোর ফাইভের ছাত্র, যাদেরকে Y প্লাটুনের ছেলে বা হায়দার ভাইয়ের আদর করে দেয়া নাম Walkie Talkie বলা হত, তারা আমার সামগ্রিক তত্ত্বাবধানে থেকেই ট্রেনিং নিয়েছে এবং এরা এত ছোট ছেলে ছিল যে এদের প্রতি সবসময় সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয়েছে।

২১

সবার পাশাপাশি আমার স্নেহ পেয়েছে প্রচুর বিধায় ওরা ছিল প্রচন্ডভাবে আমার ভক্ত। (এদের মধ্যে গ্রীন রোডের হাসান, প্রদীপ, শাহজাহান, বিচ্ছু প্রমুখ উল্লেখযোগ্য)। ভাবতো যুদ্ধকালীন সময়ে আমার সাথে থাকবে আর যুদ্ধ করবে। ক্যাম্পের সবাই জানতো কারা কারা আমার সাথে দেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধ করতে যাবে। কিন্তু কার্যত দেখা গেল এক এক করে সবাইকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে অন্যান্য গ্রুপের সাথে জড়িয়ে দেওয়া হল। বিদায় নেবার সময় সবার সেই কান্নার কোন উত্তর ছিলনা। একমাত্র ইন্ডিয়ান ফারুক (আমাদের ক্যাম্পে তিনজন ফারুক ছিল। তাই নাম ডাকার সুবিধার্থে এই ব্যবস্থা। পরবর্তীতে ঐ নামেই পরিচিত হয়) আমার সাথে থেকে যায়।

একে একে সবাই বিদায় নিল। মায়া, কাজী ভাই, আলম, পিনু, লতিফ, আব্বাস, সালাহউদ্দিন, গিয়াস, জয়নাল, রাজা সবাই যার যার দল নিয়ে বিদায় নিল। কিন্তু আমারতো আর ডাক আসেনা। শেষ পর্যন্ত কর্নেল ওসমানী, আব্দুল মালেক উকীল, শেখ ফজলুল হক মনি আর ইন্ডিয়ান আর্মির একজন লে. জেনারেল (নাম মনে নাই) মেলাঘর পরিদর্শনে এলেন। ততদিনে আমি ত্যক্ত বিরক্ত। কেননা সবাই যাওয়া সত্ত্বেও আমাকে যেতে দেওয়া হচ্ছেনা বা কোন সদুত্তরও পাচ্ছেনা। এমতাবস্থায় তাদেরকে আমার অবস্থা জানানো ছাড়া কোন গত্যন্তর ছিলনা। (অবশ্য আমাকে ভিতরে না পাঠানোর কারনটা পরে অনুমান করতে পারি যে, হয়তবা আমি ছাত্রলীগের ছেলে বলেই এই উপেক্ষা)। উনারা সব শুনে নির্দেশ দিলেন, সেদিনই আমাকে ঢাকায় Dhaka city Commander of Freedom Fighters হিসেবে নিযুক্ত করে পাঠাতে।

যাই হোক ওম্পিনগরের ট্রেনিং প্রাপ্ত ১০ জন, যাদেরকে আমি আগে দেখিনি তাদেরসহ ফারুক আর আমি মোট ১২ জনকে দিয়ে একটা দল তৈরি করে সন্ধ্যাবেলা মনতলীতে ক্যাপ্টেন আইনুদ্দিনের ক্যাম্পে পৌঁছে দেওয়া হল দেশে ঢোকার জন্য। ক্যাপ্টেন আইনুদ্দিন সেদিন আমার দলের অস্ত্র দেখে একটু অবাকই হয়েছিলেন কেননা আর যারা ওখান দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে গিয়েছিলেন তাদের কাছে আমার চাইতে অনেক উন্নতমানের অস্ত্র ছিল। আমার সেদিনকার অস্ত্র ছিল একটা Repeat Shot SLP. ৩টা SLR, ৪ টা ইন্ডিয়ান SMC, ৪টা 303 Rifle, কিছু মাইন, গ্রেনেড, এক্সপ্লোসিভ  Phosphorus bomb অথচ সবার কাছেই ১/২ টা করে LMG আর অন্যান্য ভালো ভালো weapon ছিল। গিয়াস ৫৬ মিলিমিটার বেন্ডেসাইড, কাজী ভাই Rocket Launcher, 2″ Mortar LMG, আলম  Chinese SMG (যেটা একজন মুক্তিযোদ্ধার পরম কামনা বা স্বপ্নে পাওয়া ধনের মতই অস্ত্র ছিল) পেয়েছিল। অথচ আমাকে দেওয়া হয়েছিল সবচেয়ে কম ক্ষমাশীল অস্ত্র। (অনেকে ১/২ টা পিস্তলও পেয়েছিল)। কারণটা আজও আমার কাছে অস্পষ্ট।

যাই হোক ক্যাপ্টেন আইনুদ্দিন আগ্রহ করে আমার দলকে সিএন্ডবি রোড (তৎকালে এটাই ভারত বাংলাদেশ বর্ডার বলে পরিচিত) পার করে দেবার বন্দোবস্ত করেছিলেন। উনার কাছে আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ কেননা উনি সাহায্য না করলে হয়তোবা আমার মত আরো অনেকেরই নিরাপদে বাংলাদেশে প্রবেশ করা দুঃসাধ্য হত। সময়টা সম্ভবত আগস্ট মাসের প্রথম ভাগ। নৌকায় করে দুই দিন দুই রাত্রি চলে অবশেষে তৎকালীন রূপগঞ্জ

২২

থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বশীরের তত্ত্বাবধানে আমাদের থাকা আর খাওয়ার বন্দোবস্ত করা হল। আমরা যখন বাংলাদেশে প্রবেশ করতে রওনা হচ্ছিলাম, তখন কর্মপদ্ধত সম্পর্কে আমাদের একটা ব্রিফিং দেওয়া হয়েছিল। তাতে বিশেষভাবে বলা হয়েছিল যে অনেক ছেলেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রয়ে গিয়েছে, তারা হয়ত সুযোগের অভাবে ভারতে আসতে পারছেনা বা মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং নিতে পারছেনা। সেই সাথে এলাকায় এলাকায় সংবাদ পাওয়া এবং চলাচলের সাহায্য করতে পারবে এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করতে চায় এমন সব ছেলেকে যেন আমরা ট্রেনিং দিয়ে আমাদের সার্বিক স্বার্থে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ব্যবহার করি। আমাদের করনীয় ছিল, যুদ্ধকালীন সময়ে, এমন রিক্রুট ছেলেদের নামের তালিকা তৈরি করে মেলাঘরে সেক্টর হেডকোয়ার্টারে হায়দার ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দেব। তারাও পরে মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিগণিত হবে।

যাই হোক, থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত হওয়ার পর, একজন দুইজন করে ঢাকায় পাঠানো আরম্ভ হল। ওদের কাজ ছিল হাইড আউট তৈরি করা, এবং সংবাদ সংগ্রহ করা। ৮/১০ দিন পর আমার জন্য হাইড আউট নির্ধারণ করা হল ঢাকার ঢানমন্ডি, ভূতের গলি মসজিদের কাছে একটা বাড়িতে। নিরিবিলি জায়গা। ওখানে চলে আসলাম। আমার ধারনা আশেপাশে ৮/১০ টা বাড়ির লোকজন আমাদের কথা জানত। কিন্তু ওরা পাকিস্তানিদের বলেনি। শুরু হল যোগাযোগ। আমার ৮ জন ছেলেকে পূর্বগ্রামে রেখে মাত্র ৪ জন নিয়ে ঢাকার হাইড আউটে আসলাম। ওখানে আসার পর যোগাযোগ হল প্লাটুনের হাসানের সাথে। নতুন যোগ দিল মেহমুদ, মান্নান, দুলাল, খালেদ, চিকা ফারুখ।

ওখানে ৫/৭ দিন হাইড আউটে থাকার পর একদিন সংবাদ পেলাম যে প্রতিদিন পাক আর্মির একটা জিপ গ্রীন রোড দিয়ে রাত্রি ১২ টা ১ টার দিকে ফার্মগেট এর দিকে যায়। আমরা বুঝতে পারলাম যে ঐ জিপে সম্ভবত ২/১ জন অফিসার থাকে যাদের কাজ হল জায়গায় জায়গায় যে চেকপোস্ট আছে তার ডিউটি তদারক করা। যেহেতু অফিসার আছে সেহেতু চাইনিজ স্টেঙ্গান থাকবেই। আমার জীবনের একটা স্বপ্ন একটা চাইনিজ স্টেনগানের গর্বিত মালিক হওয়া। অতএব ঐ জিপটাকে মারতে পারলে হয়ত আমার জীবনের একটা স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। তাই সমস্ত দ্বিধা সংকোচ দূর করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, ঐ রাতেই আমরা অ্যাকশানে যাব।

সেই মোতাবেক রাত্রি ১১ টার সময় আমি আব্দুল্লাহ, মেহমুদ, মান্নান, দুলাল, ইন্ডিয়ান ফারুক, খালেদ বেরুলাম। অস্ত্র বলতে ৪ টা ইন্ডিয়ান স্টেন, একটা রিপিট ফায়ার এস এল আর, দুইটা এস এল আর, এবং এপি ৪ মাইন ও কইয়েকটা গ্রেনেড। তখন সারা ঢাকায় রাত ৮ টা ৯ টা থেকেই কার্ফিউ থাকত। অতএব আমরা যখন বেরুলাম তখন চারিদিকে নীরব, নিথর, সুনসান। দুয়েকটা কুকুর শুধু জেগে আছে। আমরা এসে স্থান নিলাম গ্রীন রোডের মাঝামাঝি জায়গায় যেখানে বর্তমানে একটি হোটেল (তখন সেটা মাত্র এক তলার ছাদ ঢালাই হয়ে লিন্টেল লেভেল অর্থাৎ দুতলা পর্যন্ত ইটের গাঁথুনি ছিল) বর্তমানে চায়না গার্ডেন রেস্টুরেন্টের উল্টাদিকে ঐ একতলা বিল্ডিং এর ছাদে পজিশান নিলাম।

২৩

একতলা ছাদ হতে নিচের ফুটপাত মাত্র কয়েক হাত নিচে অবস্থিত। সবার পজিশান নেওয়া হলে আমি ডব্লিউ শেপ আকারে ১৬ টি ‘এপি ৪’ মাইন গ্রীন রোডে পেতে রাখলাম। তাড়াহুড়োয় পিন খোলার কথা মাথায় ছিলনা। ডব্লিউ আকারের ববি ট্রাপ তৈরি করে ছুটে ছাদে এলাম। মেহমুদের দ্বায়িত্ব ছিল আমার ইঙ্গিত পাওয়ার পর গ্রেনেড ছোড়ার।

কিছুক্ষণ পর দেখলাম সায়েন্স ল্যাবরেটরির দিক থেকে দুটো হেড লাইটের আলো দ্রুত এগিয়ে আসছে। রাস্তা ফাঁকা, ওটা ছিল জীপ। ঝড়ের গতিতে ৬০/৭০ মেইল বেগে আমাদের সামনে দিয়ে চলে গেল। আমরা সবাই হতবাক। এমনি সময় হঠাত মনে হল মাইন গুলোর পিন খোলা হয়নি। আবার অন্ধকারের মধ্যে মান্নানকে সাথে নিয়ে দৌড়ে গেলাম পিন খুলতে। তখনকার সেই উত্তেজনা আর বুকের ভিতর ধুকপুক আওয়াজ আজও মনে হয় শুনতে পাই। যাই হোক পিন খোলার কাজ প্রায় শেষ করে এসেছি, এমন সময় দূরে আবারো দুইটি হেড লাইটের আলো। (এদিকে আমরা পজিশন নেবার আগে গ্রীন রোডের দুইজন বিহারী নাইট গার্ডকে হাতপা বেঁধে ঐ ছাদের উপর আটকে রেখেছিলাম। যা হোক আলো দেখে পড়িমড়ি ছুটে এসে আবার পজিশন নিলাম। গাড়ি এসে পড়ল। অন্ধকারে ঠাহর করতে পারিনি কি গাড়ি ওটা। এসেই সামনের একটা চাকা মাইনের উপর পড়তেই গাড়ি ঘুরে গিয়ে সোজা আমাদের বরাবর এগিয়ে আসতে লাগল। এদিকে আমি কিছু বলার আগেই মেহমুদ গ্রেনেড ছুড়ে মেরেছে। আমাদের ভাগ্য অত্যন্ত ভাল, গাড়িটা ছিল বেডফোর্ড ট্রাক। যার ড্রাইভারের কেবিনের উপর দিয়ে ছিদ্র থাকে। ওখানে মাথা বের করে একজন আর্মি এল এম জি নিয়ে দাঁড়াতে পারে। গ্রেনেডটা পড়বিতো পড় একদম ঐ ছিদ্র দিয়ে ড্রাইভারের কেবিনে। প্রচন্ড বিস্ফোরণ। একদিকে মাইন। অপরদিকে গ্রেনেড।

গাড়িটা ঘুরে গিয়ে আমাদের দিককার ফুটপাত টপকে বিল্ডিংয়ের একটা দেয়াল ভেঙে থেমে যায়। আমাদের সাথে আর্মিদের দূরত্ব আক্ষরিক অর্থে দূরত্ব মোটে ৩/৪ হাতের। স্টেনের ব্রাশ। শুধু একটা আর্তনাদ কানে এলো দারোয়ানের। এটা শেষ করতে না করতেই আরেকটা আলো অসম্ভব গতিতে এগিয়ে আসছে। ওরা পাশ কাটিয়ে যেতে চেয়েছিল। মাইনের উপর পড়ে ৮/১০ বার উল্টেপাল্টে আমাদের দিক থেকে দূরে গিয়ে পড়ল। ওটার এমনিতেই পঞ্চত্ব লাভ হয়েছিল। এর পর পরই আরেকটা ট্রাক। কিন্তু ওটা না এসে আমাদের থেকে প্রায় ১০০ গজ দূরে থেমে রাস্তার উলটা দিকের ড্রেন আর ট্রাকের আড়ালে মিলিটারীরা পজিশন নিল। সমস্ত ঘটনাটা ঘটতে আমার মনে হয় একমিনিট সময়ও লাগেনি। যাই হোক এবার প্রতিরোধ শুরু হল। আমাদের গুলির ভান্ডার নিঃশেষিত প্রায়। পালানোর অর্ডার দিতেই, আগে ঠিক করা রাস্তায় পিঠটান।

সেই গোলাগুলি আর প্রচন্ড বিস্ফোরণে সমস্ত এলাকাই জেগে গিয়েছিল। আমরা যখন ভূতের গলির ভিতর দিয়ে পালাচ্ছি ২/৪ জন লোক আমাদের দেখে ফেলে আর পালানোর রাস্তা দেখিয়ে দেয়। হাইড আউটে পৌঁছেই সবাইকে পালানোর জন্য তৈরি হতে বলে আর্মসগুলো লুকোনোর জন্য গেলাম। কেননা এই এলাকা থেকে এগুলো নিয়ে এখন বের হওয়া সম্ভব নয়। আমরা হাইড আউটের পিছনে কচুরিপানায় ভর্তি একটা

২৪

ডোবা ছিল, তাতে পলিথিনে জড়িয়ে একটা চিহ্ন রেখে আর্মসগুলো ডাম্প করে দিলাম। এরপর সবাইকে যার যার রাস্তায় পালাতে বললাম। আর ২/৩ দিনের মধ্যে পূর্ব গ্রামে বশিরের কাছ থেকে আমার ঠিকানা নেবার জন্য বলে দিলাম।

তারপর নানান লোকের বাড়ির দেয়াল টপকে, গলি ঘুপচি হয়ে শাহবাগে চলে এলাম। তখন আজকের শাহবাগ বিপনী কেন্দ্রের নির্মানকাজ চলছিল। শেষরাত টুকু লেবারদের সঙ্গে কাটিয়ে সকালবেলা অফিসযাত্রী লোকজন চলাচল আরম্ভ হতে তাদের ভিড়ে মিশে বাসে করে ডেমরা ওখান থেকে নৌকায় পূর্বগ্রাম। কি করেছি, কতজন মেরেছি কিছুই জানিনা। শুধু জানি আমার কাঙ্খিত স্টেনগানটি পেলাম না। যাই হোক ঐ দিন রাত্রিবেলা বিবিসির বাংলা সংবাদে জানতে পারি যে, ২ জন কর্নেল, ২ জন মেজর, ১ জন ক্যাপ্টেনসহ ২৩ জন নিহত, ৪২ জন আহত। ২ টা ট্রাক আর ১ টা জীপ ধবংস। আমার নিজের করা অপারেশন। বিশ্বাস হচ্ছিল না ফলাফল শুনে। সেদিনই ধারনা হল বিবিসি কত প্রম্পট। পরে লোকমুখে জানতে পাই যে, পরদিন সমস্ত দিন গ্রীনরোডে কারফিউ ছিল।

ফায়ার ব্রিগেড এর লোকজন রাস্তা ধোয়া মোছার কাজ করেছে আর ক্রেন দিয়ে গাড়ি তুলে ট্রেইলর করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেই অপারেশনটা আমাদের ভুলক্রমিক চিন্তাধারার মধ্যেও ছিলনা। গেলাম কেন, হলোটা কি!

পূর্বগ্রামে ফিরে আসার দুইতিন দিনের মধ্যে আমার গ্রুপের সবাই ফিরে এলো। ঢাকায় আর্মস ফেলে আসাতে আমার আর্মস সর্টেজ দেখা দিল। ইতিমধ্যে কাজী ভাইয়ের গ্রুপের জুয়েল, বদি এরা মারা যাওয়াতে আর আমার কৃতকার্যতার সংবাদে কাজী গ্রুপের বাকি সদস্য যারা গ্রামে ছিল তাদের উপর নির্দেশ এলো আমার গ্রুপে যোগ দেবার জন্য। তখন রশীদ তৈয়ব আলী (বীর প্রতীক) সবাইকে নিয়ে এবং তাদের বাকি অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে আমার গ্রুপে যোগ দেয়। ফলে আমার লোকবল এবং অস্ত্রবল এবং অস্ত্রবল বেশ কিছুটা বেড়ে গেল। তবুও আবার ভারতে যাওয়ার প্রয়োজন হওয়াতে ফিরে গেলাম।  

আমার কৃতকার্য্যতায় (গ্রীনরোড অপারেশান) সবাই তখন খুশি। এবার আমার সাথে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর এক সেকশন (১০ জন) সিপাহীসহ ৮১ মিলিমিটার মর্টার ও ১০০ টি শেল, ২ টা এল এম জি এবং প্রচুর অ্যামুনিশন দেওয়া হল। যেদিন দেশে ফিরব সেদিন ক্যাপ্টেন আইনুদ্দিনের ক্যাম্পে গিয়ে দেখি ফরিদপুর ও ঢাকা জেলার মহকুমাতে যাওয়ার জন্য ৫০০/৬০০ ছেলে উপস্থিত। ওদের সাথে আমাকেও একইসাথে সিএন্ডবি ক্রস করতে হবে। তখন খুবই কড়াকড়ি। অবস্থা বেগতিক দেখে আইনুদ্দিন কে অনুরোধ জানালাম আমাদের সবাইকে অন্তত দুই ঘন্টা আগে একা গাইড দিয়ে পাঠিয়ে দিতে। উনাকে সমস্ত অবস্থা পর্যালোচনা করে বুঝানোর পর উনি আমার যুক্তিতে আমার সাথে একমত হন এবং আমাকে বাকি সবার আগে রওয়ানা করিয়ে দেন। আমরা যখন প্রায় সিঅ্যান্ডবির কাছাকাছি তখন ফরিদপুর এবং ঢাকার ৫০০/৬০০ ছেলে নৌকায় যাত্রা করেছে।

নীরব নিঝুম রাত্রিতে ৫০/৬০ টা নৌকা একত্রে সিঅ্যান্ডবির দিকে রওনা হয়েছে। ওদের ফিসফিস কথা আর দাঁড় বাওয়ার আওয়াজ অনেক দূর থেকেই আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম।

২৫

ঠিক এমনি সময় আমরা দেখলাম কয়েকটা গাড়ি কুমিল্লার দিক থেকে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার দিকে আসছে। পিছনের ওরা খেয়াল করেনি। কিন্তু পাক আর্মি ঠিকই বুঝতে পেরে তাদের হেডলাইট নিভিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে আসতে থাকে। আমাদের তখনার ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। দাঁড় বাওয়া বন্ধ করে আমরা ১৫ জন নিঃশব্দে নৌকা থেকে নেমে সাঁতরে নৌকা টেনে ব্রীজের নিচে দিয়ে পার হয়ে প্রায় ১০০ গজ দূরের পাটক্ষেতের মধ্যে ঢুকে যাই। পাক বাহিনীর কোন দিকেই মনোযোগ ছিলনা। ওরা এসে ব্রীজের উপর পজিশন নিলো। কয়েকটা গাড়ি ব্যাক করিয়ে ঘুরিয়ে ফরিদপুরের ছেলেরা যেদিক থেকে আসছিল, সেদিকে মুখ করে একসাথে সব হেড লাইট অন করে ফায়ার ওপেন করল। সাথে সাথেই নরক গুলজার। কর্ডাইটের গন্ধ, ছেলেদের আর্তচিৎকার সমস্ত রাতের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে খান খান করে দেয়। এই এম্বুশে আমাদের ২০/৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। প্রায় ১০০ এর মত আর্মস আমাদের নষ্ট হয়। তারপর অনেকদিনের জন্য সিএন্ডবি বর্ডার বন্ধ হয়ে যায়। মেলাঘরে সবার জন্য গায়েবানা জানাজা পড়া হয়। সবাই মনে করেছিল আমার গ্রুপও ওই এম্বুশে শেষ হয়ে গেছিল। তাই আমাদের নামেও গায়েবানা জানাজা পড়ানো হয়। অবশ্য সেদিন ক্যাপ্টেন আইনুদ্দিন যদি আমায় সাহায্য না করতেন বা আমাদের আলাদাভাবে পাঠানোর বন্দোবস্ত না করতেন তবে পরিস্থিতির চেহারা হয়তোবা অন্যরূপ হতে পারত। সেজন্য উনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

দেশে ফিরে আসবার পর ইছাপুরার গড়ে আমার ক্যাম্প বানালাম। এরপর থেকে ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি হতে থাকল। হেডকোয়ার্টার থেকে নির্দেশ এল আব্বাস, লতিফ, সালাউদ্দিন, ডেমরার আউয়াল, রূপগঞ্জের পিনু, জয়নাল এরা আমার সাথে পরামর্শ করে সব কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এরপর মেলাঘর গিয়ে তৈয়ব আলী এক সেকশান ছেলে নিয়ে এলো। ওকে আলাদা ক্যাম্প করে থাকবার নির্দেশ দিলাম। এল বাবলা, কাইউম। ওদেরকেও আলাদা করে দিলাম। যাই হোক, তবুও নিজস্ব চেইন অফ কমান্ড প্রতিষ্ঠিত করলাম। ফলে ইছাপুরা আর গুলশানের মাঝখানে একটা বড় বিল পাক আর্মি আর মুক্তিবাহিনীর বর্ডারে পরিনত হল।

ইতিমধ্যে আমার ৪র্থ বেঙ্গলের ছেলেরা (ল্যান্স নায়েক হেফজুল বারী সেকশান কমান্ডার ছিলেন) তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল।

১. বাড্ডা থেকে ৮১ মিলিমিটার মর্টার দিয়ে ঢাকায় তেজগাঁ এয়ারপোর্ট কে লক্ষ করে ১৬ টা শেল মারা হয়, কিন্তু শেলগুলা এয়ারপোর্টে না পড়ে কলেরা কলেরা হসপিটাল আর মহাখালীর আশেপাশে পড়ে।

২. ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ওই মর্টার থেকে একদিন শেলিং করা হয়। শেলগুলো ক্যান্টনমেন্ট মসজিদের আশেপাশে পড়ে। এতে পাক আর্মির উপর মানসিক ভাবে প্রচন্ড চাপের সৃষ্টি হয়।

৩. ঈদের দিন সকালবেলা রামপুরা টেলিভিশন টাওয়ার লক্ষ্য করে ২০ টা শেল নিক্ষেপ করা হয়। এতে রামপুরা টেলিভিশন মসজিদের ইমাম সাহেব সহ ৩ জন লোক মারা যায়।

২৬

৪. মুরাপাড়ায় গাউসিয়া জুট মিলের আর্মি ক্যাম্প ধ্বংস হয়।

৫. কাঞ্চনের এলিট জুট মিলের আর্মি ক্যাম্প ধ্বংস করা হয়।

ফলশ্রুতি ছিল ঠিক ঢাকার ২/১ মেইল এলাকার মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অবস্থান সুসংহত করতে পেরেছে, আর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে এখন মোটামুটি মানের মাঝারি ভারী অস্ত্র আছে। এই প্রচারণা পাক আর্মিকে দেশে এবং বিদেশে বেশ বেকায়দায় ফেলে দেয়।

একদিন গুলশান থেকে এক ভদ্রলোক ইছাপুরা বাজারে এসে আমাকে জানায় যে, জাপানের কনসাল জেনারেল ২/১ জন লোক নিয়ে আমাদের অবস্থা পরিদর্শন করে দেখতে চান। এতে আন্তর্জাতিক ফোরামে আমাদের অনেক সুবিধা হবে। আমি উনাকে নিয়ে আসবার অনুমতি দিই। অবশ্য ঐ লোকের কথার সত্যতা সম্পর্কে আমার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। তাই উনারা যে পথে ইছাপুরায় আসবেন, তাতে আমি সতর্কতামূলক প্রহরার ব্যবস্থা করেছিলাম। যাইহোক পরদিন ১১ টার দিকে যথারীতি ২ জন সাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যান সহ জাপানী কনসাল জেনারেল এলেন আমাদের দেখতে। আমি উনাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাদের সব অবস্থান দেখালাম। উনাদের বেশ কিছু প্রশ্ন যেমনঃ কেন এই যুদ্ধ, যদি জিতি কী হবে, হারলে কী হবে, জেতার জন্য আমরা কতোটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত, ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের প্রশ্ন তারা রেখেছিলেন। পরে বাজারের দোকানদার এবং অন্যান্য লোকের সাথে তারা মতামত বিনিময় করেন। অবশেষে যাবার সময় কনসাল জেনারেল ভদ্রলোক আমাকে দশ মাইল রেঞ্জের দুটি ওয়াকিটকি ও একটি বাইনোকুলার উপহার দিয়ে যান। এগুলো পরবর্তীতে আমাদের অনেক উপকারে আসে।

* এরমধ্যে একদিন মাঝির ছদ্মবেশে দুই আলী আকবর (আমাদের দুজন আলী আকবর ছিল। এরা দুজনেই) দুজন আর্মিকে চনপাড়ায় মেরে তাদের কাছ থেকে দুটা আর্মস উদ্ধার করে।

* ফারুক, মিরু মুরাপাড়ায় অ্যাম্বুশ করে ৬ জন আর্মিকে মারে।

* আলমকে (আমার গ্রুপের আলম, হাবিবুল আলম না) একটা গ্রুপ দিয়ে টঙ্গী জয়দেব পুরের দিকে পাঠাই। তারা বোর্ড বাজারে একটা সফল অ্যাম্বুশ করতে সমর্থ হয়। ওখানে আমার গ্রুপের একটা ছেলে মারা যায়। পরবর্তীতে গ্রামের লোকেরা সেখানে ঐ ছেলের নামে একটা রাস্তার নাম রাখে।

হাসান সাংহাই চাইনীজ রেস্টুরেন্টে (ফার্মগেটের উত্তরপাশে এয়ারপোর্ট বোর্ডের পশ্চিম দিকে) ডিনার খাবার সময় গ্রেনেড হামলা চালায় তাতে দুইজন পাক আর্মি মারা যায়।

কোরবানী ঈদের দুইদিন পর পাক আর্মির প্রায় ৩০০ সেনা দলবেঁধে বেরাইদ গ্রাম আক্রমণ করে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ করে। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সংঘর্ষে ওরা ৩ জন আর্মির লাশ ফেলে পালিয়ে যায়। আমি ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষ করে আমার এতদিনকার অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারি যে, যেহেতু ওরা মার খেয়ে ফিরে গেছে, সেহেতু

২৭

করে দরজা খোলা রেখে ঘুমাতে পেরেছে নিরূপদ্রবে, শান্তিতে সে জায়গায় স্বাধীনতার পর আরম্ভ হল লুটপাট। পাক আর্মির রাস্তায় রাস্তায় ফেলে যাওয়া আর্মস সেই কাজে সাহায্য করল। সুপরিকল্পিতভাবে এই লুটপাট কারা করাল, নাম হল মুক্তিযোদ্ধাদের। সুন্দর ভাবে লেপন করা হল কালিমা আমাদের চরিত্রের উপর। ডিসেম্বরের শেষ দিকে জোনাকী সিনেমা হলে পুলিশ, আর্মি, স্বারাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি আর মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয়ে হল একটা কনফারেন্স, নীতিমালা প্রণয়নের জন্য। বিরোধীতা করলাম। কেননা যারা নীতি নির্ধারণ করতে এসেছেন বেশিরভাগই পাকিস্তানের চাকরি করেছিলেন যুদ্ধের সময়, অতএব তাদের নীতি নির্ধারণীতে আমার কোনো আস্থা জন্মায়নি বলে প্রতিবাদ করে বেরিয়ে আসি। সাথে সাথে হায়দার ভাইসহ অন্য মুক্তিযোদ্ধারাও বেরিয়ে আসে। পরে দেখলাম এক/দেড় লক্ষ মুক্তিযোদ্ধার পরিবর্তে ১১ লক্ষ সার্টিফিকেট বিতরণ করা হল। এটাও ছিল সুপরিকল্পিত একটা ষড়যন্ত্র। বঙ্গবন্ধু ফিরে আসবার পর ৩১শে জানুয়ারী অস্ত্র সম্পণ করবার শেষ সময়সীমা নির্ধারণ করা হল। বঙ্গবন্ধু বিএলএফ এবং কাদেরীয়া বাহিনীর আর্মস নিলেন। কিন্তু কোনো মুক্তিযোদ্ধা উনার কাছে আর্মস সারেণ্ডার করবার সুযোগ পেল না। হায়দার ভাইসহ আমরা সবকিছু দেখলাম। হায়দার ভাই বললেন, মুক্তিযোদ্ধাদের রিকগনিশন প্রয়োজন। যেভাবেই পার বঙ্গবন্ধু থেকে রিকগনিশন আদায় কর। গেলাম মিন্টু রোড। বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞাসা করলেন আর্মস জমা দিয়েছি কিনা। আমি বললাম কার কাছে দেব? তখন কর্নেল শফিউল্লাহ সাহেব ওখানে উপস্থিত ছিলেন। উনি শফিউল্লাহ সাহেবের কাছে আর্মস জমা দিতে বললেন। অঙ্গীকার করে বললাম, আপনাকে জাতির জনক স্বীকার করে আপনার ডাকে অস্ত্র হাতে নিয়েছি, অতএব অস্ত্র সমর্পণ করতে হলে আপনার কাছেই করব, অন্যথায় নয়। উনি সময়ের অভাবসহ অনেক অজুহাত দেখালেন। আমি কিছুতেই মানিনি। অবশেষে ৩১শে জানুয়ারি বিকেল ৩টার সময় বাসাবো মাঠে উনি এলেন। উনার পায়ের কাছে অস্ত্র নামিয়ে রেখে অস্ত্র সমর্পণ করলাম। আমার গ্রুপের পক্ষ থেকে। মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে শুধু আমার আর্মসই বঙ্গবন্ধু নিজে গ্রহণ করেছিলেন এবং সেটাই বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সরাসরি স্বীকৃতি। এরপর আমাদের নিজেদের অস্তিত্বের জন্য একটা সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ১৩ই ফেব্রুয়ারি হায়দার ভাইসহ ডা. জাফরুল্লার সভাপতিত্বে ইস্কাটন লেডিস ক্লাবের অনুষ্ঠিত হল মুক্তিযোদ্ধাদের এক সভা। আনুমানিক ৪০০/৫০০ ছেলের উপস্থিতিতে মাহমুদ হাসান ও নজরুলকে যথাক্রমে আহবায়ক ও যুগ্মআহবায়ক করে ১১ সদস্যের এক কমিটি তৈরি হল (যাদের মধ্যে আমিও একজন ছিলাম)। নাম দেয়া হল বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ। যার কার্যক্রম হবে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণ ও স্বার্থ সংরক্ষণ করা। (আ-বুক দেশপ্রেমের এই অমিত বিক্ৰমী যোদ্ধা মোহাম্মদ আব্দুল আজিজ, বীর প্রতীক ৯ই অক্টোবর ১৯৯৯ সালে ইন্তেকাল করেন।)

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!