You dont have javascript enabled! Please enable it!

আইনশৃঙ্খলা সমস্যা ও রক্ষীবাহিনী

আনোয়ার উল আলম

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে দেশের কিছু কিছু অঞ্চল, বিশেষ করে যশাের, কুষ্টিয়া, খুলনা ও বরিশালে আইনশৃঙ্খলা-পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। স্থানীয় প্রশাসন থেকে ঢাকায় খবর আসতে থাকে যে তথাকথিত রাজনৈতিক দলের একদল উগ্রপন্থী সংঘবদ্ধভাবে বিভিন্ন থানা আক্রমণ করে পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নিচ্ছে। সংবাদপত্রেও এ সম্পর্কে কিছু খবর প্রকাশিত হয়। এদের বেশির ভাগই ছিল চীনপন্থী পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি ও পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সশস্ত্র ক্যাডার। এদের আক্রমণে সাধারণ পুলিশের দৈনন্দিন দায়িত্ব পালন দূরের কথা, তাদের পক্ষে থানা ও ফাড়ি রক্ষা করাই দায় হয়ে পড়ে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের সর্বত্র পুলিশ বাহিনীর বেশির ভাগ সদস্য ঝাপিয়ে পড়েন প্রতিরােধযুদ্ধে। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পুলিশ সদস্যরা বীরবিক্রমে যুদ্ধ করেছিলেন। পরবর্তীকালে তাদের অনেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। যারা মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেননি, তারা অনেকে জীবনের ভয়ে অথবা চাকরি রক্ষার জন্য মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান সরকারের পক্ষে কাজ করেন। কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধেও যােগ দেননি, পাকিস্তান সরকারের হয়েও কাজ করেননি। দেশের ভেতরেই পালিয়ে জীবন যাপন করেছেন। আবার পুলিশ বাহিনীর কিছুসংখ্যক সদস্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন না। তারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। তাদের এ মনােভাব মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় তেমন স্পষ্ট ছিল না। পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশে দখলদারি কায়েম করলে তার স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে। তাদের কয়েকজন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযােগী হিসেবে বাংলার জনগণের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালান। স্বাধীনতার পরও তারা চাকরিতে বহাল থাকলেও তাদের মনােবল ছিল না। তাদের পক্ষে তখন সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের মােকাবিলা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
আসলে সরকারি অস্ত্রধারী কোনাে বাহিনীর সদস্যরা যখন তাদের মনােবল হারিয়ে ফেলে, তখন তাদের দিয়ে সরকারের কোনাে কাজ হয় না। চাকরি আর বেতন যাদের লক্ষ্য, তাদের পক্ষে কোনাে ত্যাগ স্বীকার করা সম্ভব নয়। ত্যাগ স্বীকার করতে পারে শুধু দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ জনগণ, বিশেষ করে যুবসমাজ, দেশের জন্য যাদের ত্যাগ স্বীকার করার সাহস আছে, অনুপ্রেরণা আছে আর আছে দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালােবাসা। এ কারণেই সরকার তখন মনে করেছিল, অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী, সমাজবিরােধীসহ অন্য অপরাধীদের মােকাবিলা করতে পারবেন একমাত্র মুক্তিযোদ্ধারা, যাদের অনেককে তখন নিয়ােগ দেওয়া হচ্ছিল জাতীয় রক্ষীবাহিনীতে।
মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে দেখেছি, মনােবলহীন পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে ধরা পড়লে তাদের পা ধরে জীবনভিক্ষা চাইত। আরও দেখেছি, প্রাণের ভয়ে মাথা নিচু করে তারা কেমন করে ঢাকার দিকে পালাচ্ছে। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দিন দেখেছি, তাদের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান সেনাপতি টাইগার নিয়াজি নামে পরিচিত লেফটেনান্ট জেনারেল আমিত্রী আবদুল্লাহ খান নিয়াজি (এ এ কে নিয়াজি) কীভাবে মাথা নিচু করে নিজের অন্ত্র সমর্পণ করছে আর ভারতীয় সেনানায়ককে সালাম জানাচ্ছে। একজন সেনাপতি যখন অস্ত্র সমর্পণ করতে বাধ্য হন, তখন তার চেয়ে লজ্জাজনক কাজ আর কী হতে পারে। একাত্তরে বাংলার বীর মুক্তিযােদ্ধারা অনেকে পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়েছেন। তারা বীরের মতােই মৃত্যুকে বরণ করেছেন, কিন্তু বর্বর পাকিস্তানিদের কাছে মাথা নত করেননি, আত্মসমর্পণ করেননি।
শুধু আমাদের পুলিশ বাহিনী কেন, বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় যুদ্ধের দুই বছর পর পাকিস্তান থেকে বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা যখন নিজেদের দেশে ফিরলেন, তখন চাকরিতে থাকার জন্য তাদের অনেককেই নতজানু হতে দেখেছি। নিজের জ্যেষ্ঠতা ভুলে মুক্তিযোদ্ধা জুনিয়রদের কীভাবেই না স্যালুট করেছেন তারা। কেউ কেউ বলেছেন, ‘তােমরা মুক্তিযুদ্ধে যে অবদান রেখেই, সে জন্য আমরা তােমাদের জুতা পালিশ করলেও তােমাদের ঋণ শােধ হবে না’। তারা জানতেন শুধু চৌকসভাবে সালুট করতে। পাকিস্তান আমলে তাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানিদের স্যালুট করতেন। বাংলাদেশে ফিরে তারা প্রথম দিকে মুক্তিযােদ্ধাদেরও স্যালুট করেছেন।

তারপর সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের চাটুকারিতার মধ্য দিয়ে পদোন্নতি পেয়েছেন। তারপর আস্তে আস্তে দেশের বীরসন্তানদের সরিয়ে সেনাবাহিনীর কমান্ড নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছেন। যুদ্ধ করার সাহস এবং দেশপ্রেম তাদের অভিধানে ছিল না। যুদ্ধ করার জন্য তারা সেনাবাহিনীতে প্রবেশ করেননি। পাকিস্তান ফেরত সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে যাদের দেশপ্রেম ছিল, তারা নিজেদের সম্মান নিয়েই নিঃস্বার্থভাবে সেনাবাহিনী ও দেশের কল্যাণে কাজ করে গেছেন।
দেশটা স্বাধীন হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই আরও কয়েকটি সমস্যা সবার দৃষ্টিগােচর হয়। এক শ্রেণীর উচ্ছল ছাত্র-যুবক মুক্তিযােদ্ধাদের নাম করে ঢাকা শহরে গাড়ি হাইজ্যাক করতে থাকে। এতে ঢাকা শহরের ধনিকশ্রেণীর মধ্যে একটা উদ্বেগ লক্ষ করা যায়। আবার দেখা গেল, ট্রেনের যাত্রীদের অনেকেই টিকিট ছাড়া ভ্রমণ করছেন। এতে মুক্তিযুদ্ধে প্রায় বিধ্বস্ত রেলওয়ে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে ।
দেশে তখন পর্যাপ্ত পুলিশ ছিল না। যারা ছিল, তারাও নতুন দেশের নতুন পরিস্থিতিতে নতুন দায়িত্ব পালনে হিমশিম খাচ্ছিল। এ অবস্থায় সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, হাইজ্যাককারী ও টিকিটবিহীন রেলযাত্রীদের দমন এবং হাইজ্যাক করা গাড়ি উদ্ধারের। পুলিশের সঙ্গে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর সদস্যরাও থাকবেন।

ছবি – বঙ্গবন্ধুকে কুচকাওয়াজস্থলে নিয়ে যাচ্ছেন এ এন এম নুরুজ্জামান

রক্ষীবাহিনীর প্রথম ব্যাচের শিক্ষা সমাপনী কুচকাওয়াজের পর কিছুসংখ্যক রক্ষী সদস্যকে ঢাকা শহরে হাইজ্যাক করা গাড়ি উদ্ধারে নিয়ােগ করা হয়। তারা পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশের সহায়তায় গাড়ির কাগজপত্র পরীক্ষা শুরু করেন।একদিন একদল পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর একদল সদস্য কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে ওঠেন। কমলাপুর থেকে রওনা হয়ে টঙ্গী পর্যন্ত তারা যাত্রীদের টিকিট দেখেন এবং শতাধিক টিকিটবিহীন যাত্রীকে চিহ্নিত ও আটক করেন। অবাক হওয়ার মতো কাণ্ড, টিকিটবিহীন যাত্রীদের মধ্যে একজন ছিলেন পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল, তা-ও আবার সপরিবারে।
এদিকে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে নিয়মিত মুক্তিবাহিনী ও তাদের নিয়ন্ত্রণে গণবাহিনীর যারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিলেন, যুদ্ধ শেষে তাদের অস্ত্র সরকারের নিয়ন্ত্রণেই থাকে। বিএলএফ, অর্থাৎ মুজিব বাহিনী ও টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের অস্ত্র ও গােলাবারুদ অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জমা নেওয়া হয়েছিল। তবে তাদের কেউ কেউ যে বেশ কিছু অস্ত্র, গােলাবারুদ গোপনে লুকিয়ে রেখেছিলেন, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছােট-বড় কিছু আঞ্চলিক মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছিল। তারা দেশের জন্য যুদ্ধ করলেও মুক্তিযুদ্ধ শেষে তাদের অন্ত্রশস্ত্র ঠিকমতাে হিসাব করে জমা দেওয়া হয়েছে বলে মনে হয় না।
তারপর ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে গড়ে ওঠা মুক্তিবাহিনী। তাদের মধ্যে বিশেষত চীনপন্থী উগ্র বামপন্থীরা কোথাও অস্ত্র জমা দেয়নি। তারা সেসব অস্ত্র, তাদের ভাষায় সশস্ত্র শ্রেণীসংগ্রামের নামে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, জোতদার, এমনকি সাংসদ হত্যার কাজে পর্যন্ত লাগাতে থাকে। কারণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। তাদের উদ্দেশ্য ছিল শ্রেণীশত্রু খতম করা। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে একশ্রেণীর উগ্র বামপন্থী স্লোগান তুলেছিল, ‘লাখাে ইনসান ভুখা হ্যায়/ ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’ । তেমুনি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের চীনপন্থী তথাকথিত উগ্র বামপন্থীরা স্বাধীনতাকে স্বীকার করতে চায়নি। তাদের দলের নাম পর্যন্ত বদলায়নি। তারা দলের নাম পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি রাখে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে প্রচারপত্র বিতরণ করতে শুরু করে। তখন পর্যন্ত গণচীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। না দেওয়ার কারণে তারাও (চীনপন্থী উগ্র বাম দল) চায়নি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিতে। এমন ঘটনা পৃথিবীর কোথাও ঘটেছে বলে আমার জানা নেই।
এ সময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চারু মজুমদারের নেতৃত্বে চীনপন্থী উগ্র বামপন্থীরা নকশাল আন্দোলনের নামে বহু মানুষ হত্যা করতে থাকে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগেই পশ্চিমবঙ্গে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা শুরু হয়েছিল। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়ে। সদ্য স্বাধীন দেশে সবকিছু ছিল বিশৃঙ্খল অবস্থায়। উগ্রপন্থীরা এই সুযোগ কাজে লাগানাের চেষ্টা করে। সরকার তখন বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিয়ে এদের কার্যক্রম অনেকটা দমন করতে সক্ষম হয়।
স্বাধীনতার এত বছর পর আমার মনে হচ্ছে, এসব কার্যক্রম প্রথম দিকেই দমন না করতে পারলে বাংলাদেশের জন্য গভীর সংকটের কারণ হতো। কারণ, তাদের সন্ত্রাসী আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল পুলিশের থানা, ফাড়ি লুট করা; মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ সংগ্রহ করা এবং নিজেদের সন্ত্রাসী তৎপরতা বৃদ্ধি করে সদ্য স্বাধীন দেশে সন্ত্রাস ও অরাজকতা সৃষ্টি করা। এদের মনােভাবটা ছিল এ-রকমের : গণচীন বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে বিরােধিতা করার পরও স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করেছে। গণচীন যেহেতু মুক্তিযুদ্ধে বিরােধিতা করেছে, তারা বাংলাদেশকে দাঁড়াতেও দেবে না।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পরাজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ এবং অস্ত্র জমা দিলেও তাদের স্থানীয় দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের সশস্ত্র সদস্যরা আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র জমা দেয়নি। এই কাজটা তখন করা হয়নি। কেন তাদের অস্ত্র আনুষ্ঠানিকভাবে জমা নেওয়া হয়নি বা নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়নি, সেটা অন্য প্রসঙ্গ। রাজাকার, আলবদর, আলশামসের অল্প কিছুসংখ্যক নেতা ও সদস্য আত্মসমর্পণ করেছিল। তাদের অস্ত্র মুক্তিবাহিনীর জিম্মায় ছিল। এই তিন বাহিনীর বাদবাকি সদস্য, অর্থাৎ তাদের বেশির ভাগ সদস্য বিক্ষুব্ধ জনগণ ও মুক্তিযােদ্ধাদের কাছ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে নিজ নিজ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে চলে যায় অপরিচিত এলাকায়। আত্মীয়স্বজন বা কোনো আশ্রয়দাতার কাছে আশ্রয় নেয়। পালানাের সময় অনেকে আবার তাদের অস্ত্রশস্ত্র সর্বহারা দল ও অন্যান্য স্বাধীনতাবিরােধীর কাছে রেখে যায় অথবা বিক্রি করে দেয়। এ ছাড়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এদেশীয় সশস্ত্র সহযােগীদের অনেকে, বিশেষত আলবদর ও আলশামসের বহু সদস্য, ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে অকার্যকর করার লক্ষ্যে তাদের অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছিল।
পরাজিত পাকিস্তানি সেনা মিলিশিয়ারাও পালানাের সময় অনেক অস্ত্রশস্ত্র এখানে-সেখানে ফেলে রেখে যায়। সেগুলাে অনেক ডাকাত ও সমাজবিরােধীর হাতে পৌঁছে যায়, যা উদ্ধার করা তখন পুলিশের পক্ষে সম্ভব ছিল না। মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে প্রভাবশালী অনেকেই আবার নিজ নিজ এলাকায় নিজেদের প্রভাব বিস্তার করার জন্য অস্ত্র লুকিয়ে রাখেন। তাদের অনেকে আবার সরকারের সমর্থক ছিলেন। ফলে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ ছিল না। তাদের নিজেদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার নিয়েও অনেক ক্ষেত্রে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়, যার পরিণতিতে বেশ কিছু প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে থাকে।
এভাবে কিছুদিনের মধ্যে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। এটা নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের জন্য অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়ে। পুলিশের কথা আগেই বলেছি। আরেকটি কারণ তাদের সংখ্যাস্বল্পতা। জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনীতে যােগ দেওয়া মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্য থেকে যাদের পুলিশ বাহিনীর জন্য নেওয়া হয়েছিল, তাদের প্রশিক্ষণ তখনাে শুরু হয়নি। কাজেই তাদের দায়িত্নে লাগানাে যায়নি। এদিকে নতুন দেশে নতুন পরিস্থিতিতে পুলিশ বাহিনীর দায়িত্বও বাড়তে থাকে।
অস্ত্রধারী সশন্তু বিরােধীদের দমন করার মতাে শক্তি ও মনােবল তখন পুলিশের ছিল না। সবার ওপরে ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। বিমানবন্দর, রাস্তাঘাট, সেতু, রেলপথ, সমুদ্রবন্দর সবই বিধ্বস্ত । এগুলাে মেরামত করে দেশ পুনর্গঠন করা ছিল অত্যন্ত জরুরি। অথচ সরকারের তহবিলে অর্থ নেই। যুদ্ধের সময় বর্বর পাকিস্তানি সেনা আর তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামসের ভয়াবহ নির্যাতনে প্রায় ১ কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নেয়। স্বাধীন দেশে তারা ফিরে এলে সরকারকেই তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হয়। এর মধ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও কয়েকটি দেশ সাহায্য করলেও বিতরণে দেখা গেল অসংগতি ও বিশৃঙ্খলা এবং কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে লক্ষ করা গেল দুর্নীতি। এগুলাে সামাল দেওয়া চাট্টিখানি কথা ছিল না।
বিশাল হৃদয়ের অধিকারী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদারতার সুযােগ নিয়ে দলের নেতাকর্মীসহ অনেকে অসৎ কর্মকাণ্ড শুরু করে। দেশের গরিব-দুঃখী, বিশেষত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য আসা সাহায্যসামগ্রীই অসৎ ও দুর্নীতিবাজ আমলা, রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের কবলে পড়ায় সঠিকভাবে তা বিতরণ করা সম্ভব হয়নি। আবার বেশ কিছু পাচারও হয়ে যায়। এ নিয়ে জনমনে নানা সংশয় দেখা দেয়। তবে এ সময় বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত কঠোর হয়ে ওঠেন। ১৯৭২ সালের ৬ এপ্রিল দুর্নীতি ও দেশবিরােধী তৎপরতার কারণে তার দলের ১৬ জন সাংসদকে তিনি দল থেকে বহিষ্কার করেন। ৯ এপ্রিল ৭ জন এবং ২২ সেপ্টেম্বর আরও ১৯ জন সাংসদকে তিনি বহিষ্কার করেন। দলের অনেক নেতা-কর্মী, যারা অসৎ পথ অবলম্বন করেছিল, তাদের কঠিন শাস্তি দিতে থাকেন। কিছুদিন পর সরকার বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ রাইফেলসকে সীমান্তে নিয়ােজিত করে চোরাচালান ও পাচার বন্ধ করার চেষ্টা করে।
কিছুদিনের মধ্যে টঙ্গী ও নারায়ণগঞ্জে পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া কলকারখানায়ও শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয় । সদ্য জাতীয়করণ করা এসব কারখানা পরিচালনার মতো সুযােগ্য ব্যবস্থাপকের তখন নিদারুণ অভাব ছিল। এসব কলকারখানা পরিচালনার দায়িত্ব যাদের দেওয়া হয়, তারা তা সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারছিলেন না। একই সময় আবার পাকিস্তানে আটকে পড়া কয়েক লাখ বাঙালিকে দেশে ফেরত আনার দাবিতে আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। এ সবকিছুর প্রতি সরকারের সমবেদনা ছিল, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করার মতাে অবস্থা ছিল না।
ঠিক এই পরিস্থিতিতে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রশিক্ষণ দিয়ে দায়িত্ব পালনের জন্য পাঠানাে একটা চ্যালেঞ্জের ব্যাপার ছিল । জাতীয় রক্ষীবাহিনী অধ্যাদেশ ১৯৭২-এর ৮(১) নম্বর ধারায় বলা হয়েছিল:
The Bahini shall be employed for the purpose of assisting the civil authority in the maintenance of internal security when required by such authority as may be prescribed.
একই অধ্যাদেশের ৯ নম্বর ধারায় বলা হয়:
It shall be the duty of every officer or Rakkhi promptly to obey and execute all orders and warrants lawfully issued to him by any competent authority and to apprehend. all persons whom he is legally authorized to apprehend and for whose apprehension sufficient grounds exist, and deliver such persons to the custody of the Police.
জাতীয় রক্ষীবাহিনী অধ্যাদেশ ১৯৭২, জারির পর উল্লিখিত বিধান অনুযায়ী কোনাে দায়িত্ব স্থানীয় জেলা প্রশাসন অথবা মহকুমা প্রশাসন থেকে প্রাপ্ত হলেই রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তা ও সদস্যরা একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে সঙ্গে নিয়ে সেই দায়িত্ব পালন করেন। বাহিনীর সদস্য, বিশেষত কর্মকর্তাদের স্বউদ্যোগী হয়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ-সংক্রান্ত কোনাে দায়িত্ব পালন করার সুযােগ ছিল না। কাউকে গ্রেপ্তার করার ক্ষমতাও তাদের ছিল না। প্রথম দিকে পুলিশ বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য রক্ষীবাহিনী সীমিত আকারে দায়িত্ব পালন করতে থাকে এবং জনগণ ও সংবাদমাধ্যমের প্রশংসা অর্জন করে।
আগেই উল্লেখ করেছি, দেশ মুক্ত, স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন পর থেকেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে। ফলে দেশের সর্বত্র রক্ষীবাহিনীর চাহিদা বাড়তে থাকে। ঢাকা শহরে ছিনতাই, ডাকাতি, খুন ও অন্যান্য সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধ করার জুন জুন মাসের শেষ সপ্তাহে সরকার সান্ধ্য আইন কারফিউ জারির মাধ্যমে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান শুরু করে। এই সময় পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে জাতীয় রক্ষীবাহিনী ও বাংলাদেশ রাইফেলসের সদস্যদেরও মােতায়েন করা হয়। সেই অভিযানে বহু অবৈধ অস্ত্র ও গােলাবারুদ উদ্ধার করা হয়।
এ সময় একাত্তরের পরাজিত শক্তি, স্বাধীনতাবিরােধী কিছু চক্র, চীনপন্থী কিছু বাম রাজনীতিবিদ, পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েকজন আদিবাসী নেতা, হাতেগােনা কিছু লেখক ও সাংবাদিক, এমনকি সরকার-সমর্থক ছাত্রলীগের একটি অংশ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে সদ্য স্বাধীন দেশটাকে যেন দাঁড়াতেই দিতে চায়নি। কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সব দল নিয়ে বিপ্লবী জাতীয় সরকার গঠনের দাবি তােলেন। মানবেন্দ্র লারমা দাবি করেন পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্ত্বশাসন। কেউ লেখেন, সিলেটিরা বাঙালি নয়। কেউ দাবি করেন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের। আবার অনেকে ব্যস্ত হয়ে পড়েন টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জ ও আদমজী জুটমিলে শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি করার তৎপরতায়। অনেকে ধারণা করেন, পাকিস্তান আমলে আদমজীতে দাঙ্গা লাগিয়ে যেমন করে যুক্ত মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল, সেভাবে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারকেও তারা ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করতে পারবে।
ধীরে ধীরে হলেও সরকার পুলিশ, বিডিআর, রক্ষীবাহিনী ও মাঝেমধ্যে সেনাবাহিনী নিয়ােগ করে দেশে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার ব্যবস্থা করতে থাকে। তার পরও দেখা গেল, ঢাকার নারায়ণগঞ্জ১, লৌহজং, দোহার, মানিকগঞ্জ২, মুন্সিগঞ্জ৩ ও নসিংদী৪ এলাকায়; খুলনার খালিশপুর, বাগেরহাট৫ ও সুন্দরবন এলাকায়; রাজশাহীর তানাের, বাগমারা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ৬ এলাকায়; যশােরের নড়াইল৭, ফুলতলা, শৈলকুপা ও কালীগঞ্জ এবং ঝিনাইদহ৮ এলাকায় কুষ্টিয়ার চুয়াডাঙ্গা৯ ও মেহেরপুর১০ এলাকায়; বরিশালের উজিরপুর, ভােলা১১, ঝালকাঠি১২, পটুয়াখালী১৩ ও গৌরনদী এলাকায়; পাবনার বিলকুচি ও শাহজাদপুর এলাকায়; বগুড়ার জয়পুরহাট১৪, রংপুরের নীলফামারী১৫ ও গাইবান্ধা১৬ এলাকায়; ময়মনসিংহের কিশােরগঞ্জ১৭ ও নেত্রকোনা১৮ এলাকায় এবং চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চল, কক্সবাজার১৯ ও আনােয়ারা এলাকায় সন্ত্রাসী তৎপরতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে এই সব এলাকায় স্থানীয় প্রশাসন বারবার রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরে এবং সরকারের কাছে পুলিশকে সহায়তা করার জন্য রক্ষীবাহিনী পাঠানাের দাবি জানায়। রক্ষীবাহিনীর পরিচালক এ এন এম নূরুজ্জামান রক্ষীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না দিয়ে দায়িত্ব পালনে ঢাকার বাইরে পাঠাতে অনাগ্রহী ছিলেন। কিন্তু প্রশাসনের চাপে কিছু কিছু এলাকায় রক্ষীবাহিনী পাঠাতেই হয়। বাহিনীর সদস্যরাও উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে থাকে। বিশেষ করে, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে তারা যথেষ্ট সাহস ও পারদর্শিতা দেখায়। এ জন্য তারা স্থানীয় জনগণের প্রশংসা ও প্রশাসনের আস্থা অর্জন করে।
জুন মাসের শেষে দেশের বৃহত্তম শিল্পপ্রতিষ্ঠান আদমজী জুটমিলের পরিস্থিতি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ২৭ জুন শ্রমিকেরা ধর্মঘট শুরু করলে পুলিশের পক্ষে পরিস্থিতি মােকাবিলা কঠিন হয়ে পড়ে। এ সময় সরকার আদমজীতে রক্ষীবাহিনী নিয়ােগের সিদ্ধান্ত নেয়। শ্রমিকনেতাদের সঙ্গে আলােচনা করে ধর্মঘটের বিষয়গুলাে মীমাংসা করার দায়িত্ব পড়ে সরােয়ার হােসেন মােল্লা ও আমার ওপর। সরােয়ার ও আমি রক্ষীবাহিনীর একদল সদস্য নিয়ে আদমজীতে যাই। রক্ষীবাহিনী দেখে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়। আমরা কোনাে ধরনের বলপ্রয়ােগ না করে বিবাদমান দুই পক্ষকে নিয়ে আলােচনায় বসি। কিছুক্ষণ আলােচনার পর দেখা গেল, দাবিদাওয়া কোনাে বিষয় নয়, আসল বিষয় শ্রমিক নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব এবং প্রশাসনের দুর্বলতা। এই স্কুল্কের সূত্র খুঁজতে গিয়ে আমরা দেখতে পাই- মিলে যে কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করেন, বেতনের তালিকায় রয়েছে তার চেয়ে দ্বিগুণ শ্রমিকের নাম। উক্ত শ্রমিকের নামে বরাদ্দ বেতন শ্রমিকনেতা এবং সরকারের নিয়ােগ পাওয়া ব্যবস্থাপকেরা ভাগ করে নেন। এতে আদমজী জুটমিলের যে ভরাডুবি হবে, আমরা তা স্পষ্টত বুঝতে পারি। এ ছাড়া শ্রমিকদের মধ্যে বিশেষ কয়েকটি জেলার প্রাধান্য নিয়েও সমস্যা ছিল। বিষয়টি আমরা বুঝতে পেরেছি দেখে শ্রমিক নেতাদের মধ্যে সাইদুল হক সাদু ও অন্যরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেন। ২৯ জুন তারা ধর্মঘট প্রত্যাহার করেন। পরে অবশ্য সমস্যাগুলাে আবার দানা বেঁধে উঠতে থাকে। ১ জুলাই আদমজীতে শ্রমিক সংঘর্ষে চারজন নিহত ও ১৫ জুন আহত হয়। কর্তৃপক্ষ মিল বন্ধ ঘােষণা করে। চালু হওয়ার কিছুদিন পর ৬ সেপ্টেম্বর আদমজী জুট মিলে আবার বড় ধরনের সংঘর্ষ হয়। ওই এলাকায় সরকার সান্ধ্য আইন জারি করে। এরপর পরিস্থিতি শান্ত হয়। একপর্যায়ে (২০ ডিসেম্বর ১৯৭২) আদমজীর প্রধান নির্বাহী এম এ আউয়াল, মহাব্যবস্থাপক শফিউর রহমানসহ চারজনকে দুর্নীতির দায়ে অপসারণ এবং গ্রেপ্তার করা হয়।
১৯৭২ সালের আগস্ট মাসে রক্ষীবাহিনীর ২১ জন লিডার, কয়েকজন উপলিভার ও সহকারী লিডার ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে আসেন। আস্তে আস্তে তাদের ঢাকার বাইরে নিয়ােগ দেওয়া শুরু হয়। এ সময় একদিন (৩১ আগস্ট) যশােরের বারােবাজারে চীনপন্থী উগ্র রাজনৈতিক দলের সশস্ত্র ক্যাডার ও পুলিশের মধ্যে গােলাগুলিতে ১২ জন হতাহত হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতি মােকাবিলার জন্য জেলা প্রশাসক অলিউল ইসলাম২০ দ্রুত রক্ষীবাহিনী পাঠানাের অনুরােধ জানান। সরকারি নির্দেশে সেখানে লিডার সর্দার মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে রক্ষীবাহিনীর একদল সদস্য পাঠানাে হয়। এ সময় যশাের ও কুষ্টিয়া এলাকায় চীনপন্থী পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টিসহ আরও কয়েকটি সন্ত্রাসী দল খুবই তৎপর ছিল। এদের নকশালি বলা হতাে। তারা সুযােগ পেলেই পুলিশ, স্থানীয় নেতা ও জোতদারদের ওপর আক্রমণ চালাত। স্থানীয় হাটবাজারও এদের হামলা ও চাঁদাবাজি থেকে রেহাই পেত না। পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর যৌথ অপারেশনে এই সব এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা-পরিস্থিতি খানিকটা উন্নত হয়।
রাজশাহীর তানাের এলাকাতেও নকশাল বাহিনী, সর্বহারা, সাম্যবাদী দলগুলাের তৎপরতা ও তাণ্ডব বাড়তে থাকে। এলাকার সাধারণ মানুষের মনে ত্রাশের সৃষ্টি হয়। এ সময় লিডার লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে রক্ষীবাহিনীর একটি দল সেখানে পাঠানাে হয়। তারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে মিলে শক্ত অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু নকশাল বাহিনী, সাম্যবাদী ও সর্বহারা দলের সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় এবং বিধি মােতাবেক সময়মতো নিকটবর্তী থানায় তাদের হস্তান্তর করে। কিন্তু দেখা যায়, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পুলিশ স্থানীয় কোর্টে মামলা করার কিছুদিন পরই তারা নানা উপায়ে মুক্তি পেয়ে যায় এবং ভিন্ন এলাকায় গিয়ে তাদের শ্রেণীসংগ্রাম অব্যাহত রাখে। ফলে উদ্ভূত সমস্যাগুলাে থেকেই যায়।
এ সময় বিভিন্ন মহলে এ রকম একটি আলােচনা শুরু হয় যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও সুন্দরবন এলাকা স্বাধীন হয়নি। কারণ, বিভিন্ন সন্ত্রাসী দল সুন্দরবনে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের তৎপরতা দমনে তেমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সেখানে বাংলাদেশ সরকারের তেমন নিয়ন্ত্রণ নেই। এ অবস্থায় সুন্দরবন এলাকায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং পুলিশের পাশাপাশি রক্ষীবাহিনী মােতায়েন করা হয়। লিডার সর্দার মিজানুর রহমান রক্ষীবাহিনীর দলটিকে নেতৃত্ব দিতে থাকেন। দীর্ঘদিন অপারেশন করে সেখান থাকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ উদ্ধার এবং অনেক সশস্ত্র সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযান শুরু হওয়ার পর অনেকে পালিয়ে যায়।
স্বাধীনতার পর আরেকটি ঘটনায় রাজনীতিতে অস্থিরতা দেখা দেয়। ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে সরকারসমর্থক বাংলাদেশ ছাত্রলীগের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেওয়ায় ছাত্রলীগ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৯ জুলাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও নয়া পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। একটি নূরে আলম সিদ্দিকী ও আবদুল কুদ্দুস মাখনের নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আদর্শে অনুগত থাকে। তারা ঘােষণা করেন, যেকোনাে মূল্যে মুজিববাদ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অপরটি আ স ম আবদুর রব ও শাজাহান সিরাজের নেতৃত্বে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ওপর আস্থা রেখে বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করে। তারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে মত ব্যক্ত করে। এর আগে এপ্রিল মাসে বাস্তুহারাদের এক সভায় আ স ম আবদুর রব ঘােষণা করেছিলেন, “সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়ােজন হলে আবার অস্ত্র ধরব’। ২৩ অক্টোবর, ১৯৭২ মেজর (অব.) আবদুল জলিল ও আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে গঠিত হয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। একটি গণতান্ত্রিক দেশে এতে কোনাে অসুবিধা ছিল না ; অসুবিধা ও সমস্যা শুরু হলাে যখন বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক তত্ত্ব বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তারা সশস্ত্র ‘গণবাহিনী’ গঠন করে। জাসদের গণবাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী চীনপন্থী পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এএল), পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (এএল), সাম্যবাদী দল, পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি ও অন্যান্য সন্ত্রাসী দলের কাতারে মিশে দেশের ভেতরে হত্যা, লুট ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতে থাকে। গণবাহিনীর মধ্যে যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল, তাদের বিরুদ্ধেও রক্ষীবাহিনী একইভাবে অভিযান পরিচালনা করেছে।
এ সময় বাংলাদেশের একমাত্র জ্বালানি তেল শােধনাগার চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারিতে শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের মধ্যে নানা কারণে অসন্তোষ দেখা দেয়। একপর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে লিডার আকরাম হােসেনের নেতৃত্বে সেখানেও রক্ষীবাহিনী মোতায়েন করা হয়। রক্ষীবাহিনী ও শ্রমিকদের মধ্যে সংঘটিত সংঘর্ষে দুজন শ্রমিক নিহত হন। ফলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তখন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমাদের কয়েকজনকে চট্টগ্রামে যেতে হয়। সকল পক্ষকে একত্র করে আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে আমরা পরিস্থিতি শান্ত করতে এবং ইস্টার্ন রিফাইনারির তেল শােধনের কাজ শুরু করতে সক্ষম হই। কয়েক দিন পর চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়। তখন সেখানে লিডার আকরাম হােসেন ও লিডার শেখ দলিল উদ্দিনের নেতৃত্বে রক্ষীবাহিনীকে পাঠানাে হয়। তাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে এবং বন্দরের কার্যক্রম অব্যাহত থাকে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সবচেয়ে বড় রপ্তানি দ্রব্য ছিল পাট ও পাটজাতদ্রব্য। ১৯৭২ সালের শেষের দিকে সমাজবিরােধী একটি অংশ পাটশিল্পকে ধ্বংস করার জন্য উঠে পড়ে মাঠে নামে। নভেম্বর মাসে এক দিনে নারায়ণগঞ্জের ২৭টি পাটের গুদামে আগুন ধরিয়ে দুষ্কৃতকারীরা দেশের বিরাট আর্থিক ক্ষতি সাধন করে। ফলে পাট শিল্পকারখানা ও গুদামগুলাের নিরাপত্তার জন্য রক্ষীবাহিনী নিয়ােগ করা হয়।
১৯৭২, ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মাধ্যমে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও পুনর্গঠনের কাজ অব্যাহত রাখা সরকারের জন্য একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল। দেশে শুরু হয় নানামুখী অরাজকতা। চীনপন্থী বাম উগ্রপন্থী, নকশাল বাহিনী, সর্বহারারা রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা, পুলিশের থানা ও ফাঁড়ি লুট এবং হাটবাজারে হামলা করে জনমনে সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে থাকে। জনগণের নির্বাচিত স্থানীয় নেতারা ছাড়াও অনেক নির্বাচিত সাংসদ তাদের হাতে নিহত হন। ১৯৭২ সালের ৬ জুন সাংসদ আবদুল গফুর নিহত হন।
তার সঙ্গে ছিল কামাল ও রিয়াজ নামের দুজন। তারাও নিহত হয়। আবদুল গফুর ১৯৭০ সালের নির্বাচনে খুলনা থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালের ৩ জানুয়ারি নিহত হন সাংসদ সওগাতুল আলম সগির । তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে মঠবাড়িয়া থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালের ৩ মে সাংসদ নুরুল হক নিহত হন। তিনি ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসেবে নড়িয়া থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালের ১০ জানুয়ারি নিহত হন সাংসদ মােতাহার উদ্দিন আহমদ। তিনি ১৯৭০ সালে ভােলা থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সাংসদ গাজী ফজলুর রহমান নিহত হন ১৯৭৪ সালের ১৬ মার্চ। তিনি ছিলেন নরসিংদীর মনােহরদী এলাকা থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য। ১ আগস্ট ১৯৭৪ সাংসদ অ্যাডভােকেট ইমান আলী নিহত হন। তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য এবং ময়মনসিংহ আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। ২৭ ডিসেম্বর ১৯৭৪ কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ঈদের নামাজ পড়ার সময় নিহত হন সাংসদ গােলাম কিবরিয়া। তিনি ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সাংসদ আবদুল খালেক নিহত হন। তিনি প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন নেত্রকোনা থেকে। এ ছাড়া সাংসদ আবদুল মুকিম, আমিন উদ্দিনসহ (ফরিদপুর) আওয়ামী লীগের আরও অনেক নেতা-কর্মী২২ বিভিন্ন সময়ে নিহত হন। এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে সমাজের দুষ্কৃতকারী, চরম বামপন্থী, নকশাল বাহিনী, সর্বহারা ও জাসদের গণবাহিনীর হাত ছিল।
১৯৭২ সালে ২৯ জন, ১৯৭৩ সালে ৭৭ জন, ১৯৭৪ সালে ৫২ জন এবং ১৯৭৫ সালের জুলাই পর্যন্ত ৪৪ জন জনপ্রতিনিধি, ছাত্রনেতা, শ্রমিকনেতা, মুক্তিযােদ্ধা, পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর সদস্যকে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া দেশে অনেক অরাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডও ঘটে। ১৯৭৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এম মনসুর আলীর তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯৭৩ সালেই দেশে ১ হাজার ৮৯৬ টি২৩ হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল।
১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা দেশের ৫৪টি থানা ও পুলিশ ফাড়ি লুট করে বহু অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ে যায়। পুলিশের পক্ষে থানা ও ফাড়ি রক্ষা করাই তখন অসম্ভব ছিল, জনগণের জানমাল তারা কীভাবে রক্ষা করবে। ১৯৭৩ সালের ২০ আগস্ট বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজংয়ে সশস্ত্র দুর্বত্তদের সঙ্গে রক্ষীবাহিনীর প্রায় তিন ঘণ্টা গুলিবিনিময় হয়। দুর্বৃত্তরা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। আহত অবস্থায় কয়েকজন ধরা পড়ে।
২ সেপ্টেম্বর মানিকগঞ্জের আরিচায় ফেরিতে সশস্ত্র দুবৃত্তদের সঙ্গে রক্ষীবাহিনীর সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে চারজন নিহত হয়। বেশির ভাগ থানায় ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় । সন্ত্রাসীদের হামলা থেকে রক্ষা করার জন্য ২৪ সেপ্টেম্বর ১৫০ টি থানায় জাতীয় রক্ষীবাহিনীর সদস্য মােতায়েন করা হয়। ৩ অক্টোবর পাবনার শাহজাদপুরে সশস্ত্র দুবৃত্তদের সঙ্গে রক্ষীবাহিনীর গুলিবিনিময় হয়। এ সংঘর্ষে নিহত হয় ৮ জন।
১৯৭২ সালের শেষ থেকে রক্ষীবাহিনীর সাংগঠনিক কার্যক্রম ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। রক্ষীবাহিনীর লিডার মােজাফফর হােসেন, মাে. লুৎফর রহমান, আকরাম হােসেন, নীতিভূষণ সাহা, তায়েব উদ্দিন খান, রাখাল সাহা, আলমগীর হাওলাদার, শেখ দলিল উদ্দিন, আখতারুজ্জামান, সর্দার মিজানুর রহমান, শরীফ ওয়ালিউর রহমান, সৈয়দ রফিকুল ইসলাম (বীর প্রতীক), গাজী বেলায়েত হােসেন, নুরুল হক তালুকদার, লিয়াকত আলী, আলাউদ্দিন ও আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে বাহিনীর সাধারণ সদস্যরা অত্যন্ত সততা, সাহস ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। ১৫০ টি থানায় রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের পাশে পেয়ে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠেন। এর ফলে কয়েক মাসের মধ্যেই দেশে আইনশৃঙখলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়। সন্ত্রাসী দলগুলাের পুলিশের থানা আক্রমণ ও লুটপাট বন্ধ হয়। এতে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষায় রক্ষীবাহিনী কী অসাধারণ অবদান রেখেছিল। এই অবদান এই বাহিনীর প্রয়ােজনীয়তাকেও তুলে ধরে।
জাতীয় রক্ষীবাহিনী দেশে আইনশৃঙলা রক্ষার কাজে পুলিশ, বিডিআর এবং কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীকে সহায়তা করতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে। এ বাহিনীর উল্লেখযােগ্য দায়িত্ব ছিল :
ক. ঘেরাও ও অস্ত্র তল্লাশি অভিযান,
খ. সমাজ ও রাষ্ট্রবিরােধীদের বিরুদ্ধে অভিযান,
গ. আদমজীনগর, নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গী, খুলনা ও চট্টগ্রামের শিল্প এলাকাগুলােতে আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার অভিযান,
ঘ. চট্টগ্রাম, খুলনা ও চালনার সমুদ্র ও নৌবন্দর রক্ষার দায়িত্ব,

ঙ. সারা দেশে এসএসসি, এইচএসসি এবং ডিগ্রি পরীক্ষা সুচারুভাবে সম্পন্ন করায় সহযােগিতা প্রদান,
চ. সারা দেশে লুষ্ঠিত পুলিশ ফাড়ি ও থানায় নিরাপত্তা বিধান,
ছ. ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন,
জ. সারা দেশে লুকায়িত অবৈধ অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ উদ্ধার,
ঝ. পরিত্যক্ত বাড়িঘরের অবৈধ দখলদারদের অপসারণ,
ঞ. ট্রেন ও স্টিমারে টিকিটবিহীন চলাচল বন্ধ করা এবং
ট. সারা দেশে সন্ত্রাসী তৎপরতার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী, বিডিআর ও পুলিশের সঙ্গে যৌথ অভিযান পরিচালনা ইত্যাদি।
চলাচলের জন্য প্রয়ােজনীয় গাড়ি ও অভিযানের জন্য দরকারি অস্ত্রশস্ত্র ও যােগাযােগ-সরঞ্জামের স্বল্পতা সত্ত্বেও রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা অত্যন্ত নিষ্ঠা, দক্ষতা ও দেশপ্রেমের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ, প্রশাসন ও সংবাদমাধ্যমের প্রশংসা ও আস্থা অর্জন করেছিলেন। তবে কয়েকটি মহল থেকে, বিশেষ করে দেশবিরােধী চক্র, সন্ত্রাসী চরম বামপন্থীদের সমর্থকদের কাছে রক্ষীবাহিনীর তৎপরতা মােটেই সহনীয় ছিল না। কারণ, রক্ষীবাহিনীর তৎপরতা ও কার্যক্রমের ফলেই দেশ একটি শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল। তা না হলে দেশ সম্মুখীন হতাে মহা সংকটের।
১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে সরােয়ার হােসেন মােল্লা ও আমাকে জোষ্ঠ কর্মকর্তা কোর্সে ছয় মাসের জন্য ভারতে পাঠানাে হয়। কোর্স শেষে আমরা দুজনেই ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে দেশে ফিরে আসি। তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা পাকিস্তান থেকে দেশে ফিরে আসছিলেন। তাদের মধ্য থেকে এ এম খান২৫, সাবিহ উদ্দিন আহমেদ২৬, এ কে এম আজিজুল ইসলাম২৭, শফি উদ্দিন আহমেদ২৮ ও সালাহউদ্দিন আহমেদকে২৯ প্রেষণে জাতীয় রক্ষীবাহিনীতে নিয়ােগ দেওয়া হয়। রক্ষীবাহিনীর পরিচালক এ এন এম নূরুজ্জামান (তখন তিনি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন) তাদের দায়িত্ব ভাগ করে দেন। এ এম খানকে উপপরিচালক (মেডিকেল); সাবিহ উদ্দিন আহমেদকে প্রথমে উপপরিচালক (অপারেশন) পরে উপপরিচালকের (সিগন্যালস) দায়িত্ব দেওয়া হয়। আজিজুল ইসলামকে প্রথমে উপপরিচালক (প্রশিক্ষণ), পরে জোনাল কমান্ডার করে চট্টগ্রামে পাঠানাে হয়। শরিফ উদ্দিন আহমেদকে যানবাহনের দায়িত্বে সহকারী পরিচালক করা হয়। আমরা দুজন ফিরে এলে সরােয়ার
হােসেন মােল্লা ও আমি আগের পদে, অর্থাৎ উপপরিচালক (অপারেশন) ও উপপরিচালক (প্রশিক্ষণ) হিসেবে কাজ করতে থাকি।
ভারতে জোষ্ঠ কর্মকর্তা কোর্সে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে একটা বিষয় খেয়াল করে অবাক হয়ে যাই। দেখি, আমার সরকারি বাড়িতে যে লাল টেলিফোনটা ছিল, তা সংযােগহীন। লাল টেলিফোনের মাধ্যমে আমাদের পরিচালক ও রাষ্ট্রের অন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে সহজে যােগাযােগ করা যেত। ওই লাল টেলিফোনের মাধ্যমে আমাদের পরিচালকসহ রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি আমার সঙ্গে যােগাযােগ করতেন। আমিও তাদের সঙ্গে প্রয়ােজনে মাঝেমধ্যে যােগাযােগ করতাম। প্রথমে ভেবেছিলাম, আমার অনুপস্থিতির কারণে হয়তাে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। কারণ, ফোনের সেটটি বাসায় ছিল। পরে জানতে পারি, সরকারি সিদ্ধান্তে লাল ফোনের লাইন কেটে দেওয়া হয়েছে। ওই সংযােগ পুনরায় চালুর ব্যাপারে আমি আর চেষ্টা করিনি।

তথ্যনির্দেশ
১. নারায়ণগঞ্জ তখন ঢাকার মহকুমা
২. মানিকগঞ্জ তখন ঢাকার মহকুমা
৩. মুন্সিগঞ্জ তখন ঢাকার মহকুমা
৪. নরসিংদী তখন ঢাকার মহকুমা
৫. বাগেরহাট তখন খুলনার মহকুমা
৬. চাঁপাইনবাবগঞ্জ তখন রাজশাহীর মহকুমা
৭. নড়াইল তখন যশােরের মহকুমা
৮. ঝিনাইদহ তখন যশােরের মহকুমা
৯. চুয়াডাঙ্গা তখন কুষ্টিয়ার মহকুমা
১০. মেহেরপুর তখন কুষ্টিয়ার মহকুমা
১১. ভােলা তখন বরিশালের মহকুমা
১২. ঝালকাঠি তল বরিশালের মহকুমা
১৩. পটুয়াখালী তথন বরিশালের মহকুমা
১৪. জয়পুরহাট তখন বগুড়ার মহকুমা
১৫. নীলফামারী তখন রংপুরের মহকুমা
১৬. গাইবান্ধা তখন রংপুরের মহকুমা
১৭. কিশােৱগঞ্জ তখন ময়মনসিংহের মহকুমা

১৮. নেত্রকোনা তখন ময়মনসিংহের মহকুমা
১৯. কক্সবাজার তখন চট্টগ্রামের মহকুমা
২০. অলিউল ইসলাম : পরে বাংলাদেশ সরকারের সচিব।
২১. মেজর (অব.) আবদুল জলিল: পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা। ১৯৭১ সালের প্রথমার্ধে বর্তমান পাকিস্তানে (তখন পশ্চিম পাকিস্তান) কর্মরত থাকা অবস্থায় ছুটি নিয়ে দেশে আসেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধে যােগ দেন। পরে ৯ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর সুনির্দিষ্ট অভিযােগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত হন।
২২. ১৯৭২-১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের যারা নিহত হয়েছেন। পরিশিষ্ট ৬ দেখুন।
২৩. দৈনিক ইস্তেফাক, ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪।
২৪. থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি লুট এবং রক্ষীবাহিনীর ওপর আক্রমণ। পরিশিষ্ট ৭ দেখুন ।
২৫. এ এম খান : তখন মেজর, পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ।
২৬. সাবিহ উদ্দিন আহমেদ: তখন মেজর, পরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল।
২৭. এ কে এম আজিজুল ইসলাম ; তখন মেজর, পরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল।
২৮. শরিফ উদ্দিন আহমেদ : তখন ক্যাপ্টেন, পরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল।
২৯. সালাহউদ্দিন আহমেদ : তথন ক্যাপ্টেন, পরে মেজর।

Ref: রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যা, আনোয়ার উল আলম, pp 52-69

 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!