You dont have javascript enabled! Please enable it! স্বাধীনতা যুদ্ধে একটি পদাতিক প্লাটুনের অভিযান | মেজর জেনারেল আমীন আহম্মদ চৌধুরী, বীর বিক্রম - সংগ্রামের নোটবুক

স্বাধীনতা যুদ্ধে একটি পদাতিক প্লাটুনের অভিযান

মেজর জেনারেল আমীন আহম্মদ চৌধুরী, বীর বিক্রম

১৯৭১ সালে এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে মহালছড়ি- বুড়িঘাট এলাকায় যুদ্ধে শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাব কাদের, বীর উত্তম (২৭ শে এপ্রিল মহালছড়ি যুদ্ধে শহীদ হন) ভীতসন্ত্রস্ত এমজিওয়ালা থেকে এম জি (মেশিনগান) টি কেড়ে নিয়ে নিজেই ফায়ার করতে আরম্ভ করলেন। কিন্তু কেড়ে নেয়ার সময় তিনি হ্যান্ডেলটা না ধরে এমজি’র ব্যারেল বাঁ হাত দিয়ে ধরেছিলেন। উত্তপ্ত ব্যারেল তার হাতের তালু ঝলসে ফেলে। বাঁ হাত নিকটবর্তী কাদাতে ঢুকিয়ে ডান হাত দিয়ে অবশ্য ফায়ার অব্যহিত রাখেন। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে যে, অস্ত্র প্রশিক্ষনকালে প্রশিক্ষক সব সময় ব্যারেলে হাত না রাখার কথা বলে থাকেন এবং সেমতে এমজি ফায়ারের ড্রিল শিখিয়ে থাকেন। ছোট এই শিক্ষনীয় বিষয়টি যুদ্ধে কী মারাত্মক পরিনতি ডেকে আনতে পারে তা উপরের বাস্তব ঘটনায় বর্ননা তকেকে সহজে অনুমেয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের এই ছোট ঘটনাগুলো ধরে রেখে তার চেয়ে ও ছোট ছোট শিক্ষনীয় বিষয়গুলোকে সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করে আগামী দিনের পাথেয় হিসেবে রাখার উদ্দেশ্যেই এই লেখা। সে হিসেবে আমরা একটি প্লাটুনের অভিযানকে পর্যালোচনার বিষয়বস্তু হিসেবে সাব্যস্ত করি। এই প্লাটুনটি হচ্ছে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৭নং প্লাটুন। যার অধিনায়ক ছিলেন সুবেদার আব্দুল ওহাব, বীর উত্তম। সুবেদার আবদুল ওহাব ও নায়েব সুবেদার মংগল মিয়াকে একাত্তরে যুদ্ধের এলাকাসমূহে রেজমিনে নিয়ে যাওয়ার পর ও সাথীদের পূর্নাংগ নাম ঠিকানা, নিজস্ব দলের সংখ্যা, শত্রুর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অস্ত্রের সঠিক অবস্থানগুলো এত বছর পর আর সঠিকভাবে দেখাতে বা মনে রাখতে পারেননি। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, তাদের বক্তব্য ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যের মাঝে যথেষ্ট মিল রয়েছে, যা তাদের বক্তব্যের সততার স্বপক্ষেই রায় দেয়। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রেরিত মুক্তিবাহিনীর সিচুয়েশন (Situation) রিপোর্টগুলো আমাদের হাতে নেই তা না হলে বক্তব্য,বিশেষ করে নামধাম ও দুশমনের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ পুংখানুপুংখরুপে যাচাই করা যেত।যাচাই করা আরো সহজ হত যদি পাকিস্তানি রিপোর্টগুলো মিলিয়ে দেখার সুযোগ পাওয়া যেত।অবশ্য আমরা বক্তব্য বা ফলাফলের ওপর গুরুত্ব না দিয়ে শিক্ষনীয় বিষয়গুলোর উপর গুরুত্ব দিতে বেশী আগ্রহী।

২নং সেক্টরের অধীন ব্রাক্ষণবাড়িয়ার কসবা ও মন্দভাগ অতি পরিচিত নাম । এত বছর পর আজো ঐ এলাকার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা এক লহমায় সুবেদার (যে নামে তিনি পরিচিত) ওহাবকে চিনেছিল এবং তার ব্যক্তিত্ব, ব্যক্তিগত সততা ও দুঃসাহসিকতার জন্য এলাকাবাসী আজও তাকে নিয়ে গর্ব করে । দূর দূরান্ত থেকে লোক এসেছিল তাকে এক নজর দেখার জন্য । সুবেদার আবদুল ওহাব ১৯২৯ সালের ১৫ই মার্চ কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার থানার রাজামেহের ইউনিয়নে মরিচা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন । ১৯৪৮ সালের ১লা এপ্রিল কুমিল্লায় দেবিদ্বার থানার জাফরগঞ্জ ডাক বাংলোতে অবস্থানকালে ক্যাপ্টেন আবদুল গনি তাকে সেনাবাহিনীতে রিক্রুট করেন । সেনাবাহিনীতে ফুটবল খেলায় একজন দক্ষ গোলকিপার হিসেবে সর্বস্তরে তার পরিচিতি ছিল । ১৯৬৩ সালে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বদলী হন । ১৯৭০ সালের শেষ দিকে লাহোর থেকে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলী হয়ে কুমিল্লা আসেন । ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের ‘সি’ বা চার্লি কোম্পানি ব্রাক্ষণবাড়িয়া আসে । এ সময় ২৬শে মার্চের পর প্রথম মেজর সাফায়েত জামিল, বীর বিক্রমের নেতৃত্বে ও পরে মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তমের নেতৃত্বে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে । তখন সুবেদার ওহাব চার্লি কোম্পানির ৭নং প্লাটুনের কমান্ডার ছিলেন । স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহসিকতার জন্য তিনি বীর বিক্রম উপাধিতে ভূষিত হন । ১৯৮০ সালের মার্চ মাসে তিনি অবসর গ্রহণ করেন । শালগড় অভিযান মুক্তিযুদ্ধ চরম আকার ধারণ আগে এপ্রিল মাসের শেষ দিকে কিংবা মে মাসের শুরুতে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল ৭নম্বর প্লাটুন কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়ীয়া সড়কের উপর বড় শালগড় এলাকায় কুমিল্লার দিক থেকে আগত প্রায় ২৫/২৮ টি গাড়ির বহরের উপর একটি এম্বুশ করে । উক্ত কনভয়ে গাড়ি ও জনবলের তুলনায় এম্বুশ দলের সংখ্যা নিতান্ত কম (২২/২৪ জন) থাকলেও তারা উক্ত কনভয়ের উল্লেখযোগ্য ক্ষতিসাধন করতে সমর্থ হয় । এই অভিযানের ফলে শত্রুর আওতাধীন এলাকার মধ্যে মুক্তিবাহিনীর নিজস্ব প্রাধান্য বৃদ্ধি পায় । যোগাযোগের জন্য পাকবাহিনী কুমিল্লা-ব্রহ্মণবাড়ীয়া (সিএন্ডবি) সড়ক নিয়মিত ব্যবহার করতো তা সুবেদার ওহাব জানতে পারেন । তিনি এই সড়কের উপর শত্রুর উপর এম্বুশ করার সুযোগ গ্রহণ করেন । সেই অনুযায়ী ১টি মেশিনগান, ১টি ব্লেন্ডিসাইড ও বেশ কয়েকটি লাইট মেশিনগান নিয়ে তার প্লাটুন সীমান্তের ওপারে দেবিদ্বার থেকে মন্দভাগ হয়ে কায়েমপুরের দক্ষিণ দিক দিয়ে চান্দলা গ্রামে বিকেল চারটার দিকে উপস্থিত হন । সেদিন সেখানে বাজার ছিল বলে তারা লোকজনের দৃষ্টি এড়ানোর জন্য গ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব কোণ পুকুরের ধারে ঝাড় জঙ্গলে অবস্থান নেন । স্থানীয় মেম্বার পরে তাদেরকে স্কুলে থাকার ব্যবস্থা করে দেন । সেখানে অবস্থান করা তাদের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক ছিল বলে স্থানীয় কয়েক ব্যক্তির পরামর্শ অনুযায়ী উক্ত প্লাটুন খুব ভোরে দু’মাইল পশ্চিমে সিঁদলাই গ্রামে চাঁদ মিয়া মেম্বারের বাড়িতে আশ্রয় নেয় ।

সকালে সুবেদার ওহাব সাধারণ বেশ ধরে সেখান থেকে শালগড় এলাকায় সিএন্ডবি সড়ক রেকি (পর্যবেক্ষণ) করার সময় উক্ত পথে দু’একটি আর্মির গাড়ির চলাচল দেখতে পান । তিনি রাস্তার অতি নিকটে গিয়ে এম্বুশের স্থান নির্বাচন করেন । ঐ এলাকায় জনসাধারণ মুক্তিবাহিনীর প্রতি তেমন সহযোগিতামূলক মনোভাব পোষণ করতো না, তাই নিজের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সুবেদার ওহাব রাস্তা ও গ্রাম এড়িয়ে ফাঁকা জায়গা দিয়ে চলাচল করেন । দুপুরে খাওয়ার পর জনৈক ফকিরের কাছে সংবাদ পাওয়া যায় যে ঐ দিন রাতে সিএন্ডবি সড়কে পাকবাহিনী কারফিউ ঘোষণা করেছে । এতে সুবেদার ওহাব অনুধাবন করতে সক্ষম হন যে ঐ দিন রাতে উক্ত সড়ক পাক সেনারা চলাচলের জন্য ব্যবহার করবে । সুতরাং ঐ রাতেই এম্বুশ করার সিদ্ধান্ত নেন । পরিকল্পনা অনুযায়ী এবং ভারী জিনিসপত্র চারজনের তত্ত্বাবধানে রেখে রাতের অন্ধকারে বড় শালগড় এলাকায় সিএন্ডবি সড়কের পাশে ফাঁদ স্থাপন । (চিত্র দেখুন) সুবেদার ওহাব তার দলকে এক সারিতে উত্তর-দক্ষিণ-এ বিস্তৃত করে অবস্থান নেন । তিনি এলএমজি নিয়ে দক্ষিণ দিক থেকে তৃতীয় বৈদ্যুতিক স্তম্ভের কাছে (আলুক্ষেত) ছিলেন এবং তার কাছাকাছি নায়েক তোফাজ্জল হোসেন সর্ব উত্তরে অবস্থান নেয় । জায়গা দেখানো ও ব্রিফিংয়ের পর দলকে মোতায়েন না করে প্লাটুন অধিনায়ক সকলকে একসাথে রাখেন (শত্রুর আগমনের দিক জানা ছিল না এবং দলের সদস্যরা তাদের অবস্থানে ঘুমিয়ে পড়তে পারে কিংবা একা থাকলে দুশ্চিন্তা ও মানসিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেতে পারে এ কথা চিন্তা করেই সকলকে একত্রে রাখা হয়) । রাতে আনুমানিক ১২টায় দক্ষিণ দিক থেকে অনেক গাড়ির আলো দেখা যায় । সঙ্গে সঙ্গে সুবেদার ওহাব সতর্ক করেন এবং প্রত্যেককে নির্দিষ্ট স্থানে পাঠিয়ে দেন । শত্রুর অধিকাংশ গাড়ি যখন এম্বুশ এলাকায় প্রবেশ করে তখন এম্বুশ দল গুলিবর্ষণ শুরু করে । কিন্তু বেবিটেক্সি মনে করে নায়েক তোফাজ্জল প্রথম গাড়িতে ফায়ার করেনি বলে সেটা এম্বুশ এলাকার কিছুটা আগে চলে যায় । প্রথম ৪মিনিট এম্বুশ দল শত্রুর উপর অবিরাম গুলিবর্ষণ করে । সুবেদার ওহাব তার দলের গুলিবর্ষণ বন্ধ করে সকলকে স্থান ত্যাগ করতে বলেন (এখানে তিনি সিগন্যাল পিস্তল ব্যবহার করেন) । এই সময় দু’জনকে কভারিং ফায়ার দিতে বলা হয় এবং তারা কমান্ডারের সাথেই সেখানে থেকে পশ্চাদনসরণ করে । এম্বুশস্থল থেকে সৈয়দপুর স্কুল (আর ভি)-এ একজন ছাড়া বাকি সকলেই উপস্থিত হয় । সে পথ ভুল গিয়েছিল এবং ভয়ে তার এলএমজি ঝোপের মধ্যে ফেলে আসে । পরে সে সরাসরি সিঁদলাইতে গিয়ে দলের সাথে মিলিত হয় । সিঁদলাইতে চা-নাস্তা খাওয়ার পর উক্ত দল যখন চান্দলা হয়ে মন্দভাগের কাছে সীমান্ত অতিক্রম করে তখন পূর্বাকাশ ধীরে ধীরে ফর্সা হতে শুরু করেছে । এই অভিযানে শত্রুর দুটি গাড়িতে আগুন ধরে যায় এবং সুবেদার ওহাবের মতে ১৮টি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয় যার মধ্যে ১০টি গাড়ি একেবারে অকেজো হয়ে পড়ে । এতে কতজন পাকসেনা হতাহত হয় তা জানা যায়নি । তবে উঁচু রাস্তার পশ্চিম পাড়ে আশ্রয় এবং আড় নিয়ে তাদের অনেকেই গুলির আঘাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সমর্থ হয় । বড় শালগড় (নোহাটি) গ্রামের নসু মিয়া, বসু মিয়া, যোগেশ চন্দ্র সূত্রধর, ওদুদ মিয়া তারা সাক্ষ্য দেয় যে অন্তত একটি গাড়ির ধ্বংসাবশেষ এখনও নালার ভিতর আছে । তারা আরো বলে ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ির পরিমাণ অনেক ছিল বলে সকালে গাড়ি চলাকালে বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় । মাত্র বিশ জনের একটি অতি ক্ষুদ্র দলের এম্বুশের ফলে শত্রুর উল্লেখযোগ্য ক্ষতি সাধিত হয় । এম্বুশ দল তাদের যাতায়াতের নিরাপত্তা এবং পাকবাহিনীর সহযোগীতাকারী স্থানীয় লোকজন বিশেষ করে মফিজ চেয়ারমযান ও তার সঙ্গোপাঙ্গ কর্তৃক চিহ্নিত না হবার জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন । সাফল্য অর্জনে এর বিশেষ প্রয়োজন । লোকজনের সন্দেহ এড়ানোর জন্য তারা তাদের অস্ত্রসমূহ থলিতে বহন করেছিলেন । কমান্ডার সঠিকভাবে শত্রু কনভয়ের চলাচল অনুমান করতে পেরেছিলেন কিন্তু এ ধরণের অনুমানের উপর ভিত্তি করে কার্যক্রম গ্রহণ অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে । যে আকৃতির লক্ষবস্তুর অনুমান করে এম্বুশ লাগানো হয় তার চেয়েও বড় লক্ষবস্তুর আগমন ঘটলেও অধিনায়ক উদ্দেশ্য সাধনে অবিচল থাকতে পারেন যদি অপ্সহচাদপসরণের ভালো রাস্তা withdrawal route থাকে । সুবেদার ওহাব এখানে অত্যন্ত উঁচু মনোবলের পরিচয় দিয়েছেন যা দলের জন্য বিশেষ অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল । অধিনায়কের দৃঢ় মনোবল এ সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি । যদিও সামরিক প্রশিক্ষণে এটা শিক্ষা দেয়া হয় যে এম্বুশের সময় বিভিন্ন দল নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে শত্রুর জন্য প্রতিক্ষা করবে, কিন্তু সুবেদার ওহাব তার দলের প্রশিক্ষণ ও মনোবল যাচাই করে শত্রু দেখার আগ পর্যন্ত তার দলকে একত্রিত রেখেছিলেন । এটা প্রচলিত শিক্ষার ব্যতিক্রম হলেও দলের মনোবল চাঙ্গা রাখার জন্য তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তা সত্যিই প্রশংসনীয় । যার ফলে সোইনিকরা সম্ভবত গুলিবর্ষণ করে ও সংঘদ্ধভাবে পশ্চাদসরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন । তবুও লক্ষণীয় বিষয় যে কভারিং ফায়ার দেয়ার জন্য যাকে একাকী এবং একটু দূরে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল যে তার এলএমজি ফেলে পালিয়ে গিয়েছিল । অন্যান্য দলকে আগে থেকে একাকী দূরে দূরে পাঠিয়ে দিলে হয়তো তারাও মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে এমনি করে পালিয়ে যেত এবং গোটা এম্বুশ শুরু করার আগেই শেষ হয়ে যেত । একজন সামরিক দলের অধিনায়ককে তার সৈনিকদের এই ধরণের আচরণ (যা যুদ্ধের ময়দানে হওয়া স্বাভাবিক) সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকা দূরদর্শিকতার পরিচায়ক । যে সমস্ত শত্রু উঁচু রাস্তার অপর পাড়ে আড় নিয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে মর্টার ও গ্রেনেডের ব্যবহার বিসেষ কার্যকর হত যা তারা করেননি । সকলকে পশ্চাদপসরণের পথ পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে যাতে করে অভিযানের পর ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি না হয় এবং কেউ যেন হারিয়ে না যায় ।

কোনো অবস্থাতেই সৈনিকেরা তাদের অস্ত্র পরিত্যাগ করবে না । সুর্বলচিত্তের অধিকারী সৈনিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হলেও যুদ্ধের সময়দানে ঘাবড়িয়ে গিয়ে তাদের পক্ষে অস্ত্র ফেলে পালিয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয় । সে জন্যই প্রশিক্ষণ বাস্তবধর্মী (Realistic) এবং জীবন্ত (live) মহড়ার মাধ্যমেই হওয়া বাঞ্ছনীয় যাতে করে সৈনিকেরা যুদ্ধের ভয়াবহতার মাঝে দৃঢ় মনোবল ও স্থিরচিত্তের পরিচয় দিতে পারে । মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশনে ট্রন্সি ধ্বংস অভিযান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে সুবেদার ওহাবের নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানগুলোর মধ্যে মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশনে পাক সেনাদের গোলাবারুদ ও রসদবহনকারী একটি রেলওয়ে ট্রলি ধ্বংস অভিযান অন্যতম । ১৮ই জুনে পরিচালিত এই অভিযানে উক্ত রেলওয়ে ট্রলি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় । এটি ছিল একটি ত্বরিৎ এম্বুশ । এই অভিযানের পর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দিল হলো শত্রুর সংবাদ লাভের পর কোনও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি ব্যতিরেকেই অত্যন্ত অল্প সময় (২/৩ ঘণ্টা)এর মধ্যে এম্বুশ পেতে সাফল্যজনকভাবে ট্রলির ধ্বংস কাজ সম্পন্ন করা । মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ এবং আক্রমণ তীব্রতর আকার ধারণ করার আগে যখন পাকবাহিনী আখাউড়া কুমিল্লা রেলওয়ে লাইন যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে তখন বিএসএফ এর মারফত সংবাদ পাওয়া যায় যে পাকসেনারা একটি রেলওয়ে ট্রলিতে গোলাবারুদ ও সাজ সরঞ্জাম নিয়ে কসবা থেকে শালদা নদী এলাকায় অবস্থিত প্রতিরক্ষা ব্যূহতে নেয়ার জন্য যাচ্ছে । এই সময় ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৭ নম্বর প্লাটুন কসবার ৫ মাইল পূর্বে দেবীপুরে অবস্থান করছিল । শত্রু ও ট্রলির ওপর এম্বুশ করার জন্য ৭ নম্বর প্লাটুনকে দায়িত্ব দেয়া হয় । বেলা তখন আনুমানিক সাড়ে এগারোটা (চিত্র দেখুন)। যখন এই সংবাদ পাওয়া যায় তখন লক্ষবস্তু ও গন্তব্যস্থানের দিকে ধাবিত হচ্ছে অথচ শালদা নদী পৌছানোর আগেই তাদেরকে ধ্বংস করতে হবে । কাজেই হাতে সময় অল্প । সুবেদার ওহাব প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আনুমানিক ৪০ জনের একটি দল প্রস্তুত করেন এবং মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশন শত্রুকে এম্বুশ করার সিদ্ধান্ত নেন । তিনি তাঁর দল নিয়ে অনেকটা দৌড়ে ও তাড়াহুড়ো করে মন্দভাগ ষ্টেশনের পূর্বদিকে রেললাইন থেকে মাত্র দেড়শ গজ দূরে অবস্থান গ্রহণ করেন । তার সাথে ছিল ২টি মেশিনগান, ৭টি এলএমজি, ১টি ২//মর্টার এবং ১টি ব্লেন্ডিসাইড । সুবেদার ওহাব তার দলকে গ্রাম ও গাছপালার আড়ালে এমনভাবে লাগান যে একেবারে কাছে থেকেও তাদের অবস্থান দেখে ফেলার সম্ভবনা ছিল না বলাবাহুল্য তাদের পোশাকও ছিল স্থানীয় জনসাধারণের মত । যখন তার দল অবস্থান গ্রহণ করে তখন শত্রুর রেলওয়ে ট্রলি মন্দভাগ স্টেশনের উত্তরে সিগন্যাল পোস্টের কাছাকাছি পৌছে গেছে । এ সময় বেলা আনুমানিক আড়াইটা । রেলওয়ে ট্রলিকে মাঝখানে রেখে রেললাইনের দু’পাশ দিয়ে পাকসেনারা পায়ে হেঁটে অগ্রসর হচ্ছিল এবং রেল লাইন ছাড়াও পশ্চিম দিকের কসবা-শালদা নদী বোর্ডের রাস্তা ধরেও বেশ কিছু পাকসেনা এগিয়ে আসছিল ।

রেলওয়ে ট্রলি যখন এম্বুশ এলাকায় প্রবেশ করে তখন সুবেদার ওহাবের ফায়ারের সাথে সাথে তার দল লক্ষবস্তুর ওপর আঘাত হানে । এই আক্রমণে রেলওয়ে ট্রলি দাঁড়িয়ে যায় এবং অধিকাংশ পাকসেনা যদিও হকচকিয়ে যায় কিন্তু পরমুহূর্তে উঁচু রেললাইনের পশ্চিম দিকে আড় গ্রহণ করে মুক্তিবাহিনীর গুলিবর্ষণ থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে সমর্থ হয় এবং পাল্টা গুলিবর্ষণ করে পশ্চাদপসরণ করতে থাকে । কিছুক্ষণ পর সুবেদার ওহাব সিপাই হেফজু মিয়া ও অপর একজনকে ট্রলিটি টেনে স্টেশনের দিকে নেয়ার জন্য আদেশ দেন । তারা ক্রলিং করে ট্রলির কাছে গিয়ে রেল লাইনের অপর পাশে দুটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে কিন্তু ওপাশ পর্যন্ত না পৌছানোয় বিস্ফোরিত হওয়া সত্ত্বেও সেগুলো শত্রুর তেমন ক্ষতি করতে পারেনি । যখন ট্রলিটিকে টেনে আনার চেষ্টা করছিল তখন সিপাহী বসু মিয়ার ফায়ারে হঠাৎ করে ট্রলির অব্যন্তরের গোলাবারুদ-এ আগুন ধরে সেগুলো সশব্দে বিস্ফোরিত হতে শুরু করে এবং ট্রলিতে আগুন ধরে যায় । গোলাবারুদের কিছু বাক্স ট্রলি থেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। সুবেদার ওহাব তৎক্ষণাৎ তাদেরকে ট্রলির কাছ থেকে সরে আসতে বলেন । মুক্তিবাহিনী ছিটকে পড়া বেশ কিছু গোলাবারুদ সংগ্রহ করে । পরে সুবেদার ওহাব তার দল নিয়ে সেখান থেকে ক্যাম্পে প্রত্যাবর্তন করেন । এই দলের সাথে যারা এম্বুশে অংশ নেয় তাদের কয়েকজনের নামঃ নায়েব সুবেদার মংগল মিয়া, হাবিলদার মোসলেম, নায়েক তোফাজ্জেল হোসেন পাটোয়ারী, সিপাহী হেফজু মিয়া, সিপাহী কালাম এবং নায়েক সোবহান । এই অভিযানের পরদিন সকালে সুবেদার ওহাব আবার উক্ত স্থানে গিয়ে ট্রলিটি জ্বলন্ত অবস্থায় দেখতে পান । তিনি স্থানীয় লোকের সাহায্যে ট্রলি থেকে কিছু সামগ্রী উদ্ধারের চেষ্টা করেন । সেখান থেকে প্রচুর আটা ও চাল গ্রামবাসীদের ভিতর বিতরণ করা হয় । ট্যাংক বিধ্বংসী রাইফেল, মর্টার ইত্যাদি অস্ত্রের গোলাবারুদ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায় এবং অনেক টেলিফোন ও বেতার যন্ত্র পুড়ে নষ্ট হয়ে যায় । এই অভিযানের ফলে কসবা ও শালদানদী সংযোগকারী রেলওয়ে লাইন শত্রুর ব্যবহারের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠে । এই অভিযানে মুক্তিবাহিনীর সাফল্য পাকসেনাদের এত বেশি ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়ায় যে, তারা পরবর্তী কয়েকদিন প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ঐ এলাকায় নির্বিচারে নিরীহ গ্রামবাসীদের হত্যা করে । জনাব আবদুল মালেক (হেডমাস্টার, বায়েক হাই স্কুল) এর বক্তব্য অনুযায়ী ট্রলি ধ্বংস হওয়ার পর পর পাকসেনাবাহিনী কেবলমাত্র বায়েক গ্রামের ৪৭ জন লোক হত্যা করে । এদের মধ্যে ঐ গ্রামের অশীতিপর বৃদ্ধ তমিজ উদ্দিন সর্দারকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় । মোঃ কেরামত আলী, পিতা মৃত মনসুর আলী, বায়েক, কসবা, রেলওয়ে ট্রলির ওপর আক্রমণ প্রত্যক্ষ করেছেন । আবুল হাসেম, পিতা মিন্নত আলী, কলতা দিঘীর পাড়, আবুল করিম, পিতা- আসমত আলী,বায়েক, কসবা, আবদুল সোবহান, পিতা- দিল্লর আলী, বায়েক, কসবা, মোহাম্মদ আলী, পিতা-আসমত আলী, বায়েক, কসবা, এরা এবং মন্দভাগ রেল স্টেশনের সংলগ্ন বিভিন্ন গ্রামের অধিবাসীরা সুবেদার ওহাবের নেতৃত্বে পরিচালিত ট্রলি ধ্বংস অভিযানসহ ঐ এলাকায় পরিচালিত অন্যান্য অভিযান সম্বন্ধে অবগত । তারা সকলেই পাকসেনাদের বিরুদ্ধে সুবেদার ওহাব ও তার সাহসিকতাপূর্ণ অভিযানগুলোর কথা আওতঃস্ফূর্তভাবে উল্লেখ করেন । এ ছিল অত্যন্ত তাড়াহুড়ায় করা এম্বুশ যা সহজ পরিকল্পনায় ও অল্প প্রস্তুতিতে কার্যকর করা হয়েছিল । এম্বুশ দলের অত্যন্ত ত্বরিৎ গমনাগমন এবং শত্রুর রেলওয়ে ত্রলি সম্পর্কে খবর পাওয়ার পর দ্রুত অবস্থান নিয়ে বাড়তি সময় লাভ করে লক্ষবস্তুকে প্রয়োজনীয় মুহূর্তে তাদের এম্বুশের মধ্যে পাওয়া । যুদ্ধের ময়দানে সময়ের সদ্ব্যবহার করাই প্রত্যেক সেনানায়কের জন্য হয় অগ্নিপরীক্ষা এবং যিনি ঐ পরীক্ষায় সফল হন তিনিই যুদ্ধের গতিকে নিজের আয়ত্বে আনতে সক্ষম হন । ওহাবের কৃতিত্ব সেখানেই । শত্রুকে সঠিক সময়ে গুলিবর্ষণ করে তাঁকে অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলার মাধ্যমে সারপ্রাইজ অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল । অধিক সংখ্যক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের কার্যকরী গোলাবর্ষণ দ্বারা শত্রুর জনশক্তির প্রাধান্য বিশেষভাবে হ্রাস করা সম্ভব হয়েছিল । এতে প্রমাণিত হয় যে কো-অর্ডিনেটেড বা সমন্বিত ফায়ার দিয়ে নিজস্ব জনবল ও অস্ত্রশস্ত্রের স্বল্পতাও পুষিয়ে নেয়া যায় । এম্বুশ দল বেসামরিক পোষাক পরিধান করার ফলে এবং এলাকা ও প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়াতে দিবালোকেও তারা শত্রুর নজর এড়াতে সক্ষম হয় । এম্বুশ করার জন্য এমন স্থানে নির্বাচন করা প্রয়োজনের যেখান থেকে সহজে আড়াল নিয়ে লুকিয়ে থেকে শত্রুকে ঘায়েল করা যায় । যে সমস্ত শত্রু উঁচু রেল সড়ক বা রাস্তার অপর পার্শ্বে আড়াল নিয়েছিল তাদেরকে ঘায়েল করার জন্য মাথার ওপর দিয়ে গুলিবর্ষণ (High Trajectory Weapon) করা সম্ভব । এ রকম অস্ত্র যেমন মর্টার, গ্রেনেড ফায়ারিং রাইফেল ইত্যাদি ব্যবহার করার প্রয়োজন ছিল বা সাথে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল তারা করেননি বা সাথে নেননি । শত্রুর দিক থেকে বলা যায় যে তারা যদি হতবুদ্ধি না হয়ে এম্বুশকারী দলের ওপর সরাসরি চার্জ করে বের হয়ে যেত তবে সেটাই হত বুদ্ধিমানের কাজ । কেননা এই ধরণের এম্বুশে সেটাই করা বেশি প্রয়োজন । এতে তাদের হয়তো কিছুটা ক্ষয়ক্ষতি হত কিন্তু তারা এম্বুশকারীদের উদ্দেশ্য বানচাল করে দিতে পারতো । এমনকি সমস্ত দলকে উলটো ধ্বংস করে দিতে পারত । কারণ শত্রু যেভাবে ট্রলিটিকে দুইধার দিয়ে এসকট করে আসছিল সেইভাবে তারা যদি এম্বুশকারীদের উপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালাত তবে এম্বুশদলের পক্ষে উইথড্র করা খুব কঠিন হত । ঝিকুরা অভিযান এটি সুবেদার ওহাবের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি উল্লেখযোগ্য এম্বুশ । জুলাই মাসের ১০ তারিখে কসবা থানাধীন ঝিকুরা গ্রামের কাছে এই অভিযান চালান হয় । এই অভিযানে প্রায় ১২জন আরোহীসহ (এর মধ্যে সম্ভবত ৮জন অফিসার) পাকবাহিনীর ১টি স্পিড বোট সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয় । সহজ পরিকল্পনা, নিজেদের মধ্যে সমঝোতা এবং উদ্দেশ্য কার্যকর করার মনোবল থাকলে দিনের বেলাতেও যে এম্বুশ করে শত্রুকে ধ্বংস করা সম্ভব এটা তারই একটা জ্বলন্ত উদাহরণ । মে-জুন মাসে পাকসেনারা কসবা থানার শালদানদী, মন্দভাগ বাজার, কামালপুর ইত্যাদি এলাকায় প্রতিরক্ষাব্যূহ রচনা করে । এসব এলাকায় যোগেরযোগের জন্য কুমিল্লা থেকে সিএন্ডবি সড়কযোগে তারা কালামুড়িয়া ব্রিজ পর্যন্ত আসার পর সেখান থেকে উল্লিখিত স্থানসমূহে রসদ, গোলাবারুদ ও সেনাবাহিনী পাঠানোর জন্য নদীপথ ব্যবহার করতো । শালদানদী দিয়ে শত্রুর চলাচল যম্বন্ধে সুবেদার ওহাব অবগত ছিলেন । কোনাবনে অবস্থানরত তার প্লাটুন নিয়ে এই পথে শত্রুর উপর এম্বুশ করার জন্য তিনি কোম্পানি অধিনায়কের অনুমতি গ্রহণ করেন । সেই অনুযায়ী তিনি ৩০/৩৫ জনের একটি দল প্রস্তুত করেন যার সহ-অধিনায়ক ছিলেন নায়েব সুবেদার মংগল মিয়া । ভারি অস্ত্রের মধ্যে ছিল ১টি মেশিনগান, ৭/৮টি লাইট মেশনগান । অভিযানের দিন অতি প্রত্যুষ সুবেদার ওহাব তার প্লাটুন নিয়ে কোনাবন শিবির ত্যাগ করেন এবং সীমান্ত অতিক্রম করে কালতাদিঘীর পাড় ও নাপতার হাট হয়ে সকাল নয়টায় তিনি মইনপুর গ্রামের পশ্চিম দিকে উপস্থিত হন । সেখানে পৌছে তারা দেখতে পান যে ১টি স্পিড বোট ও ৬/৭টি নৌকায় প্রায় ১০০জন পাকসেনা নদীর উভয় তীরে পায়ে হাঁটা প্রহরাদলসহ শালদা নদী দিয়ে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হচ্ছে । সুবেদার ওহাব অনুমান করেন যে শক্ত ঐ দিনই একই পথে প্রত্যাবর্তন করবে এবং তখনই তাঁকে আঘাত হানার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন । তার দলকে মইনপুর গ্রামে রেখে শত্রু চলে যাওয়ার পর সুবেদার ওহাব একা নদীর পাড়ে গিয়ে এম্বুশের স্থান নির্বাচন করেন । উক্ত এলাকার বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনী প্রতিরক্ষা অবস্থানে থাকায় তাঁর দলের ওপর শত্রুর পাল্টা আক্রমণের আশংকা করে সুবেদার ওহাব, মইনপুর গ্রামের উত্তরে অবস্থিত কামালপুর গ্রাম থেকে প্রায় এক হাজার গজ আগে বিনি নদীর পশ্চিম পাড়ে খালের ওপর ব্রিজে ১টি মেশনগান (হাবিলদার মুসলিমের দায়িত্বে) মইনপুর গ্রামের দক্ষিণ পূর্বে অবস্থিত এবং মইনপুর গ্রামের উত্তর পশ্চিমে গোবিন্দপুরের দিকে মুখ করে আরো ১টি লাইট মেশিনগান মোতায়েন করেন । এম্বুশের জন্য উপযুক্ত স্থান নির্বাচনের পর বেলা ১২টার দিকে প্লাটুনকে নির্ধারিত স্থানে মোতায়েন করা হয় (চিত্র দেখুন) । সুবেদার ওহাব ১টি এলএমজি সহ ৫/৬ জনকে নিয়ে নদীর পূর্ব পাড়ে একটি বটগাছের পাশে অবস্থান নেন । নায়েব সুবেদার মংগল মিয়া ৩/৪টি এলএমজি ও ৬ জনকে নিয়ে নদীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থান নেন । অপর একটি দলকে এলএমজিসহ বটগাছের ঠিক উত্তরে ২০/৩০ গজের মধ্যেই মোতায়েন করা হয় পূর্ব সংকেত দেয়া এবং প্রয়োজনবোধে শত্রুকে গুলি করার জন্য । ঐ এলাকায় পানির ওপর বেড়ে ওঠা ৪/৫ হাত লম্বা ধান ও ছন জাতীয় গাছ থাকায় তারা দিনের বেলায় শত্রুর দৃষ্টি থেকে নিজেদের আড়াল করে রাখতে সক্ষম হয়েছিল ।

দুপুর ২টার দিকে শত্রুর স্পিড বোটটিকে দলের অন্যদের থেকে অনেক আগে বেশ দ্রুত ফিরে আসতে দেখা যায় । যখন এম্বুশ দলের আওতার মধ্যে পৌছে যায় তখন সুবেদার ওহাব তার এলএমজি দিয়ে স্পিড বোটের ওপর গুলি শুরু করেন এবং পরিকল্পনা মাফিক দলের অন্যান্য সদস্যরা স্পিড বোটের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে । এই সময় স্পিড বোট থেকে সুবেদার ওহাবের দূরত্ব ছিল মাত্র ২৫/৩০ গজ । আচমকা এই গুলিবর্ষণে আক্রান্ত হওয়ার জন্য শত্রু মোটেই প্রস্তুত ছিল না ফলে আত্মরক্ষার কোনো সুযোগই তারা পায়নি । এত কাছে থেকে ফায়ার করার ফলে স্পিড বোটটি ঝাঁঝরা হয়ে যায় এবং এর ফলে সকল আরোহী নিহত হয় । সুবেধার ওহাবের মতে স্পিড বোট এর আরোহীদের মধ্যে সম্ভবতঃ ছিল পাকবাহিনীর ২জন কর্নেল, ২জন মেজর , ৪জন ক্যাপ্টেন (এদের মধ্যে ১জন ছিল বাঙালি মেডিক্যাল অফিসার) এবং ৩৩ বেলুচ রেজিমেন্ট এর সুবেদার মেজর । দু’জন কর্নেলের মধ্যে ১জন ছিল ৩৩ বেলুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ক লে. কর্নেল মাজহারুল কাইয়ুম । এই দলে নিহতদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল কুখ্যাত ক্যাপ্টেন বোখারী যার অত্যাচারে কুমিল্লা শহরে ত্রাস ও আতংকের সৃষ্টি হয়েছিল । অভিযানকারী দল স্পিড বোট থেকে ১টি এমজিও১এ৩ (MGIA3), ১টি এসএমজি, গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনাল ম্যাপ এবং বেতারযন্ত্র উদ্ধার করে । আবদুল জলিল, পিতা-আবদুল গফুর, মইনপুর, কসবা, তিনি তাঁর নৌকায় করে নায়েব সুবেদার মংগল মিয়ার দলকে নদীর ওপারে যেতে সাহায্য করেন এবং দূর থেকে স্পিড বোটের ওপর এ্যাম্বুশ প্রত্যক্ষ করেন । ৭নম্বর প্লাটুন কর্তৃক সম্পাদিত এ্যাম্বুশ সমূহের মধ্যে এটা ছিল সবচেয়ে সফল অভিযান । এতে আনুমানিক ১২জন নিহত হয় যার মধ্যে ৮জনই অফিসার ছিল বলে ধারণা করা হয় । এই অভিযানে প্রমাণিত হয় যে দিনের এম্বুশও সফল হতে পারে যদি তার পরিকল্পনা সহজ হয় ও দলের সদস্যবৃন্দ লক্ষ অর্জনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকে । এর বিশেষ দিকসমূহ ছিল পূর্বাহ্নে রেকি করে স্থানটি অতি সতর্কতার সাথে নির্বাচন করা হয়েছিল । এম্বুশটি এমন জায়গায় কার্যকর করা হয়েছিল যেখানে শত্রুর যাতায়াত ছিল এবং কাছাকাছি বেশ কিছু শত্রু অধ্যুষিত এলাকা থাকলেও এম্বুশ দলকে নিরাপদ রাখার জন্যে কমান্ডার সঠিকভাবে তিনটি স্থানে বহিরাগত শত্রুদের দলের ওপর নজর রাখা বা বাধা প্রদানের জন্য নিরাপত্তা প্রহরী দল নিয়োগ করেন । শালদা নদীর অপর পাড়ে নায়েব সুবেদার মংগল মিয়ার অধীনে একটি অবস্থান ছিল যেটা পরিহার করা যেত । যদি এম্বুশটি অসফল হত তবে উক্ত স্থান থেকে আসা এবং প্রধান দলের সাথে মিলিত হওয়া সম্ভব হত না । অধিকন্তু স্পিড বোটটি আগের মত নদীর উভয় তীর দিয়ে টহল দল কর্তৃক অনুসরণ করা হয়নি । এম্বুশ কমান্ডার স্বীকার করেছেন যে স্পিড বোটাটি যদি প্রহরীসহ আসত তবে তার দলের অধিকাংশই হতাহত হত ।

যদিও তার দলের অনেকেই কমান্ডারকে উদ্দেশ্য ত্যাগ করতে প্ররোচিত করেছিল তিনি তাদের কথায় কর্ণপাত না করে অভিযান কার্যকর করতে অবিচল ছিলেন যা অধিনায়কোচিত গুণ । লক্ষবস্তু আবির্ভুত হলে এম্বুশ দল অত্যন্ত দক্ষতার সাথে স্বল্পতম দূরত্ব থেকে অধিক সংখ্যক অস্ত্র দ্বারা কার্যকর ফায়ার শুরু করেছিল । প্রচলিত প্রশিক্ষণে লক্ষবস্তুর উপর ঘনীভূত ফায়ার (Concentrate Fire) এবং মৃত্যু এলাকা (Killing Zone)-এর অভ্যন্তরে আসলে শত্রুর উপর গুলিবর্ষণ করার যে শিক্ষা দেয়া হয়ে থাকে সুবেদার ওহাবের দলই এই অভিযানে তা সঠিকভাবে প্রয়োগ করেছেন । শত্রুর দিক থেকে বলা যায় যে এই ধরনের অভিযান ব্যাপৃত যে কোনো সেনাবাহিনী নদী পথে চলাচলের সময় যদি পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা (যেমন এস্কর্ট, পিকেটিং, ইত্যাদি) গ্রহণ না করে তবে সেটা তাদের জন্য বিপজ্জনক । যুদ্ধের সময় একস্থান থেকে অন্যস্থানে চলাচলের সময় নিরাপত্তা ব্যবস্থার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয় । শত্রুর বেপরোয়াপনা আর সুবেদার ওহাবের এম্বুশের স্থান ও অস্ত্র এর স্থান নির্বাচনে পারদর্শিতা ও দৃঢ় মনোবলই এম্বুশকে সাংঘাতিকভাবে সফল করেছে । মিরপর-মাধবপুর জুলাই মাসের প্রথমদিকে কুমিল্লা ব্রাহ্মণবাড়ীয়া সড়কের ওপর কালামুড়িয়া ব্রিজে প্রহরারত অনুগত রাজাকারদের (হাবিলদার বুরহানউল্লাহ) সহযোগিতায় এবং ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের সুবেদার আম্বিয়ার নেতৃত্বে কালামুড়িয়া ব্রিজটি রাতের অন্ধকারে ধ্বংস করে দেয়া হয় । একই রাতে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের সি কোম্পানি শালদানদীতে পাকবাহিনীর প্রতিরক্ষার উপর গুলিবর্ষণ করে । সেদিনই রাতে সুবেদার ওহাব সঠিকভাবে অনুধাবন করেন যে কালামুড়িয়া ব্রিজ পরিদর্শনে কুমিল্লা থেকে সিএন্ডবি সড়ক দিয়ে অবশ্যই পাক বাহিনীর অফিসাররা যাবে । এই সুযোগে উক্ত সড়কে এম্বুশ করার জন্য অধিনায়ক ক্যাপ্টেন গাফফারের কাছে অনুমতি গ্রহণ করেন যদিও তাঁকে জানানো হয় যে সুবেদার সামসুর মর্টারের গোলাবর্ষণ সহযোগিতা তিনি লাভ করবেন না (সুবেদার সামসু তখন মর্টার প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন) । আনুমানিক ৪০ থেকে ৫০ জনের একটি দল নিয়ে সুবেদার ওহাব শালদানদী এলাকা থেকে চাড়বা, ঝিকুরা ও শাইটলা হয়ে নৌকাযোগে সকাল ৯টার দিকে মাধবপুর গ্রামে পৌছান । সেখানে পৌছার পর স্থানীয় লোক মারফত জানতে পারেন যে পাকবাহিনীর একটি পতাকাবহনকারী জিপসহ মোট তিনটি গাড়ি ইতোমধ্যেই কুমিল্লার দিক থেকে কালামুড়িয়া ব্রিজের দিকে গেছে । উপরোক্ত সংবাদ প্রাপ্তির পর সুবেদার ওহাব তার দলকে সংক্ষিপ্ত ব্রিফিং করেন এবং তার নির্দেশ মতো তারা মীরপুর-মাধবপুর এলাকায় সিএন্ডবি সড়কের পূর্ব পাশে অবস্থান গ্রহণ করে (চিত্র দেখুন) । অধিনায়ক নিজে রাস্তার কাছাকাছি একটি ঘরের পাশে এলএমজি সহ তার উত্তরে পুকুরের পাড়ে এবং সর্ব দক্ষিণে নায়েক তাহের আর একটি পুকুরের ধারে গাছপালার ঝারিতে এলএমজিসহ অন্যান্য সৈনিকদের নিয়ে অবস্থান নেয় । এই সময় উত্তরদিক থেকে দক্ষিণে ৩জন রাইফেলধারী রাজাকারদের এম্বুশ দলের অধিনায়কের অবস্থান থেকে প্রায় ৪০০ গজ দক্ষিণে রাস্তার ওপর ব্রিজের (২নম্বর ব্রিজ) নিচে প্রহরারত তাদের অন্যান্য সঙ্গীদেরসহ অগ্রসর হতে দেখা যায় । সুবেদার ওহাবের নির্দেশে নায়েব সুবেদার মংগল মিয়া অতি সন্তপর্ণে এগিয়ে তাদের মধ্যে বাচ্চু নামে একজনকে (যার কাছে রাইফেল ছিল) পেছন দিক থেকে জাপট ধরে ফেলেন তখন অন্য দু’জন “মুক্তি আগিয়া” বলে চিৎকার করে ওঠে । বাকি দু’জনকে আত্মসমর্পন করার জন্য আদেশ দেয়া হলে তারা তাদের হাতিয়ার নিয়ে আসার কথা বলে উক্ত ব্রিজের দিকে (যেখানে তাদের প্রহরী ছিল) অগ্রসর হয় । এম্বুশ দল উত্তর দিক থেকে শত্রুর আগমনের জন্য প্রতিক্ষা করছিল কিন্তু উক্ত রাজাকারদ্বয় ব্রিজের কাছাকাছি পৌছাতেই দক্ষিণ দিক কুমিল্লার দিক থেকে একটি জানালা বন্ধ বাস সেখানে ব্রিজের কাছে পৌছলে তারা সেটা থামায় । দূর থেকে সুবেদার ওহাব রাজাকারদ্বয়কে বাসে আরোহীরা মিলিটারি কিনা জিজ্ঞেস করলে তার উত্তর দেয় আরোহীরা সিভিল । এর কিছুক্ষণ পরেই ১টি ডজসহ আরো দু’টি গাড়ি দক্ষিণদিক থেকে বাসের পেছনে এসে থামে । এম্বুশ দলের সর্ব দক্ষিণে অবস্থানকারী নায়েক তাহের এই গাড়িদ্বয়ের আরোহিদের মিলিটারি বলে চিনতে পারে এবং সে সঙ্গে সঙ্গে সুবেদার ওহাবকে জিজ্ঞেস করে তাদের উপর ফায়ার করবে কিনা । সুবেদার ওহাব তৎক্ষণাৎ তাকে ফায়ার করার আদেশ দেন এবং দক্ষিণ দিকে অবস্থানকারী সকলেই একযোগে বাসে ও ডজের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে । একই সময় গোলাগুলির আওয়াজের মধ্যে হঠাৎ সুবেদার ওহাব দেখেন যে পতাকাবাহী ১টি জিপ কালামুড়িয়া ব্রিজের দিক থেকে অতি দ্রুতবেগে ১নম্বর ব্রিজটি অতিক্রম করে চলে যাচ্ছে । দেখা মাত্রই তিনি এলএমজি দ্বারা জিপের ওপর গুলিবর্ষণ করার প্রচেষ্টা চালান কিন্তু প্রথমত সেফটি ক্যাচ অন না থাকায় এবং লিড নিতে ভুল করায় এবং তাড়াহুড়োর মধ্যে তিনি জিপে আঘাত করতে ব্যর্থ হন । ফলে সম্ভব ব্রিগেড কমান্ডারের জিপ আশ্চর্যজনকভাবে খুব দ্রুতগতিতে এম্বুশ এলাকা অতিক্রম করে চলে যেতে সক্ষম হয় । তবে তার সামান্য পেছনেই আগমনকারী ১টি ডজের প্রভূত ক্ষতি সাধন করতে সক্ষম হন এবং কয়েকজন পাকসেনা রাস্তার পাড়ে আশ্রয় নেয় এবং অন্যান্যরা হতাহত হয় । গুলিবর্ষণ বন্ধ করার পর নায়েব সুবেদার মংগল মিয়াকে রাস্তার কাছে পাঠানো হয় যারা বেঁচে আছে তাদের আত্মসমর্পণ করানোর জন্য । নায়েব সুবেদার মংগল মিয়া তার পাশের জওয়ানকে সাথে আসার অনুরোধ করে কিন্তু জওয়ান চেম্বারে গুলি ভরায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তার পাশে অবস্থিত এফএফ (ছাত্র) মোজাম্মেল হক তার সাথী হন । তিনি রাস্তার কাছে পৌছিয়ে চিৎকার করে শত্রুদের আত্মসমর্পণ করতে বলেন । তখন পাকসেনাদের ইএমই কোরের ১জন নায়েক হাত তোলার ভান করে রাস্তার উপর উঠে এসে আচমকা নায়েব সুবেদার মংগল মিয়াকে লক্ষ করে গুলি ছুঁড়ে । তৎক্ষণাৎ মাটিতে শুয়ে পড়ে মংগল মিয়া সৌভাগ্য ক্রমে রক্ষা পান । আবার এটিএমসমর্পণ করার আদেশ দেয়া হলে একজন নায়েক (পাঠান) আত্মসমর্পণ করে । তারপর আরো একজন আসে । তখন নিরুপায় হয়ে প্রথমোক্ত ইএমই কোরের নায়েক, নায়েব সুবেদার মংগল মিয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করে । তাদের হাতিয়ার সংগ্রহ করা হয় । সুবেদার ওহাবের বক্তব্য অনুযায়ী এই অভিযানে বেশ কিছু সংখ্যক পাকসেনা হতাহত হয় এবং কয়েকটি গাড়ি কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় । ব্রিগেড কমান্ডারের জিপের পেছনে আগমনকারী সিভিল গাড়িটি ধ্বংস অবস্থায় অনেকদিন পর্যন্ত সেই স্থানে পড়েছিল বলে স্থানীয় লোকজনের কাছে যানা যায় । একজন রাজাকার সহ ৪জন শত্রুসেনা হাতেনাতে বন্দি করে নায়েব সুবেদার মংগল মিয়া এই অভিযানে সাহসিকতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন । মাধবপুর গ্রামের পূর্বদিকে রাখা নৌকায় উঠে দেখা যায় সিপাহী দারুল আলম সেখনে পোছায়নি । সুবেদার ওহাব আবার পূর্বস্থানে ফিরে এসে সিপাহী দারুলকে খোঁজ করেন । সে দক্ষিণ পূর্ব দিকের পুকুরের পাড় থেকে তখনও দক্ষিণ দিকের গাড়িগুলোর উপর ফায়ার করছিল । তাঁকে নিয়ে প্লাটুন একই পথে কোনাবন ক্যাম্পে প্রত্যাবর্তন করেন । ৪ জন বন্দিকে সাথে করে কোনাবনে নিয়ে আসা হয় এবং তাদেরকে কোম্পানি সদরে হস্তান্তর করা হয় । বন্দি করার সময় দু’একটি চড় থাপ্পড় দেয়া ছাড়া পথে তাদের সাথে কোনো প্রকার দুর্ব্যবহার করা হয়নি বলে সুবেদার ওহাব উল্লেখ করেন । দেউশ-মন্দভাগ অভিযান এ সময় বর্ষাকাল থাকায় চারদিক পানিতে নিমজ্জিত ছিল । ফলে শালদানদীর সাথে যোগাযোগ রক্ষায় পাকবাহিনীকে কুটি থেকে শালদানদী পথ অথবা চান্দলা খাল ব্যবহার করতে হত । এই সকল পথে প্রায় রসদ ও যুদ্ধ সরজ্জাম বহনকারী নৌকায় পাকসেনারা শালদানদীতে যাতায়াত করতো । ৭ নম্বর প্লাটুনের দায়িত্ব ছিল মন্দভাগ বাজার হয়ে শালদানদী যাতায়াতকারী শত্রুর যে কোনো দলকে প্রতিহত করা ঐ দিন চান্দলা খাল দিয়ে ৩৩ বেলুচ রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানি রাতের অন্ধকারে শালদানদী অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকে । সুবেদার ওহাবের প্রতিরক্ষা ছিল এমজি (ক) চান্দলা খালের দক্ষিণ পাড়ে আবু মিয়ার বাড়ির পাশে । (খ)দ্বিতীয় এমজির অবস্থান সঠিকভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি । এলএমজি-গুলো ছিল (ক) মসজিদের পাশে (খ) ২ নম্ভর পুকুরের নিকট । (গ) ১ নম্ভর পুকুরের পাড়ে । (ঘ) স্কুলের পাশে । (ঙ) খালের দক্ষিণ পাড়ে । (চিত্র দেখুন) ভোর ৪টার দিকে শত্রুর অগ্রসরমান নৌবহনের শব্দ চান্দলা খালে মাছ ধরায় নিয়োজিত জনৈক আবু মিয়া শুনতে পায় । তার সন্দেহ হওয়াতে সে তার বাড়ীর নিকটবর্তী মেশিনগান পোস্টের খবর দেয় । কিন্তু উক্ত এমজি পোস্টে কোনো প্রতিক্রিয়া না হওয়ার পূর্বেই প্রথম নৌকা প্রতিরক্ষা অবস্থানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে । ঠিক এ সময় মসজিদের পাশের এলএমজি পোস্টের নায়েক আতাউর রহমান (১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট)নৌকাকে থামার আদেশ দেয় । তখন শত্রু সেখানে মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতি টের পায় এবং নায়েক আতাউর রহমানকে নৌকা থেকে উর্দুতে গালিগালাজ করে । এতে নায়েক আতাউর পাকসেনাদলের উপস্থিতি সম্বন্ধে নিশ্চিত হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে তার এলএমজি দিয়ে গুলিবর্ষণ করে । এতে সমগ্র প্রতিরক্ষা সচকিত হয়ে উঠে এবং নৌকার উপর গুলিবর্ষণ করে । এ সময় সুবেদার ওহাব তার প্লাটুন নিয়ে সদর দফতর মন্দভাগ বাজারে অবস্থান করছিলেন । তিনি সম্মুখে এসে ফায়ার যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণে আনেন এবং প্রথমে মসজিদের এলএমজি পোস্ট ও পরে আবু মিয়ার ঘরের পশ্চিম দিকের এমজি পোস্ট থেকে শত্রুর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন । শত্রুর ৭/৮টি নৌকা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং উক্ত পাকসেনা দলের অধিকাংশই নিহত অথবা আহত হয় । সূর্য ওঠার পর সকালে সুবেদার ওহাব তার দলের কিছু সদস্য নিয়ে নৌকা এবং খাল থেকে ১৫/২০টি লাশ উদ্ধার এবং স্থানীয় দু’একজন লোকের সহায়তায় (দেউশ গ্রামের মহব্বত আলী পাকসেনাদের লাশ দেখেছে এবং ১২টি লাশ কোনাবন পর্যন্ত বহন করেছে বলে জানায়) বেশ কিছু লাশ কোনাবন কোম্পানি সদরে পাঠানো হয় । ভোর রাতে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর সকাল দশটার দিকে বেশ কিছু সংখ্যক পাকসেনা সংগঠিত হয়ে এবং নতুন শক্তি নিয়ে পশ্চিম ও দক্ষিণ দিক থেকে অগ্রসর হতে শুরু করে । এ সময় সুবেদার ওহাব এমজি পোস্ট এবং দলের অন্যান্য সদস্য স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে অত্যান্ত কার্যকরীভাবে শত্রুর উপর গুলিবর্ষণ করলে অনেকেই নিহত এবং আহত হয় । কিলিং জোনে মুক্তিবাহিনীর সমন্বিত গুলিবর্ষণের ফলে পাক সেনাদের প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয় এবং তারা অগ্রসর হওয়ায় বাসনা ত্যাগ করে । কিন্তু সম্মুখ সমরে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করার পর দুপুর প্রায় একটার দিকে শত্রু দেউশ প্রতিরক্ষার উপর প্রচণ্ড বিমান হামলা শুরু করে । বিমান আক্রমণে ৪টি বিমান অংশ নিয়ে পর্যায়ক্রমে দুদিকে থেকে গুলিবর্ষণ করে । সৌভাগ্যক্রমে সুবেদার ওহাবের প্লাটুন বিস্তৃত হয়ে নিকটস্থ গ্রাম ও গাছপালার আড়ালে আশ্রয় নেওয়ায় কেউ হতাহত হয়নি । এ ব্যক্তব্যের স্বপক্ষে নয়নপুর গ্রামের শাহ এমরান গাজীও একই মত প্রকাশ করেঞ । বিমান হামলার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে সুবেদার ওহাব তার অপারেটর হাবিদার মোসলেমের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে হামলা চলাকালীন এবং তার পরে প্রায় ১ঘন্টা কোম্পানি দফতরে যোগাযোগ করতে সক্ষম হননি । এদিকে কোনো যোগাযোগ না হওয়াতে কোনাবনে অবস্থিত ক্যাম্পের সকলে চিন্তিত হয়ে পড়ে এবং নায়েব সুবেদার শহীদকে ৩/৪ জনসহ সংবাদ জানার জন্য পাঠানো হয় । নায়েব সুবেদার শহীদ দেউশে পৌছে সুবেদার ওহাবের দলকে নিরাপদ অবস্থায় দেখতে পান এবং কোম্পানি সদরে সংবাদ জানানো হয় ।

সিদ্দিকুর রহমান ভূঁইয়া, পিতা-মৃত আসমত আলী, দেউশ, কসবা এবং আবদুল গফুর, দেউশ, কসবা । এরা দুজন ভোর রাতে পাকসেনাদের উপর গুলিবর্ষণের পর মসজিদে আশ্রয় গ্রহণ করেন । এই অভিযানে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে রাতের অন্ধকারে অপ্রস্তুত অবস্থায় ঢুকে পড়া শত্রুকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয় । এর উল্লেখযোগ্য দিকগুলো হচ্ছেঃ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রসমূহ মোটামুটি আদর্শ স্থানে স্থাপনের ফলে একটা শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পড়ে উঠেছিল । স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র স্থাপনের নীতিসমূহ যুদ্ধের সময় মেনে চলার জন্য সামরিক প্রশিক্ষণে সবসময় বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয় । দেউশ-মন্দভাগ বাজার অভিযানে দেখা যায় যে সব স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ফিল্ড অব ফায়ার, পারস্পরিক সহযোগিতা, কনসিলমেন্ট ইত্যাদি থাকার ফলে উক্ত প্লাটুন তাদের অবস্থান থেকে শক্তিশালী ও অত্যন্ত কার্যকরী গুলির জাল সৃষ্টি করেছিল যা ভেদ করা শত্রুর পক্ষে কোনো ক্রমেই সম্ভব হয়নি বরং তাদেরকে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে । প্রতিরক্ষা অবস্থানে শত্রুর আগমন সম্বন্ধে জানার জন্য (Continuous Alertness) অবিরাম সতর্কতা অবলম্বনে এবং কোনো কিছু দেখা কিংবা শোনার জন্য সজাগ সৃষ্টি রাখা একান্ত প্রয়োজন । এই অভিযানে দেখা গাছা যে, খালের প্রথম এমজি পোস্ট অতিক্রম করে অনেক ভিতরে এলএমজি পোস্টের নিকট শত্রুর নৌকা পৌছার পরই কেবল তাঁকে চ্যালেঞ্জ করা হয় । শত্রু গালিগালাজ না করে সক্রিয় হলে প্রতিরক্ষাব্যুহের প্রভূত ক্ষতি করতে পারতো । প্রথমদিকে সমস্ত প্লাটুন একযোগে ফায়ার শুরু করে । সুবেদার ওহাব সামনে এসে ফায়ার নিয়ন্ত্রণে আনেন । অনিয়ন্ত্রিত ফায়ার শুরু গুলির অপচয়ই করে না, কোনো কার্যকর ফলও আনতে পারে না । অন্যদিকে শত্রু সহজেই অস্ত্রের অবস্থানগুলো চিহ্নিত করে প্রতিরক্ষাব্যূহের দুর্বল স্থানে আক্রমণ এবং অস্ত্রসমূহের মর্চার পর সরাসরি গুলিবর্ষণ করতে সক্ষম হয় । যে কোনো অভিযানে ফায়ার কন্ট্রোল অত্যাবশক । বিমান হামলার সময় সুবেদার ওহাবের প্লাটুন ছড়িয়ে ছিটিয়ে গাছপালার আড়ালে আশ্রয় নেয়ার ফলে তাদের কোনো ক্ষতি সাধিত হয়নি । বিমান হামলা শুরু হওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে সুবেদার ওহাবের সিগন্যাল অপারেটর তার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, ফলে অনেকক্ষণ পর্যন্ত তার পক্ষে যোগাযোগ করা সম্ভবপর হয়নি । তাই বেতারযন্ত্র ছারাও যোগাযোগের বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে সংবাদ বাহক থাকা একান্তভাবে প্রয়োজন । শত্রু কোনো প্রকার রেকি ছারাই নৌকাযোগে চলাচল করেছিল । তার ভুলের মাসুল তাঁকে দিতে হয়েছে চরমভাবে । সর্বদাই রেকি পেট্রোল পাঠিয়ে এলাকা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকা প্রত্যেক কমান্ডারের আশু কর্তব্য তা না হলে প্ল্যান যত উন্নতমানের হউক না কেন তা ব্যর্থ হতে বাধ্য । প্রশিক্ষণকালে যুদ্ধের কলাকৌশল পুস্তক অনুযায়ী অবশ্যই দেখা উচিত । কলাকৌশলগুলো বিশেষভাবে রপ্ত করতে পারলেই যুদ্ধের ময়দানে পরিস্থিতি মোতাবেক নিজেদের অবস্থান, দল বিন্যাস, সংগঠন ইত্যাদি রদবদল করা সম্ভব । প্রায় সব ক্ষেত্রেই সুবেদার ওহাব পরিস্থিতি ও নিজ সৈনিকদের প্রশিক্ষণের মান অনুযায়ী দলের বিন্যাস, সংগঠন ও অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন । সর্বোপরি অধিনায়কোচিত আচরণ তিনি সকল অভিযানে দেখিয়েছিলেন । যার ফলে কেতাবী নিয়মে পরিপূর্ণভাবে দুরন্ত না হলেও সবগুলো অভিযান সাংঘাতিকভাবে সফল হয়েছিল । সৌভাগ্যবান বটে, তবে তার ব্যক্তিগত সাহসিকতাই তাকে এই সফপলতা এনে দিয়েছে । তাই বলা হয়  It is not the gun but the man behind the gun which matters. সবগুলো অভিযানের মধ্যে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি প্রণিধানযোগ্য তা হলো, ওহবের দল তাদের প্রয়োজনীয় রসদপত্র নিয়মিত পেয়েছে এবং নিরাপদ হাইড আউট থেকে নিশ্চিত মনে বের হয়ে জনগণের সাথে মিশে যেতে পেরেছিল । এবং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা আর তাদের আশা আকাঙ্ক্ষা একে অপরের মাঝে লীন হয়ে গিয়েছিল যার ফলে সর্বত্রই জনগণের সক্রিয় সহযোগিতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তারা পেয়েছিল, তা না হলে কোনো অভিযানই সফল হত কিনা বলা মুশকিল । অন্যদিকে শত্রুর (পাকবাহিনী) জন্য কোনো কিছুই নিরাপদ ছিল না । যে মাঝি তাঁকে নৌকা দিয়ে নদী পার করে দিচ্ছে সেও মুক্তিবাহিনীর লোক হতে পারে । যে বালক তাকে পানি সরবরাহ করছে তার কাছেও একটা গ্রেনেড থাকতে পারে । এই বাড়তি মানসিক চাপই শত্রুকে ঘায়েল করেছে সবচেয়ে বেশি । যুদ্ধটা কিসের জন্য এবং কার জন্য-সে কোনো উত্তর পায়নি তাই যুদ্ধটা তার কাছে যেমন অর্থবহ নয় অন্যদিকে যুক্তবাহিনীর জন্য যুদ্ধ হলো জেহাদ-মৃত্যু মানে শাহাদাত । অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের দক্ষতা না থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধের ময়দানে এ মনোবল তাকে দারুণভাবে চাঙ্গা রেখেছে । এটাই তার সাফল্যের মূল চাবিকাঠি । তাই বলা হয় সেনাবাহিনী জনগণের ভালোবাসার সাগরে ভেসে ভেসে জনগণের জন্য যুদ্ধ করে জীবন উৎসর্গ করে ধন্য হয় । সে মৃত্যুতে আছে অনাবিল আনন্দ । আছে গর্ব-যদিও ভয়ংকর তবুও জীবন সেখানে রক্তাক্ত সৌন্দর্যে মহীয়ান হয়ে উঠে ।

মেজর জেনারেল আমীন আহম্মদ চৌধুরী, বীর বিক্রম জন্মঃ ১৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯৪৬, ফেনী । শিক্ষাঃ ময়মনসিংহের সিটি কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৬১ সালে এসএসসি এবনহ আনন্দমোহন কলেজ থেকে ১৯৬৩ সালে এইচএসসি । চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ । ৫ই জুন ১৯৬৬ সালে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এ কমিশন লাভ মুক্তিযুদ্ধে রাত ৩/৪ আগস্টে শেরপুরের নকশী বিওপি-তে পাকিস্তানি শক্ত অবস্থানের উপর ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুই কোম্পানি নিয়ে আক্রমণ করেন । এই আক্রমণে তিনি দুইবার আহত হন । সরকার তাকে ‘বীর বিক্রম’ উপাধিতে ভূষিত করে । তিনি ওমানে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন । মেজর জেনারেল আমীন আহম্মদ চৌধুরী, বীর বিক্রম বর্তমানে অবসর জীবন যাপন করছেন ।

Ref: স্বাধীনতা মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া