You dont have javascript enabled! Please enable it!

উত্তর জনপদের এক রণাঙ্গন

মাহাবুব এলাহী রঞ্জু, বীর প্রতীক

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জীবনের সব চাইতে স্মৃতিময় অধ্যায় । লাখো শহীদের রক্তস্নাত স্বাধীনতা বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন । হাজার বছরের ঐতিহ্য ও ইতিহাস সমৃদ্ধ একটি জাতি সুদীর্ঘ পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তি পেয়েছিল । শত সংগ্রাম ও সর্বোচ্চ ত্যাগ, তিতিক্ষা ও লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির বীরত্ব অসীম সাহসিকতার সাথে লড়াই করে গৌরনময় বিজয় অর্জন বিশ্বের মুক্তিকামী জনগণের নিকট দৃষ্টান্ত ও প্রেরণার উৎস হয়ে আছে । আমরা সত্যই সৌভাগ্যবান সেদিন আমাদের অনেকের জীবনে সুযোগ এসেছিল মাতৃভূমির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার । সেই মহান মুক্তিযুদ্ধের আমিও একজন গর্বিত মুক্তিযোদ্ধা । ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই এই ভূখন্ডের বাঙালিরা স্বতন্ত্র জাতিসত্ত্বার প্রকাশ ঘটে । পাকিস্তান আমল জুড়ে কখনো সামরিক শাসন কখনো বেসামরিক সরকারের লেবাসে সামরিক সরকারের অত্যাচার, নির্যাতন, দুঃশাসনে বাঙালির নিজস্ব রাষ্ট্রে প্রতষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা নিরস্ত্র সংগ্রাম এবং আন্দোলন থেকে সশস্ত্র যুদ্ধে পরিণত হয় । যুদ্ধের ঘটনাবলি সুখপাঠ্য কিংবা শুনতে বা জানতে বেশ উত্তেজানাকর এটা সত্যি । কিন্তু যুদ্ধ মানেই ভয়াবহতা যুদ্ধ মানেই শত্রুর উপর আঘাত যুদ্ধ মানেই শত্রুকে ঘায়েল কিংবা নিধন করা, যুদ্ধ মানেই ধ্বংসস্তূপের উপর নব জাগরণ, সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ মূলত একটি সফল জনযূদ্ধ । প্রচলিত যুদ্ধের রণনীতি কিংবা রণকৌশলের দিক থেকেও স্বতন্ত্র । একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনীর বিপরীতে বাংলাদেরশের মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ? যে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তান সেনা নৌ বিমান বাহিনী থেকে সম্পর্ক ছিন করে আসা বাঙালি সন্তান ইপিআর, পুলিশ, আনছার মোজাহিদ বাহিনীর অধিকাংশ সদস্য ছাত্র কৃষক এবং শ্রমিকের সমন্বয়ে গঠিত! বস্তুত মোটেও তেমনটি না । মূলত সেদিনের যুদ্ধ হয়েছিল পাকিস্তানের বর্বর সেনা বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির । তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের সমগ্র জনগণের জাতীয় স্বাধীনতার প্রবল আকাঙ্ক্ষায় প্রজ্জলিত নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালি জাতির ইস্পাত কঠিন ঐক্য, দেশমাতৃকার জন্য আত্মত্যাগ এবং সম্মিলিত শক্তির মূর্ত প্রতীক ও সম্মিলিত কন্ঠের বহিঃপ্রকাশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । আর সেই দেশমাতার গর্ভে জন্মেছিল সূর্য সন্তানদের দ্ধারা গঠিত মুক্তিবাহিনী ।

আমরা যোদ্ধা কিংবা যুদ্ধাকঙ্খা হিংস্র বর্বর নিষ্ঠুর ও পরজাতির ধন লোভী কখনই ছিলাম না । আমরা নিরীহ, আমরা দেশপ্রেমিক আমরা ধার্মিক এবং ভিন্ন জাতির প্রতি সহানুভূতিশীল । আমাদের পোশাক পরিচ্ছদ, আচার, আচরণ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তার স্বাক্ষর বহন করে । রণহুংকার কিংবা রণসঙ্গীত আমাদের সাংস্কৃতি ঐতিহহ্য নেই । শত শত বৎসর ধরে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা পর আক্রমণকারী দখলদারদের শোষণ, অত্যাচার, নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতাঁর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন । ব্রিটিশদের এ দেশের মাটি থেকে তাড়িয়ে দিতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও সংগ্রামে আনাদের দেশের অনেক সূর্যস্নতান আত্মাহুতি দিয়ে ভারত উপমাহাদেশের ইতিহাসে খ্যাত হয়ে আছেন । মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা ব্যক্তি পর্যায়ে প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধাই অর্জন করেছেন । দলগত অভিজ্ঞতা অর্থাৎ, প্লাটুন, কোম্পানি ব্যাটালিয়ান, সেক্টর, সাব-সেক্টর ইত্যাদি আর সফল অভিজ্ঞতার বসামষ্টিক রূপ জাতীয় অভিজ্ঞতা । ১১ নম্বর সেক্টর অধীন সেদিনের মহুকুমা বর্তমানে গাইবান্ধা জেলার বিভিন্ন এলাকায় সহযোদ্ধাসহ মাঠে ময়দানে যুদ্ধ করেছি । কখনো “আঘাত এবং দৌড়” আবার কখনো সম্মুখ যুদ্ধ, কখনো অতর্কিত আক্রমণ, কখনো প্রতিহত । এছাড়াও পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে আতংকিত ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে দুর্বল করে পরাস্ত করার কৌশল অবলম্বন করা হয়েছিল । শহরের ছাত্র ও যুবক ছাড়া মুক্তিবাহিনীর অধিকাংশই ছিলেন গ্রামের গরীব কৃষক পরিবার থেকে আসা খেটে খাওয়া মানুষ । শারীরিকভাবে যোগ্য সহজ সরল দরিদ্র জীবনে অভ্যস্ত কষ্টসহিষ্ণু অদম্য মনোবল, অসীম সাহস ও নিখাদ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ এই সকল তরুণ যুবকেরা সামান্য প্রশিক্ষণ ও অতীব সাধারণ প্রচলিত অস্ত্র দ্বারাই সু-প্রশিক্ষিত ও আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত শক্তিশালী পাকিস্তানি দখলদার সেনাবাহিনীকে নাস্তানাবুদ করতে করতে চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে এগিয়ে যায় । শত শত ক্ষতি স্বীকার ও নিশ্চিত মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে গণমানুষের সমর্থন ও সাহায্যপুষ্ট হয়ে মুক্তিবাহিনী এগিয়ে যায় । আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র । আমার বাড়ি গাইবান্ধা শহরে । ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণার সাথে সাথে গাইবান্ধায় চলে আসি এবং স্থানীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি । ইতোমধ্যেই গাইবান্ধা কলেজের ইউওটিসি এর ডামি রাইফেল দিয়ে কলেজ মাঠে রাতের বেলা ছাত্র-যুবকদের ট্রেনিং চলছিল । ২৫ শে মার্চের কালরাতে হত্যাযজ্ঞের পর উত্তরের সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে আফতাব হাবিলদারের নেতৃত্বে ত্রিশ জনের একটি বাঙালি সেনাদল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে গাইবান্ধায় এলে তাদেরকে কেন্দ্র করে । অতোমধ্যেই ডামি রাইফেল নিয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছাত্র-যুবকেরা গাইবান্ধা ট্রেজারির আনছার বাহিনীর গচ্ছিত প্রায় তিনশত রাইফেল নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে । রংপুর সেনানিবাস থেকে কয়েক দফা পাকিস্তান বাহিনী এসে প্রতিরোধ বুহ্য ভেদ করতে আক্রমণ করে, কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায় । শেষ পর্যন্ত ১৭ই এপ্রিল কয়েকটি ট্যাঙ্ক ও অধিক শক্তি নিয়ে আক্রমণ করলে আমরা টিকে থাকতে পারিনি । পাকিস্তান সেনাবাহিনী গাইবান্ধা শহরে ঢুকে পড়লে আমরা শহর ছেড়ে পূর্ব দিকের ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে বিভিন্ন গ্রামে আশ্রয় নেই । রাত কাটিয়ে পরের দিন বিশাল ব্রক্ষপুত্র নদ পাড়ি দিয়ে দেশ মাতৃকার মুক্তির অদম্য বাসনা নিয়ে ভারতের অজানা গন্তব্যে রওনা হয়ে যাই । আমরা ২৫ জনের একটি দল বড় আকারের একটি নৌকায় চেপে বিশাল ব্রক্ষপুত্র নদ পাড়ি দিয়ে গভীর রাতে কালাসোনার চরে যাই । ১০ই আগস্ট খবর এল মানস নদীর পশ্চিম তীর সংলগ্ন রতনপুর গ্রামে একদল রাজাকার এসে ব্যাপকভাবে লুটতরাজ করছে । আমাদের অবস্থান নদীর পীর্ব পাড়ের গ্রামে । নদীর পাড়ে এসে ব্যাপারটি নিশ্চিত হয়ে আমরা ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকায় ভাগ হয়ে অতি সন্তর্পনে মানস নদী পার হয়ে পশ্চিম তীরে অবস্থান নিলাম । শত্রুরা আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে আমাদের উপর আক্রমণ করলে আমাদের পাল্টা আক্রমণে ওরা পরাস্ত হয়ে পালানোর চেস্টা করে । আমরা পলায়নপর বার জন রাজাকারকে অস্ত্রসহ হাতেনাতে ধরে ফেললাম । দুইজন রাজাকারকে পালানোর সময় স্থানীয় জনগণ ধরে পূর্ব ক্রোধের বসে ধারালো কোদাল দিয়ে ওদের দেহ কুপিয়ে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলে । রাজাকাদের নিকট থেকে দখল করা ষোলটি রাইফেল ও গোলাবারুদসহ রাজাকারদের হাতে পায়ে দাড়ি দিয়ে বেঁধে পশ্চিম তীর থেকে পূর্ব তীরের কালাসোনার চরে ফিরে এলাম । বন্দি রাজাকারদের দুইজন সাথী যোদ্ধাদের পাহারায় আমাদের মুক্ত এলাকার ক্যাম্পে পাঠিয়ে পরবর্তী নিশ্চিত যুদ্ধের জন্য তৈরি হতে লাগলাম । আমাদের অনুমান এবং ধারণা সম্পূর্ণ সঠিক ছিল । বিকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল ছুটে আসল রাজাকার ধরার স্থানে । আমরা কিছুটা তৈরি থাকাতে সহসাই যুদ্ধ বেঁধে গেল ।দু’পক্ষের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ গুলি বিনিময় হবার পর পাকবাহিনী পিছু হটে পালিয়ে যাবার সময় দুই তিনজন আহত হল । আমরা পুনরায় কালাসোনার চরে ফিরে পরের দিনের নির্ঘাত যুদ্ধের কৌশল, পরিকল্পনা, জনগণের উপর সমূহ নির্যাতনের সম্ভবনা ইত্যাদি নিয়ে দুশ্চিন্তাসহ রাত্রিযাপন করলাম । ধারণা ও আনুমানিক হিসাব এতটুকু ভুল ছিল না । সকাল থেকেই শুরু হল অগ্নিসংযোগ, বর্বরতা, লুটতারাজ । চারিদিকে নিরীহ মানুষের আর্তচিৎকার ও আর্তনাদে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠলো । সে এক নারকীয় দৃশ্য । প্রথমে লুটতরাজ করে বাড়ি ঘরে আগুন দিয়ে লুট করা মালামাল দুটি নৌকায় বোঝাই করে মানস নদীর পশ্চিম তীর ঘেঁষে নিরীহ মাল্লামাঝিদের দিয়ে নৌকার গুণ টানিয়ে উজানে রসুলপুর পাকবাহিনীর ক্যাম্পের উদ্দ্যেশে রওনা হল । কয়েকজন করে পাকসেনা নৌকার ছোয়ের উপর অস্ত্র উঁচিয়ে বসে, বাকিরা নদীর পাড় দিয়ে পায়ে হেঁটে রওনা দিল । যুদ্ধের কৌশলগত দিক থেকে আমরা মোটেও ভালো অবস্থানে ছিলাম না আমাদের অবস্থান শত্রুকে আক্রমণ করার পর্যায়ে ছিল না । এদের সমান্তরালভাবে আমরাও চরের ভিতর দিয়ে লুকিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলাম । সেই সকাল থেকে শুরু করে দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে একটু পানি পর্যন্ত পান করার সুযোগ হয়নি । কাশবন, কলাই ও ধৈনচা গাছের কারণে নদীর পূর্ব তীর বনাঞ্চলের মতো দেখাচ্ছিল । আর সেই আড়াল আবডালের সুযোগে আমরা অগ্রসর হচ্ছিলাম । এতক্ষণ সুবিধা ছিল কিন্তু এখন আর উপায় নেই । আমাদের সামনে চরের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত একটি নালা । সেটি অতিক্রম করতে গেলে পশ্চিম পাড় থেকে শত্রুরা আমাদের দেখে ফেলবে । এখন আর উপায় নেই, শুধুমাত্র একটি পথ খোলা । তাহলো শত্রুকে আক্রমণ করে পরাস্ত করা এবং নিজেদের বাঁচানো । মুহূর্তেই তুমুল লড়াই শুরু হয়ে গেল । প্রথম আঘাতেই নৌকার ছৈয়ে বসা সৈন্যরা গুলিবিদ্ধ পাখির মতো পানিতে পড়তে লাগলো । যারা নদীর পাড় দিয়ে অস্ত্র উঁচিয়ে পায়ে হেঁটে এগুচ্ছিল এখন তারা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে ক্রলিং করে পালাবার চেষ্টা করতে লাগল । দীর্ঘক্ষণ গুলি বিনিময় হবার পর ওদের কয়েকজন জীবন নিয়ে পালিয়ে গেল । আমরা ডিঙ্গি নৌকা দিয়ে ৩/৪ জন করে ভাগ হয়ে নদী পার হয়ে নৌকা দুটির নিকট যেয়ে হতবাক হয়ে গেলাম । চার জন যুবতীর আর্তনাদে আকাশ বাতাস কম্পিত হয়ে উঠল, প্রায় পঁচিশ-ত্রিশটি ছাগল, খাসি, বাক্স, ট্রাংক, চাল, ডাল ইত্যাদি দিয়ে নৌকা বোঝাই ছিল । মুহূর্তেই গ্রামবাসীরা ছুটে আসতে লাগলো ইতোমধ্যেই পাক সেনাদের কয়েকটি লাশ নদীতে ভেসে গেছে । বাকি ৬/৭ টি লাশ গ্রামবাসী তড়িঘড়ি করে নদীতে ভাসিয়ে দিল । বেদনা এবং বিষণ্ণতার মাঝেও যেন আনন্দের বন্যা । স্থানীয় মুরুব্বিদের ঐ সকল লুটকরা মালামাল যথাযথদের ফেরত দেবার জন্য বুঝিয়ে দিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের একটি চাইনিজ স্টেনগান ও পাঁচটি চাইনিজ রাইফেলসহ বেশ কিছু গোলাবারুদ ও রাজাকারদের দশটি রাইফেল আমাদের হস্তগত হল । দখলকৃত অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং ধরা পড়া কয়েকজন রাজাকারকে নিয়ে যখন ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বে তীরের মুক্ত এলাকায় ফিরে এলাম তখন যেন আনন্দের উৎসব । মুক্তিকামী জনতা ঐ ধৃত রাজাকারদের হত্যা করতে চায় । মানকাচর সাব-সেক্টরের আমরাই প্রথম মুক্তিযোদ্ধা দল যারা পাক সেনাবাহিনীর দখলকৃত অস্ত্র ও রাজাকারদের বন্দি করে মুক্ত এলাকায় নিয়ে এসেছিলাম । বাঙালি সন্তান ভুল করে বাঙ্গালির বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকের ভূমিকায় নেমেছে এই বিশ্বাসে সেদিন ওদের ক্ষমা করেছিলাম । মজার বিষয় হচ্ছে ঐ সকল বন্দি রাজাকারদের সকলেই চূড়ান্ত বিজয় পর্যন্ত আমাদের রঞ্জু কোম্পানির সাথেই ছিল । পাক সেনাকে হত্যা করে তাদের অস্ত্র সংগ্রহ করার প্রথম এই সফল অভিযানের মধ্য দিয়ে আমাদের অঞ্চলের যুদ্ধের গতি নতুন মাত্রা পেল । আমাদের সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল অনেক অনেক বেড়ে গেল । এই সফল অভিযানের কয়েকদিন পরেই আমাদের অপর একটি বোনারপাড়া-ফুলছড়ি রেলওয়ের ভারতখালী রেল স্টেশনের পশ্চিমে রেল লাইনে ট্যাংকে বিধ্বংসী মাইন বসিয়ে পাকিস্তানি সেনা বহনকারী একটি ট্রেনের কয়েকটি বগি উড়িয়ে দিয়ে পাক বাহিনীর উপর প্রবল আক্রমণ করলে লে.কর্নেল রহমত উল্লাহ এবং মেজর শের আলী খানসহ প্রায় বিশ জন পাক সেনা নিহত হয় । পাকিস্তান বাহিনী সাধারণত ট্রেনের ইঞ্জিনের সম্মুখে একটি কিংবা দু’টি খালি মালবাহী বগি সংযোগ করে চলাচল পরিচালনার সময় আশেপাশের জনগণের উপর পাকিস্তান বাহিনীর অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যাবে, সমূহ ক্ষতি এবনহ নিশ্চিত মৃত্যু ভয়কে উপেক্ষা করে নিরীহ জনগণ মুক্তিবাহিনীকে উৎসাহ প্রদানসহ সব ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করেছে ।

আগস্টের প্রথম দিকে খুব সুষ্টুভাবে কমান্ড স্থাপিত হল । সেক্টর হেডকোয়ার্টা, সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টার এবং কয়েকটি করে যুদ্ধরত কোম্পানি । আমাদের ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে মানকাচর সাব-সেক্টরের কোম্পানি কমান্ডারদের মধ্যে খন্দকার রুস্তম আলী, মাহাবুব এলাহী রঞ্জু, এম এন নবী লালু, আমিনুল ইসলাম সুজা এবং খায়রুল আলম (নজরুল ইসলাম) প্রমুখ এক একটি কোম্পানির সেনাবল একশ পঞ্চাশ জনের অধিক কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনশত ছাড়িয়ে গিয়েছিল । কোম্পানি কমান্ডারদের নাম অনুসারে কোম্পানিগুলির নামকরণ করা হয় । যেমন রুস্তম কোম্পানি, রঞ্জু কোম্পানি, লালু কোম্পানি, সুজা কোম্পানি, খায়রুল আলম কোম্পানি ইত্যাদি । গাইবান্ধা শহর থেকে সুন্দরগঞ্জ থানা এলাকায় যাবার রাস্তায় প্রায় তিনশত ফুট দৈর্ঘ দাড়িয়াপুর সেতুটি গুরুত্বপূর্ণ । সেতুটি উড়িয়ে দিতে পারলে শত্রুর যোগাযোগ ব্যাহত হবে এবং সেই সুযোগে শত্রুর উপর আক্রমণ জোরদার করে শত্রুকে ঘায়েল করা সহক হবে । পরিকল্পনা মাফিক আমাদের রঞ্জু কোম্পানির প্রায় একশ জন সদস্য ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ি দিয়ে সুন্দরগঞ্জ থানাধীন দক্ষিণ শ্রীপুরে অবস্থান গ্রহণ করে । পথ-ঘাট দেখানোর জন্য স্বেচ্ছায় ষাটোর্ধ বয়সের শরনার্থী রাজেন বাবু আমাদের সাথে এসেছেন, তার বাড়ি সুন্দরগঞ্জ থানাধীন ছাগড়হাটি গ্রামে । ১৭ই সেপ্টেম্বর দিনগত রাতে সেতুটির উভয় প্রান্তের পাহাড়ারত শত্রু পক্ষের সঙ্গে প্রচণ্ড লড়াই হয় । সেতুটির গুরুত্ব বুঝে পাকা বাংকার বানিয়ে শত্রুপক্ষ বেশ কিছুদিন যাবত সেখানে অবস্থান করছিল । যাহোক শেষ পর্যন্ত শত্রুরা পরাস্ত হলে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিস্ফোরক বসানো হল । বিকট শব্দে দাড়িয়াপুর সেতু ধ্বংস হয়ে পানিতে পড়ে যায় । এতবড় একটি সেতু ধ্বংস হয়ে পানিতে পড়ে যাবার দৃশ্য স্বল্প কথায় বর্ণনা করা সম্ভব নয় । সফল অভিযানের আনন্দ নিয়ে আমরা ভোরবেলা আশ্রয়ে ফিরছিলাম । দাঁড়িয়াপুর সেতুর দুই কিলোমিটার উত্তরে মাঠের হাটে পৌছলে আমাদের উপর অতর্কিত হামরা হল । মুহূর্তেই আমাদের কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয় । গুলি বিনিময় করতে করতে আহতদের নিয়ে আমরা নিরাপদ আশ্রয়ে পৌছে আহত সহযোদ্ধাদের দ্রুত ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্ব তীরের মুক্ত এলাকায় পাঠাই । আমরা বাকি সবাই সুন্দরগঞ্জ থানাধীন ছাপড়হাটি এলাকায় আশ্রয় নিলাম । এলাকাটি ঘন বাঁশবাগানে ঘেরা । ১৯ শে সেপ্টেম্বর বেলা আনুমানিক ১২টার দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদেরকে ঘিরে ফেলে । বিকাল পর্যন্ত একটানা গুলিবিনিময় হলে আবারো আমাদের কয়েকজন আহত হয় । এই ভয়াবহ যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্তত বিশ-পঁচিশজন সেনা আহত কিংবা নিহত হয় । আমরা আহত সাথীদের নিয়ে ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দিয়ে মুক্ত এলাকায় চলে আসি এবং আহতদের দ্রুত সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টারে পাঠানো হয় । যুদ্ধ শেষে ঐ দিন রাতে আমি ব্যক্তিগতভাবে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ি জ্বরের মাত্রা ১০৬ ডিগ্রি পার হয়েছিল বলে শুনেছি । আহত সহযোদ্ধাসহ অধিকাংশরাই ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দিলেও প্রায় দশ জন সহযোদ্ধাসহ আমি এবং রাজেন বাবু নৌকা না পাওয়ায় দক্ষিণ শ্রীপুরের এক দরিদ্র কৃষকের আশ্রয়স্থলে থেকে যাই । পরের রাত্রে বড় নৌকা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত একটি ছোট নৌকায় আমরা রওনা হই । গভীর রাতে মাঝ নদীতে প্রচণ্ড ঝড়- বৃষ্টি শুরু হয় । আমাদের ছোট্ট নৌকাটি ঝড়ের কোপে ডুবে উপক্রম হয় । ভয়ে আমাদের সহযোদ্ধাদের সকলে উচ্চকণ্ঠে লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহু…কালেমাসহ বিভিন্ন দোয়া দরুদ পড়তে থাকে । রাজেন বাবু উচ্চস্বরে হরি-গুরু-হরি-গুরুসহ বিভিন্ন মন্ত্র পাঠ করছিলেন তার সাথে দুই হিন্দু সতীর্থ নির্মল ও ষষ্ঠি একই সুরে জপতে লাগল । জ্বরের তাপে এক পর্যায়ে আমি মূর্ছা গিয়েছি । যখন হুঁশ হল তখন নির্ঝর পরিচ্ছন্ন ভোর রাত । সকলের মুখে মহাবিপদের পরের স্বস্তির হাসি । সে রাতে সে অসাম্প্রতিক পরস্পরের প্রার্থমার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আমার স্মৃতিস্পটে চির জাগরুক । ইতোমধ্যেই পাকিস্তানিরা ব্রহ্মপুত্র নদের সমান্তরাল পশ্চিম তীর ঘেঁষে যে বন্যা নিরন্তণ বাঁধ সেটির কামারজানি, রসুলপুর স্লুইসগেট, রতনপুর, ফুলছড়ি, সাঘাটা ইত্যাদি স্থানে শক্ত ঘাঁটি গড়ে তুলেছে । বাঁধের উপর দূরত্বভদে মাঝে মাঝে রাজাকার বাহিনীর ক্যাম্প বসিয়ে বাঁধ পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে । তাদের উদ্দেশ্যে মুক্তিবাহিনী যেন ব্রক্ষ্মপুত্র নদ পাড়ি দিয়ে এসে বাঁধ পার হতে না পারে । কালাসোনারচর এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের মাঝ দিয়ে মানস নামের ছোট একটি নদী প্রবাহমান । ইতোমধ্যেই আমরা মানস নদী পার হয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সংলগ্ন ক্যাম্পগুলি আক্রমণ শুরু করেছি । ৫ই অক্টোবর ও ২৫শে অক্টোবর রাতে ক্ষীপ্র আক্রমণের মধ্য দিয়ে কাইয়ার হাট ও কেতকীর হাট রাজাকার ক্যাম্প দখল করে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে । বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদ আমরা দখল করি । ওদের কেউ আত্মসমর্পণ করেছে আর কেউবা জীবন নিয়ে পালিয়েছে । রাজাকারদের এই ক্যাম্পগুলি থেকে আশেপাশের গ্রামের জনগণের উপর অবর্ণনীয় নির্যাতন করা হতো । ২৯শে অক্টোবর ফুলছড়ি থানার কঞ্চিপাড়া গ্রামে রসুলপুর স্লুইচগেটের পাকিস্তানি ক্যাম্প থেকে প্রায় ২০/২৫ জন পাকিস্তানি সেনা তাদের দোসর রাজাকারদের সাথে নিয়ে লুটতরাজ করতে এলে আমরা আক্রমণ করি । যুদ্ধের পর পর্যায়ে পাকসেনারা বিক্ষিপ্তভাবে পালাতে থাকে এবং একে অন্যের নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় । এমতাবস্থায় আমরা খবর পাই পাকিস্তানির একজন সৈনিক অস্ত্রসহ একটি বাড়িতে লুকিয়ে আছে । আমরা সন্তপর্ণে বাড়িটি দীর্ঘ সময় ঘিরে রাখি । সন্ধ্যা নেমে আসছে বিধায় আমাদের কয়েকজন সহযোদ্ধা মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে তল্লাসী করতে থাকে । বাড়িটি এক কোণে মুরগি পালনের ছোট্ট একটি ঘরের পাশে লুকিয়ে থাকা ভীত সন্ত্রস্ত পাকিস্তানি সৈন্যকে আমরা ধরে ফেলি । আশ্চর্য ও নির্মম সত্য যে, ঐ বাড়ির মা- বোনেরা পাকিস্তানের ঐ সৈনিককে লুকিয়ে থাকতে সাহায্য করেছিল । বাঙালি মা-বোনের চিতায় মমত্ববোধের ঐ দৃষ্টান্ত আমাদের কোমল হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি । আমাদের অবস্থান মোটেও নিরাপদ ছিল না । উত্তর দক্ষিণে কয়েক মেইল কালাসোনাচর বিস্তৃত কিন্তু প্রস্থে খুব সামান্য । পূর্ব দিয়ে বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদ প্রবাহিত আর পশ্চিম দিকে ছোট মানস নদীটি পার হলেই বাঁধের বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি শত্রু ক্যাম্প । পিছনে অরক্ষিত, সামনে তোপের মুখে । সামরিক কৌশলগত দিক থেকে মহা বিপদোম্মুখ অবস্থান । তার উপর পাক বাহিনীর দোসর, দালাল, শান্তি কমিটি, আলবদর,

রাজাকারদের উৎপাত । রঞ্জু কোম্পানির তখন পাঁচটি প্লাটুন নিয়ে কালাসোনারচরের বিভিন্ন স্থানে স্থায়ী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা চলছিল । ৩রা নভেম্বর ভোরবেলা পাকবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে পড়ে গেলাম । বালাসী ঘাটের কাছে বন্যা নিয়ন্তণ বাঁধ এবং মানস নদীর মাঝে সমান্তরাল আরেকটি অনুচ্চ বাঁধ ছিল । আমরা ধান ক্ষেতের ভিরত দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম আর ওরা অবস্থান নিয়েছিল সেই অনুচ্চ বাঁধে । সময় কৌশলের দিক থেকে আমাদের চেয়ে ওদের অবস্থান অনেকটা নিরাপদ । আমরা জমির আইলে অবস্থান নিলাম। তুমুল যুদ্ধ বেধে গেল । গুলি বিনিময় চলতে থাকলো । ভোর থেকে ক্রমে সূর্যের আলী বাড়ছে আর এদিকে রণাঙ্গনের উত্তাপও বেড়ে বচলেছে । আমাদের সাথী ফজলু একটু ভালো অবস্থানে যাবার চেষ্টা করতেই পাঁজরে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে গেল । অদম্য সাহসী মান্নান ওকে পিঠে নিয়ে ভালো অবস্থানে নেবার চেষ্টা করলে পুনরায় আরেকটি গুলি ফজলুর ঘাড়ে বিদ্ধ হল । ফজলু ছটফট করতে করতে একটু পানি চাচ্ছিল । আমি অতি সন্নিকটে কিন্তু ওর আমৃত্যু পিপাসা আমি মেটাতে পারিনি, ওর মুখে দেবার মতো এতটুকু পানি ছিল না কোথাও । প্রথমে আর্তনাদ পরে ছটফট করতে করতে অশান্ত ফজলু চির শান্ত হয়ে গেল । ফজলু শহীদ হল, আহত হয় তাজুল ইসলাম । বেলা প্রায় সাড়ে দশটা পর্যন্ত যুদ্ধ চলল, ফজলুর মৃতদেহ পড়ে রইল । আমরা মরিয়া হয়ে আক্রমণ জোরদার করলাম । পাকিস্তানি সেনারা শেষ পর্যন্ত পিছু হাঁটতে বাধ্য হল, পালিয়ে বাঁচল । বেদনা ভারাক্রান্ত মনে ফজলুর মৃতদেহ ও আহত তাজুলকে নিয়ে কালাসোনার চরে ফিরে এলাম । স্থানীয় জনগণ সমবেদনা জ্ঞাপন করে দাফন কাফনের ব্যবস্থা করে দিল । এক পর্যায়ে স্থানীয় জনগণ কালাসোনারচরের নাম শহীদ ফজলুর নামে রাখার প্রস্তাব করলে কালাসোনারচর ফজলুপুর ইউনিয়ন নামকরণ করা হয় । ফজলু চিরকাল মুক্তিযুদ্ধের গৌরব হয়ে রইল ।

মাহাবুব এলাহী রঞ্জু, বীর প্রতীক জন্মঃ ১৭ই জুন ১৯৫২, গাইবান্ধা । শিক্ষাঃ গাইবান্ধা সরকারি হাইস্কুল থেকে ১৯৬৮ সালে এসএসসি এবং রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে ১৯৭০ এইচএসসি । রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখান বিদ্যায় অনার্স এবং মাস্টার্স । একাত্তরের প্রথম বর্ষ সম্মানের ছাত্র যখন তখনই রঞ্জু যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে । ১১ নম্বর সেক্টরের রঞ্জু কোম্পানির কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে কোম্পানিসহ যুদ্ধ করেন মাইনকারচর সাব-সেক্টরের অধীনে । যুদ্ধে অসম সাহস প্রদর্শনের জন্য সরকার তাকে ‘বীর প্রতীক’ বীরত্ব উপাধি প্রদান করে । মাহাবুব এলাহী রঞ্জু, বীর প্রতীক বর্তমানে ব্যবসায়ী ।

Ref: স্বাধীনতা মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!