সাব-সেক্টর-সাহেবগঞ্জ বেদনা ও আনন্দের গাথা
ক্যাপ্টেন (মুজাহিদ) আজিজুল হক, বীর প্রতীক
১. স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় লালমনিরহাট ছিল একটি প্রশাসনিক থানা । উত্তরে ভারতের কুচবিহার জেলা, পূর্বে কুড়িগ্রাম মহকুমা, দক্ষিণ পশ্চিমে রংপুর জেলা । ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তিতে লালমনিরহাটে মোজাহের নামে বিহার থেকে আগত উর্দু ভাষা-ভাষীরা লালমনিরহাট সদরে তাদের অবস্থান নানাভাবে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করে তোলে । বাঙালিরা প্রতি মুহূর্তে তাদের আগ্রাসনের শিকার হতো । মাঝে মধ্যে সংঘাত বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌছাত । বিচ্ছিন্ন ভাবে বাঙালিরা স্বকীয়তা বজায় রাখতে গিয়ে প্রতিবাদী হয়ে উঠত । কিন্তু, নানা কারণে প্রভাব এবং প্রতাপ বিস্তার করতে সক্ষম হয়নি । একদিকে পাকিস্তানি শাসকদের বিমাতাসুলভ আচরণ, অন্যদিকে বিহারীদের প্রতাপ স্থানীয় জন মনে ক্ষোভ বাড়িয়ে তোলে । ষাটের দশক থেকে ৬দফা আন্দোলনের ঢেউ বাঙালি চেতনাকে শানিত করতে থাকে । বিশেষত আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ভাসানী এবং কমিয়নিস্ট পার্টির রাজনৈতিক বিস্তার লাভের ফলে গোটা দেশের সাথে লালমনিরহাটের মানুষের সংগ্রামী মনোভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে । ঊনসত্তরের গণআন্দোলন এবং সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী বাঙালি মানসে স্বদেশ ভাবনার যে জোয়ার তোলে লালমনিরহাট থানাবাসী আপামর জনসাধারণের সে জোয়ারের ধাক্কা অভূতপূর্ব এক শক্তির জন্ম দেয় । ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলে লালমনিরহাটবাসী নির্বিকারভাবে রাজপথে নেমে আসে এবং প্রতিরোধের আগুন বুকে নিয়ে পাকিস্তানিদের অবিচার অত্যাচারের বিরুদ্ধে মরিয়া হয়ে উঠে । ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংরাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ । ‘যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে’ । ৭ই মার্চের এই ঐতিহাসিক আহবানে সত্যিকার অর্থেই লালমনিরহাটবাসী শত্রু মোকাবেলার জন্য ঐদিন থেকে স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে । সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে বাঙালি ইপিআর, পুলিশ মুজাহিদ, ছাত্র-জনতা, প্রতিরোধ গড়ে তোলে । তিস্তা ব্রিজের উত্তর প্রান্ত ঘিরে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য গড়ে তোলে ডিফেন্স লাইন । নারী, পুরুষ, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে অভূতপূর্ব শক্তি নিয়ে শুরু হয় প্রাণপণ লড়াই । পাকিস্তান আর্মির একজন মেজরসহ বেশ কিছু সংখ্যক পাকসেনা নিহত হয় এবং বাঙালুর গড়ে তোলা ডিফেন্স দূর্ভেদ্য হয়ে উঠে কিন্তু সে সময়ের কিছু বিশ্বাসঘাতক বাঙালির চক্রান্তে হারাগাছ হয়ে তিস্তা নদী পাড়ি দিয়ে ৪ঠা এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী লালমনিরহাট শহরের ব্রিটিশ নির্মিত বৃহৎ বিমান ঘাঁটিতে অবস্থান গ্রহণ করলে বাধ্য হয়ে তিস্তা নদীর উত্তর পাড় বেষ্টিত ডিফেন্স ছেড়ে দিতে হয় । ৫ই এপ্রিল সকাল থেকে বিহারীদের সহায়তায় শুরু হয় বাঙালি নিধন ও ধ্বংসযজ্ঞ । হাজার হাজার মানুষ পালাতে থাকে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য । গৃহহারা, ভারত থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে শত্রু হনন ও মাতৃভূমির স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে থাকে সর্বস্তরের হাজারো মানুষ । ৬নং সেক্টর গঠিত হলে এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা দুর্বার গতিতে সংঘবদ্ধভাবে আক্রমণের পর আক্রমণ চালাতে থাকে পাকসেনাদের অবস্থানের উপর । গেরিলা পদ্ধতিতে ে আক্রমণ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে । শত্রুমুক্ত বুড়িমারী (বর্তমান লালমনিরহাট জেলাধীন) ৬নং সেক্টরের কমান্ডার উইং কমান্ডার মোহাম্মদ খাদেমুল বাশার-এর নেতৃত্বে বড়খাতায় এবং কুড়িগ্রাম জেলার ভূরঙ্গামারীতে সম্মুখ যুদ্ধের ডিফেন্স শক্তভাবে গড়ে তোলা হয় এবং এই দুই ডিফেন্স লাইনের মাঝপথের বিরাট এলাকা দিয়ে চলতে থাকে গেরিলা আক্রমণের অব্যাহত ধারা । ধরলা নদী পেরিয়ে মুক্ত এলাকা ফুলবাড়ী (বর্তমান কুড়িগ্রাম জেলাধীন) মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অবস্থান কেন্দ্রেরূপে গড়ে উঠে । লালমনিরহাট থেকে ৮কি.মি. দূরে বড়বাড়ীহাট স্বাধীনতাযুদ্ধে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে । মুক্তিযোদ্ধারা ধরলা নদী পার হয়ে বড়বাড়ীতে অস্থায়ী অবস্থান নিয়ে পাকহানাদার বাহিনীদের অবস্থানের উপর আক্রমণ চালাত বিভিন্ন পথে বিভিন্ন কৌশলে । শুরু থেকেই পাকিস্তানিদের টার্গেট হিসেবে বড়বাড়ীহাট অন্তর্ভুক্ত ছিল । কিন্তু, মুক্তিযোদ্ধাদের অসীম বীরত্ব এবং সাহসিকতাপূর্ণ অভিযানের মাত্রা দেখে পাকহানাদার বাহিনী আক্রমণ করেনি । ইতোমধ্যে দীর্ঘ আট মাস অতিবাহিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের । মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল এবং মুক্তিযোদ্ধা কৌশল লক্ষ করে পাকসেনারা বড় ধরণের প্রস্তুতি নিতে থাকে এবং ৯ই নভেম্বর ভোরে তিন দিন থেকে বড়বাড়ীহাটকে আক্রমণ করে। বড়বাড়ীহাট থেকে ৮কি.মি. পশ্চিমে অবস্থিত বিমান ঘাঁটি থেকে ২শতাধিক পাক সেনা সুসজ্জিত হয়ে আক্রমণ পরিচালনা করে । ৩// মর্টারের পর পর দুইটি শেল নিক্ষেপ করে তারা আক্রমণ সূচনা অরে । বড়বাড়ীহাটে এসে তিন ভাগে বিভক্ত হয় পাকসেনারা । প্রথম দল বড়বাড়ী থেকে ঢুকে গড়ে শিবরামের দিকে, এক দল যাত্রা শুরু বড়বাড়ীহাটের চারপাশের শুরু করে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে এগুতে থাকে এবং অন্য দলটি বড়বাড়ীহাটের চারপাশের শুরু করে মহাতান্ডব । আত্মরক্ষার্থে পলায়নকারী মানুষকে গুলি করতে থাকে পৈশাচিক উল্লাসে । প্রথম দলটি প্রায় ৪০জন নিরপরাধ বাঙালিকে ধরে নিয়ে চলে যায় কুড়িগ্রামে । বন্দিদের মধ্যে জনাব নূরুল হক পাটোয়ারী, সে সময়ের ছাত্র বর্তমানে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত জনাব আবদুস ছালাম প্রমুখ ব্যক্তি বীভৎস স্মৃতি নিয়ে এখনো বেঁচে আছেন । বেঁচে আছেন পচু পাল, নওশের আলী, গুলিবিদ্ধ রয়েজ উদ্দিন । স্বল্প সময়ের মধ্যে শতাধিক লোককে হত্যা করা হয় । লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ করা হয় একই সাথে । মুহূর্তে নারকীয় ঘটনা সকল সভ্যতাকে ভ্রকুটি করে বর্বরতার সীমাহীন নজির স্থাপন করে পাক হায়নারা । মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন দল বিভিন্নভাবে ধরলা নদী আতিক্রম করে । এই অপারেশনে রংপুর কারমাইকেল কলেজের ছাত্র সংসদের জি.এস ও প্রতিভাবান ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা মোক্তার এলাহী পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন । শিবরামের এক বাড়ি থেকে পালাতে গিয়ে এই দেশপ্রেমিক সন্তান শত্রুর গুলিতে ঢলে পড়েন বাংলা মায়ের কোলে । মোক্তার এলাহী, পাঙ্গা হাইস্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ও বড়বাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জনাব আবুল কাশেম, জাহের সর্দারসহ ৩১ জনকে হত্যা করা হয় আইরখামার ডাকবাংলো স্কুল প্রাঙ্গনে ও জগবন্ধু নামক স্থানে । মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৯ই নভেম্বর বড়বাড়ীর হাটে ঘটে গেল হৃদয় বিদারক ঘটনা । এর মাস খানেক পর ১৬ই ডিসেম্বরেল বাঙালির মহান বিজয় দিবস । আজ স্বাধীনতার দীর্ঘকাল অতিবাহিত । এতদিনেও লেখা হল না ত্যাগের এ ইতিহাস, গড়ে উঠেনি কোনো স্মৃতির মিনার । অনাগত ভবিষ্যতের নাগরিকদের কাছে কী জবাব আছে এর? ঐতিহাসিক কারণে, গৌরবময় স্বাধীনতা যুদ্ধের মাহাত্ম নির্ণয়ে শহীদ এই সন্তানদের উদ্দেশ্যে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবার কাছে একটি আবেদন- বড়বাড়ীরহাটের এই নির্মম হত্যাকাণ্ড এবং দেশ মাতৃকার উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত সন্তানদের স্মরণে ইতিহাস রচনা এবং স্মৃতি রক্ষায় এগিয়ে আসুন । ৯ই নেভম্বরে এই বিদেহী আত্মার কল্যাণ কামনায় একত্র হোন । গৌরবময় ইতিহাস বর্ণনা করে নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেমিক হবার শিক্ষা সম্প্রসারিত করুন । ২. মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ৬নং সেক্টরের সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন নওয়াজেস উদ্দিনের অধীনে যুদ্ধে যোগদান করি । যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় ১১ই সেপ্টেম্বর আমার পিতা মরহুম ছখি উদ্দিন আহমেদ বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন । আমি আমার পিতা প্রথম পুত্র হয়েও তার নামাজে জানাজায় উপস্থিত থাকতে পারিনি । সেসময় আমি ভূরুঙ্গামারী-বাঘভাণ্ডার ডিফেন্সে ছিলাম । ১১ই সেপ্টেম্বর দুপুরে আমি ডিউটি চেক করে ২টার সময় ক্যাম্পে ফিরে সংবাদ পাই । কমান্ডার সাহেব আমাকে সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টারে (সাহেবগঞ্জ) ডেকেছেন । দুপুরের খাবার শেষে সুবেদার বোরহান আমাকে বার বার হেডকোয়ার্টারে যাবার জন্য তাগিদ দিচ্ছিলেন । আমি হেড কোয়ার্টারের দিকে রওনা দিয়ে বিকেল ৫.৩০ ঘটিকায় হেডকোয়ার্টারে পৌছি । গেটে প্রবেশকালে সেন্ট্রি জানাল- ‘স্যার, আপনার আব্বা মারা গেছেন, আপনার ভাই একরামুল টেলিফোন করেছিল’। কমান্ডারের নির্দেশে আমি ভারতীয় ট্রাকে চড়ে কুচবিহারের উদ্দেশ্যে রওনা দেই । রাত ১০টায় আলিপুর দুয়ারে আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠি । আমার আত্মীয় স্বজন রাতে আমাকে যেতে না দেয়ায় সকালে আমার পরিবারের আশ্রয়স্থল ঢালকর গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে সকাল ১০টায় পৌছাই । সেখানে পৌছে শুনি রাত ১১টায় আমার পিতার জানাজা হয়ে গেছে । আমার পরিবারের সঙ্গে ২/৩ দিন অবস্থান করে কুলখানি শেষে সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টারে ফেরত আসি ।
আমার পিতার মৃত্যুর দুই মাস পর নভেম্বরের ১২ তারিখ সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন নাওয়াজেস আমাকে ডিফেন্স লাইন থেকে রাত ১১টায় ডেকে পাঠিয়ে আমার কুশলাদি জানালেন এবং একটি বিশেষ অপারেশনের দায়িত্ব দিলেন । কুড়িগ্রাম-ভূরুঙ্গামারী রোডের বর্তমান নাগেশ্বরী উপজেলার সন্তোষপুর নামক স্থানে সড়ক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য অপারেশন ম্যাপ দেখানো হল । সন্তোষপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের দুইটি সেকশন অবস্থান করছিল । এক সেকশন কমান্ডারের নাম নুরুল হক সরকার এবং অপর সেকশনের দায়িত্বে ছিলেন মঞ্জুরুল ইসলাম । প্রয়োজনীয় আর্মস-এমুনেশন নিয়ে সেকশন দুইটির সঙ্গে যোগাযোগ করে নাগেশ্বরী-ভূরুঙ্গামারী সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ দেয়া হল যাতে করে পাক সেনা নাগেশ্বরী হতে ভূরুঙ্গামারী ও ভূরুঙ্গামারী হতে নাগেশ্বরী যেতে না পারে । নভেম্বরের ১৩ তারিখ বিকাল ৩টায় আমাকে তৎকালীন মেজর ডা. এম.এম. হোসেনের শ্যালক মুক্তিযোদ্ধা বাবু মোটর সাইকেলযোগে সন্তোষপুরে পৌছে দেয় । সেদিন অপারেশন স্থল রেকি করার পর সন্ধ্যায় একটি ছোটখাটো অপারেশন করা হয় । এই অপারেশন করতে গিয়ে ২// মর্টার চালক আহত হয় । সেখানে মর্টার চালানোর মতো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কেউ না থাকায় আমি আহত মর্টার চালকের নিকট থেকে মর্টার পরিচালনা করার কারিগরি কৌশল শিক্ষে নেই । আহত মর্টার চালককে হাসপাতালে পাঠানোর পর আমি মর্টার পরিচালনার দায়িত্ব নেই এবং সেটি আমার সঙ্গেই রাখি । ১৪ তারিখ দিনের বেলা যেখানে সড়ক বিচ্ছিন্ন করা হবে জায়গাটি রেকি করার পর রাত আনুমানিক ৯টা হতে অপারেশনের কাজ শুরু করি । প্রথমে একটি বড় আমগাছে মাইন দিয়ে চার্জ করে গাছটিকে রাস্তার উপর ফেলা হয় এবং রাত ১২টার দিকে হাই এক্সপ্লোসিভ মাইন দিয়ে ৫ থেকে ৭ ফুট রাস্তা কেটে ফেলা হয় । পরের দিন ১৫ তারিখ সকাল থেকে আমরা অবজারভেশনে ছিলাম । বিকাল ৩টার দিকে ভুরুঙ্গামারীর উদ্দেশ্যে পাক আর্মির একটি ট্রাক অপারেশনস্থলে রাস্তায় Obostacle দেখে থেমে যায় এবং রাস্তাটি মেরামত করে চালু করার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে । আমরা তখন ২” মর্টার, LMG, SLR, Rifle দিয়ে তাদের তাদের উপর আক্রমণ চালাই । একটানা ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে । সন্ধ্যায় তারা নাগেশ্বরীর দিকে ফিরে যায় এবং আমরা আমাদের ক্যাম্পের দিকে ফিরে আসি । রাত আনুমানিক ৮টায় স্থানীয় এক ব্যক্তি ক্যাম্পে এসে জানায়, আপনাদের ফায়ারিং-এ একজন পাক আর্মি মারা গেছে, আমাদের বাড়ির পার্শ্বে রক্তাক্ত অবস্থায় তার লাশ পড়ে আছে । তিনি আমাদেরকে ঘটনাস্থলে যাবার অনুরোধ করেন । আমরা তাঁকে পাক বাহিনীর চর হিসেবে সন্দেহ করে তার সঙ্গে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই । আমরা তাকে বলে দেই, আপনি যান আমরা পরে আসছি । ১৬ তারিখ সকাল আনুমানিক ৭-৩০টায় আমি গোলাবারুদ লোড না করে ২” মর্টার নিয়ে একজন সৈনিকসহ ঘটনাস্থলের দিকে যাই এবং একজনকে LMG একজনকে SLR, দুইজনকে Rifle ও একজনকে ২” মর্টারের গোলা নিয়ে আমাদের পিছনে আসতে বলি । ধান ক্ষেতের পাশ দিয়ে আমরা কাটা রাস্তায় উঠি । গোলাবারুদ ও অস্ত্র বহনকারী পাঁচজন আমদের বেশ কিছু দূর পিছনে ছিল । আমরা স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় অপারেশনকৃত রাস্তাটি অনেক গভীর করে গর্ত করার প্রস্তুতি নেই । এমন সময় আমার এক সহযোদ্ধা দেখতে পায় যে দুইজন পাক সেনা রায়গঞ্জ হতে ধান ক্ষেতের ভিতর দিয়ে আমাদের দিকে মেইন সড়ক অভিমুখে আসছে । সে আমাকে ডেকে দেখায় ‘স্যার, দুইজন খান সেনা আমাদের দিকে আসতেছে’ । আমি তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই দুইজন খাকি পোশাকধারী পাক সেনা পাকা ধানের রংয়ের সঙ্গে মিলে আমাদের দিকে আসছে । আমার সহযোদ্ধা পাক সেনা দুইজনকে দেখে বিচলিত হয় । কারণ আমাদের কাছে তখন শুধু গোলাবারুদ বিহীন অস্ত্র ছিল । আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম-তুমি ঘাবড়াবে না, চুপচাপ দেখ আমি কী করছি । এই বলে আমি আমার ২” মর্টারটি হ্যাড গার্ড পজিশনে নিলাম এবং উচ্চ স্বরে বলতে লাগলাম ‘কোন হায় আগে বার্নেকা কোশিশ মত করো’ অর্থাৎ কে আছে আগে আসার চেষ্টা করো না । ‘এক কদম আগে হিলেগা তো গুলি করে দেগা’ অর্থাৎ এক পা আগালে গুলি করে দিব । এই কথাগুলি দুই তিন বার রিপিট করি । আমি উর্দু ভাষা ভালোভাবে ও কিছু কিছু পাঞ্জাবী ভাষা বলতে পারতাম । আমার কথা খান সেনারা হয়তো বুঝতে পারে । তারা এক পা দু’পা করে আমাদের দিকে আসতে থাকে । আমি আবারও উচ্চ স্বরে বললাম, ‘হিলো মত আগার হিলেগা তো গুলি করে দেগা’ অর্থাৎ নড়বে না, নড়লেই গুলি করব । কিন্তু, এদিকে আমার কাছে ২” মর্টার ব্যারেল ছাড়া আর কিছুই নেই । আমার মনের সাহস ছিল প্রবল । আমি নিজ বিচলিত হই নাই । পাক পিড়িয়ডে আমার এক ওস্তাদ আমাদের ট্রেনিং দেয় ‘দোশমন কো কভি পিঠ মত দেখাও, বীরের মতো মর । আমার সে মুহূর্তে ওস্তাদের কথাটি মনে পড়ল । আমি এও ভাবলাম আমার পিতা ভারতে মারা গেল, যদি আমি মারা যাই আমার লাশ হয়তো বাংলাদেশে ফিরবে না । আমি তখন মনস্থির করলাম যদি মরি মরি বীরের মতো মরব, পালাবার চেষ্টা করব না । কারণ আমি পালালে আমার সহযোদ্ধারা সহ আমাদের পিছনে মাটি খননের কাজে নিয়োজিত নিরস্ত্র সাধারণ জনগণ নিশ্চিত মারা যাবে । আমার শেষোক্ত নির্দেশের পর দেখলাম একজন খান সেনা অস্ত্র নিচে রাখল, অপরজন অস্ত্র রাখছে না । আমি আবারও বললাম, ‘দোনা গ্রাউন্ড আর্ম কর, মেরা পাছ আজাও’ অর্থাৎ দুই জনেই মাটিতে অস্ত্র রেখে আমার কাছে এস । দু’জনেই অস্ত্র নিচে রাখল । আমি পুনরায় বললাম- ‘হাত উপর করকে অ্যাডভান্স কর’ অর্থাৎ হাত উপর করে অগ্রসর হও । দু’জনে হাত উপর করে আমার কাছে আসল । একজন আমার হাত ধরে বল, ‘আপ লোক কোন হায়’ অর্থাৎ আপনারা কারা । আমি উত্তরে কৌশলে বললাম ‘হাম রাজাকার হায়’ অর্থাৎ আমরা রাজাকার । সে আবার বলল, ‘আপ লোক ইধার কিয়া কর রহে’ অর্থাৎ আপনারা এখানে কী করছেন । উত্তরে বললাম, ‘দেখো সালা মুক্তি লোকনে রাস্তা খারাপ কর দিয়ে, নাগেশ্বরী মে লেফটেন্যান্ট ছাহেব নে হাম লোককো রাস্তা ঠিক করনেকা অর্ডার দিয়া, ইছি রাস্তাছে কানভাই আনে ওয়ালা হায়, ভূরুঙ্গামারী মে এ্যাটাক করনা হায়’ অর্থাৎ শালা মুক্তিরা রাস্তা খারাপ করে দিয়েছে, নাগেশ্বরী হতে ল্যাফটেন্ট সাহেব আমাদেরকে রাস্তা ঠিক করতে অর্ডার দিয়েছে । এ রাস্তা দিয়ে ভূরুঙ্গামারী আক্রমণ করার জন্য কনভয় আসবে । স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক বাহিনীতে নতুন অফিসার লেফটেন্যান্ট হতে ক্যাপ্টেন পর্যন্ত সম্মুখ যুদ্ধে পাঠাত । এই ধারনা করে আমি লেফটেন্যান্ট এর কথা বলি । তাদের একজন আমাকে একজন লেফটেন্যান্ট-এর নাম বলল ‘ওহি; লেফটানেট ছাব হায় না-নাগেশ্বরী মে? খান সেনারা যার নাম বলল । আমি তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ‘হাঁ ওহি লেফটানেন্ট ছাবাহ নাগেশ্বরী মে হায়’ । খান সেনারা আমাদের বলল ‘হাম লোককো লেফটানেন্ট ছাহাব কা পাছ পৌছাইয়ে’ অর্থাৎ লোক কেতনা আদমী হায়’ । উত্তরে তারা বলল ‘হাম লোক দো আদমী হায়, রাতকো জো ফায়ার হোয়া সব আদমী ভাগ গিয়া হাম লোক নয়া আদমী, রাস্তা নেহি জানতে ভাগনে নেহী ছাকা’ অর্থাৎ রাত্রে গোলাগুলি হয়, তখন সবাই পালায়, আমরা নতুন, রাস্তা জানা ছিল না বলে পালাতে পারিনি । তখন আমি তাদের কোমরে হাত দিয়ে দেখলাম তাদের নিকট কোনো গ্রেনেড আছে কি না । কারণ যুদ্ধের সময় প্রত্যেক সৈনিকের আত্মরক্ষার জন্য দুটি করে গ্রেনেড ইস্যু করা হয় । গ্রেনেড না থাকায় তাদের কোমরে বাধা চাইনিজ এমুনেশনের বান্ডুলিয়ার খুলে দিলাম । দেখলাম তাতে চাইনিজ রাউন্ড ভর্তি করা ছিল । আমার সঙ্গী এক মুক্তিযোদ্ধাকে ইশারা করলাম- পিছনে ফেলে আসা খান সেনাদের অস্ত্র দুটি নিয়ে আসতে । সে অস্ত্র নিয়ে এসে বলল- অস্ত্র এনেছি স্যার । যে মুক্তিযোদ্ধাটি অস্ত্র আনল তার কাছে ছিল SLR । খান সেনা দুটি SLR দেখে বলল ‘ইয়ে হাতিয়ার তো মুক্তি কা হায়’ অর্থাৎ এই অস্ত্র তো মুক্তিযোদ্ধাদের । খান সেনাদের ভয় পাওয়ার কারণ হল, যুদ্ধের সময় SLR থাকত শুধু ভারতীয় সৈনিক এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট, পাক সেনাদের কোনো SLR ছিল না । আমি খান সেনাদের আশ্বস্থ করে পাঞ্জাবী ভাষায় বললাম, ‘আলাকা তোম লোক ঘাবড়া গিয়া? ইছে হাতিয়ার হামলোক মুক্তিছে কব্জা কিয়া’ খান সেনা দু’জন আমার কথায় আশ্বস্ত হল । তারা মনে করল আমরা তাদের লোক । তাই তারা আমাদের বলল, ‘হাম লোক দোদিন ছে কোছ খায়া নেহি, আপলোক কা কেম্প মে লে জাইয়ে কুছ খানেকা দিজিয়ে’ অর্থাৎ আমরা দুই থেকে কিছু খাইনি, আপনাদের ক্যাম্পে নিয়ে আমাদের কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করেন । আমার সঙ্গের মুক্তিযোদ্ধাটি পাকিস্তান আর্মিতে ছিল, সে ছুটিতে আসার পর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে । সেও উর্দু বলতে পারত । সে বলল- ‘খোদাকি কছম হাম লোক আপলোককো হামারা কেম্প মে লে জাইংগে ঘাবড়াও নেহি’ । ইতোমধ্যেই আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা এসে গেছে । একজনকে রশি আনার জন্য বললাম । রাস্তার পাশেই একটি ছাগল বাঁধা ছিল । ছাগলটি ছেড়ে দিয়ে রশি আনল । রশি দিয়ে যেই খান সেনাদের হাত বাঁধতে যাচ্ছি, তারা বল, “আপ লোক কেয়া কর রাহে” অর্থাৎ আপনারা কী করছেন । তখন খান সেনাদের বললাম, ‘সালে লোক জানতে হো হাম লোক কৌন হায়? হাম লোক রাজাকার নেহি হায়, হাম লোক মুক্তি হায় । জয় বাংলা বোলো’ অর্থাৎ আমরা রাজাকার নই, আমরা মুক্তিযোদ্ধা । তাদেরকে জয় বাংলা বলতে বলায় তারা বলল, ‘জয় বাংলা কেয়া হায়’ অর্থাৎ জয় বাংলা কী? অমনি দু’জনের গালে সজোরে চড় মারলাম । এরপর আর কাউকে মারতে দেই নাই । জানি, এরা দু’জনতো একরকম মরেই গেছে, তাদেরকে আর মেরে কী হবে । এই ভেবে তাদেরে চোখ হাত বেঁধে নিয়ে আসছি । তখন সকাল সাড়ে নটা বা দশটা হতে পারে ।
খান সেনা ধরার খবর পেয়ে চৌধুরীরহাট হাই স্কুলের ছাত্ররা প্রত্যেকের হাতে লাঠি নিয়ে খান সেনাদের মারার জন্য দল বেঁধে আসছিল । অবস্থা বেগতিক দেখে আমরা রাস্তা বেরিকেড দিলাম যাতে ছাত্ররা কিছু করতে না পারে । খান সেনাদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য চৌধুরীর হাট BSF ক্যাম্পে তাদের রেখে আমি সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টর হেড কোয়ার্টারে আসি । সেক্টর কমান্ডার বাশার সাহেব ও সাব-সেক্টর কমান্ডার নওয়াজেস সাহেবকে বিস্তারিত ঘটনা জানাই এবং খান সেনা দু’জনকে আনার জন্য একটি গাড়ি চাই । তারা দুজনেই আমাকে এই কাজের জন্য প্রশংসা করলেন । পাশাপাশি আমাকে সাবধান করে দিলেন এরকম সাহস যেন আর না দেখাই । পরে আমাকে একটি জিপ গাড়ি দিল । আমি খান সেনা দু’জনকে BSF ক্যাম্প থেকে নিয়ে হেডকোয়ার্টারে পৌছিয়ে দেই । এরপর তাদেরকে যুদ্ধবন্ধি হিসেবে প্রিয়জনার অফ ওয়ার হিসেবে জেলে পাঠায় । আমি সেদিন দেখেছি মৃত্যুর আগে মানুষের অবস্থা কেমন হয় । আটককৃত খান সেনারা জানত তাদের নিশ্চিত মৃত্যু । তাদের দু’চোখে অঝোরে পানি পড়ছে আর যত রকম কলেমা আছে তারা পাঠ করছে । জীবিত দুই খান সেনা ধরা পড়ার সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে । অনেক সাংবাদিক ক্যামেরাম্যান আসে । ফটো তোলে, সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে ভারতের কয়েকটি পত্রিকায় ছবিসহ সংবাদ ছাপান হয় । পরে যুদ্ধের মোড় এগুলে থাকে,এ সমস্ত সংবাদ রাখার আর চেষ্টা করি নাই । এই ঘটনার চার দিন পর অর্থাৎ ২০শে নভেম্বর ছিল আমাদের ঈদ-উল-ফিতরের দিন । ঐদিন আর এক হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটে । ঈদের দিন সকালে সেকেন্ড লে.সামাদ শহীদ হন । যে দুইজন খান সেনাকে সশস্ত্র অবস্থায় আটক করা হয়েছিল তাদের একজনের নাম সিপাহী আতা মোহাম্মদ, ৪৮ ফিল্ড রেজিমেন্ট বার্টিলারি এবং অপরজন সিপাহী আসলাম খান নেওয়াজী, ২৫পাঞ্জাব রেজিমেন্ট । দুই জনের নিকট হতে দুইটি ৭.৬২ চাইনিজ রাইফেল ও ২০০+২০০=৪০০ রাউন্ড গুলি করে উদ্ধার হরা হয় । উদ্ধারকৃত চাইনিজ রাইফেল দুইটির মধ্যে একটির নম্বর ছিল 05492 । ১৫ তারিখে পাক সেনাদের সঙ্গে গোলাগুলির সময় তাদের ফেলে আসা MMG-এর গুলি ১১১০ রাউন্ড, ৭;৬২ চাইনিজ রাইফেলের গুলি ১৯৪০ রাউন্ড ঐ স্থান হতে উদ্ধার করা হয় । ক্যাপ্টেন (মুজাহিদ) মোঃ আজিজুল হক, বীর প্রতীক জন্ম ১লা এপ্রিল ১৯৪৫, লালমনিরহাট । শিক্ষাঃ লালমনিরহাট গভর্নমেন্ট হাই স্কুল । প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে এইচএসসি পাস । ১৯৬৫ সালে মুজাহিদ বাহিনীতে ভর্তি । ১৯৬৮ সালে ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত । একাত্তরে ৬নম্বর সেক্টরের সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টরে যুদ্ধ করেন বীরত্বের সাথে । মুক্তিযুদ্ধে তার সাহসিকতা ও অবদানের জন্য সরকার তাঁকে ‘বীর প্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত করে । স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে রংপুর সেনানিবাসে ১৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত থেকে কোয়াটার মাস্টারের দায়িত্ব পালন করেন ।
Ref: স্বাধীনতা মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া