বদলে গেছে সবাই
মাহবুব আলম
১. এই যুদ্ধে বদলে গেছে সবাই, সব কিছু । যুদ্ধটা সব কিছু পালটে দিয়েছে । ওলোট-পালোট করে দিয়েছে মানুষের অভ্যাস, চিন্তা-চেতনা । পাল্টে দিয়েছে দৈনন্দিন রুটিন । জীবন ধারণ পদ্ধতি । পূর্বের মতো আর কেউই নেই । সবকিছুই এখন পরিবর্তিত । সবাই এখন কেমন আত্মকেন্দ্রিক আর স্বার্থপর । ক্লিষ্ট, শুকনো রোগগ্রস্ত মানুষ । হাসি আনন্দ উঠে গেছে । এখন কান্না বড় বেশি স্পষ্ট । অভাব আর রোগ শোক বিপর্যস্ত করে ফেলেছে । পর্দাটর্দাগুলো উঠে গেছে । লজ্জা শরমের বালাই নেই । লাখ লাখ মানুষ গাদাগাদি শরনার্থী শিবিরে । লাল রঙের তাবুর আচ্ছাদনে । কেঁচোকেন্নোর মতো । সেখানেও আব্রু নেই । নেই বাইরেও ।
২. রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছেন । দু’পাশে ফসলবিহীন মাঠ । মহিলারা বসে গেছেন প্রাকৃতিক কর্ম সারতে । কোথাও একা, গ্রুপসহ অন্যখানে । আপনি একবার তাকাতেই ধাক্কা খাবেন । তাকাবেন না দ্বিতীয়বার । পারবেন না । লজ্জাটা তাদের নয়, আপনার । প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতেই হয় । উপায় নেই না দিয়ে । তাতে কে দেখলো না দেখলো তার আসে যায় না । শান্তিকালীন সময়ে ভাবাই যায় না । আড়ালে আবডালে, নিজের লজ্জা ঢেকে চিরদিন এই কাজ করে এসেছে বাঙালি নারী কিন্তু এখন কী? এটা কী? বাধ্যগত পরিবর্তন? সেটা কী ভয়ানক!
৩. একজন স্কুল মাস্টার বিড়ি সিগারেটের দোকান দিয়েছেন । পঞ্চগড়ের কোনো একটা স্কুলের বিএসসি শিক্ষক । সপরিবারে দেশ থেকে পালিয়েছেন । শরনার্থী শিবিরে সেই অমানবিক পরিবেশের মধ্যে যেতে পারেননি । একটা বাড়ির গোশালায় আস্তানা নিয়েছেন । হাতে সম্বল সামান্য কিছু অর্থ । দ্রুত ফুরিয়ে যায় । রেশন কার্ড হয়েছে, কিন্তু ক্যাম্পে না গেলে তা নাকি বাতিল হয়ে যাবে । বাচ্চা কাঁদে ক্ষুধার জ্বালায় । বুকের দুধ শুকিয়ে গেছে মায়ের । তারওতো ক্ষুধা প্রচুর । শরনার্থী হয়ে এসে পেট পুরে খাবারই জুটছে না । বাচ্চা চারটি কাঁদে । সোমত্ত বয়সের ননদ । স্বাস্থ্যোজ্জ্বল লাবণ্যময় সেই রূপ হারিয়ে গেছে । মলিন চোখ মুখ । পেটে ক্ষুধা । সামনে ভয়াবহ অমানিশার ডাক । ভীত মাস্টার সাহেব । শেষ সম্বল টাকা কটি দিয়ে তেঁতুলিয়া স্কুল মাঠ লাগোয়া রাস্তাটার পাশে বিড়ি সিগারেটের দোকান দিয়েছেন । একটা টেবিলেন ওপর সাজানো পশরা । টুলমতো একটা কাঠের ওপর তিনি বসে থাকেঞ আর ঝিমান । পানামা, লেক্স, উইলস, চারমিনার এইগুলো ভারতীয় সিগারেটের নাম । আর বিড়ির নাম হচ্ছে উড়োজাহাজ, মতবিড়ি । সঙ্গে দিয়াশলাই । মোমবাতি আগরবাতি সুঁই, সুতা । এগুলোও কিছু আছে । চলে কি? তেমন না । তবে দিয়েছেন কেন দোকান? কী করবো, শিক্ষক মানুষ, যাইতে পারি না কোথাও । তাই বলে বিড়ি সিগেরেটের দোকান, শিক্ষক হয়ে? যুদ্ধে যাবেন না? না । উপায় নেই । পরবর্তিত মানুষ । বদলে যাওয়া মানুষ, দাড়িতে হাত বুলিয়ে হাসেন মলিন হাসি । যুদ্ধের আগে দাড়ি ছিল না । এখন রেখেছেন পয়সা বাঁচাতে । অদ্ভুত সময়!
৪. পাকা সড়ক । আসাম-বেঙ্গল হাইওয়ে । সাকাতি থেকে ব্রাঞ্চ রোড মিশেছে যেয়ে হাইওয়েতে । কোন দিকে তাকাবো । মানুশের হাল একই । রাস্তার ঢালে মানুষ, গ্রাছের তলে মানুষ, খোলা আকশের নিচে মানুষ, স্কুল ঘরে ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই ভীড় । বাজার উপচে পড়ছে মানুশের দ্বারা । পেছনে ঘোরতর যুদ্ধ চলে, দখলদারীর । নিরস্ত্র মানুষের মৃত্যুভয় । গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয় । সামনে পড়লেই হলো । কোনো কারণ নেই সোজাসুজি গুলি । ভীত মানুষ । প্রাথমিক ধাক্কায় হতবিহ্বল । শুধু তাগিদ পালানোর । সীমান্ত পার হতে পারলে মৃত্যু আর পিছু নেবে না । কিন্তু সীমান্ত পার হলেই তো রিসিপশন জানানোর জন্য কেউ বসে নেই । সবাই ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে । কোথায় যাবে, কী কবরে, কী খাবে কিছুই ভাবতে অয়ারে না শিক্ষিত, সদবংশীয়, স্বচ্ছল মানুষ । মাঝারী গোছের চাররীজীবী । ব্যবসায়ী কৃষক । দিন মজুর । সবাই এলাকার । রাস্তার পাশের বড় আমগাছের ছায়ার তলে আপাতত আশ্রয় । সে তো মাত্র ক’জন, অন্যরা হয়তো কিছুই পায় না । উদোম আকাশের তলে । রোদ বৃষ্টির মাঝে । ঘোরলাগা মানুষ । ভেঙ্গে পড়া অসহায় অবস্থা । চাই রেজিস্ট্রেশন, রেশন কার্ড, একটা তাবু । নিরাপদ আশ্রয় । কোথায় যাবেনযাবেন ঠিক করেছেন? জানি না । মুক্তিযুদ্ধে যাবেন? যেতাম, ওদের জন্য সম্ভব নয় । কী করবেন তাহলে? দেখি নেতারা কী করেন । মুজিবনগর সরকারের কাছে কাজ নেব । যুদ্ধ সবাইকে করতে হবে তাঁর মানে নেই । তা ঠিক । কিন্তু কাজ না পেলে । যদি দীর্ঘদিন থাকতে হয়? তখন দেখা যাবে । এখন দরকার একটা রেশন কার্ড । কোথায় পাওয়া যাবে জানেন? জানি না । ভদ্রলোক তখন তাকিয়ে থাকেন থাকেন অসহায় মানুষের মহাসমুদ্রের দিকে । বললেন, কিছু না হলে ফিরে যাবো দেশে । এপারেও মৃত্যু এপারেও । তবে দেশের মাটিতে মরতে আপত্তি কী? আপত্তি কোনো নেই । কিন্তু তিনি কী ফেলে আসা দেশে সহজে ফিরতে পারবেন তার পরিবার পরিজন আর বয়ে আনা লটবহর নিয়ে? মনে হয় না ।
৫. মেয়েটা শুধু কাঁদে । কেন কাঁদে সে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে লাভ নেই । একটি তরুণী মেয়ে, তারতো একটা নিজস্ব গণ্ডি থাকেই । তাঁর পছন্দ অপছন্দ ভালোলাগা, মন্দলাগা । তাঁর রাগ অনুরাগ । ভালোবাগার নিজস্ব মানুষ । প্রথম থরোথরো হৃদয়ে কাঁপন জাগানো সেই সৌম্য দর্শন যুবক । কোথায় সে এখন? সামনের কোনো ফ্রন্টে যুদ্ধরত । আসবে কি ফিরে কখনও? বাসবো না বাসবো না করে সত্যিকারভাবেই ভালোবাসে ফেলে এখন কষ্টের কী দারুণ তীব্রতা! সে আসে না । মনের গভীরে কষ্টগুলো কেমন ঝাঁক বেঁকে বসে থাকে । চোখ জোড়া জলে ভাসে । এখানে তাঁর কিছুই ভালো লাগে না । শরনার্থী শিবিরের পাশ দয়া করে জায়গা দিয়েছেন এক হৃদয়বান মানুষ । এটুকুই । আর সব কিছু করে নিতে হয় তাদের । অভাবের করাল গ্রাস । সামনে গভীর অমানিশা । একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে নানা রোগ বালাই । হাতের পয়সা দ্রুত ফুরিয়ে যায় । মহা বিরক্তি আর রাগের সদা বহিঃপ্রকাশ নিয়ে গার্জিয়ান । সবার জন্য খাদ্য জোগাড়, রেশন টানতে যেয়ে তাঁর অবস্থা খারাপ হয়ে যায় । তিনি হাল ছেড়ে দেয়ার মতো অবস্থায় পৌছে যান । ক্ষুধা জরা সকলকে গ্রাস করে । এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়া দরকার । সব সময় দুর্ব্যবহার আর রাগারাগি করেন গার্জিয়ান । অসহনীয় । পালাতে পারলে হতো । কোথায় পালাবে সে? তাঁর প্রেমিক যুবকটির কাছে যাওয়া কি সম্ভব? ফ্রন্টে, যুদ্ধের মাঠে তার জন্য গভীর আকুতি, অচেনা প্রতিকূল পরিবেশে সব কিছুই অসহনীয় । কোথায় সেই হারিয়ে যাওয়া জগত । সেখানে কোনো দিনই কি ফেরা যাবে? আসে না কেন সেই যুদ্ধের মাঠের সৈনিক? দুর্দান্ত প্রেমময় যুবক । এ জন্য মেয়েটির কান্না । তাঁর কান্না থামানো যাবে না কোনো কিছুর বিনিময়েই । যদি না জয়বাংলা হয় ।
ঢাকাইয়া নুরু কারপড়ের দোকান দিয়ে বসে এসেই । জিজ্ঞেস করলে বলে, খামু কী? খামু কী মানে, সকলেই যা খায় । একা হইলে পারতাম । আমার রাবণের গুষ্ঠি । নুরু তার পরিবার নিয়ে উঠেছে বেরুবাড়ির পাশে একটা দু’কক্ষের বাসায় । অর্ধেকটা ভাড়া নিয়ে । স্ত্রী অতিমাত্রায় এ্যাডভান্স স্টেজ । উপায় নেই । ছাত্রলীগের বড় ধরণের নেতা । যুদ্ধে যাবার কথা তাঁর । কিন্তু শরনার্থী জীবনের ঝামেলা সামলাতে জান ওষ্ঠাগত । এখন তাঁর কাছে অন্যকিছু মূখ্য নয় । পরিবারের সদস্যদের প্রাণ বাঁচানোই অন্যতম দায় । গলা ফাটিয়ে শ্লোগান দিত জয়বাংলা । দীপ্তিময় চেহারা । ছোট-খাটো বেঁটে ধরনের শ্যামলা রঙের টগবগে যুবক । স্বাধীনতার জন্য নিবেদিত । কিন্তু এখন কেমন মিইয়ে গেছে । এখন তার কণ্ঠে শ্লোগান নেই । যুদ্ধে যাবার ইচ্ছে নেই । স্বাধীন বাংলার জন্য সরাসরি কোনো কর্মকান্ডে জড়িত হবার উপায় নেই । এখন লুঙ্গি গেঞ্জির দোকান । চৌকির ওপর বসে থাকা । দরসাম করে কাপড় বিক্রি করা । আর চেনা পরিচিতদের সাথে জয়বাংলার গল্পে অংশগ্রহণ করা । যা কেউ ভাবেনি, তাই হতে হল । চলে আসতে হল নিজ দেশ, জন্মভূমি ছেড়ে । সীমান্তের এপারে । ভারতীয় অংশে । দেশের ভেতরে খাওয়া পরা থাকার ঠাঁই আছে, কিন্তু বাঁচার নিরাপত্তা নেই । এপারে জীবন আছে । কিন্তু থাকার জায়গা নেই । সবখানেই ঠাঁই নেই ভাব । মানুষের মধ্য থেকে কোমল অনুভূতি সব উঠে গেছে । যান্ত্রিক মানুষ এখন কেউ কোথাও ঠাঁই দেয় না । নাম কী? মাহববুবার রহমান প্রধান দুলু । যুবক মানুষ । যুদ্ধে যাচ্ছেন না কেন? যেতে চাই সাহস পাই না । কেন? আমাকে নকশাল ভাবে । তাই কী আপনি? না, দেশে করতাম ভাসানী ন্যাপ, এপারে এসে নকশাল হয়ে গেছি । অপপ্রচার। আমাদের সাথে যাবেন? যাবো । ডিপ্রনডেন্টরা আপত্তি করবে না? করবে । বাট আই ডোন্ট কেয়ার । হোয়াই? বিকজ তাদের তিন বেলা খাবার সংস্থান করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে । বর্ডরের ওপরেই আমাদের জায়গা জমি। ফসলের মাঠ । যুদ্ধে আপনাদের সাহায্য করতে চাই । আমাকেও আপনারা করবেন । হ্যাঁ করবো । আমাদের গাইড হবেন আপনি । হবো । যে নামেই ডাকেন । শুধু থাকতে দেবেন সঙ্গে । থাকলে উপকার হবে । আমি ফ্রন্টের সব কিছু চিনি । রাস্তা-ঘাট, লোকালয়, হাট-বাজার, শত্রুর অবস্থান ইত্যাদি সব । ঠিক আছে । চলেন তাহলে । অদ্ভুত ব্যাপার! দুলু একেবারে নিয়মিত সৈনিকই হয়ে যায় । চমৎকার সুরেলা গানের গলা । রবীন্দ্রসংগীত । তার আর ফিরে চাওয়া হয় না ।
৮. সোনা মিয়া মেম্বার পাক-বাহিনীর দালাল । শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান । তার বাড়িতে খান সেনারা এসে থেকে খেয়ে যায় । ফুর্তি করে তার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীকে নিয়ে । অসহনীয় । তিনি এসে সারেন্ডার করেন । জয়বাংলার যুদ্ধে নিজের জান কোরবান দেয়ার শপথ । একারণে একদিন তিনি হারিয়েই যান । জোনাব আলীর চেহারাটার মধ্যে চোর চোর ভাব । কিন্তু অসম্ভব সাহসী মানুষ সে । ছিল ইপিআর ক্যাম্পের কাজের লোক । এখন সে মুক্তিযোদ্ধাদের গাইড । অন্ধকার রাতে শার্দূলসম গতি আর ক্ষিপ্রতা নিয়ে, সঠিক লক্ষে সে এগিয়ে নেয় আমাদের । হাজী কালা গাজী রাতভর জেগে থাকেন মুক্তিযোদ্ধা ছেলেগুলোর জন্য । আমরা এলেই যেন তার স্বস্তি । জীবনে কোনোদিন বন্দুকের গুলি ছোঁড়েননি । কিন্তু দৈনন্দিন যুদ্ধের শব্দ শোনার সাথে নিজেকে কেমন মানিয়ে নিয়েছেন । রাত জেগে থেকে তিনি কামান যুদ্ধ দেখেন মেশিনগানের খই ফোটার শব্দ শুনে যান । মুক্তিরা না আসা পর্যন্ত শান্তি পান না । শান্তিপ্রিয় নির্ভেজাল মানুষটি এখন দৈনিক যুদ্ধ খোঁজেন । মন্টু চেয়ারম্যান মানিকগঞ্জের শরনার্থী । আক্কাসের বুক ঝাঁঝরা হয়ে যায় শত্রুর গুলিতে, লাশ হয়ে পড়ে থাকে সে বেরুবাড়ী শরণার্থী শিবিরের পাশে । দলে দলে মানুষ দেখতে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ । হৃদয় বিদারক দৃশ্য । রউফ, দোহা, লুৎফর, জব্বার, দুদু, মোস্তফা, আনোয়ার প্রফেসরসহ অগণিত মানুষ । দেশে ফেলে এসেছেন তাদের প্রাচুর্য, স্বচ্ছলতা আর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক সামাজিক জীবন । ৯. সোনাউল্লাহ হাউজে কমরেডদের আড্ডা । তেঁতুলিয়া, ঘুঘুডাংগায় ট্রানজিট ক্যাম্প । লেফট রাইট আর দু’বেলা খাওয়া । অফিসার হবো আমরা, এজন্য যুদ্ধে যাচ্ছি না । অদ্ভুত মানসিকতা!
মানুষের বয়স বেড়ে যায় । অপেক্ষার প্রহর শেষ হতে চায় না । একটা কিছু হোক । হতেই হবে । দেরি আর কিছুতেই নয় । কমান্ডার জব্বার তাঁর গ্রামের বাড়ি ডোমার থেকে বউ বাচ্চা নিয়ে আসে । ওঠে ভোলা বাবুর গোয়াল ঘরে । তাদের আনন্দের শেষ নেই । এমপি কমরুদ্দীন মোক্তারের আড্ডা বেরুবাড়ীতে । লোক লঙ্কর ঘিরে থাকে । তিনি আশা ছাড়েন না । অনেকেই তা ছাড়তে পারেন না । আশা নিয়ে তো বেঁচে থাকা । নইলে মানুষের বাঁচার অবলম্বন কী?
১০. ওরা ক’জন শরনার্থী হয়ে এসে উঠেছে আত্মীয়ের বাড়িতে । এপার বাংলা ওপার বাংলা’। ৪৭-এর পার্টিশনের পর একটি অংশ চলে যায় বাংলাদেশের সংপুর দিনাজপুর অঞ্চলে । অন্য অংশ থেকে যায় । ভারতীয় নাগরিক তারা । শিক্ষা সাংস্কৃতি, চিন্তা-ভাবনা, রুচি, খাদ্যাভাস সবগুলোতেই রয়েছে ভিন্নতা । প্রাচীন জোতদারের বাড়ি । সেখানে এসে ওঠে অধিকৃত বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসা নিকটাত্মীয় শরনার্থী । একসময় যারা ওপারে পাড়ি জমিয়েছিল । প্রথম ক’দিন আত্মীয়তার উষ্ণ বাঁধনের বিহঃপ্রকাশ থাকলেও ধীরে ধীরে তা স্তিমিত হয়ে আসে । হবেই । গভীর দুঃখ আর হতাশা নিয়ে তারা অপেক্ষা করেন । কিছু একটা চূড়ান্ত কিছু ঘটবার । কাছেই ফ্রন্ট । ঘন ঘন কামানের গোলা ওড়ে । ধরণী কাঁপানো বিস্ফোরণের পর বিস্ফোরণ । মধ্যরাতে লাগাতার যুদ্ধের বার্স্ট ফায়ার । ভয় পায়না কেউই । শুধুই মনে হয় এ নাহলে তো স্বাধীন হবে না । জয়বাংলা হবে না । প্রতিদিনের যুদ্ধের শব্দ বড় বেশি আপন মনে হয় তাই । পরিবর্তিত মানুষ । দ্রুত কিছু একটা ঘটুক এটাই চায় । তরুণ যুবা বউওসের ক’জন । বয়সের যা ধর্ম । নিজেদের মধ্যে হৈ-হুলোড় করে । ঘোরাঘুরি নির্দোষ আড্ডা । কাজ নেই । অলস মন্থর জীবন । সামনে যুদ্ধ আছে কিন্তু সেখানে যাবার তাগিদ নেই । চলমান যুদ্ধ তাদের উদ্বোলিত করে । কিন্তু যুদ্ধ ডাকে না । এখানে আশ্রয় আছে নিরাপদ । ভাত-কাপড়ের নিশ্চয়তা আছে । বড়রা হাহুতাশ করে রেডিও শোনে, পত্রিকা পড়ে । যুবক তরুণের দল সামনের বাজরে যেয়ে রেস্টুরেন্টে আড্ডা জমায় । গরম চা-চারমিনার সিগারেটের ধোঁইয়া ছাড়ে কেউ । নিরুপদ্রব জীবন । শঙ্কাবিহীন । কিন্তু হঠাৎ করেই অবস্থার পরিবর্তন হয়ে যায় । তক্কে তক্কে ছিল । একদিন বিএসএফ এসে তাদের তুলে নিয়ে যায় । এরপর সোজা মেজর শেরকির এফএফ ক্যাম্প । লেফট রাইট, দৌড়াকে চল । ফ্রগ জাম্প । ফ্রন্ট্রুল, শান্তিময় ভয়ানক জীবন । এ থেকে পরিত্রাণ নেই জয়বাংলা না হওয়া পর্যন্ত ।
১১. প্রচণ্ড বিষণ্নতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মেয়েটি । চলে যাবো । একরাতের জন্য এসেই চলে যাওয়া । বাবার প্রাক্কালে কাছাকাছি থাকে না সে । বাবা মা ডাকেন । অন্যরা খোঁজ করে । কিন্তু তাঁকে পাওয়া যায় না । বাড়ির বাইরে এসে দেখা যায় । বড় একটা গাছের গুড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে । আনত দৃষ্টি । তাঁর সেই বিষণ্নতা বুকের গভীরে কেমন কাঁটার মতো বিঁধে থাকে । অথচ রাতে তাঁর ভাষা ছিল ভিন্ন । আগে কথা প্রায় বলতই না । প্রচুর বলেছে । দেশ ছেড়ে একদঙ্গল বাচ্চা-কচ্চা নিয়ে তার চলে নাসার বিবরণে চমৎকৃত হতে হয় । নিজের গল্পে, অন্যদের গল্প, যুদ্ধের গল্প, সামনের ফ্রন্টের গল্প, সবশেষে তাদের সঙ্গে বাসরত সেই হৈ-চৈ পার্টি তরুণ যুবকদেরকে ধরে নিয়ে যাওয়ার গল্প । ক্যাম্পে উদ্ধার করতে যেয়ে বাবা-চাচা খালু ফুফাদের নাজেহাল হাওয়া । মেজর শেরকি তাদেরও আটকে দিয়ে বলেছেন, তুম লোগ ভি লেইট-রাইট করো । বলে কী! এই মধ্য বয়সে পৌঢ় বয়েস । লেইফ রাইট, যুদ্ধের ট্রেনিং? ইয়েস, নইলে ভাগো । যুদ্ধে যাবে না । যুবক বয়স কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ে । চায়ের দোকানে আড্ডা হৈচৈ । অনেকদিন থেকেই আমরা তাদের ফলো করছিলাম । এখন ধরে এনেছি । তাদেরতো ছাড়া হবেই না, মগার তুম লোগ লেফট রাইট করো । তারা কোনোক্রমে ভেগে এসেছেন । এই গল্পে করতে যেয়ে মেয়েটির হাসির দমকে ভেঙে পড়া । সংক্রামক ব্যাধির ন্যায় তা ছড়িয়ে পড়ে সকলের মধ্যে । দূরে গুর গুর যুদ্ধের শব্দ ধ্বনি । যেন শুনতে চায় না কেউ । ইচ্ছে করেই পাশ কাটিয়ে যায় । সযত্নে বিছানা পেতে দেয় খাবার পানি দেয় টেবিলে । হারিকেনের নরম আলোয় তাঁকে কেমন অপরূপ দেখায় । মনে হয় তখন, খুব সকালেই তো কাল চলে যেতে হবে । দেখা হবে । যুদ্ধ কি এটা হতে দেবে? কেন এই যুদ্ধ, এত কষ্ট? আর আসবেন না । আসবো । কবে? জানি না । যুদ্ধ কতে হবে । করছেন । অহেতুক রিক্সা নেবেন না । কেন? বলছি, তাই? আর যেন কিছু বলতে চাইছিল, বলা হয় না । চোখে জল । কান্নার আবেগ প্রচণ্ড ভাবে তাঁকে পেয়ে বসে । অনেক কিছুতই হয়তো বলা দরকার । পারি না । শুধু আলতো করে বলি, আসবো, আবার আসবো, যদি বেঁচে থাকি । সেই মেয়েটি ভোরের নরম আলোতে গুড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে । একা । গভীর বিষণ্নতা নিয়ে । হাসে না কাঁদে না, বিদায়ও দেয় না । কে জানে কী হবে । জয়বাংলা না হলে বিষণ্নতা কাটবে না আর কোনোদিন ।
১২. ২৮ নভেম্বর শিং পাড়ায় যুদ্ধ হয় রাতভর । পঞ্চগড় দখলের আগে চূড়ান্ত সর্বাত্মক যুদ্ধ । শীতের কুয়াশা ভেজা রাত । খেলা আকাশের নিচে স্যাঁতস্যাঁতে ধান ক্ষেত । আখ ক্ষেত ফসলের মাঠ, ডাংগা জমি মাড়িয়ে ঘোরতর যুদ্ধের তাণ্ডবতায় নিজেদের জড়িয়ে ফেলা । মধ্য রাতে ট্যাংক এসে যোগ দেয় । আর্টিলারি, মর্টারের গোলা ছোটে অবিরাম । আমরা এগিয়ে চলি স্থির লক্ষ নিয়ে । শীতার্ত রাত কাবু করতে পারে না । কোনো বাঁধাই আর বড় হয়ে দেখা দেয় না । ভোর ভোর সময় পঞ্চগড় শহরের উপকণ্ঠ । সিও অফিস দখল । অতঃপর পঞ্চগড় শহরের মূলে অংশে পৌছানো । জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক হয়ে যাওয়া একটা শহর । কেমন ভুতুড়ে পরিত্যাক্ত । বিজয়োল্লাস । সকলের পাগলপারা করে তোলে । উত্তাল তরঙ্গের ন্যায় গঈজে উঠে জয়বাংলা ধ্বনি । আর তখন তাঁর একটা চিঠি আসে । যুদ্ধের মাঠের মরার ঠিক নেই । জীবন এখানে বড়ই অনিশ্চিত । কিন্তু সম্পূর্ণ পুড়ে যাওয়া বিধ্বস্ত একটা শহর দখলের যুদ্ধের এই পর্যায়ে সব থেকে বড় সাফল্যের লগ্নে একটি চিঠি প্রাপ্তি । কী আনন্দের কী আনন্দের! তখুনি সেটা খুলি না, পড়ি না । পকেটে ঢুকিয়ে সেটা বুকের সাথে সেঁটে রাখি । জানি, সেখানে কী লেকা আছে । লেখা আছে চিরন্তর নারীর সেই আঁকুতি, বেঁচে থাকো, বেঁচে থাকো ।
মাহবুব আলম জন্ম ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৫০, রংপুর । শিক্ষা রংপুর জেলা স্কুল থেকে এসএসসি (১৯৬৬) এবং কাবমাইকেল কলেজ থেকে এইচএসসি (১৯৬৮) । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞানে এম এ । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন মুক্তিযুদ্ধে যোগদান । ৬নম্বর সেক্টরের ৬/এ সাব-সেক্টরে স্কোয়াড্রন লিদার সদরুদ্দিনের অধীনে পঞ্চগড় এলাকায় যুদ্ধ । প্রকাশিত গ্রন্থ-গেরিলা থেকে সম্মুখ যুদ্ধে (দুই খণ্ড), স্মৃতিসৌধ, এইদিন সেইদিন, এখন বড় অসময়, হাইড আউটের গল্প, ইত্যাদি ।
Ref: স্বাধীনতা মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া