You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে আর্মি মেডিকেল কোরের ভূমিকা ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা | ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খুরশিদ উদ্দিন আহমেদ - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে আর্মি মেডিকেল কোরের ভূমিকা ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খুরশিদ উদ্দিন আহমেদ

আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং একজন চিকিৎসক । আমি বিখ্যাত আগরতলা মামলার একজন আসামীও বটে । মুক্তিযুদ্ধে একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল মেডিকেল সাপোর্ট । বাংলাদেশের ইতিহাস আংশিক ও অনাবৃত থাকবে যদি এই সাপোর্টের কথা অজানা থেকে যায় । যুদ্ধের সময় আমার বয়স, সেনাবাহিনীতে আমার জ্যেষ্ঠতা, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ, ১৯৬৪সালের রান অফ কাচ্চ ও ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধসহ মোট ৪টি যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং চিকিৎসা পেশায় আমার সম্পৃক্ততার জন্য দেশী-বিদেশী বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মেলামেশা ও আলাপ আলোচনার সূত্রে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা সম্পর্কে আমি অবহিত । কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্পৃক্তও । শৈশব থেকে সব সময় মনে হত যে, যদি আমাদের একটা আলাদা, শান্তিপূর্ণ সুন্দর, শ্যামল আনন্দময় দেশ থাকত । ১৯৫২ সালে আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশুনা করি এবং আর দশজন ছাত্রের মতো আমি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করি । ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান আর্মি মেডিকেল কোর-এ কমিশন লাভ করি । স্পবসময়ে আমার দেশ পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন বাংলাদেশে রূপান্তর করার ইচ্ছা জাগ্রত হতে থাকে । ১৯৬০ সালে পাকিস্তান নৌবাহিনীর জাহাজ পিএনএস জাহাঙ্গীর এর কমান্ডিং অফিসার কমান্ডার মোয়াজ্জেমের সাথে পরিচয় হয় এবং তাঁর সঙ্গেই সশস্ত্র বিল্পবের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভের উদ্দেশ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্রে প্রধান ভূমিকায় জড়িয়ে যাই । ১৯৬৯ সালে আগরতলা মামলা বাতিল হওয়ার পরে আমরা যারা সশস্ত্র বাহিনীতে চাকুরিরত ছিলাম তাদেরকে সামরিক বাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয় । আগরতলা মামলার পর বঙ্গবন্ধুর সাথে সৌহার্দ গড়ে উঠে । ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পর সবসময় এই ধারণা মনে গাঁথে যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই । জানুয়ারি ১৯৭১-এ ঈদের দিন ধানমণ্ডির ৩২ নং বাসায় বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করলে উনি আমাদেরকে তথা আগরতলা বিপ্লবীদের জিজ্ঞাসা করেন যে, আমাদের পুরনো সামরিক পোশাক রেডি আছে কিনা । তাঁর এ প্রশ্নে মনে দৃঢ়ভাবে দানা বাধে যে, দেশে সশস্ত্র সংগ্রাম হবে এবং বিজয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশ স্বাধীন করতে হবে । ৭ই মার্চে বঙ্গবন্দুর ঐতিহাসিক ঘোষণা দেশ স্বাধীন করার চূড়ান্ত রায় বলে মনে হল ।

মার্চ একাত্তরে আমি ঢাকায় লালবাগ কেল্লার কাছে আমাদের পৈতৃক বাড়িতে থাকতাম । ২৫ তারিখ রাত ১২টায় গোলাগুলির শব্দ ও লালবাগের পশ্চিম উত্তর দিকে ভয়ানক আগুনের লেলিহান শিখা দেখে বুঝলাম ঢাকা বিশ্ববিদযালয়ে পাক বাহিনী অগ্নিসংযোগ করেছে । রাত ২টার পরে একটু নিস্তব্ধতা বিরাজ করতে থাকে । সকাল ৮টায় লালবাগের বাসায় একজন এসে আমাকে শীঘ্র আমার বাসা ত্যাগ করে চলে যেতে বলে । ২৬শে মার্চ বিকালেই বৃদ্ধ মা, বোন, স্ত্রী, ভাই ও ভ্রাতৃষ্পুত্রদের নিয়ে বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে কামরাঙ্গীর চরে আমাদের গোয়ালার বাসায় আশ্রয় গ্রহণ করি । ২৮ তারিখে কামরাঙ্গীর চর আমাদের কাছে অরক্ষণীয় মনে হয়, কেননা পাকিস্তান একটি গানবোট নদীতে টহল দিচ্ছিল । ইতোমধ্যে জানাজানি হয় যে, আমি সেনাবাহিনীর অফিসার । ২৯ তারিখে কেরানীগঞ্জের মাঠে কয়েকজন ছাত্র একটা এলএমজি যোগাড় করে আমাকে তার ব্যবহার সম্বন্ধে জানতে চাইলে আমি তাদেরকে তা দেখিয়ে দেই । তাদের মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রাক্তন ডিজিএমএস মেজর জেনারেল মইদ সিদ্দিকিও ছিলেন । তখন তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ২য় বর্ষের ছাত্র । রামেরকান্দা গ্রামের এক বাড়িতে আমরা পুরো পরিবারসহ আশ্রয় গ্রহণ করি । ১লা এপ্রিল পাকিস্তানি সৈন্যরা কেরানিগঞ্জ আক্রমণ করে একরূপ ধ্বংস করে দেয় । আমি আগলা গ্রামের জনৈক মতি মেম্বরের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করি । সেখানকার লোকজন আমার পরিচয় পেয়ে খুব খুশি হয় এবং আমাকে অনুরোধ করে আশপাশের গ্রামের পরিচয় পেয়ে খুব জন্য । অল্প সময়ে আমার পক্ষে যতটা সম্ভব তা আমি করতে থাকি । কারণ তখন মনে হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ চালাতে হলে পাক বাহিনীকে চলার পথে মাঝেমধ্যে বাধা বা প্রতিরোধের ব্যবস্থা করতে হবে । যদিও আমাদের একজনের কাছে একটা রাইফেল ছিল, প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য তখন যথেষ্ট মনে হতো । সেখান থেকে এপ্রিল মাসে ১০০ মাসের প্রথমদিকে মেজর খালেদ মোশারফের চিঠি পেলাম । তিনি আমাকে বর্ডার ক্রস করে ভারতে এসে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে পেলাম । তিনি আমাকে বর্ডার ক্রস করে ভারতে এসে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে বলেন । দুই তিন বার চেষ্টার পরে অবশেষে আমি আমার ভাইয়ের সাথে আগরতলা ডেলতা সেক্টর (ভারতীয়) হেডকোয়ার্টারে যোগদান করি । বাংলাদেশ মেডিকেল কোরের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ অফিসার স্কোয়াড্রন লিডার সামসুল হক ২২শে এপ্রিল ঢাকা ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য আগরতলা পৌছান । এসময় বেসামরিক ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ডাক্তার ও ছাত্রদের মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার আহ্বান জানানো হয় । তখন অবশ্য নানা অবস্থান থেকে ডাক্তাররা মেডিকেল ছাত্র, নার্সরা যুদ্ধাহতদের বিচ্ছিন্নভাবে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছিল । ১নং সেক্টরে আমি মেজর খুরশিদ, লে.রেজা, ২নং সেক্টরে ক্যাপ্টেন আবুল হোসেন, ক্যাপ্টেন আখতার ও ক্যাপ্টেন সেতারা বেগম, ৩নং সেক্টরে লে.আহমেদ আলী লে.মইন উদ্দিন ও ক্যাপ্টেন কামাল, ৬নং সেক্টরে ক্যাপ্টেন মোশাহেব, ৭নং সেক্টরে মেজর মকসুল পাক বাহিনী ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন । মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, আমিও অন্যান্য সেক্টর কমান্ডারের মতো সম্মুখযুদ্ধে নেতৃত্ব দিব । কারণ ইতোপূর্বে ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ ও রান অব কাচ্চাসহ দুটি যুদ্ধে অগ্রবর্তী লাইনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করি । এ দুটি যুদ্ধে কিছুটা হলেও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি । কিন্তু দেখলাম আরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অপেক্ষা করছে । আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার তখন প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি । চিকিৎসা না পেলে যোদ্ধাদের মনোবল ভেঙে যাবে । আহতদের করুণ অবস্থা দেখলে অন্য যোদ্ধাদের আক্রমণাত্মক ও সাহসী ভূমিকার ভাটা পড়ে যাওয়া স্বাভাবিক । তাই সিদ্ধান্ত নেই মেডিকেল সাপোর্ট ব্যবস্থা সংগঠিত করার । ইতোপূর্বে ক্যাপ্টেন লতিফ মল্লিক, ক্যাপ্টেন আবেদ, ক্যাপ্টেন মো. শাহজাহান, ক্যাপ্টেন মুজিবুর রহমান ফকির, ডা.বড়ুয়া, ডা. জাফর সাদেক, ডা. নাজিম, ডা. বেলায়েত, ডা. গোফরান, ডা. মুস্তাফিজ বিভিন্ন সেক্টরে যোগ দেন । মেডিক্যালের ছাত্র আলী আকবর, আবুল কালাম আজাদ, আবেদুর রহমান, বিভিন্ন সেক্টরে যোগ দেন । এরা তখন সামান্য কিছু ঔষুধ, তুলা ও ব্যান্ডেজ দিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করতে থাকেন । জুন মাসে ক্যাপ্টেন আখতার সোনামুড়া নামক স্থানে একটি ছোট হাসপাতাল খোলেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিতে থাকেন । সেটাই হল আমাদের প্রথম হাসপাতাল । পরে সেই হাসপাতাল বিশ্রামগঞ্জে হাবুল ব্যানাজীর লিচু বাগানে স্থানান্তর করে ঐতিহাসিক বাংলাদেশ হাসপাতালে রূপান্তর করা হয় । এ হাসপাতালই মেজর খালেদ মোশারফের তত্ত্বাবধানে ও ক্যাপ্টেন আখরাত, ক্যাপ্টেন সেতারা বেগম এবং অন্যান্যদের পরিশ্রমে একটি ২০০ শয্যার হাসপাতালে রূপান্তর করা হয় । ইতোপূর্বে ইংল্যান্ড থেকে প্রখ্যাত সার্জন ডা. মোবিন, ডা.জাফরুল্লাহ প্রমুখ এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয় । তাদের এবং ক্যাপ্টেন সেতারা বেগম ও ভারতীয় কিছু ডাক্তারের সহযোগিতায় এটি একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতালে রূপ নেয় । এখানে আহতদের অপারেশনসহ নানা রোগের চিকিৎসা করা হয় । এ হাসপাতালের সরঞ্জাম ও যন্তপাতি বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে গোপনে সরবরাহ করা হয় । গুরুতর আহতদের চিকিৎসার জন্য আগরতলা জি বি (গোবিন্দ বল্লভ) হাসপাতালে পাঠানো হত এবং ওষুধপত্র সংগ্রহ করা হত সেখান থেকেই । এখানে সিভিলিয়ন নার্সরা ও দেশের গণ্যমান্য এবং প্রখ্যাত ব্যক্তিবর্গের স্ত্রী ও কন্যারা যেমন খুকু, সুফিয়া কামালের মেয়ে লুলু, টুলু, কর্নেল নুরুজ্জামানের মেয়ে মিনু ও শিমুল বিল্লাহসহ আরও অনেকে যোগদান করে এদের চিকিৎসায় আহতরা খুব দ্রুত আরোগ্যলাভ করে এবং যুদ্ধে ফেরত যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায় । আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট জনাব নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন, কর্নেল ওসমানী, ডা. ট হোসেন ও ভারতীয় উর্দ্ধাতন সামরিক অফিসারেরা ১নং সেক্টর হেডকোয়ার্টার (হরিনা) পরিদর্শনে আসেন এবং সেক্টর কমান্দার মেজর রফিকের সাথে যুদ্ধের অগ্রগতি সম্বন্ধে আলোচনা করেন । সেদিন ছিল ঝড়ের রাত । সে রাতে টিনের চালার ঘরে কেরোসিন বাতির আলোয় পেন্সিল দিয়ে লেখা কাগজে আমি আমার বাংলাদেশ মেডিকেল কোর-এর অর্গানোগ্রাম তাদের সামনে উপস্থাপন করি । এতে বাংলাদেশ মেডিকেল কোর-এ ডিজিএমএস এবং তার অধীনে যথাক্রমে এডিএমএস (ইস্টার্ন সেক্টর), এডিএমএস (ওয়েস্টার্ন সেক্টর), এডিএমএস (স্টোর) এই ৩টি দফতর রাখা হয় । কর্নেল ওসমানীর এ অর্গানোগ্রামটি অত্যন্ত পছন্দ হয় এবং উনি প্রস্তাবের কাগজটি সাথে দিয়ে যান । সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমে কলকাতার থিয়েটার রোডে অবস্থিত বাংলাদেশ সচিবলয় থেকে বাংলাদেশ আর্মি মেডিকেল কোরের অর্গানাইজেশনের-এর অর্ডার বের হয় । বাংলাদেশ সরকারের অন্য এক আদেশে মেডিকেল এডমনিস্টেশনের ক্ষেত্রে সকল সেক্টরকে ইস্টার্ন ও ওয়েস্টার্ন সেক্টরের অধীনে ন্যাস্ত করা হয় । কোয়াড্রন লিডার শামসুল হক ডিজিএমএস এর দায়িত্ব নিয়োজিত হন । আমাকে ইস্টার্ন সেক্টরের এবং মেজর সামসুল আলমকে ওয়েস্টার্ন সেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হয় । এডিএমএস ( স্টোর) এর দায়িত্ব একজন বেসামরিক কর্মকর্তাকে দেয়া হয় । এখন আমার উপরে ১ থেকে ৫ নম্বর সেক্টরের সকল মেডিকেল এডমিনিস্ট্রেশনের ভার পড়ে এবং বিশ্রামগঞ্জে বাংলাদেশ হাসপাতাল আমার অধীনে ন্যস্ত হয় । বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মেডিকেল কলেজের খ্যাতনামা প্রফেসররা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা, ওষুধ ও সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি গোপনে প্রধান করতেন । উল্লেখ্য, প্রফেসর আলিম চৌধুরী, প্রফেসর ফজলে রাব্বি, ডাঃ মুর্তজা (১৪ ডিসেম্বর আল বদরদের হাতে নির্মমভাবে শাহাদাতবরণ করেন) সহ অনেক সিনিয়র/জুনিয়র প্রফেসর হাসপাতাল থেকে গোপনে যন্ত্রপাতি বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে আমাদের হাতে পৌছাতেই । এক্ষেত্রে ডা. আজিজ ও সুলতানা আজিজের নাম মোটেও ভুলবার নয় । অক্টোবর মাসের শেষের দিকে যে সমস্ত মেডিকেল ষ্টুডেন্ট আমাদের হাসপাতালে কাজ করত তারা অদম্য স্পৃহায় অস্ত্র হাতে যুদ্ধে চলে যায় । রোগীরা কেউই হাসপাতালে রোগী হয়ে থাকতে চাইত না । সকলেই অস্ত্র হাতে যুদ্ধে চলে যেত । এমন মানসিক অবস্থা ছিল রোগী এবং চিকিৎসকদের । ৫টা সেক্টর ও বাংলাদেশ হাসপাতাল আমার অধীনে হওয়ায় কাজ অধিকমাত্রায় বেড়ে যায় । প্রফেসর বদরুদ্দোজা চৌধুরীর কাছ থেকেও অনেক প্রেসক্রিপশন ও ডিমান্ড পেতাম ওষুধ দেয়ার জন্য । আমার ইস্টার্ন হেডকোয়ার্টার সঙ্গে অবস্থিত ছিল । মেডিকেল সেক্টর থেকে ডিমান্ড দিয়ে ওষুধ ও যন্ত্রপাতি অতি সিহিজেই পেতাম । এ পর্যায়ে আমাদের ওষুধের কোনো ঘাটতি ছিল না । সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণ তীব্রতর হতে থাকে । বিশেষ করে খালেদ মোশারফের নিয়ন্ত্রণাধীন ফোর্সের আক্রমণ পাক হানাদার বাহিনীর মধ্যে বিভীষিকা সৃষ্টি করে । এ আক্রমণের ধরণ ছিল আঘাতের পর আঘাত । ফলে একদিকে পাকহানাদার বাহিনীর জানমালের ক্ষয়ক্ষতি যেমন দারুণভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর মধ্যে হতাহতের সংখ্যাও বেশ বেড়ে যায় । আহত মুক্তিযোদ্ধাদের মাইনর ও মেজর অপারেশন, রক্তসঞ্চালন, বুলেট, স্প্লিন্টার অপসারণ, যাবতীয় জরুরি চিকিৎসার চাপ দিন দিন প্রচণ্ডভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে । সাথে সাথে চিকিৎসাসহ সরঞ্জামাদি বিশেষ করে রক্ত, জরুরি ওষুধ, গজ ব্যান্ডেজ, ব্যথানাশক ওষুধ সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়ে । এ সব কিছুতেই হতো আমার নিয়ন্ত্রণাধীন কার্যালয়ের । তার উপর গুরুতর কেসগুলোকে ভারতীয় হাসপাতালে স্থানান্তর কাজটিও করতে হতো, যা ছিল বেশ দুরূহ ব্যাপার । সব কিছুই আমাদের সামাল দিতে হয়েছে, যা করতে গিয়ে মাঝেমাঝে হিমশিম খেতে হয়েছে ।অনেক কষ্ট হয়েছে এগুলো করতে কিন্তু কখনও কাজ বন্ধ করিনি । কারণ আমার কষ্টের চেয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁচানো ও দ্রুত আরোগ্য করে পুনরায় যুদ্ধে পাঠানোর দাবি ছিল আমার কাছে অনেক বড় । চট্রগ্রামের মদুনাঘাট অপারেশনে ফ্লাইট লেফটেনেট সুলতান মাহমুদ অতি দক্ষতার সাথে ৩রা অক্টোবর ইলেক্ট্রিক ট্রান্সফরমার ও অনেক পাইপ ধ্বংস করেন ।সুলতান ঐ অপারেশনে পাহাড় থেকে নিচে পড়ে মারাত্মক আহত হন । টিংচার আয়োডিন দিয়ে জখমগুলো পরিস্কার করতে আমার খুব কষ্ট হয়েছে । প্রতিটি ক্ষতস্থানে সেলাই ও ঔষধ লাগানোর সময় সে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল । ৫/৬ নভেম্বর বিলোনিয়া দখল নিয়ে বিখ্যাত যুদ্ধ হয় পাকিস্তানিদের সাথে । এ যুদ্ধে মূল আক্রমণের দায়িত্ব ছিল ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ওপর । ভারতীয় ২ রাজপুত রেজিমেন্ট এ যুদ্ধে সাহায্যকারী হিসেবে অংশগ্রহণ করে । বিলোনিয়া যুদ্ধের সময় ২ রাজপুত রেজিমেন্টের অধিনায়ক লে.কর্নেল দত্ত তার সেনাদলের জন্য আমার কাছে মেডিকেল কভার চাইলে অত্যন্ত খুশিমনে আমি নিজেই অনশগ্রহণ করি । প্রচণ্ড যুদ্ধে যৌথবাহিনীর কাছে বিলোনিয়া পতন হয় । মুক্ত বিলোনিয়া পদাচারণা করতে ভীষণ উৎফুল্ল বোধ করছিলাম । ৬ ডিসেম্বর সকালেই রেডিওতে সংবাদে পেলাম যে, ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে । ইতোপূর্বে দুষ্ট লোকের বলত যে, আমাদেরকে ভারতের করদরাজ্য হয়ে থাকতে হবে কিন্তু এ স্বীকৃতির পর ঐ শঙ্কা আর রইল না, আমরা একটা স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেলাম এবং নিন্দুকের মুখ বন্ধ হল । হঠাৎ করে ১৬ই ডিসেম্বর বেলা ৩টায় কর্নেল ওসমানী সিলেট এলাকায় পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান দেখতে ইচ্ছা প্রকাশ করলেন । হয়তবা তাঁর নিজের জেলা ও নাড়ির টানে । তিনি আগরতলা এয়ারপোর্ট থেকে ভারতীয় হেলিকপ্টারে উঠলেন । সাথে ছিল ভারতীয় লিয়াজো অফিসার ব্রিগেডিয়ার উজ্জল গুপ্ত, লে.কর্নেল রবের উরুতে বিদ্ধ হয় । আর একটা গুলিতে হেলিকপ্টারের অয়েল ট্যাংক ছিদ্র হয়ে গেলে তেল চুইয়ে চুইয়ে পড়তে থাকে । পাইলট একটু দূরে ছোট মাঠে হেলিকপ্টারটি নামায় । গ্রামের লোক ছুটে এসে কর্নেল রবকে গ্রামের একটি ছোট বাড়িতে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয় । পরদিন ১৭ই ডিসেম্বর আহত কর্নেল রবকে নিয়ে হেলিকপ্টারটি আগরতলা ল্যান্ড করে । কর্নেল ওসমানী নেমে এসে আমাকে বলেন, ‘ডক, টেক কেয়ার অফ রব, আই এম গোয়িং’, বলেই কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দেন । এ সময় শেখ কামাল আমাকে শুধু বলল, ‘স্যার, পড়েছি মোগলের হাতে’, এই বলে এডিসি লে.শেখ কামাল এসমানীর সাথে যাত্রা করে । কর্নেল রবকে সঙ্গে সঙ্গে এ্যাম্বুলেন্স করে আগরতলা হাসপাতালে নিয়ে যাই । এক্স-রে করে বুলেট পাওয়া যায়নি অথবা হাড়ের ইনজুরিও পাওয়া যায়নি । বুলেটটা উরু ভেদ করে বের হয়ে গিয়েছিল । ২৪ ঘন্টা কর্নেল রবকে জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি রেখে আমাদের বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতালেম নিয়ে আসি । ৯ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ বাহিনীর ডিজিএমএসএর একটি পোস্টিং অর্ডার বের হয়, যাতে এএমসি-র অফিসার ও অন্যান্য পদবীর ১৫০ জনের পোস্টিং অর্ডার লিপিবদ্ধ ছিল । ১১ তারিখে ভারতীয় অফিসাররা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে যে, ‘দেশ এখনও স্বাধীন হল না, যুদ্ধ শেষ হল না, এর মধ্যেই তোমাদের এ পোস্টিং অর্ডার । তবে তোমাদের এই দূরদর্শিতার কথা চিন্তা করাই যায় না’। আমাকে অবিলম্বে সিএমএইচ কুমিল্লা এর কমান্ডিং অফিসার হিসেবে টেকওভার করতে বলা হল । ২৫শে ডিসেম্বর প্রথম একটি সাদা গাড়ি নিয়ে কুমিল্লা যাই । সেখানের সিএমএইচ এলাকায় ভারতীয় বাহিনীর ১০১ফিল্ড হাসপাতাল টির অবস্থান ছিল । আমি এক রকম দখল করে ফেলি এবং কুমিল্লা সিএমএইচ নামে এর কার্যক্রম শুরু করি । কুমিল্লা সেনানিবাসের ইস্পাহানী কলেজে ভারতীয় ডিভিশনাল হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হয়েছিল । স্কুলের মাঠে দেখি পাকিস্তানি সেনারা মাঠের ঘাস কাটছে । তাদের চোখ-মুখ খুব বিরক্তিতে ভরা । ভারতীয় কয়েকজন সৈনিক তাদের পাহারা দিচ্ছে । আমাকে দেখে তারা প্রশ্ন করে যে তারা যুদ্ধবন্ধি এবং এই কাজ তাদের দিয়ে কেন করানো হচ্ছে । তখন আমি পাক বাহিনীর নৃশংসতার কথা স্মরণ করে ঘৃণার সাথে মাটিতে থুথু ফেলি । ডিভিশনাল হেডকোয়ার্টারের ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিংয়ের সাথে দেখা হল । তাঁর সাথে পূর্ব পরিচিত ছিলাম । তাঁকে আমাদের পার্ট-১ অর্ডারটা দেখলাম । উনি ভারতীয় এডিএমএস এর সাথে বললেন এবং এক ঘন্টা পরে আমাকে একটা চিঠি দিলেন যাতে পুরো সিএমএইচকে মেজর খুরশিদের (আমার) কাছে হস্তান্তর করার আদেশ দেয়া আছে । এ আদেশের সুবাদে আমি ভারতীয় কর্নেল কাদুয়ার কাছে থেকে সিএমএইচ এর দায়িত্ব বুঝে নেই । কুমিল্লায় বাংলাদেশ হাসপাতালের সব সৈনিক, নার্সরা আমার এখানে কাজে যোগদান করতে থাকে । পাক আমলে পালিয়ে যাওয়া মালি, সুইপার ও অন্যান্য নানা পদের লোকজনও কাজে যোগ দেয় । হাসপাতালের প্রশাসনিক কাঠামো ঠিক করতে মেজর আখতার ও ক্যাপ্টেন আহমদ আলী প্রচুর পরিশ্রম করেন । এ সময় আফসার্স মেস শুরু করা হয় । অত্যন্ত সুচারুরূপে এ মেস পরিচালিত হতে লাগল । এর মধ্যে হঠাৎ একদিন খবর এল যে, ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ থেকে পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হচ্ছে । ২৬শে মার্চ ১৯৭২ ভারতীয় বাহিনীর সমস্ত সৈন্যরা বাংলাদেশের জমি ছেড়ে চলে গেল । ভারতীয় অফিসাররা যুদ্ধকালে আমাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতো, যেটা পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছে পাকিস্তানের ২৩ বছরের চাকরি জীবনে পাইনি ।

জেড ফোর্স পূর্বেই ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার এলাকায় স্থাপিত হলো । কর্নেল জিয়া ওখানেই তাঁর দাফতরিক কাজ শুরু করলেন । ১লা এপ্রিল ৭২-এ আমি পদোন্নপ্তি পেয়ে লে.কর্নেল র‍্যাংক লাগালাম । জেড ফোর্সের কমান্ডার কর্নেল জিয়া একদিন আমাকে ডেকে বললেন, কুমিল্লা সেনানিবাসে অনেক লোককে পাকিস্তানিরা মেরেছে । গবকবরগুলো সনাক্ত করে লাশ উঠে আসছে । এটা ছিল একটা গণকবর । এই গণকবর থেকে আর্মি মেডিকেল কোরের লে.কর্নেল জাহাঙ্গীর, লে.কর্নেল ইসলাম, মেজর হাসিব, মেজর জামান, কযাপ্টেন বদিউল, ক্যাপ্টেন ফারুল, ক্যাপ্টেন তারেক, ক্যাপ্টেন খালেকসহ অনেকের লাশ উদ্ধার করা হয় । লে. কর্নেল জাহাঙ্গীরের লাশ অক্ষত অবস্থায় স্কক্ত হয়ে গিয়েছিল । তাঁর বারিতে ৩০ শে মার্চ তারিখ দেখাচ্ছিল । কুমিল্লা সিএমএইচ-এর কমান্ডিং অফিসার থাকাকালীন তাঁকে ঐ দিন ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে ডেকে তুলে নিয়ে যায় । আর ফিরে আসেনি, মেজর জামান, ক্যাপ্টেন বদিউল, ক্যাপ্টেন ফারুক, ক্যাপ্তেন তারেক, ক্যাপ্টেন খালেকসহ অনেকের লাশ উদ্ধার করা হয় । লে.কর্নেল জাহাঙ্গীরের লাশ অক্ষত অবস্থায় শক্ত হয়ে গিয়েছিল । তাঁর ঘড়িতে ৩০শে মার্চ তারিখ দেখাচ্ছিল । কুমিল্লা সিএমএইচ-এর কমান্ডিং অফিসার থাকাকালিন তাঁকে ঐ দিন ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে ডেকে নিয়ে গুলি করে মারা হয় । মেজর হাসিবকে তাঁর স্ত্রী ও কন্যার সামনে থেকে তুলে নিয়ে যায় । আর ফিরে আসেনি, মেজর হাসিবের মেয়ে তাঁর ঘরের দেয়ালে লাল কালিতে লিখে গিয়েছিল, ‘বাবা আমরা চলে যাচ্ছি । তুমি ফিরে এসে যদি আমাদের না পাও তাহলে দুঃখ করো না”। দেশ স্বাধীনের পর আমি মেজর হাসিবের লাশ তাদের হাতে তুলে দেই । বাকি সকলের লাশ টিপরাবাজার এমপি চেকপোস্টের সামনে সামরিক রীতি অনুসরণ করে দাফন করা হয় এবং পরবর্তীতে এর পাশ স্বাধীনতা যুদ্ধের মনুমেন্ট ও মিউজিয়াম তৈরি করা হয় । দাফনের সময় প্রতিটি শহীদের সম্মানে আকাশে ২১ বার ফায়ার করা হয় । প্রতি দাফনের সকল অফিসার উপস্থিত ছিলেন । দু’জন মেডিক্যাল অফিসারের লাশ তাদের দুজনের নাম একত্রে লেখা হয় । একটা ছোট পাহাড়ের টিলায় মেজর গণির (যিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা) কবর ছিল । সেখানে একটি কাঁচা কবরে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন বোখারীর মৃতদেহ ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় পাওয়া যায় । কুখ্যাত, নৃশংস, অত্যাচারী এই পাকিস্তানি অফিসারের নামে কবরের সংবাদ পেয়ে কুমিল্লাবাসীরাই জ্ঞাত ছিল । মুক্তিবাহিনী তাঁকে নভেম্বর মাসে এম্বুশ করে হত্যা করে । তার কবরের সংবাদ পেয়ে কুমিল্লাবাসী দাবি জানায় যে, এই ঘৃণ্য অত্যাচারীর লাশ যেন বাংলায় মাটিতে না থাকে । জেনারেল ওসমানীকে আমি এ খবর দেওয়ার পর তিনি আদেশ দিলেন, এ অত্যাচারীর লাশ সমুদ্রে ফেলতে । ক্যাপ্টেন বোখারীর মৃতদেহ উঠিয়ে একটা ছোট কাঠের বাক্সে ভরে চট্টগ্রামের সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয় । কুমিল্লায় যে কত শহীদের লাশ ছুড়ে বের করি তাঁর হিসাব নিরূপন করা সহজসাধ্য ছিল না ।

বাহাত্তরের মে মাসে কর্নেল জিয়াকে জার্মানি পাঠানো হয় । তিনি সেখানে পরখ করবেন ট্রেনিংয়ের জন্য সেদেশের ইউনিফর্ম আমাদের আর্মিতে উপযুক্ত কিনা । তিনি সেনাসদরের এক আদেশে জেড ফোর্স-এর দায়িত্ব আমার উপর দিয়ে যান । এর পর সেনাসদরের এক আদেশে জেড ফোর্সের ৪৪ ব্রিগেড রূপান্তরিত করি । এসময় ব্রিগেড মেজর ও ডিকিট-এর দায়িত্ব পালন করছিলেন যথাক্রমে ক্যাপ্টেন অলি আহমদ, বীর বিক্রম ও ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান, বীর উত্তম । এরা দুজনেই ছিলেন অত্যন্ত, দক্ষ ও ন্যায়নিষ্ঠ কর্মকর্তা এবং সর্বোপরি বীর মুক্তিযোদ্ধা । তাদের নিরলস সহযোগিতায় এই নতুন ব্রিগেড কমান্ড করতে মোটেও বেগ পেতে হয়নি । এ সময় তিনটি বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর এটেস্টেশন প্যারেড সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা হয় । কর্নেল জিয়া জার্মানি থেকে ঢাকায় ফেরার পর এসে সরাসরি উপ-সেনাপ্রধান হিসেবে যোগদান করেন । এ সময় জানতে পারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোনো একটি সেনানিবাস পরিদর্শন করবেন । যে কারণেই হোক তিনি কুমিল্লা সেনানিবাসে কুচকাওয়াজ ও করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন । বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনায় ব্রিগেড কুচকাওয়াজ ও সেনানিবাস প্রদর্শণের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয় । কারণ, এটা ছিল বঙ্গুবন্ধুর সর্বপ্রথম সেনানিবাস পরিদর্শন । তার আগমন উপলক্ষে কুমিল্লা সেনানিবাস ও তদসংলগ্ন এলাকা রাস্তায় সাজ সাজ ভাব পড়ে যায় । এসময় লে.কর্নেল তাহের নতুন কমান্ডার অফিসার হিসেবে পোস্টিং পেয়ে কুমিল্লায় উপস্থিত হন । আর ঢাকা সিএমএইচ-এর কমান্ডিং অফিসার হিসেবে আমার পোস্টিং অর্ডার বের হয় । আরও ১০দিন পর বঙ্গবন্ধু এক আদেশে জানালেন প্যারেড সমাপ্ত হওয়ার পরই যেন লে.কর্নেল তাহেরের কাছে আমি দায়িত্ব হস্তান্তর করি । ১৯৭১ সালের ৬ই জুনের প্রত্যুষে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মাধ্যমে পুরো ব্রিগেডের সদ্য ফেরত দামাল সন্তানদের সমন্বয়ে মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকেরা রাষ্ট্রপতিকে প্রথম কুচকাওয়াজ প্রদর্শণে প্রস্তুত হয় । বঙ্গবন্ধু পিছনে সেনাপ্রধান কর্নেল শফিউল্লাহ, আমি ও উপ-সেনাপ্রধান কর্নেল জিয়া ডায়াসে অবস্থান নেই । প্যারেড কমান্ডার বঙ্গুবন্ধুর কাছ থেকে কুচকাওয়াজ শুরু করার অনুমতি নিয়ে মার্চ শুরু করেন । ব্যান্ডের তালে তালে দৃপ্ত পদক্ষেপে বঙ্গবন্ধুকে সালাম দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে । পেছন থেকে আমি বঙ্গবন্ধুর অনুভূতি টের পাচ্ছিলাম । মনে হচ্ছিন গর্বে ওনার বুক ফুলে যাচ্ছে । পুলকিত নেত্রে দেখছিলেন বাংলার এই বীরদের । তিনি অত্যন্ত আবেগময় ভূমিকার কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন । প্যারেড শেষ হওয়ার সাথে সাথে আমার সাথে হাত মিলালেন ও উষ্ণ অভিনন্দন জানালেন । পরদিন লে.কর্নেল তাহেরের কাছে ৪৪ ব্রিগেডের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে ঢাকার পথে রওনা হই ও ঢাকা সিএমএইচ এর কমান্ডিং অফিসার হিসেবে যোগদান করি ।

সেনাবাহিনীর মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামে শাহাদাৎ বরণকারী আর্মি মেডিকেল কোর-এর অফিসারের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি । ১৫ জন অফিসারের মধ্যে ৪জন লে.কর্নেল, ৫জন মেজর, ৬জন ক্যাপ্টেন ও লে.পদবীধারী ডাক্তার । অন্য কোনো কোরের এতজন লে. কর্নেল শহীদ হননি । অফিসারদের মধ্যে যারা শহীদ হয়েচেন লে. কর্নেল বদিউল আমল চৌধুরী, লে. কর্নেল সৈয়দ আবদুর হাই, লে. কর্নেল এএনএম জাহাঙ্গীর, লে. কর্নেল এ এফ জিয়াউর রহমান, মেজর আসাদুল হক, মেজর নাইমুল ইসলাম, মেজর রেজাউর রহমান, মেজর মুজিব উদ্দিন আহমেদ, মেজর আমিরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন আবুল কালাম শেখ, ক্যাপ্টেন বদিউল আলম, লে. এনামুল হক, লে. এম ফারুক, লে. নুরুল ইসলাম তৃর্কী, লে. মো. আমিনুল হক। জেসিও ও অন্যান্য র‍্যাংকের ১৩১ জন শহাদাত বরণ করেন, যার মধ্যে ১ জন বীর উত্তম, ৩ জন বীর বিক্রম ও ১ জন বীর প্রতীক উপাধিধারী । মুক্তিযুদ্ধে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যদের সঙ্গে মেডিক্যাল কোরের সদস্যরা সমান তালে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে । মুক্তিযুদ্ধে মেডিক্যাল কোরের পাঁচ শতাধিক অফিসার জেসিও ও অন্যান্য পদবীর সৈনিকেরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন ও অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দেন ।যুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য এই কোরের ১০ জন সদস্যকে বীরত্বপৃর্ণ রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত করা হয় । এরা হলেনঃ শহীদ সিপাহী নুরুল হক, বীর উত্তম শহীদ হাবিলদার মোঃ রুহুল আমিন বীর বিক্রম শহীদ ল্যান্স নায়েক মো. দেলোয়ার হোসেন বীর বিক্রম শহীদ সিপাহী মো. জামাল উদ্দিন বীর বিক্রম শহীদ সিপাহী ফারুক আহমেদ পাটোয়ারী বীর প্রতীক সুবেদার গোলাম মোস্তফা খান বীর বিক্রম সুবেদার মুসলেহ উদ্দিন আহমেদ বীর প্রতীক মেজর আখতার আহমেদ বীর প্রতীক ক্যাপ্টেন সেতারা বেগম বীর প্রতীক ক্যাপ্টেন সৈয়দ মইন উদ্দিন আহমেদ বীর প্রতীক এখানে ছাত্র ও বেসামরিক ডাক্তারদের অবদানও গভীর কতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করছি । তবুও কিছু গৃহিনী/ছাত্রীরা নাম উল্লেখ না করলেই নয়-সুলতানা কামাল, সাইদা কামাল, খুকু, ডালিয়া, পদ্ম, নীলিমা, অনুপমা, আসমা, রেশমা, মিনু বিল্লাহ-এরা সবাই বাংলাদেশ হাসপাতালে নার্স হিসেবে রোগীদের চিকিৎসা দিয়েছে । ডাক্তার ছাত্র নাজিম, শামছুদ্দিন, ফারহান, সেলিম, আবেদ, মাহমুদ, রশিদ,খাজা, কিরণ, জুবায়ের, মনছুর, কাসেম, লুৎফর, মোরশেদ ছিলেন নিবেদিত প্রাণ । ডা. মোবিন ও ডা. জাফরুল্লাহ ইংল্যান্ডের চাকরি ছেড়ে দিয়ে গাড়ি বিক্রি করে যন্ত্রপাতি, ওষুধ নিয়ে আগরতালায় এসে আহতদের অপারেশন সম্পন্ন করেন । আমি জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত । ও সময় মুক্তিযুদ্ধে আর্মি মেডিক্যাল কোর ও চিকিৎসা সেবকদের কথা না লিখে গেলে এ লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে । তাদের উপর অবিচার করা হবে । স্বাধীনতার ৪০ বছর পর বয়স বৃদ্ধি ও স্মৃতিশক্তি দুর্বল হওয়ায় যুদ্ধকালীন বিভিন্ন সেক্টর ও দেশব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য দেশপ্রেমিক চিকিৎসক, ছত্র, ছাত্রী ও নার্স যাদের নাম স্ম্রণ করতে পারছি না তাদের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি । এদের সকলের অবদান কখনই বৃথা যায়নি । বাঙালি জাতি তাদেরকে সবসময় স্মরণ করবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস । যদি কোনো কারণে আমার লেখায় কোনো ভুল-ভ্রান্তি বা কারও নাম ও কথা বাদ পড়ে গিয়ে থাকে অথবা কেউ দ্বিমত প্রকাশ করে থাকেন, তাহলে আমাকে জানালে আমি অত্যন্ত খুশি হব । স্বাধীনতার জন্য এদেশের মানুষ অকাতরে জীবন দান করেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে, লাখ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম বিসর্জিত হয়েছে । নিজেদের অভাব-অনটনের মধ্যেও খাবার দিয়েছে । অসংখ্য মা-বোনেরা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার রান্না করে মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়েছে নিজেরা অভুক্ত থেকেও । দেশের অভ্যন্তরে চিকিৎসকদের গোপনে ডেকে সশস্ত্র যুদ্ধে আহত চরম মূল্য । এসব সাধারণ মানুষের ঋণ শোধ হবার নয় । তাদের দেশপ্রেম ছিল সব চাওয়া-পাওয়ার উর্ধে । স্বাধীনতার ৪০বছরে এসে আজ দেখি যে মুক্তিযোদ্ধারা, যারা একটা স্বাধীন ভূখন্ডের জন্য জীবনের সব মায়া ত্যাগ করে, মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে, বাবা-মায়ের স্নেহবন্ধনকে ছিন্ন করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল, তারা এখন দরিদ্রের নির্মম কষাঘাতে জর্জরিত এবং সামাজিক লাঞ্চনায় দগ্ধ হয়ে মানবতার জীবন যাপন করছে । এতে ভীষণ কষ্ট হয় । টেলিভিশনে এবং খবরের কাগজে আজ যখন দেখতে পাই যে যুদ্ধাকালের শক্ত সবল দুর্দান্ত যুব যোদ্ধাদল আজ বয়সের শেষ প্রান্তে এসে ভিক্ষাবৃত্তি করে কোনোরকমে জীবনটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, চিকিৎসার অভাবে পঙ্গুত্বকে বরণ করে কোনো রকম্ভাবে বেঁচে আছে, বিয়ে দেবার সামর্থ্য নেই বলে তাদের কন্যারা আইবুড়ো হয়ে চোখের সামনে বাড়িতে বসে আছে, রাজাকার যুদ্ধাপরাধীরা দেশের ক্ষমতা দখল করে গাড়িতে পতাকা উড়িয়ে বিলাসিতার দাপটে ঘুরে বেড়ায়; তখন বিক্ষুব্ধচিত্তে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে এ জন্যই কি আমরা দেশটা স্বাধীন করেছি? এ দুঃখ রাখার কি কোনো জায়গা আছে? যখন চাকরিতে ছিলাম তখন কিছু করার সমর্থ্য ছিল । তখন কর্মহীন মুক্তিযোদ্ধাদের যতটা সম্ভব পুর্নবাসন করেছি । আজ এদের এই অবস্থায় আমি কিছু করতে পারছি না বলে প্রচন্ড ক্ষোভে আমার মন অস্থির হয়ে যায় । আমার এ অক্ষমতা আমাকে সারাক্ষণ পীড়া দেয় । জীবনের এই করুণ অবস্থায় এই সব অসহায় মুক্তিযোদ্ধারা যখন প্রশ্ন করে-এ জন্যই কি আমরা যুদ্ধ করেছি, দেশটা স্বাধীন করেছি, তখন তার উত্তর দিতে পারি না । কারণ এখন যে কোনো সান্ত্বনা তাদের কাছে উপহাস বই কিছু নয় ।

সবশেষে জীবনের এ পর্যায়ে আমার সুখ ও দুঃখ হিসেব করলে মনে হয়, আমি একজন সুখী ব্যক্তি । কারণ সারাজীবন নিঃস্বার্থভাবে মানুষের ও দেশের জন্য কিঞ্চিৎ হলেও কাজ করতে পেরেছি । সর্বোপরি মাতৃভূমিকে মুক্ত করতেও অবদান রাখতে পেরেছি । চাকরি ও অবসরকালে সকল স্তরের মানুষ, সকল পদের সামরিক ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে সম্মান পেয়েছি । মুক্তিযুদ্ধের অংশগ্রহণ ও বিজয় আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন । এটাই আমার জীবনের বড় সুখ । তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এখনো শেষ হল না-এটা আমার জীবনের বড় দুঃখ । তবুও আশায় আছি যদি নতুন প্রজন্ম আমাদের এই বিবেক দংশনের কষ্ট থেকে রেহাই দেবে । তাহলেই, মুক্তিযুদ্ধে জীবনদানকারী অগণিত শহিদদের আত্মার প্রশান্তি মিলবে ।

বিগ্রেডিয়ার জেনারেল খুরশিদ উদ্দিন আহমেদ জন্মঃ ১৯শে মার্চ ১৯৩৩, ময়মনসিংহ । শিক্ষাঃ ১৯৫৭ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করেন । ১৯ মে ১৯৫৮ তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে আর্মি মেডিকেল কোরে কমিশন লাভ করেন । ১৯৬৭ সালে তিনি আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে গ্রেফতার হন । পরবর্তিতে মামলায় অব্যাহতির পর মহান মুক্তিযুদ্ধের পূররাঞ্চলের অ্যাসস্টান্ট ডাইরেক্টর জেনারেল মেডিক্যাল সার্ভিসের দায়িত্বে ছিলেন । ছাত্র জীবনে তিনি বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন । তিনি ১৯৫৬-৫৭ সালে মোহামেডন স্পোর্টিং ক্লাবের সেন্টার করোয়ার্ড হিসেবে বিভিন্ন খেলায় অংশগ্রহণ করেন । ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খুরশিদ উদ্দিন আহমেদ বর্তমানে অবসর জীবন যাপন করেছেন ।

Ref: স্বাধীনতা, মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া