You dont have javascript enabled! Please enable it! তাজউদ্দিন আহমদঃ একটি উজ্জ্বল স্মৃতি | গোলক মজুমদার - সংগ্রামের নোটবুক

তাজউদ্দিন আহমদঃ একটি উজ্জ্বল স্মৃতি
গোলক মজুমদার

তখন পূর্ব পাকিস্তান উত্তাল । নির্বাচনে সবকটি প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারানো সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ভুট্টা সাহেবের পরামর্শে আওয়ামী লীগের সমগ্র পাকিস্তানের বৃহত্তম বা সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে মেনে নিতে অনিচ্ছ প্রকাশ করতে লাগলেন । শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং তারই কোনো সহকর্মীকে পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেখা পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের কল্পনার অতীত । তাই শুরু হলো নানা রকমের টালবাহানা এবং নির্বাচনী রায়কে এড়িয়ে যাওয়ার কূট অভিসন্ধি । সমস্ত আলাপ আলোচনায় শেখ মুজিব এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের একটিমাত্র দাবি-নির্বাচনী রায়কে কার্যকর করতে হবে । পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দ পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি নেতৃবৃন্দকে এবং তাবৎ বাঙালি জনসাধারণকে বরাবরই অত্যন্ত অবজ্ঞার চোখে দেখেছেন । বাঙালি জনসমাজে তাদের অত্যাচারে জর্জরিত । বাণিজ্য, শিল্প, অর্থনীতি, শাসন ব্যবস্থা, সব ক্ষেত্রেই বাঙালিরা বঞ্চিত । এমনকি বাংলা ভাষার ওপর তাদের বলাৎকার, বাঙালি সংস্কৃতি তাদের চক্ষুশূল । রবীন্দ্র সাহিত্য ও সঙ্গীতের কণ্ঠরোধে তাদের নিত্যনতুন প্রচেষ্টা । শেখ সাহেবের বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত এই দাবি তাদের কাছে অন্যায় এবং অসহ্য বলে মনে হলো । বাঙালিরাও জানিয়ে দিলেন সে ক্ষেত্রে তাদের পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিদায় নিতে হবে । ভুট্টো সাহেব ঢাকা থেকে নিঃশব্দে নিস্ক্রান্ত হলেন, নিস্ক্রান্ত হলেন ইয়াহিয়া খানও । যাওয়ার সময় নির্দেশ দিয়ে গেলেন দূর্বিনীত বাঙালিদের শায়েস্তা করতে । শুরু হয়ে গেল পশ্চিমা সশস্ত্রবাহিনীর তাণ্ডব । রাজধানী ঢাকায়, জেলা ও মহকুমা শহরে, রেলস্টেশনে, বন্দর ও বিমানঘাঁটিতে; এমনকি গ্রামে-গঞ্জে ত্রস্ত, বিহ্বল বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল হিংস্র লালসায় সেনাবাহিনী-শাসক সম্প্রদায় এবং তাদের ছড়িয়ে পড়লেন । ইপিআর, আনসার, পুলিশবাহিনীর কিছু অংশ তাদের নিরস্ত করার প্রতিবাধে রুখে দাড়াল এবং ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কাছে সাহায্যের আবেদন জানাল । শেখ সাহেবের পূর্বঘোষিত নির্দেশে তখন পূর্ব পাকিস্তান বন্ধ, দেশব্যাপী হরতাল এবং জনজীবন অচল । ভারতের দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানের এই অভূতপূর্ব ঘটনাবলীর ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছিল সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মীরা এবং অন্যান্য কয়েকটি সংস্থা । গণবিক্ষোভ ও সন্ত্রাসের ঢেউ সীমান্ত ছাড়িয়ে ভারতে আছড়ে পড়তে পারে বলে এই সতর্কতা । ১৯৭১-এর ৩১ মার্চ । খবর এল আওয়ামী লীগের প্রথম সারির কোনো নেতা, হয়তো বা শেখ মুজিবুর রহমান স্বয়ং, কুষ্টিয়ার মেহেরপুর অঞ্চলে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন । শোনা মাত্র তাঁর সঙ্গে কথা বলতে রওনা হয়ে গেলাম । সন্ধ্যার মুখে উপস্থিত হলাম নদীয়া জেলার টুঙ্গি সীমান্ত চৌকিতে । সঙ্গী কর্নেল চক্রবর্তীর চেষ্টায় মহকুমা শাসক তৌফিক এবং পুলিশ অধিনায়ক মাহবুবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল । তারা জানালেন শেখ সাহেবকে দেখা যায়নি তবে অন্য দুইজন নেতা ওখানে আত্মগোপন করতে এসেছেন এবং মুসলিম লীগ ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা তাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে । তাদের প্রাণে বাঁচা কঠিন । অনেক অনুরোধ ও আশ্বাসে তারা ওই দুই নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করালেন । একজন হলেন তাজউদ্দিন আহমদ এবং তাঁর সঙ্গীর নাম আমীর-উল-ইসলাম । তাদের পউওনে ছিল ময়লা গেঞ্জি ও লুঙ্গি । ক্লান্ত মূখে চার পাঁচ দিনের দাড়িগোঁফ, পায়ে রাবারের ছেঁড়া চটি । একেবারে কৃষকের সাজ । অনাহারে-অর্ধাহারে শরীর দূর্বল, কণ্ঠস্বর ক্ষীণ । তাজউদ্দিন সাহেব জানালেন সামরিক বাহিনীর চরম আঘাতের ঠিক আগে শেখ সাহেবের নির্দেশমতো তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন । কথা ছিল শেখ মুজিবও তাঁর সঙ্গে আসবেন কিন্তু পূর্বনির্ধারিত স্থানে ও সময়ে বেরিয়ে পড়ল তখন বাধ্য হয়র তাকে ও আমীর-উল-ইসলামকে হাঁটা শুরু করতে হয় । শেখ সাহেবের কোনো খবর তিনি আর পাননি এবং তাঁর জন্য তিনি উদ্বিগ্ন । তাজউদ্দিন সাহেব বলেন, দেশে প্রতি পদক্ষেপে বিশ্বাসঘাতকতা ও বিপদ সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ অবহিত কিন্তু ভারতে আশ্রয় নিতে তিনি আগ্রহী নন । কেননা শেখ সাহেবের সুস্পষ্ট নির্দেশ যে ভারতেই বাঙালির শেষ সম্বল সুতরাং এমন কিছু যেন না করা হয় যাতে ভারত বিব্রতবোধ করে । সার্বিক অবস্থার বিশদ পর্যালোচনা করে যখন তাঁকে বোঝানো গেল যে পূর্ব পাকিস্তানে থাকা তাঁর পক্ষে নিরাপদ নয়, যোগ্য নেতার অভাব গণবিক্ষভ স্তিমিত হয়ে যাবে এবং তিনি এলে ভারত কোণোভাবেই বিব্রত হবে না তখন তিনি ফিরে আসেন এবং আমাদের সঙ্গে কলকাতা রওনা হন । পথে কিছু আনসার ও মুসলিম লীগ সদস্য অন্ধকারে তাঁকে আক্রমণের চেষ্টা করে কিন্তু সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সতর্কতা ফলে ওদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয় । দমদম বিমানবন্দরে সেই রাতেই সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সর্বাধিনায়ক কে এফ রুস্তমজী এসে পৌঁছুলে তাজউদ্দিন ও আমীর-উল-ইসলামের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় । এবং পরে রুস্তমজী সাহেবের পাজামা-পাঞ্জাবী পরে প্রায় শেষ রাতে তারা সামান্য আহার করলেন । এই সময়ে তাজউদ্দিন সাহেব জানালেন পূর্ব বাংলায় স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত তারা সমস্ত বিলাস-ব্যসন, খানাপিনা পরিত্যাগ করার সংকল্প নিয়েছেন । তারপর আরম্ভ হলো কথাবার্তা । অত্যন্ত সরল করে এবং সহজ ভাষায় তাজউদ্দিন সাহেব পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানের সামগ্রিক পরিস্থিতি বুঝিয়ে দিলেন এবং জানালেন বাঙালির জাতীয় জীবন পর্যুদস্ত করতে ইয়াহিয়া, টিক্কা খান ও ভুট্টো চক্র বদ্ধপরিকর । পৃথিবীর রাজনৈতিক মানচিত্রে বাংলার স্থান এবং কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারত মহাসাগরের গুরুত্ব তাঁর ব্যাখ্যায় সুস্পষ্ট হয়ে উঠল । সকালের দিকে তারা বিশ্রাম করতে গেলেন । ইতোমধ্যে রুস্তমজী সাহেব দিল্লির সঙ্গে কথা বললেন এবং স্থির হল তাদের সেখানে যেতে হবে এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাজউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে আলোচনা করবেন । পরের দুদিন দফায় দফায় রুস্তমজী সাহেব তাদের সঙ্গে কথা বলেন । মোটামুটি স্থির করলেন পূর্ব পাকিস্তানের নাম বদলে রাখা হবে বাংলাদেশ, পতাকা হবে সবুজ জমিতে সোনালী রেখায় চিত্রিত বাংলাদেশের মানচিত্রসহ লাল সূর্য, জাতীয় সঙ্গীত হবে রবীন্দ্রনাথের “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি” । এবং সরকার হবে ধর্মনিরপেক্ষ গণপ্রজাতন্ত্র । স্বাধীনতার ঘোষোণাপত্রের মূল লেখাগুলো তাজউদ্দিন আজমেদ ঠিক করে আমীর-উল-ইসলাম এবং প্রখ্যাত-ব্যরিস্টার সুব্রত রায় চৌধুরী তাঁর সহকর্মীদের সাহায্যে ঘোষোণাপত্র রচনা কাজে হাত দেন । সেদিন ছিল শহরে হরতাল । বিশেষ অনুরোধে দোকান খুলিয়ে তাজউদ্দিন সাহেব ও আমীর-উল-ইসলামের জন্য জামাকাপড়, স্যুটকেস এবং জুতা মোজা এ সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনা হয় । ওষুধপত্রের বিকল্প ব্যবস্থা করা হয় যেহেতু তাঁর অভ্যন্ত ওষুধ ভারতে অচল । তাজউদ্দিন সাহেবের ইচ্ছামতো তাঁকে টুঙ্গী সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয় । সেখান থেকে তিনি সহকর্মীদের কিছু নির্দেশ পাঠান এবং ভারতের মনোভাব সম্বন্ধে অবহিত করেন । কলকাতায় ফিরে যাওয়া প্রস্তুতি নিতে হয় । মধ্যরাতে বিশেষ বিমান তাদের নিয়ে যাত্রা করি । শ্রান্তিতে তারা সেই বিশাল বিমানের মেঝেতে শুয়ে পড়েন এবং আচ্ছন্ন হয়ে যান । রাত আড়াইটার সময় যখন পালাম বিমানবন্দরে পৌছাই তখন অন্যান্য সমস্ত বিমানের জন্য বিমানবন্দর বন্ধ ছিল নিরাপত্তার স্বার্থে । বিশেষ মোটরযোগে বিদেশী গোয়েন্দাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়িয়ে অনেক ঘোরা পথে তাদের গুপ্তবাসস্থান নিয়ে আসা হয় । পরের দিন তাজউদ্দিন আহমদ-এর প্রকৃত পরিচয় এবং আওয়ামী লীগে তাঁর প্রতিপত্তি যাচাই করার উদ্দেশ্যে ইতোমধ্যেই যারা দিল্লি এসে পৌছেছিলেন এমন কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা ও ব্যক্তিবর্গকে তাজউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে নিয়ে আসা হয় কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় । তাজউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে এদের প্রথম দর্শন এবংকথাবার্তায় দিল্লির কর্তারা নিশ্চিত হন যে, শেখ সাহেবের ঘনিষ্ঠতম সহযোগী তাজউদ্দিন সাহেব এবং তাঁর অনুপস্থিতিতে লীগের নেতৃত্ব গ্রহণে সক্ষম এবং এর অধিকারী একমাত্র তাজউদ্দিন আহমদ । তারপর তিনি বিদেশ সচিব ও উপদেষ্টা এবং অবশেষে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেন এবং তাৎক্ষণিক প্রয়োজনের কথা বুঝিয়ে বলেন । প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় স্থির হয় লীগের প্রধানদের বৈঠক সর্বস্মতিক্রমে একটি সরকার গঠন করতে হবে । প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্তী ও অন্যান্য মন্ত্রী এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব নিয়োগ এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, পূর্ব পাকিস্তানের নতুন প্রভৃতি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং সুযোগ মত ঐ দেশেরই কোনো স্থানে প্রকাশ্য সভায় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র গ্রহণ, সরকার গঠন, মন্ত্রীদের শপথ গ্রহণ, জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম ঘোষণা এবং মুক্তিযুদ্ধের জন্য সম্পন্ন করতে হবে । প্রথম থেকেই তাজউদ্দিন সাহেব স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের দাবি করতে থাকেন এবং স্বীকৃতি ঠিকই দেওয়া হবে আশ্রয়দান বস্তুত স্বীকৃতি দান । ইতোমধ্যে আমি কলকাতা ফিরে তাদের থাকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্তা সেরে ফেলি এবং টেলিফোনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি জেলার সঙ্গে প্রয়োজনমতো যোগাযোগের গোপন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করি । দিল্লী থেকে ফিরে তাজউদ্দিন সাহেব যুব নেতাদের সহযোগিতায় মুক্তিবাহিনী গঠন করেন এবং ভারতীয় সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলে তাদের জন্য কয়েকটি সামরিক শিক্ষার ও অভিযানের ঘাঁটি স্থাপন করান । সামরিক বাহিনী এবং ইপিআর-এর দলত্যাগী অফিসারবৃন্দ এইসব ঘাঁটির ভার নেন । ইতোমধ্যে তিনি বিভিন্ন নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের ভারতে আনিয়ে নেন । এদের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খন্দকার মোস্তাক, কামরুজ্জামান প্রমুখ । অনেক এমএনএ এবং নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরও সমাগম হয় । এদিকে ত্রিপুরার পথে কর্নেল ওসমানী এবং ধুবড়ীর পথে মাওলানা ভাসানী এসে পড়েন । আবদুস সামাদ আজাদ, মনি সিংহ, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, আইনবিদ নূরুল আলম প্রমুখকে প্রায়ই দেখা যেত । ইতোমধ্যে সমস্ত এমএনএকে উদ্ধুদ্ধ করে তাজুদ্দিন সাহেব সর্বসম্মতিক্রমে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, মন্ত্রিসভার সদস্য, জাতীয় সঙ্গীত ওপতাকা প্রভৃতি যাবতীয় বিষয় অনুমোদন করিয়ে নিলে মুজিবনগরের আমবাগানে শত শত দেশবাসীর সামনে এবং আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের সম্মুখে বাংলাদেশের জাতীয় সরকার শপথগ্রহণ করেন । কয়েক দিনের মধ্যেই তাজউদ্দিনের নির্দেশে কলকাতার পাকিস্তানি ডেপুটি হাইকমিশনার হোসেন আলী তার আনুগত্য পরিবর্তন করেন এবং বাংলাদেশের প্রথম কূটনৈতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয় । কত সূক্ষ্মতার সঙ্গে ধীরস্থিরভাবে তাজউদ্দিন সাহেবকে এ ব্যাপারে অগ্রসর হতে হয় তা সহজেই অনুমেয় । নির্বাসনে গঠিত সরকার চালাতে যে অর্থের প্রয়োজন তার ব্যবস্থাও তিনি করেন । প্রনাসী বাংলাদেশীরা সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলে সেই অর্থ সরাসরি তাদের তহবিলে জমা পড়ার ব্যবস্থা তিনি সহজেই পাকা করেন । পাকিস্তানি রাজকোষের টাকাও তার চেষ্টায় ঠিকমতো আসতে থাকে । বিদেশী মন্ত্রী ও নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তিনি প্রায়ই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সাক্ষাৎ করতেন এবং অনেক সময়েই তাকে হাসিমুখে প্রাণ বিপন্ন করেও এগিয়ে যেতে । মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণের চাপ তার উপর প্রবল হলেও তিনি তার কাছে নতিস্বীকার করেননি, কেননা তিনি নিশ্চিত জানতেন অধিকসংখ্যক মন্ত্রী অধিকসংখ্যক সমস্যারই সৃষ্টি করবে । সকলেই আপন আপন স্বার্থ সিদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে । ভারতের প্রতি তার বন্ধুত্বের মনোভাব বিষিয়ে দিতে অনেকেই সচেষ্ট ছিলেন। কেন আরো অর্থ সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে না, কেন আরো আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র আসছে না, কেন ভারত প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের হয়ে যুদ্ধ করছে না? এক কোটি শরনার্থীর ভার আমাদের গরিব দেশের পক্ষে কী ভয়ানক তা তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারতেন আর আন্তর্জাতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে যে কোনো রকমের অসাবধানতা বা অপ্রসাঙ্গিক দ্রুততার ফল কত মারাত্মক হতে পারে, তাও তার অজানা ছিল না । তিনি ছিলেন সহনশীলতার প্রতিমূর্তি । তার দৃষ্টি ছিল স্বচ্ছ, তার স্থির লক্ষে তিনি ছিলেন অটল, অনড় । একবার তাকে বলা হয় তার স্ত্রী পুত্রকন্যার কোনো হদিস যদি তিনি উত্তর দেন, বাংলাদেশের লাখ লাখ পরিবারের যে ভাগ্য তার পরিবার সেই ভাগ্যেরই অংশীদার হবে, তাদের জন্য কোনো বিশেষ ব্যবস্থার প্রয়োজন হবে না । তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন বাংলাদেশ প্রকৃত স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত সহজ ও সরলভাবে দিন কাটাবেন, গার্হস্থ্য জীবন পরিহার করবেন । শেষ দিন পর্যন্ত তার প্রতিজ্ঞা তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন । তার পরিবার এক সময় কলকাতায় এসে পৌছালে তিনি কোনোদিন তাদের দেখতে যাননি । একদিন তার শিশুপুত্র অত্যন্র অসুস্থ । বাঁচার আশা খুব কম । ঘোরের মধ্যে বাবাকে ডাকছে । ডাক্তার পরামর্শ দিলেন বাবাকে আনিয়ে নিতে। প্রতিজ্ঞায় অটল তাজউদ্দিন সাহেব যেতে অস্বীকার করলেন। শেষ পর্যন্ত আমাকে ডেকে পাঠানো হল। অনেক বুঝিয়ে বলার পর তিনি যেতে রাজী হলেন। পুত্রের শিয়রে মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে নীরব প্রার্থনার পর নিঃশব্দে ফিরে এলেন। বিধাতার অসীম করুনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভার ন্যস্ত হয়েছিল এমন একজন নির্ভীক ও নিঃস্বার্থ বীরের হাতে। কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা তার নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ক্রমাগত গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন এবং বিদেশী শক্তির সঙ্গে সহযোগিতা করতে থাকেন। তাজউদ্দিন সাহেব তার সহজ ও সরল যুক্তির জোরে তাদের ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণে রাখেন। কয়েকজন যুবনেতা বিক্ষুব্ধ হয়ে মুক্তিবাহিনীর প্রতিযোগী মুক্তিবাহিনী গঠন করে এবং কিছু দিশাহারা আমলার সাহায্যে অধিকতর অর্থ ও অস্ত্রসস্ত্র যোগাড়ে সমর্থ হয়। তাদের একজন তাজউদ্দিন সাহেবের প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে পিস্তল হাতে অতর্কিতে তার ঘরে ঢোকে । কিন্তু শেষ মূহুর্তে তার পায়ে লুটিয়ে পড়ে। তাজ উদ্দিন সাহেব তাকে ক্ষমা করে নিজের বিশ্বস্ত অনুগামী করে তুলতে সক্ষম হন। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে তাজউদ্দিন সাহেব ছিলেন নিঃসঙ্গ সেনানায়ক। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং কর্নেল ওসমানী সাধারণত তাকে সমর্থন করতেন তবে কেউ তার মত নিবেদিত প্রাণ ছিলেন বলে মনে হয়নি। ব্যক্তিগত সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি সকলেরই প্রখর দৃষ্টি ছিল, শুধু তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন এর ব্যতিক্রম। তার স্বাতন্ত্র্য এবং নীতিবোধ তাকে অনন্য মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছিল। এমনকি মাওলানা ভাসানী পর্যন্ত একদিন বলেছিলেন, “আওয়ামী লীগের মধ্যে মানুষের মত মানুষ ওই তাজউদ্দিন”।
এদিকে আওয়ামী লীগের ভেতরের এক অংশ এবং বাইরের শক্তির সহযোগিতায় প্রবল চেষ্টা চলছিল আওয়ামী লীগের প্রতিপত্তি খর্ব করে সর্বদলীয় মন্ত্রীসভা গঠনের।

তাজউদ্দীন সাহেব এই অপচেষ্টার তীব্র বিরোধিতা করেন । ভাসানী সাহেব তাকে সমর্থন জানান এই বলে যে, বাংলাদেশের জনগণ যাদের একজনকেও নির্বাচিত করেনি তারা কোন দাবিতে মন্ত্রীর পদ অধিকার করবে ।‘ শেষ পর্যন্ত ইন্দিরা গান্ধীর চেষ্টার এই অভিসন্ধির শেষ হয় । তিনি তাজউদ্দিন সাহেবের যুক্তিতে সায় দেন । শুভ বুদ্ধির জয় হয় । বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর যেদিন মন্ত্রীরা ঢাকায় ফিরে যান (২১শে ডিসেম্বর ১৯৭১) সেদিন রুস্তমজী সাহেবের সঙ্গে দমদম বিমানবন্দরে যাই তাদের বিদায় জানাতে । নানা কথার পর রুস্তমজী সাহেব বলেন, ‘আমারা আশা করবো ভারত-বাংলাদেশের মৈত্রীর বন্ধন চিরদিন অটুট থাকবে ।‘সঙ্গে সঙ্গে তাজউদ্দিন সাহেব জবাব দেয় ‘হ্যাঁ, স্বাধীন বাংলাদেশের উপর যদি কোনো চাপ সৃষ্টি না করা হয়, বাংলাদেশের কাজকর্মে যদি কোনো প্রভাব বিস্তার না করা হয় তাহলে স্বাশীন বাংলাদেশ ও স্বাধীন ভারতের মৈত্রী চিরকাল অক্ষুন্ন থাকবে ।‘যে রুস্তমজীর চেষ্টায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ এবং যার সঙ্গে তার মধুর সম্পর্ক, স্বদেশের স্বার্থে তাকেও স্পষ্ট ভাষায় ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে দৃঢ় মনোভাব জানাতে তাজউদ্দিন সাহেব মুহূর্তমাত্র দ্বিধা করলেন না ।অথচ বাংলাদেশে প্রচার করা হল তিনি ভারতের দালাল । মিথ্যা কি চিরদিন সত্যের কন্ঠরোধ করে রাখবে? যখন স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ কোথায় অনুমান করা যাচ্ছে না সেই রকম একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন নববর্ষ ঢাকাতে উদযাপন করব । নববর্ষের দিন ঢাকা সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রীর ঘরে তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি কেক, মিষ্টি, চা প্রভৃতি খাইয়ে আমাকে এবং আমার কন্যা জয়ন্তিকে আপ্যায়ন করেন । আমাকে আমার সেই আগের কথাও স্মরণ করিয়ে দেন । তার কোমল স্নেহার্দ্র ব্যাবহার আমাকে মুগ্ধ করে । আমার দুই কন্যার বিবাহে তার পরিবারের সাহচর্য লাভ করি । জীবনের যখন চরম আঘাত আসে, ঈশ্বর আমার পত্নীকে চরণে স্থান দেন, তখনো তাজউদ্দিন সাহেব ছুটে এসে সমবেদনা জানিয়ে যান । এ তার মহত্ত্বেরই পরিচয় । তাজউদ্দিন সাহেব মন্ত্রীসভা থেকে বিদায় নিয়েছিলেন । প্রধান প্রধান শক্তিগুলো তাকে নানা প্রলোভন দেখিয়েছে । সামরিক বাহিনীও তার ইঙ্গিতের প্রতিক্ষা করতে থাকে । কিন্তু তার সুস্পষ্ট উত্তর ছিল ‘শেখ সাহেবের নেতৃত্বে যেকোনো পরিবর্তনের প্রয়াসে তিনি যুক্ত হতে প্রস্তুত, তাকে বাদ দিয়ে কোনো পরিবর্তনের কথা তিনি চিন্তাও করতে পারেন না ।‘ সমস্ত প্রলোভন তিনি হেলায় প্রত্যাখ্যান করেন । এরজন্য চরম মূল্য দিতেও তার দ্বিধা ছিল না । মনে হয় তার নীতিবোধ ও নের্তত্বকে মর্যাদা দোওয়ার ক্ষমতা তখন বাংলাদেশের ছিল না । গভীর মানবিকতা, উজ্জ্বল আদর্শবান, নপূন কর্ম্প্রণালি, মূল্যবোধের মাহাত্ম্য, অকপট আচরণ, সারল্য ও সহনশীলতা তার নির্লোভ নিরাসক্ত হৃদয়কে এক অপূর্ব মহিমায় ভাস্বর করে তুলেছিল । তার প্রতিভা ও চরিত্র গরিমার দীপ্তিতে যাঁরা ম্লান হয়ে পড়েছেন তারাই ঈর্ষা ও মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে তার চরিত্র হরনের চেষ্টা করেছেন । কিন্তু প্রভাত সূর্যের আলোর মতোই সত্য দিক দিগন্তে ছড়িয়ে সমস্ত কুয়াশা, সকল অন্ধকার দূর করে দেবে । দেশবাসীও এই দেশভক্ত সন্তানকে যোগ্য আসনে প্রতিষ্ঠিত করবে স্মরণের অমরতায় । ০২-০৭-১৯৯৫

গোলক মজুমদার ১৯৭১ সালে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (BSF)-এর Inspector General, West Bengal ছিলেন । মুক্তিযুদ্ধের সহায়তায় সরকারিভাবে এবং ব্যাক্তিগত পর্যায়ে নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলেন । প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব । [সূত্রঃ সিমিন হোসেন রিমি (সম্পাদনা), তাজউদ্দিন আহমেদ-আলোকের অনস্তধারা, প্রতিভাস, ঢাকা, ২০০৯, পৃ. ২৩৩-২৪১ ।]

Ref: স্বাধীনতা, মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া