You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো

সাদেক হোসেন খোকা

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি শাসকরা হঠাৎ আমাদের ওপর এক অসম যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল। জাতি হিসেবে আমরা সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলাম। তখন সময়টা ছিল যেন-হেলাল হাফিজের কবিতার মতো ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্ৰেষ্ঠ সময়।’ তরুণ-যুবারা কী এক অমোঘ আকর্ষণে সব মায়ার বাঁধন পেছনে ফেলে জীবন বাজি রেখে দলে দলে যোগ দিয়েছিল দেশ মাতৃকার মুক্তির এই লড়াইয়ে। লাখো মুক্তিযোদ্ধার মতো আমরাও গিয়েছিলাম রণাঙ্গণে। যারা বেঁচে ফিরেছি তারা স্বাধীন দেশের মুক্ত হওয়ায় বুক ভরে নি:শ্বাস নেয়ার সুযোগ পেয়েছি; কিন্তু আমাদের কতো সহযোদ্ধা আর ফিরে আসেনি। যখনই পেছন ফিরে নষ্টালজিক সে সব দিনের কথা ভাবি হারিয়ে ফেলা সাখীদের জন্য বুকের ভেতরে হাহাকার করে ওঠে। আমি যুদ্ধে গিয়েছিলাম মা’কে এমনকি পরিবারের অন্য কাউকে কিছু না জানিয়েই। আমার মতো বেসামরিক জনগণের মধ্য থেকে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের বেশির ভাগেরই অংশগ্রহণ ঘটেছিল নাটকীয়তাহীভাবে। সময় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে বলে কয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে তারা যুদ্ধে যোগ দেননি। যে যেভাবে পেরেছেন বা যে যেখানে ছিলেন সেখান থেকেই চলে গেছেন। অনেক মা-বাবাই হঠাৎ এক সময় খেয়াল করলেন তাদের কোনো কোনো সন্তান আর ঘরে নেই, স্ত্রী দেখলেন স্বামী ঘরে নেই, বোন দেখলেন ভাইটি লাপাত্তা। তারা সবাই একটা নতুন দেশের জন্ম, একটা জাতির মুক্তির সংগ্রামে অংশ নিতে ঘর ছেড়েছে। একদিকে মা, আরেক দিকে মাতৃভূমি। মাতৃভূমির ডাকে ছুটে গেলাম মুক্তিযুদ্ধে, কিন্তু মাঝে মধ্যে মায়ের স্নেহাস্পর্শ পাওয়ার তৃষ্ণায় হৃদয়টা হাহাকার করে উঠতো। তাই সুযোগ করে যুদ্ধ চলাকালে একবার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এলাম, অবশ্যই কুঁকি নিয়ে রাতের বেলায় গোপনে। সকালে নিজ হাতে নাস্তা বানিয়ে পাশে বসে খাওয়াতে খাওয়াতে মা জানতে চাইলেন আমি যুদ্ধে না গেলে কী ক্ষতি হতো? কারণ তোমার হাতে কোনো মানুষ খুন হোক তা আমি চাই না।’ ভাবনায় পড়ে গেলাম, মাকে কী করে বুঝ মানাই। আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম মা আমাকে যেতেই হবে। আর আমরা তো যুদ্ধই করছি পাকিস্তানি দখলদারদের মেরে এবং ভয় দেখিয়ে এদেশ থেকে বিতাড়িত করতে। তিনি যখন দেখলেন। আমাকে ফেরানো যাবে না তখন বললেন, ‘আমাকে কথা দাও অন্যায়ভাবে ঠাণ্ডা মাথায় কাউকে হত্যা করতে পারবেনা।’ মায়ের কথায় রাজি হয়ে তাকে প্রতিশ্রুতি দিলাম যে, ‘অন্যায়ভাবে ঠাণ্ডা মাথায় ধরে এনে কোনো মানুষ হত্যা করবো না।’ যাহোক প্রিয় মাকে দেয়া অঙ্গীকার আক্ষরিক অর্থেই রক্ষা করেছিলাম। পরবর্তীতে যুদ্ধ শেষে আটক বহু মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীকে আইনের হাতে সোপর্দ করেছিলাম।

একাত্তরে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। বামপন্থি রাজনীতির সেই স্বর্ণ যুগে আমিও ছাত্র ইউনিয়নের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম (কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য)। ২৫ মার্চের কালো রাত্রির হত্যাযজ্ঞের পরে পুরো জাতি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ক্ষোভ-যন্ত্রণা, অপমান আর প্রতিশোধ নেয়ার স্পৃহায় ভেতরে ভেতরে ফুসছিল সাড়ে ৭ কোটি বাঙালি। একাত্তরের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন নেতা। রুহুল আমীন এবং গোপীবাগের মাসুদ (বুড়া) সহ বেশ কয়েকজন মিলে প্ৰথমে যাই নরসিন্দীর শিবপুরে। ওখানে কয়েক দিন অবস্থানের পর যুদ্ধের ট্রেনিং নেয়ার জন্য আমরা রওনা দেই। আগরতলার উদ্দেশ্যে। আগরতলায় আমাদের রিসিভ করেন শহীদুল্লাহ খান বাদল। ওখানে পৌছে প্ৰথমে বটতলাস্থ সিপিএম অফিসে গিয়ে মেনন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে চলে যাই ২ নম্বর সেক্টরে। খালেদ মোশাররফ ছিলেন সেক্টর কমান্ডার। মেজর হায়দারের নেতৃত্বে ঢাকার মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছিল। ২ নম্বর সেক্টরের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছিল। দুই নম্বর সেক্টরের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের- নাম ছিল ‘মেলাঘর’। এই ক্যাম্প বামপহী (আওয়ামী লীগ বহির্ভূত) মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি; একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধ প্ৰত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্ৰায় পুরো জাতি অংশগ্রহণ করেছিল। তাই এটা ছিল জনযুদ্ধ। মাতৃভূমির কিছু চিহ্নিত বিশ্বাসঘাতক ছাড়া দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এ দেশের মানুষ সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন।

মেজর হায়দারের অধীনে তিন সপ্তাহ গেরিলা ট্রেনিং শেষে আমাদের সম্মুখযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে পরিচালিত কোনাবন সাব সেক্টরে পাঠানো হয়। আমরা গভীর রাতে সেখানে গিয়ে পৌঁছাই। এখানে দুই সপ্তাহ ট্রেনিং এর প্রথম দিন সকালে তিনি আমাদের ৪০ জনকে ২০ জন করে দুটি গ্রুপে ভাগ হয়ে যেতে বললেন। কিন্তু আমরা কোনভাবেই দুটি গ্রুপ হতে পারছিলাম না। তখন তিনি নির্দেশ দিলেন এক লাইনে দাঁড়ানোর। আমি আর আমার বন্ধু জাকির দাঁড়ালাম পাশাপাশি যাতে এক গ্রুপে থাকতে পারি। কিন্তু তিনি নির্দেশ দিলেন প্রথম থেকে বেজোড় (১,৩,৫) এক গ্রুপে, জোড় (২,৪,৬) আরেক গ্রুপে। ফলে আমি আর জাকিরের মতো অনেকেই যারা এক সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলেন পড়ে গেছেন ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপে। আমাদের মন খারাপ হয়েছে লক্ষ করে টগবগে প্ৰাণবন্ত ক্যাপ্টেন গাফফার বললেন, ‘তোমরা দেশ মাতৃকার জন্য যুদ্ধ করতে এসেছ। এখানে মান অভিমান আবেগের কোনও মূল্য নেই। তোমাদের ব্যাকগ্রাউন্ড যার যতই ভালো হোক না কেন, সকলেই এখানে সাধারণ সৈনিক” । ওখানে ট্রেনিং শেষ করার পর প্রথম দিকে কসবা-মন্দভাগ (মির্জাপুর) বর্ডার এলাকার সাব সেক্টরে কয়েকটি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেই। এসব যুদ্ধে ক্যাপ্টেন গাফফার সরাসরি অংশ নিতেন এবং শত্রুর বাঙ্কারের কাছাকাছি তিনি চলে যেতেন। তার সাহসিকতা দেখে আমরা দারুণ অনুপ্রাণিত হই। এখানে যুদ্ধ করেই মূলত এসএমজি, এসএলার ও চাইনিজ রাইফেলসহ বিভিন্ন অন্ত্র পরিচালনা ও সরাসরি যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করি। ওখানেই একটি যুদ্ধে প্রবল সাহসিকতা দেখিয়ে শহীদ হন গোপিবাগ এলাকার কৃতী সন্তান ও আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু জাকির হোসেন। আমাদের গ্রুপের পুলিশের একজন হাবিলদার ছিলেন, তিনি সেনাবাহিনীর সদস্যদের মতো অতটা যুদ্ধ কৌশল না জানলেও তার মধ্যে বেশ সাহসিকতা ছিল। এক ধরনের রোমান্টিকতা তার মধ্যে কাজ করতো। একদিন তিনি জাকিরদের একটি গ্রুপ নিয়ে পাকিস্তানি আর্মির একটা বাঙ্কার রেইড করতে যান। ওরা ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে ক্রলিং করে এগুচ্ছিল তাতে ধান গাছ নড়ছিল, এটা দেখে গুলি চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। তাদের একটি গুলি এসে লাগে মতিঝিল কলোনি এলাকার নবম শ্রেণীর ছাত্র মোস্তাকের হাতে। ও পাশে থাকা জাকিরকে ডেকে বলে, ‘জাকির ভাই আমার গুলি লেগেছে’। ঘাড় উচু করে সেদিকে তাকাতেই আরেকটি গুলি এসে জাকিরের কানের নিচে লেগে ভেদ করে বেরিয়ে যায়। পরে আরো মুক্তিযোদ্ধারা গিয়ে আক্রমণ করে পাকিস্তানিদের হটিয়ে তার মৃতদেহ উদ্ধার করে এবং বাংলাদেশের মাটিতেই তাকে দাফন করা হয়। ট্রেনিং শেষে আমাকে একটি গেরিলা গ্রুপের কমান্ডার করে ঢাকায় পাঠানো হয়। এই গ্রুপে আগরতলা থেকে ট্রেনিং নিয়ে আসা যোদ্ধা ছিল ৪০ জন এবং এখানে এসে আরো ২৫ জন রিক্রুট করি। ঢাকায় আসার আগের দিন মেজর হায়দার গেরিলা যুদ্ধ এবং শত্রু এলাকায় অবস্থানকালে কী কী বিষয় অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে সে বিষয়ে একটা ব্রিফিং দেন। ক্লিপিং গাউন পরা মেজর হায়দার মোহনীয় ভঙ্গিতে হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছিলেন; যা আজো আমার স্মৃতিতে একটা জীবন্ত দৃশ্য হয়ে বিরাজ করছে। তখন ঢাকার আয়তন এবং জনসংখ্যা আজকের তুলনায় অনেক কম ছিল। আর পাকবাহিনীর দখলদারিত্বের কারণে এই শহরের বহুলোক নিরাপত্তার অভাবে গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছিল। ফলে লোকসংখ্যা আরো অনেক কমে গিয়েছিল। আমাদের আগেও কয়েকটি গ্রুপকে গেরিলা অপারেশনের জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল। তাদের কেউ কেউ অসাবধানতার জন্য পাকিস্তানি আমির হাতে ধরাও পড়েছিলেন।

অপারেশন শুরুর আগে আমরা অগ্রবর্তী গ্রুপগুলোর ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো নিয়ে গভীরভাবে পর্যালোচনা করি। আমার সঙ্গী যারা ছিলেন তাদের মধ্যে রয়েছেন জনপ্রিয় পপ গায়ক আজম খান, ইকবাল, সুকী, আলমাস লস্কর, কাজী মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ্‌, মোহাম্মদ শফি, খুরশিদ, আব্দুল, মতিন, আবু তাহের, মোহাম্মদ বাশার, খন্দকার আবু জায়েদ জিন্নাহ, ফরহাত জামিল ফুয়াদ, মোহাম্মদ শামসুল হুদা, ড. নিজাম, জাহের কচিসহ আরো অনেকে। ঢাকার সন্তান হিসেবে এই শহরের প্রতিটি অলিগলি ছিল আমাদের নখদর্পণে। অন্যদিকে পাকিস্তানি দখলদারদেরও কেন্দ্রীয় শক্তি ছিল ঢাকায়। তখন পাকিস্তানি শাসকরা বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে বলে ব্যাপকভাবে প্রচার চালাচ্ছিল। আমরা সংকল্প করলাম ঢাকায় বড় কিছু বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তাদের প্রচারণার অন্তঃসারশূন্যতা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরবো। ঢাকায় আসার আগে মেজর হায়দার যে ব্রিফিং দিয়েছিলেন তা যুদ্ধকালীন সময়ে যথাযথভাবে মেনে চলেছি। একক সিদ্ধান্ত না নিয়ে সঙ্গীদের সঙ্গে আলোচনা-পর্যালোচনা করে অগ্রসর হই। তাই আমাদের সবগুলো অভিযানই সফলতা পেয়েছিল। গেরিলা যুদ্ধের রণকৌশল যেমন হিট এ্যান্ড রান, জনগণের মধ্যে থেকে যুদ্ধ করা, শত্রুপক্ষকে সবসময়ই অস্থির রাখা, সাফল্য নিয়ে বেশি উৎফুল্ল না হওয়া, নিজেদের নিরাপত্তার কথা স্মরণে রাখা, যুদ্ধে নিজেরা যতটা সম্ভব কম ক্ষতিগ্ৰস্ত হওয়া, শত্রুর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করা, প্রমাণাদি একেবারেই সাথে না রাখা, ইত্যাদি মেনে চলেছি। এমন সব জায়গায় আমরা সফল অপারেশন করেছি যে, আজো ভাবলে শরীর শিউরে ওঠে।

মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে (নভেম্বর) আমাদের আরেকটি সফল অপারেশন ছিল বিডিআরএর গেটে। এই অভিযানে অনেক প্রাণহানি হয়েছিল। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান দ্য ইঞ্জিনিয়ার্স লি, এখানে সে সময় সার্ভের কাজ করছিল।

প্রতিষ্ঠানটির মালিক মজিদ সাহেব ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের মানুষ। এই ঠিকাদার ফার্মটির ইঞ্জিনিয়ার মান্নান এবং ইঞ্জিনিয়ার আনিসুল ইসলাম আমাদের সহায়তা করেন। তাদের সহায়তায় দিনমজুর সেজে পিলখানার অভ্যন্তরে প্রবেশের সুযোগ পেয়ে যাই। দিনমজুরদের যে দলটির সঙ্গে আমি ভেতরে যেতাম সে দলের একজন ছাড়া কেউ আমার আসল পরিচয় জানতো না। একদিন কাদামাটি গায়ে ঝিগাতলার গেইট দিয়ে বের হচ্ছি এমন সময় মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন এনএসএফ- এর তৎকালীন নেতা মাহবুবুল হক দোলন আমাকে চিনে ফেলেন, অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘খোকা না? একী হাল?’ আমার তখন ভয় ও বিব্রতকর অবস্থা। সংক্ষেপে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর দ্রুত মিশে গেলাম জনতার মধ্যে। এভাবে বেশ কয়েকদিন পিলখানার অভ্যন্তরে প্রবেশের সুযোগ পেয়ে যাই। আমি উত্তেজনা নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পিলখানার অভ্যন্তরের সবকিছু দেখে নিচ্ছি। কোথায় কোথায় অবজার্ভেশান পোস্ট আছে পরখ করে নেই। যদিও আমাদের মূল লক্ষ ছিল পিলখানার অভ্যন্তরে বিস্ফোরণ ঘটানো। সম্ভব হলে তাদের অস্ত্ৰ ভাণ্ডারের কাছাকাছি। কিন্তু সার্ভের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় ভেতরে বিস্ফোরক নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে আজিমপুর কবরস্থান সংলগ্ন গেট এলাকায় আমরা প্ৰচণ্ড গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তৎকালীন ইপিআরো বাহিনীর বেশ ক্ষয়-ক্ষতি ঘটিয়েছিলাম। রাতের বেলায় পরিচালিত এই হামলার সময় একটি গুলি দেয়ালে লেগে দিক পরিবর্তন করে আমার পায়ে এসে লাগে। দুইদিন পর একটি ক্লিনিকে গিয়ে ওটা অপারেশন করে তুলে ফেলি। ঢাকায় পৌছে অনেকগুলো বড় ধরনের অপারেশন করি। ঢাকায় যুদ্ধরত অন্য গ্রুপগুলোও তটস্থ করে তুলেছিল পাকিস্তানি বাহিনীকে। দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা দখলদারদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। তবুও পাকিস্তানিদের মিথ্যা প্রচারণায় মনে ক্ষোভের সঞ্চার হতো। তখন সিনেমা হলগুলোতে ‘শো’য়ের আগে ‘চিত্রে পাকিস্তানি খবর শিরোনামে ডকুমেন্টারি দেখানো হতো। এতে হানাদাররা প্রমাণ করতে চাইত যে সব ঠিকঠাক চলছে। ডিএফপিতে মিথ্যাচারে পূর্ণ এই ডকুমেন্টারিগুলো তৈরি হতো।

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্ৰহণ ছিল অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের মতো আমারো জীবনের শ্ৰেষ্ঠ অর্জন। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের কথা, মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের কথা ভাবলেই মন নস্টালজিয়ার ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। মন শুধু রণাঙ্গণের সাহসী সহযোদ্ধাদের হারানোর স্মৃতিতেই ভারাক্রান্ত হয় না, তারচেয়েও বেশি হয় মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন-চেতনার দুর্দশা দেখে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা স্বপ্ন যাই বলি না কেন সেটা শুধু একটি ভূ-খণ্ডের স্বাধীনতা নয়, একটি সার্বিক মুক্তিই ছিল এই মহান যুদ্ধের মূল স্পিরিট। তাই এর নাম হয়েছিল ‘মুক্তিযুদ্ধ’ স্বাধীনতা যুদ্ধ নয়। মূলত ব্রিটিশ বেনিয়াদের রেখে যাওয়া সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামো ভেঙে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও মানবিক সমাজ গঠনই ছিল স্বপ্ন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল এ জাতির একটি সামষ্টিক মুক্তির লক্ষ থেকে। কিন্তু স্বাধীনতার পরপরই আমরা সামষ্টিক উন্নয়নের চিন্তা বাদ দিয়ে ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠলাম। জাতীয় মুক্তি না এলেও একটি স্বাধীন দেশতো আমরা পেয়েছি। যেখানে দাঁড়িয়ে স্বাধীনভাবে দেশকে গড়ে তোলার কথা ভাবতে পারছি, স্বপ্ন দেখতে পারছি সুন্দর আগামীর। আমাদের জাতীয় জীবন থেকে হয়তো দীর্ঘ ৩৮টি বছর চলে গেছে, কিন্তু সুদীর্ঘ ভবিষ্যৎ তো এখনো সামনে পড়ে আছে। যে জাতি প্ৰাণ-ধন-মানসহ জীবনের সকল ঐশ্বৰ্য বাজি রেখে দেশমাতৃকার জন্য যুদ্ধে নামতে পারে সে জাতি পিছিয়ে থাকতে পারে না, থাকবে না; এ বিশ্বাস রাখতে চাই। অনেক রক্ত আর ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের প্রাণপ্ৰিয় বাংলাদেশ অবশ্যই অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীতে মৰ্যাদাপূর্ণ জায়গা অর্জন করে নেবে।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!