You dont have javascript enabled! Please enable it!

রাধানগর অপারেশন
লে. কর্নেল এসআইএম নূরুন্নবী খান, বীর বিক্রম

ভূমিকা: মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস সময়ে বিভিন্ন রণাঙ্গনে অসংখ্য ছোটবড়ো অপারেশনে অংশগ্রহণ করেছিলাম। এ সকল অপারেশনের মধ্যে ‘রাধানগর অপারেশন’ বিভিন্ন কারণে বাঙালি জাতির জন্য অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। এই অপারেশন পরিচালনার মধ্যে দিয়ে বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা প্রমাণ করেছিল যে, তারা বিশ্বখ্যাত গুর্খা রেজিমেন্টের সৈন্যদের চেয়েও অনেক উন্নতমানের যোদ্ধা। ২৬ নভেম্বর ভোররাতে আর্টিলারির ব্যাপক ফায়ার সাপোর্ট নিয়েও ৫/৫ গুর্খা রেজিমেন্ট দুপুর ১২ টা পর্যন্ত ছোটখেল অবস্থানটি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। রাধানগর অবস্থানে তারা উঠতেই পারেনি। এক ছোটখেলেই তাদের হতাহতের সংখ্যা ছিল ৩৫ জন। আর ব্যর্থ রাধানগর আক্রমণে একজন মেজর, একজন ক্যাপ্টেন এবং দুজন লেফটেন্যান্টসহ তাদের হতাহতের সংখ্যা ছিল ১০০ জনের মতো। ওই দিনের অপারেশনে পুরো ৫/৫ গুর্খা রেজিমেন্টটিই পরবতী যুদ্ধের জন্য অকেজো (Unfit for Battle) হয়ে পড়েছিল। অথচ আটিলারির ফায়ার সাপোর্টসহ মিত্রবাহিনীর কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সাহায্য ছাড়াই আমার নেতৃত্বাধীন ডেল্টা কোম্পানি ২৮ নভেম্বর ছোটখেল দখল করে নিতে সক্ষম হয়েছিল।
২৯ নভেম্বর স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কোম্পানিগুলোকে সঙ্গে নিয়ে একযোগে চারদিক থেকেই শত্রুর রাধানগর অবস্থানগুলোর ওপর আক্রমণ পরিচালনা শুরু করি। ৩০ নভেম্বর সকল ৮টার মধ্যে রাধানগরের শক্তিশালী পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা অবস্থানটির পতন ঘটে। অপারেশন ছোটখেল এবং অপারেশন রাধানগর তাই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ তথা সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য এক বিরল গৌরবের বিষয় হিসেবে চির ভাস্বর হয়ে থাকবে। এই অপারেশনটি ছিল এক ধরনের ‘সিজ অপারেশন’। ৬ নভেম্বর থেকে শুরু করে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত এই Seize operation- এর কার্যক্রম চলে। শক্ৰকে চারদিকে থেকে ধাপে ধাপে ঘিরে ফেলে শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান গড়ে তোলার সঙ্কুচিত করে ফেলাই ছিল এই অপারেশনটির মূল লক্ষ্য। ঐ লক্ষ্য অর্জনে আমার নেতৃত্বাধীন ডেল্টা, ইকো এবং স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কোম্পানিগুলো সক্ষম হয়েছিল। একটানা ২৪ দিন ধরে পরিচালিত এই যুদ্ধে বিশ্রাম বলতে আমাদের কিছু ছিল না।

আমাদের প্রতিটি সৈন্যের বিছানা ছিল বাঙ্কার, লেপ-তোশক ছিল স্থানীয়ভাবে প্ৰাপ্ত ধানের খড়। বালিশ ছিল বাঙ্কারের মাটির দেয়াল।
রাধানগরের অবস্থান : সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট থানাধীন রাধানগর সীমান্ত এলাকার একটি ছোট বাজার। রাধানগর বাজারের পূর্ব পাশ ঘেঁষে চলে গেছে পিয়ং নদীর একটি শাখা। নদীর উত্তর পাড়ে রয়েছে জাফলং চা বাগান। ৩ মাইল উত্তরপূর্বে রয়েছে জাফলং বাজার। ৫ মাইল দূরে উত্তর -পূর্ব দিকে রয়েছে জাফলং পিকনিক স্পট ও বল্লাঘাট। অদূরেই বাংলাদেশের সীমান্তবতী বিওপি তামাবিল চেকপোস্ট এবং ভারতীয় ডাউকি চেকপোস্ট ও বাজার। সিলেট- তামাবিল-ডাউকি-শিলং মহাসড়কটি রাধানগর বাজার থেকে বড়জোর ৬ মাইল উত্তরে অবস্থিত ছিল। রাধানগর বাজার থেকে দক্ষিণে গোয়াইনঘাট থানা সদরের দূরত্ব ছিল ৫ মাইলের মতো।
পাকবাহিনীর অবস্থান : বাংলাদেশ সীমান্তে যে সকল সম্ভাব্য এক্সিস (Axis) ধরে মুক্তিবাহিনীর সাহায্যে মিত্রবাহিনী মুভ করতে পারে সেসব এক্সিসে পাকবাহিনী সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় অনেকগুলো শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান (Strong Point) প্রতিষ্ঠা করেছিল। এসকল Strong Point-এ প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়ে যাতে মাসের পর মাস যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া যায় তার সর্ববিধ ব্যবস্থাই তারা করে রেখেছিল। শিলং-ডাউকি-তামাবিল-সিলেট এক্সিস-এ রাধানগর ছিল পাকবাহিনীর ঐ ধরনেরই একটি সীমান্তবতী ‘শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান’। রাধানগর বাজার এলাকা, আলমনগর, ছাটখেল, কুমিল্লাবস্তি, মুরাবস্তিসহ এলাকাগুলো নিয়ে পাকবাহিনী একটি নিশ্চিছদ্র ও শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক কোম্পানি এবং টৰ্চি স্বাউট-এর দুই কোম্পানি সৈন্য রাধানগর strong Point- এ প্রতিরক্ষা কাজে নিয়োজিত ছিল। পাকবাহিনীর এই প্রতিরক্ষা কমপ্লেক্সের সদর দপ্তর ছিল রাধানগর-গোয়াইনঘাট সড়ক ঘেঁষা ছোটখেল গ্রামে। পাকবাহিনীর রাধানগর অবস্থানের ফায়ার সার্পোর্ট দেওয়ার জন্য গোয়াইনঘাটে ছিল ফিল্ড আর্টিলারি গানের একটি ব্যাটারি। তাছাড়া ৩৯ বালুচ রেজিমেন্টের এক কোম্পানি, ১২ এ কে আর এফ, পাঞ্জাব রেঞ্জার এবং টৰ্চি স্বাউট-এর আরো এক কোম্পানি সৈন্য সার্বক্ষণিভাবেই Reinforcement- এর জন্য গোয়াইনঘাটে প্রস্তুত থাকতো। গোয়াইনঘাটের সঙ্গে পাকা সড়কপথে পাকবাহিনীর দরবক্স, জৈন্তা- ও খাদিমনগরের অবস্থানগুলোর সাৰ্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল। খাদিমনগরে ছিল পাকবাহিনীর ২০২ ব্রিগেডের সদর দপ্তর। এই বিগ্রেডের ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন ব্রিগেডিয়ার সলিমুল্লাহ। রেজিমেন্ট দুটি এসে অবস্থান নেয়। অক্টোবর মাসের শেষ দিকে হাদারপার এলাকা থেকে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা, ডেল্টা এবং ব্যাটেলিয়ন হেডকোয়ার্টার কোম্পানিকে তামাবিলে নিয়ে আসা হয়। ৬ নভেম্বর লে. নবীর ডেল্টা কোম্পানিকে পাকবাহিনীর ছোটখেল গ্রামের অবস্থানের বরাবর ঠিক পশ্চিমের লুনি গ্রামে প্রতিরক্ষা অবস্থান গড়ে তোলার নির্দেশ দেওয়া হয়। আর লে. মনজুরের নেতৃত্বাধীন আলফা কোম্পানিকে পাকবাহিনীর রাধানগর বাজার অবস্থান বরাবর পূর্বের কাফাউরা ও বাউরিবাগ গ্রামে প্রতিরক্ষা অবস্থান গড়ে তুলতে বলা হয়। ব্রাভো ও চার্লি কোম্পানি দুটিকে ব্যাটেলিয়ন টু-আই-সি মেজর মোহসিনের কমান্ডে ছাতক সংলগ্ন এলাকায় রেখে ব্যাটেলিয়ন অধিনায়ক মেজর শাফায়াত জামিল ডাউকিতে এসে আলফা ডেল্টা এবং ব্যাটেলিয়ান হেডকোয়টার কোম্পানির সঙ্গে অবস্থান নেন। সুবেদার মোশাররফের নেতৃত্বাধীন এফএফ কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় লেফটেন্যান্ট নবী পার্শ্ববতীর্ণ দুয়ারীখেল ও ছাত্তার গাঁ গ্ৰাম দুটি দখল করে নিয়ে তার প্রতিরক্ষা বেষ্টনীর বিস্তৃতি ঘটান। নভেম্বর মাসের ১০/১২ তারিখের দিকে ব্যাটেলিয়ন অধিনায়ক বাঁশতলার সেক্টর হেডকোয়ার্টার সংলগ্ন বাংলা বাজার এলাকার প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে ইকো ও ব্রাভো কোম্পানি থেকে দুটি প্লাটুন এনে লে. নবীর কমান্ডে ন্যস্ত করেন। অতিরিক্ত সৈন্য পেয়ে ডেল্টা কোম্পানি কমান্ডার লে. নবী গোরা ও শিমুলতলা গ্ৰাম দুটিও দখল করে নিয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান গড়ে তোলেন। গোরা ও শিমুলতলা গ্ৰাম দুটি দখল করে নেওয়ার ফলে গোয়াইনঘাটের সঙ্গে রাধানগর এলাকায় অবস্থানকারী সৈন্যরা FUP অবস্থানে নিরাপদে পৌঁছে যায়। কুয়াশার কারণে পাঁচ গজ দূরেও কিছু দেখা যাচ্ছিল না। পুরো দেলটা কোম্পানি Extended Formation করে Assault Line-এর অবস্থানের দিকে অতি সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে চলে। এক লাইনে ডেল্টা কোম্পানির ১৫০ জন সৈনিক এগিয়ে চলে। তাদের সামনে দুটি রাস্তা খোলা- হয় জয় না হয় মৃত্যু। লাইনের একেবারে বাঁয়ের প্লাটুনের সঙ্গে এগিয়ে যান ব্যাটেলিয়ন অধিনায়ক মেজর শাফায়াত জামিল। মাঝখানের প্লাটুনের সঙ্গে অবস্থান নেন ডেল্টা কোম্পানির কমান্ডার লে. নবী। কুয়াশার সুযোগ নিয়ে ছোটখেল গ্রামের পশ্চিম প্রান্ত থেকে মাত্র ১৫০ গজ দূরে Assault Line তৈরিতে সিদ্ধান্ত সকলেই FUP-তে অবস্থানকালেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। Assault Line- এ পৌঁছানোর পর সকলকেই স্ট্যান্ডিং পজিশনে নিজ নিজ অন্ত্র থেকে ফায়ার করতে করতে একদৌড়ে ছোটখেল গ্রামে উঠে পড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। গ্রামে উঠেই প্রতিটি সৈনিককে একটি করে ৩৬ হ্যান্ড গ্রেনেড শক্রর বাঙ্কার লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
অবশেষে সেই প্ৰতীক্ষিত মুহুর্তটি এসে গেল। ছোটখেল গ্রামের পশ্চিমপ্রাপ্ত থেকে মাত্র ১০০ গজ দূরে পৌঁছেই ডেল্টা কোম্পানির ১৫০ জন সৈনিক একযোগে ‘আল্লাহু আকবর, ইয়া হায়দার ও জয়বাংলা’ স্লোগান দিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে ছোটখেল গ্রামের পশ্চিম দক্ষিণ ও উত্তর দিকে উঠে পড়ে। গ্রামে উঠেই অসংখ্য গ্রেনেড শক্রর ওপর ছুড়ে মারা হয়। শক্ৰ হতবিহবল হয়ে প্রতিহত করার পরিবর্তে নিজ নিজ অবস্থান ছেড়ে এদিক-সেদিক দৌড়ে পালাতে থাকে। হাতাহাতি যুদ্ধের প্ৰস্ততির জন্য যে সময়ের দরকার, তাও তাদের ছিল না। ছোটখেল গ্রামের উত্তর-পূর্ব দিককার অবস্থান থেকেও গুলি নিক্ষেপের কোনো সুযোগ ছিল না। কেননা তাতে নিজ পক্ষেরই সৈনিকদের হতাহতের সম্ভাবনা ছিল। শত্রুপক্ষের সৈনিকদের অনেককেই আন্ডারওয়ার পরে বা তোয়ালে পেঁচিয়ে খালি হাতেও দৌড়ে পালাতে দেখা গেল। পলায়নরত পাকসেনাদের বহুসংখ্যক সৈন্য ডেল্টা কোম্পানির সৈনিকদের গুলিতে ধরাশায়ী হতে লাগলো। ১০ থেকে ১২ মিনিটের মধ্যে পুরো ছোটখেল গ্রাম ডেল্টা কোম্পানির দখলে চলে আসে।
বিজয়ের আনন্দে ডেল্টা কোম্পানির সৈনিকরা কয়েকটি খড়ের গাদায় আগুন ধরিয়ে দেয়। এক পর্যায়ে গ্রামের উত্তর প্রান্তে মেজর শাফায়াত জামিল পাশের কাশবন হয়ে পলায়নরত এক পাকিস্তানি সৈনিকের গুলির আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হন। তার সঙ্গে থাকা ৩/৪ জন সৈনিক আহত মেজর শাফায়াত জামিলকে কাধে করে পিছনের লুনি গ্রামের অবস্থানে নিয়ে যায়। সেখানে ব্যাটেলিয়ন আরএমও ডা. ওয়াহেদ মেজর শাফায়াতের প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। আহত মেজর শাফায়াত যে কোন কিছুর বিনিময়ে ছটোখেল অবস্থানটি দখলে রাখাসহ প্রয়োজনীয় কিছু নির্দেশাবলী দিতে ডেল্টা কোম্পানির অধিনায়ক লে. নবীকে একটি চিঠি লিখে পাঠান। চিঠিটি লে. নবীর কাছে পৌছালে তিনি মেজর শাফায়াতের আহত হওয়ার বিষয়টি কাউকে না জানানোর জন্য সৈনিকদ্বয়কে অনুরোধ করেন। ছোটখেল দখলের পর পরই লুনি গ্রামে অবস্থানকারী সুবেদার মোশাররফের (ইপিআর) এফএফ কোম্পানির বেশ কিছুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা লুনি ও ছোটখেল গ্রামের মধ্যকার মাঠটিতে গ্ৰাম্য হাঁটাপথকে আড়াল করে দুই সারিতে উত্তর এবং দক্ষিণ দিকে মুখ করে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়ে নেয়। তাতে করে লুনি গ্ৰাম থেকে ছোটখেল গ্রামে পৌছার নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। এছাড়া এই এফএফ কোম্পানির অন্তত ৭০/৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা ডেল্টা কোম্পানির প্লাটুনগুলোর সঙ্গে বাঙ্কারে অবস্থান নিয়ে নেয়।
পাকবাহিনীর প্রতিআক্রমণ প্রতিহত ডেল্টা কোম্পানি কর্তৃক ছোটখেল দখলের সংবাদ ওয়াকিটকি সেটের মাধ্যমে ডাউকিতে অবস্থানরত ১০১ কমিউনিকেশন জোনের জিওসি মেজর জেনারেল গুরবক্স সিং গিল এবং ই-১ সেক্টর কমান্ডার কর্নেল রাজ সিংকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। রাধানগরে গুর্খাদের পূর্বনির্ধারিত আক্রমণটি পরিচালিত না হওয়ার কারণে ছোটখেলে টিকে থাকা ডেল্টা কোম্পানির জন্য দুঃসাধ্যে ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এ বিষয়টি কর্নেল রাজ সিংকে জানানো হলে তিনি ঐদিন দুপুরের মধ্যেই গুর্খাদের আক্রমণ পরিচালনার নিশ্চয়তা দেন। ডেল্টা কোম্পানি কর্তৃক ছোটখেল দখল করে নেওয়ার ফলে শক্ৰদের রাধানগরের সঙ্গে গোয়াইনঘাটের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে ছোটখেল পুনর্দখলের জন্য পাকবাহিনীর যে বেপরোয়া হয়ে প্রতি আক্রমণ চালাবে তা অধিনায়ক লে. নবীর জানা ছিল। পাকবাহিনীর প্রতিআক্রমণ প্ৰতিহত করার জন্য প্রয়োজন ছিল প্রচুর অ্যামুনিশন এবং ভারী অস্ত্ৰ-শস্ত্রের। ছোটখেল অবস্থানে পাকবাহিনীর ফেলে যাওয়া কয়েকটি হেভি মেশিনগান, মিডিয়াম মেশিনগান, লাইট মেশিনগান এবং অজস্র অ্যামুনিশন ভীষণ কাজে লাগে। পাকবাহিনীর ফেলে যাওয়া অন্ত্রগুলো ডেল্টা কোম্পানির ফায়ার পাওয়ার বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। পাকবাহিনীর মজবুত বাঙ্কারগুলোও প্রতিরক্ষার কাজে সাহায্যে করে। পাকবাহিনী যে পরিমাণ অ্যামুনিশন ফেলে গিয়েছিল তা একটি ব্যাটেলিয়নের এক হাজার সৈনিক দৈনিক ২৪ ঘন্টা করে গুলি নিক্ষেপ করলেও এক বছরে শেষ হবে না। সুবেদার মোশাররফের এফএফ কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় স্বল্প সময়ের মধ্যেই প্লাটন ভিত্তিক প্রতিটি বাঙ্কারে পর্যাপ্ত পরিমাণ অ্যামুনশিন পৌছানোর ব্যবস্থা করা হয়। ছোটখেলে পাকিস্তানিদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্তা এমনই নিশ্চিছদ্র এবং নিখুঁত ছিল যে, এক বাঙ্কার থেকে অন্য বাঙ্কারে বা এক অবস্থান থেকে অন্য অবস্থানে যাওয়ার জন্য গভীর কমিউনিকেশন ট্রেঞ্চ ছিল। গুলিগোলার মধ্যেও হেঁটে এক অবস্থান থেকে অন্য অবস্থানে যাওয়া যেতো।
গোয়াইনঘাট থেকে ব্যাপক আটিলারির গোলা নিক্ষেপের মাধ্যমে সকাল ৮টার দিকেই পাকিস্তানিদের ব্যাপক প্ৰতিআক্রমণই শুরু হয়। ডেল্টা কোম্পানির বীর সৈনিকরা এই প্রতিহামলা প্রতিহত করে। প্রতি দুই ঘন্টা পর পর এদিন কয়েকবারই ছোটখেল অবস্থানের ওপর পাকবাহিনী প্ৰতিআক্রমণই চালিয়ে যায়। কিন্তু ডেল্টা কোম্পানির সৈনিকরা পাকবাহিনীর প্রতিটি প্ৰতিআক্রমণই (Counter Attack) প্ৰতিহত করে। এদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত মিত্রবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুত রাধানগর দখলের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ২৯ অক্টোবর দুপুর পর্যন্ত মিত্র বাহিনীর রাধানগর আক্রমণের অপেক্ষায় থেকে ডেল্টা কোম্পানির কামন্ডার লে, নবী নিজ উদ্যোগেই রাধানগর শক্রমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। এদিন বিকাল ৪টা থেকে রাধানগরকে ঘিরে অবস্থান নেওয়া সুবেদার মোশাররফ, লে. মতিউর রহমান, হাবিলদার রফিক, মুজাহিদ ক্যাপ্টেন দাউদ এবং ৩য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানির অধিনায়ক লে, মনজুরকে নিজে নিজ কোম্পানির সম্মুখবর্তী অবস্থানগুলোর ওপর একযোগে আক্রমণ পরিচালনার নির্দেশ দেন।
রাধানগর শক্রমুক্ত ২৯ অক্টোবর বিকাল থেকেই এফএফ ও এমএফ কোম্পানিগুলো একযোগে রাধানগর দখলের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হতে শুরু করে। এদিন সন্ধ্যার পরপরই উত্তর-পূর্ব দিক থেকে পাকবাহিনী ছোটখেল অবস্থানের ওপর এক ভয়াবহ আক্রমণ করে বসে। এক পর্যায়ে দুপক্ষের মধ্যে গ্রেনেড ছোড়াছুড়ি শুরু হয়ে যায়। ডেল্টা কোম্পানির সৈনিকরা নিজ নিজ বাঙ্কারে অবস্থান নিয়ে শত্রুর প্ৰতিআক্রমণ মোকাবিলা করে। শত্রুর ৩৯ বালুচ রেজিমেন্টের কোম্পানিটি আক্রমণে ব্যর্থ হয়ে গোয়াইনঘাটের দিকে পশ্চাদপসরণ করে। এদিকে রাআত ৮টার দিকে ইসলামপুর, কুমিল্লাবস্তি, ভিত্রীখেল, বাউরিবাগ এবং কাফাউরা গ্রামসহ সর্বত্রই মুক্তিযোদ্ধারা খড়ের গাদা ও ছনের ঘরগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেন। আগুনের লেলিহান শিখায় পুরো এলাকা আলোকিত হয়ে যায়। লে. মতিউর এবং মুজাহিদ ক্যাপ্টেন দাউদের এফএফ কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা জাফলং চা বাগানের অবস্থা ছেড়ে নদী পার হয়ে রাধানগর বাজারের কাঁচা দোকান ও ঘরগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। অবস্থা বেগতিক দেখে ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের কোম্পানিটি রাধানগরের সম্মুখবর্তী অবস্থান ছেড়ে আলমনগরে সুলতান মেম্বারের বাড়ি আশপাশ ধরে সড়কের ওপর বাঙ্কারগুলোতে অবস্থান নেয়। ৩০ নভেম্বর ভোর ৪টার দিকে এই কোম্পানিটি ডেল্টা কোম্পানির ছোটখেল অবস্থানের ওপর এক আত্মঘাতী হামলা চালায়। ডেল্টা কোম্পানির সৈন্যরা নিজ নিজ অবস্থানে অটল থেকে যায়। শেষ প্ৰচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে এরাও গোয়াইনঘাটের দিকে পশ্চাদপসরণ করে। টৰ্চি ব্যাটেলিয়নের কিছু সৈনিক ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে তাদের অবস্থানে থেকে যায়। এরা পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সৈনিকদের সঙ্গে পশ্চাদপসরণে ব্যর্থ হয়েছিল।
৩০ নভেম্বর সকাল ৬টার দিকে শত্রুপক্ষ থেকে গুলিগোলা নিক্ষেপ বন্ধ হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা বুঝতে সক্ষম হয় যে, শত্রু রাধানগর ছেড়ে চলে গেছে। এদিন সকাল ৮টার মধ্যেই রাধানগর সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত হয়ে যায়। এখানে সেখানে লুকিয়ে থাকা ৮ জন শত্রু সৈন্য মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দি হয়। এদেরকে রশি দিয়ে বেঁধে ডাউকি বিএসএফ ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মুক্তিবাহিনী কর্তৃক রাধানগর দখলের সংবাদ সকাল ৮টার সময় ডাউকি বিএসএফ ক্যাম্পে পৌছে যায়। এ সময় মিত্রবাহিনীর ঊর্ধ্বতন অফিসারগণ রাধানগর আক্রমণের জন্য এক আলোচনা সভা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সংবাদটি প্ৰথমে তাদের কাছে অবিশ্বাস্য বলেই মনে হয়েছিল। আর তাই মুক্তিবাহিনী কর্তৃক রাধানগর দখলের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তারা বিএসএফ-এর মেজর রাওয়ের নেতৃত্বে একটি সেনাদল রাধানগরে পাঠান। মেজর রাও যখন রাধানগর বাজারে পৌছেন, তখন মুক্তিযোদ্ধারা রাধানগর হাইস্কুল প্রাঙ্গনে একত্রিত হয়ে বিজয় উৎসব পালন করছিলেন। এলাকার সকল মুক্তিযোদ্ধাকে একত্রিত করে ঐ সময় অপারেশনের অধিনায়ক লে. নবী মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে একটি টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে পরবতী কার্যক্রম সম্বন্ধে ব্রিফিং দিচ্ছিলেন। লে. নবী এগিয়ে গিয়ে মেজর রাওকে রাধানগর দখলের সংবাদ জেনারেল গুরুবক্স সিং গিল, ব্রিগেডিয়ার ওয়াকে এবং কর্নেল রাজ সিংসহ সকলকে জানিয়ে দিতে অনুরোধ করেন। মেজর রাও এ সংবাদ নিয়ে ডাউকিতে ফিরে যান।
অপারেশনের ফলাফল : মুক্তিবাহিনী কর্তৃক ছোটখেল ও রাধানগর দখলের ফলে ছাতক-সুনামগঞ্জ- ভোলাগঞ্জ-তামাবিল-ডাউকি-মুক্তারপুর সীমান্ত এলাকার সবচেয়ে শক্তিশালী পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা অবস্থানটির পতন ঘটে। রাধানগরের পতনের সংবাদ বিদ্যুৎবেগে চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল লক্ষগুণ বেড়ে যায়। পশ্চিমে নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, ছাতক ও কোম্পানিগঞ্জ এবং পূর্বে মুক্তারপুর, কানাইঘাট, কমলগঞ্জ, মৌলবীবাজার ও শ্ৰীমঙ্গল এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্তবর্তী শত্রুর প্রতিটি অবস্থানের উপর উপর্যুপরি আক্রমণ পরিচালনায় ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করে। ৩/৪ দিনের মধ্যেই সীমান্তবর্তী পাকবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানগুলোর পতন ঘটতে শুরু করে।
২৪ দিন স্থায়ী এই অপারেশনে মুক্তিবাহিনীর হতাহতের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৫ জন। ডেল্টা কোম্পানির ৪ জন সৈনিক শাহাদৎবরণ করেন। গুরুতর আহতের মধ্যে ছিলেন ব্যাটেলিয়ন অধিনায়ক মেজর শাফায়াত জামিল, ব্রাভো কোম্পানি থেকে আগত প্লাটুন কমান্ডার সুবেদার হাবিব এবং ল্যান্স নায়ক মুজিবসহ আরো কয়েকজন। মিশুলতলা গ্রামে নিজ বাঙ্কারে অনড় থেকে শক্রর আক্রমণ প্ৰতিহত করতে গিয়ে সুবাদার হাবিবের (ইপিআর) দুটি পা-ই শক্রর গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে অচল হয়ে গিয়েছিল। গুরুতর আহত সুবেদার হাবিবকে শিমুলতলার গ্রামবাসী গভীর রাতে কাশবনের আড়ালে ডেল্টা কোম্পানির দুয়ারিখেল গ্রামের অবস্থান নিয়ে এলে তাকে চিকিৎসার জন্য ডাউকি বিএসএফ ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মেজর শাফায়াত জামিলকেও প্ৰাথমিক চিকিৎসার পর ডাউকি বিএসএফ ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তী সময় সুবেদার হাবিবকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়েছিল। আর মেজর শাফায়াত জামিলকে ভূষিত করা হয় বীর বীক্রম খেতাবে। যদিও বীর উত্তম খেতাবই ছিল তার নিম্নতম প্ৰাপ্য। শত্রুপক্ষের হতাহতের সংখ্যা ছিল অগণিত। স্থানীয় জনগণ এলাকার কাশবন থেকে শত্রুর অনেকগুলো লাশ একত্র করে দাফনের ব্যবস্থা করেছিল। রাধানগর অপারেশনটি পরিচালনা করে ৩য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকবৃন্দ এবং স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা (এফএফ) প্রমাণ করেছে যে, তারা পৃথিবীখ্যাত দুর্ধর্ষ গুর্খাদের চেয়েও সাহসী যোদ্ধা। অকৃত্রিম দেশপ্রেম এবং দেশের আপামর জনতাকে শত্রুমুক্ত করার দৃঢ় সঙ্কল্পই মুক্তিযোদ্ধাদের গুর্খাদের চেয়েও বেশি সাহসী যোদ্ধায় রূপান্তরিত করেছিল। পৃথিবীখ্যাত গুর্খাদের দিয়ে যা সম্ভব হয়নি লুঙ্গিপরা বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা তা সম্ভব করেছে। আমাদের মহান স্বাধীনতার জন্য গুর্খারাও অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন। আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা মিত্রবাহিনীর এসকল বীর সৈনিকদের কাছে ঋণী হয়ে আছে।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!