You dont have javascript enabled! Please enable it!

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও জুনিয়র টাইগার
নুরুদ্দীন মাহমুদ কামাল

এক.
কীভাবে এ লেখাটা শুরু করবো মনস্থির করতে পারছিলাম না। বারদুয়েক মুসাবিদ করে মূল প্রবন্ধের সঙ্গে জুনিয়র টাইগারের সম্পৃক্ততা নিয়ে লিখতে বসেছি। কিন্তু এ জুনিয়র টাইগার কে বা কারা বা কীভাবে জুনিয়র টাইগার নামের প্রচলন হলো এবং সে নামই ১৯৭১ পর্যন্ত বহাল থাকলো তা হয়তো অনেকের জানা নেই বা স্পষ্ট নয়।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সমাপ্তি হয় ১৯৪৫ সালে। দুবছর পর ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হয়। স্বাধীন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল আবারো শৃঙ্খলাযুক্ত হলো পাকিস্তানের বেসামরিক ও সামরিক নেতৃত্বের কাছে। সামরিক নীতি নির্ধারকদের পরামর্শে পাকিস্তানে গঠিত হতে থাকে বিভিন্ন বাহিনী। এ ধরণের একটি আনুষ্ঠানিক সামরিক অঙ্গ ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৪ ডিভিশন, যার অবস্থান ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজ ও অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষাই ছিল এ ডিভিশনের প্রধান দায়িত্ব। ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত মাত্র দুটি বিগ্রেড সংবলিত। স্বল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে ৫৩ বিগ্রেডের অবস্থান ছিল কুমিল্লার ময়নামতি এবং ১০৭ ব্রিগেড ছিল যশোরে। বিমান বাহিনীতে ছিল মাত্র একটি স্কোয়াড্রন-ঢাকায়। ঢাকায় ২৩ ব্রিগেড মাত্র দুটি ব্যাটেলিয়নের সমন্বয়ে গঠিত হয় ১৯৬৪ সালে। তবে ১৯৪৮ সাল থেকেই বেঙ্গল রেজিমেন্টের সূত্রপাত ঘটে। এরাই টাইগার নামে অধিক পরিচিত ছিল। ১৮৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান ১৭ দিনের যুদ্ধের পর পাঞ্জাব, পাঠান, ফ্রন্টিয়ার ফোর্স এবং বেলুচ রেজিমেন্টের প্রত্যেকটিতে ৪০টির অধিক ব্যাটেলিয়ান হলেও বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যাটেলিয়ান সংখ্যা অনেকদিন যাবত ছিল মাত্র ৬টি। ১৯৬৯-৭০ সালে টাইগারদের ৭ম ও ৮ম ব্যাটেলিয়ান সৃষ্টি করা হলেও এদের প্রশিক্ষণ ও গঠন পদ্ধতি ছিল ক্রুটিজনক। ১৯৭০ সালের শেষ দিকে চট্টগ্রাম অবস্থানরত ৮ম ব্যাটেলিয়ান পশ্চিম পাকিস্তানের স্থানান্তরিত হতে থাকে। সবচেয়ে মজার কথা হলো, ১৯৪৯ সালে ২য় ইস্ট বেঙ্গল প্রতিষ্ঠিত হলেও এটি একটানা ২২ বছর ‘জুনিয়র টাইগার’ নামে অভিহিত হতে থাকে। ১৯৭১ সালে এ শার্দুলদের সঙ্গে একাত্মতার সুযোগ পেয়ে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি। কিন্তু দুঃখ লাগে আজকাল আর এ ব্যাটেলিয়ন রেইজিং ডে’তে আমন্ত্রণ পাই না-সম্ভবত আমার সম্পৃক্ততা বেসামরিক কর্মকর্তা (সিভিলয়ন স্টাফ অফিসার কোয়ান্টার মাস্টার) ছিল বিধায়।

দুই.
ঢাকা থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে শত বছরের পুরনো জয়দেবপুর রাজবাড়িতে জুনিয়ার টাইগার তথা ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের প্রবেশপথে প্রহরীর মতো অবস্থান করছিল। ১৯৭১ সালে ভারতীয় আক্রমণের ধুয়া তুলে দেশের উত্তর-পূর্ব এলাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি এ রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানিকে ময়মনসিংহ এবং টাঙ্গাইলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও ভারতীয় আক্রমণ প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে ব্যুহ থেকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ৫৭ ব্রিগেডের কমান্ডার বিগ্রেডিয়ার জাহাজের আবাবের নির্দেশে এ দুটি কোম্পানি সম্মুখভাগ অর্থাৎ জামালপুর ও হালুয়াঘাট অঞ্চলে সৈন্য পরিচালনা করে পেছনে তথ্য পাঠাবে এবং আক্রমণ প্রতিহত করবে। এ ছিল আপাতদৃষ্টিতে জুনিয়র টাইগারের একাংশের দায়িত্ব। কিন্তু রেজিমেন্টের বাঙালি কর্মকর্তারা বুঝতে পেরেছিলেন। ঐ সৈন্য মোতায়েন ছিল একটি সামরিক ধোঁকাবাজি। আসলে, বাঙালি সৈন্যদের ঢাকা থেকে আপাতত দূরে সরিয়ে রাখা মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের কাছে প্রয়োজনীয় মনে হয়েছিল। রাখে আল্লাহ মারে কে? ২৫ মার্চ ১৯৭১-এর কালরাতে পাকিস্তানি নরপশু সেনাবাহিনীর গণহত্যা শুরুর পর ব্রিগেড কমান্ডারদের সিদ্ধান্ত বাঙালি সৈন্যদের জন্য শাপে বর হয়েছিল। ফেব্রুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশে অবস্থানরত সকল অবাঙালি ব্রিগেড কমান্ডার নিয়ে ঢাকা সেনাসদর দপ্তরে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সে সম্মেলনে চারটি বেঙ্গল রেজিমেন্টকেই বিভিন্ন অজুহাতে বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করা অথবা মাঠ পর্যায়ের প্রশিক্ষণ/অনুশীলনের জন্য বিশেষভাবে চিহ্নিত এলাকাসমূহে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। ১ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুই বাঙালি কমান্ডার যথাক্রমে লে.কর্নেল জলিল ও লে.কর্নেল মাসুদের হয় কাপুরুষতা না হয় সিদ্ধান্ত হীনতায় সৈন্যদের জন্য দুর্ভোগ নেমে আসে। ২য় ইস্ট বেঙ্গলের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মেজর সফিউল্লাহও ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের মেজর খালেদ মোশাররফ এবং ৮ম ইস্ট বেঙ্গলের মেজর জিয়া মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে চলে আসেন। এদের নামের আদি অক্ষর যথাক্রমে এস-ফোর্স (সফিউল্লাহ), কে-ফোর্স (খালেদ মোশাররফ) ও জেড-ফোর্স (জিয়াউর রহমান) নামকরণে জুলাই মাসের দিকে তিনটি ব্রিগেড সৃষ্টি করা হয়। এস-ফোর্সের তত্ত্বাবধানে তিন নম্বর সেক্টর, কে-ফোর্সের দুই নম্বর সেক্টর ও জেড-ফোর্সের এক নম্বর সেক্টর বাংলাদেশ ফোর্সেসের পূর্বাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হতো। এর প্রধান কারণ ছিল সেক্টর সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনায় নেতৃত্বে ছিল ‘ফ্রিডম ফাইটার’ বা এফ-এফ। এরা অনেক ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর সদস্য বা এম এফ ক্যাটাগরির ছিলেন না। সাধারণ সেনারা ছিলেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছাত্র-যুবক, শ্রমিক কৃষক। ইতিহাস সৃষ্টিকারী নিতান্ত সাধারণ মানুষ যাদের ভূমিকা চিরকাল হাল ধরে থাকা, চিরকাল দাঁড় টানা আর চিরকাল কুলি মজুরের কাজ করা-স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিক ইতিহাসে প্রতিফলিত হয়েছে কী না বিচার ও বিশ্লেষণের প্রবৃত্তি ও সময় কি কখনো হয়েছে? যদি না হয়ে থাকে। তবে মুক্তিযুদ্ধের এ ইতিহাস প্রহসন হয়ে গোটা বাঙালি জাতির বিবেক দংশন করতে থাকবে বছরের পর বছর। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ও ভূখণ্ডের মানুষ এর আগে কখনো এতো ব্যাপকভাবে সশস্ত্র পদ্ধতিতে শাসক ও শোষক শ্রেণীর মুখোমুখি হয়নি।

তিন.
যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম ফিরে আসি সেখানে। ডিসেম্বর মাস, বিজয়ের মাস। মনে পড়লো মুক্তিযুদ্ধের হিরন্ময় দিনগুলির কথা। সেদিন আমি মুক্তিযুদ্ধের একজন সশস্ত্র সৈনিক। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলার অদূরে হেজামারার টিলায় ঘেরা এক দুৰ্গম এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের তিন নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তরে অবস্থানরত। একটি টিলায় মোট তিনটি তাঁবু ও একটি লম্বা বেড়ার ঘর। বেড়ার ঘরে বাঁশের মাচায় আমরা পাঁচজন অফিসার রাতের বেলায় ঘুমাই। প্রত্যেকটি মাচার সামনে একটি বাঁশ পোতা যেখানে আমাদের পরিধেয় লুঙ্গি, প্যান্ট ও গামছা বুলিয়ে রাখা হতো। আমরা ছিলাম ভাগ্যবান। তাই আমাদের পোশাক ছিল সাধারণ সৈন্যদের চেয়ে একটি বেশি-অর্থাৎ খাকি রঙের ট্রাউজারটি। প্ৰত্যেক মাচায় হয় মাথার কাছে অথবা পাশে যার যার অন্ত্র। আমার জন্য বরাদ ছিল চাইনিজ সাব মেশিনগানটি (এসএমজি), যার প্রত্যেক ম্যাগাজিনে ২৮ রাউন্ড গুলি ও কোমরে বেল্টের সঙ্গে আরো প্ৰায় ৪০টি। নির্ধারিত প্ৰশিক্ষণ কেন্দ্ৰে যাওয়ার আগেই এই অন্ত্র ব্যবহার, খোলা ও বন্ধ করা এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার নিয়মাবলী শিখেছিলাম কোম্পানি কমান্ডার ক্যাপ্টেন এএসএম নাসিমের কাছে। জুন মাস থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সেক্টর সদর দপ্তরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার হচ্ছে অপারেশন প্লান ও সেগুলোর বাস্তবায়ন অনেক সুষ্ঠা হয়ে উঠেছে। কিছু এলাকা আমরা মুক্ত করছি আবার তা পাকিস্তানিরা পুনর্দখল করে নিচ্ছে। হতাহতের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। প্রথাগত সম্মুখ সমরে আমাদের অভিজ্ঞতা বাড়ছে-হিট এন্ড রান পদ্ধতিতে গেরিলা অপারেশন প্ৰায় প্রতি সপ্তাহেই চলছে। তবে ২-৩ সেপ্টেম্বর সিলেটের ধর্মগড় বিওপি আক্রমণ আমার জীবনের প্রথম আনুষ্ঠানিক সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণের অনন্য অভিজ্ঞতা। এ এলাকাটি ছিল পাকিস্তান বাহিনীর একটি সুরক্ষিত ঘাঁটি-যা একটি নিয়মিত প্লাটুন ও এক কোম্পানি প্রশিক্ষিত রাজাকার পরিবেষ্টিত। এ অভিযান পরিচালনায় মাঠ পর্যায়ে নেতৃত্বে ছিলেন মুক্তিবাহিনী তথা এস-ফোর্সের পাঁচজন অফিসার যথাক্রমে ক্যাপ্টেন নাসিম, ক্যাপ্টেন মতিন, ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভুইয়া লে. মোরশেদ ও লে. বদিউজ্জামান। সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন ব্রিগেড কমান্ডার লে. কর্নেল সফিউল্লাহ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্যাপ্টেন ভুইয়ার অবিবেকোচিত ও হতাশাগ্ৰস্ত কর্মকাণ্ডের ফলে আক্রমণটি সফল হয়নি। সৈন্যদের মনোবল ভেঙে যায়। শেষ পর্যায়ে হামলা-অভিযান ব্যর্থ হলে তা প্ৰত্যাহার করা হয়।

চার.
বাঙালি জাতির ত্যাগ, আত্মহুতি আর স্বজন হারানোর করুণ কাহিনীর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের সফলতা ও অসফলতা এক অনন্য ইতিহাস। একাত্তরের ৯ মাসে নিরীহ ও নিরন্ত্র জনগণের ওপর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি সামরিকজান্তা। ২৫ মার্চ থেকেই শুরু হয় এক অসম রক্তক্ষয়ী সশস্ত্ৰ যুদ্ধ। পক্ষান্তরে, প্রথম মুখোমুখি সংঘাত হয় জুনিয়ার টাইগারের ঘাঁটি জয়দেবপুর থেকেই। তা ছিল ১৯ মার্চ। ৫৭ ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জাহাজের আরবাব একদল সুসজ্জিত (৭০ জন সৈন্যের প্ৰত্যেকেই চাইনিজ এল.এম.জি হাতে) সেনাদল নিয়ে জয়দেবপুর এসেছিলেন এক ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। কিন্তু সেটা জানাজানি হয়ে গেলে এলাকার সাধারণ মানুষ অনেকটা ঝাঁপিয়ে পড়ে পাক ফৌজের ওপর। বেশ কয়েকজন হতাহত হন। তারপর অনেকটা বাধ্য হয়ে ব্রিগেডিয়ার আরবাব মনোন্মুন্ন হয়ে ফিরে যান ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। এ ঘটনা ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জন্য যথেষ্ট ইঙ্গিতবহ ছিল। তাই মেজর সফিউল্লাহর নেতৃত্বে ইউনিটের অবিশষ্ট জনবল, গাড়ি, সমরাস্ত্রসহ সৈন্যরা জয়দেবপুর রাজবাড়ি পরিত্যাগ করে টাঙ্গাইলের পথে রওনা হতে পেরেছিল ২৮ মার্চ। পরদিন পাকিস্তানিরা পূর্ণ ক্ষমতায় রেজিমেন্টের সদর দপ্তর (জয়দেবপুর-রাজবাড়ি) আক্রমণ করে বিশ্বাসঘাতক বাঙালি অধিনায়ক লে. কর্নেল রকিবকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে। তারপর রেজিমেন্টের অবশিষ্ট সেনাসদস্য সাধারণ মানুষদের নিয়ে রুখে দাঁড়ায়।

পাঁচ.
জুনিয়ার টাইগারদের তত্ত্বাবধানে গঠন তিন নম্বর সেক্টরের যুদ্ধক্ষেত্র ছিল বিস্তৃত সিলেট-ব্ৰাহ্মণবাড়িয়া-কিশোরগঞ্জসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহ-ঢাকা শহর ব্যতীত নরসিংদী, শিবপুর, রায়পুরা ইত্যাদি এলাকা। সিলেট ও কুমিল্লার মধ্যবতীর্ণ ব্ৰাহ্মণবাড়িয়া ছিল পাকিস্তানিদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। তাই তারা জীবনমরণ চেষ্টা করেছিল। সেক্টরের রক্ষাবৃহ ভেঙে ফেলতে। যুদ্ধে বাঙালি সৈনিক ও সাধারণ মানুষ দৃষ্টান্তমূলক সাহস ও দৃঢ়তার পরিচয় দেয়। তারপর যুদ্ধের চরিত্রে আস্তে আস্তে পরিবর্তন আসতে থাকে। নানা সীমাবদ্ধতার জন্য প্রচলিত যুদ্ধ প্রথম পর্যায়ে সীমিত থাকে। কৌশলগত দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে স্বাভাবিকভাবে অপ্রচলিত রণনীতির দিকে কুঁকে পড়ে সেক্টর নেতৃত্ব যা ‘গেরিলা যুদ্ধ’ নামে অভিহিত হয়। ইতোমধ্যে প্রশিক্ষণ কেন্দ্ৰ স্থাপিত হয় বেশ কয়েকটি। সে সময়ে যুদ্ধ নিয়োজিত সেনাবাহিনী থেকে আগত সৈনিকদের নিয়ে নিয়মিত বাহিনী (বা মুক্তিফৌজ/এম এফ) এবং অনিয়মিত সেনাদের দ্বারা গণবাহিনী গঠিত হতে থাকে। এর পেছনে ভারতীয় সেনানীতি নির্ধারকদের নিজস্ব চিন্তাভাবনা ছিল, যা অনেকের কাছে ভিন্ন অর্থ বহন করতো সে সময়ে।

ছয়.
১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ২য় ইস্ট বেঙ্গল-জুনিয়র টাইগার নামে পরিচিত একটা পদাতিক ব্যাটেলিয়ন-১৯৭১ সালের শুরুতে ঢাকার অদুরবর্তী ঐতিহাসিক জয়দেবপুর রাজবাড়িতে অবস্থানরত। প্ৰায় ২১ বছর নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এর কমান্ড স্ট্রাকচার পরিবর্তিত হচ্ছিল। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসেই ৩ জন কমান্ডিং অফিসার (সিও)-এর পরিবর্তন এ ইউনিটটির জন্য অভূতপূর্ব ঘটনা। ১৯ মার্চ একাত্তর সালে ব্রিগেডিয়ার জাহানজের আরবাবের নেতৃত্বে পরিচালিত অতর্কিত আক্রমণ ও জয়দেবপুরে স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে গুলিবিনিময়ের ঘটনা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সূচনা। কয়েকজন এলাকাবাসী হতাহতের পর পরিস্থিতি যখন ভিন্ন দিকে মোড় নিচ্ছিল তখন সুসজ্জিত ৭০ জন সৈন্যসহ ব্রিগেডিয়ার সাহেব পলায়ন করলেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের দিকে। এ অভাবনীয় ঘটনায় পাকিস্তানিরা হতভম্ব ও বাঙালিরা আনন্দিত। সামান্য কয়েকটি দোনালা বন্দুক আর দা-সড়কি নিয়ে হাজার হাজার সাধারণ মানুষ যে সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিল তাতে বাহাদুর পাকিস্তানি সেনারা নিশ্চয়ই ভীত হয়ে শেষপর্যন্ত পশ্চাদপসরণ করেছিল। সে সময়ে ইউনিটের কমান্ডার ছিলেন লে. কর্নেল মাসুদ-এক অসহায় ও সন্ত্রস্ত সেনা। ব্রিগেডিয়ার আরবার তাকে প্ৰত্যাহার করলেন ইউনিট থেকে। ৫ দিন পর নতুন চমক। চট্টগ্রামস্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার (ইবিআরসি) এর কমান্ডিং অফিসার বাঙালি ব্রিগেডিয়ার মজুমদার এলেন জয়দেবপুরে-সঙ্গে পুরাদস্তুর পাকিস্তানি মনোভাবাপন্ন বাঙালি লে. কর্নেল রকিব, যিনি এ ইউনিটের নতুন সিও। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার কাজ শেষে সেদিনই ঢাকায় ফিরে গেলেন। কিন্তু কর্নেল রকিব পড়লেন বিপাকে। তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল সে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় শূন্য। শুধু জন্মসূত্রে কয়েকজন পাকিস্তানি অফিসার ও সেপাইদের মুখে হাসি ফুটলো তাকে পেয়ে। কিন্তু রকিব সাহেবকে অন্য সকলেই সন্দেহের চোখে দেখতে লাগলো। ভদ্রলোক জয়দেবপুর আগমনের পর বাঙালি অফিসার ও সেপাইরা শুধু আকার-ইঙ্গিতে যোগাযোগ রেখেছে একে অন্যের সঙ্গে।

সাত.
বলা বাহুল্য শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক নাটকীয় পরিবর্তন ঘটায়। ছাত্র-জনতা সেদিন স্বাধীনতা বিষয়ে প্রচণ্ড স্পর্শকাতার হয়ে উঠেছিল। মজার কথা হলো, ঐ লাখ লাখ মানুষের সভায় একটি পুলিশও সেদিন কেউ দেখেনি-সামরিক বাহিনীর সদস্য দূরে থাক। সম্ভবত ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে জেনারেল টিক্কা খান অস্থিরভাবে পায়চারী করছিলেন আর ভাবছিলেন, কখন এতোগুলো বাঙালি শিকারের ওপর বোমা ফেলবেন। ৩১ বছর আগে ৩০ বছর বয়সের তরুণের দেখা পূর্ব বাংলার উত্তাল অগ্নিঝরা দিনগুলোর কথা মনে হলে আজও অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি। বন্ধু প্রকৌশলী মাশরুরুল হক (কমল) ও আণবিক শক্তি কেন্দ্রের বিজ্ঞানী ড. মোজাম্মেল হোসেনসহ আমরা ৩ জন রেসকোর্সের বক্তৃতা মঞ্চ থেকে একটু দূরে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের প্রায় দেয়াল ঘেঁষে বসেছিলাম। কমলের পরামর্শ ছিল ‘রিট্রিটের’ রাস্তা দেখেশুনে বসা উচিত হবে। সেদিন তার কথার মর্মাৰ্থ বুঝিনি। বেশ কয়েক সপ্তাহ পরই সিলেটের তেলিয়াপাড়া চা-বাগান এলাকায় গেরিলা অপারেশনে ‘ট্যাকটিক্যাল রিট্রিট’ সম্পর্কে ব্রিফিঙের বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিলাম। ততোদিনে কমল পুরাদস্তর মুক্তিযোদ্ধা। আফসোস একাত্তরের ডিসেম্বর মাসেই এক মিলিটারি অপারেশনে কমলের চোখ উড়ে গেল। তাকে ভারতের এক হাসপাতালে নেওয়া হলো চিকিৎসার জন্য।

আট.
মনে পড়ে ৩ নম্বর সেক্টরের প্রথম প্রস্তুতিমুলক যুদ্ধ হয়েছিল ১৫ এপ্রিল। পাকিস্তানের আক্রমণ শুরু হয় একযোগে আশুগঞ্জ-ভৈরব এলাকায়। প্ৰচণ্ড গোলাবর্ষণে বাঙালি সৈন্যরা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছিল না। এমন সময় পাকিস্তান বিমান বাহিনীর কয়েকটি জেট বিমান মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর উপর্যুপরি হামলা শুরু করে। ফলে মুক্তিসেনারা বিশৃঙ্খলা অবস্থায় পড়েন। শেষপর্যন্ত ভৈরব আর ধরে রাখা গেল না। মেঘনা নদীর বুকে মুক্তিযুদ্ধের ৩ নম্বর সেক্টরের প্রথম প্রস্তুতিমূলক যুদ্ধ। এর মাধ্যমে পাকিস্তান বাহিনীর অন্ত্র ক্ষমতার একটি পরিমাপ হয় মুক্তিযোদ্ধাদের। গতিশীলতা এবং আধুনিক যুদ্ধান্ত্রের অভাবে এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মনে কিছুটা ভয়ও ধরে। তারপর আসে মাধবপুর প্রতিরোধ যুদ্ধ, ২৮ এপ্রিল। এ যুদ্ধে বাঙালি সৈনিকরা দৃষ্টান্তমূলক সাহস ও দৃঢ়তার পরিচয় দেয়। তারপর যুদ্ধের চরিত্রে আস্তে আস্তে নতুনত্ব ছাড়াও পরিবর্তন আসতে থাকে। নানা সীমাবদ্ধতার জন্য প্রচলিত যুদ্ধ পরিচালনা সীমিত হয়ে আসে। কৌশলগত দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে স্বাভাবিক কারণেই অপ্রচলিত (গেরিলা) রণনীতির দিকে ঝুকে পড়ে সেক্টর নেতৃত্ব। তেলিয়াপাড়া ও মনতলা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় প্রচলিত যুদ্ধ সংঘটিত হলেও সিলেট জেলার চুনারুঘাট, হবিগঞ্জ ও বানিয়াচং, ব্ৰাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর ও সরাইল; কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর, বাজিতপুর ও কটিয়াদী; ঢাকা জেলার রায়পুরা, শিবপুর এবং ময়মনসিংহের গফরগাঁও ও ভালুকায় চলতে থাকে গেরিলা যুদ্ধ। এ সকল এলাকা ৩ নম্বর সেক্টরের আওতাধীন ছিল। মনতলা ছিল সেক্টরের শেষ রক্ষাকবচ। তেলিয়াপাড়ায় মুক্তিযুদ্ধের দুকোম্পানি সৈন্য মারাত্মকভাবে বিপর্যন্ত হওয়ার পর অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে সেক্টরের সৈন্যদের বাংলাদেশে পা রাখার জায়গা শেষ হয়ে যাবে।

নয়.
মে মাসের ২২ তারিখে আমি ঢাকায় আসি-বাবা, মা, ছোটভাই ও বোন এবং ভাই বিমান বাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সুলতান মাহমুদের স্ত্রীকে আগরতলা নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। এবার কুমিল্লা হয়ে ঢাকা আসার অভিজ্ঞতা ছিল ভিন্নতর। তারপর ঢাকা পৌঁছে শহরে চলাফেরা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা ধরণের। আসার সময়ে ক্যাপ্টেন নাজিম, ক্যাপ্টেন ভুইয়া ও সেলিম-আনিস নামে দুভাইয়ের চিঠি নিয়ে এসেছিলাম। সেলিম-আনিসের দুলাইন চিঠিতে লেখা ছিল ‘মা আমরা ভালো আছি-দোয়া করো।’ তাদের মা থাকতেন তেজতুরি বাজার এলাকায়। আজও চিঠির লাইন দুটি জ্বলজ্বল করে আমার চোখে। সে দুভাই দুর্দান্ত সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে এবং স্বাধীনতা উত্তর জানুয়ারি ১৯৭২ সালে মীরপুর এলাকায় সশস্ত্ৰ বিহারিদের বন্দি করতে গিয়ে শহীদ হয় এক ভাই সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট সেলিম। যুদ্ধকালীন দুভাই কমিশনড প্রাপ্ত হয়েছিলেন। আনিস এখন বিখ্যাত ডাক্তার।

দশ.
মনতলার কথায় ফিরে যাই। এদিকে ১৫ জুনের পর পাকিস্তানিদের রণকৌশলেও পরিবর্তন দেখা দেয়। ২১ জুন সকালে শত্রুবাহিনী মনতলা ব্যুহে বেপরোয়া আক্রমণ শুরু করে। শেষপর্যন্ত হরষপুর-মুকুন্দপুর একটি ক্ষুদ্র এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। এ যুদ্ধে গণবাহিনীর অভিজ্ঞ মুক্তিযোদ্ধা দৌলা মিয়ার সাহসিকতার কথা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে লেখা না হলেও আমাদের স্মৃতিতে অমলিন রয়েছে। কুমিল্লা জেলার শালদানদী এলাকার বাসিন্দা নিবেদিতপ্ৰাণ বেপরোয়া মুক্তিযোদ্ধার কাছে জন্মভূমির স্বাধীনতাই ছিল একমাত্র বিবেচ্য বিষয়। লে. মোরশেদের একটি লাইট মেশিনগান এ অপারেশনের সাফল্য ত্বরান্বিত করে। মুক্তিযুদ্ধে এ সাহসী মুক্তিযোদ্ধা দুদুবার সম্মুখ সমরে আহত হন-সুস্থ হয়ে আবার যুদ্ধে চলে আসেন।
এলএমজি ব্যবহার করে দুঃসাহসী গেরিলা দৌলা মিয়া যুদ্ধে মারাত্মক আহত এবং ঘেরাও হয়েও যুদ্ধ চালিয়ে যান। তার তলপেট ভেসে যাচ্ছে রক্তে। এদিকে তার একটানা এলএমজি ব্যবহার শক্ৰদের মনে ভয় ধরিয়ে দেয়। তারা পিছু হটে যায়। এভাবে পাল্টা আক্রমণে সফলতা আসে। কিন্তু তারও আগে সেদিন সকালে কী ঘটেছিল তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা না দিলে বিষয়টি উপলব্ধি করা যাবে না।
পাকিস্তান বাহিনী মনতলা ব্যুহে বেপরোয়া আক্রমণ চালায়। শক্রপক্ষের ৪ জন সৈনিকের বিপরীতে মুক্তিযোদ্ধাদের মাত্র একজন। তারা তিন দিক থেকে আক্রমণ করে। তার ওপর রয়েছে (শত্রুপক্ষের) গোলন্দাজ বাহিনীর নির্ভুল গোলাবর্ষণ। ক্যাপ্টেন নাসিমের অবস্থানে পরিখার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়া দুটি শক্রদল আক্রমণ চালায়। ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভূঁইয়াও আক্রান্ত। লে. মোরশেদের অবস্থানে আক্রমণ চালায় দক্ষিণ-পশ্চিমের মুকুন্দপুর এলাকা থেকে। তারপর মোরশেদকে প্রায় ঘিরে ফেলে হেলিকপ্টার থেকে নামানো কমান্ডোরা। ওদিকে ক্যাপ্টেন নাসিম আরো সৈন্য চান-এগুতে পারছেন না। সেক্টর কমান্ডার সফিউল্লাহর নির্দেশে এ ভয়াবহ সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে নাসিম, মতিন ও মোরশেদ মরিয়া হয়ে ওঠেন। বেপরোয়া পাল্টা আক্রমণ ফলপ্রসূ হয়-মোরশেদ উদ্ধার হন। হারিয়ে যাওয়া কিছু এলাকা পুনর্দখল করা সম্ভব হয়। এখানেই দৌলা মিয়ার প্রচণ্ড সাহসিকতার প্রমাণ মেলে। গুলির আঘাতে তার নাড়িতুড়ি বেরিয়ে আসতে থাকে। তবুও এলএমজি হাতে নিয়ে যুদ্ধ করেছেন তিনি। তাকে এ অবস্থান থেকে সরিয়ে আনেন মুক্তিযোদ্ধা সাদেক (পরবতী সময় কমিশনড অফিসার) ও আনিস (পরবতী সময় কমিশনড অফিসার)। ৪ মাস হাসপাতালে থেকে দৌলা মিয়া কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠেন। আবারো যুদ্ধ যেতে চান। সেক্টর কমান্ডার মেজর সফিউল্লাহ অনেকটা জোর করেই তাকে সদর দপ্তরে রেখে দেন। মুক্তিযুদ্ধের এ ঘটনা অনেককেই উদ্দীপ্ত করে। এ রকম দৌলা মিয়াদের সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের জন্যই দেশ স্বাধীন হয়। বেঙ্গল টাইগারের মূল বাঙালি অফিসারদের মধ্যে ছিলেন সেক্টর কমান্ডার মেজর সফিউল্লাহ, মেজর মুইন, ক্যাপ্টেন নাসিম, ক্যাপ্টেন মতিন, ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান, ক্যাপ্টেন আজিজ, ক্যাপ্টেন এজাজ, লে. মোরশেদ ও লে. ইব্রাহিম। এরা সকলেই সফল মুক্তিযোদ্ধা। জুলাই মাসের পর এস-ফোর্স-এর কমান্ডার কর্নেল সফিউল্লাহর নেতৃত্বে এরা প্রত্যেকে এক একজন ফিডেল ক্যাস্ট্রো আর চেগুয়েভারার মতো স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। অন্যদিকে আমরা মেজর নুরুজ্জামানের নেতৃত্বে (হেজামারার টিলায়) সেক্টর ট্রপস হিসেবে পুনগঠিত হই। দেশ স্বাধীন হওয়া অবধি ৩ নম্বর সেক্টরে কর্মরত ছিলামএমনকি ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত।

এগারো.
আফসোস নয় মাসে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। অনেকের বিকলাঙ্গ চরিত্র পর্দার আড়ালেই থেকে গেল। মুক্তিযুদ্ধের কোনো কোনো হিরো ভিলেন হয়ে গেলেন-আর কিছু ভিলেন হয়ে গেলেন হিরো। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পুলিশের কর্মকর্তা তসলিম, রহিম ও সফদর নয় মাস পাকিস্তানিদের পদলেহনের পরও ক্ষমতায় বসলেন। তসলিম হলেন পুলিশের আইজি, রহিম হলেন গোয়েন্দা প্ৰধান ও পরে এস্টাবলিস্টমেন্ট সেক্রেটারি, সফদর হলেন বেসামরিক গোয়েন্দা প্ৰধান। শেষোক্ত দুজন ১৯৭১-এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গুপ্তচর সংক্রান্ত প্রশিক্ষণও পেয়েছিলেন। এরাই সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত হয়েছিলেন। কেন এবং কীভাবে? আরো আশ্চর্য ঘটনা-তসলিম মুক্তিযুদ্ধের সনদপত্র স্বাক্ষর করেছিলেন। আজ জেনারেল ওসমানী ও সেক্টর কমান্ডারের যৌথ স্বাক্ষরে প্রণীত মুক্তিযুদ্ধের সনদপত্ৰই নাকি বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে।

বারো.
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে জুনিয়ার টাইগার কর্নেল সফিউল্লাহ ও তার অগ্রগামী দল, মুক্তিযুদ্ধের দুনম্বর সেক্টরের গেরিলা কমান্ডার মেজর হায়দার ও টাঙ্গাইলের কাদের বাহিনীর সাহসী কমান্ডার কাদের সিদ্দিকী ঢাকায় পৌছেন। আগরতলা থেকে হেলিকপ্টারে আসেন বাংলাদেশ ফের্সেস সদর দপ্তরের ডিপুটি চিফ অফ স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার। কিন্তু এরা কেউই ঢাকার রেসকোর্সে অনুষ্ঠিত যৌথ বাহিনীর সদস্য হিসেবে পাকিস্তানি নিয়াজি বাহিনীর আত্মসমৰ্পণ দলিলে স্বাক্ষরের সুযোগ পাননি। সেদিন কর্নেল ওসমানী সাহেবের রহস্যময় নিরুদেশ স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণকে এতোটা হতবাক করেছিল যে এতো বছর পরও এ বিষয়ে কেউ মুখ খুলছেন না।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!