মৌলিক গণতন্ত্র ১৯৫৯
১৯৫৯ সালের ২৫ অক্টোবর আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্র আদেশ জারি করেন। মৌলিক গণতন্ত্রের ৫টি স্তর ছিল- ইউনিয়ন, থানা, জেলা, বিভাগ ও প্রাদেশিক কাউন্সিল।
১৯৬০ সালের ১১ জানুয়ারি উভয় অঞ্চলে মৌলিক গণতন্ত্রী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানে ৪০ হাজার ও পূর্ব পাকিস্তানে ৪০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী নির্বাচিত হয়। প্রত্যেক ইউনিয়নে ৯ জন নির্বাচিত ও ৪ জন মনােনীত সদস্য ছিল। তারা চেয়ারম্যান নির্বাচিত করত। ১৯৬০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি হ্যা ও না সূচক ভােট অনুষ্ঠিত হয়। সঙ্গত কারণে আইয়ুব খান আস্থাসূচক ভােট লাভ করেন।
১৯৬০ সালের ১৫ এপ্রিল জাকির হােসেনের স্থলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী লেঃ জেনারেল আজম খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। তিনি ১৯৬২ সালের ১১ মে পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন। তিনি পাঞ্জাবের অধিবাসী হয়েও মানব দরদী ও জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য বাঙালীদের আপনজন হতে পেরেছিলেন।
১৯৬০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর করাচীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর সাথে পাকিস্তানের সিন্ধু নদের পানি চুক্তি সম্পাদিত হয়। আইয়ুব খানের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা না থাকায় তিনি অসংখ্য কমিশন গঠন করেন।
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান আস্থা ভােট লাভ করে ১৯৬০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে শাসনতন্ত্র কমিশন গঠন করেন। ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও চট্টগ্রামের ও.আর নিজাম কমিশন সদস্য ছিলেন। কমিশন ১৯৬২ সালের মে মাসে রিপাের্ট দাখিল করে। প্রশ্নোত্তর কাল ৫০.৬ ভাগ সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে মতামত প্রকাশ করে এবং ৪৭.৪ ভাগ প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির পক্ষে ছিল। কিন্তু আইয়ুব খান তার মন্ত্রিসভা দিয়ে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয়।
সামরিক সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ৯টি মামলা দায়ের করে। হোসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী তার মামলা পরিচালনা করেন। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৯ সালের ৭ ডিসেম্বর মুক্তিলাভ করেন।
দেশব্যাপী আইয়ুব খান প্রণীত প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও সমালােচনা চলছে। এ সময় হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা। তাকে মুক্ত রেখে আইয়ুব খান শাসনতন্ত্র কার্যকর করা সম্ভব হবে না ভেবে ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি করাচী বাসভবন থেকে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে করাচী জেলে অন্তরীণ রাখে। তার বিরুদ্ধে অভিযােগ ছিল তিনি দেশদোহী ও পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে চান। হােসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর গ্রেফতারের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা ধর্মঘট ও হরতাল পালন করে। ১৯৬২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা রাস্তায় মিছিল করে- সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। সর্বপ্রথম সামরিক আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। সরকার ৬ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান, তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়াকে গ্রেফতার করে। সারা দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হরতাল চলে। সামরিক সরকার শত শত আওয়ামী লীগ নেতা, কর্মী ও ছাত্রনেতাদের গ্রেফতার করে। আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদ, কোরবান আলী, কফিলউদ্দিন চৌধুরী, ন্যাপের সৈয়দ আলতাফ হােসেন, আবদুর রব সেরনিয়াবাত, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম প্রমুখকে বন্দী করা হয়। সােহরাওয়ার্দীর গ্রেফতার ও বিচারপতি হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপাের্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলতে থাকে। সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘােষণা করে।
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান নতুন সংবিধান অনুসারে ১৯৬২ সালের ২৮ এপ্রিল জাতীয় পরিষদ ও ৬ মে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘােষণা দেন। ভােটার হন ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী। সাধারণ জনগণের ভােটের অধিকার নেই। রাজনৈতিক দলগুলাে নির্বাচন বর্জন করে। তবে অনেক রাজনীতিবিদ ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচনে প্রার্থী হন।
১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। ২৮ এপ্রিল পল্টন ময়দানে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয় এবং তাকে ঢাকা হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে দাফন করা হয়। গভর্নর আজম খান তার জানাজা ও দাফন অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
১৯৬৪ সালের ২৮ এপ্রিল ঢাকায় পরিষদের ১৬৭ এবং ৬ মে প্রাদেশিক আইনসভার ১৫৫টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আইয়ুব খান ১৯৬২ সালের ৯ মে রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশ জারি করেন এবং ৮ জুন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করেন। ১৯৬২ সালের ৮ জুন আইয়ুব খান সামরিক আইন প্রত্যাহার করেন। একই দিনে তমিজউদ্দিন স্পিকার, আবুল কাসেম ও আফজাল মিয়া ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালের ১৩ জুন আইয়ুব খান নিম্নোক্ত মন্ত্রিসভা গঠন করেন।
মােহাম্মদ আলী – সিনিয়র মন্ত্রী ও পররাই
বিচারপতি মুহাম্মদ মুনির – আইন
আবদুল কাদির – অর্থ
আবদুল মােনায়েম খান – স্বাস্থ্য, শ্রম
হাবিবুল্লাহ খান – স্বরাষ্ট্র
ওয়াহেদুজ্জামান – বাণিজ্য
জুলফিকার আলী ভুট্টো – শিল্প ও প্রাকৃতিক গ্যাস
সবুর খান – যােগাযােগ
এ কে এম ফজলুল কাদের চৌধুরী – খাদ্য ও কৃষি
আবদুল ওয়াহেদ খান – তথ্য ও বেতার
এটিএম মােস্তফা – শিক্ষা
পরে জেড এ ভুট্টো পররাষ্ট্র, মুহাম্মদ শােয়েব অর্থ, আবদুল্লাহ জহিরুদ্দিন স্বাস্থ্য ও শ্রমমন্ত্রী নিযুক্ত হন।
নয় নেতার বিবৃতি
২৪ জুন, ১৯৬২
সামরিক আইন প্রত্যাহারের পর শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদসহ অনেক নেতা ১৯৬২ সালের ১৮ জুন মুক্তি লাভ করেন। পূর্ব বাংলার জনগণ আইয়ুব খানের শাসনতন্ত্র মেনে নেয়নি। ১৯৬২ সালের ২৪ জুন পূর্ব বাংলার ৯ জন নেতা এক যৌথ বিবৃতিতে সর্বজনীন ভােটাধিকার, নির্বাচিত গণপরিষদ কর্তৃক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের আহবান জানান। নেতারা হলেন৩ :
নূরুল আমিন – মুসলিম লীগ
আতাউর রহমান খান – আওয়ামী লীগ
শেখ মুজিবুর রহমান – আওয়ামী লীগ
আর হােসেন সরকার – কেএসপি
হামিদুল হক চৌধুরী – কেএসপি
মাহমুদ আলী – ন্যাপ
সৈয়দ আজিজুল হক – কেএসপি
মৌলানা পীর মুহসেন উদ্দিন আহমেদ দুদু মিয়া – নেজামে ইসলাম
নয় নেতার বিবৃতি প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে ছাত্র ও জনগণের মধ্যে বিপুল সাড়া পড়ে যায়। নয় নেতার বিবৃতির সমর্থনে ১৯৬২ সালের ৮ জুলাই ঢাকা পল্টন ময়দানে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। আইয়ুব খান ১৯৬২ সালের ১৪ জুলাই রাজনৈতিক দল বিধি প্রণয়ন করেন।
১৯৬২ সালের ১৯ আগস্ট ৬ মাস ২০ দিন কারাবাসের পর হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী মুক্তি লাভ করেন। ১৯৬২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বিমানে তিনি ঢাকা তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। লাখ লাখ জনতা প্রাণপ্রিয় নেতা সােহরাওয়ার্দীকে সংবর্ধনা জানায়।
১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা কমিশনের রিপাের্ট বাতিলের দাবিতে ছাত্র সমাজ প্রদেশব্যাপী হরতাল পালন করে। ঢাকায় পুলিশের গুলিতে কয়েকজন ছাত্র নিহত হয়।
Reference:
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, সিরাজ উদ্দিন আহমেদ, pp 204-207
সংগ্রামের নোটবুক
www.songramernotebook.com