শেখ মজিবুর রহমান ও অলি আহাদের মধ্যে সম্পর্কের ভাঙন
অলি আহাদ ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের অন্তরঙ্গ বন্ধু। এমনকি পারিবারিক ব্যাপারে অনেক সময় শেখ মুজিবুর রহমান অলি আহাদের ওপর নির্ভর করতেন। শেখ হাসিনা ও শেখ কামালের স্কুলে ভর্তির ব্যাপারে অলি আহাদের পরামর্শ চাইতেন। ১৯৫৬ সাল হতে তাদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এর প্রধান কারণ হলাে অলি আহাদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ দখল করতে চান।
১৯৫৫ সালের আওয়ামী লীগের সংশােধিত গঠনতন্ত্রের ৬০ ধারায় উল্লেখ আছে যে আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভাপতি, সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ অন্যান্য বিভাগীয় সম্পাদক মন্ত্রীর পদ গ্রহণ করলে সংগঠনের পদ হতে পদত্যাগ করতে হবে। এ ধারা অনুসারে মন্ত্রী আতাউর রহমান খা, আবুল মনসুর আহমদ ও খয়রাত হােসেন ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বরে মন্ত্রীর পদ গ্রহণ করে সহসভাপতির পদত্যাগ করেন। একই সময় শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সম্পাদকের পদ ত্যাগ করেন।
ওয়ার্কিং কমিটির সভায় শেখ মুজিবুর রহমানের পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়নি। সংগঠনের বৃহত্তর স্বার্থে শেখ মুজিব তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। তিনি মন্ত্রিত্ব হতে পদত্যাগ করে প্রমাণ করলেন মন্ত্রিত্বের চেয়ে দল বড়। সেদিন মন্ত্রিত্ব ছেড়ে তিনি রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। অলি আহাদ আশাহত হলেন এবং আওয়ামী লীগ ছেড়ে ন্যাপে যােগ দন। অলি আহাদ তার গ্রন্থে শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে কঠোর সমালােচনা করেছেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বাড়ি নির্মাণ নিয়ে কটাক্ষ করেছেন। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের হত্যার ঘটনাকে বিপ্লবী পরিবর্তন ও খুনীদের সূর্য সন্তান বলেছেন। বঙ্গবন্ধু মহান হৃদয়ের মানুষ ছিলেন। অলি আহাদ তার গ্রন্থে সংকীর্ণতার পরিচয় দিয়েছেন। শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক বিষয়ে সাংগঠনিক সম্পাদক অলি আহাদের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। আওয়ামী লীগের এই শূন্যতা পূরণ করলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তাজউদ্দীন আহমদ দলের সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে ছিলেন। শেখ মুজিব- তাজউদ্দীন জুট আন্দোলনের প্রত্যেকটি স্তর পেরিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করে। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নিকটাত্মীয় মমিনুল হক খোকা বলেন:
“একদিন মিঞাভাই শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে বললেন, ‘চলতাে আমার সাথে একটু নারায়নগঞ্জের দিকে।’ মিঞাভাইকে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে হামিদুল হক চৌধুরীর ভাগিনা রহিম চৌধুরীর আয়রন রডের এক বিশাল কারখানার কাছে এসে পৌছাই। সেখানে দেখি এক ভদ্রলােক চেয়ারে বসে কি কাজ করছেন। তার কাছে গিয়ে শেখ মুজিব বললেন, ‘হয়েছে, নে চল গাড়িতে উঠ।’ ভদ্রলােক বললেন, ‘আমি কাজ করছি তো। আর আপনি কি করে জানলেন আমি এখানেই?’ শেখ মুজিব বললেন, ‘আর কথা বলতে হবে না, চল আমি লিলির কাছ থেকে শুনেই এসেছি।’ তারপর ওই ভদ্রলােককে নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসি। এই ভদ্রলােক আর কেউ নন, স্বাধীনতা যুদ্ধে সেই নয় মাস যিনি বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, নরপশুদের বুলেট যাকে পরে রেহাই দেয়নি, তিনি সেই সর্বজন শ্রদ্ধেয় চার জাতীয় নেতার অন্যতম তাজউদ্দীন আহমদ এবং লিলি হচ্ছেন তার তখনকার ভাবী স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীন। মিঞাভাই তাজউদ্দীনকে নিয়ে এসে অলি আহাদের স্থলাভিষিক্ত করেন। পরের ইতিহাস সবারই কম বেশি জানা। আজও একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই না- শহীদ তাজউদ্দীনের যথার্থ মূল্যায়ন কি এই স্বাধীন দেশে কখনাে হবে না?”
১৯৫৭ সালের ৩০ মার্চ সাংগঠনিক সম্পাদক অলি আহাদকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয় এবং পরে তিনি ন্যাপে যােগ দেন। তাজউদ্দীন আহমদ অলি আহাদের শুন্যতা পূরণ করে শেখ মুজিবুর রহমানের হাতকে শক্তিশালী করেন।
আওয়ামী লীগে ভাঙ্গন
কাগমারী সম্মেলনের পর আওয়ামী লীগের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে। যুগ্ম সম্পাদক অলি আহাদ পররাষ্ট্র নীতি, স্বায়ত্তশাসন ও মন্ত্রীদের দুর্নীতি নিয়ে সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে মতদ্বৈততা সৃষ্টি হয়। অলি আহাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগ বিবেচনার জন্য ১৯৫৭ সালের ৩০ মার্চ আওয়ামী লীগের সদর দপ্তর ৫৬ সিম্পসন রােডে ওয়ার্কিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন আবুল মনসুর আহমেদ। সভায় অলি আহাদ পাক- মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল এবং মন্ত্রীদের দুর্নীতির প্রশ্নে অটল থাকেন। সভায় সাংগঠনিক সম্পাদক অলি আহাদকে সম্পাদকের পদ হতে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। অলি আহাদের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের মূল্যায়ন না করে তাকে বহিষ্কার করা হলাে। ৩৭ জন সদস্যের মধ্যে সভায় ৩০ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
৩০ জনের মধ্যে ১৪ জন প্রস্তাবের পক্ষে এবং ৯ জন বিপক্ষে ভােট দেয়। ৯ জন প্রতিবাদ করে পদত্যাগ করেন।
তারা হলেন :
ইয়ার মােহাম্মদ খান এমএলএ – কোষাধ্যক্ষ
আবদুল হাই – প্রচার সম্পাদক
আবদুস সামাদ এমএলএ – শ্ৰম সম্পাদক
সেলিনা বানু এমএলএ – মহিলা সম্পাদিকা
দবির উদ্দিন আহমদ এমএলএ – সদস্য
হাবিবুর রহমান এমএলএ – সদস্য
হাতেম আলী খান এমএলএ – সদস্য
অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ- সদস্য
আকবর হােসেন এমএলএ, বগুড়া – সদস্য
১৯৫৭ সালের ২১ মে ওয়ার্কিং কমিটির সভায় পদত্যাগী ওয়ার্কিং কমিটির ৯ সদস্যের পদত্যাগপত্র গৃহতি হয় । ৩ জুন ওয়ার্কিং কমিটির সভায় নিম্নের নেতাদের কো-অপ্ট করা হয়:
জসিম উদ্দিন আহমদ – সভাপতি, সিলেট আওয়ামী লীগ
আমজাদ হােসেন – ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, পাবনা আওয়ামী লীগ
মজিবর রহমান – সভাপতি, রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগ
দেওয়ান মহিউদ্দিন আহমদ- বগুড়া
রওশন আলী – সম্পাদক, যশাের আওয়ামী লীগ
শামসুল হক – ঢাকা
আজিজ আহমদ – নােয়াখালী
মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ – পাবনা
একই সভায় নিম্নলিখিত কর্মকর্তা নিয়ােগ করা হয়:
আবদুল হামিদ চৌধুরী – সাংগঠনিক সম্পাদক
জহুর আহমদ চৌধুরী – শ্রম সম্পাদক
অধ্যাপক হাফেজ হাবিবুর রহমান – প্রচার সম্পাদক
মিসেস মেহেরুন্নেসা খাতুন – মহিলা সম্পাদিকা
Reference:
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, সিরাজ উদ্দিন আহমেদ, pp 190-193
সংগ্রামের নোটবুক
www.songramernotebook.com