স্মৃতি ভাস্বর একাত্তর
আখতারুজামান মণ্ডল
ঊনসত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে আইয়ুব খান- ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানি সামরিকজান্তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে আমরা সার্বক্ষণিক সম্পৃক্ত ছিলাম। ইতিহাসের এই শ্রেষ্ঠ গনঅভ্যুত্থান ও সংগ্রামের ফলে ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচন এবং ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ। আমরা যারা সংগ্রাম-আন্দোলনে লিপ্ত ছিলাম, তাদের মাঝে আমাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতেই হবে এই মানসিকতায় উদ্দীপ্ত ছিলাম। ৭ মার্চ ’৭১ রেসকোর্স মাঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বক্তৃতা দেয়ার পড় আমরা আর কোনো নির্দেশের অপেক্ষায় ছিলাম না। তৎকালীন কুড়িগ্রাম মহকুমার বিশেষ করে ভুরুঙ্গামারী, নাগেশ্বরী ও ফুলবাড়ী সীমান্তে ইপিআর ফাঁড়িগুলোয় বাঙালি ইপিআরদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলি। যদিও বাঙালি ইপিআররা যুদ্ধ করার মানসিকতা নিয়ে প্রস্তুত হয়েই ছিল। চিলমারী সীমান্ত ফাঁড়ি থেকে ইপিআর সদস্য আনিস মোল্লা অস্ত্রসহ (স্টেনগান) রওশনের সঙ্গে কুড়িগ্রাম এলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী আনিস মোল্লার নেতৃত্বে ভুরুঙ্গামারীর জয়মনিরহাটস্থ (শহীদ সামাদ নগর) ইপিআর কোম্পানি হেডকোয়ার্টারের অবাঙালি ইপিআর সুবেদার ও অবাঙালি ইপিআরদের (মোট ৭ জন) হত্যা করে বিভিন্ন সীমান্ত ফাঁড়ির ইপিআরদের সমন্বয়ে ২৫ মার্চ অপরাহে তিস্তায় তিস্তা পুলের পাড় ঘেঁষে আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলি এবং লালমনিরহাটসহ সমগ্র কুড়িগ্রাম মহকুমা আমাদের দখলে মুক্ত রাখতে সক্ষম হই। ভুরুঙ্গামারীতে আমাদের হেডকোয়ার্টার এবং রায়গঞ্জ, নাগেশ্বরী, কুড়িগ্রাম, টগরাইহাট, শিঙ্গেরডাবরী ও লালমনিরহাটে অস্থায়ী ঘাঁটি স্থাপিত হয়।
ভুরুঙ্গামারীতে কলেজ, হাইস্কুল এবং বঙ্গসোনাহাটে ইপিআরদের তত্ত্বাবধানে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ট্রেনিং ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২২ এপ্রিল পাকিস্তানি জান্তা কুড়িগ্রাম শহর দখল করে নেয়। আমরা ধরলা নদীর অপর পাড়ে পাটেশ্বরী বরাবর ডিফেন্স প্রতিষ্ঠা করি এবং নাগেশ্বরী, ফুলবাড়ী ও ভুরুঙ্গামারী শক্রমুক্ত রাখতে সক্ষম হই। ২৭ মে নরপশু পাকিস্তানি বাহিনী ধরলা নদী অতিক্রম করে নাগেশ্বরী ও ভুরুঙ্গামারী দখল করে। ভুরুঙ্গামারীস্থ আমাদের হেডকোয়ার্টার ভারতের কুচবিহার জেলা দিনহাটার সাহেবগঞ্জে স্থানান্তর এবং সঙ্কোষ নদীর পূর্ব পাড়ে বহালগুড়ি থেকে মাদারগঞ্জ পর্যন্ত বিশাল এলাকা শক্রমুক্ত রাখতে সক্ষম হই।
১ আগস্ট সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগ মুহূর্ত এমন সময় ইনফরমার খবর নিয়ে এলো, আজ শেষ রাতে পাকবাহিনীর কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তা নাগেশ্বরী থেকে ভুরুঙ্গামারী আসবে। আমরা সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করলাম, পাকা রাস্তা কেটে এন্টি ট্যাঙ্ক মাইন স্থাপন করে পাক বাহিনীর গাড়ি উড়িয়ে দেব। আন্ধারী ঝাড়ের উত্তরদিকে বাঁশের ঝোপের কাছে পাকা রাস্তা কেটে মাইন বসানো হবে। রাস্তার পাশের বাঁশের ঝোপ থেকে ফুলকুমার নদী প্রায় সিকি মাইল পশ্চিমে। প্রয়োজনে দ্রুত নদী অতিক্রম করে নিরাপদ ও সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান গ্ৰহণ করা সম্ভব। সুতরাং এ জায়গাকেই মাইন বসানোর উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করা হলো। রাতে সাধারণত পাক বাহিনী খুব কম যাতায়াত করে। এ সময় এসব জায়গায় কেবল রাজাকাররা টহল দিয়ে বেড়ায়। আরো জানা গেল, আন্ধারী ঝাড় থেকে জয়মনিরহাট পর্যন্ত বিস্তৃত একমাত্র এই রাস্তা দিয়ে রাজাকাররা খুব কমই টহল দেয়। রাত ১১টায় ক্যাম্প থেকে বের হওয়ার আগ মুহূর্তে অপারেশনের অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের দাঁড় করিয়ে ব্রিফ করা হলো। আমরা চারটি দলে বিভক্ত হলাম। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয়, প্রত্যেক দলে বিশজন এবং চতুর্থ দলে দশজন-মোট সত্তরজন এই অপারেশনে অংশগ্রহণ করব ঠিক হলো। প্ৰথম দল বাঁশঝোপের পাঁচশ’ গজ উত্তরে ও দ্বিতীয় দল পাঁচশ’ গজ দক্ষিণে অবস্থান গ্ৰহণ করবে। তৃতীয় দল রাস্তা কেটে মাইন স্থাপন করবে। চতুর্থ দল তৃতীয় দলের সোজা পশ্চিমে ফুলমার নদীর পাড়ে অবস্থান গ্রহণ এবং অপারেশনের সার্বিক তত্ত্বাবধান করবে। আমাদের প্রত্যেক দলের কাছে ওয়্যারলেসে সেট, প্রথম ও দ্বিতীয় প্রত্যেক দলের কাছে চারটি এলএমজি, বাকি সব অস্ত্র এসএলআর। তৃতীয় দলের কাছে শুধু মাইন আর রাস্তা কাটার কোদাল-শাবল। চতুর্থ দলের কাছে দুটি এলএমজি, এসএলআর এবং এসএমজি। রাত ১টার মধ্যে যার যার নির্ধারিত স্থানে অবস্থান গ্ৰহণ করা হলো। প্ৰায় এক ঘণ্টার মধ্যে অন্তত পনেরো হাত পাকা রাস্তা কাটা হয়ে গেল। রাস্তার পাকা স্তর চাপ চাপ করে কাটা হয়েছে। ছয়টি এন্টি-ট্যাঙ্ক মাইন স্থাপন করা হলো এবং এগুলোকে আবৃত করা হলো এমন সুচারুভাবে, মাইন আছে শত্রু সৈন্য যাতে কোনোমতেই বুঝতে না পারে-এ রকম কৌশলে। নিরাপদে মাইন বসানোর কাজ স্বল্পসময়ে সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা হলে তৃতীয় দল চতুর্থ দলের সঙ্গে এবং প্রথম ও দ্বিতীয় দল একসঙ্গে পাঁচশ’ গজ দূরত্বের ব্যবধানে পূর্ব পরিবল্পনা অনুযায়ী অবস্থান গ্রহণ করল। আমাদের অবস্থান থেকে রায়গঞ্জ ব্রিজে পাকিস্তানি দাসু্যদের অবস্থানের আলো মিটমিট দেখা যাচ্ছে। ঠিক এমন সময় আসামের রূপসী বিমান ঘাটিতে জেনারেল অরোরার কথা মনে পড়ল।
৮ এপ্রিল বিকেলে বিএসএফ সুবেদার রবীন মেহেরা ও ক্যাপ্টেন যাদব ভুরুঙ্গামারীতে এলেন। বিভিন্ন খবর নেয়ার পর এক পর্যায়ে এই এলাকার এমএনএ, এমপিএদের অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজনে আজকেই রাত ৯টার মধ্যে বিএসএফ ফাঁড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি অনুরোধ করলেন। এ সময় শামছুল হক চৌধুরী ছিলেন না। তিনি সন্ধ্যার আগেভাগে এলেন। আমি তাঁকে সব বললাম। মোজাহার চৌধুরী এমএনএ ও আবদুল হাকিম এমপিএ সীমান্তের ওপারে ভারতের সাহেবগঞ্জে আশ্রয় নিয়েছেন। সন্ধ্যায় মোটরসাইকেলে করে শামছুল হক চৌধুরীকে নিয়ে সীমান্তের ওপারে ভারতের সাহেবগঞ্জে তাদের খুঁজে বের করতে গেলাম। একটু একটু বৃষ্টি ও বেশ ঠাণ্ডার মধ্যে অনেক চেষ্টার পর মোজাহার হোসেন চৌধুরী ও আব্দুল হাকিমকে পাওয়া গেল। বিলম্ব না করে আমাদের সঙ্গে তাদের সোনাইহাট বিএসএফ ফাঁড়িতে যেতে বলা হলো। তারা যেতে সম্মত হলেন না। মোজাহার হোসেন চৌধুরী শামছুল হক চৌধুরীকে বললেন, ‘সোগে তো তুই করবার লাগছিস, হামার গুলাক নিয়া আর টানাটানি না করিস। যা করবার হয় তুই কর’। অগত্যা বাধ্য হয়ে ভুরুঙ্গামারীতে ফিরে এলাম। বৃষ্টির মধ্যে রাতে আটটায় থানা ম্যাজিস্ট্রেট জিয়াউদ্দিন আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে আমরা জিপে সোনাইহাট রওনা হলাম। সোনাইহাট বিএসএফ ফাঁড়িতে পৌছানোর পর মুষলধারে বৃষ্টি ঝরতে লাগল। তাই বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর বৃষ্টির মধ্যেই রাত ১২টায় কর্নেল আর দাস বিএসএফের দুটি জিপে করে আমাদের নিয়ে চললেন। বৃষ্টি আর অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। পানবাড়ি পাহাড়ের মধ্যে গাড়ি কিছুক্ষণের জন্য থামল, পথ ঠাহর করা যাচ্ছে না। আমরা গাড়িতে বসে থাকলাম। এখানে অনেকবার এসেছি। হঠাৎ এই সময় বিজলি চমকালো। তার আলোয় চকিতে পানবাড়ি বিএসএফ হেডকোয়ার্টার চিনতে পারলাম। আমাদের গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। কিন্তু কিছুদূর এগিয়েই আবার গাড়ি থামলো। না, কোনো কিছু আর চেনা যাচ্ছে না। ঘোর অন্ধকার রাত আর তুমুল বৃষ্টি। কিন্তু থামলে চলবে না। তাই ধীরে উঁচু-নিচু আঁকাবঁকা পথে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আমাদের গাড়ি চলতে লাগলো। এক সময় কর্নেল আর দাস বললেন, আগামীকাল আপনাদের বড় নেতার সঙ্গে দেখা হবে। সেজন্য আপনাদের নিয়ে রূপসী যাচ্ছি। আমি বললাম, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হবে? কর্নেল বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু কিনা জানি না, তবে আপনাদের উচ্চ পর্যায়ের নেতাই তিনি’। তিনি আরো বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু যদি সত্যিই আসেন, আর ভগবানের কৃপায় যদি তাকে দেখতে পাই, তাহলে জীবনটা সার্থক হবে, আমার চাওয়া-পাওয়ার আর কিছুই থাকবে না।’ বঙ্গবন্ধু কোথায় কীভাবে আছে, আমরা তখনো কিছু জানি না। নিশ্চিত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হতে যাচ্ছে ভেবে আমরা শিহরিত ও পুলকিত বোধ করছিলাম। সারা রাত আমাদের গাড়ি চলল। কোনো কষ্ট বা অবসাদ কিছুই বোধ হচ্ছিল না।
এক সময় সকাল হলো, গাছের ফাঁকে ফাঁকে সূৰ্য উঁকি দিল। আমাদের গাড়ি চলছে তো চলছেই। কখনো সমতল, কখনো উচু-নিচু পাহাড়ি পথ আর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ছুটছে। মাঝে মাঝে আমরা চঞ্চল হয়ে উঠছি, কখন রূপসী পৌছব। অবশেষে ৯ এপ্রিল সকাল আটটায় জঙ্গলঘেরা রূপসী বিমান ঘাটিতে পৌঁছে গেলাম। আমাদের বিমান ঘাঁটির রেস্টহাউজে নিয়ে যাওয়া হলো। ব্রিটিশ শাসনামলে জাপানের সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ বেধে গেলে ইংরেজরা এই রূপসী বিমান ঘাঁটি তৈরি করেছিল। রেস্টহাউজে চিলমারীর এমএনএ সাদাকাত হোসেন ছক্কু মিয়াকে পাওয়া গেল। তিনি বললেন, শাড়ি ও বোরখা পরে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আব্দুল মান্নান পায়ে হেঁটে অনেক কষ্টে গতকালই সীমান্ত অতিক্রম করে আসাম পৌঁছেছেন। হাঁটতে হাঁটতে সৈয়দ নজরুল ইসলামের পা ফুলে গেছে। তারা খুবই পরিশ্রান্ত, এখন ঘুমাচ্ছেন।’
হাত-মুখ ধুয়ে নাস্তা খেয়ে চা-পান করছিলাম। এমন সময় চারদিক তাকিয়ে দেখার সুযোগ পেলাম। দেখা গেল, বিমান ঘাঁটির চারদিকে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সদস্যরা যুদ্ধসাজে সজ্জিত হয়ে কড়া পাহারা দিচ্ছে। জলপাই রঙের পোশাক পরিহিত সৈন্যদের রূপসীর ঘন জঙ্গলের সবুজের অপূর্ব সমারোহের ভেতরে হঠাৎ করে আবিষ্কার করা খুবই কঠিন।
বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী, আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আব্দুল মান্নান সাহেবের সঙ্গে তখনো আমাদের দেখা হয়নি। জানা গেল, তারা হাত-মুখ ধুয়ে তৈরি হচ্ছেন। সামরিক বাহিনীর কয়েকটি জিপ রেস্টহাউজের গেটে এসে থামলো। কর্নেল আর দাস এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর কয়েকজন অফিসার আমাদের জিপে উঠতে অনুরোধ করলেন। শামছুল হক চৌধুরী ও আমি এক জিপে, অপরটি সৈয়দ নজরুল এবং আব্দুল মান্নান সাহেবকে নিয়ে রেস্টহাউজের অপর প্রান্তে বিমান ঘাঁটির লাউঞ্জে এলো। আমাদের একটি কক্ষে বসতে দেয়া হলো। আমাদের সঙ্গের অন্যদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। আমরা চুপচাপ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি, সামনে কী ঘটছে তাই দেখার জন্য। বুক দুরু দুরু করে কাঁপছে বঙ্গবন্ধুকে কাছে পাব, দেখতে পাব-এই প্ৰত্যাশায়। সকাল সাড়ে দশটায় একটা বিমান অবতরণ করল। বিমান থেকে প্রথমে নেমে এলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক লে. জেনারেল অরোরা। তার সঙ্গে শেখ ফজলুল হক মণি, তাজউদ্দীন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং কয়েকজন উধৰ্ব্বতন ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তা। আমাদের পাশের হলঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। সবার সঙ্গে করমর্দন ও পরিচয় হলো। সবার সঙ্গে করমর্দন ও পরিচয় হলে মণি ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুই কীভাবে এসেছিস, তোরা কোথায় আছিস?’ আমি একপাশে দাঁড়িয়ে সংক্ষেপে তিস্তায় সংগঠিত আমাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান, বিশাল মুক্ত এলাকা এবং ভুরুঙ্গামারী প্রধান ঘাঁটির কথা জানালাম। আমি বলছিলাম কিন্তু তিনি শুনছিলেন কিনা জানি না। কারণ তাকে খুবই অস্থির ও উত্তেজিত দেখা গেল। বঙ্গবন্ধুকে না দেখে আমরা নিরাশ হলাম। আলোচনা শুরু হলো। শামছুল হক চৌধুরী বিস্তারিত বলছেন। জেনারেল অরোরা জানতে চাইলেন, বর্তমানে আমাদের ডিফেন্স কোথায়, কীভাবে রয়েছে? কী কী অস্ত্ৰ আছে? ইপিআরসহ ট্রেনিং সেন্টার কয়টি ইত্যাদি। শামছুল হক চৌধুরী সংক্ষেপে অবগত করলেন। আমাদের বর্তমানে সবচেয়ে বড় অসুবিধা অস্ত্র, গোলাবারুদ ও খাদ্যদ্রব্যের অপ্রতুলতার বিষয়ে তাকে জানানো হলো। দেয়ালে লাগানো বাংলাদেশের বড় একটা মানচিত্রের সামনে জেনারেল অরোরা দাঁড়িয়ে শামছুল হক চৌধুরীকে ডাকলেন। বর্তমানে আমরা কোন কোন অঞ্চল মুক্ত রেখেছি, আমাদের ডিফেন্স ও মধ্যবতী ঘাঁটি কোথায় ইত্যাদি জনাব চৌধুরী মানচিত্রে আঙ্গুল নির্দেশ করে দেখিয়ে দিলেন। সমগ্র কুড়িগ্রাম মহকুমা আমরা মুক্ত রেখেছি দেখে জেনারেল অরোরা খুব খুশি হয়ে বললেন, ‘ভেরি গুড।’ তিস্তা পুল বরাবর লাল পেন্সিল দিয়ে দাগ কষে তিনি বললেন, ‘ইয়ে তিস্তা ব্রিজ তোড় দিজিয়ে, তিস্তা ব্রিজকা ইধার ডিফেন্স আচ্ছা করনে হোগা’।
বিস্তারিত আলোচনার পর শামছুল হক চৌধুরীকে আমাদের এই উত্তরাঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্ৰ গ্ৰহণ, সার্বিক দায়িত্ব পালনের কর্মভার অর্পণ করা হলো, সেই সঙ্গে তার স্বাক্ষরও সত্যায়িত করে নেয়া হলো। সৈয়দ নজরুল ইসলাম শামছুল হক চৌধুরীকে পারিবারিক কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলামের খবর জানতে চাইলে তিনি প্ৰায় অস্থির হয়ে উঠলেন এবং বললেন, তারা কোথায় আছে তিনি জানেন না। বললেন, তিনি একাই চলে এসেছেন। নেতাদের আমাদের বিস্তীর্ণ এলাকার হেডকোয়ার্টার ভুরুঙ্গামারীতে অবস্থানের জন্য অনুরোধ করা হলো। আলোচনা করা হলো মুক্ত এলাকার বিভিন্ন সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে। আমাদের মুক্ত এলাকায় স্বাধীন বাংলা বেতার খোলার জন্য রেডিও ট্রান্সমিটার এবং সম্ভাব্য সব ধরনের সাহায্য প্রদানের আশ্বাস দেয়া হলো। সৈয়দ নজরুল ইসলাম বললেন, ‘এখনো বহুবিধ অসুবিধা রয়েছে। আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার এখনো গঠিত হয়নি। সরকার গঠিত হলে বৈদেশিক সমর্থন ও সাহায্য পেতে সুবিধা হবে। মুক্তিযুদ্ধ সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য অচিরেই বিপ্লবী সরকার গঠন করা হচ্ছে। সরকার গঠিত হওয়ার পর সব অসুবিধা ধীরে ধীরে দূর হয়ে যাবে এবং এবটি সুষ্ঠু সমন্বয় ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। তবে স্বাধীনতা যুদ্ধ করলে কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার এবং অসুবিধার সম্মুখীন হওয়াটা স্বাভাবিক। সবকিছু পরিহার করে স্বাধীনতা যুদ্ধ চালিয়ে যেতেই হবে। যুদ্ধ মানেই কষ্ট, জীবন বাজি রাখা, মনে রাখতে হবে’। বঙ্গবন্ধু কোথায় জানতে চাইলে এক করুণ দৃশ্যের অবতারণা হলো। কারো মুখে কোনো কথা নেই। সবার চোখ ছলছল করছে। নেতারা যেন বোবা হয়ে গেছেন। তারা শুধু বললেন, ‘নেতা আমাদের সঙ্গেই রয়েছেন এবং আমাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন’। প্রায় দুঘণ্টা পর তারা বিদায় নিলেন। বিমান সবুজ’ বনানীর ওপর দিয়ে উড়ে গেল, যতক্ষণ দেখা গেল আমরা তাকিয়ে থাকলাম। কর্নেল আর দাসসহ আমরা ফিরে এলাম। দিনের অবস্থা ও আবহাওয়া বেশ সুন্দর, আমাদের জিপ দ্রুত ছুটে চলল। সন্ধ্যার পর আমরা ঘোলকগঞ্জ পৌঁছলাম। আমাদের জিপের শব্দ পেয়ে শত শত মানুষ রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে গেল। জিপ থামাতে হলো। ভারতীয় বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিক অপেক্ষা করছিলেন। বিদেশী সাংবাদিকরাও রয়েছেন। সাংবাদিকরা জিপ ঘিরে দাঁড়ালেন। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করতে লাগলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছে কিনা? এখন তিনি কোথায় রয়েছেন, কেমন আছেন? ইত্যাদি নানা প্রশ্ন। শামছুল হক চৌধুরী শুধু বললেন, ‘নেতা আমাদের সঙ্গে রয়েছেন এবং নেতৃত্ব দিচ্ছেন’। সোনাহাটী বিএসএফ ফাঁড়িতে আসার পর রাতেই সামরিক কর্মকর্তাদের সামনে পুনরায় শামছুল হক চৌধুরীর স্বাক্ষর সত্যায়িত করে নেয়া হলো। পরদিন ১০ এপ্রিল আসামের গৌহাটি থেকে প্রকাশিত দৈনিক অহম, কলকাতা থেকে প্ৰকাশিত দৈনিক যুগান্তর ও আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় হেডলাইনে খবর বের হলো, ‘আসামের কোনো এক জঙ্গলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে শামছুল হক এমপিএর সাক্ষাৎ লাভ’।
শামছুল হক চৌধুরীর স্বাক্ষর সত্যায়িত করে নেয়ার পর অস্ত্র সরবরাহ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হলো। দ্বিতীয় পর্যায়ে দুটি এলএমজি, দুটি ৮১ মি.মি. মর্টার, এক্সপ্লোসিভ, রকেট লঞ্চার, গ্রেনেড এবং প্রচুর গুলি পাওয়া গেল। বঙ্গবন্ধুর বিষয়টি মর্মান্তিকভাবে আমাদের ভাবিয়ে তুলল। বঙ্গবন্ধু কোথায়, কীভাবে রয়েছেন, কোনো সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে না। তার কথা যখনই মনে হয়, তখনই আঁতকে উঠি এই ভেবে যে, তিনি আদৌ বেঁচে রয়েছেন কিনা, নরপশুরা বাংলার শিরোমণিকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে কিনা? শামছুল হক চৌধুরী এবং আমি এক অস্বস্তিকর উভয় সংকটে পড়লাম। কেননা, বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি বলতে পারি না, আবার দেখেনি একথাও বলা যাচ্ছে না। তবে বঙ্গবন্ধুর এই অভাব আমাদের প্রবলভাবে আলোড়িত করল, সঞ্চার করল পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণ ও লড়াই করে মাতৃভূমিকে শক্রমুক্ত করতে প্ৰচণ্ড শক্তি ও সাহস।
জয়নালের মৃদু ডাকে জেনারেল অরোরার রূপসী বিমান ঘাঁটির ভাবনা থেকে বাস্তব আন্ধারী ঝাড় অভিযানে ফিরে এলাম। আমরা এখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গাড়িবহরের অপেক্ষায়। মাইন স্থাপন করা জায়গা থেকে সোজা পেছন দিকে নদীর পশ্চিম পাড়ে কলাগাছ, বাঁশের ঝোপ ও ছোট গাছের নিচে আমাদের দু’দল সামান্য ব্যবধান রেখে অবস্থান গ্ৰহণ করে অপেক্ষা করছি। সন্ধ্যায় একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। জঙ্গলের মধ্যে বৃষ্টিতে ভেজা ঘাস ও মাটির ওপর আমরা বসে। মশা কামড়াচ্ছে, ছোট ছোট জোক হাতে লাগছে, জোক কাপড়ের ওপর দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে বাদুড় উড়ে যাওয়ায় পাখার ঝাপটার শব্দে নীরবতা ভেঙে পাখিরা চিৎকার করে উঠছে। কিন্তু একই জায়গায় সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ। হানাদার বাহিনীর গাড়ি কখন আসবে, তারই অধীর অপেক্ষায় গুনছি প্রহর। ভোর চারটা-সাড়ে চারটায় রায়গঞ্জের দিক থেকে একটি গাড়ির দুটি হেডলাইট উপরে উঠে নিচে নেমে গেল। স্পষ্ট বোঝা গেল গাড়ি রায়গঞ্জ পুল পার হয়ে উত্তরে আন্ধারী ঝাড়ের দিকে আসছে। গাড়ি যতই অগ্রসর হচ্ছে, ততই আমাদের বুকের স্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে। আর কয়েক মুহূর্ত। ওই তো গাড়িটি মাইন বসানো স্থানে চলে এসেছে। আমরা দু’হাত দিয়ে কান চেপে, ধরলাম। হঠাৎ গগনবিদারী ‘গুরুম গুরুম’ বিকট শব্দে আকাশ যেন ভেঙে পড়ল। মাটি কেঁপে উঠল। পাখিরা ভয়ে চিৎকার করতে করতে উড়তে থাকল। মনে হলো, কান ফেটে গেছে। কয়েক মুহূর্ত পর সম্বিৎ ফিরে পেয়ে সবাইকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বললাম। কিন্তু সবাই ছুটছে ঘটনাস্থলের দিকে। দেখা গেল, রাস্তার মধ্যে বিরাট এক খাল হয়ে গেল। জিপের কোনো চিহ্ন পাওয়া গেল না। রাস্তার বেশ দূরে ক্ষেতের মধ্যে একটি টুপি আর ক্যাপ্টেনের ব্যাজ লাগানো শার্টের হাতাসহ একটি হাত পড়ে রয়েছে। বিলম্ব না করে এগুলো নিয়ে দ্রুত চলে এলাম। শত শত লোক ও ভারতীয় সেনাবাহিনী দাঁড়িয়ে। ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার জসি আমাদের অভিনন্দন জানালেন। জানা গেল, সাহেবগঞ্জসহ পার্শ্ববতী এলাকার বাড়িঘর, দিনহাটার পাকা ভবনগুলোও কেঁপে উঠেছিল। পাক বাহিনীর ওই গাড়িতে একজন ক্যাপ্টেনসহ এগারোজন হানাদার বাহিনীর সদস্য ছিল। মাইনের আগাতে লরি-জিপসহ শয়তানদের সবাই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। পার্শ্ববতীর্ণ দিনহাটা, কুচবিহার, তফানগঞ্জ এবং দূর-দূরান্ত থেকে উৎসুক মানুষ কয়েকদিন যাবৎ আমাদের এই অপারেশনের সাফল্যের কথা জানতে এসেছে। মানুষের এই প্ৰাণঢালা ভালোবাসা এবং আমাদের প্রতিটি সাফল্যে মানসিকভাবে উত্তরোত্তর আরো বেশি করে শক্তি অর্জন করতে লাগলাম।