You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি | ডা. জিয়াউদ্দীন আহমদ - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি

ডা. জিয়াউদ্দীন আহমদ

সময়টা একাত্তরের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি। লেফটেন্যান্ট হেলাল মোরশেদের নেতৃত্বে ১৪ জন সৈনিক নিয়ে একটা স্পেশাল প্লাটুন গঠন করা হয়েছে। যার দায়িত্ব হবে অনবরত শক্রির কাছাকাছি বিচরণ করা এবং সুযোগ বুঝে বারবার হামলা চালানো। সারাক্ষণ শক্রকে ব্যস্ত রাখলে তারা দুর্বল হয়ে পড়বে এবং রেগুলার বাহিনী নিয়ে ক্যাপ্টেন নাসিম সহজেই মুখোমুখি যুদ্ধে শক্রকে ঘায়েল করতে পারবেন। আমরা ছাত্র তিন বন্ধু ছাড়া আর সবাই ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাছাই করা যোদ্ধা। ক্যাপ্টেন নাসিম মাধবপুরে ঘাঁটি করেছেন, শক্রর মুখোমুখি। ঠিক হলো শাহবাজপুর ব্রিজে দখলকৃত পাকিস্তান বাহিনীর ঘাঁটির ওপর রেইড করতে হবে। স্পেশাল প্লাটুনের এবং তার সঙ্গে আমার প্রথম অপারেশন। স্থানীয় একটি ছেলে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। আমাদের পথ চলতে হবে রাতের অন্ধকারে। কাকপক্ষিতেও যেন টের না পায়। শক্ৰকে পাশ কাটিয়ে পেছনে গিয়ে অতর্কিতে চালাতে হবে আক্রমণ তারপর দ্রুত ফিরে আসতে হবে ঘাঁটিতে। সেদিন ছিল অমাবস্যা, নিকশ কালো রাত। বৃষ্টি থেমে গেছে ততক্ষণে, কিন্তু মেঠোপথ কাদায় একাকার। সমস্ত রাত আমাদের হাঁটতে হবে পথ। গ্রামের ভেতর দিয়ে, মানুষের উঠান পেরিয়ে, কখনো ঘরের কিনার ঘেষে সন্তৰ্পণে নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছি আমরা। পরনে আমাদের লুঙ্গি ও শার্ট এবং খালি পা। পিঠের মাঝে আমার ঝুলানো চাইনিজ লাইট মেশিনগান ও দুটি ভারি ম্যাগাজিন, কোমরে আঁটা দুটি গ্রেনেড। কথা বলা বা শব্দ করা বারণ, তাই একজনের পিঠে রাখা আছে আরেকজনের হাত নাহলে নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে দল থেকে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। ঝানু সৈনিকদের হাঁটার সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে দু’বার আমি হারিয়ে গেলাম। বাধ্য হয়ে পাখির ডাকের সংকেত দিয়ে আবার মিলিত হলাম। ভোর হওয়ার আগেই আমরা শাহবাজপুর ব্রিজের কাছে চলে এসেছি। আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী একটা টিনের মসজিদের ভেতর সবাই আশ্রয় নিলাম। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই পালিয়ে গেছে। প্রচুর বাড়িঘর ভস্মীভূত। বুঝলাম শূন্য গ্রামে এবং পরিত্যক্ত মসজিদই দিনের আলোতে গা-ঢাকা দেয়ার জন্য সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে রাতের জন্য। লে. মোর্শেদ দু’জন সাহসী হাবিলদারকে রেকি করতে পাঠালেন। তারা চাষীর মেশিনগানের পোস্ট এবং আমাদের পশ্চাদপসরণের সম্ভাব্য পথ নির্ধারণ করে এলো।

সারারাত ভারী অন্ত্র কাঁধে নিয়ে পথ চলে ক্লান্ত আমি লাইট মেশিনগানটা মাথার নিচে দিয়ে শক্ত ধূলিময় মেঝেতে অনায়াসে ঘুমিয়ে পড়লাম। বিকেলে যখন ঘুম ভাঙলো তখন দেখলাম, কলা পাতার ওপর গরম ভাত আর ডাল বাড়া হয়েছে। সবার খাবার পর লে. মোর্শেদ আমাদের সবাইকে যার যার পজিশন বুঝিয়ে দিল। অন্ধকার নেমে আসছে, মোমবাতির ক্ষীণ আলোকেও ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা চলছে, নিঁচুগলায় ফিসফিস করে কথা বলছে কেউ কেউ। শক্ত করে ধরে থাকলাম আমার হাতের এলএমজিটাকে, এই মুহূর্তে আমার সবচেয়ে বিশ্বাসী বন্ধু। শীতল ইস্পাত থেকে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হতে লাগল আমার রক্তে। বিস্কিটের টিনের মতো মসৃণ ম্যাগাজিনের ওপর কয়েকবার হাত বুলালাম। ধীরে ধীরে মনে পড়তে লাগল বাবা, মা, ভাই, বোন ও বন্ধুদের কথা। ২৫ অনেক চেষ্টা করেও গণতান্ত্রিক উপায়ে শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। পাকিস্তানিদের বেইমানির মুখোশ খসে পড়েছে। প্রথম কয়েকদিন অবিশ্বাস্য দুঃস্বপ্লের মতো কেটে গেল। সিলেট শহরের রাজপথে নিরীহ মানুষের লাশ বাড়তেই লাগলো। হঠাৎ মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণায় যেন সম্বিৎ ফিরে পেলাম, এবার বাঙালি সৈনিকরাও জেগেছে। একটা দুর্বার সাহস ফিরে পেলাম। কী করবো বুঝতে পারার আগেই শুনলাম পাঞ্জাবিরা নিজেদের রেজিমেন্টের ৩১ পাঞ্জাব দু’জন বাঙালি অফিসার লে. ডা. মইন ও ক্যাপ্টেন মাহবুবকে গুলি করে সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফেলে গেছে। কারফিউ ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ছুটে গেলাম। অদূরে অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালেন। সার্জারির প্রধান অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দীন আহমদ, আমার বাবা। আমার দিকে চোখ পড়তেই নিস্পলক তাকিয়ে থাকলেন কয়েক মুহূর্ত। তাকে মনে হলো অনেক ক্লান্ত ও চিন্তিত। মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এখন ডাক্তার-শূন্য। সবাই আকস্মিকতায় দিশেহারা। অথচ হাসপাতালে আহত, মুমূর্ষ অসহায় রোগীদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দীন হাসপাতালে। সারাক্ষণ থেকে যাওয়ার কথা মনস্থ করেছেন। তার জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। প্ৰাণের ভয় থেকে বড় দায়িত্ববোধ। এই ভয়ংকর দুঃসময়ে বুকের মধ্যে আগলে ধরে রাখলেন হাসপাতালকে। যে করেই হোক খোলা রবে এর দ্বার। কানে বাজতে লাগলো। গত রাতের তার কথাগুলো। ‘হানাদারদের এখন চ্যালেঞ্জ করতে হবে সমরাস্ত্ৰ দিয়ে, তীর, বল্লম আর গাদা বন্দুক দিয়ে নয়। বেশি দেরি হলে বাঙালি জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে।’ তৎক্ষণাৎ ঘুরে দাঁড়ালাম, পেছন ফিরে আর একবারও তাকালাম না (তখন বুঝতে পারিনি এটাই আমার বাবাকে আমার শেষ দেখা । ৫ দিন পর ৯ এপ্রিল এই হাসপাতালের ভেতর মুমূর্ষ ও আহতদের সেবা করার সময় পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে তিনি কিছু সাথীকে নিয়ে শহীদ হন)।

কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সালাম, আনিস ভাই, বুলু ভাই (চিকিৎসক) আর আমি প্রথম বর্ষ মেডিকেলের ছাত্র, সিলেট শহর থেকে রওনা দিলাম অজানার পথে। যেহিন, ফয়সল, শাহরীয়ার, বাবলু, আতিক ও অন্যান্য বন্ধুকে সিলেটে অপেক্ষা করতে বললাম পরবতী নির্দেশের জন্য। প্রথম লক্ষ সিলেটের অদূরে বিয়ানীবাজার থানার দিকে কারণ

সেখানে আর্মি তখনো ওখানে যায়নি এবং বাঙালি পুলিশরা তখনো অস্ত্র জমা দেয়নি। পরিকল্পনা হলো পুলিশের কাছ থেকে রাইফেল জোগাড় করতে হবে, প্রয়োজনবোধে ছিনতাই করে হলেও। তারপর ছাত্র-জনতাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে সংগঠিত করতে হবে প্রতিরোধ; কিন্তু তার প্রয়োজন হলো না। দেখা হয়ে গেল কর্নেল (অব.) রবের সঙ্গে । শুনলাম আজ রাতে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা ক্যাপ্টেন আজিজের নেতৃত্বে সিলেটে হানাদার বাহিনীর ওপর হামলা চালাবে। তিনি আমাদের যথাশিগগির তেলিয়াপাড়া চা বাগানে জমায়েত ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের কাছে রিপোর্ট করার জন্য নির্দেশ দিলেন।

বিয়ানীবাজারের সাবু ভাইয়ের সাহায্যে আমরা ভারতে পৌঁছলাম। অপরিচিত কয়েকজন উৎসাহী ভারতীয় যুবকের সাহায্যে করিমগঞ্জ হয়ে আগরতলার বর্ডার দিয়ে পরদিনই আবার বাংলাদেশের ভেতর তেলিয়াপাড়াতে এসে পৌঁছলাম। তেলিয়াপাড়াতে তখন বাঙালি সমরনায়কদের প্রথম ঐতিহাসিক বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধের নকশা তৈরি হচ্ছিল।

ব্ৰাক্ষণবাড়িয়া তখনো বাঙালি সৈনিকদের দখলে। দুদিনের মধ্যেই হাতে হাতে সাব-মেশিনগান, রাইফেল, লাইট মেশিনগান আর গ্রেনেড ছোড়ার ট্রেনিং নিয়ে আমরা চারজন ছাত্র মিশে গেলাম ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে। ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার মৃদুভাষী মেজর কাজী মোহাম্মদ সফিউল্লাহ ছটোখাটো বক্তৃতা দিলেন। ‘অন্যায়ভাবে বাঙালিদের ওপর হত্যা, ধ্বংস ও বর্বরতা শুরু করেছে পাকিস্তানি সৈন্যরা। এখন জাতীয় কর্তব্য হবে দেশকে শক্রমুক্ত করার জন্য প্ৰাণপণে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া। কতদিন যুদ্ধ চলবে জানি না তবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে জয় আমাদের হবেই।’

কিছুদিন সালাম, আমি আর আনিস ভাইকে নবগঠিত পুলিশ, ইপিআর ও ছাত্ৰজনতা তৈরি কোম্পানিগুলোর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বভার দেয়া হলো। আমাদের আর্মি ক্যাডেট হিসেবে পবিচয় করানো হলো সাংগঠনিক সুবিধার্থে। তখন মুক্তিযুদ্ধের মাত্র প্রথম পর্যায় এবং ভারতের সঙ্গে আগের কোনো বোঝাপড়া না থাকায় ভারতের কাছ থেকে তখনই কোনো সামরিক সাহায্য পাওয়া গেল না। তাই বেঙ্গল রেজিমেন্ট স্বল্প লোকবল ও সীমিত অস্ত্র নিয়ে হানাদারদের মরিয়া হয়ে প্ৰতিহত করার চেষ্টা করছিল। আর আমরা ক্যাম্পে রণক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য সারাক্ষণ উদগ্ৰীব হয়ে থাকতাম। তখনই একদিন হঠাৎ করে হাজির হলো এক তরুণ সুদৰ্শন বাঙালি লেফটেন্যান্ট, তার এক হাত প্লাস্টারে ঢাকা, যুদ্ধের সময় শক্রর গুলি লেগে ভেঙে গেছে। তাতে সে দমবার পাত্র নয়, আরেক হাত তো এখনো আছে। অনায়াসে ছুড়তে পারবে গ্রেনেড অথবা চালাতে পারবে সাব-মেশিনগান। মোর্শেদ জানাল, তার স্পেশাল প্লাটুনের পরিকল্পনা। পরিষ্কারভাবে বোঝালো এই ঝুকির মর্মার্থ। আত্মঘাতী অভিযান। আমি যেন এতদিন তারই জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তক্ষুনি কোম্পানির দায়িত্ব আমার সহকারী ওয়াকারের কাছে দিয়ে মোর্শেদের সঙ্গে চলে এলাম শক্র হননের দুর্বার স্বপ্ন নিয়ে। একের পর এক দ্রুত ভাসতে থাকলো স্মৃতিগুলো।

হঠাৎ করে তন্দ্ৰা ভাঙলো, দেখি সবাই তৈরি হয়ে গেছে। এখনই বেরিয়ে পড়তে হবে। এলএমজিটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম, গ্রেনেডগুলো চেক করে নিলাম। একটা প্রচণ্ড শক্তি অনুভব করলাম। আজ আমার প্রথম অপারেশন। চঞ্চলতা নেই ভেতরে, ভয় যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। অদ্ভুত, অব্যক্ত এক অনুভূতি। শক্রর গুলি আজ আমাকে কিছুতেই স্পর্শ করতে পারবে না বলে এক দৃঢ়বিশ্বাস জন্মেছে। হঠাৎ করে আবার বাবা, মা, ভাই ও বোনদের কথা মনে পড়ল, বন্ধুদের মুখ ভেসে উঠল। কে, কোথায় কীভাবে আছে বা নেই কিছুই জানি না, কোনোদিন কাউকে দেখতে পাব কিনা তাও জানি না। চিন্তাটাকে দূর করার জন্য মনে করতে চাইলাম সামনের শক্রকে আক্রমণ করার এই মুহূর্তে আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।

নিঃশব্দে সবাই আবার গাঢ় অন্ধকারে বেরিয়ে পড়লাম। কাদায় ভরে গেছে পথ। জল আর কাদায় অতি সন্তৰ্পণে হাঁটলেও প্যাচপ্যাচ শব্দ হতে লাগল। হঠাৎ নিস্তব্ধতা খানখান করে পাকিস্তানিরা আকাশে সার্চ পিস্তল ছুড়ল। আগের নির্দেশমতো নিঃশব্দে সবাই মাটিতে শুয়ে পড়লাম। সাদা আলোতে চারদিক আলোকিত হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য। সব চুপচাপ মনে হলো। তারা টের পেল না আমাদের উপস্থিতি। সন্তৰ্পণে আবার রওনা হলাম শক্রর ছাউনির দিকে খুব ধীরগতিতে। আরো কাছাকাছি আসার পর লে. মোর্শেদ দু’জন দু’জন করে পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী সবাইকে যার যার পজিশনে বসিয়ে দিল। আমি লাইট মেশিনগানটা নিয়ে সবার ডানদিকে বসলাম। হাত ধরে ইশারায় সে দেখলো আমার প্রথম টার্গেট, শক্রর ভারী মেশিনগানের বাঙ্কার। নিকষ অন্ধকারে কিছুই পড়লো না চোখে। বাঙ্কার কত দূরে বোঝা গেল না। ট্রিগারে আঙুল রেখে শুয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম সংকেতের। দুই ইঞ্চি মর্টার দিয়ে মোর্শেদের আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও শুরু করতে হবে বাস্ট ফায়ার। ঘুটঘুটে অন্ধকারে সামনে কতক্ষণ তাকিয়ে আছি জানি না, হঠাৎ যেন অন্ধকার ভেদ করে আমার দৃষ্টিতে ধরা দিতে থাকলো কিছু রেখা। ব্রিজ, ছাউনি, শক্রর ট্রাকগুলো সবকিছু যেন এখন ঠাহর করতে পারছি। হঠাৎ দেখি সামনে খুব কাছে দুটো ছায়া নড়ে উঠল। মনে হলো ছাউনি থেকে বাঙ্কারে আসছে দু’জন শক্রসেনা। তক্ষুনি আক্রমণের সংকেত, মোর্শেদের মর্টার গর্জে উঠল, ছাউনিতে আঘাত করেছে শেলটি। আমার নিশানা ততক্ষণে দু’টি ছায়ার দিকে নিবদ্ধ, ট্রিগারে আঙুল চেপে ধরলাম সব শক্তি দিয়ে। শুরু হয়ে গেল অ্যাটাকা। আচমকা পেছন থেকে এই আক্রমণে হৈচৈ পড়ে গেছে পাকিস্তানিদের মধ্যে।

অনবরত স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের শব্দে কাপতে থাকলো গোটা এলাকা। মাঝে মাঝে মর্টারের শব্দ। শক্ররা কিছুটা সামলে নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করছে। হঠাৎ দেখি সামনের বাঙ্কার থেকে প্ৰচণ্ড শব্দে ভারী মেশিনগান গর্জে উঠলো, আমার মাথার খুব কাছ দিয়ে ছুটিতে লাগল গুলি। বুঝলাম বাঙ্কারে যারা ছিল তাদের এক্ষুনি স্তব্ধ করে দিতে হবে। গ্রেনেডের পিনটা খুলে ছুড়ে দিলাম অন্ধকারে মেশিনগানের ফুলকির দিকে লক্ষ করে, তারপর কানে হাত দিয়ে পজিশন নিলাম। গ্রেনেডের বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে স্তব্ধ হয়ে গেল শক্রর বাঙ্কার। তথাপি আবার বাস্ট ফায়ার করতে থাকলাম আরো কিছুক্ষণ সেদিকে। তারপর ছাউনির দিকে ঘুরিয়ে ধরলাম নিশানা। সেদিক থেকে বেশকিছু স্বয়ংক্রিয় অন্ত্রের গুলি আসছিল। আবার গর্জে উঠলো আমার এলএমজি। অনবরত ঠিকরে বেরুচ্ছে আগুন, উত্তপ্ত হয়ে গেছে ইস্পাতের শরীর। ধারে কয়েকটি গ্রেনেড ফুটলো।

কতক্ষণ গুলি চলছে খেয়াল নেই, ধীরে ধীরে শত্রুর গোলাগুলি কমতে লাগলো। হঠাৎ দেখি ডানদিকে রাস্তায় হেডলাইট বন্ধ করে এগিয়ে আসছিল একটি গাড়ি, মুহুর্তে লাইটটা জুলে আবার নিভে গেল। ওইদিকে তৎক্ষণাৎ ঘুরিয়ে নিলাম। এলএমজির নলটি, আবারো কিছুক্ষণ চেপে ধরলাম ট্রিগার। গাড়ি থেকে কোনো গুলি এলো না। মোর্শেদ তৎক্ষণাৎ সংকেত দিয়েছে ফিরে যাওয়ার। মেশিনগানটা হাতে নিয়ে ক্রলিং করে পিছু হাঁটতে থাকলাম।

একটা বাড়ির আড়ালে এসে উঠে দাঁড়ালাম সোজা হয়ে। দু’টো এলএমজি থেকে শক্ররা তখনো চালিয়ে যেতে থাকলো গুলি। বেশ কয়েকবার বাঁশির মতো শব্দ করে খুব কাছ দিয়ে উড়ে গেল গুলি, ভ্ৰক্ষেপ না করে চলতে লাগলাম। মোর্শেদ দেখে নিল আমাদের কেউ হতাহত হয়নি। অজানা একটি আনন্দে ভরে উঠেছে বুক। আমরা লাইন করে এগিয়ে যেতে লাগলাম মাধবপুরে আমাদের ঘাঁটির দিকে। (গ্রামের লোকজন পরদিন ২২ জন শক্রসেনার লাশ ট্রাকে করে নিয়ে যেতে দেখেছে)

ধীরে ধীরে আলোকিত করে অন্ধকার কাটতে লাগল। এতদিনের একটা অব্যক্ত অসহায় যন্ত্রণা ক্রোধ ও ঘূণার সংমিশ্রণে ভরা ভারি বুকটা একটু হালকা মনে হলো। বুক ভরে জোরে জোরে কয়েকবার নিঃশ্বাস নিলাম। বেশ হালকা লাগছে।

অনেকদিন পর ভোরের বাতাসের ঘ্রাণ নিলাম। সামনে তাকিয়ে দেখলাম চোখজুড়ানো সবুজ ক্ষেত আর এঁকেবেঁকে চলে গেছে মেঠোপথ, অনেক দূরে দিগন্তের দিকে। হঠাৎ মনে হলো কবে শেষ হবে এই পথ।