You dont have javascript enabled! Please enable it!

শিবপুর মুক্তিযুদ্ধের এক সশস্ত্ৰ ঘাঁটি

হায়দার আনোয়ার খান জুনো

একাত্তরের বেশ আগে থেকেই শিবপুর বামপন্থীদের একটা শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে সেখানে জঙ্গি কৃষক সংগঠন গড়ে উঠেছিল। শিবপুরে বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নও খুব শক্তিশালী ছিল। উনসত্তরের গণঅভু্যখানে শিবপুর যথেষ্ট অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। উনসত্তরের শহীদ আসাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থাতেই শিবপুরের কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন।

একাত্তরের পঁচিশ মার্চ যখন পাক হানাদার বাহিনী নিরীহ জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন এ হিংস্র হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার মানসিক প্রস্তুতির কোনো অভাব ছিল না শিবপুরের বামপন্থীদের। একাত্তরের পঁচিশে মার্চের পরপরই এপ্রিলের এক-দুই তারিখে পাঁচদোনায় ইপিআর এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিকদের সঙ্গে পাক হানাদার বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। বাঙালি সৈনিকরা খুব একটা সংগঠিত না থাকায় দুদিন পর্যন্ত আক্রমণ প্রতিহত করে শেষ পর্যন্ত পিছু হটতে বাধ্য হয়। এরপর ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে চলে যায়। তারা এতই পরিশ্রান্ত ছিল যে, যাওয়ার পথে বেশকিছু অস্ত্রশস্ত্ৰ পথে ফেলে যায়। এসব অস্ত্র আমরা সংগ্ৰহ করি এবং আমাদের যুদ্ধে কাজে লাগাই।

প্রাথমিক অবস্থায় শিবপুর থানার রাইফেল দিয়েই ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। এ ট্রেনিংয়ের দায়িত্বে ছিলেন হারিস মোল্লা এবং ছুটি কাটাতে দেশে আসা বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার মজনু মৃধা। সশস্ত্ৰ সংগ্রামের প্রস্তুতি পর্বে সার্বিক কর্মকাণ্ডে মান্নান ভূঁইয়ার সঙ্গে নেতৃত্ব দেন তোফাজ্জল হোসেন, মান্নান খান, আওলাদ হোসেন, আবদুল আলী মৃধা, কালা মিয়া, ঝিনুক খান প্রমুখ। প্রা

থমিক পর্যায়ে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা প্রকাশ্যে করা হলেও যখন শিবপুর থানা সদরে পাক বাহিনী এসে স্থায়ী ক্যাম্প বসায়, তখন অভ্যন্তরের পাহাড়ি এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা নেয়া হয়। তাছাড়া এপ্রিল মাসের শেষদিকে আগরতলায় অবস্থিত বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটা যোগাযোগ স্থাপিত হয়। নির্ভয়পুর ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন মাহবুবের সহযোগিতায় সেখানে শিবপুরের কিছু কর্মীর কয়েক দফা ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়।

দীর্ঘ নয় মাসের শিবপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে পাক বাহিনীর সঙ্গে ছোট-বড় অনেক সশস্ত্ৰ সংঘর্ষ হয়েছে। এসব সংঘর্ষের মূল পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে ছিলেন মজলু মৃধা, মান্নান খান, তোফাজ্জল হোসেন, আওলাদ হোসেন, ঝিনুক খান, আবদুল আলী মৃধা প্রমুখ। প্রথম বড় আকারের সংঘর্ষটি হয় ১৩ আগস্ট নরসিংদী-শিবপুর রাস্তার ওপর পুটিয়া বাজারে। নরসিংদী ছিল পাক হানাদার বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি। সেখান থেকেই তারা প্রায়ই শিবপুরে আসতো। তাদের ঘন ঘন শিবপুরে আসা বন্ধ করার লক্ষে পুটিয়া ব্ৰিজ ধ্বংসের পরিকল্পনা নেয়া হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ভোরবেলা বিস্ফোরকের সাহায্যে ব্রিজের একটা অংশ উড়িয়ে দিয়ে আমাদের যোদ্ধারা অপেক্ষা করতে থাকে পাক বাহিনীর জন্য।

দীর্ঘ অপেক্ষার পর পাক বাহিনীর একটা বড় দল এসে আমাদের যোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ চালায়। প্রায় এক ঘণ্টা প্ৰচণ্ড যুদ্ধের পর পাক বাহিনী একজন ক্যাপ্টেনসহ প্রায় ত্রিশজনের মৃতদেহ রেখে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। আমরা হারাই আমাদের তরুণ যোদ্ধা ফজলুকে। শিবপুরের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ।

শিবপুরের মুক্তিযুদ্ধের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রথমত শিবপুর এলাকায় কোনো রাজাকারের অস্তিত্ব ছিল না। নয় মাসে কোনো খুন বা ডাকাতি সংঘটিত হয়নি। জনগণের ওপর অত্যাচার করে কোনো প্ৰকার টাকা-পয়সা বা খাবার আদায় করা হয়নি। ক্যাম্পগুলোতে খাওয়া-দাওয়ার বেশ কষ্ট ছিল । খাওয়া-দাওয়ার যত সংকটই থাক মান্নান ভুঁইয়ার কঠোর নির্দেশ ছিল, কোনো ক্যাম্পের জন্য আলাদাভাবে কিছুই সংগ্ৰহ করা যাবে না। কেন্দ্রীয়ভাবেই চাল, ডাল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্ৰহ করা হতো।

বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চল সবসময়ই মুক্ত ছিল। এসব এলাকার প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করত। আমাদের মুক্তিবাহিনী। ছোটখাটো বিচার-আচার স্থানীয়ভাবেই করা হতো। বড় কোনো সমস্যা দেখা দিলে হেড কোয়ার্টার থেকে মান্নান ভূঁইয়া কাউকে পাঠিয়ে তার সমাধান করতেন।

সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে পাক বাহিনীর ওপর একটা বড় ধরনের অ্যামুশের পরিকল্পনা নেয়া হয়। নরসিংদী থেকে শিবপুর আসার পথে পুটিয়া বাজারের এক মাইল উত্তরে শাসপর চৌরাস্তা। চব্বিশে সেপ্টেম্বর মান্নান খানের নেতৃত্বে একটা বড় দল চৌরাস্তার দুই প্ৰান্তে সারারাত অবস্থান নিয়ে বসে থাকে। মান্নান খানের দলকে সাহায্য করার জন্য মজনু মৃধার নেতৃত্বে আর একটা দল চন্দরদিয়া পুলের কাছে অবস্থান নেয়। এই দলের দায়িত্ব ছিল দুটো। প্রথমত মান্নান খানের দল বিপদে পড়লে পাক বাহিনীকে পেছন থেকে আক্রমণ করা। দ্বিতীয়ত যদি পাক বাহিনী আক্রান্ত হয়ে চন্দরদিয়া দিয়ে পালাতে থাকে তবে তাদের সেখানে আক্রমণ করা।

পরিকল্পনা অনুযায়ী দু’দলই যার যার অবস্থানে সারারাত বসে থাকে; কিন্তু সম্ভবত আমাদের এ অবস্থানের কথা পাক বাহিনী আগেই জেনে যায়। তারা শাসপুরের রাস্তায় না এসে ভোরবেলা হঠাৎ করে চন্দরদিয়ায় অবস্থানরত মজনু মৃধার দলকে পেছন থেকে আক্রমণ করে বসে।

এই অতর্কিত আক্রমণে প্রথম হকচকিয়ে গেলেও পরে মজনু মৃধা, আবদুল আলী মৃধা, আমজাদ, মানিক, ইদ্রিস, নজরুল ও অন্যরা অসীম সাহসের সঙ্গে পাক বাহিনীর আক্রমণ মোকাবেলা করতে থাকে। আমজাদের রাইফেলের গুলি একটা আর্মির ট্রাকের ড্রাইভারকে বিদ্ধ করে। ফলে নিয়ন্ত্রণহীন ট্রাকটা রাস্তার পাশে উল্টে পড়ে এবং চারজন সৈন্য নিহত হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও মজনু মৃধার দলের ওপর পাক বাহিনীর আক্রমণ তীব্রতর হতে থাকে।

এক সময় মজনু মৃধা তার দলকে পিছু হটতে নির্দেশ দেন। পিছু হটতে গিয়ে প্রথমেই গুলিবিদ্ধ হয় মানিক। তার একটু পরেই ইদ্রিসের গুলি লাগে। মজনু মৃধার দল আক্রান্ত হয়েছে শুনে মান্নান খান তার দলবলসহ ছুটতে ছুটতে চন্দরদিয়ায় এসে পৌঁছায়। এ অবস্থায় মজনু মৃধা তার সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলেন এবং অসীম সাহসিকতার সঙ্গে এসএমজি দিয়ে গুলি করতে করতে আবার পাক বাহিনীর দিকে এগিয়ে যান। তাকে পেছন থেকে কভার দিতে থাকে মান্নান খান, আমজাদ আর আব্দুল আলী মৃধা।

যুদ্ধের এক পর্যায়ে পাক বাহিনী ও আমাদের যোদ্ধারা রাস্তার এপারে আর ওপারে মুখোমুখি অবস্থানে চলে আসে। পাক বাহিনী চিৎকার করতে থাকে, ‘সবাকো জিন্দা পাকড়ো। মজনুকো পাকড়ো।’ ইতিমধ্যে মজনু মৃধাসহ বেশ কয়েকজনের গুলি ফুরিয়ে যায়। তখন আমজাদ, নজরুল ও আব্দুল আলী মৃধা একটা-দুটো গুলি ছুড়ে কভার দিতে থাকে। আর বাকিরা পিছিয়ে আসে। প্ৰায় শেষ পর্যায়ে আমজাদের পায়ে গুলি লাগে। আব্দুল আলী মৃধার সাহায্যে আমজাদ পালিয়ে আসতে পারলেও নজরুল পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে।

এই যুদ্ধে আমরা হারালাম আমাদের দুই সাহসী যোদ্ধা মানিক আর ইদ্রিসকে। নজরুল একটা রাইফেলসহ ধরা পড়ে। পাকবাহিনীর সাতজন মারা গেলেও আমরা কোনো অস্ত্ৰ সংগ্ৰহ করতে পারিনি। আমাদের যোদ্ধারা অসীম বীরত্ব প্রদর্শন করলেও সার্বিকভাবে আমাদের ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী। এ রকম পরিস্থিতিতে সবার মাঝেই হতাশা সৃষ্টি হতে পারে। যোদ্ধাদের মনোবল ও আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার জন্য নতুনভাবে অ্যাকশনের পরিকল্পনা নেয়া হয়।

ভারতের কান্দি সেতু উড়াতে হবে। মজনু মৃধার নেতৃত্বে বারোজনের দল বাছাই করা হলো। দুটো এলএমজি, দুটো স্টেনগান, একটা এসএমজি আর বাকি সব রাইফেল। সঙ্গে কয়েকটা হ্যান্ড গ্রেনেড ও বিস্ফোরকও রয়েছে।

সেতুটা পাক বাহিনী দিন-রাত পাহারা দেয়। সেতুর দুই পাশেই বাঙ্কার আছে। আমাদের পর্যবেক্ষক দল আগেই খবর দিয়েছে, সাধারণত ভোর ৬টার দিকে গার্ডরা। বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে এসে হাঁটাহাঁটি করে। আমরা ঠিক করি, ঐ সময় সেতুর দুদিক থেকে এক সঙ্গে আক্রমণ করা হবে ।

শেষ রাতের দিকে আমরা ছয়জন করে দুই দলে ভাগ হয়ে সেতুর দুই দিকে অবস্থান নিলাম। ভোরবেলা দেখা গেল মজন মৃধা যেদিকে অবস্থান নিয়েছেন, সেদিকের গার্ডরা বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে আসছে; কিন্তু আমাদের দিকের বাঙ্কারের গার্ডরা তখনো বাঙ্কারেই রয়ে গেছে। ফলে মজনু মৃধার দল আমাদের আগেই আক্রমণ শুরু করে দিল। প্ৰথম আক্রমণেই চারজন ধরাশায়ী। কিন্তু আমাদের দিকের বাঙ্কার থেকে প্রতিরোধ শুরু হলো। প্রায় কুড়ি-পঁচিশ মিনিট প্রচণ্ড গোলাগুলি চলে। আমরা কয়েকটা গেনেডও ব্যবহার করি। শেষ পর্যন্ত গার্ডরা আর প্রতিরোধ না করে পালিয়ে যায়। ফেলে রেখে যায় ছয়টা মৃতদেহ। বাঙ্কার থেকে আমরা তিনটা চাইনিজ রাইফেল ও চার বাক্স গুলি উদ্ধার করি। ফিরে আসার আগে আমরা বিস্ফোরকের সাহায্যে সেতুটা ধ্বংস করে দেই।

সেতু থেকে তিন-চারশ’ গজ দূরে রাস্তার একজন পাক সেনাকে আমরা গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বন্দি করি। তার বাঁ পায়ের উরুতে আর ডান কাঁধে গুলি লেগেছে। প্রচুর রক্ত ঝরছে। বাঁচার আশা কম। তবু তাকে ধরাধরি করে কাছের একটা স্কুলঘরে নিয়ে এলাম। ঘণ্টা দুয়েক বেঁচে ছিল। মরার আগে সে একটা পোস্টকার্ড আমাদের হাতে দিয়ে বলল, ‘আমি জানি আমি আর বেশিক্ষণ বাঁচব না। আমার একটা অনুরোধ, আমার বিবির কাছে লেখা এই চিঠিটা পোস্ট করে দিও। আমার বিবি জানুক, আমি বেঁচে আছি’।

নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকেই বোঝা যাচ্ছিল যুদ্ধ প্ৰায় শেষ হয়ে আসছে। পাক বাহিনীর মনোবল ভেঙে যাচ্ছে। এ সুযোগে আমরা পাক বাহিনীর ওপর কয়েকটা আক্রমণ চালাই। আক্রমণগুলো ছিল স্বল্পস্থায়ী এবং আচমকা। নভেম্বরের শেষদিকে আমরা শিবপুরকে মুক্ত করি।

তেরো ডিসেম্বর আমাদের যোদ্ধারা নরসিংদী মুক্ত করে। টিএন্ডটি অফিসে অবস্থিত পাক বাহিনীর মূল ক্যাম্পটি দখল করে সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ভারতীয় বাহিনী তখন নরসিংদী থেকে অনেক দূরে। মাত্র ভৈরব পর্যন্ত পৌঁছেছে।

ক্যাম্প দখলের পর ভেতরে ঢুকে অস্ত্রের সম্ভার দেখে আমরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই। ঘর বোঝাই হালকা ও ভারী মেশিনগান। থরে থরে সাজানো রকেট লঞ্চার আর দুই ইঞ্চি মর্টার। অফুরন্ত গোলা-বারুদ আর গ্রেনেড।

কিন্তু এ অস্ত্ৰ আমরা আমাদের দখলে রাখতে পারলাম না। কারণ অল্পক্ষণের মধ্যেই একটা হেলিকপ্টার নামল। তাতে কয়েকজন ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসার ও কয়েকজন ভারতীয় সৈনিক। তারা আমাদের যোদ্ধাদের নরসিংদী মুক্ত করার জন্য ধন্যবাদ জানালো এবং ওই ক্যাম্পের দায়িত্ব তাদের হাতে ছেড়ে দিতে বললো। আমরা দখল করা অস্ত্ৰ সম্ভার ভারতীয় বাহিনীর হাতে তুলে দিয়ে ব্যথিত হৃদয়ে শিবপুর ফিরে এলাম।

রচনাকাল ২০০১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!