২৬ মার্চ ছিল যুদ্ধে নামার দিন
কর্নেল মোহাম্মদ আব্দুস সালাম (অব.), বীর প্রতীক
ঢাকায় তৎকালীন জিন্নাহ্ কলেজের (বর্তমানে তিতুমির কলেজ) একজন স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র হিসেবে অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। নিজ কর্মতৎপরতার জন্য তৎকালীন জিন্নাহ কলেজের প্রতিনিধি হিসেবে ঢাকা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের একজন কর্মতৎপর সদস্য ছিলাম। ৩ মার্চ এবং ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সভায় উপস্থিত থাকারও সুযোগ হয়েছিল। তৎকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম প্রতিরোধ আন্দোলন এবং প্রয়োজনে সশস্ত্ৰ আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়। আমাকে নিজ শহর সিলেটে গিয়ে এ দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়। প্রতি জেলাতেই আলাদাভাবে সর্বদলীয় ছাত্ৰ সংগ্রাম পরিষদ ছিল। আমরা বিশেষ করে গোপনে সশস্ত্ৰ সংগ্রামের প্রস্তুতিপর্বে নিয়োজিত ছিলাম। সপ্তাহ ২/১ কাজীটুলার টিলার পেছনে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ পদ্ধতি নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম আমরা কয়েকজন। জিন্দাবাজারের এক বাসায় বসে আমরা গানপাউডার / মলটভ ককটেল / বোমা তৈরি কাজে নিয়োজিত ছিলাম। এমতাবস্থায় দ্রুত পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি আমাদের চিন্তিত করে তোলে। এবং প্রস্তুতিপর্বে যথেষ্ট প্রতিবন্ধকতা আসে।
এমনি এক সময় ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১০ টার সময় আমার বড়ভাই মরহুম আবদুর রব সিলেট শহর থেকে আমাদের এয়ারপোর্ট রোড, চৌকিদেখীর বাসায় আসেন। তড়িঘড়ি করে বলতে থাকেন, শহরের অবস্থা বিপজ্জনক, অস্বাভাবিকভাবে সামরিক বাহিনীর গাড়ি চলাচল করতে দেখা যাচ্ছে। ইয়াহিয়া খান ভাষণ দিয়েছেন। খবর শুনেই আমি ও আমার বড়ভাই শহরের দিকে আমার সবচেয়ে বড়ভাই মরহুম আবদুল হাই-এর কালীঘাটের বাসায় গেলাম। সেখানে আমার আরেক ভাই মোঃ আবদুল বাসিত-এর সঙ্গেও দেখা হয়। তিনি তখন সিলেটের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদেরও একজন সক্রিয় সদস্য। আমরা আমাদের নিজস্ব দু’টি শটগান নিয়ে গাড়িতে করে প্রথমেই দেওয়ান ফরিদ গাজী এমপির বাসায় যাই। দেওয়ান ফরিদ গাজী তখন সিলেটের রাজনৈতিক দলগুলো অসহযোগ আন্দোলনের প্রধান সমন্নয়কারী। রাত সাড়ে ১১ টার দিকে তার বাসায় গিয়ে শুনতে পাই, তিনি গাড়ি নিয়ে বের হয়েছেন। তাকে না পেয়ে আমরা আর একজন এমপির বাসায় যাই। তাকেও বাসায় পাওয়া যায়নি। শহরের পরিস্থিতি দেখার জন্য আমরা শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ঘোরাফেরা করি। কিন্তু রাস্তা প্রায় জনশূন্য এবং সামরিক বাহিনীর লোকজন থামায় এবং ঘোরাফেরা না করার জন্য সতর্ক করে দেয়। সিদ্ধান্ত হয় আমাকে সিলেট মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে নামিয়ে দিয়ে আমার ভাইরা সবাই কালীঘাটে আমার বড়ভাইয়ের বাসায় গিয়ে অপেক্ষা করবেন এবং আমি তাদের সঙ্গে পরে যোগাযোগ করবো।
অসহযোগ আন্দোলনে শহরে অবস্থিত সিলেট মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা তুলনামূলকভাবে অনেক তৎপর ছিল। আমি প্রায়ই মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে যেতম এবং ডা. দেলোয়ার (রানা), ডা. নজরুল ইসলাম, ডা. আহাদসহ অনেকে কীভাবে অসহযোগ আন্দোলনে আরো গতিসঞ্চার করা যায় এবং সশস্ত্ৰ বিপ্লব-এর বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রায়ই মিটিং এবং আলোচনা করতাম। আমরা বিভিন্নভাবে প্রতিরোধ এবং সশস্ত্ৰ সংগ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তাই সিলেট মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে গিয়ে আমি সবাইকে একসঙ্গে আলোচনায় পাই এবং কী করণীয় ভাবতে থাকি। হঠাৎ পুলিশ রিজার্ভ লাইন যা মেডিকেল কলেজের স্টাফ কোয়ার্টারের পশ্চিম পার্শ্বে অবস্থিত, সেখান থেকে একজন বেসামরিক ব্যক্তি হয়তবা বাবুর্চি বা মালি এসে জানায় যে সামরিক বাহিনী পুলিশ লাইনের চতুর্দিকে অবস্থান নিচ্ছে এবং পুলিশরা ভীতসম্রস্ত অবস্থায় রয়েছে। হোষ্টেলের ছাত্রদের তাদের সাহায্য করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে পাঠিয়েছে রিজার্ভ লাইনের ইন্সপেক্টর। খবর শুনেই আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে আমাদের যেভাবেই হোক শটগান, বন্দুক, বল্লম ইত্যাদি নিয়ে লোক জড়ো করে প্রতিরোধ গড়তে হবে। আমি, ডা. দেলোয়ার রানা, ডা, বুলু একটি অ্যামবুলেন্স নিয়ে বের হই; কেননা ইতোমধ্যে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা বেসামরিক গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। ডা. দেলোয়ার রানাসহ আমরা আবারো দেওয়ান ফরিদ গাজীর বাসায় যাই, কিন্তু তার কোনো সন্ধান পাইনি। সিলেট মেডিকেল কলেজের তৎকালীন সার্জারির প্রফেসর শহীদ ডা. শামসুদ্দিন আহমদ যিনি তৎকালীন মেডিকেল কলেজের ছাত্র-শিক্ষক সবারই একজন প্রিয় ব্যক্তিত্ব এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন দিকনির্দেশক ও উপদেষ্টা এবং সংগ্রামের চেতনার প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করে আসছিলেন, ডা. দেলোয়ার রানা তার বাসায় যাওয়ার জন্য প্ৰস্তাব করেন। আমিও সে প্ৰস্তাবে রাজি হই। কারণ আমি জানি যে আমার বন্ধু ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদ (তখন মেডিকেল কলেজের ছাত্র)- এর সঙ্গে দেখা হবে এবং তাকেও আমাদের সঙ্গে পাবো এবং আমি জানতাম তার কাছে থেকে শটগান এবং কিছু গুলিও সংগ্ৰহ করা যাবে। আমরা আনুমানিক রাত সাড়ে ১২ টার সময় প্রফেসর শামসুদ্দিন আহমদের বাসায় যাই। প্রফেসর শামসুদ্দিন আহমদ ঘুম থেকে উঠে আসেন এবং আমাদের বসতে বলেন। তিনি আমাদের কাছে থেকে বিস্তারিত পরিস্থিতি সম্বন্ধে অবগত হন। তখন তাকে ভীষণ ভারাক্রান্ত বলে মনে হয়। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘এই অবস্থায় তোমরা খালি হাতে কী করবে? ওদের সঙ্গে লড়াই করা তোমাদের পক্ষে অসম্ভব। যাই হোক সাবধানে চলাফেরা কর এবং সকালে আমি ভেবে দেখি কী করা যায়।’ আমি তার কাছে আমাদের কিছু বন্দুকের গুলি দিতে অনুরোধ করি। তিনি কোনো কথা না বলে দুই বাক্স শটগানের গুলি এনে আমাকে দিয়ে খুব সাবধানে থাকতে উপদেশ দিলেন। সেদিন আমি জানতাম না যে, আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় এই ব্যক্তিকে কর্মরত অবস্থায় ৯ এপ্রিল তার সহকর্মী ডা. লালা, অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার সোহরাবসহ মোট ৭ জনকে বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী হাসপাতালে ঢুকে সার্জারি ওয়ার্ড থেকে বের করে লাইন দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করবে। তার সঙ্গে আমার এটাই ছিল শেষ দেখা। তার অবদানের কথা এ জাতি কোনো দিনই ভুলবে না। অসহায় অবস্থায় আমাদের সবার চোখে তখন পানি।
তবুও কিছু একটা করতে হবে। যে কোনো অবস্থায় পাকিস্তানি সেনাদের মোকাবেলা করতে হবে। আমরা তার বাসা থেকে বের হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম আবার আমরা মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে গিয়ে পুলিশ লাইনের চতুর্দিকে অবস্থান গ্ৰহণ করবো। সিলেট পুলিশ লাইনের উত্তর-পূর্ব দিকে মিরের ময়দান এবং মেডিকেল কলেজের স্টাফ কোয়ার্টার এলাকায় ৪/৫টি শটগান নিয়ে আমরা ১০/১৫ জন অবস্থান গ্ৰহণ করি। রাত প্ৰায় ১.৩০ টার সময় পুলিশ লাইনের পুলিশরা সাহস পায়। কিন্তু ঘন্টাখানেক-এর মধ্যে জানা যায়, সিলেট রিজার্ভ পুলিশ লাইনের সবাইকে নিরস্ত্র করা হয়েছে। ২/১ জন পুলিশের সদস্য ভয়ে বেসামরিক পোশাকে পেছন দিয়ে পালিয়ে এসে আমাদের খবর জানায়। আমি তখন এডভোকেট মুশতাক এবং জহিন আহমদ চৌধুরীর বাসার পেছনে বন্দুক হাতে অবস্থান নেই এবং অন্যদের সঙ্গে আলাপ করে সাধারণ জনগণকে পরিস্থিতি জানানোর সিদ্ধান্ত নেই। আমরা যখন মধ্যরাতে বিভিন্ন পাড়ায় যাই তখন বুঝতে পারি, অনেক লোকজন নিজ নিজ বাসায় জেগে আছে, কিন্তু ভয়ে কেউই দরজা খুলছে না। আমি ডা. দেলেয়োরের সঙ্গে আলাপ করে ডা. বুলুকে সঙ্গে নিয়ে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে আমার এলাকায় যাই এবং আমাদের এলাকার মেম্বার মরহুম হামিদ মিয়ার বাড়িতে গিয়ে কথা বলি। হামিদ মিয়া, খালেক, সাত্তারসহ তার বাড়ির এলাকায় ছিলেন এবং তারাও আমাকে দেখে আমার সঙ্গে যোগ দেন। আমরা পাড়ার লোকজনকে নিয়ে মিছিল করার জন্য সিদ্ধান্ত নেই। তখন হামিদ মিয়া বলেন, চা বাগান ছাড়া এতরাতে কোনো লোক পাওয়া যাবে না। লেবার বস্তিতে একজন চৌকিদারকে জিজ্ঞেস করি আমরা বস্তির লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে চাই। সে বলে এত রাতে পাগলা ঘন্টা ছাড়া কেউ আসবে না। লেবার বস্তিতে একটি ঘন্টা ঝুলানো অবস্থায় থাকে, যে কোন বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে এই ঘন্টা বাজানো হয় এবং লেবাররা সাধারণত তীর/বল্লম নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। আমরা তাৎক্ষণিকভাবে পাগলা ঘন্টা বাজালাম এবং প্রায় ১৫০ লেবার দাও/বল্লম এবং তীর ধনুক নিয়ে বের হয়ে আসে। সবাই তাদের পূজাঘরের কাছে আসলে আমি অতি সংক্ষেপে এক বক্তৃতা করি এবং সব পরিস্থিতি সম্বন্ধে সবাইকে অবগত করি। তাদের আমাদের সঙ্গে সব হাতিয়ার নিয়ে শহরের দিকে যাওয়ার জন্য আহবান জানাই। তারা সবাই সম্মত হয় এবং প্রায় ভোর ৫ টার সময় আমরা মিছিল করে লাক্কাতুরা হতে আম্বরখানা হয়ে চৌহাট্টায় যাই। কিন্তু অন্য কোনো পাড়া বা এলাকা থেকে কোনো মিছিল বা লোকজন আসতে দেখা যায়নি।
আমরা প্ৰায় দু’শতাধিক লোক যখন চৌহাট্টায় পৌঁছাই তখন মহিলা কলেজের সম্মুখে সেনাবাহিনী এক লাইনে দাড়িয়ে রাস্তার ওপর ফায়ারিং পজিশন নেয়। আমি তখন সবাইকে সাবধান করি, কিন্তু আমাদের প্রস্তুতি গ্রহণের আগেই তারা মিছিল লক্ষ্য করে গোলাগুলি শুরু করে। ২/৩ জন শ্রমিক আহত হয় এবং আমরা তাড়াতাড়ি করে সদর হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে পড়ি। কিছুসংখ্যক লোক সেন্ট্রাল ফার্মেসির পেছনের পিচ্ছিল গলি দিয়ে পালিয়ে যায় এবং কিছুসংখ্যক লোক মাদ্রাসার নিরাপদ এলাকায় ঢুকে পড়ে। সিলেট শহরে সেনাবাহিনী প্ৰথম গুলিবর্ষণ করে এই মিছিলের ওপর। আমরা আমদের শটগান ও গোলাবারুদসহ হাসপাতালে ঢুকে পড়ি, তখন কর্মরত ডাক্তার ও কর্মচারীরা আমাদের অস্ত্ৰ-সন্ত্র বাথরুমে ছাদের ওপর লুকিয়ে রেখে দেয় এবং আমরা হাসপাতালে অবস্থান করি।
ইতোমধ্যে পাক সেনাবাহিনীর সদস্যরা সব হাসপাতাল ঘেরাও করে রাখে এবং শহরে কারফিউ থাকার জন্য লোকজন রাস্তায় বের হতে পারেনি। আমরা পরিস্থিতি জানার জন্য হাসপাতাল এলাকায় লুকিয়ে থাকি এবং আনুমানিক ২৬ মার্চ সাড়ে ১০ টার সময় হাসপাতাল থেকে গোপনে বের হয়ে হযরত শাহজালালের (রঃ) দরগার ভেতর দিয়ে নিজ বাসায় ফিরে আসি এবং অন্যদের নিজ নিজ এলাকায় পাঠিয়ে দেই। আহত শ্রমিকদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরদিনও কারফিউ থাকার জন্য আমরা গোপন রাস্তা দিয়ে শহরের বিভিন্ন স্থানে মিটিং করে করণীয় নিয়ে আলোচনা করি। ২/৩ দিন পর আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে আমাদের অস্ত্ৰ সংগ্রহ এবং সশস্ত্ৰ যুদ্ধ ছাড়া কিছুই করা সম্ভব হবে না, এমনই এক মুহূর্তে চট্টগ্রামে কালুরঘাট রেডিও স্টেশন থেকে মেজর জিয়াউর রহমানের বক্তৃতা শুনে আমি, ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ, আনিস, ডা. বুলুসহ কয়েকজন সিদ্ধান্ত নেই, আমরা ভারতে পালিয়ে গিয়ে গোপনে অস্ত্ৰ সংগ্রহ করে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দেব। ২৮ মার্চ শহর থেকে আমি, ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ সাদেক, ডা. বুলু এবং আনিস আমাদের গ্রামের বাড়িতে যাই এবং পরে ভারত হয়ে তেলিয়াপাড়ায় গিয়ে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করি। লে. কর্নেল মোহাম্মদ আবদুর রব আমাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য তেলিয়াপাড়ায় নিয়ে যান।
তারপরের ইতিহাস আরেক উপাখ্যান ।
রচনাকাল ২০০৬