You dont have javascript enabled! Please enable it! একাত্তরের স্মৃতি | নিজামউদ্দিন লস্কর - সংগ্রামের নোটবুক

একাত্তরের স্মৃতি

নিজামউদ্দিন লস্কর

বরফ গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। আজ আমার চারদিকে, বরফগলা নদীর জন্ম হতেও আর বেশি দেরি নেই। আমার বিবেকের শপথ নিয়ে তাই একাত্তরের স্মৃতিকে রোমন্থন করতে বসেছি।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। একেকজনের একেক রকমের স্মৃতি। একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঘটে যাওয়া অযুত-নিযুত ঘটনার স্মৃতি। এই স্মৃতির বসতি শুধু মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, রাজনীতিবিদ কিংবা সাংবাদিকদের বুকের গভীরেই নয়, বরং যারা সেদিন এই যুদ্ধ দেখেছে, যাদের চোখের সামনে সংঘটিত হয়েছে হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর বর্বরতার নারকীয় অধ্যায়, যারা অতিক্রম করেছে এই দিনগুলো, তারা সবাই এই স্মৃতির ধারক ও বাহক। মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ছবিটি তাই অনেকটা ‘জিগ সো পাজলের’ মতো আমাদের আজকের প্রজন্মের কাছে উপস্থিত হচ্ছে। অস্বচ্ছ, অস্পষ্ট, জানালার শার্সিতে ঠিক যেন কুয়াশার ছায়ার মতো। একটি পূর্ণাঙ্গ ছবি, অযুত-নিযুত করছে। স্মৃতির অতল অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার আগেই মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ছবিটিকে হস্ত আন্তর করতে হবে বর্তমান প্রজন্মের কাছে। অন্যথায় জাতি হিসেবে আগামী পৃথিবীর ইতিহাসে আমাদের জন্য সম্মানজনক কোনো স্থান বরাদ হবার সম্ভাবনা মোটেই নেই। এই প্রশ্নটি সামনে রেখে, ব্যক্তিগত আবেগ এবং অহংবোধকে বিসর্জন দিয়ে আমাদের সবাইকে তাই ঝাঁপ দিতে হবে বুকের গভীরে, যেখানে স্মৃতি নামক মানবিক অনুভূতিগুলো বরফের মতো শক্ত এবং জমাট হয়ে আছে। সেই বরফকে মারাত্মক যত্নসহকারে গলাতে হবে। জন্ম হবে তখন অসংখ্য বরফগলা নদীর। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তিগুলো সব বাধা-বিপত্তির পাহাড় ডিঙ্গিয়ে এই নদীগুলোর মিলনে তখন সৃষ্টি হবে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তে গড়া সেই মহাসাগরের। তখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়বে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ছবিটি; আমাদের সন্তানদের চোখের সামনে।

যুদ্ধের মাঠের, আমার শেষ দিনটির শেষ মুহুর্তের ঘটনা দিয়ে আরম্ভ করছি। আজকের স্মৃতিচারণ শুরুর দিনগুলোকে উপস্থাপন করার মতো সময় এবং সুযোগ প্রার্থনা করছি মহান স্রষ্টার কাছে।

১৬ আগস্ট একাত্তর। সোমবার। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হয়তো এই দিনটির স্মৃতি আমি বহন করে বেড়াবো। স্থান আহসানমারা ফেরি এবং জয়কালস ব্রিজের মাঝামাঝি। সুনামগঞ্জ থেকে সিলেট রওনা হলে ৯ মাইল পার হতেই জায়গাটি পাওয়া যায়। সন্ধ্যা

৯৪

তখন হয় হয়। যুদ্ধের মাঠ থেকে বিদায় নেয়ার পালা আমার। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নৌকার পাটাতনে শুয়ে আছি। বাম পায়ে এসে কিছু একটা লাগলো। মনে হলো পাথরের টুকরো। গুলি অথবা গ্রেনেডের আঘাতে পাথর ফেটে গিয়ে অনেক সময় এরকম আঘাত লেগে থাকে। এই অভিজ্ঞতা অনেকের মতো আমারও হয়ে গিয়েছে ইতোমধ্যে। ব্যথাও খুব একটা লাগেনি। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে আমার বাম পা ভাঁজ হয়ে আসতে লাগলো। বসে পড়লাম মাটিতে প্ৰায় সঙ্গে সঙ্গে। হাত দিতেই ঠাণ্ডা রক্তে তা ডুবে গেল। তখন টের পাইনি কিসের আঘাত লেগেছে। পায়ের উল্টোদিকে হাত দিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় হবার কোনো চিহ্ন খুঁজে পেলাম না। ইত্যবসরে ধরাধরি করে অন্যরা আমাকে তুলে নিয়ে নৌকার পাটাতনে শুইয়ে দিল। সহযোদ্ধা শামছুল হক খুব শক্ত করে গামছা বেঁধে দিল আমার পায়ের রক্ত বন্ধ করার জন্য। নৌকা ছেড়ে দিলাম আমরা-যে গ্রামে উঠেছিলাম সেই গ্রামটির উদ্দেশ্যে। গ্রামটির নাম বইয়াখাউরি, লেখায়-পড়ায় বশিয়াখাউরি। জয়কলস, উজানিগাউ-এর কাছাকাছি গ্রামটির অবস্থান। আমরা অবস্থান করছি গ্রামটিতে। যারা বালাট সাব-সেক্টর থেকে এসে গত বারো দিন যাবৎ বাড়িতে অবস্থান করছিলাম, ভদ্রলোকের নাম দানিছ মিয়া। ১৯৯০ সালে মারা গেছেন তিনি। ভীষণ সাহসী লোক ছিলেন। আমাদের পঞ্চাশ থেকে ষাটজন লোকের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হাসিমুখে করে দিয়েছিলেন তিনি তার বাড়িতে। সুনামগঞ্জের এমএনএ মরহুম দেওয়ান ওবায়দুর রাজা সাহেব আমাকে বলেছিলেন, তার সঙ্গে এসে যোগাযোগ করার জন্য, সঙ্গে একটি চিঠিও নিয়ে এসেছিলাম রাজা সাহেবের হাতের লেখা। কারণ বিশ্বস্ত লোক ছাড়া ওই সময় কোথাও ওঠা কল্পনাতীত ব্যাপার ছিল আমাদের জন্য। সন্ধ্যা পার হবার পর আমরা গিয়ে পৌঁছলাম বইয়াখাউরিতে। দানিছ মিয়া সাহেবের ছোট ভাই আনিছ মিয়া সাহেব ছিলেন একজন গ্ৰাম্য ডাক্তার। তিনিও আজ বেঁচে নেই। আমাকে দেখলেন তিনি। এন্টিসেপটিক জাতীয় লোশন দিয়ে আমার ক্ষতস্থান ধুয়ে পরিষ্কার করলেন তিনি প্রথমে। আমার একপাশে মুক্তিযুদ্ধারা, আর অন্যপাশে দানিছ মিয়াসহ তার পরিবারের লোকজনরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে। পায়ে তখন যন্ত্রণা শুরু হয়েছে, তবে সহ্যের বাইরে নয়। খুব যত্নসহকারে একটি কাঠির আগায় তুলো পেঁচিয়ে আমার ক্ষতস্থান পরীক্ষা করে ডাক্তার সাহেব বললেন ‘গুলি লেগেছে এবং গুলিটি আটকে আছে। অপারেশন ছাড়া কোনো অবস্থাতেই বের করা সম্ভব নয়’। তিনি খুব শক্ত করে ব্যান্ডেজ করে দিলেন, আর একটি এন্টিটিটেনাস ইঞ্জেকশন দিলেন। এর চেয়ে বেশি কিছু করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। সেদিন। এক কাপ গরম দুধ বাড়িয়ে দিলেন একজন মহিলা আমার দিকে। কে যেন আমার মাথাটা উঁচু করে ধরলো। দুধপান করার সময় অভূতপূর্ব একটি দৃশ্য দেখলামমুক্তিযোদ্ধারা কাঁদছে, বাড়ির মেয়ে-পুরুষ সবারই চোখে পানি, সবাই কাঁদছে, শুধু আমি ছাড়া। ওই চোখের পানি প্রতিটি বিন্দুকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার বলে মনে হয়েছিল সেদিন আমার কাছে। চোখের নিমিষে মুছে গেল সব যন্ত্রণা। আমি আহত হয়ে সেদিন আনন্দিত হলাম      ধন্য হলাম গর্বিত হলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে এও জানালাম ‘মরণেও সুখ আছে’।

৯৫

দানিছ মিয়া ছাড়া বাড়ির সব আমার ইশারায় আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। মুক্তিযোদ্ধা এই দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছিলাম আমি। সহকারী কমান্ডার শামছুল হকের হাতে সোপর্দ করলাম আমার পরবতী দায়িত্ব। ছইওয়ালা একটি নৌকাতে আমিসহ আরো তিনজন মুক্তিযোদ্ধা, তার মধ্যে দু’জন বেশ কিছুটা আহত এবং গাইড মজলিসকে সঙ্গে নিয়ে ওই রাতেই রওনা হলাম বালাটের উদেশে। দু’জন মাঝিসহ আমরা মোট পাঁচজন। নৌকা ভাসালাম হাওরের বুকে। হাওরটির নাম করছা। নিকষ অন্ধকারের বুক চিরে এগোচ্ছে আমাদের নৌকা। বৃষ্টির একটানা শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রণাও বাড়াতে লাগল। মায়ের মুখটি মনে পড়ল এই প্ৰথম, গুলি খাওয়ার পর। বাবাসহ ভাইবোন সবার কথা ভীষণভাবে মনে হতে লাগলো, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দুর্ভাগ্যের মূল চিত্রটি সম্পূর্ণ অন্য আদলে ধরা পড়লো আমার কাছে। ভাবলাম, পালিয়ে যাচ্ছি আমি, চোরের মতো, নিজের দেশ ছেড়ে, মা, বাবা, ভাইবোন সবার অজাত্মে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। আমারই দেশের কোনো হাসপাতালে ভর্তি হবার বিন্দুমাত্র সুযোগ কিংবা অধিকার আজ আমার নেই। প্ৰচণ্ড যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির বিশাল ব্যাপ্তি আমার বোধে তখন উন্মোচিত হলো। বিস্ময়কর এই শব্দটিকে জীবনে এই প্ৰথম আমার প্রণতি জানালাম ।

১৭ আগস্টের সকাল। বৈঠার ছপৃ ছপৃ আওয়াজে বুঝতে পারলাম, হাওরের বুকে ভাসছি এখনো আমরা। রাতের শেষপ্রহরে আমার নাকি প্রচণ্ড জ্বর উঠেছিল। জুরের ঘোরে প্রলাপ বকেছি, যন্ত্রণায় চিৎকার করেছি। শুধু, ঘুমুতে পারিনি এক ফোটাও । সহযাত্রীরা সবাই মিলে অবিরাম পানিপট্টি দিয়েছে আমাকে। যন্ত্রণার এমন একটি স্তর রয়েছে, যেখানে পৌছানোর পর আর কোনো যন্ত্রণাই টের পাওয়া যায় না-এই অভিজ্ঞতাও ছিল না আমার। জুর নাকি খানিকটা কমেছে এখন, জুর কমার সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রণা বেড়ে গেলো আবার। আরো কয়েক ঘন্টার পথ পাড়ি দিতে হবে, অসহ্য যন্ত্রণার কবল থেকে মুক্তি পাবার জন্য প্রার্থনা করলাম যেন জ্বরটা আবার বাড়ে, তাহলে আর কিছু না হোক অসহনীয় যন্ত্রণার হাত থেকে সাময়িক ছুটি অন্তত পাওয়া যাবে। জ্বর বাড়লো না এবং যন্ত্রণাও কমলো না বরং নানারকম এলোপাতাড়ি দুশ্চিন্তা এসে ভর করল। মাথায়। হিসাব করে দেখলাম, প্ৰায় চৌদ-পনেরো ঘন্টা পার হয়েছে গুলি খাওয়ার পর, অথচ এখনো বলতে গেলে কোনো চিকিৎসা হয়নি, তাছাড়া রক্ত পড়ছে ক্ষতস্থান থেকে চুইয়ে চুইয়ে, মাথা ঝিম ঝিম করছে। হঠাৎ মনে হলো-মারা যাচ্ছি। আমি, মরে যাওয়ার মারাত্মক একটা ভয় এসে আক্রমণ করলো আমাকে, ভীষণ কান্না পেল। ভাবলাম, এমন একটি পরিবেশে মারা যাচ্ছি। আমি, যেখানে আমার মা, বাবা, ভাইবোন কেউ উপস্থিত নেই, অর্থাৎ ঘটা করে সবার সামনে মরতে চাইছিলাম আমি। যুদ্ধক্ষেত্রে এহেন মৃত্যু কল্পনাও করা যায় না, ব্যাপারটি আমার মাথায় ওই মুহূর্তে মোটেই ঢুকছিল না। ভয়ে সব শরীর কাঁপতে লাগলো। ফেলে আসা জীবনে এ যাবৎ সচেতন কিংবা অবচেতনভাবে যত অন্যায় অপরাধ করেছি, সবকিছুর জন্য অনুশোচনা হতে লাগল, কলেমা পাঠ করা শুরু করলাম জোরে জোরে, কোরআন শরীফের মুখস্থ সুরাগুলো সব একে একে তেলাওয়াত করতে থাকলাম। এভাবে কতক্ষণ কেটেছে জানি

৯৬

না, তবে একসময় আবিষ্কার করলাম, যন্ত্রণা আছে, কিন্তু সহ্য করতে পারছি কিছুটা, শরীরের সেই কাপন আর টের পাচ্ছি না। স্রষ্টার অস্তিত্বকে ভীষণ কাছাকাছি মনে হলো। স্রষ্টারই কৃপায় যেন হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ল-ট্রনিং সেন্টারে একজন অফিসার একদিন বলেছিলেন, চায়নিজ বুলেট তৈরির পেছনে একটি অদ্ভুত কারিগরি দর্শন রয়েছে। সাধারণত চায়নিজ বুলেট বিশেষ কোনো দুর্বল জায়গায় না পড়লে মানুষ মরে না, শুধু আহত হয়, কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত সৈনিকের চেয়ে আহত সৈনিকের মূল্য শত্রুপক্ষের কাছে অনেক বেশি হয়। যুক্তিটিকে বেশ জোরালো মনে হলো আমার কাছে এই মুহুর্তে। আমি মারা গেলে ইত্যবসরে আমার লাশ ওই এলাকার কোথাও দাফন হয়ে যেত, অথচ আমার জন্য নৌকা ব্যবস্থা করে, সঙ্গে লোকজন দিয়ে পাঠানো হচ্ছে আমাকে চিকিৎসার জন্য। এই মুহূর্তে একজন বাতিল সৈনিক হলেও আমার ভরণপোষণ, চিকিৎসার সব বন্দোবস্ত আমার সরকারকেই করতে হবে। আহতের সংখ্যা বেশি হলে প্রচুর লোকবল এবং অর্থের বিরাট ক্ষতিসাধনের এই দর্শন যুদ্ধের স্ট্রাটেজি হিসেবে বেশ ইফেক্টিভ মনে হলো আমার কাছে। নানারকম চিন্তার স্রোতের মধ্য দিয়ে আরো কয়েক ঘন্টা কাটলো।

অবশেষ বিকেল তিনটার দিকে আমরা গিয়ে পৌঁছলাম পলাশ ইউনিয়নে । সময়ের হিসাবে প্রায় একুশ ঘন্টা পার হয়েছে আহত হওয়ার পর, আর দিনের হিসাবে আজ মঙ্গলবার, ১৭ আগস্ট। পলাশ ইউনিয়ন তখন সম্পূর্ণ আমাদের দখলে, অর্থাৎ মুক্ত এলাকা। মুক্ত এলাকার বাতাসের সংস্পর্শে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্ৰচণ্ড আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলাম মনের মধ্যে। আমাদের নৌকা কুলে ভেড়ার আগেই টহলরত সেন্ট্রির নজরে পড়লো। আমার অবস্থা দেখেই কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা দৌড়ালো গ্রামের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে লোকজন ছুটে এলো। যেতে হবে আরো পাঁচ-ছয় মাইল পথ। গুলিবিদ্ধ পা নড়াচড়া করলেই যন্ত্রণা হয়। অবশেষে গ্রামের এক মসজিদ থেকে লাশ বহন করার ‘করার’ নিয়ে আসা হলো, কুরারের মধ্যে কথা বিছিয়ে খুব সাবধানে এবং যত্ন সহকারে আমাকে শোয়ানো হলো, লোকজন এসে ভিড় করলো আমাকে দেখার জন্য, অনেকে এটা-ওটা নিয়ে এলো খাওয়াতে, খাবার আগ্রহ ছিল না মোটেই। রুচিও ছিল না। আসলে বালাটি পৌছার জন্য মারাত্মক উদগ্ৰীব হয়ে পড়েছিলাম। তারপর শুরু হলো যাত্রা, লোকজনের কাঁধে চড়ে। জীবিত অবস্থায় কারো ভাগ্যে মৃতদেহের কুরার চড়ার সুযোগ হয়েছে কিনা জানি না, তবে আমার হলো। গিয়ে পৌঁছলাম একসময় পলাশ ইউনিয়নের শেষ প্রান্তে, পাহাড়ি নদী মাইলামের তীরে, ওপারে বলাট, ভারত সীমান্তের শুরু সেখান থেকেই। ট্রাঞ্জিট ক্যাম্পের তাঁবুতে নামানো হলো আমাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুট করা হয় এই ক্যাম্প থেকে।

তাঁবুর ভেতরে মাটিতে শুয়ে আছি আমি। রিক্রুটিং ক্যাম্পের ইনচার্জ তাঁবুর পর্দা সরিয়ে এসে ঢুকলেন, আমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে সাপ দেখার মতো চমকে উঠলেন, মনে হলো, আমাকে এ অবস্থায় দেখতে পাবেন কোনোদিন কল্পনাও করতে পারেননি। একই অবস্থা আমারও। (মরহুম), লতিফ সরদার ভাইকে তখন আমার পাশে পাব, আমিও কল্পনা করিনি। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তার সঙ্গে এই আমার প্রথম দেখা। দৌড়ে

৯৭

এসে হাঁটুমুড়ে আমার পাশে বসলেন তিনি, ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললেন। রক্তে ভেসে যাচ্ছে আমার পা। সরদার ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, আমার অবস্থা খুব সুবিধার নয়। ছুটে বেরিয়ে গেলেন তিনি তাবুর ভেতর থেকে। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলেন। বললেন, খবর পাঠিয়ে দিয়েছেন বালাটে, ওখানে রাজা সাহেবসহ আরো অনেকে রয়েছে, ইতোমধ্যে ছোটখাটাে একটি হাসপাতালও খোলা হয়েছে আমাদের নার্স এবং ডাক্তারের মাধ্যমে। গরম দুধের ব্যবস্থা করালেন আমার জন্য, কিন্তু আমি পুরোটা পান করতে পারলাম না যন্ত্রণার কারণে। যে লোকটি খবর নিয়ে গিয়েছিল সে ফিরে এসে জানাল, রাজা সাহেব ওদিকের মুক্ত এলাকা পরিদর্শনে গিয়েছেন। ইত্যবসরে আমাদের যোদ্ধারা মঙ্গলকাটা, ষোলঘর, বেরিগাউ এবং আরো কয়েকটি গ্রাম মুক্ত করে নিয়েছে হানাদার বাহিনীর দখল থেকে। ম্যাসেঞ্জারের কাছ থেকে জানলামডাক্তার আসছে, তবে দেরি হবে কিছুটা, কারণ মাইলামে তখন ঢল নেমেছে, প্ৰায় ন’মাইল পথ ঘুরে আসতে হবে। পাহাড়ি নদীর বৈশিষ্ট্য হলো-যখন ঢল নামে, বিরাট বড় হয়ে যায় নদী, প্রচন্ড স্রোত থাকে, নৌকা নিয়ে পার হওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। আবার ঢল বন্ধ হলে হাঁটুপানিও থাকে না, একটি ছোট্ট বাচ্চাও পেরুতে পারে অনায়াসে। অধীর আগ্রহে ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। সন্ধ্যা তখন হয় হয়। তাঁবুর বাইরে মিলিটারি জিপ থামার শব্দ শুনলাম। ছুটে বেরিয়ে গেলেন সরদার ভাই। গতকাল ঠিক এই সময়ে পায়ে আমার গুলি লেগেছিল। ইন্ডিয়ান আমির অফিসার মেজর ডি সুজা, আরো একজন ভদ্রলোক এবং দু’জন মহিলা ঢুকলেন তাবুর ভেতরে, সবার পেছনে সরদার ভাই। আমাদের সাব-সেক্টরের সঙ্গে ভারতীয় পক্ষের কোঅর্ডিনেটিং অফিসার হিসেবে কাজ করার দায়িত্ব ছিল মেজর ডি সুজার। ভীষণ কড়া মেজাজের লোক। প্রায়ই মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তার খিটিমিটি লাগতো। বেশি লাগত কমান্ডারদের সঙ্গে, কারণ বিভিন্ন দাফতরিক কাজে তার কাছে কমান্ডারদের যেতে হতো, প্ৰায় সময় হস্তক্ষেপ করতে চাইতো সে আমাদের বিভিন্ন পরিকল্পনায়। পরে আমাদের সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল মীর শওকত আলী সুকৌশলে তাকে বাগে আনতে সক্ষম হন। আমার সঙ্গে ঝগড়ার মাধ্যমেই তার পরিচয়ের সূত্রপাত। প্রথম যেদিন আমরা বালাট সাব-সেক্টরে যোগ দিতে আসি, সেদিন শ্ৰী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তাকে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য নিয়ে আসেন। পাঁচ নম্বর সেক্টরের একজন শক্তিশালী সংগঠক হিসেবে সুরঞ্জিত বাবুকে কাজ করতে দেখেছি। যুদ্ধকালীন সময়ে, তাছাড়া টেকেরঘাট ও বড়ছড়ার সার্বিক দায়িত্ব তার ঘাড়ে ছিল প্রথম দিকে। সুরঞ্জিত দা’র সঙ্গে আলাপ করার উদ্দেশ্যে আমি দৌড়ে যাই। দাদা আমাকে ডি সুজার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। প্রতিউত্তরে সে বলল, “আই এম মেজর ডি সুজা, ফ্রম গোয়া; ইউ উইল ওয়ার্ক আন্ডার মি ফ্রম নাও’। আমি তাকে সেলুট করলাম। তার বদলে সে আমাকে কঠিন এক শাস্তির হুকুম করে বসলো। আমরা দাঁড়িয়েছিলাম পাথরের একটি টিলার ওপর। আমাকে সে ওই টিলা বেয়ে ক্রোলিং করে নামতে বলল । আমরা কনুই এবং হাঁটুর সম্পূর্ণ চামড়া থেৎলে গিয়েছিল আদেশটি পালন করতে গিয়ে। যদিও ভালো করে জানতাম, আমি তার অধীনস্ত নই, তারপরও সেদিন তার দেয়া

৯৮

হুকুমটি তামিল করেছিলাম শুধু পরিস্থিতিগত কারণে। পরে তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক পাল্টে গিয়েছিল একেবারে। সেই ডি সুজা তাঁবুতে ঢুকেই উল্লসিত কষ্ঠে আমার নাম ধরে হাঁক দিল-‘হেই লঙ্কর, কী ব্যাপার ফ্রেন্ড, মনে হচ্ছে ঘাবড়ে আছো, ডোন্ট ওরি ম্যান, ওই দেখো কাকে ধরে এনেছি, হি উইল ডু এভরিথিং ফর ইউ’। ইংরেজিতেই বলছিল সে কথাগুলো। পাশের এপ্ৰোন পরা ভদ্রলোকটির প্রতি নজর পড়ল আমার। ভদ্রলোকের নাম ডক্টর এলভিস, ক্রিশ্চিয়ান মিশনারিদের একটি মিশনে কাজ করেন। ভদ্রলোক নিজেই তার পরিচয় দিলেন। স্কার্ট পরা সুন্দরী নার্স দু’জন যে তার সঙ্গের, সে আর বুঝতে বাকি রইল না আমার। ডি সুজা আমার মুখে একটি পানামা সিগ্রেট ধরিয়ে দিলো। আহত হওয়ার চব্বিশ ঘন্টা পর এই প্ৰথম সিগ্রেট টানলাম, ভুলে গেলাম সরদার ভাইয়ের সামনে আমি সিগ্রেট খাই না। একনাগারে বক বক করে যাচ্ছিল ডি, সুজা । ইয়ার, নার্স দু’জনের কাকে তোমার পছন্দ?” এরা হাসছিল মিটমিট আমার দিকে তাকিয়ে। আমারও হাসি পেলো তখন। নার্স দু’জন আমার ক্ষতস্থান ধুয়ে পরিস্কার করে জায়গাটির পাশেই একটি ইনজেকশন পুশ করলো। ডাক্তার বললো, ‘পেথেন্ড্রিন”। ডি সুজার হাস্যরসে সাড়া দিলেও আঁড়চোখে আমি দেখলাম গ্লাভস পরে ডাক্তার কাঁচি হাতে নিচ্ছে। আমি বললাম, যা ইচ্ছে তোমরা করো, কিন্তু দোহাই আশ্বাস দিল কোনো ব্যথা লাগবে না, পেথেন্ড্রিন দেয়া হয়েছে। নার্স দু’জন, ডি সুজা, সবাই মিলে আমার হাত-পা চেপে ধরল। ডাক্তার প্রথমে ক্ষতস্থানটি কেটে আরো একটু বড় করল, তারপর আর কিছুই জানিনা। শুধু এইটুকু বলতে পারবো, আমি চিৎকার করেছি একটানা পনেরো মিনিট, কোরবানির গরুর মতো ছটফট করেছি। যন্ত্রণায়, ডাক্তার, নার্স, ডি সুজা সবাইকে মা, বাপ চৌদ্দগুষ্ঠী তুলে ইংরেজিতে গালাগাল দিয়েছি যাতে তারা আমার কষ্ট বুঝতে পারে। কিন্তু কেউ আমার চিৎকার অথবা গালিগালাজে কান দিলো না। এক পর্যায়ে মুক্তি পেলাম। এই অত্যাচার থেকে। ডাক্তার জানালো, হাডিডর পেছনে আটকে আছে গুলিটি। ফুল এনেস্থেশিয়া ছাড়া সম্ভব নয় কিছুতেই, তবে রক্তপড়া বন্ধ করা যাবে, ব্যথা কমানোর ইনজেকশনও ব্যবহার করা যাবে। শেষ পর্যন্ত তাই-ই করা হলো ওই রাতে বালাটে, আমাদের ইমার্জেন্সি হাসপাতালে। ডাক্তার ভদ্রলোক খুব মর্মাহত হলেন আমার অবস্থা দেখে। এই মুহূর্তে তার নামটি সঠিক মনে করতে পারছি না, তবে আমার মনে হয়, তার নাম ছিল ডা. মকবির আলি। ইতোমধ্যে আমার খবর মুক্ত এলাকায় পৌছানোর ফলে মুক্তিযোদ্ধারা আসতে লাগলো দলে দলে। ওবায়দুর রাজা সাহেব, আছন্দর আলি সাহেব, সুনামগঞ্জের তৎকালীন ওসি সাহেব, এনাম ভাই (এনামুল হক চৌধুরী), সদর ভাই (সদর উদ্দিন চৌধুরী), মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ, সবাই এলেন। সিলেট সদরের এই তিনজনকে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খুবই ভালো লাগল। হরলিকস, সিগারেট, আর আপেলে আমার টেবিল ভর্তি হয়ে গেল। মনে হলো, আমি যেন নিজের বাড়িতে চলে এসেছি। রাত ন’টার দিকে এলো ডি সুজা । জানালো, গুর্থ রেজিমেন্টের একটি অ্যাম্বুলেন্স আজ রাতেই রওনা হবে শিলং থেকে। শেষ রাতে অ্যামুলেন্স পৌছলে, কাল সকালেই যাত্রা শুরু করা যাবে, শিলং মিলিটারি হাসপাতালে

৯৯

আমার সিটও বুক করা হয়েছে ওয়ারলেসের মাধ্যমে। এত তাড়াতাড়ি এতখানি ব্যবস্থা হবে, আমি ভাবতেও পারিনি, আসলে সবটুকু সম্ভব হয়েছে ডি সুজার ব্যক্তিগত উৎসাহের ফলে। আত্মরিক ধন্যবাদ জানালাম তাকে। একজন সৈনিক বন্ধুর জন্য এতটুকু করতে পেরে সে নিজে ব্যক্তিগতভাবে আনন্দিত বলে জানালো আমাকে । মানবিক অনুভূতি দেশ কিংবা রাজনীতির খুঁটিতে বাধা থাকে না, আমার জন্য এই তাড়াহুড়া না করলেও পারতো সে, মনটা তাই ওর প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠলো। ডি সুজার বাড়িয়ে দেয়া আরেকটি সিগারেট টানতে টানতে টের পেলাম চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছে, আহত হবার পর এই প্ৰথম ঘুমালাম।

ঘুম ভাঙল পরদিন, বুধবার ১৮ আগস্টের সকালে। আরো কয়েকজন আহত মুক্তিযোদ্ধা ছিল কামরাটিতে, গতকাল তাদের কেউই আমার নিজের পড়েনি, কারণ আমি শুধু আমাকে নিয়েই ছিলাম। তাদের কাছ থেকে জানলাম, বেশ কিছুটা ঘুমিয়েছি। পেইনকিলারের সঙ্গে ঘুমের ড্রাগ মেশানো ছিল নিশ্চইয়, ঘুমের আবেশটা তখনো পালিয়ে যায়নি চোখ থেকে। ডা. মকবিবার আলী এলেন। ডা. এলভিসের দেয়া কী একটা ইনজেকশন পুশ করল আমার পায়ে। সকালে আবার এনাম ভাই, সদর ভাই, সিরাজ, ওবায়দুর রাজা সাহেব, সুনামগঞ্জের আরো অনেকে এলেন আমাকে দেখতে। সকাল ন’টায় এলো ডি সুজা। অ্যাম্বুলেন্স আসার সংবাদ পেলাম তার কাছ থেকে। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চড়লাম অ্যাম্বুলেন্সে। দুৰ্গম পাহাড়ি পথে আবার শুরু হলো যাত্রা। চেরাপুঞ্জির ভেতর দিয়ে যেতে হবে। আমাদের। রাস্তায় কালো ‘ফগ’। ফগলাইট জ্বালানোর পরও সাত-আট ফুটের বেশি দেখা যায় না। বৃষ্টি আর কুয়াশার চাদর সরিয়ে উঠতে লাগলো আমাদের গাড়ি পাহাড়ের চূড়া বেয়ে। পায়ের ব্যথা বাড়তে তাল মিলিয়ে। বেশ কিছুদূর পর হঠাৎ থেমে পড়ল অ্যাম্বুলেন্স। পেছনে আরেকটি জিপ থামার শব্দ পেলাম। খটাং করে পেছনের দরজা খুলে গেল, একরাশ ঠাণ্ডা বাতাস এসে আক্রমণ করল। সঙ্গে সঙ্গে। দরজায় ডি সুজার মুখ দেখে আমি চমকে উঠলাম। “আমি আসছি তোমার সঙ্গে, জানাল সে। চার্চের একজন বয়স্কা নানা’কে দেখলাম ডি সুজার পেছনে। উনি তোমার জন্য যীশুর কাছে প্রার্থনা জানাবেন, যদি তুমি অনুমতি দাও।” বিস্ময়ে অভিভূত হলাম কথাটি শুনে। খ্রিস্টান ডি সুজা, তার ধর্মবিশ্বাসের মাধ্যমে আমার জীবনের জন্য প্রার্থনা করার অনুমতি চাইছে আমার কাছে, আর ওদিকে, প্ৰায় বিয়াল্লিশ ঘন্টা আগে, আমারই দেশের মাটিতে, মুসলমান কোনো এক সৈনিক, কাফের হিসেবে আমার জীবনকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে। সহাস্যে আমি তাকে অনুমতি দিলাম। অ্যাম্বুলেন্সে উঠে আমার স্ট্রেচারের উল্টো দিকে সিটটিতে বসে বিড় বিড় করে প্রার্থনাবাক্য উচ্চারণ করা শুরু করল। মহিলা। ‘আমেন’ বলার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম, শেষ হয়েছে তার প্রার্থনা। আমার মুখের ওপর তার স্নেহদ্ৰ হাতটি বুলিয়ে বললেন, ‘গড ব্লেস ইউ মাই সন’। প্ৰতি উত্তরে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, ‘স্ৰষ্টার আশীৰ্বাদই এখন আমার জীবনের একমাত্র মূলধন’। সহাস্যে আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তিনি গাড়ি থেকে নেমে গেলেন। ডি সুজা আমার মুখে একটি সিগারেট ধরিয়ে

১০০

দিয়ে বলল, ‘পেছনের গাড়িতে আছি আমি’। শুরু হলো আবার আমাদের যাত্রা। বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর টের পেলাম, কানে পট পট করছে, বুঝতে পারলাম আমরা অনেক উঁচুতে উঠতে শুরু করেছি।

বিকেল তিনটার দিকে অবশেষে এসে পৌঁছলাম শিলং মিলিটারি হাসপাতালে। গাড়ির দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে একটি ভীষণ পরিচিত গন্ধ নাকে এসে ঢুকল, হাসপাতাল-হাসপাতাল গন্ধ। পৃথিবীর সব হাসপাতালের একই গন্ধ, যে গন্ধটি জীবনে কখনো আমি সহ্য করতে পারিনি এবং আজো না। কিন্তু সেদিন ওই গন্ধটা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পারফিউম বলে মনে হয়েছিল আমার কাছে। দু’জন ট্রলিবয় এসে মিনিটের মধ্যে আমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে স্ট্রেচারে ওঠালো, গিয়ে পৌঁছলাম ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে। ইউনিফর্ম পরা দু’জন নার্স সুপটু হাতে কাঁচি দিয়ে আমার শরীরের কাপড় কেটে বের করলো সঙ্গে সঙ্গে। ব্যান্ডেজ খুলে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করলো। একজন ডাক্তার এসে পরীক্ষা করলেন, ইনজেকশন দেয়া হলো । তারপর হাসপাতালের কাপড় পরানো হলো। ইতোমধ্যে আমার ভর্তির সব কাগজপত্র রেডি হয়ে গেছে। ট্রলিবিয়রা নিয়ে চললো আমাকে কেবিনের উদ্দেশ্যে, সেখানে অন্য আরেকজন নার্সের হাতে কাগজপত্রসহ আমাকে সঁপে দিয়ে তারা ফিরে গেল। লাল পর্দাঘেরা ছিমছাম সুন্দর একটি কেবিনের সুদৃশ্য বিছানায় শোয়ানো হলো আমাকে। কিছুক্ষণ পর ডি সুজা এসে উপস্থিত হলো আবার। বললো, ‘তোমার সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। অর্থপেডিক সার্জন এসে দেখবে’। কিছুক্ষণের মধ্যে দু’কার্টুন সিগারেট আর সাড়ে তিনশ টাকা রেখে যাচ্ছি, কাজে লাগবে সুস্থ হওয়ার পর। লস্কর, এবার তাহলে উঠি-বেস্ট অব লোক মাই ফ্রেন্ড।’ কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়ালো ডি সুজা চেয়ার ছেড়ে। কৃতজ্ঞতায় মনটা আমার ভরে এলো তার প্রতি। অনুরোধ করলাম তাকে আরো দু’মিনিট বসতে। বল্লাম, ‘তোমার সঙ্গে কথা আছে’। বসলে সে, আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে। সেদিন ভারতীয় আর্মির বন্ধুবৎসল৷ ওই অফিসারটিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম-“তুমি যে আমার জন্য এত কিছু করলে, ব্যক্তিগত প্রভাবে ক্রিশ্চিয়ান এসোসিয়েশনের ডাক্তার এলভিসকে দিয়ে আমার চিকিৎসা করালে, রাতারাতি ৫/৫ গুর্খা রেজিমেন্টের অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করালে, নিজে আমার সঙ্গে আজ এই লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে এলে, উপরন্তু গাঁটের পয়সা দিয়ে সিগারেট কিনলে আমার জন্য, আবার নগদ টাকাও দিয়ে যাচ্ছে-এই যে এত কিছু করলে, কেন করলে?” উচ্চঃস্বরে হেসে উঠলো সে প্রথমে। তারপর বলল, ‘বাঙালিরা সবাই কি তোমার মতো এরকম কনজারভেটিভ? কাউকে সহজে বন্ধু হিসেবে নিতে চায় না?’ আমি বললাম, ‘উত্তরটি আমার ভীষণ প্রয়োজন, ঠাট্টা করো না প্লিজ’। ডি সুজা সেদিন যে উত্তর দিয়েছিল, আমার বুকের গভীরে তার প্রতিটি অক্ষর আজো খোদাই করে লেখা রয়েছে। স্মিতহাস্যে সে বলল, “বিবেকের তাগিদে করেছি।’ আমি বললাম-“আরো খোলাসা করো।” সে বলল, “তোমার মতো একজন সৈনিক মারা গেলে আমার কিংবা ইন্ডিয়ান আর্মির কোনো দায়-দায়িত্ব নেই, তোমার চিকিৎসার জন্য অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করার আংশিক দায়িত্ব আমার রয়েছে, তবে এত তাড়াতাড়ি না করলেও পারতাম আমি। আর বাদ-বাকি যা করেছি, সত্যিই বিবেকের তাগিদেই করেছি। এরপরও যদি জানতে চাও কেন করেছি, তাহলে শোনো-আমি একজন ভারতীয় নাগরিক। ইন্ডিয়ান আর্মির একজন অফিসার। চাকরির সুবাদে এই মুহূর্তে আমাকে

১০১

পাঠানো হয়েছে বালাট সাব-সেক্তরে, তোমার আর্মির সঙ্গে সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করতে। হুকুম পেলে আবার কালই চলেই যাব হেডকোয়ার্টারে। তোমার দেশ স্বাধীন হবে কিনা জানি না। যদি হয়, যদি আমার দেশ তোমার দেশকে দখলও করে নেয়, আমার ব্যক্তিগত কোনো লাভ নেই তাতে । লাভ হলে হবে আমার দেশের রাজনীতিবিদদের। আমার বুকে বড়জোর একটা নতুন রিবন চক চক করবে, হয়তো বা একটা প্রমোশনও পাবো। কিন্তু এই রিবন বা প্রমোশন পাওয়া খুব সহজ নয়। মনে করো, তোমাদের সঙ্গে যদি আমাদেরও ভবিষ্যতে যুদ্ধ করতে হয়, তাহলে আমিও তোমার মতো আহত হতে পারি, মারা যাওয়াটাও বিচিত্র নয়। মরে গিয়ে মহাবীর চক্র হয়েও আমার কী লাভ হচ্ছে, লাভ হচ্ছে ইন্দিরা গান্ধীসহ আমার দেশের অন্য নেতাদের। তোমার ব্যাপারটিও অনেকটা আমার মতো। দেশ স্বাধীন হবে কিনা তুমি নিজেও জান না, হলে তুমি কি হবে? কিছুই না। বড়জোর বড়সড় একটা চাকরি পেতে পার। তবে তুমি তোমার দেশের জন্য লড়ছে, এটাই সবচেয়ে বড় কথা। তোমার সঙ্গে আমি যা করেছি, আমারই একজন সহকমী সৈনিক মনে করে করেছি, বন্ধু ভেবে করেছি, একজন মানুষ হিসেবে করেছি। অনেক কথা হলো, এবার দিয়ে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে, কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে, উপযুক্ত কথাগুলো বলে। একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজন মানুষের সম্পর্ক ভৌগোলিক সীমারেখা, কিংবা রাজনীতির মারপ্যাচ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। ব্যক্তি ডি সুজা আর মেজর ডি সুজার মধ্যে আমি দু’জন ভিন্ন মানুষকে আবিষ্কার করলাম। মেজর ডি সুজার প্রথম দিকের কিছু অসংলগ্ন ব্যবহার আমার কাছে এবার খোলাসা হলো। ডি সুজার মতো হাতেগোনা ভারতীয় আর্মির অফিসারদের প্রতি মনটা আমার কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল।

ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। নার্স এসে ঘুম ভাঙাল। বলল, ‘ডাক্তার আসছেন আপনাকে দেখতে’। দুজন আর্মির ডাক্তার এলেন, একজন কর্নেল আর আরেকজন মেজর, সঙ্গে একজন নার্স। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর কর্নেল জানালেন, ‘পা কেটে ফেলতে হবে, জায়গাটিতে পুঁজ হয়ে গিয়েছে, গ্যাংগ্রিনের আলামত দেখা যাচ্ছে, অতএব পা না কাটলে রোগী বাঁচবে না’। মেজর ভদ্রলোকটি তখন বললেন, কর্নেলকে-‘রোগীর বর্তমান ফিজিক্যাল কন্ডিশনে যদি অপারেশান করা যায়, তাহলে অপারেশনের দায়িত্ব স্যার আমার, যা করতে হয়, আমি করবো’। কর্নেল ভদ্রলোকটি তখন কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন, “ঠিক আছে রক্ত দেয়ার ব্যবস্থা করো আগে, প্রচুর ব্লাড। লস হয়েছে, পরে আমি আবার চেক করে বলবো এনেস্থেসিয়া নিতে পারবে কি না।” বের হয়ে গেলেন কর্নেল। ওদের আলাপ আমি এতক্ষণ খুব মন দিয়ে শুনছিলাম। কর্নেল বেরিয়ে যেতেই মেজর ভদ্রলোকটি ফিরলেন আমার দিকে। নার্সের সাহায্যে আমার ক্ষতস্থানটি ভালো করে আবার পরীক্ষা করলেন। নার্সকে পাঠালেন আমার ব্লাড ট্রান্সফিউসনের আয়োজন করার জন্য। নার্স বেরিয়ে যেতেই জিজ্ঞাস করলেন, ‘বাড়ি কোথায়?’

বললাম, ‘বাংলাদেশ’। হেসে বললেন, ‘বাংলাদেশে কোথায়?’ বললাম, ‘সিলেটে’। এবার তিনিও বাংলায় বললেন, ‘আমি প্ৰদীপ সরকার, বাড়ি বাংলাদেশে, ময়মনসিংহ। দেশভাগের সময় আমরা চলে এসেছিলাম’। ভীষণ খুশি হলাম আমি মেজর সরকারকে

১০২

পেয়ে। বললেন, ‘ভয় পেয়ো না, আমি তোমার পা টি বাচানোর চেষ্টা করবো। ওই ব্যাটা কর্নেল জাতে পাঞ্জাবি, সে এনেস্থেসিয়ার ডাক্তার, তার দায়িত্ব তোমাকে বেহুশ করা, সে খামাখা মাতব্বরি ফলাতে চাইছে, তোমার অপারেশন করবো আমি। তাছাড়া বুঝতেই পাচ্ছ, তোমার পায়ের প্রতি তার দরদ থাকার কথা নয়’। কী আর বলব, মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পেয়ে বিস্ময়ে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছি। বললাম, স্যার, আপনার যা ইচ্ছ। আপনি তাই করুন, আমার বলার আর কিছুই নেই, এখন আপনি শুধু ডাক্তার নন, আমার গার্জিয়ানও’। ঘাড়ে হাত রেখে আমাকে আরেক দফা সাহস জুগিয়ে মেজর সরকার বিদায় নিলেন। দুশ্চিন্তার এক বিরাট পাহাড় যেন আমার বুকের ওপর থেকে নেমে গোল সঙ্গে সঙ্গে। চোখের পাতা আবার ভারি হয়ে এলো।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানি না। টুকটাক শব্দে ঘুম ভাঙল। তাকিয়ে দেখি, রক্ত দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ঠিকঠাক করা হচ্ছে। ব্রেড, জেলি আর হরলিক্স খেলাম, তারপর শুরু হলো রক্ত দেয়া। নার্সদের কাছ থেকে জানতে পারলাম, কাল অপারেশন হতে পারে। সেই অনুযায়ী আজ রাত থেকে তারা আমাকে প্রস্তুত করবে।

ঘুম ভাঙল পরদিন সকালে আটটার দিকে। দিন-তারিখের হিসাবে, বুধবার, ১৯ আগস্ট। সাড়ে আটটার দিকে এলেন মেজর সরকার ও এনেস্থেসিয়ার কর্নেল মাথুর। পর্যবেক্ষণ-পরীক্ষণ শেষ করে কর্নেল বললেন, সকাল ১০টায় অপারেশন করবেন। চলে গেলেন তারা দু’জন। তিনজন মুক্তিযোদ্ধা এলো আমাকে দেখতে। ওদের কাছ থেকে জানলাম, আরো অনেকে আছে ওয়ার্ডে। মর্টারের স্প্ৰিন্টার ছিল ওদের সারা গায়ে। এখন মোটামুটি ভালো হওয়ার পথে। একজন বলল, ‘আপনার জন্য ভীষণ চিন্তা লাগছে’। আমি কারণ জানতে চাইলে বলল, ‘আপনার আগে এই কেবিনটিতে আরো দু’জন পেশেন্টকে দেখেছি। আমি, অপারেশনের পর ওরা দু’জনই মারা যায়। রোগীর অবস্থা খুব খারাপ হলে তারা এই কেবিনে রাখে, তাই আপনার জন্য ভাবছি’। হা করে তাকিয়েছিলাম কিছুক্ষণ সরল-সহজ গ্রাম্য মুক্তিযোদ্ধাটির দিকে। বয়সে আমার বড় হলেও মনের দিক থেকে ভীষণ সরল না হলে আমাকে এই মুহূর্তে এই কথাটি বলতে পারতো না সে। তাই রাগ না করে তাকে বললাম, আমরা যে বেঁচে আছি, এটাই তো অনেক! আমার এই গুলিটি দুইঞ্চি উপরে লাগলে আমি সঙ্গে সঙ্গে মারা যেতাম, কিংবা মর্টারের গোলা এসে যদি সরাসরি তোমার উপরে পড়তো, তাহলে কি করতে? মৃত্যু আমাদের কপালে যেভাবে লেখা আছে, ঠিক সেভাবেই আসবে, এর কোনো পরিবর্তন তুমি-আমি কেউ করতে পারবো না। তবে দোয়া করো আমার জন্য।’ নার্স এসে ওদের বের করে দিল আমাকে রেডি করার জন্য।

ট্রলি-বয়রা এসে নিয়ে গেল আমাকে অপারেশন থিয়েটারে। মাস্কের আড়ালে থাকলেও মেজর সরকারকে চিনতে পারলাম শরীরের আকৃতি দেখে। অপারেশন টেবিলে শোয়ানোর পর কর্নেল মাথুর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আজকের তারিখটি কত?’ আমি তারিখ বললাম, তারপর কালো একটি ছোট রাবারের চাকতিকে কামড়ে ধরতে বললেন। আমি তাই করলাম। তারপর বললেন, চোখটি খোলা রেখে মনে মনে দশ পর্যন্ত গুনতে। রাবারের চাকতিটিকে কামড়ে ধরার সঙ্গে সঙ্গে আমার সব শরীরের ভেতর দিয়ে একটি ঠান্ডা স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে মনে হলো, চোখের পাতা বুজে এলো

১০৩

আপনা আপনি। তারপর আর কিছু জানি না। মনে হলো-অন্ধকার একটি ঘরে শুয়ে আছি, ভীষণ দুর্বল লাগছিল, খুলতে পারছিলাম না চোখ দুটো। বহু কষ্ট টেনে টেনে চোখের পাতা দুটোকে খালার চেষ্টা করলাম। অন্ধকার কাটতে লাগলো ধীরে ধীরে। বুঝতে পারলাম, শুয়ে আছি বিছানায়, আমার কেবিনে। বা হাতটি আপনা আপনি স্পর্শ করল। আমার বাম হাঁটুকে। টের পেলাম, পা কাটা হয়নি। নার্স এসে ঢুকলো। নার্সকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ক’টা বাজে?’ সে জানাল, ‘সন্ধ্যা সাতটা’। তার মানে প্ৰায় ন’ঘণ্টা পার হয়েছে ইতোমধ্যে। ছুটে বেরিয়ে গেল সে ডাক্তারকে খবর দিতে।

কিছুক্ষণ পরই এলেন মেজর সরকার, টেনিসের ড্রেস পরা অবস্থায়। খুব উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল তাকে। ঢুকেই বললেন, ‘লস্কর, ভাগ্যবান তুমি, পা তোমার কাটতে হবে না, তবে সেলাই করিনি, ঘা শুকানোর আগ পর্যন্ত একদিন পর পর খুলে ব্যান্ডেজ বদলাতে হবে’। আনন্দে আমার চোখে সেদিন পানি এসে গিয়েছিল। তাকে বললাম, ‘স্যার, আমার একটি অমূল্য সম্পদ হারিয়ে ফেলেছিলাম চিরদিনের জন্য, আপনি আজ আবার তা ফিরিয়ে দিলেন, আপনার এ দা …’। আমাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলতে শুরু করলেন মেজর সরকার, ‘চেপে যাও, ধন্যবাদ দিতে চাইলে চেপে যাও, সে সুযোগ তোমার নেই। আমি যা করেছি চাকরির খাতিরে করেছি, আর বাড়তি কিছু করে থাকলে, সেটা আমার নিজের স্বার্থে করেছি, তোমার জন্য নয়’। স্তম্ভিত হয়ে গেলাম তার কথা শুনে। তিনি বুঝতে পারলেন, ব্যাপারটি খোলাসা হয়নি আমার কাছে। বললেন … ‘একজন ভারতীয় বাঙালি নাগরিক হিসেবে আমার দেশকে আমি প্ৰাণের চেয়ে ভালোবাসি, এই দেশের জন্য প্রয়োজনে প্রাণও দিতে পারি। কিন্তু জন্মগ্রহণ করেছি আমি বাংলাদেশের ময়মনসিংহে। আমারই জন্মভূমিতে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টা চলছে আজ। এই মুহূর্তে দায়িত্ব তোমার চেয়ে আমারও কম নয়, ভারতীয় হিসেবে সে সুযোগ থেকে আজ আমি বঞ্চিত হতে যাচ্ছিলাম। তোমার মাধ্যমে কিঞ্চিৎ সুযোগ পেয়ে বরং আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি’। ভীষণ আবেগের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন মেজর সরকার। বলা শেষ করে থামলেন। রাতের খাবার নিয়ে নার্স এসে ঢুকল কেবিনে। বিদায় নিয়ে চলে গেলেন ডক্টর সরকার। খেতে খেতে ভাবছিলাম, স্ৰষ্টা যা করেন, মঙ্গলের জন্যই করেন।” এই কথাটির মর্মার্থ প্রায়ই বুঝি না বলে, আমরা স্রষ্টাকে ভুল বুঝি তাঁর আশীৰ্বাদকে অভিসম্পাত মনে করি। আহত হওয়ার সঙ্গে ভেবেছিলাম, ভাগ্যটা নেহায়েত খারাপ বলে আহত হলাম, আমার পায়ে না লেগে অন্যের পায়েও লাগতে পারত। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, আমার আহত হওয়ার সময় বিধাতার আশীৰ্বাদ আমার সঙ্গে ছিল, অপারেশন টেবিলেও ছিল, আজো আছে। আসলে আমরা বুঝতে পারি না, তাই তাঁকে ভুল বুঝি। যুদ্ধক্ষেত্রের পেছনেও যে আরেকটি যুদ্ধ চলছে, আহত না হলে কোনোদিন তা জানতে পারতাম না। খাওয়া শেষ হতেই মফিন দেয়া হলো এক ডোজ। ঘুমের রাজ্যে প্রবেশ করলাম তারপর।

সকাল সাতটায় ঘুম ভাঙানো হলো পরদিন। মিলিটারি হাসপাতালের নিয়ম অনুযায়ী, স্পঞ্জ-বাথ করানো হলো। শুরু হলো হাসপাতালের রুটিনবাঁধা জীবন, ডাক্তার, নার্স, ওষুধ, ব্যান্ডেজ, ইন্সপেকশন, সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা, রাত, ঘুম … । হাসপাতালের বিছানায় পুরো একটি মাস। বিচিত্র অভিজ্ঞতায় অতিক্রম করা প্রতিটি

১০৪

দিনের স্মৃতিকে রোমন্থন করে, তার মাঝ থেকে কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরেই শেষ করব আজকের স্মৃতিচারণ।

অপারেশনের তিন দিন পর মোটামুটি যখন সুস্থবোধ করা শুরু করেছি, তখন আমাকে দেখতে এলো অন্য মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের কাছ থেকে জানলাম, আরো অনেক রয়েছে এই হাসপাতালে। বেশ ক জন পরিচিত মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎ পেলাম। ট্রেনিং শেষ করে বিভিন্ন সেক্টরে চলে গিয়েছিলাম সবাই। কিশোরগঞ্জের মোস্তফা তালুকদায়ের খবর শুনে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। ভোলাগঞ্জ সাব-সেক্টরে যুদ্ধ করছিল সে। একটি অপারেশনে তাড়াহুড়োর মাঝে টু-ইঞ্চ মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করতে গিয়ে নব্বই ডিগ্রিতে সেট করে নাকি ফায়ার করেছিল সে। সঙ্গে ছিল আমারই এক পুরনো বন্ধু মুশফিক। গোলাটি উপরে উঠে আবার সরাসরি নিচে নেমে আসে। নিজেরই গোলার আঘাতে মারা যায় মোস্তফা তালুকদার, মুশফিক আহত হন। এত কম দিনের ট্রেনিং-এ এত কিছু জানা বা মনে রাখা সহজ ব্যাপার নয়। সাহসের অভাব ছিল না, ছিল অভিজ্ঞতার অভাব। অভিজ্ঞ একজন তাদের সঙ্গে থাকলেই এই সাহসী সৈনিকটি বাঁচতে পারতো। জীবন দিয়ে সেদিন অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের। মোস্তফা তালুকদারের এই আত্মহুতির পর ভোলাগঞ্জ সাব-সেক্টর এরকম দুর্ঘটনা আর ঘটেনি। সহকর্মীর প্রাণের বিনিময়ে, বাংলাদেশের প্রতিটি রণাঙ্গনে বহু মুক্তিযোদ্ধাকে সেদিন অনেক মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়েছে। বিডিআর এর সুবেদার সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে দেখা হলো। ডাউকি সাব-সেক্টরে যুদ্ধরত ছিলেন। শত্রুপক্ষের থ্রি-ইঞ্চ মর্টারের গোলা এসে লাগে তার হাতে ও বুকে । শিলং সিভিল হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে । বয়সে একজন অভিজ্ঞ সৈনিক তিনি। পঁয়ষট্টিতে যুদ্ধ করেছেন ভারতের বিপক্ষে। চারটি আঙুল তার কেটে ফেলেছে। ওরা সিভিল হাসপাতালে। বুকের স্প্লিন্টার বের করার জন্য এখানে পাঠানো হয়েছে। বললেন-এই হাসপাতালে প্রথমে এলে চারটা আঙুলাই বাঁচানো যেত। তার কাছ থেকে জানলাম, আরো অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে এভাবে মর্জি মাফিক চিকিৎসা করা হচ্ছে সেখানে। যুদ্ধের পেশেন্টদের ট্রিটমেন্ট করার বিশেষ অভিজ্ঞতা এমনিতেই সিভিল হাসপাতালের থাকে না। কিন্তু এই সমস্যাটি দেখার বা মোকাবেলা করার দায়িত্ব আমাদের নেতাদের, যুদ্ধের সংগঠকদের। ভারতীয় প্রশাসনের আমাদের বক্তব্য শোনার কথা নয়। কারণ আমাদের অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে দাফতরিক আলোচনার ভিত্তিতেই এসব ব্যাপার ঠিক হতো তখন। চুক্তি মোতাবেক কাজ হচ্ছে কিনা সেটা দেখার জন্য আমাদের সরকারের বিভিন্ন লোকজনও নিয়োজিত ছিলেন। আমরা ঠিক করলাম আমাদের কর্মকর্তা কেউ এলে ব্যাপারটি তাদের গোচরে আনবো।

এদিকে আমার ট্রিটমেন্ট এগিয়ে চলছিল ঠিক-ঠাক, কিন্তু একদিন পরপর যখন ড্রেসিং বদলাতে আসত, মারাত্মক একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো তখন। ব্যান্ডেজ খুলে, কাঁচির আগায় গজ পেঁচিয়ে আমার ক্ষতস্থানের গর্তের জমে থাকা পুঁজি পরিষ্কার করতে হতো। পায়ের যন্ত্রণা গিয়ে তখন মগজে উঠতো। সিস্টাররা আমার হাত-পা চেপে ধরত সজোরে, আর আমি চিৎকার করে সারা হাসপাতাল সরগরম করে তুলতাম। পরিষ্কার হয়ে গেলে এক শিশি স্টেপটোমাইসিন পাউডার ঢেলে দিয়ে গর্তে আরেক

১০৫

টুকরা গজ ঢুকিয়ে আবার ব্যান্ডেজ করে দিত। একটি শিখ সুবেদার এই কাজ করত। কেবিনে ঢুকেই সে সিনেমার ভিলেনদের মতো কাঁচিটাকে তলোয়ারের মতো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমার সামনে দোলাতো আর আমাকে ক্ষেপাতো। আমি তার চৌদ্দগুষ্ঠী তুলে গাল দিতাম, সে হাসতো। প্ৰায় পনেরো দিন পর শেষ হলো এই অত্যাচার। শেষ দিনে আমি সুবেদারটির কাছে মাপ চেয়েছিলাম। অবশ্য। হাসতে হাসতে সেও ক্ষমতা করেছিল আমাকে। আরেকটি অসুবিধায় পড়েছিলাম অপারেশনের সাত-আট দিন পর। প্রথম দিকে ঘুমের ইনজেকশন দেয়া হতো, কিন্তু ঘুমের ইনজেকশন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ঘুম পালালো চোখ থেকে। অনেক কাকুতি-মিনতির পরও বরাদ্দ হলো না ঘুমের ওষুধ। ব্যবস্থাটি অবশ্য আমার মঙ্গলের জন্যই করা হয়েছিল, এডিকশনের ভয়ে। যাক, ঘা শোকানোর পর শিখ সুবেদারের হাত থেকে মুক্তি পেলাম, কিন্তু ক্ষতস্থানটি সেলাই করার জন্য যখন অন্য আরেকজন নার্স এলো, ভয়ে আমার মুখ শুকিয়ে গেল। কোনো পেইনকিলার না দিয়ে সরাসরি সেলাই করলো তারা, যেন এক টুকরা কাপড় সেলাই করছে। এরপর মোটামুটি স্বস্তি ফিরে পেলাম ঘুমের সমস্যাটি ছাড়া। তবে সমস্যাটির সমাধান হলো অন্যভাবে, রাতের শিফটে নতুন এক মাদ্রাজি নার্সের আগমনে। ওয়ার্ডে ডিউটি শেষ করে নার্সটি চলে আসতো আমার কেবিনে। যুদ্ধের গল্প শুনতো সে আমার কাছে, তার নিজের গল্প করতো, কফি খাওয়াতো। ওর সঙ্গে গল্প করাটা একটা রুটিনে দাঁড়ালো এক সময়। প্রতি রাতে গল্প করতে করতে টায়ার্ড হয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়তাম, সে চলে যেত। একরাতে অনডিউটি একজন তরুণ ডাক্তার আমাদের দু’জনকে হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কি ব্যাপার, তোমরা দু’জনে কি প্রেমে পড়ে গেলে?’ নার্সটির নাম ছিল ‘ললিতা’।

একদিন বিকেলে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে এলেন মেজর সরকার। গোলার আঘাতে তার ডান হাতের কব্জি পর্যন্ত উড়ে গেছে, কনুই পর্যন্ত হাডিড বাঁশের মতো ফেটে গিয়ে সেখানে আবার পুঁজ সৃষ্টি হয়েছে। কেবিনে ঢুকতেই দুৰ্গন্ধ পেলাম নাকে । সরকার বললেন, গ্যাংরিন শুরু হয়েছে, এখন তার হাতটি কেটে ফেলতে হবে, কনুই-এর একটু উপরে, তা না হলে সব শরীরে ছড়িয়ে পড়বে গ্যাংরিন, কিন্তু সে কোনো অবস্থাতেই হাত কাটতে নারাজ। সরকার বললেন তাকে বোঝাতে। ওর হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, একটি আঙুলও বাকি নেই, শুধু কিছু গুড়ো হাড় রয়েছে সেখানে। মেজর সরকারের পরিচয় দিলাম তাকে, বললাম তার প্রাণ বাঁচাতে হলে এইটুকু কাটতেই হবে, অপারেশন বন্ডে টিপসই না দিলেও ডাক্তাররা কেটে ফেলবে তার ভালোর জন্যই। আমার কথা শুনে প্রচুর কান্দলো, কোনো অবস্থাতেই হাতটি বাঁচানো যাবে না জেনে শেষ পর্যন্ত রাজি হলো সে। দেশের জন্য সজ্ঞানে অগণিত মুক্তিযোদ্ধা সেদিন নিজ হাতে তাদের হাত-পা কাটার অনুমতি দিয়েছিল এভাবেই। ওদের নাম দেয়া হয়েছে আজ পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা।

আমার হাসপাতালের দিন ফুরোতে লাগল। পায়ে কোনো ব্যথা নেই, ক্ষতস্থানে ঘুষি মেরে দেখলেন মেজর সরকার, কোনো ব্যথা নেই। কিন্তু বিছানা ছেড়ে হাঁটতে গিয়ে পড়ে গেলাম। আমি। সকাল-বিকেল ফিজিওথেরাপি শুরু হলো এবার। হুইল চেয়ারে বসে থেরাপি

১০৬

তে যেতম রোজ দু’বার। বিভিন্ন ওয়ার্ডে যাওয়ার অনুমতি পাওয়াতে আরো লাভ হলো। নতুন অনেকের সঙ্গে দেখা হলো। আরেকটি মারাত্মক সমস্যার খবর পেলাম সহযোদ্ধাদের সঙ্গে আলাপ করে। মুক্তিযোদ্ধারা মাসিক ভাতা পেতো হাতখরচের জন্য, যে টাকা দিয়ে বিড়ি-সিগারেট কিনতে পারতো তারা। আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর, এই টাকা তাদের হাতে আসতো না। যার যার সেক্টরের ঠিকানায় তাদের না পেয়ে টাকাগুলো ফেরত চলে যেতো হেডকোয়ার্টারে। প্ৰায় সবার পকেট খালি। আমার নিজেরও হতো এই সমস্যা যদি ডি সুজা সমাধান না করে যেতো। ব্যক্তিগতভাবে আমি কিছু সাহায্য করলাম কয়েকজনকে সিগারেট দিয়ে, কিন্তু পাছে আমার কম পড়ে সেই ভয়ে খুব সাবধানে কাজটি করতাম, অর্থাৎ যাকে না দিলেই নয় এম কাউকেই শুধু দিতাম। হাসপাতালের একজন ডাক্তারের কাছ থেকে আরেকটি পরামর্শ পেলাম, ভদ্রলোকটি বললেন, ‘তোমাদের যুদ্ধের প্রতিটি সেক্টরের সফল অপারেশনের খবরাদি, আন্তর্জাতিক বিশ্বে তোমাদের যুদ্ধ সম্পর্কে যেসব পজেটিভ কাজ হচ্ছে, নিশ্চয়ই এইসব খবর সংবলিত কোনো পত্রিকা কোথাও বেরুচ্ছে, কিন্তু আমরা জানি না-জানলে হয়ত আমরাই আনিয়ে দিতাম। আমাদের পত্রিকায় মাঝে মধ্যে বের হলেও খুব ছোট করে বের হয়। রেগুলার এই কাগজটি সরবরাহ করলে পেশেন্টদের মানসিক সাহায্য হতো প্রচুর।’ মূল্যবান একটি পরামর্শ, কিন্তু সমাধান পেলাম না খুঁজে অনেক ভাবনাচিন্তার পরও।

আরো দু’তিন দিন থেরাপি দেওয়ার পর, দেখা গেল আমার পায়ের কোনও উন্নতি হচ্ছে না। একজন বোনস্পেশিয়েলিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো আমাকে । ভদ্রলোক আমার হাঁটু ধরে একটু ঝাড়া দিয়েই বললেন, ‘নি জয়েন্টের একটি লিগামেন্ট হয়ত ছিড়ে গেছে তোমার।’ পরদিন এক্সরে করার পর দেখা গেল ঠিকই ছিল তার ধারণা। উরুতে গুলি লাগার পরিণামে হাঁটুর নার্ভ ছিড়ে যাওয়ার ব্যাপারটি আমার মাথায় না ঢুকলেও বাস্তবে তাই ঘটলো। ডাক্তার বললেন, ‘ক্র্যাচ নিয়ে হাঁটতে হবে কিছুদিন, তারপর আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। ভয়ের কোনো কারণ নেই, ফুটবল প্লেয়ারদের প্রায়ই এই লিগামেন্ট নামক বস্তুটি ছিড়ে থাকে।’ আরো দু’তিন দিন কিছু বিশেষ এক্সসারসাইজ দেখিয়ে দিয়ে আমাকে রিলিজ দেয়া যাবে, বললেন তিনি।

পরদিন থেরাপি রুমে যাওয়ার আগে নার্স এসে জানাল, ‘তোমাদের বাংলাদেশের খুব বড় তিনজন কর্মকর্তা এসেছেন।’ শুনে খুব খুশি হলাম। আমার হুইল চেয়ারটি ঠেলতে ঠেলতে গেলাম ওয়ার্ডে তাদের সঙ্গে দেখা করতে। গিয়ে দেখলাম, ব্যারিস্টার মুস্তাকিম চৌধুরী, যিনি আমাদের ওই পুরো অঞ্চলের আঞ্চলিক প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন, কয়েছ চৌধুরী, যিনি তখন আমাদের সেক্টরের চিফ কো-অর্ডিনেটরের দায়িত্বে ছিলেন, ডা. টি হোসেন অথবা আলি, নামটি আমার ঠিক মনে পড়ছে না, তবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নামকরা চক্ষু বিশেষজ্ঞ ছিলেন তিনি-তাদের সঙ্গে ইন্ডিয়ান আর্মির বড় অফিসাররাও রয়েছেন। আমাদের সমস্যাদি আছে কি না জানতে চাইলেন। আমি তখন মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে প্রথমেই আমাদের পঞ্চাশ টাকা ভাতা ফ্রন্টে গিয়ে কীভাবে ফেরত আসছে এবং এর ফলে কী সমস্যা হচ্ছে, তাদের জানালাম, মুক্তিযুদ্ধের খবর সংবলিত পত্রিকার কথা বললাম, সিভিল হাসপাতালের খামখেয়ালিপনার কথা উত্থাপন করলাম এবং সবশেষে আরো একটি মারাত্মক সমস্যার কথা বললাম, সেটি হচ্ছে-আমরা যারা, এখানে

১০৭

আহত হয়ে আসি, আমাদের শরীরের সব কাপড় কেটে ফেলা হয়, রিলিজ হবার দিনে সমস্যা দেখা দেয়, কারণ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পক্ষে কাপড় দেয়া সম্ভব নয়, যে সমস্যাটি আমার বেলায় ঘটতে যাচ্ছে এ দু’তিন দিনের মধ্যে, তাছাড়া আরেকটি বাড়তি সমস্যা আমার বেলা ঘটবে, সেটি হচ্ছে, আমার একটি ক্র্যাচও লাগবে। সহযোদ্ধারা বাকি সবাই আমার উত্থাপিত দাবিগুলো সমর্থন করল। নেতৃবৃন্দ খুব মনোযোগ সহকারে আমাদের অভাব-অভিযোগ শুনলেন, প্রয়োজনীয় নোট নিলেন ডায়রিতে, পরিশেষে জানালেন অতিসত্বর প্রতিটি সমস্যার সমাধান করা হবে। আমার মতো যারা দু’চার দিনের মধ্যে রিলিজ হবে, তাদের সমস্যা কালপরশুর মধ্যেই করা হবে, এই আশ্বাস দিয়ে তারা আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। সমস্যাগুলো সমাধান হওয়ার আনন্দে আমরা সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।

এই নেতাদের সঙ্গে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে আর কোনোদিন দেখা হয়নি, আমার সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি তাদের মাধ্যমে, এটুকু হলফ করে বলতে পারি। বাকিদের হয়েছিল কিনা, আমি জানি না। ভারতীয় এক সেবা সংস্থার দানকৃত ক্র্যাচ আর কাপড় পরে আমাকে হাসপাতাল থেকে বেরোতে হয়েছিল সেদিন।

মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে আজ পয়ত্রিশ বছর। কিন্তু বইয়াখাউরি গ্রামের রক্ষণশীল পরিবারের সেই মহিলা, যিনি মাতৃস্নেহে সেদিন আমার মুখে এককাপ গরম দুধ তুলে দিয়েছিলেন, প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে প্রাণের মায়া ত্যাগ করে যে মাঝিরা রাতের অন্ধকারে করছার হাওর পাড়ি দিয়েছিল আমাকে নিয়ে, মাইলের পর মাইল পথ কাঁধে করে যারা সেদিন রিক্রুটিং ক্যাম্পে আমাকে পৌছে দিয়েছিল, অথবা গ্রামডাক্তার আনিছ মিয়া, যার প্রাথমিক চিকিৎসা না পেলে হয়ত রাস্তাতেই মরতে হতো আমাকে, তাদের কারোর অবদান একজন মুক্তিযোদ্ধার চেয়ে কি কম ছিল? বিগত পয়ত্রিশটি বছরে তাদের কাছ থেকে ‘ধারা পাওয়া’ এই যাপিত জীবনে আমি নিজে তাদের ক’বার স্মরণ করেছি? ক’জনকে জানিয়েছি তাদের কথা? অথচ তাদের মাধ্যমেই সেদিন আমি নতুন জীবন লাভ করেছিলাম। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ছবিটি রয়ে যাচ্ছে আজ আমাদের দৃষ্টি সীমানার আড়ালে। তাই আজ লেখাটি শেষ করার আগে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি, সমগ্র বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ জনপদের অগণিত অনুপ্রাণকদের, যাদের অফুরানে স্নেহ আর বুকিময় সহায়তা ছাড়া কোনো ক্রমেই মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে দেশের প্রত্যন্ত এলাকার অভিযানকে সফল করা সম্ভব হতো না। স্মরণ করছি, সেই মা-বোনদের, যারা সেদিন অনাত্মীয় অপরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন তাদের বাড়িতে, পরম যত্নে খাইয়েছিলেন তাদের, সেবাশুশ্ৰষা করেছিলেন অসুস্থ এবং আহতদের। সেই মা-বোনদের শিরা-উপশিরায় প্রবহমান রক্তকণিকা থেকেই জন্ম নিয়েছেন আজকের প্রজন্মের যুবকযুবতীরা। তারা যদি আজ তাদের মা-বোন, বাবা-ভাইদের সেই অকৃত্রিম ও অকৃপণ প্রেম, স্নেহ, ভালোবাসা এবং সাহসকে সঠিকভাবে বিচার ও যাচাই করতে সক্ষম হন; স্বদেশপ্রেম আর আত্মত্যাগের মানবতাবাদী এই চেতনাগুলোকে যদি আজ সম্মান জানাতে সক্ষম হন; মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে কোনো অসুবিধা হবে না। তখন আর স্বাধীনতার শক্ররা নিশ্চিহ্ন হবে চিরতরে, ‘এই’ প্রজন্মেরই হাতে।

রচনাকাল ১৯৯০