You dont have javascript enabled! Please enable it! মান্দারতলার যুদ্ধ | কর্নেল মোহাম্মদ সফিক উল্লাহ (অব.), বীর প্রতীক - সংগ্রামের নোটবুক

মান্দারতলার যুদ্ধ

কর্নেল মোহাম্মদ সফিক উল্লাহ (অব.), বীর প্রতীক

কুষ্টিয়াতে অবরুদ্ধ পাকিস্তান আর্মির ২৭ বালুচের শেষ অংশকে বিনেন্দা-শৈলকুপার মাঝামাঝি নির্মূলের অভিযান চলাকালেই যশোর ক্যান্টনমেন্ট অভিমুখে একটি বিশেষ সশস্ত্র অভিযান প্রেরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কুষ্টিয়া শক্রমুক্ত হয়ে মুক্তিবাহিনীর হাতে আসার পর গোয়ালন্দ থেকে চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর পর্যন্ত বিরাট অঞ্চল জয়বাংলার উল্লাসধ্বনিতে মুখরিত। চারপাশ থেকে পরস্পর যোগাযোগশূন্য বিক্ষুব্ধ জনতা নিরাপদ দূরত্বে যশোর ক্যান্টনমেন্ট অবরুদ্ধ করে রেখেছে। জনতার আছে মনোবল, হাতে লাঠিসোটা, দা-কুড়ালের দেশি অস্ত্র। তাদের আগ্নেয়াস্ত্র নেই বললেই চলে। আপোসে পাকিস্তান আমি যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে যাবে না তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ অঞ্চলে পাকিস্তানিদের শক্তির উৎস ক্যান্টনমেন্ট দখল করতে না পারলে আনন্দ নিরানন্দে পরিণত হতে বেশিক্ষণ লাগবে না। ক্যান্টনমেন্ট দখলের অগ্রযাত্রার প্রাথমিক প্ৰস্তুতিরূপে কোম্পানি প্রেরণের স্থির সিদ্ধান্ত নিলেন চুয়াডাঙ্গার ইপিআরের মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। দক্ষিণপশ্চিম রণাঙ্গনের অন্যদের সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি এ ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানের ভর আমার ওপর ন্যস্ত করলেন। আমি তখন বিনোদা ক্যাডেট কলেজের বাংলার অধ্যাপক। মার্চের প্রথম থেকে কুষ্টিয়া দখল পর্যন্ত একাধিক সামরিক ও সাংগঠনিক কাজে আমার তৎপরতা স্থানীয় সামরিক ও রাজনৈতিক নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলাম বলে হয়তো আমার ওপর তার এ গুরুদায়িত্বের ভার অর্পণ করলেন।

এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে আমাকে দুটি প্লাটুন প্লাস দেয়া হলো। কুষ্টিয়ার ২৭ বালুচ রেজিমেন্টের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনা অস্ত্ৰ, চুয়াডাঙ্গার ইপিআরের অস্ত্ৰ, যশোর ক্যান্টনমেন্টের মরণ ফাঁদ থেকে সশস্ত্ৰ পালিয়ে আসা ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অস্ত্ৰ, স্থানীয় আনসার-মোজাহিদদের অন্ত্র দিয়ে তাদের সজ্জিত করা হলো। বালুচ রেজিমেন্টের ছিনিয়ে আনা একটি রিকয়েললেস রাইফেল (আর আর)’, একটি ভারী মেশিনগান, কয়েকটি চায়নিজ এলএমজি, ব্রিটিশ এলএমজি এবং থ্রি নট থ্রি রাইফেল ছিল প্ৰধান অস্ত্ৰ । একটি ৩” মর্টারও ছিল। মান্দারতলা থেকে সেটি প্রথম দিকে উইথড্র করে গোয়ালন্দ পাঠানোর নির্দেশ নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও পালন করতে হলো। চুয়াডাঙ্গার ইপিআর, যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসা ১ম ইস্ট

……………..

রিকয়েললেস রাইফেলঃ ধাক্কাবিহীন ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্ৰ।

৭৪

বেঙ্গলের সৈনিক, ঝিনেদা ক্যাডেট কলেজের পাঁচজন বাঙালি এনসিও, স্থানীয় আনসার-মোজাহিদ দিয়ে কোম্পানি তৈরি হলো। ১ম ইস্ট বেঙ্গলের সুবেদার ফিরোজ, ইপিআরের সুবেদার মজিদ মোল্লা, সুবেদার মুকিত, ঝিনেদার আনসার কমান্ডার মাকসুদ আলী, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার আজহার উদ্দিন এ কোম্পানির শক্তি, সাহস ও প্রেরণার উৎসরূপে প্ৰস্তুতিতে এগিয়ে এলেন।

স্থানীয় যোদ্ধাদের লঙ্গর ও প্রশাসনের দায়িত্বে ছিলেন প্রাক্তন ছাত্রনেতা ও নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য নুরে আলম সিদ্দিকীর পিতা নুরুন্নবী সিদ্দিকী। তিনি দিলেন দেড়দিনের রেশন। চাওয়া হলো সাত দিনের। খিটমিট লেগে যাওয়ায় তিনি অভিযোগ করলেন উধ্বতন অপারেশন কমান্ডার এসডিপিও মাহবুবকে। তড়িৎগতিতে এসে মাহবুব রেশন ও গাড়ির ব্যবস্থা করে ট্যাকটফুল হয়ে স্থানীয় সম্পদের ওপর নির্ভর করে অগ্রাভিযানের নির্দেশ দিলেন।

ঝিনেন্দ থেকে কোম্পানিসহ কালিগঞ্জে এসে বিরূপ সংবর্ধনা পেলাম। কেউ যেন আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে চায় না। কালিগঞ্জের দারোগা লতিফকে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপার কী? তিনি জানালেন, আমাদের আগেকার বিশখালী যুদ্ধের সময় পাকিস্তান আর্মির গোলাগুলির সময় তিনি মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে থানায় ছিলেন। পাকিস্তান আমি তাকে প্ৰাণে মারেনি। পাকিস্তান আমি ভুল করেই হোক বা যেভাবেই হোক স্থানীয় কয়েকজন গণ্যমান্য মুসলিম লীগের লোককে হত্যা করে টেবিল উল্টে দিয়ে গেছে। ঢাকা-খুলনা মূল সড়কের কালিগঞ্জ ব্রিজ উড়াতে এসে স্থানীয় লোকজনের বাধার মুখে মাহবুবের পাঠানো লোকজনের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। কালিগঞ্জের ব্যবসায়ীরা অনুকূল ও প্রতিকূল হাওয়া আঁচ করার তালিমে আছেন। যশোর, খুলনা ও ঢাকার বাঙালি নিহতদের খবর আসছে। আহতদের কয়েকজন। এখানে ফিরে এসেছেন। যশোরে দোকানপাট ও মাল-সম্পদ হারিয়ে অনেক স্থানীয় ব্যবসায়ী দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন। দারোগা শুধু বললেন, তার শক্তি-সাহস কিছুই নেই। তবু নির্দেশ পালনে তিনি এগিয়ে এলেন। স্থানীয় আমির রিটায়ার্ড মাওলা মিয়া এ সময় আমার সঙ্গে এসে মিলিত হলেন। এক ঘণ্টার মধ্যে কালিগঞ্জের কালিমা দূর করার জন্য একটি সেকশনের সাহায্যে থানাব হাজতটি পূর্ণ করে ফেললাম। হাজাতের চাবি আমার কাছে এনে আর্মির সশস্ত্ৰ গার্ড দিলাম। এক ঘণ্টা পর আর্মির গার্ড উইথড্র করে নিয়ে দারোগা লতিফাকে ডেকে বললাম, আপনার আর কি চাই?” তিনি শুধু বললেন, ‘আর কিছুর প্রয়োজন নেই, বাকিটা আমি পারব, আপনার এখন কোনোকিছুর অভাব হবে না।” দারোগাকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হলো কাউকে মারপিট বা হত্যা করা থেকে বিরত থাকার জন্য। এক ঘণ্টার মধ্যেই সবাইকে ছেড়ে দেয়া হলো। পুরা ব্যাপারটাই জাদুমন্ত্রের মতো কাজ করল। এরপর পুরো অভিযানে কোনো কিছুরই অভাব হয়নি।

কালিগঞ্জের পর দুলাল মুন্দিরা-মোবারকগঞ্জ চিনির কল পেছনে ফেলে সামনে কেয়াবন পর্যন্ত এগিয়ে একটা বাজারের কাছে বিকাল নাগাদ থামলাম। সবাইকে সন্ত্রস্ত

এসডিপিও : সাব-ডিভিশনাল পুলিশ অফিসার বা মহকুমা পুলিশ প্রশাসক।

৭৫

ও বিরূপ দেখে রাস্তার পাশে এক ভাঙা টিনশেডের সামনে এক সুবেশধারী নাদুস-নুদুস ছাত্র ধরনের যুবককে অকস্মাৎ রাইফেলের বাঁট দিয়ে কয়েক ঘা দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোন রাজত্বে আছো বাবা, বুঝি না?” ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সে দাঁড়িয়ে গেল। আশপাশের অন্য কয়েকজন হতাশা ও উদ্বেগের সঙ্গে দৌড়ে পালিয়ে না গিয়ে ফ্যাকাশে মুখে ধীরপায়ে আমার পাশে এগিয়ে এলো। যুবকটি শেডের তালা খুলে আমাকে ডাকলো। শেডের ভেতরে মুখ বাড়িয়ে এবার বেকুফ, বনার পালা আমার, ডাব, ছোলা, চিড়া, গুড়মুড়ির পাহাড়। আসল গোলমাল লাগিয়েছে আমাদের সৈন্যদের পাকিস্তান আর্মির ইউনিফর্ম, তাই আসল-নকল বোঝার ব্যাপারে স্থানীয় জনগণের পরীক্ষা। আমাদের অগ্রযাত্রার খবর আগেই পৌছে গেছে। তারই প্ৰশাসনিক বন্দোবস্ত । জনগণের কাছে নিজের রূঢ়তার জন্য ক্ষমা চাইতে তারা ব্যস্ততার সঙ্গে বললেন, “আপনার স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে জানাশোনা না থাকায় এমন সেমসাইড হওয়াই স্বাভাবিক।” বিশখালী ও ভাটুই হাটের যুদ্ধে আমার ভূমিকা ও কালিগঞ্জ থানার কার্যকলাপ আমার ব্যাপারে তাদের সন্দেহ মুক্তি ঘটিয়েছে। স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীরা জানালেন, উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে দূর থেকে তারা আমাদের ছায়ার মতো অনুসরণ করে আসছেন। আমাদের সব রকম সাহায্য ও সহযোগিতার জন্য তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সব ভাবনা মুক্ত হয়ে এবার সামনে এগুনোর প্রেরণা পেলাম ।

 যশোর ক্যান্টনমেন্ট অভিমুখী ঢাকা-খুলনা মূল সড়ক ধরে কেয়াবন থেকে বারোবাজার পর্যন্ত কোম্পানি নিয়ে সন্ধ্যার আগে পৌঁছা গেল। মূল হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে বারোবাজার, কালিগঞ্জ, ঝিনেদা পর্যন্ত টেলিফোন যোগাযোগ স্থাপন করা হলো। সন্ধ্যার পর পূর্বদিকে বারোবাজারের মাইল দুয়েক দক্ষিণে মান্দরতলা থেকে লেবুতলা-সীমাখালী পর্যন্ত ক্রিনিং ফোর্সের মতো একটা প্লাটুন মাইনাস পেট্রোল পাঠানো হলো। কারণ লেবুতলা দিয়ে যশোর শহর ও ক্যান্টনমেন্টের পাশ দিয়ে ঢাকা অভিমুখে মাগুরা যাওয়ার রাস্তা ছিল। বারোবাজার থেকে একটা প্লাটুন নিয়ে পেছনে কেয়াবনে ফিরে এলাম। সুবেদার ফিরোজসহ গ্রামের পথে পাকা সড়কের পশ্চিমে অগ্রসর হয়ে দক্ষিণ দিকে যশোর ক্যান্টনমেন্ট অভিমুখে ফাইটিং পেট্রোল নিয়ে অগ্রযাত্রা চললো। কারণ যশোর থেকে পশ্চিম দিক দিয়ে চৌগাছা, কোটচাঁদপুর দিয়ে উত্তরে বারোবাজার, কালিগঞ্জ, ঝিনেদা, ঝিনেদা-চুয়াডাঙ্গা রোডে সাধুহাটি পর্যন্ত যাওয়ার রাস্তা ছিল। পশ্চিমে শীর্ণকায়া ভৈরব নদী, বাঁওড় ও অন্যান্য জলাশয়ের স্বাভাবিক প্রতিবন্ধকতা ছিল।

রোমাঞ্চকর এই অভিযান। যাত্রার শেষ নির্দেশ দেয়ার পরও দেখি রাতের আলো-আঁধারিতে খেজুর বনে সবাই নিশ্চুপ, কেউ নড়ছে না। নিজেদের নিঃশ্বাস ছাড়া অন্য কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। গাঁয়ের কুকুরগুলো পর্যন্ত কোনো প্রকার শব্দ না করে আমাদের অনুসরণ করে যাচ্ছে। সুবেদার ফিরোজ পর্যন্ত লজ্জিত ও লা-জবাব। বেঙ্গল রেজিমেন্টের দু’জন তরুণ সৈনিক অস্ত্ৰ হাতে স্তব্ধতা ভেঙে আমার দিকে এগিয়ে এলো। সুবেদারের ভ্রুকুটিকে তারা গ্রাহ্য করল না। অভাবনীয় নাটকীয় কিছুর আন্দাজ করে হাতের অস্ত্ৰ মাটিতে রেখে সোজা হওয়ার আগে দেখি তড়িৎগড়িতে এবাউট টার্ন

৭৬

হয়ে অস্ত্রসুদ্ধ অর্ধচন্দ্রাকারে তারা আমাকে ঘিরে আছে। ভয় বা উদ্বেগের কোনো কিছু তখন আমার মধ্যে নেই। নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছি। আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে তাদের বললাম, ‘বন্ধুরা, আপনাদের কমান্ড করার যোগ্যতা আমার নেই, আপনাদের দেয়া অস্ত্ৰ আপনারা নিয়ে নিন। হুঙ্কার ছেড়ে গর্জে উঠলেন সিলেটের সুবেদার ফিরোজ। কী কতায় কী কইন, উল্টা বুঝলেন স্যার। হারামজাদারা আইজও আপনারে চিনে নাই। মরণেরে কাছে পাইয়া এইবার হুস হইছে। এই কয়দিনে আপনার সামনে হুওরেরা বহুত বেয়াদবি কইরা ফালাইছে, এইবার মাপ চাইবার চায়।” আমার কিছু বলার ও বোঝার আগেই বাঁধভাঙা বন্যার মতো প্ৰথমে মোজাহেদ, পরে অন্য সৈনিকরা পা ছুয়ে সালাম করে ক্ষমা চেয়ে দোয়া চাইলেন। রাস্তার দুই পার্শ্বে বিন্যস্ত হয়ে আমাকে মাঝে রেখে এবার চলল অগ্রাভিযান। সারারাতের পেট্রোলিংয়ের পর সূর্যোদয়ের আগে উভয় দল নিয়ে বারোবাজারে ফিরে এলাম। পূর্বাহ্নে সৈনিকদের ফাইটিং পেট্রোলের উদ্দেশ্য সম্পর্কে পুরোপুরি ব্ৰিফ না করার কারণেই গোলযোগ দেখা দিয়েছিল।

সারাদিন চলল বিভিন্ন দিকে খোঁজখবর ও রেকি। বিকেল নাগাদ আরো এগিয়ে সামনে মান্দরতলার কোম্পানি মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। রাতের মধ্যে কোম্পানিকে মান্দরতলায় সরিয়ে আনা হলো। কোম্পানিকে এবার তিন প্লাটুনে বিন্যস্ত করে সুবেদার ফিরোজের নেতৃত্বে এক প্লাটুন যোদ্ধা, আরআর এবং ভারী মেশিনগানসহ মূল পাকা সড়কের ওপর ডানে-বামে রাস্তার পাশ ধেয়ে মোতায়েন করা হলো। পূর্বে ডানদিকে লেবুতলায় সুবেদার মুকিতের নেতৃত্বে রাখা হলো এক প্লাটুন। পশ্চিমে বামদিকে ভৈরব নদী, বাওড়, চৌগাছা-কোটচাঁদপুর সড়কের তাহিরপুর পর্যন্ত সুবেদার মজিদ মোল্লার অধীনে দেয়া হলো প্লাটুন মাইনাস। প্রতিদিনই সশস্ত্র ও নিরস্ত্ৰ যোদ্ধারা এসে কোম্পানির শক্তি বৃদ্ধি করতে লাগলেন।

ফ্রন্টলাইনের খুবই কাছাকাছি পাকা সড়কের ডানে গ্রামের ভেতরে লঙ্গর স্থাপন করা হলো। কয়েকদিনের অভিজ্ঞতায় দেখা গেল, যদিও সব দিক থেকে সরবরাহ খুবই সুবিধাজনক, তবুও ফ্রন্টলাইনের এত কাছাকাছি লঙ্গর রাখা নিরাপদ নয়। কারণ আমাদের পশ্চাদপসরণ, ডানে-বামে সরে যাওয়া ও অগ্রাভিযানের কারণে এ স্থানে লঙ্গর নিরাপদ নয়। তাই মূল লঙ্গর পাকা সড়কের ডানে বারোবাজারের পেছনে গ্রামের এক অবস্থাপন্ন লোকের পাকা বাড়ির কাছাকাছি আঙিনায় স্থাপন করা হলো। এখানে পানির বন্দোবস্ত, টিউবওয়েল ও পাকা ঘাটওয়ালা পরিষ্কার বিশুদ্ধ পানির পুকুর ছিল। এখান থেকে রান্না করা খাবার গাড়িতে করে ফ্রন্টে মান্দরতলায় নেয়া হতো। সুবেদার মুকিত ও মজিদ মোল্লাকে এখান থেকে খাবার পাঠানো যেতো না। তাদের চিনি, চা, গুড়াদুধ ও বিড়ি-সিগারেট জাতীয় কিছু জিনিসপত্র জিপে করে মাঝে মাঝে দিয়ে আসা হতো। স্থানীয়ভাবেই তাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। খাবার-দাবারের ব্যবস্থার জন্য স্থানীয় জনগণই ছিলেন ভরসা। তারা আমাদের বহু অসুবিধা দূর করেছিলেন।

মান্দারতলায় ঢাকা-খুলনা মূল পাকা সড়কের ডানদিকে সামান্য দূরত্বে রেললাইন। প্রাইমারি স্কুলের সামনে দিয়ে পূর্বদিকে একটি কাঁচা রাস্তা লেবুতলার দিকে চলে গেছে।

৭৭

সে কাঁচা রাস্তায় জিপ, পিকআপ চলাচল করতে পারে। মান্দরতলা থেকে পেছনে উত্তরদিকে গিয়ে বারোবাজারের কাছাকাছি একটি কাচা রাস্তা পশ্চিমে চৌগাছা-কোটচাঁদপুর সড়কের সংযোগকারী কাঁচা রাস্তায় জিপ চলতে পারে।

পাকা রাস্তার পূর্বে ডানদিকে স্কুল সংলগ্ন আম বাগান। তার পেছনে উত্তরে খেজুর বাগান। পাকা রাস্তার পশ্চিমে বামদিকে রেললাইন পার হয়ে তিন-চারশ’ গজ সামনের দিকে এক দুর্ভেদ্য সুবিস্তৃত বহির্মুখী বিশাল খেজুর বন। এ খেজুর বনের সঙ্গে সামনে প্ৰায় বিশুষ্ক নদী, বিল-বাঁওড়ের প্রতিবন্ধকতা। এ খেজুর বনের সামনে যশোর ক্যান্টনমেন্ট অভিমুখী ঝনঝনিয়ার ফাঁকা মাঠের প্রায় চার হাজার গজের ফিল্ড অব ফায়ারের সুবিধা ছিল।

রাস্তার ডানে স্কুলের পাশের আম বাগানে পাকা রাস্তা নিশানা করে ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী আরআর স্থাপন করা হলো। আরআরের নিকট দূরত্বে দক্ষিণে ফিল্ড অব ফায়ারের খালি মাঠ নিশানা করে ভারী মেশিনগান মোতায়েন করা হলো ।

মান্দরতলা ও লেবুতলার মাঝে দূরত্ব ছিল প্রায় এগারো হাজার গজের মতো। এ দূরত্বটাকে কভার করার জন্য স্থানীয় আনসার-মোজাহেদদের দিয়ে দুটো সেকশনকে আনসার কমান্ডার মাকসুদের নেতৃত্বে মান্দারতলার মাইল দেড়েক দূরে মান্দারতলা-লেবুতলার মাঝে এক খেজুর বাগানে স্থাপন করা হলো।

স্থানীয় জনগণের কোদাল-টুকরি চেয়ে নিয়ে সব পজিশনে উপযুক্ত বাঙ্কার, ওভারহেড কভার, ক্যামোফ্লাজ ইত্যাদি তৈরি করা হলো। এসব অঞ্চলে অধিকাংশ জায়গায় বালু মাটি। মাটি খুঁড়লে সহসা পানি পাওয়া যায় না। ফলে বাঙ্কার বা মরিচা খোদাইতে বিশেষ বেগ পেতে হলো না। ইতোমধ্যে শক্ৰ যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে উত্তরে ঝিনেদার দিকে আসার রাস্তা বন্ধ করার জন্য হায়বাতপুর ব্রিজটি পচাত্তর পাউন্ড বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

আমাদের ফাইটিং পেট্রোল যশোর ক্যান্টনমেন্ট অভিমুখে হায়বাতপুর ব্রিজ পর্যন্ত পেট্রোলিং শুরু করল। লেবুতলার পজিশন থেকে সুবেদার মুকিতও যশোর ক্যান্টনমেন্টের দিকে পেট্রোল পাঠানো আরম্ভ করলেন। পাকিস্তানিরা লেবুতলার দিকে পেট্রোল পাঠাতে থাকল। লোক মারফত বিলম্বে খবর পেয়ে মান্দারতলা থেকে পেট্রোল নিয়ে লেবুতলা পর্যন্ত এগিয়ে সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানিদের ধরার বা মোকাবেলা করার চেষ্টায় কয়েকবারেই অল্পের জন্য ব্যর্থ হতে হলো।

প্ৰায় অর্ধশত গাড়িতে করে পাকিস্তানিরা কী মনে করে যশোর প্রায় খালি করে খুলনা চলে গেল। ঝিনেদার মাহবুব মানব তরঙ্গ দিয়ে যশোর ক্যান্টনমেন্ট দখলের এক আত্মঘাতী দুর্বর পরিকল্পনার কথা আমাকে বলেছিলেন। লাখ লাখ বিক্ষুব্ধ জঙ্গি জনতা দিয়ে যশোর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে দখলের পরিকল্পনার কথা আমরা ভাবতাম। লক্ষাধিকের আত্মোৎসর্গের বিনিময়েও বিদেশী রাজ্য সংলগ্ন একটা ক্যান্টনমেন্ট ও এয়ারপোর্ট আমাদের দখলে থাকলে স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসই ভিন্ন খাতে বইবে, এমন উচ্চাশায় আমরা উৎসাহী ছিলাম। কয়েক লাখ জনতার বিসর্জনে অন্তত কয়েক হাজারও যদি যশোর ক্যান্টনমেন্ট দখল করতে পারে তবে জয় আমাদের সুনিশ্চিত।

৭৮

বিক্ষুব্ধ জঙ্গি জনতাকে সংগঠিত করা তখন মোটেই কষ্টকর ছিল না। কিন্তু পুরো পরিকল্পনায় রাজনৈতিক অনুমোদন না পাওয়ায় তা করা গেল না। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ অবস্থার মূল্যায়নে ব্যস্ত। প্রাথমিকভাবে পরের ওপর বেশি ভরসা ও আশাবাদের ওপরই শুরু হলো বিপর্যয়ের সূচনা। যশোর ক্যান্টনমেন্ট মানব তরঙ্গ দিয়ে দখলের পরপরই প্ৰত্যক্ষ বা পরোক্ষ সাহায্য ছাড়া দখল কায়েম রাখার ব্যাপারে রাজনৈতিক সংশয় দেখা দিল। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাহায্যের সুস্পষ্ট সিদ্ধান্তের রূপরেখা ‘নিই-নিচ্ছি’ করে সময় দ্রুত বয়ে চলল। পাকিস্তানিরা সংহত হতে থাকলো। ভারতের প্রত্যক্ষ সামরিক সাহায্যের জবাব সুস্পষ্ট না হলেই সম্ভবত সর্বোত্তম হতো। বাংলাদেশিরা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে প্রথমেই শেষ লড়া লড়তে পারত, ফলাফল যা-ই হোতে না কেন। মেজর ওসমানও ক্যান্টনমেন্টের ওপর আত্মঘাতী মরণ আঘাতের অনুমতি দিতে দ্বিধায় পড়ে গেলেন। এভাবেই মূল উদ্দেশ্য বাস্তবে মুখ থুবড়ে পড়লো।

পাকিস্তানিরা আবার খুলনা থেকে গাড়ি গাড়ি নতুন শক্তি ও সংখ্যায় যশোর ফিরে এলো। ঢাকা থেকে একটা সামরিক বিমান অনেক ওপর দিয়ে এসে প্রতিদিন এক বা একাধিক ফ্লাইটে অস্ত্র, গোলাবারুদ, রসদ, সাজ-সরঞ্জাম ও সৈন্যদল পৌছে দিয়ে যেতে থাকলো। মান্দরতলা ও লেবুতলার মাঝামাঝি স্থান দিয়ে প্লেনটি উড়ে আসত। বহু চেষ্টা করেও অতিরিক্ত একটি এলএমজি জোগাড় করে মান্দরতলা ও লেবুতলার মাঝামাঝি স্থাপন করে প্লেনটিকে ঘায়েল করা গেলো না। এলএমজির রেঞ্জের মধ্যে প্লেনটিকে আনা যেতো বলে বিশ্বাস ছিল। কারণ যশোর এয়ারপোর্ট সেখান থেকে বেশি দূরে ছিল না।

লেবুতলার ব্যবস্থাপনার অসুবিধার জন্য মাগুরার এসডিও অলিউর রহমান এলেন। সেদিন আমিও রসদ নিয়ে লেবুতলা গেছি। এসডিও সাহেব আমাদের জন্য একটি গরু জবাই করলেন। গরুর চামড়া ছিলানো হলো, এমন সময় পাকিস্তানিদের অগ্রবতী পেট্রোলের সঙ্গে পড়ন্ত বেলায় ভীষণ গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল। আমার আনন্দ যে বিপর্যয়ের সময় প্লাটুনটির পাশে থাকতে পারলাম। ইপিআররা আমাকে শুধু বললেন, ‘স্যার আপনি আমাদের ছেড়ে যাবেন না।” আমাকে আগে বাড়তে না দিয়ে প্লাটুন কমান্ড পোস্টে বসিয়ে সুবেদার মুকিত সিংহবিক্রমে পাকিস্তানিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় পাকিস্তানিরা পিছিয়ে গেল। তাদের ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণ করা গেল না। আমাদের কয়েকজন সামান্য আহত হলো। একটা চটপটে তরুণ ছেলেকে গালেমুখে কিছু আঘাতের দাগসহ আমাদের মাঝে সন্ধ্যা নাগাদ পাওয়া গেল। দক্ষিণে যশোরের দিকে তিন মাইল দূরে এক বাজারে এ তরুণ ছেলেটির সাইকেল কেড়ে নিয়ে তাকে আমাদের পজিশন দেখে গিয়ে রিপোর্ট করতে বলেছে পাকিস্তানিরা। তাকে কিছু উত্তম-মধ্যম দিয়ে পাঠিয়েছে। ফিরে গিয়ে আমাদের অবস্থানের কথা বললে তাকে তার সাইকেল ও টাকা দেবে বলেছে। মেহের হাত বুলিয়ে তাকে কাছে ডেকে বললাম, যাও দেখা তো হলো, এবার তোমার সাইকেল ও টাকা নিয়ে এসো।

এসডিও-সাবডিভিশনাল অফিসার বা মহাকুমা প্রশাসক।

৭৯

আমাদের তো তোমাকে দেয়ার কিছু নেই।‘ রুদ্ধ আবেগে ছেলেটি ফোসাতে থাকলো। আমাদের একজন যোদ্ধা বাড়ল।

গুলে-হরিবোল গরুর মাংস লাপাত্তা। স্থানীয় মুসলিম লীগাররা নিয়ে গেছে বলে এসডিও সাহেব দোষারোপ করলেন। সেদিন যোদ্ধাদের না খেয়ে রোজার কাফফারা দিতে হলো। এসডিও সাহেবকে বলা হলো, ‘পেছন থেকে লজিস্টিক সাপোর্ট দেবেন, ফ্রন্টলাইন আপনার কর্ম নয়।” বাঙ্কারে সবাইকে বিনিদ্র রজনী কাটাতে হলো। মূল লঙ্গর থেকে নিয়ে যাওয়া চা-চিনি, পাউডার মিল্ক ও বিড়ি-সিগারেট নিয়েই সবাইকে তুষ্ট থাকতে হলো। পাকিস্তানিরা মুক্তিবাহিনীর পজিশন জেনে গেছে বিধায় রাতে বা উষালগ্নে ভোররাতে আক্রমণের সম্ভাবনায় সেখানেই থেকে যাওয়া স্থির করলাম। রাতে প্লাটুনটিকে সারপ্রাইজ চেকের ইচ্ছে ছিল। নিজের অবস্থান সম্পর্কে কাউকে সুস্পষ্ট কিছু না বলা মারাত্মক ভুল হয়েছিল। রাতে পার্শ্ববতী জীৰ্ণশীর্ণ দশার একটি পাকা বাড়িতে উঠলাম। টিমটিমে কুপি হাতে একটি ছোট ছেলে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে এলো। মাসিমা বলে ডাক দিতে এক প্রৌঢ়া মহিলা এগিয়ে এলেন। তার কাছে খাবার ও আশ্রয় চাইতেই দুঃখ ও অভিমানে এ হিন্দু মহিলা কেঁদে ফেললেন। একদিন তার সবই ছিল, স্বামী নিখোঁজ, বড় ছেলে পাগল হয়ে নিরুদেশ, ছোট ছেলেকে নিয়ে তিনি স্বামীর সংসার আগলে পরপারের দিন গুনছেন। প্ৰস্থানের উদ্যোগ নিতেই ‘বালাইষাট” বলে ঝটপট তিনি চিড়াগুড়-নারিকেল খেতে দিলেন। এমন তৃপ্তির স্নেহময় হাতের খাবার জীবনে কমই খেয়েছি। শ্ৰান্তিতে-ক্লান্তিতে কখন যে মাসিমার স্নেহময় হাতের কোমল বিছানায় ঘুমিয়ে গেছি জানি না। ঘুম ভাঙলো কাকডাকা ভোরে। তাকে পাঁচটা টাকা দিতে গেলে “নারায়ণ, নারায়ণ’ বলে তিনি জিব কাটলেন। জোর করেই সে টাকা তার ছেলের হাতে গুজে দিয়ে এলাম। জানি না। আজ আমার লেবুতলার মাসিমা কোথায় হারিয়ে গেছেন।

এদিকে ইপিআর প্লাটুনে তুলাকালাম কাণ্ড। ‘প্রফেসর গেল ‘কই’? রসিকতা করে কেউ বলছেন, ‘সেণ্টিপিন পালাইছে’ মুকিতের কথা, ড্রাইভার আছে, গাড়ি আছে, অফিসার কই? আসল বিপদের সময় যে সঙ্গে ছিল, এখন সে কই? রাস্তাঘাট চেনে তো? পাকিস্তানিদের কমান্ডোদের শিকার হয়নি তো? হয়। অফিসারকে বের করে দিতে হবে, নয়। হারামজাদাদের একদিন কী আমার একদিন” বলে সবাইকে তিনি স্ট্যান্ড টু করে রাখলেন। তাদের নাকের ডগায় আমি ছিলাম। সকালে আমাকে পেয়ে সব রসিকের চোখ ছানাবড়া।

পশ্চিমে সুবেদার মজিদ মোল্লার প্লাটুনে গিয়ে দেখি আসেপাশের স্বেচ্ছাসেবকরা মুরগি ও খাসির গোস্তের সুখাদ্য নিয়ে ব্যস্ত। ঝিনেদা ক্যাডেট কলেজের কয়েকজন পিয়ন-দারোয়ানকেও এখানে গোস্ত-পরোটায় ব্যস্ত দেখলাম। যুদ্ধপ্ৰস্তুতি বাদ দিয়ে হালুয়া প্ৰস্তুতিতে ব্যস্ত মজিদকে ভীষণভাবে শাসিয়ে রান্না করা গোস্ত কড়াইসুদ্ধ ক্রুদ্ধ আক্ৰোশে ল্যাট্রিনে ফেলে দিলাম। লড়াই এই না মাত্র শুরু। হালুয়ার গ্রুপ ভাগ। ছাত্ৰজনতা আর এমন হবে না বলে ক্ষমা চেয়ে নিলেন।

যুদ্ধক্ষমতার সুবিধার জন্য মান্দরতলায় রাখা হলো বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিকাংশ সৈন্য। সর্বশেষ পূর্ব-পশ্চিমে ছিল মূলত ইপিআররা। মান্দারতলা ও লেবুতলার

৮০

মাঝখানে রাখা ছিল আনসার ও মোজাহেদদের। ক্যাপ্টেন এআর আজম চৌধুরী ব্যাটল ম্যাপসহ ফ্রন্টলাইনে এসে উপদেশ দিয়ে গেলেন। এসডিপিও মাহবুব প্রায়ই ফ্রন্টলাইনে এসে যোদ্ধাদের দেখে যেতেন। তিনি সবাইকে দেয়ার জন্য পাঁচ হাজার টাকা দেন। কয়েকদিনের ব্যবধানে লেবুতলা ও মান্দরতলার মধ্যে পাকিস্তানিদের সঙ্গে বেশকিছু খণ্ডযুদ্ধ হয়ে গেল। দু’দলের কারোরই এলাকা দখলে রাখার যুদ্ধের মানসিকতার পরিচয় পাওয়া গেল না ।

গাড়ি, রসদ প্রভৃতির জোগাড়ে প্রায়ই পেছনে বারোবাজার ও কালিগঞ্জে আসতে হতো। মান্দরতলায় আরআরের অবস্থান পর্যন্ত টেলিফোন লাইন ছিল। ১২ এপ্রিল দুপুরে ক্যাপ্টেন আজম মান্দরতলার ফ্রন্টলাইনে মূল পাকা সড়কে বসে ব্যাটল ম্যাপ দেখছিলেন। তখনই দূর-দূরান্ত খেকে গোলাগুলির ও ব্লেনডিসাইডের আওয়াজ আসছিল। ব্যস্ততার সঙ্গে তিনি ম্যাপ গুটিয়ে সুবেদার ফিরোজের সঙ্গে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় ও কথাবার্তা বলে সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে চলে গেলেন।

ফিল্ড অব ফায়ারের ফাঁকা স্থানের অধিকতর সুবিধা পাওয়া যাবে ভেবে ১২ এপ্রিল সন্ধ্যার পরপরই ভারী মেশিনগানটি রাস্তার পূর্ব পার্শ্ব থেকে স্থানান্তর করে পশ্চিমে খেজুর বাগানে সরিয়ে নেয়া হলো। এভাবে একস্থানে স্থির থেকে ডানে-বামে পেট্রোলিং করে কাজের কিছু হবে না। পাকিস্তান আর্মি রেকি, পেট্রোল ও অন্যান্য সূত্র থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের খবরাখবর নিচ্ছে। তাদের গোলাগুলি ও আনাগোনা যেন একটা বিশেষ কিছু হতে যাচ্ছে ধরনের বিশ্বাস মনে সৃষ্টি হলো। পুরো ব্যবস্থাপনায় কিছু পুনর্বিন্যাস আরম্ভ করলাম।

রাতে স্থানান্তরিত পশ্চিম পাশের খেজুর বনের ভারী মেশিনগান সেকশনকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে তাদের সামনের ফাঁকা মাঠের ফিল্ড অব ফারার বরাবর নির্দিষ্ট আওতার ভেতর শত্রু না আসা পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিশ্চুপ থাকার জন্য তাদের কঠোরভাবে হাঁশিয়ার করে দেয়া ছিল। মূল পাকা সড়কে যা-ই ঘটুক তার ব্যাপারে ভারী মেশিনগানকে সম্পূর্ণ নিস্ক্রিয় থাকার নির্দেশ দিলাম। মূল পাকা সড়ককে সামলানোর জন্য আরআর রিকয়েললেস রাইফেল ও পূর্ব পার্শ্বের প্লাটুনই ছিল যথেষ্ট। প্রয়োজনে পূর্ব পার্শ্বে নিয়োজিত মান্দরতলা ও লেবুতলার মাঝের মাকসুদের প্লাটুনের সাহায্য পাওয়া যাবে।

১৩ এপ্রিল রসদ, গাড়ি, গাড়ির তেল সংগ্ৰহ জাতীয় কাজে সকাল ৯টার দিকে মান্দরতলা থেকে বারোবাজার হয়ে কালিগঞ্জ পৌছার সঙ্গে সঙ্গেই সুবেদার ফিরোজের উদ্বিগ্ন টেলিফোন পেলাম। পাকিস্তানি সৈন্য মূল পাকা সড়ক ধরে গাড়ির কলাম নিয়ে এগিয়ে আসছে। কালিগঞ্জ থেকে সে সংবাদ টেলিফোনে ঝিনেদাকে জানানো হলো। ঝিনেদা সে সংবাদ টেলিফোন ও ওয়্যারলেসে মেজর ওসমানকে চুয়াডাঙ্গায় পাঠায়। এভাবে যুদ্ধের গতিধারা সম্পর্কে সর্বক্ষণ ঝিনেদা ও হেডকোয়ার্টার চুয়াডাঙ্গায় মেজর ওসমানকে অবহিত করা হচ্ছিল।

বারোবাজারের লঙ্গর পর্যন্ত কোনো টেলিফোন লাইন দেয়া ছিল না। ভুলবশত তাদের সঙ্গে কোনো সুনির্দিষ্ট বার্তাবাহক মারফতও সংবাদ আদান-প্রদানের ব্যবস্থা ছিল না। ফলে যুদ্ধের গতিধারা সম্পর্কে তাদের না জানার ফল হয়েছিল মারাত্মক।

৮১

সুবেদার ফিরোজকে রেঞ্জের ভেতরে আসার আগে আরআরের গোলা ছুড়তে নিষেধ করলাম। শত্রুর অগ্রগামী ভ্যানগার্ড গাড়িটি আমাদের আরআরের তিন নম্বর গোলার সঠিক নিশানায় ঘায়েল হলো। সম্পূর্ণ গাড়িটিতে আগুন ধরে গেলো। আগুনের লেলিহান শিখা আকাশে অনেকদূর উর্ধে শিখা বিস্তার করলো। পেছনের দু’নম্বর গাড়িটি আকস্মাৎ তাল সামলাতে না পেরে সৈন্যসামন্তসহ রাস্তার পাশে কাত হয়ে পড়ে গেলো। গাড়ির কনভয়ের কলাম রাস্তায় হল্ট হলো।

ঝিনেন্দাকে শক্রির আগমনের খবর দিতে বিনোদার ওয়াপদা থেকে ক্যাপ্টেন আজম বললেন, “আরআরের পাল্লায় এখনো আসেনি, তারা তো অনেক দূরে’। পরে আমাদের আরআরের গোলায় শক্রির গাড়ি বিধবন্ত ও অগ্রাভিযান থেমে যাওয়ার সংবাদ দিতে টেলিফোনেই তাদের আনন্দ-উল্লাসের আওয়াজ পেলাম। চুয়াডাঙ্গায় সে সংবাদ মেজর ওসমানের কাছে পৌছাতেই তড়িঘড়ি কন্ট্রোল হেডকোয়ার্টারে স্বয়ং এসে তিনি ওয়ারলেসে কোম্পানিকে মোরারক্যবাদ ও প্রফেসারের (আমার) জন্য অভিনন্দন বাণী পাঠান। জীবনে এমন আনন্দঘন উদ্বেগে আকুল অবস্থার সম্মুখীন বেশি হইনি।

শত্রু এবার গাড়ি থেকে নেমে পূর্বদিকে অধিক সংখ্যায় গোলাগুলির বন্যা সৃষ্টি করে পায়েদল যাত্রা আরম্ভ করলো। দু’দলে তুমুল লড়াই শুরু হয়ে গেলো। মান্দরতলা ও লেবুতলার মাঝে মোতায়েন মাকসুদের আনসার-মোজাহেদ প্লাটুনও বীরবিক্রমে শক্রির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। সম্ভবত সৰ্বক্ষণ নিচুপ থাকার কারণে মাকসুদের প্লাটুনের ব্যাপারে শত্রু অবহিত ছিল না, তাই পূর্বদিকে বিস্তৃত (এক্সটেনডেড) লাইনে এগুতে গিয়ে শক্রকে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির স্বীকার হতে হলো। নিজ পক্ষেও বেশ কয়েকজন হতাহত হলো ।

হেডকোয়ার্টার বারোবাজার থেকে কালিগঞ্জ সরিয়ে আনা হলো। মান্দারতলায় ফ্রন্টলাইনে আমার যাওয়ার প্রস্তাবে ফিরোজ বিশেষভাবে আপত্তি করলেন। সংকটের সন্ধিক্ষণে সাখীদের ছেড়ে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থানের অপবাদ থেকে মুক্তির জন্য মান্দারতলা যাত্রার জেন্দাজেদিতে ফিরোজ হয় জেনারেল উইথড্রাল, না হয় তার নিজের চলে আসার অনুমতি চাইলেন। তিনি আমাকে বললেন, ‘স্যার, আপনি অনেক কিছু এখনো বুঝেন নাই, মন খারাপ কইরা লাভ নাই, আপনি পিছের যোগাযোগ ও আমার সাপ্লাই ঠিক রাখেন। আমি আপনের সঙ্গে কথা কইতে আছি, সবাই জানে আপনে আমাদের সঙ্গে আছেন-ফৌজের এর বেশি দরকার নেই’।

বেলা বারোটা নাগাদ দূরপাল্লার কামানের গোলা আসা আরম্ভ হলো। প্রথমে আমাদের পজিশনের অনেক দূরে পেছনে গোলা পড়া আরম্ভ হলো। পরে রেঞ্জিং করে তারা গোলা আমাদের পজিশন বরাবর গোলা আনা আরম্ভ করল। এবার উদ্বিগ্ন ফিরোজ কাউকে বিশেষ কিছু না বলে আরআরটি রক্ষা করা যাবে না ভেবে আরআরটি কালিগঞ্জে নিয়ে এলো। সাহায্যের আকুল আবেদন জানিয়ে ঝিনেদাকে সংবাদ দিলাম। সংকট সময়ে চুয়াডাঙ্গা থেকে মেজর ওসমান সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলেন।

পাকিস্তানি সৈন্য পূর্বদিকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করেও এগুতে পারলো না। রাস্তার পশ্চিম দিকে সবকিছু নীরব, খালি মাঠ দেখে তারা এবার ঝনঝনিয়ার ফাঁকা মাঠ

৮২

ধরে দক্ষিণ থেকে উত্তর-পশ্চিমে খেজুর বনের দিকে নিচুপ ভারী মেশিনগান বরাবর অগ্রসর হলো। পশ্চিম দিক থেকে কোনো গোলাগুলি নিক্ষিপ্ত না হওয়ায় শক্রর আর্টিলারির শেলের গোলাও সেদিকে বিশেষ একটা পড়লো না। সে নিবিড় খেজুর বনে দু’একটা বিক্ষিপ্ত গোলায় তেমন ভয় বা ক্ষতির কিছু ছিল না।

পাল্লায় আসতেই ঝড়ো হাওয়ার উল্কাগতিতে নিচুপ ভারী মেশিনগান শত্রু নিধনে গর্জে চলল। এ মরণফাঁদে পা দিয়ে শক্ৰকে চরম মূল্য দিতে হলো। পরবতী দু’দিনে এ ভারী মেশিনগানের মুখেই নিহত আশি জনের লাশ শক্ররা মাঠ থেকে কুড়িয়ে নিয়েছে। পূর্বপাশের ব্যর্থতার পর শক্ৰ মরিয়া হয়ে পশ্চিমের সব ক্ষয়ক্ষতি ও বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে সম্মুখে এগিয়ে এলো। শক্রির চায়নিজ বুলেট আমাদের ভারী মেশিনগানের নাম্বার ওয়ানের বুকে লেগে রক্তপাত আরম্ভ হলো। নিজের সঙ্গের গামছা ছিড়ে বুক বেঁধে সর্বশেষ শক্তি নিয়োগ করে নিজের জীবনের মায়া উপেক্ষা করে তিনি শক্ৰ নিধনে বেপরোয়া নিয়োজিত রইলেন। গুলি ফুরিয়ে আসছে, রক্তক্ষরণে তিনি নিস্তেজ হয়ে পড়ায় মেশিনগানের দ্বিতীয় নাম্বারের সৈনিক তার স্থান নিয়ে শক্ৰ নিধন করে চললেন। শত্রু এবার ভারী মেশিনগানের পজিশন বরাবর খেজুর বনে দূরপাল্লার গোলা ফেলা আরম্ভ করলো। নিঃশেষপ্রায় গুলির মুখে শত্রুর ‘হ্যান্ডস আপ, হ্যান্ডস আপ’ ধ্বনির মধ্যে মেশিনগানের সৈনিককে বহন করে একজন উধৰ্বশ্বাসে ঝড়ো হাওয়ার মতো খেজুর বনের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে পাশের গায়ে নিয়ে তার প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। পরে তাকে একটি ঘোড়ার গাড়িতে করে রাতের মধ্যেই বর্ডার পার করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। চায়নিজ গুলি সরাসরি কলিজা ছেদ না করলে, তাৎক্ষণিক প্রাথমিক চিকিৎসা ও পরবতী উপযুক্ত চিকিৎসা হলে ভয়ের কিছু থাকে না; আহত ব্যক্তি তখন বেঁচে যান। চায়নিজ গুলি সৈনিকের বুকে আঘাত হেনে পিঠ ভেদ করে সম্পূর্ণ বের হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কলিজা ভেদ করেনি বলে ইপিআরের সে অসীম সাহসী বীর সৈনিক বেঁচে গিয়েছিলেন।

দূরপাল্লার কামানের গোলায় আমাদের পজিশন বিধ্বস্ত হওয়া আরম্ভ হলো। সাহায্যের জন্য বিনেন্দাকে এসওএস মেসেজ দিতে ক্যাপ্টেন আজম সাহায্য পাঠাচ্ছেন বলে খবর দিলেন। শত্ৰু পূর্বদিকে মাকসুদের পজিশনেরও পূর্বদিক দিয়ে আমাদের পেছন দিক থেকে ঘিরে ফেলতে চাইলো। কামানের অবিরাম গোলায় আমাদের পূর্বের পজিশন বিধ্বস্ত হয়ে গেল। মাকসুদ পিছে হটে গেলো। ফিরোজ বারোবাজারে পিছিয়ে এসে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চাইলেন। বেলা ১টা থেকে ২টা নাগাদ মান্দারতলার পজিশন সম্পূর্ণ ছেড়ে এসে বারোবাজারে শত্রুর আর্টিলারি শেলের গোল গুলির ভেতরই পজিশন নেয়ার চেষ্টা চললো। বেলা ৩টা নাগাদ একটি সশস্ত্ৰ প্লাটুন নিয়ে ক্যাপ্টেন আজম নিজে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলেন। পথে বিশখালী ব্রিজ উড়ানো ছিল বলে আসতে তার দেরি হলো। কালিগঞ্জে আমাকে থানা হেডকোয়ার্টারে ও টেলিফোনে থাকার নির্দেশ দিয়ে শত্রুর আর্টিলারি শেলের বৃষ্টির মাঝেই তিনি এগিয়ে চললেন। শক্ৰ এরই মধ্যে বারোবাজার পৌছে গেছে। বারোবাজারে পৌঁছেই আজম শক্রির মেশিনগানের মুখে ট্রাকসুদ্ধ পড়ে গিয়েও অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলেন। সুবেদার

৮৩

ফিরোজ প্রতিরোধের শেষ চেষ্টা করে ক্যাপ্টেন আজমের ট্রাকে উঠে কালিগঞ্জ এলেন। আজম আমাকে প্রতিরোধের চেষ্টা ত্যাগ করে তার সঙ্গে চলে আসার আহবান জানালেন। আজমের মারফত সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলাম। আমার যাওয়া হবে না বলে জানিয়ে দিলাম। বললাম, ভাগ্যের খেলার শেষ পরিণতি আমাকে দেখতে দাও। অগত্যা আজম প্লাটুন নিয়ে ঝিনেদা ফিরে গেলেন।

ঝিনেদা পৌঁছেই ক্যাপ্টেন আজম মাহবুবের সঙ্গে যোগাযোগ করে অবাধ্য প্রফেসরকে ফিরিয়ে আনার আবেদন জানালেন। মাহবুব রেগে গিয়ে আমাকে ফেলে আসার জন্য আজম ও ফিরোজের প্রতি ক্রুদ্ধ আক্ৰোশে ফেটে পড়লেন। টেলিফোন তুলেই মাহবুব প্ৰথমে চুয়াডাঙ্গায় মেজর ওসমানের সঙ্গে কথা বললেন। এবার আমাকে অবাধ্যতার পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে কালিগঞ্জ ছেড়ে ঝিনেদা চলে আসার তাৎক্ষণিক নির্দেশ দিলেন। দু’জনের মধ্যে এবার আক্রোশের বাকযুদ্ধ টেলিফোনে শুরু হলো। আমার সাফ জবাব, ছিন্নবিচ্ছিন্ন কোম্পানির ব্যাপারে স্থির নিশ্চিত না হয়ে কালিগঞ্জ ছাড়ছিনে। মানুষের নেতৃত্বের আমানতের বিশ্বাসের মূলে কোম্পানির সবাইকে ফেলে পালিয়ে গিয়ে পোড়ামুখ কাউকে দেখাতে চাইনে। পরাজয়ে দুঃখ নেই। বিপদের মুখে সৈনিকদের নেতৃত্বশূন্য করে কাপুরুষের মতো পালানো ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে বন্ধুদের কাছে শেষ বিদায় চেয়ে নিলাম। এবার সফিক উল্লাহ তোমাদের কাছে মৃত ওসমানের স্মরণ নিলেন। দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের অধিনায়ক মেজর ওসমানের ফিরে আসার সুস্পষ্ট নির্দেশও সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলাম। ক্রুদ্ধ আক্ৰোশে মাহবুব বারবার ফেটে পড়ছিল। একাধিকবার ধড়াম করে তিনি টেলিফোন রেখে দিচ্ছিলেন। অগত্যা তিনি আমাকে শাসিয়ে শেষবারের মতো মেজর ওসমানের স্মরণ নিলেন। ওসমান মাহবুবের মারফত জানতে চাইলেন প্রফেসর আদতে পাগল কিনা; যদি তা না হয় তবে তার নিজস্ব কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা, তা যত তুচ্ছ, অবাস্তব বা অসম্ভবই হোক না কেন।

মাহবুব এবার সুর পাল্টিয়ে আমার নিজস্ব পরিকল্পনা জানতে চাইলেন। বেলা তখন চারটার বেশি বাজে। সন্ধ্যা হতে বেশি বাকি নেই। পাকিস্তান আমি আজ মার কম খায় নাই। এতসবের পর তারা প্রয়োজনীয় রেকি, রিপ্লেসমেন্ট, সাপ্লাই প্রভৃতি স্থির না করে দিনের অবশিষ্টাংশ ও রাতের মধ্যে এডভান্স করবে না বলে আমার স্থির বিশ্বাসের কথা জানিয়ে দিলাম। দুটি প্লাটুন এখনো অক্ষত আছে। সুবেদার মজিদ মোল্লা ও মুকিতের প্লাটুন দুটিকে উইথড্র করে আনার কথা বললাম। এখানে তিষ্টানো যাবে না জেনেও এ মরণফাঁদে অবস্থানের দু’টি সুস্পষ্ট কারণ উল্লেখ করলাম (১) বিচ্ছিন্ন কোম্পানিটাকে একত্র করে দুলাল মুন্দিয়ায় প্রতিরোধের চেষ্টা নেয়া, (২) শক্ৰকে স্ক্রিনিংয়ের মতো সামনে ব্যস্ত রেখে মাগুরা, কুষ্টিয়া, ঝিনেদা, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুরে যুদ্ধের উপকরণ অস্ত্ৰ, গোলাবারুদ, পিওএল যোদ্ধাদের নিরাপত্তা, ব্যাংকের টাকা-পয়সা নিরাপদ দূরত্বে স্থানান্তরজনিত সুযোগ করে দেয়া। মেজর ওসমানের কাছে সাহায্যের আকুল আবেদন শেষবারের মতো পেশ করলাম। ওসমান উদ্বিগ্ন না হয়ে

৮৪

স্থিরচিত্তে কাজ করার ও অস্থিরতা পরিহারের নির্দেশ দিলেন। তিনি তার তাৎক্ষণিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলেন। সাহায্যের ধরণ ও প্রকৃতির বাস্তব চিত্র শিগগিরই জানানো হবে বলে বলা হলো ।

রাত ৯টায় চুয়াডাঙ্গা থেকে কালিগঞ্জ অভিমুখে সাহায্যের একটি কোম্পানি রওনা হয়ে গেছে বলে জানানো হলো। এবার ভাবনামুক্ত হয়ে পরিকল্পনায় লাগলাম।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। সব হারিয়ে ঠুঁটো জগন্নাথ কালিগঞ্জ থানায় বসে আছি। যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে কালিগঞ্জ পর্যন্ত রাস্তা খোলা। যে কোনো সময় শক্রির হাতে ধরা পড়তে পারি। থানায় মাত্র দু’জন পুলিশের কনস্টেবল আছে। অন্ত্রের মধ্যে সঙ্গের রাইফেলই আছে। সবার জন্য খাবার পাক করিয়ে কালিগঞ্জে রেখেছি। খাবে কে? হায় দুৰ্ভাগ্য। কোম্পানির কেউ বেঁচে থেকে ফিরে এলে তো? আমার থানায় অবস্থানের ফলে বাজারের সিভিলিয়ানদের অনেকে রয়ে গেলেন। স্থানীয় কলেজের এক তরুণ ছাত্র আজব ধরনের একটা ছোট্ট ব্যাটন হাতে ঘুরতে ঘুরতে থানায় এলেন। এ কথা সে কথার পর তিনি তার হাতের ব্যাটনটা সম্পর্কে আমার ধারণা জানতে চাইলেন। আমি স্বাভাবিকভাবেই ব্যাটন ব্যাটনই বা আমার অজ্ঞতার কথা বললাম। তিনি তা খুলে দেখালেন। ভেতরে একটা অদ্ভুত ধরনের রাশিয়ান ড্যাগার। তিনি কেন যেন নিজের পরিচয় দিতে ইতস্তত করছিলেন। শুধু বললেন, আওয়ামী লীগের বাইরে ভিন্নতর রাজনৈতিক আদর্শে তারা দীক্ষিত। বর্তমান সংক্ষিপ্ত পরিচয় নকশাল বলে। আমি সোজাসুজি তার উদ্দেশ্য কী জানতে চাইলাম। তার অকপট জবাব, অস্ত্ৰ সংগ্ৰহই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। তিনি রাইফেলের পাশে এসে বসলেন। বাইরে দূরে যেন অন্য কয়েকজনের আনাগোনা রাতের আঁধারেই টের পেলাম। শ্রেণীশক্ৰ খতমের জন্য তাদের অস্ত্ৰ চাই। অস্ত্ৰ সংগ্রহের এই হলো মহেন্দ্ৰক্ষণ ও মোক্ষম সময়। শুধু জিজ্ঞেস করলাম, স্বাধীন বাংলা তাদের তাদের কাম্য কিনা। স্বাধীনতার প্রশ্নে একমত হলেও ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, এ স্বাধীনতায় শোষিত মানুষের মুক্তি আসবে না। রাজনৈতিক ইজমের নীতিকথার আদর্শ প্রচারের মন-মেজাজ বা সময় কোনোটাই আমার ছিল না। অনেকক্ষণ ধ্যানমগ্ন হয়ে যেন সম্বিৎ হারিয়ে ফেললাম। সুপ্তি কাটিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। বিগত কয়েকদিনের পরিশ্রম, অনিদ্রা ও উদ্বেগে ঘুম ঘুম ভাব আসছে। তাকে শুধু বললাম, তবে বসে আছেন কেন? অন্ত্র নিয়ে চলে যান। এখানে তো আমি একা, বিভীষণদের সঙ্গে লড়া আমার কর্ম নয়। তবে আপনাদের প্রতি শেষ অনুরোধ, যাওয়ার আগে শত্রুর হাতে ধরা পড়ার পূর্বমুহূর্তে বা শেষমূহুর্তে আমাকে হত্যা করে যাবেন।’

এ নাটকীয় মুহুর্তে থানার পুলিশটা কী মনে করে যেন অন্ত্র নিয়ে পাশের রুমে বসল। অপ্রত্যাশিতভাবে রণক্ষেত্র থেকে শ্ৰান্ত এক ইপিআর সৈনিক অস্ত্রসুদ্ধ সামনে এলেন। অবাক বিস্ময়ে, স্যার’ বলে স্যালুট করে ক্লান্তিতে তিনি বসে পড়লেন। তার পেটে ভীষণ বেদনা। তাকে লঙ্গরে যেতে বলতে তিনি বিশ্রাম চাইলেন। পাশের রুমে তাকে বিশ্রাম নিতে বললাম। ১১টা নাগাদ ইপিআরের দ্বিতীয় সিপাই অন্ত্রসহ এসে ক্যাপ্টেনের খোজ নিলেন। ক্লান্ত হলেও তিনি কর্মক্ষম ছিলেন। তাকে লঙ্গরে গিয়ে খেতে বলতে তিনি জিজ্ঞেস করলেন আমি খেয়েছি। কিনা। আমার নিরুত্তরে তিনি

৮৫

চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। “আপনারা বোঝেন তো সবই, চাচা আপন প্ৰাণ বঁাচার পথে না গিয়ে এ দুর্ভাগ্য প্রফেসরের কাছে কেন মরতে এসেছেন।” বলতে না বলতেই রুদ্ধ আবেগে কণ্ঠ আমার ভারী হয়ে এলো। নিজের অজান্তে আনন্দাশ্রঞ্চ নীরবে গড়িয়ে পড়লো। সৈনিককে যেখানে খুশি চলে যেতে বললাম। তাদের প্রটেকশন দেয়ার শক্তিসামৰ্থ্য এখন আমার নেই। সরল সৈনিক সোজাসুজি জানতে চাইল, আমি যাব কিনা। বিরক্তির সঙ্গে তাকে বললাম, “বাবা, আমাকে শান্তিতে মরতে দাও, নিজের পথ দেখ”। “কছম খোদার’ বলে সৈনিক চিৎকার করে উঠল। ‘আপনাকে ফেলে কোথাও যাচ্ছি না’ বলে রাইফেল নিয়ে আমার রুমের সামনে সেন্ট্রির পাহারায় লেগে গেল। পাশের রুম থেকে পুলিশ ও ক্লান্ত ইপিআর চিৎকার শুনে বেরিয়ে এসে ব্যাপার কি দেখতে চাইল ।

নকশালদের চালে ভুল হলো কী বিলম্ব হলো, না। স্বদেশ প্ৰেম জাগল, বুঝলাম না। তারা শুধু বললেন, ‘স্যার, আমাদের উদ্দেশ্য যা-ই থাক, কিন্তু আজ আপনি এখানে কেন? অনেককে তো দেখলাম, তারা আজ কোথায়? জানি ভবিষ্যতে আমরাই আপনাদের শক্র হবো, আমাদের আপনারা ভুলে যাবেন। যদি বিশ্বাস করেন আমাদের কাজে লাগাতে পারেন। আমাদের দ্বারা আপনার উপকার ছাড়া কোনো অপকার হবে। না।’ আমি তাদের বললাম, “ব্যক্তিবিশেষের প্রতি দরদ বা বিশ্বাসের দাম নেই। বাংলাদেশকে যদি ভালোবেসে থাকেন, স্বাধীনতা যদি কাম্য হয়ে থাকে আমার পাশে এসে দাঁড়ান’। তারা আমার প্রতি বিশ্বস্ততা ও আনুগত্যের শপথ নিয়ে আদেশের প্ৰতীক্ষায় রইলেন।

লোক পরম্পরায় দূর-দুরান্তে ছরিয়ে-ছিটিয়ে পড়া সৈনিকদের কাছে আমার কালিগঞ্জ থানায় অবস্থানের সংবাদ পৌঁছে গিয়েছিল। প্ৰথমে কথাটা অনেকেরই বিশ্বাস হয়নি। খবরের সত্যতা যাচাই করে, সন্দেহমুক্ত হয়ে দু’একজন করে সশস্ত্র সৈনিক কালিগঞ্জে আসতে আরম্ভ করল। আমি তাদের গরম আহার ও চা পানের ব্যবস্থা করে বিশ্রাম নিতে বললাম।

 রাজনৈতিক কর্মীরা ও স্থানীয় জনগণ সব বিপদ-আপদ তুচ্ছ করে সৈনিকদের আশ্রয়, শুশ্ৰষ্যা, আহারের ব্যবস্থা করলেন। পারস্পরিক যোগাযোগের কাজটা তারা বিশ্বস্ততার সঙ্গে করেছিলেন। নকশালদের মাধ্যমে সুবেদার মুকিত ও মজিদ মোল্লাকে যে কোনো মূল্যে রাতের মধ্যে বা ভোরের মধ্যে প্লাটুনসহ কালিগঞ্জে আমার সঙ্গে যোগ দেয়ার জরুরি নির্দেশ পাঠালাম। আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনৈতিক কর্মীদের যে কোনো মূল্যে ও প্রচার মাধ্যমে মাগুরা, কুষ্টিয়া, ঝিনেদা, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরের দিকে কালিগঞ্জের সশস্ত্র প্রতিরোধ। শরিক হওয়ার আকুল আবেদন পৌছে দিতে বললাম। নকশাল ও রাজনৈতিক কর্মীরা অত্যন্ত বিশ্বস্ততা ও আনুগত্যের সঙ্গে সে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

রাত দুটো থেকে তিনটা অতিক্রান্ত হয়ে গেল, ঝিনেদা থেকে মাহবুব বারবার বলছেন, চুয়াডাঙ্গার কোম্পানি যাত্রা করেছে, এখনই পৌঁছে যাবে। আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটলো। পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে কেমন যেন লাগলো। চুয়াডাঙ্গা থেকে গাড়িতে করে কালিগঞ্জ পৌঁছতে এতক্ষণ লাগতে পারে না-রাস্তা যত খারাপই থাক। মাহবুব বারবার বলছেন, কোম্পানি এখনই পৌঁছে যাবে। আমি সব সংশয়ের অবসান করে

৮৬

জিপ নিয়ে পাকা রাস্তা ধরে বিশখালীর উড়ানো ব্রিজ পর্যন্ত এলাম। জিপ থেকে নেমে একা একাই খালের অপর পারে এলাম। সব চুপচাপ, কেউ কোথাও নেই। সামনে এগিয়ে কী মনে করে স্টেনের টিগারে হাত দিয়ে রাগে চিৎকার করে বললাম, ‘দিলাম ছেড়ে, কে কোথায় আছিস কথা ক’ নিকট দূরত্বে আলো-আঁধারিতে অস্ত্ৰ সংবরণের তুড়িত আবেদন জানিয়ে একজন দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি ধীরকষ্ঠে ক্যাপ্টেন খোন্দকার নাজমুল হুদা বলে নিজ পরিচয় দিলেন। রাগে ফেটে পড়ে তার ওপর একহাত নিলাম। ‘হুদাই আপনার নাম হুদা, এই আপনার আমাকে সাহায্য? কোথায় কালিগঞ্জ আর কোথায় বিশখালী? কাপুরুষ কোথাকার।’ নাজমুল হুদা স্মিত হেসে বললেন, একমাত্র স্টেন নিয়ে একাই তো একটা কোম্পানিকে সারেন্ডার করালে, আর কী চাই? তোমার সঙ্গে আমার সবেমাত্র পরিচয়, অধৈৰ্য হয়ে না, শান্ত হও। এটা একটা সদ্য জোড়াতালির মোজাহেদ-আনসার কোম্পানি। শক্রির এক বাস্টের পর এরা যে কতটুকু তিষ্টাবে তাতে আমার সন্দেহ আছে। তাই এ টেকনিক্যাল অবস্থান।’

লাখো শুকরিয়া আল্লাহ তোমার দরবারে। সন্ধ্যায় যার কিছুই ছিল না, রাতের মধ্যেই তার প্রতি তোমার অপার অনুগ্রহ। একটা কোম্পানির সাহায্য আমার সব ক্লান্তি দূর করে শক্তি-সাহস বহুগুণ বাড়িয়ে দিল।

কালিগঞ্জ ফিরে এলাম। ঝিনেদা ক্যাডেট কলেজের ড্রাইভার অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক শ্ৰান্ত -ক্লান্ত হালিমকে অস্ত্রসহ পেলাম। তিনি হতাশায় ভেঙে পড়লেন। তাকে লঙ্গরে খেয়ে বিশ্রাম নিতে বললাম। হতাশ কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘স্যার, মারেন-কাটেন যা-ই করেন আর পারি না’। পাশের রেলস্টেশন থেকে এক হাবিলদার খবর পাঠালেন, ‘স্যারের নির্দেশ পেলে তিনি আসতে পারেন”। অস্ত্ৰ, গোলাবারুদ, ক্লান্ত সাখীদের সঙ্গে আনার জন্য তিনি ট্রান্সপোর্ট চেয়ে পাঠালেন। আসার অনুমতি পেয়ে ট্রান্সপোর্টের অপেক্ষা না করে নিজের থেকেই ঘোড়ার গাড়ির ব্যবস্থা করে সবকিছু নিয়ে তিনি আমার সঙ্গে মিলিত হলেন।

চতুর্দিকের থানাগুলোকে ওয়ারলেস, টেলিফোন ও অন্যান্য প্রচার মাধ্যমে প্রাক্তন আর্মির লোকজনকে কালিগঞ্জ যাত্রার জরুরি নির্দেশ পাঠান ঝিনেদার এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন আহমদ । রাজনৈতিক কর্মীরা পঞ্চাশ বৰ্গমাইল এলাকায় কালিগঞ্জের শক্ৰ প্রতিরোধের সংবাদ রাতের মধ্যে পৌছে দিয়ে কী করে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা রিটায়ার্ড, ছুটিতে আসা আর্মি ও অন্য লোকজনকে সশস্ত্ৰ নিয়ে এলেন তা আমার কাছে এক পরম বিস্ময়। কিছুসংখ্যক আন্ডারগ্রাউন্ড সশস্ত্র ব্যক্তিও আমার সঙ্গে যোগ দিলেন। উষার আলো-আঁধারির মাঝেই দূর-দূরান্ত থেকে সদ্য প্রত্যাগত প্রায় দু’প্লাটুনের মতো যোদ্ধা পেয়ে গেলাম। তারা একজন-দু’জন করে এসে ক্রমেই আমার শক্তি বৃদ্ধি করছিলেন। তারা আমার কাছে ডিফেনসিভ পজিশনের দিক নির্দেশ চাইলেন। তাদের গরম চাবিষ্ণুট দিতে অনেকে বিরক্তির সঙ্গে তা ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, “এখনই খাবার জন্য তো। এখানে আসিনি’। তাদের দুলাল মুন্দিয়া বাজারে পাকা সড়কের পূর্ব-পশ্চিমে যে কাচা রাস্তা গেছে তার বরাবর ডিফেন্স নিতে বললাম।

এখানে সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো খোড়াখুড়ির খন্তা-কোদাল-গোন্তি-বেলচার। সবাই অস্ত্র নিয়ে এলেও কেউ ডিগিং টুলস নিয়ে আসেননি। স্বেচ্ছাসেবক কমীরাও

৮৭

বিশেষ সাহায্য করতে পারলেন না। কারণ ঘুমন্ত গ্রাম থেকে শেষ রাতে খন্তা-কোদাল জোগাড় তত সহজ ছিল না। রাস্তার পাশের অনেকে পরিবার-পরিজন দূরে সরিয়ে ফেলায় অনেক ঘরবাড়ি খালি পড়ে ছিল। ফলে সেখানে খোজ করেও বিশেষ কিছু পাওয়া গেলো না। ফলে উচু রাস্তার পাশের আড়, খেজুর ও অন্যান্য গাছের গোড়া, মাটির ঘর জাতীয় কভারই হলো আমাদের পজিশন। সূর্যোদয়ের রক্তিম আভার সঙ্গে যোদ্ধাদের তেজোদীপ্ত নিভীকি চেহারা দেখলাম। তারা সবাই তাদেও সেরিমনিয়াল পোশাক, মেডেল, পদক ও রিবনে সজ্জিত ছিলেন। বেল্ট, ব্যাজ, পদক ঘষামাজা, চকচক করছিল। তাদের নেতৃস্থানীয় কয়েকজন বললেন, ‘স্যার, তাদের যে এতক্ষণ ঠেকিয়ে রেখেছেন এই যথেষ্ট। বাকিটা আমাদের হাতে ছেড়ে দিন”। সবাই আগে বাড়িয়ে উষ্ণ করমর্দনের মাধ্যমে গর্বভরে নিজেদের পরিচয় দিলেন। সকালের দিকে অনেকে আনন্দের আতিশয্যে দুলাল মুন্দিয়ায় তাদের পজিশন দেখাতে নিয়ে গেলেন। এমন দুৰ্যোগপূর্ণ সংকটের মাঝে গর্ব ও আনন্দে অভিভূত হয়ে গেলাম। বাংলাদেশে আমার চেয়েও বড় অনেক বেয়াকুব আছে। না হয় মৃত্যুর মুখে এমন বন্ধুদের পেলাম কী করে? জীবনের মহোত্তম স্মৃতিগুলোর মাঝে দুলাল মুন্দিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

সকাল ৭টার দিকে মোটরসাইকেলে গ্রামের ঘুরপথে সুবেদার মজিদ মোল্লা একা এলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে ও অবস্থার মূল্যায়ন করতে। তাকে অকথ্য গালাগালে প্লাটুন নিয়ে না আসার জন্য চার্জ করলাম। অনুগত সৈনিকের মতো মজিদ মোল্লা নীরব রইলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চা পানের আবেদনে সাড়া না দিয়ে, ‘মাফ করবেন’ বলে দ্রুতগতি মোটরসাইকেলের পেডেলে পা বাড়ালেন প্লাটুন নিয়ে আসার জন্য।

সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তারা নয় ইঞ্চি পরিমাণ মাটি খুঁড়তে না খুঁড়তে শক্রর দূরপাল্লার কামানের গোলার ব্যাপক বর্ষণ আমাদের ওপর শুরু হলো। এক সঙ্গে চার থেকে আটটা গোলা আমাদের পজিশন ও তার পেছনে পড়তে শুরু করলো। আটিলারির ছত্ৰছায়ায় শক্রির অগ্রাভিযান শুরু হলো। নিজপক্ষের অনেক হতাহতের পরও দুলাল মুন্দিয়ার পজিশন থেকে আমাদের বিচুত করা গেলো না। দুলাল মুন্দিয়া বাজারের চারপাশে দু’দলের তুমুল লড়াই শুরু হলো। ব্যাপক গোলাগুলির মাঝে শক্রর অগ্রাভিযান প্ৰতিহত হলো। শক্রির সম্মুখ সমরের গোলাগুলি যেন কিছুটা স্তিমিত হয়ে এলো; কিন্তু আর্টিলারির গোলাবর্ষণ প্রবলভাবে চলতে থাকলো। শত্রুর দূরপাল্লার কামানের আওতা আমাদের পজিশনের অনেক পেছনে সরে গেলো। আটিলারির গোলার স্ক্রিনিংয়ের কভারে শক্ররা অনেকদূর পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ঘুরে পেছন থেকে পাকা রাস্তার বামে আমাদের পজিশনের পূর্ব অংশকে সম্পূর্ণ ঘিরে ফেললো। এখানে প্রবল গোলাগুলি ও হাতাহাতি লড়াইয়ের মধ্যে এমুনিশনশূন্য কোম্পানিকে এক অভাবনীয় দুর্বিপাকে পড়তে হলো। পেছনে আর্টিলারির গোলাবর্ষণ ও অন্যান্য অসুবিধার কারণে তাদের কাছে কোনো গোলাগুলি বা লোকজনের সাহায্যই পাঠাতে পারলাম না। রাস্তার পশ্চিমে ডানপাশ থেকে মুকিতও তাদের কোনো সাহায্য করতে পারলেন না। শত্রুর সারেন্ডারের আবেদন সবাই ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে আমৃত্যু লড়ে গেলেন। জয়

৮৮

বাংলার সগর্জন ওয়ার-ক্ৰাই তুলে তারা মরণব্যজ্ঞে আহুতি দিলেন। শক্ররা আল্লাহু করে ইতিহাসের নজিরবিহীন তৃণ্য-জঘন্য পদ্ধতিতে বেয়নেট মেরে, বিকলাঙ্গ করে সবাইকে হত্যা করল। আন্ডারগ্ৰাউন্ড কমীরা পার্মানেন্ট আন্ডারগ্রাউন্ডে শ্রেণীবিহীন সমাজে শান্তির ঘুম দিল।

 বেলা ২টার দিকে দুলাল মুন্দিয়ার পূর্ব অংশের লড়াই শেষ হয়। পশ্চিমে মুকিত বিক্ষিপ্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছেন। পেছনে কালিগঞ্জ থেকে দুলাল মুন্দিয়ার দিকে দক্ষিণ-পূর্ব বরাবর কিছু বিক্ষিপ্ত গোলাগুলি ছুড়ে শত্রুর ওয়াকওভারের রাস্তা প্রতিহত করা হলো। মুকিত উইথড্রলের অনুমতি চাইতে তাকে শেষ নির্দেশের অপেক্ষায় থাকতে বলা হলো।

এবার কালিগঞ্জের ওপর কামানের গোলার বর্ষণ তীব্রতর হলো। থানার চারপাশে শেল পড়া আরম্ভ হলো। থানায় আমার বসার ঘরের টেবিল-চেয়ারসুদ্ধ শেলের শব্দে থরথর করে কেঁপে নড়ে-চড়ে উঠছে, দরজা-জানালা ভীষণভাবে আলোড়িত হচ্ছে। শেল আমার চারপাশে পড়ে মাটি বিদীর্ণ হচ্ছে। অবাক কাণ্ড, আল্লাহর অপার মহিমা শেলগুলো শূন্য মাঠে, নালায়-ডোবায় বা জংলা স্থানে পড়ছে। একটা শেলও কোনো ঘর বা বিল্ডিংকে সরাসরি আঘাত করল না। থানার মাঠে, টেলিফোন এক্সচেঞ্জের সামনের সামান্য খালি জায়গায় শেল পড়ে মাটি বিদীর্ণ হলো। কিন্তু কোনো ঘরে আঘাত করে আগুন জ্বললো না। কয়েক স্থানে শক্ত মাটিতে শেল ফেটে আগুন জ্বলে উর্ধের্ব আগুনের শিখা ও ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠলো; কিন্তু কোনো ঘরে আগুন লাগলো না বা কেউ মরলো না।

চারপাশে যারা আছেন তাদের মুখে চরম হতাশা। নকশাল তৎপরতা সন্দেহজনক। ঝিনেদাকে টেলিফোনে বললাম, “কি শুনতে পাচ্ছে?” তারা বললেন, “টেলিফোনে কেবল শেল ফাটার ভীষণ গৰ্জনের শব্দ পাচ্ছি।” ক্যাপ্টেন আজমকে বললাম, আমার চারপাশে শেলের অগ্নিবৃষ্টি হচ্ছে। আসতে পারবো কিনা জানি না। কিছুক্ষণ পরেই আমি কালিগঞ্জ ছাড়ছি, আপনারা সব গুছিয়ে নিন’। তার মাধ্যমে মেজর ওসমানকে পরিস্থিতি জানাতে বললাম। মেজর ওসমান উইথড্র করে আমাকে চুয়াডাঙ্গা পৌঁছার নির্দেশ দিলেন। এমন সময় ঝিনেদার এক্সচেঞ্জের শব্দ অস্পষ্ট ও দুর্বল হয়ে এলো। বহুকষ্টে এক্সচেঞ্জকে কারণ জিজ্ঞাসা করতে ব্যাটারি নেই বা ডাউন বলে জানালেন। তাকে ব্যাটারির অসুবিধার আর সময় না পাওয়ার জন্য তিরস্কার করে যে কোনো মূল্যে কিছুক্ষণের জন্য হলেও লাইন চালু রাখার আবেদন জানালাম। সাইফুল সোবহান নামে এক সৌখিন স্বেচ্ছাসেবক ছাত্র-অপারেটরের কারণে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কালিগঞ্জ এক্সচেঞ্জ চালু ছিল।

শেষবারের মতো বের হয়ে লঙ্গরের লোকজনের কাছে হাত মিলিয়ে তাদের বিদায় দিলাম। ঝিনেদা ক্যাডেট কলেজের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার মাজেদুল হককে ২টা ট্রাক নিয়ে মূল পাকা সড়কে কালিগঞ্জ-চুয়াডাঙ্গা রোডের সংযোগকারী কাঁচা রাস্তার মোড়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অবস্থানের সতর্ক নির্দেশ দিলাম।

৮৯

কারণ শেষ মুহুর্তেও আহত, নিহত, বেঁচে থাকা কেউ তাদের শ্রদ্ধা, আস্থা, বিশ্বাস, ভালোবাসা ও আদরের হতভাগ্য অধ্যাপকের খোঁজে এলে তাকে যেন উদ্ধার করে সাধুহাটির পথে চুয়াডাঙ্গা নিয়ে যাওয়া যায়। কালিগঞ্জের যে কোনো নারী, শিশু, যুবকবৃদ্ধকে দলমত নির্বিশেষে উদ্ধার করে যেন ট্রাকে ওঠানো হয়। শেলের গোলাবৃষ্টির মাঝে সব বিপদ তুচ্ছ করে মাজেদুল হক ট্রাক দুটি সংগ্রহ করে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। অতিরিক্ত গোলাবারুদ, যা সঙ্গে নেয়া যাবে না, সেগুলো গভীর পানিতে ফেলে দেয়ার ও জঙ্গলে মাটির নিচে পুঁতে ফেলার ত্বড়িত নির্দেশ দিলাম। এসবের অধিকাংশই সে সময় ও পরবতীকালে নকশালদের হাতে পড়েছিল।

শেষবারের মতো ঝিনোদার সঙ্গে কথা বলার জন্য টেলিফোন ওঠাতে বিনোদার দারোগা সাইদ আমার জন্য উধ্বতন জরুরি নির্দেশ শোনালেন, মুকিতের সঙ্গে মিলে আমাকে পশ্চিমে সাধুহাটির পথে চুয়াডাঙ্গা পৌঁছতে। মুকিতকে নির্দেশ দিলাম উইথড্র করে মজিদ মোল্লাসহ পশ্চিমে সাধুহাটির দিকে ফিরে যেতে। এক্সচেঞ্জ থেকে সাইফুল সোবহান বারবার বলেছেন, ‘স্যার, এক্সচেঞ্জের চারদিকে শেল পড়ছে। যে কোনো সময় এক্সচেঞ্জে আগুন ধরে যেতে পারে’।

তাকে শেষবারের মতো বিনেন্দা ওয়াপদার কন্ট্রোল হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে মেলাতে বললাম। ওপাশে কে শুনছে। তার তোয়াক্কা না করেই বললাম, ‘এখনই টেলিফোন কানেকশন বিচ্ছিন্ন করে আমি কালিগঞ্জ ছেড়ে যাচ্ছি। সাইফুল সোবহানকে ‘বিদায় পুত্র’ বলে টেলিফোনের কানেকশন ছিড়ে ফেললাম। জিপে উঠতে গিয়ে দেখি গাড়িতে রাখা এলএমজিটি নেই। পেছন দিকে বাজারের চিপা গলির পথে রিটায়ার্ড আর্মি মাওলা মিয়ার সন্তান সেটি নিয়ে পালাচ্ছে। তাকে ডাকতে তিনি এলএমজিসহ ফিরে এলেন। নির্দেশ দিতে সুবোধ বালকের মতো অন্ত্রসহ নকশালজি জিপের পেছনে বসলেন।

বিভীষণপুরী ছাড়ার জন্য জিপে উঠে পাকা সড়কে এসে দেখি বিশ্বস্ততা ও আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে হাবিলদার মাজেদুল হক দুটি ট্রাকসহ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন। এ সময় মূল পাকা সড়ক বরাবর রাস্তার ওপর ডাইনে, বাঁয়ে, সামনে শেল পড়ছে। এরই মধ্যে কয়েকজনকে মাজেদ ট্রাকে উঠিয়ে নিয়েছেন। তাকে পশ্চিমের কাঁচা রাস্তায় গাড়ি ছাড়তে বললাম। ড্রাইভারকে জিপের গতি বাড়াতে বলতে দেখি মাজেদ নিশ্চুপ অনড় অবাক দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁট নেড়ে বিশুষ্ক গলায় তিনি বললেন, “স্যার আপনি একা গাড়িসহ শেলের ভেতর, উত্তরে যাবেন না, আমার সঙ্গে আসুন”। নকশালি কারবারে বিশ্বাসঘাতকতার আসল চেহারা দেখে মন-মেজাজ ভালো ছিল না। ক্যাপ্টেন হুদা না আবার আমারই মতো নকশালি কায়দার শিকার হন। তাই তাকে সতর্ক করার জন্য শেলের ভেতরই বিশখালী যাওয়া স্থির করলাম। বিশখালীর সঙ্গে টেলিফোন যোগাযোগ না থাকায় ক্যাপ্টেন হুদাকে সর্বশেষ অবস্থা জানিয়ে ওয়ার্নিং দিয়ে যাওয়া পবিত্র কর্তব্য মনে করলাম। শেষ মুহূর্তেও দেখি মাজেদুল হক দাঁড়িয়ে আছে। সে বারবার আমার দিকে চেয়ে এগিয়ে আসতে চায়। অধৈৰ্য হয়ে ক্রুদ্ধ আক্ৰোশে তাকে গালি দিলাম, হারামজাদা যা কই কর, আমার ভাবনা তোকে ভাবতে হবে না’।

৯০

বিশখালীর পথে ক্যাপ্টেন হুদার জন্য মেসেজ রেখে ঝিনেদা এলাম। শহরের কাছে ঝিনেদা ক্যাডেট কলেজের কুষ্টিয়া রোডের মোড়ে এসে গাড়ির গতি মন্থর হয়ে এলো। কারণ জানতে চাইলে ড্রাইভার দেখি ক্যাডেট কলেজের রাস্তার দিকে চেয়ে আমার দিকে চায়। ড্রাইভারের বুঝতে বাকি রইল না। ক্যাডেট কলেজে যাব কিনা তাই সে জানতে চাইল। আমার প্ৰিয়তমা স্ত্রী পারভিন বেগম তিনটি নাবালক এতিম পোষ্যসহ আমার জন্য প্রহর গুনছেন। ভাবনা জাগল মনে, মালপত্তর পরিজনসুদ্ধ সবকিছু নিয়ে জিপেট্রাকে যাওয়া এখনো আমার পক্ষে খুবই সহজ। সঙ্গের যোদ্ধাদের কেউ সামনে এসে যদি বলে, “স্যার, আপনি তো সব নিয়ে কেটে পড়ছেন, আমাদের কী করলেন?” সারা বাংলাদেশের মানুষের যে গতি আমার পরিজনেরও সে গতি। তাদের আল্লাহর হাতে সঁপে দিয়ে দু’মাইল ব্যবধানে প্রিয় স্ত্রীর মুখ দেখার বাসনা ত্যাগ করে, তার জন্য কোনো নির্দেশ বা ব্যবস্থা না রেখেই প্ৰস্থানের উদ্যোগ নিলাম।

আমার প্রিয় ঝিনেদা ছেড়ে যাচ্ছি। কত চেনা মুখ, কত স্মৃতি, বুকটা ভেঙে খানখান হয়ে যাচ্ছে। যে মুখ জয়ধ্বনি দিয়ে আমাকে বরণ করতো তারা আজ বিবৰ্ণ, ফ্যাকাশে, উদ্বেগে আকুল হতাশায় আমাকে দেখছে। ঝিনেদার শেষ দর্শন ওয়াপদার কন্ট্রোল হেডকোয়ার্টার। বানরের বাচ্চা পেটের নিচে থেকে বানরকে জড়িয়ে ধরে থাকে, আর বানর। যেমন তাকে নিয়ে গাছ থেকে গাছে লাফায়, ক্যাঙ্গারু পেটের থলিতে বাচ্চা রেখে লেজের ওপর যেভাবে লাফায়, তেমনি দুৰ্গম পথে গোলাগুলির মাঝে সময়অসময়ে ফ্রন্টলাইনে নিজের মোটরসাইকেলে করে আমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াত যে দানেশ, সে আজ নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। ইউসুফ, আনিস, দানেশ, মানেশ ভাইদের গাড়ি চালনা, মেরামত ও দৌত্যকার্যে যুদ্ধে তাদের আবিস্মরণীয় অবদানের কথা স্মরণ করে গাড়ির গতি মন্থর করতেই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে, স্যার বেঁচে আছেন” বলে শিশুর মতো কেঁদে ফেললো। অতি দ্রুত চলে যাওয়ার জন্য তারা আবেদন জানালেন। মাহবুব ও আজম পূর্বেই চলে গিয়েছিলেন।

আমি ঝড়োগতিতে চুয়াডাঙ্গার দিকে গাড়ি চালাতে নির্দেশ দিলাম। আলবিদ্যা ঝিনেদা, আলবিদা … ।

উধৰ্ব্বতন কমান্ডের দ্বিধাদ্বন্দ্বের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নই ব্যর্থতার কারণ। শক্রর একটি কোম্পানি প্লাস নির্মূল। নিজের এক প্লাটুন নিশ্চিহ্ন। শত্রুর অগ্রাভিযান বিলম্ব করানাের মাধ্যমে যোদ্ধা, যুদ্ধের উপকরণ, টাকা-পয়সার নিরাপদ স্থানান্তরে সাহায্য হলো। নিজ পক্ষের কেউ ধরা পড়েনি। কোনো শক্রকে বন্দি করা যায়নি। সমুদয় ট্রান্সপোর্ট সরিয়ে আনা হয়েছিল। জনসমর্থন পূর্ণাঙ্গ পাওয়া গেছে। শক্রকে মুক্তিদের যুদ্ধ ক্ষমতার পরিচয় দেয়া গেছে। শত্রুর বিষদাঁত ভাঙা গেছে। ব্যাটল ইনোকুলেশনের মাধ্যমে নিজেদের যুদ্ধ ক্ষমতার ওপর আস্থা বেড়েছে। নিজেদের পরাজয় স্বীকারের মাধ্যমে ভবিষ্যতের দৃঢ়তা ও প্রস্তুতি অর্জিত হয়েছে।

১৬ এপ্রিল ঝিনেদার প্রতিরোধ যুদ্ধের অবসান হলো। কোনো পর্যায়েই শক্রিরা ঝিনেদার বেসামরিক প্রশাসন চালু করতে পারেনি। প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থারূপে শক্ৰ ঝিনেদার একুশশ’ বেসামরিক লোককে হত্যা করে। একজন মুক্তিযোদ্ধা ঝিনেদা

৯১

ক্যাডেট কলেজের প্রিন্সিপাল লে. কর্নেল মোহাম্মদ মনজুরুর রহমান ১৮ এপ্রিল কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতর পাকিস্তানিদের হাতে প্ৰাণ হারান।

আজ স্মৃতির মন্দিরে কিছু বিস্মৃত ঘটনা মনকে তোলপাড় করছে। যশোর-কালিগঞ্জের বীর জনতার সুখ-দুঃখের, আনন্দ-বেদনার রূপ-কাহিনীর সঙ্গে অল্প কয়েকদিনে মিশে গিয়েছিলাম। এক ঝঞাবিক্ষুব্ধ পরিবেশে জনতার কাতারে জনযুদ্ধে শরিক হয়েছিলাম। রাষ্ট্রদর্শনের গালভরা বুলি সদৃশ থিওরির বাইরেও যে গণসমর্থন ও জনগণের ইচ্ছাশক্তিরূপ একটি প্রচ্ছন্ন রাষ্ট্র আছে তা ক্যাডেট কলেজের চারদেয়ালের দুর্গের এ অধ্যাপকের জানা ছিল না। স্বদেশপ্রেমে স্বাধীনতার দীক্ষামন্ত্রে উদ্ভাসিত প্ৰাণ কালিগঞ্জের বীর জনতা একটি সুশিক্ষিত ও সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীর চেয়েও অধিকতর আত্মত্যাগে আমাকে সব ধরনের সাহায্য ও সহযোগিতা দান করেছিলেন।

আজ মনে পড়ছে যুদ্ধ পরিচালনাকালে সেদিনের সে কালবৈশাখীর রাতের কথা। একদিন লাগলো কালবৈশাখীর ঝড়ের তাণ্ডব। প্রবল বৃষ্টিতে ও ঝড়-তুফানে খোলা আকাশের নিচে আমাদের পাকের চুলা নিভে গেল। রান্না হলো না। মাঠে পানি জমে গেল। মাঠের শক্ত মাটির কাদায় হাঁটু পর্যন্ত পা দেবে যেতো। নিচু জমির ট্রেঞ্চ ও বাঙ্কারে পানি উঠে গেল। প্রতিরক্ষা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো। জিপ, পিকআপ সরাসরি মাঠের সরু রাস্তা ও মাঠের ওপর দিয়ে চালানো সম্ভব হলো না। মূল পাকা রাস্তায় ট্রাকজিপে যেতে স্থানে স্থানে পাকা সড়কের সঙ্গে গ্রামের সংযোগকারী কাঁচা রাস্তার মোড়ে, বড় বড় গাছের নিচে রুটি, ছোলা, চিড়া-গুড়, ডাব, দৈ, দুধ ও মধু নিয়ে জীৰ্ণশীর্ণ বসনের সাধারণ মানুষ, ঝড়-বাদল উপেক্ষা করে ট্রাক-জিপ থামিয়ে জোর করে তাদের আনা খাবার উঠিয়ে দিতো।

সাধারণ মানুষের দেয়া খাবার তাদেরই সাহায্যে ভারবশে করে ঝড়-বাদল, বৃষ্টি কাঁদা উপেক্ষা করে নিজেদের পজিশনে কোম্পানির লোকজনের জন্য নিয়ে গিয়ে দেখি কেউ নেই। এমুনিশনের বাক্স পড়ে আছে, গুলিভর্তি ম্যাগাজিন পড়ে আছে, ট্রেঞ্চে পানি, চারপাশে কাদায় একাকার, সৈন্য-সামন্ত হাওয়া। খাদ্য বয়ে আনা লোকজনের কাছে লজ্জিত হলাম। প্রচণ্ড ঝড় ও বৃষ্টি-বাদলে কাদায় একাকার হয়ে ঘুরছি। নিজের টর্চ গেছে। খারাপ হয়ে, সঙ্গের হারিকেন গেছে নিভে, বিদ্যুতের আকস্মিক ঝলকানিতে পথ দেখে চলি । কোথাও জনমানবের সাড়া নেই। রাত বারোটা-একটার দিকে আশপাশের ও দূর-দূরান্তের বাড়িঘরগুলোতে নিজের লোকজন খোঁজা আরম্ভ করলাম। মাটির দেয়ালের এক বাড়িতে অনুমানে দরজার কড়া নাড়তে বিদ্যুতের ঝলকানিতে দেখি রাইফেলের নল বেরিয়ে আসছে। তাদের গুলির হাত থেকে আকস্মিক ও অলৌকিকভাবেই বেঁচে গেলাম। ভেতরে কুপি জ্বলিছে। কয়েকজন সশস্ত্র সৈনিক আতঙ্কে উদ্বিগ্ন হয়ে বসে আছেন। কে যে কাকে দেখে বেশি বেকুব বা অবাক হলাম বুঝলাম না। একজন হাবিলদার তো আনন্দে কেঁদেই ফেললেন। আবেগ রুদ্ধকণ্ঠে বললেন, ‘স্যার, পঁয়ষট্টি সালের লড়াই করেছি, দেখেছি অনেক, এতটা ভাবিনি। এ সময়, এ অবস্থায় আপনি আমাদের খাবার নিয়ে আসবেন তা স্বপ্নেও ভাবিনি।’

ক্রুদ্ধ আক্ৰোশে পজিশন ছেড়ে আসার কারণে সবার প্রতি ফুঁসছিলাম। কিন্তু তাদের আচরণে রাগ ঠাণ্ডা হয়ে গেল। তাদের আহার করালাম। দূর-দূরান্তের সবাইকে

৯২

জড়ো করে পজিশনে নিয়ে গেলাম। সোজা বলে দিলাম, ‘কোনো অজুহাত শুনতে চাই না, কোনো অবস্থাতেই কেউ ট্রেঞ্চ ছাড়তে পারবে না। পাকিস্তানিরা এ অবস্থায় এডভান্স করলেই বাবারা টের পেতে’। হায় রণক্ষেত্রের নির্মম অভিজ্ঞতা।

বারোবাজারের সদা হাস্যময় আওয়ামী লীগ প্রধানের অতুলনীয় সাংগঠনিক প্রতিভা, অচাঞ্চল স্থিরচিত্ত কর্মপ্রবাহ, চরম বিপর্যয় ও হতাশার মুখে জনগণের পাশে দাঁড়ানো রূপকথার মতো মনে হয়। দল-উপদলে বিভক্ত বিহারি অধুষিত এলাকায় মুকুটহীন রাজার মতো লিখিত আইনের চেয়েও শক্তিমান অলিখিত আইনে কর্তৃত্ব করে মুক্তিসেনার রসদ জোগানো যেকোনো মানদণ্ডে অবিস্মরণীয়। বারোবাজরের আওয়ামী লীগ অফিস চব্বিশ ঘণ্টা বিরামহীন গতিতে যুদ্ধ ও বেসামরিক যোগাযোগের অফিসরূপে কাজ করেছে। স্বল্পতম সময়ে তিনি আমার সগর্জন ও ক্রুদ্ধ আবেগে সময়েঅসময়ে চাওয়া যানবাহন, লোকজন, ওষুধ, খাদ্যদ্রব্য, টেলিফোনের লোকজন, তার ও অন্যান্য বহুবিধ সরবরাহ অপূর্ব স্থির প্রশান্তিতে সংগ্রহ করে দিয়েছেন।

পৃথিবীর বহু দেশই জনসমর্থন নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা করেছে। কিন্তু এমন স্বতঃস্ফুর্ত গণসমর্থনের জনযুদ্ধ পৃথিবীর ইতিহাস বোধ হয় দেখেনি। এমন আত্মত্যাগের মহিমা-ধন্য জনযুদ্ধের ইতিহাসও ইতিহাসে বিরল। জাতীয় জীবনের উষালগ্নে, পূর্ব তোরণের উদীয়মান সূর্যরশ্মিকে সালাম জানাতে ক্ষুদ্ৰশক্তিকে নিয়োজিত করতে যারা সুযোগ দিয়েছিলেন তাদের আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।

এ যুদ্ধের এপারের বীর সৈনিকদের কাছে নিজের ঔদ্ধত্যের জন্য ক্ষমা চেয়ে পরপারের সৈনিকদের জান্নাত কামনা করি।

রচনাকাল ১৯৮৫