You dont have javascript enabled! Please enable it!

আরেক বাঙলায় পঁচিশে বৈশাখ ঃ ১৩৭৭
যীশু চৌধুরী

স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন যে, আগামী ২৫শে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের জন্মদিবস সরকারিভাবেই উদ্যাপন করা হবে এবং স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্র থেকেও অনুষ্ঠান প্রচারিত হবে। অথচ আজ থেকে কয়েক বছর আগে আয়ুব খানের আমলের শেষদিকে ঢাকা রেডিওতে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বাঙালিরা তার তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন এবং শুধু তাই নয়, তাঁরা সংস্কৃতির মধ্যে ধর্মের সংকীর্ণতাকে তীব্র ভাষায় নিন্দা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ‘হিন্দু, ডিকটেটরের এই ঘৃণ্য বক্তব্যকে বাঙালিরা আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছিলেন। বদরুদ্দীন উমর সাহেব স্পষ্টত প্রশ্ন রেখেছিলেন …এবার তাহলে দেখা যাক লিপস্টিকে যদি মুসলমানদের জাত বজায় থাকে তাহলে কপালে টিপ দিলে তাদের জাত যাবে কেন? পশ্চিমী চিত্রশিল্পীদের ছবি দেওয়ালে টাঙানাে যদি আমাদের সংস্কৃতি বিনষ্ট হয় তাহলে অবনী ঠাকুর, যামিনী রায়ের ছবিতে তা বিনষ্ট হবে কেন? ফ্রাঙ্কলিন মার্কা মার্কিনী সাহিত্য আমদানী করলে পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা যদি বিপন্ন না হয় তাহলে বিশ্বভারতীর বইপত্রে সেটা হবে কেন? এদেশের উচ্চশ্রেণীর ক্লাবে, হােটেলে পশ্চিমী নাচ যদি স্বদেশী সংস্কৃতির পক্ষে বিপজ্জনক না হয় তাহলে রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যের দ্বারা সে বিপদপাত হবে কি কারণে।
কপালের টিপ থেকে লিপিস্টিক, অবনীন্দ্রনাথ, যামিনী রায়ের থেকে ভ্যানগগা, পলগগা, বিশ্বভারতীর থেকে ফ্রাঙ্কলিন, রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যের থেকে ওয়াজ চাচাচা কোন অর্থে ইসলাম, মুসলিম সংস্কৃতি অথবা ‘পাক বাঙলা কালচারের নিকটতম আত্মীয়?
প্রকৃতপক্ষে ধর্মের ব্যবসা যারা করেন তাদের চেয়ে গণতান্ত্রিক মনােভাবাপন্নদের সংখ্যা অনেক বেশি। তাই এই প্রকৃত সংস্কৃতি-বিরােধী মনােভাবকে তুড়ি মেরে বাঙলাদেশের মানুষ রবীন্দ্রনাথের গানকে জাতীয়সংগীত করেছেন, বাঙলাদেশের সর্বত্র রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠান করতে যাচ্ছেন। এই অনুষ্ঠান ঠিক এক বছর আগেও হয়েছিল, পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের উপেক্ষা করেই। ঢাকায় সেই সময়কার পত্রপত্রিকাগুলাে থেকে তার বিবরণ দেবার চেষ্টা করা যেতে পারে।
গত বছরের সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য অনুষ্ঠান হয়েছিল ঢাকার সংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বুলবুল একাডেমিতে তাঁদের অনুষ্ঠান হবার কথা ছিল ২৪ বৈশাখ, রাতে। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্যে সেটা ২৫শে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ড. কাজী মােতাহার হােসেনের সভাপতিত্বে সকাল সাড়ে সাতটায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়েছিল। প্রধান অতিথি ছিলেন ড. এনামুল হক। এই অনুষ্ঠানের আকর্ষণীয় বিষয় ছিল, বাঙলা উন্নয়ন বাের্ডের তরফ থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের একনিষ্ঠ সাধিকা কণ্ঠশিল্পী সানজিদা খাতুন এবং রবীন্দ্র সাহিত্য চর্চার নিষ্ঠাবান পণ্ডিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলার অধ্যাপক মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর সম্বর্ধনা। তাদের এক সেট করে পুস্তক উপহার দেওয়া হয়েছিল। এবছরে যতদূর জানি, পাকি ফৌজ তাঁদের কে একসেট করে মেসিনগানের গুলি উপহার দিয়েছেন। পণ্ডিত এবং প্রাজ্ঞদের প্রতি বর্বরদের ব্যবহার এমন হওয়াই তাে সম্ভব।
সে অনুষ্ঠানে সনজিদা খাতুন মােট নখানি গান গেয়েছিলেন, তার মধ্যে ছিল ‘ঐ মহামানব আসে’ গানটি। এছাড়া মিশিয়া গনি এবং নাসরিন আহমদ গান শুনিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন প্রখ্যাত চিত্রাভিনেতা হাসান ইমাম, ইফতেকার, জাকেয়া খােন্দকার এবং হাকিম। ৩০শে বৈশাখ ১৩৭৭ এর ‘সংবাদ পত্রিকায় ছবি আছে মঞ্চে সনজিদা খাতুন গান শােনাচ্ছেন, পাশে বসে আছেন ড. এনামুল হক, ড. কাজী মােতাহার হােসেন এবং অধ্যাপক মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী আর পাশের ছবিতে ছিল হাসান ইমাম কবিতা আবৃত্তি করছেন।
২৫শে বৈশাখ রাত্রে বুলবুল ললিতকলা একাডেমি যে অনুষ্ঠানের আয়ােজন করেছিলেন তাতে পূর্বাঞ্চল শিল্পী পরিষদ ‘গানের কবি প্রেমের কবি রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক গীতি অনুষ্ঠান পরিবেশন করেছিলেন। ২৬শে বৈশাখ সকালে বাঙলা একাডেমি সৈয়দ মুর্তজা আলির সভাপতিত্বে যে অনুষ্ঠান করেছিলেন তাতে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের দুটি ভিন্ন দিক নিয়ে আলােচনা করেন বােরহান উদ্দীন খান জাহাঙ্গীর এবং সৈয়দ “আকরাম চৌধুরী। এই আলােচনায় উদ্যোক্তা ছিলেন বাঙলা একাডেমির প্রধান ড. কবীর চৌধুরী। সন্ধেবেলায় ওয়াপদা মিলনায়তন হলে ছায়ানটে’র রবীন্দ্র জয়ন্তী অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের নাটক পরিবেশিত হয়েছিল।
২৭শে বৈশাখ সন্ধেবেলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র ছাত্রীরা রবীন্দ্র জয়ন্তীর যে অনুষ্ঠান করেছিলেন অধ্যক্ষ মুনীর চৌধুরী, ড. নীলিমা ইব্রাহিম, অধ্যাপক মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক ওয়াকিল আহমদ, অধ্যাপক সৈয়দ আকবর হােসেন প্রভৃতি উপস্থিত ছিলেন। আবৃত্তি ও গানে অংশ নিয়েছিলেন শামীম তরফদার, আলহামরা পারভীন, সালমা খান, মীনাক্ষী হক, সাধন ঘােষ, রবীন্দ্রনাথ রায়, মােস্তফা কামাল এবং হামিদা আতিক। লায়লা হােসেন ও শরমিন হাসান রবীন্দ্রনৃত্যে অংশ নিয়েছিলেন। এঁদের সকলের ছবি কাগজ একসঙ্গে বেরিয়েছিল সেই সময় কিন্তু আজ তারা কী করছেন? প্রখ্যাত সব অধ্যাপক অধ্যাপিকাদের তাে হত্যা করেছে পাকফৌজ—আর ছাত্র-ছাত্রীরা? নিশ্চয়ই লড়ছেন অত্যাচার, শােষণ আর গুরুহত্যার প্রতিশােধ নেবার জন্য। কেননা এক বছর আগে তারাই তাে সমবেত কণ্ঠে গেয়েছিলেন ‘আমি ভয় করবাে না, ভয় করবাে না।
যে কথা সেই সব অনুষ্ঠানে আলােচিত হয়েছিল তার মধ্যে হয়তাে এমন মনােভাবও ছিল যে, ‘রবীন্দ্রনাথকে বাঙলা সাহিত্যের কর্ণধার এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে স্বীকার করা এবং তাদের সাথে পূর্বপাকিস্তানের সংস্কৃতির যােগকে অস্বীকার করা অসম্পূর্ণ মানুষ অথবা বিকারগ্রস্থ মানসিক রােগীর পক্ষেই সম্ভব…এটা সত্য অথে, মানসিক বিকারগ্রস্তদের কেন্দ্রস্থানীয় ব্যক্তিদের কথা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তাদের অবস্থা পর্যালােচনা করলে দেখা যাবে যে তাদের জ্ঞান আছে, বুদ্ধি আছে এবং সেই জ্ঞান-বুদ্ধির সাথে পাপও আছে মিশ্রিত।
প্রকৃতপক্ষে আজ যে অস্ত্রর লড়াই তা বহুদিন আগেই মানসিক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে পােক্ত হচ্ছিল। অন্যায়ের সঙ্গে আপসবিরােধী রবীন্দ্রনাথ তাই তাদের কাছে প্রাণের শান্তি মনের আরাম হয়ে দেখা দিয়েছিলেন। জ্ঞানপাপীদের ভেদবুদ্ধি এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাই রবীন্দ্রনাথই ছিলেন প্রধান অস্ত্র । বর্বররা এসে ২৫ মার্চ ঢাকাতে তাই প্রথমেই সে অস্ত্র কেড়ে নিতে চেয়েছে। কিন্তু বাঙালিদের সভ্যতার এই বিকারগ্রস্ত সংকটে তারা শত্রুকে মানসিক এবং সশস্ত্র দুভাবেই পরাজিত করতে জানেন।
অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ অনেক বিপ্লবীরই প্রাণপুরুষ হয়ে দেখা দিয়েছেন। ইন্দোনেশিয়াতে বিপ্লবী দিয়েছেন। ইন্দোনেশিয়াতে বিপ্লবী কমিউনিস্টরা ব্যর্থ বিপ্লবের পরও রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে গাইতে ফাসীকাঠে উঠেছেন নারায়ণগঞ্জে যে জয়ন্তী উৎসব হয়েছিল তাতে এমনই ছিল বক্তাদের বক্তব্য। চট্টগ্রামের একজন বক্তা বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের তর্কাতীত ভূমিকা সম্পর্কে কেউ প্রশ্ন তুললে যিনি বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের কৃতিত্ব সম্পর্কেই সন্দেহ প্রকাশ করবেন। রবীন্দ্রনাথ মানব প্রেমিক তিনি বিপ্লবীদেরও প্রেরণাদাতা।
আজকের মুক্তিযােদ্ধাদের এক হাতে রয়েছে প্রতিরােধের আগ্নেয়াস্ত্র, অন্যহাতে প্রতিরােধের ভাষা রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল, তাই জাতীয় সংগীত ‘আমার সােনার বাঙলা’। যে বাঙলাদেশ আজ স্বাধীনতার জন্যে, গণতন্ত্রের জন্যে লড়ছে। তাদের এ লড়াই শুরু হয়েছে দীর্ঘদিন। সম্ভবত ঢাকাতে রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানে এক বছর আগেই নবীন গায়ক গায়িকারা সমবেত কণ্ঠে প্রথমেই গেয়ে উঠেছিলেন, ‘ঐ মহামানব আসে। তারা কি বারুদের গন্ধের মধ্য দিয়ে নতুন সূর্যোদয়ের সম্ভাবনা আগেই বুঝেছিলেন? তাই কি হাসান ইমাম থর থর কণ্ঠে আবৃত্তি করেছিলেন ‘ভালােই হয়েছে প্রভাত এসেছে মেঘের সিংহাসনে।’

সূত্র: সপ্তাহ, ৭ মে ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!