বাংলার বাণী
ঢাকা : ২১শে অক্টোবর, সোমবার, ১৯৭৪, ৩রা কার্ত্তিক, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ
জলপথে নিরাপত্তার অভাব
দেশের নৌ-পথগুলো দিনের পর দিন নিরাপত্তাহীন হয়ে উঠছে। প্রতিদিনই প্রায় জলপথে ডাকাতের আক্রমণ অথবা সংঘবদ্ধ দুষ্কৃতিকারীদের মালামাল লুটের খবর পাওয়া যাচ্ছে। চাল, গম, পাট বা অন্যান্য দ্রব্য সামগ্রী নিয়ে যে সকল নৌকাই বন্দর-গঞ্জের দিকে রওয়ানা হচ্ছে তাদের সবার মনেই আশঙ্কা কখন অতর্কিতে লুটেরা অথবা ডাকাতেরা নৌকার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। নরসিংদী-নারায়ণগঞ্জ জলপথ সমগ্র ডাকাতদের উপদ্রবে রীতিমতো ভীতিপ্রদ ও বিপদসংকুল হয়ে উঠেছে। ভৈরব বণিক সমিতি সূত্রে প্রকাশ, ভৈরব-ঢাকা-সিলেটের মধ্যে নৌ-পথে মাল চলাচল প্রায় বন্ধ। দৌলতপুর, খুলনা থেকেও প্রায় একই প্রকার সংবাদ আসছে।
জলপথে মাল চলাচলে নিরাপত্তার অভাব যে শুধু আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতির চিত্রই তুলে ধরছে তাই নয় বরং এর আরো মারাত্মক প্রতিক্রিয়া খুব শীঘ্রই অর্থনীতির উপর দেখা দিতে পারে। কে না জানে বাংলাদেশ জল পরিবহন সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ এমনকি দুর্গম বহু অঞ্চলে মালামাল সরবরাহের একমাত্র উপায়ই এই নৌ-পথ। সেই নৌপথে মাল চলাচলে যদি বর্তমান নিরাপত্তাহীনতা অব্যাহত থাকে তবে স্বাভাবিকভাবেই বাজারে তার প্রতিক্রিয়া পড়বে। জিনিসপত্রের অভাবে হু হু করে দাম বেড়ে যাবে। প্রায় সর্বক্ষেত্রেই ঘাটতি পণ্যের এই দেশে সরবরাহের অনিয়ম অধিকতর সংকটের সৃষ্টি করবে।
দেশের সংকট আজ চরমে। চারদিকে অনাহারে মৃত্যুর আহাজারি। অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিও ঘটছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। সরকারী কর্তৃপক্ষই দেশে দুর্ভিক্ষের কথা স্বীকার করেছেন। দুর্ভিক্ষ শুধু যে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে তাই নয়—সামাজিক, রাজনৈতিক এমনকি মানবিক মূল্যবোধের উপরও এর সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়াকে অগ্রাহ্য করা ভুল হবে। ডাকাত-দুষ্কৃতিকারীদের হামলা এবং লুটের খবরের পাশাপাশি বুভুক্ষু মানুষের চাল, গম ছিনিয়ে নেয়ার সংবাদ আজকাল প্রায়ই খবরের কাগজে ছাপা হচ্ছে। সামাজিক অনাচার, ব্যভিচার রীতিমতো গোটা জাতিকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
আজ আর তাই কোনো সমস্যা, কোনো সংকটই বিচ্ছিন্নভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। সার্বিক অবস্থাটা উপলব্ধি করে অতিসত্বর কোনো বাস্তব কর্মসূচী গ্রহণ করা আবশ্যক। কি আইন শৃঙ্খলা, কি খাধ্য সংকট সব কিছুই আয়ত্তে আনার জন্য জনগণের উপর সার্বিক আস্থা রেখে তাদের সহযোগিতায় সংকট উত্তরণে অগ্রসর হতে হবে। এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য এবং পারস্পরিক বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করা। সরকারকেই যে এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে তা বলাই বাহুল্য।
আজ জলপথে ডাকাতি, হামলা, লুট চলছে। কাল যে সে ঢেউ শহরে-গঞ্জে আঘাত হানবেনা তা কে বলতে পারে? অবস্থা সম্পূর্ণভাবে আয়ত্তের বাইরে যাওয়ার আগেই তাই প্রয়োজন সতর্কতা অবলম্বন।
বাংলাদেশ-উগান্ডা বাণিজ্য সম্পর্ক
সম্প্রতি বাংলাদেশ ও উগান্ডার মধ্যে এক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় দু’টি দেশের মৈত্রী বন্ধন দৃঢ়তর হলো। প্রাথমিকভাবে এই চুক্তির মেয়াদ এক বছর। তবে পারস্পরিক মতৈক্যের মাধ্যমে এই চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। দু’দেশের মধ্যে সাধারণ চুক্তি বলেই বাংলাদেশ উগান্ডায় পাট, চটের থলে, পাকা চামড়া ও দিয়াশলাই রপ্তানী করবে। বিনিময়ে বাংলাদেশ উগান্ডা থেকে তামা, সূতা, খাবার তেল আর তেলবীজ আমদানী করবে।
বাংলাদেশ-উগান্ডার এই চুক্তির আওতায় পণ্যের লেনদেনের পরিমাণ নিরূপণের জন্য শীঘ্রই একটি দলিল স্বাক্ষরিত হবে। এ ব্যাপারে অনতিবিলম্বে বাংলাদেশ থেকে উচ্চ পর্যায়ের একটি বাণিজ্য দল কাম্পালা যাবেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রের সংবাদে প্রকাশ। বস্তুতঃপক্ষে বাংলাদেশ-উগান্ডা বাণিজ্য চুক্তি সম্পৃক্ত লেনদেনের পরিমাণ যত শীঘ্র নিরূপিত হয়—আমাদের মতে উভয় দেশের তাতেই মঙ্গল। কারণ আধুনিক সভ্যতার দ্রুতগতির ধারার প্রেক্ষিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোকেও আজ কাজে ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ঢিলে নীতি পরিত্যাগ করতে হবে। নইলে প্রতিযোগিতার বিশ্বের দেশজ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা হবে কঠিনতর।
এ কথা সত্য যে, বাংলাদেশ ও উগান্ডা দু’টি উন্নয়নশীল দেশের প্রাকৃতি সম্পদ ও সম্ভাবনা আছে প্রচুর। তুব এ দু’টি দেশের কোনোটিই স্বয়ম্ভর নয়। কিন্তু সেটা আজকের দিনে খুব বড় একটা সমস্যা নয়। কারণ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তিতেই বর্তমান বিশ্ব প্রগতি ও সমৃদ্ধির পথকে করছে সুগম। এবং এই মসৃণ পথ উন্নত ও উন্নয়নশীল উভয় শ্রেণীর দেশগুলোর জন্যই আবশ্যক ও কল্যাণকর। এবং এই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সহজ সমঝোতার মাধ্যমেই পাওয়া যায় পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতার নিশ্চিত আশ্বাস—যার মূল্য অপরিসীম।
বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও সৌভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে পারস্পরিক বিপরীতমুখী চাহিদা পূরণের বাস্তব ক্ষেত্রও সৃষ্টি করতে পারে। তবে এই বিনিময় সম্পূরণ শুধু যে পণ্য বা উৎপাদিত দ্রব্যাদি দিয়েই সম্ভব তা নয়। উভয় দেশের মধ্যে গণসংযোগ সৃষ্টি করেও পারস্পরিক সাহায্য দান সম্ভব। সম্ভবতঃ এই বাস্তব প্রশ্ন সামনে রেখে শীঘ্রই বাংলাদেশের ১৭০ জন নাগরিক উগান্ডায় চাকুরী গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ ও উগান্ডার মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর উপলক্ষে উচ্চপর্যায় থেকে এই তথ্য জ্ঞাপন করা হয়। এবং উগান্ডার তথ্যমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ঢাকা সফরের সময় দু’দেশের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে তাদের চাকুরীর জন্য মনোনীতও করা হয়। আবার শিল্পজাত উৎপাদনের ব্যাপারেও উন্নতিকামী দেশগুলো পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতার ভিত্তিতে কাঁচামাল আমদানী করে লাভবনা হতে পারে। উগান্ডার মন্ত্রী সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলেন যে, উগান্ডায় পাট শিল্প গড়ে তোলা ও তার সম্প্রসারণের ব্যাপারে উগান্ডা বাংলাদেশের সহযোগিতার প্রতি বহুলাংশে আশ্বাস রাখতে পারবেন এবং তেমন বাস্তব সহযোগিতাকে তাঁরা স্বাগত জানাবেন সর্বদা।
ভৌগোলিক অবস্থান ও আবহাওয়ার সৌজন্যে উগান্ডায় উন্নতমানের প্রচুর কফি জন্মে। হয়তো পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বমূলক বন্ধুত্বের ভিত্তিতে বাংলাদেশ উগান্ডার কফি অপেক্ষাকৃত সুলভ মূল্যে আমদানী করতেও পারবে। তাতে আমরা অবশ্যই লাভবান হবো। আর সবচেয়ে বড় কথা—প্রয়োজন ও চাহিদার শর্তে বাংলাদেশ ও উগান্ডার মধ্যে আজ যে বাণিজ্য সম্পর্ক আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে—তার সম্প্রসারণ সম্ভাবনা রয়েছে যা আমাদেরকে উৎসাহিত ও আশান্বিত করে।
এ কথা সত্য যে, আজকের পৃথিবীতে বড় বা ছোট, কিংবা উন্নত ও অনুন্নত কোনো দেশেই একক অস্তিত্বের অহংকারে টিকে থাকতে পারে না। এই সহজ সত্যকে সহজে অনুধাবন করেই স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ বৈদেশিক নীতিতে অত্যন্ত উদার মতপোষণ করে এসেছে। যার ফলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আজ বহু দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছে। সেই সঙ্গে স্বদেশ সম্ভাবনা সম্পর্কে নিশ্চিত হবার জন্যও অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে আপন সম্পদের পরিমাণ ও মূল্যায়ন করতে ব্রতী হয়েছে। যা ছিল ঔপনিবেশিক চক্রান্তের অন্তরালে তাকে আজ জাতীয় স্বার্থে তথা জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে ব্যবহার করার পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে।
আফ্রিকা মহাদেশে সূর্যোদয় হয়েছে অনেক কাল আগেই। সেই সূর্যালোকিত দেশের একটি হলো উগান্ডা। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ উগান্ডা আজ মাথা উঁচু করে বহির্বিশ্বের সঙ্গে বন্ধুত্ব সৃষ্টি করছে। উন্নতি ও অগ্রগতির শপথে দীপ্ত বাংলাদেশ তাই সমআদর্শে অনুপ্রাণিত উগান্ডার সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করতে পেরে আনন্দিত। বাংলাদেশ-উগান্ডা সম্পর্ক সম্প্রসারিত ও সুফলপ্রসূ হোক, দু’দেশের জনগণ কর্মের আদর্শসূত্র ধরে আরও নিকটতর হোক—ভ্রাতৃপ্রতিম দু’টি দেশ সুমুখের যাত্রায় হোক ঐতিহ্য সৃষ্টিকারী—আমরা ঐকান্তিকভাবে তাই কামনা করি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক