You dont have javascript enabled! Please enable it! 1972.12.16 | মুজিববাদ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার | খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস | ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ - সংগ্রামের নোটবুক

মুজিববাদ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার
খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২

“মুজিববাদ” বইয়ের লেখক খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস-এর কতিপয় প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু

প্রশ্ন : বঙ্গবন্ধু, আমরা দীর্ঘকাল আপনার রাজনৈতিক জীবনের সংস্পর্শে থেকে লক্ষ্য করে এসেছি যে, বাংলাদেশের নিজস্ব ঐতিহাসিক ধারার বিকাশ ও বাঙালি জাতির চেতনার স্তর বিবেচনায় রেখে আপনি এদেশের রাজনৈতিক, অর্থনেতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্যে সুনির্দিষ্ট ও সুষ্পষ্ট পথনির্দেশ দিয়ে আসছেন, নিজস্ব একটি মতবাদ ব্যক্ত করে আসছেন। এখন আমার প্রশ্ন আপনি জিন্নাবাদ, গান্ধীবাদ, নাসেরবাদ, ইহুদিবাদ, মাওবাদ, টিটোবাদ, লেনিনবাদ ও মার্কসবাদের আলােকে আপনার মতবাদের মূল্যায়ন সম্পর্কে কি ভাবছেন?

উত্তর : দেখুন, ছাত্রজীবন থেকে আজ পর্যন্ত আমার এই সুদীর্ঘকালের রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা ও সংগ্রাম কতিপয় চিন্তাধারার উপর গড়ে উঠেছে। এদেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী তথা সকল মেহনতী মানুষের জীবনে। শান্তি, সমৃদ্ধি ও সাম্য প্রতিষ্ঠাই আমার চিন্তাধারার মূল বিষয়বস্তু। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম। কাজেই কৃষকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে আমি জানি শােষণ কাকে বলে। এ দেশে যুগ যুগ ধরে শােষিত হয়েছে কৃষক, শােষিত হয়েছে শ্রমিক, শোষিত হয়েছে বুদ্ধিজীবীসহ সকল মেহনতী মানুষ। এ দেশের জমিদার, জোতদার, মহাজন ও তাদের আমলা-টাউটদের চলে শােষণ। শােষণ চলে। ফড়িয়া-ব্যবসায়ী ও পুঁজিবাদের। শােষণ চলে সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও নয়াউপনিবেশবাদের। এ দেশের সােনার মানুষ, এ দেশের মাটির মানুষ শােষণে শােষণে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের মুক্তির পথ কি? এই প্রশ্ন আমাকেও দিশেহারা করে ফেলে। পরে আমি পথের সন্ধান পাই। আমার কোন কোন সহযােগী রাজনৈতিক দল ও প্রগতিশীল বন্ধুবান্ধব বলেন, শ্রেণী সংগ্রামের কথা। কিন্তু আমি বলি জাতীয়তাবাদের কথা । জিন্নাবাদ এ দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সৃষ্টি করে সাম্প্রদায়িকতাবাদের বিষবাষ্প। তার জবাবে আমি বলি, যার যার ধর্ম তার তার- এরই ভিত্তিতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের কথা। সেই সঙ্গে বলি, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের কথা। শােষণহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সমাজতন্ত্র চাই। কিন্তু রক্তপাত ঘটিয়ে নয়- গণতান্ত্রিক পন্থায়, সংসদীয় বিধিবিধানের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা করতে চাই সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। আমার এই মতবাদ বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা ও ঐতিহাসিক পরিস্থিতি বিচারবিশ্লেষণ করেই দাঁড় করিয়েছি। সােভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, যুগােশ্লাভিয়া প্রত্যেকে নিজ নিজ পথে, নিজ নিজ অবস্থা মােতাবেক গড়ে তুলছে সমাজতন্ত্র। আমি মনে করি, বাংলাদেশকেও অগ্রসর হতে হবে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র এই চারিটি মূল সূত্র ধরে, বাংলাদেশের নিজস্ব পথ ধরে। আমার উপরােক্ত মতবাদকে অনেকে বলছেন, ‘মুজিববাদ’। এ দেশের লেখক, সাহিত্যিক কিংবা ঐতিহাসিকগণ আমার চিন্তাধারার কি নামকরণ করবেন সেটা তাদের ব্যাপার, আমার নয়। নামকরণের প্রতি আমার কোন মােহ নেই। আমি চাই কাজ। আমি চাই আমার চিন্তাধারার বাস্তব রূপায়ণ। আমি চাই শােষণমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ! আমি চাই আমার স্বপ্ন সােনার বাংলা নির্মাণের পূর্ণ বাস্তবায়ন।

প্রশ্ন : জাতীয়তাবাদ আপনার মতবাদের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। কিন্তু আপনি তাে জানেন, জাতীয়তাবাদ উগ্রতা কিংবা সংকীর্ণতায় পর্যবসিত হলে ফ্যাসিবাদের জন্ম দেয়? তা সত্ত্বেও জাতীয়তাবাদের প্রতি আপনি এত গুরুত্ব দিচ্ছেন কেন?

উত্তর : আপনি ঠিকই বলেছেন যে, জাতীয়তাবাদ উগ্রতা কিংবা সংকীর্ণতায় পর্যবসিত হলে হিটলারের জার্মানি, মুসােলিনির ইতালি, ডক্টর ভেরউর্ডের দক্ষিণ আফ্রিকা, পাঞ্জাবি খানদের পাকিস্তান বা ইসরাইলের ইহুদিবাদের মতাে অতি জঘন্যরূপ ধারণ করতে পারে। সে জাতীয়তাবাদ দক্ষিণপন্থী ও প্রতিক্রিয়াশীল। জাতীয়তাবাদ। কিন্তু আমার জাতীয়তাবাদ বামপন্থী ও প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদ। নাৎসী জার্মানি, ফ্যাসিবাদী পাঞ্জাব, বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইহুদিবাদের মতাে উত্র ও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের চরিত্র ও তার বিকাশ ধারা লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন যে, একচেটিয়া পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও নয়াউপনিবেশবাদ এবং আমলাতন্ত্রবাদ ও জঙ্গিবাদ উগ্র ও সকীর্ণ জাতীয়তাবাদের মূলশক্তি। তারা গণতন্ত্রেরও শত্ৰু, সমাজতন্ত্রেরও শক্র। তাদের জাতীয়তাবাদ শােষকদের জাতীয়তাবাদ। আমার জাতীয়তাবাদ শােষিতের জাতীয়তাবাদ। কারণ, আমার জাতীয়তাবাদের নেতৃত্বে রয়েছেন কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর সমন্বয়ে গঠিত আওয়ামী লীগ। কাজেই যে জাতীয়তাবাদ আমার মতবাদের অন্যতম প্রধান অঙ্গ, সেই বিপ্লবী ও প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদ ফ্যাসিবাদে রূপান্তরিত হবার কোন ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও বাস্তব কারণ নেই।

প্রশ্ন : বিশ্ব সমাজকে একটি সমাজ এবং বিশ্ব মানবকে যদি একটি গােষ্ঠী ধরে নেই, তবে কি জাতীয়তাবাদের চেয়ে আন্তর্জাতিকতাবাদ উন্নততর পর্যায় নয়?

উত্তর : সাম্প্রদায়িকতাবাদ এ দেশের মাটিতে গভীর শিকড় গেড়ে বসে আছে। তাকে নির্মূল করে তবেই এ দেশের শ্রেণী চেতনার বিকাশ সাধন সম্ভবপর। আর একমাত্র শ্রেণী চেতনাই আন্তর্জাতিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর পূর্ব শর্ত। এ দেশের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি যে, শ্রেণী-চেতনা বিকাশের পথে সাম্প্রদায়িকতাবাদ প্রধান অন্তরায়। আর সাম্প্রদায়িকতাবাদ নির্মূল করার রণকৌশল হিসাবেই আমি জাতীয়তাবাদী দর্শন অনুসরণ করেছি। এই মতবাদ কার্যকরী হলে, আমার বিশ্বাস, এ দেশের ভাবীকালের মানুষ ক্রমে ক্রমে জাতীয়তাবাদের গণ্ডি পার হয়ে উত্তীর্ণ হবে বিশ্বমানবতাবাদী উদার দৃষ্টিভঙ্গীতে।

প্রশ্ন : গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা বলতে আপনি কি বুঝাতে চান?

উত্তর : দেখুন, সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় দুইটি পথের কথাই আমরা জানি। একটি হলাে শ্রমকি, কৃষক, বুদ্ধিজীবী ও অন্যান্য মেহনতী মানুষের নেতৃত্বে সশস্ত্র বিপ্লবের পথ, অপরটি সংসদীয় গণতন্ত্রের পথ। লেনিন রাশিয়ায় এবং মাও সে তুং চীনে প্রথমােক্ত লাইনে সশস্ত্র বিপ্লবের পথ বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজ জীবনে সাম্প্রদায়িকতাবাদের অশুভ ভূমিকার দরুন এ দেশে শ্ৰেণী সংগঠন ও শ্রেণী সংগ্রাম গড়ে উঠেনি। এমনকি সাধারণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পক্ষেও সাম্প্রদায়িকতাবাদের ভূমিকা ছিল অতিশয় মারাত্মক। তদুপরি দেশটি শিল্পে পশ্চাৎপদ বলে এখানে শিল্প-শ্রমিকও তেমন সৃষ্টি হয় নি, সংগঠিতও হয় নি। এরূপ বাস্তব অবস্তায় বাংলাদেশে শ্রেণী সংগঠন ও শ্রেণী সংগ্রামের স্থলে গড়ে উঠেছে শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী ও অন্যান্য মেহনতী শ্রেণীর সক্রিয় সমর্থনে বহু-শ্রেণী ভিত্তিক জাতীয় সংগঠন ও জাতীয় সংগ্রামী দল আওয়ামী লীগ। জমিদারি উচ্ছেদের পর এ দেশের সামন্তবাদ তেমন শক্তিশালী নয়। এখন রয়েছে সামন্তবাদের ভগ্নবিশেষ- জোতদার, মহাজন ও তাদের আমলা-টাউট। আইনের মাধ্যমেই তাদের উচ্ছেদ সম্পন্ন হবে। ওদিকে আওয়ামী লীগের জাতীয় সরকার ব্যাংক-বীমা, বৃহৎ ও ভারি শিল্প এবং বাণিজ্যের এক বিরাট অংশ জাতীয়করণ করার ফলে বুর্জোয়া শ্রেণী ও পুঁজিবাদের বিকাশের পথরুদ্ধ হয়েছে। তাদের এমন ক্ষমতা নেই যে, সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করে। শােষক শ্ৰেণীকে দমন করার মতাে যথেষ্ট ক্ষমতা দেশবাসীর আছে। সমাজতন্ত্র রাতারাতি হয় না। দীর্ঘদিনের ব্যাপার। শান্তিপূর্ণভাবে এবং ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে হবে, ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে হবে। রক্তপাত অনেক হয়েছে, আর নয়। এবার সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে আমরা দেশকে ঐক্য, প্রগতি ও সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে নিতে চাই। এ কাজে আমি মনে করি, শক্তির উৎস বন্দুকের নল নয়, শক্তির উৎস আমার জনগণ।

প্রশ্ন : ইতিহাসের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশই সাম্রাজ্যবাদ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে ধ্বংস করার চক্রান্তে লিপ্ত থাকে। আপনি কি মনে করেন যে, বাংলাদেশেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে?

উত্তর : দেখুন, পুঁজিবাদী ও সামন্তবাদী শােষণ ব্যবস্থার ধ্বংসসাধনের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা, শােষণহীন সমাজ ব্যবস্থা। কাজেই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশেই পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদ প্রতিরােধ গড়ে তুলবার চেষ্টা করে। তাদের সঙ্গে কখনাে প্রকাশ্যে, কখনাে গােপনে যুক্ত হয় শােষকদের আন্তর্জাতিক দোসর- সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও নয়াউপনিবেশবাদ। বাংলাদেশেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটা অস্বাভাবিক নয়। বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদের বৈরী ভূমিকায় আমরা ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছি, কিন্তু বিস্ময় প্রকাশ করি নি। কারণ, জাতীয় স্বাধীনতার বিরােধিতা করাই তাদের বিঘােষিত নীতি। তবে, সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহেও প্রগতিশীল সংগঠন ও ব্যক্তি আছেন। তারাও তাদের দেশে শান্তি, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের জন্যে সংগ্রাম করছেন। আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে আমরা তাদের সক্রিয় সমর্থন লাভ করেছি। আশা করি, আমাদের সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও শান্তির সংগ্রামেও তাদের সক্রিয় সমর্থন আমরা লাভ করব। এ প্রশ্নে দেশের অভ্যন্তরে আমরা সকল প্রগতিশীল শক্তি ঐক্যবদ্ধ। আন্তর্জাতিকভাবেও আমরা ঐক্যবদ্ধ এবং শক্তিশালী।

সূত্র : মুজিববাদ, খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস, ন্যাশনাল পাবলিকেশন্স, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ : বিজয় দিবস, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২