You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে সিভিল সার্ভিস অফিসারগণ: দূতাবাসে ও মিশনে কর্মরত বাঙালিদের ভূমিকা - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে সিভিল সার্ভিস অফিসারগণ: দূতাবাসে ও মিশনে কর্মরত বাঙালিদের ভূমিকা

মহিউদ্দিন আহমেদ (পিএফএস ১৯৬৫)

যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে অবস্থিত পাকিস্তান দূতাবাসের তৎকালীন দ্বিতীয় সচিব ছিলেন মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি ১লা আগস্ট পাকিস্তানপক্ষ ত্যাগ করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করেন। এসম্বন্ধে বিচারপতি চৌধুরী লিখেছেন: “পহেলা আগষ্ট ‘এ্যাকশন বাংলাদেশ’ কর্তৃক আয়ােজিত এই সভায় অভূতপূর্ব উদ্দীপনা দেখতে পাই। এই সভায় রওনা হবার অল্পক্ষণ পূর্বে পাকিস্তান দূতাবাসের সেকেণ্ড সেক্রেটারী মহিউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে প্রস্তুত একথা ফোনে জানান। এখানে পাকিস্তান সরকারে কর্মরত কূটনীতিবিদদের মধ্যে সমগ্র ইউরােপে মহিউদ্দিন আহমেদই প্রথম পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেন ।.. ট্রাফালগার স্কোয়ারের সভায় মহিউদ্দিন তার বক্তৃতায় ঘােষণা করেন যে, তিনি পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ত্যাগ করলেন। তাঁর এই ঘােষণা খুবই উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। মহিউদ্দিন তার বক্তৃতায় বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।”২৯

পৃষ্ঠাঃ ১৯৭

এ এফ এম আবুল ফতেহ

বলাবাহুল্য  বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পাকিস্তানি দূতাবাসে কর্মরত বাঙালি কর্মকর্তাগণ স্বাভাবিক  কারণে তাদের নিজেদের জন্মভূমির স্বাধীনতা-প্রত্যাশায় পাকিস্তানপক্ষ ত্যাগ করেছিলেন। এই তালিকায় আরেকটি স্মরণীয় সংযােজন ছিল ইরাকে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত এ এফ এম আবুল ফতেহ-এর। এঁর সম্বন্ধে শওকত ওসমান লিখেছেন (১৯৭১/১১শে আগস্ট): “.. ওয়াশিংটন দূতাবাস থেকে তেরজন পাকিস্তানী অফিসারের ‘ডিফেক্ট’ সংবাদের উত্তেজনা পনর দিনে কিছু ঢিমে হয়ে এসেছে, এমন সময় খবর এলাে ইরাকের রাষ্ট্রদূত বাগদাদ থেকে লন্ডনে পালিয়ে যেতে পেরেছেন সপরিবার। লেভেল-পর্যায় এবার আরাে উর্ধে (উর্ধ্বে)। সুতরাং মুজিব নগবের অভিবাসীদের জন্যে তুমুল উত্তেজনার খবর বৈকি। / ইরাকের রাষ্ট্রদূতের নাম এ এফ এম আবুল ফতেহ। কয়েকদিন এই নাম জপমালার মত উচ্চারিত হবে। পরবর্তী খবরটি কাগজে ছিল না, কিন্তু শােনা গেল, মাত্র একটি সুটকেস তাতে তিনি নাকি পাকিস্তানী গােলামীর মুখে পদাঘাত করে এসেছেন। পাকিস্তানের দোস্ত ইরাক থেকে নিষ্ক্রমণ নিশ্চয় ঝুঁকিপূর্ণ।”  ৩০

ঝুঁকি তাে অবশ্যই ছিল, দেশমাতৃকার আহ্বানে সেদিন এভাবেই ঝুঁকি নিয়েছিলেন মৃত্যুর পরােয়াহীন অগণিত বাঙালি সন্তানেরা। এখানে লক্ষণীয়, রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহ শুধু নিজেই পালিয়ে আসেননি, সেইসঙ্গে সেখানে এমন ব্যবস্থাও করে এসেছিলেন যার ফলে অচিরেই মুজিবনগর সরকারের তহবিলে ২৫,০০০ (পঁচিশ হাজার) পাউন্ডের মতাে জমা পড়েছিল।

 আবু সাঈদ চৌধুরী লিখেছেন: “রাষ্ট্রদূত এ, এফ, এম আবুল ফতেহ’র কথা আমি আগেই লিখেছি। তিনি ইরাকে রাষ্ট্রদূত থাকাকালে ২৫ হাজার ব্রিটিশ পাউণ্ড মুজিবনগরে পাঠিয়ে লণ্ডনে চলে এসেছিলেন। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি নজরুল ইসলামের আহ্বানে লণ্ডনে আসার অব্যবহিত পরেই মুজিবনগর চলে যান। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিকট পঁচিশ হাজার ইরাকী দিনার মুজিবনগরে প্রেরণের ব্যাপারে পাকিস্তান দূতাবাস প্রতিবাদ করেছিল, কিন্তু তিনি তাতে ভ্রুক্ষেপ করেননি এবং কয়েকবার লণ্ডনে যাতায়াত করেছেন। তাঁর মত অভিজ্ঞ রাষ্ট্রদূত ও নির্ভীক দেশপ্রেমিককে সহকর্মীরূপে পেয়ে আমরা আনন্দিত হই।”৩১

আমরা আগেই দেখিয়েছি, মুক্তিযুদ্ধের একেবারে সূচনাপর্বে সিএসপি অফিসারেরা যখন পাকিস্তানপক্ষ ত্যাগ করে মুজিবনগর সরকারে যােগ দিয়েছিলেন এবং সে ঘটনা ঘটেছিল কোথাও কোথাও মুজিবনগর সরকার গঠনেরও আগে- এসময় অনেক সিএসপি তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন জেলার ট্রেজারি এবং স্থানীয় ব্যাঙ্কের ভল্ট থেকে পর্যন্ত বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ, সােনা-রূপা ইত্যাদি নিয়ে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারে যােগ দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রদূত এ এফ এম আবুল ফতেহ-এর মাধ্যমে এবারে পিএসপি কর্মকর্তারা এতে যুক্ত হলেন। এতে মুজিবনগর

পৃষ্ঠাঃ ১৯৮

সরকারের সুবিপুল অর্থচাহিদার কিছু হলেও মিটেছিল। উল্লেখ্য, জনাব ফতেহ মুক্তিযুদ্ধকালে রাষ্ট্রদূত পদমর্যাদায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা হিশেবে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলে।  এপ্রতিনিধি দলের অন্যান্য সদস্যের মধ্যে আবুল মাল আবদুল মুহিতও ছিলেন।

এস (সৈয়দ) আনওয়ারুল করিম

এর সম্পর্কে আবু সাঈদ চৌধুরী লিখেছেন: “সৈয়দ আনােয়ারুল করিম ভদ্র, বিনয়ী এবং সুরুচিসম্পন্ন মানুষ। তিনি নিউইয়র্কস্থিত পাকিস্তান দূতাবাসে উপস্থায়ী  প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ৪ঠা আগষ্ট পদত্যাগ করেন। তবে তিনি মে মাসেই আমার সঙ্গে দেখা করে পাকিস্তানের পদ যথাসময়ে ত্যাগ করবেন বলে জানিয়েছিলেন।”৩২

উপরে আলােচিত এসব কীর্তিমান কর্মকর্তা এবং তাদের ন্যায় জ্ঞাত-অজ্ঞাত আরাে অনেকের সম্মিলিত উদ্যোগে ও প্রচেষ্টায়, নিরলস পরিশ্রমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে সেদিন আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে উঠেছিল এবং কালক্রমে মুক্তিযুদ্ধ একটি যৌক্তিক ও সফল পরিণতির দিকে ধাবিত হয়েছিল, তা না বললেও চলে। যাই হােক, এখানে অপ্রাসঙ্গিক হলেও একটা কথা কহতব্য যে বহির্বিশ্বে যাঁরা মাতৃভূমির শৃঙ্খলমুক্তির সংগ্রামে সেদিন প্রত্যক্ষ-পরােক্ষে শামিল হয়েছিলেন, পরবর্তীকালে লিখিত (দেশ স্বাধীনের বহু পরেই মূলত এসব রচিত) বিভিন্ন গ্রন্থে, প্রবন্ধে-নিবন্ধে এদের অনেকের নাম (পদ-পদবিসহ) পাওয়া যায় । তবে তা খুব অপ্রতুল ও ক্ষেত্ৰত বিভ্রান্তিকরও এজন্য যে, এর একটার সঙ্গে অন্যটার প্রায়শ অসামঞ্জস্য দুর্লক্ষ নয়।

কারও কারও লেখায় তাদের নিজেদের সরাসরি সম্পৃক্তির উল্লেখ থাকলেও তা অসঙ্কোচে গ্রহণে সমস্যা হলাে এসম্পর্কিত আপাত নির্ভরযােগ্য গ্রন্থপ্রচয়ে তার বা তাদের সে দাবির সমর্থন মেলানাে কঠিন হয়ে দাঁড়ায় ।

উদাহরণস্বরূপ ১৯৫৭ সাল-ব্যাচের সিএসপি খােরশেদ আলমের কথা বলা যায়। তার ভাষ্য মতে, ০১/০৯/১৯৭০ থেকে পরবর্তী ১১-মাসের জন্য তিনি প্রশিক্ষণে সপরিবারে (স্ত্রী ও ২ সন্তানসহ) আমেরিকায় অবস্থান করেছিলেন।

তবে অন্যদের মতাে প্রকাশ্যে ঘােষণা দিয়ে অর্থাৎ আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি পাকিস্তানপক্ষ ত্যাগ বা স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন- এ মর্মে কোনাে প্রমাণ পাওয়া যায় না, যদিও স্বপ্রণীত প্রশাসনে নিবেদিত এক কর্মকর্তার আত্মস্মৃতি রচনায় তিনি লিখেছেন: “১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করার সংবাদ পেয়ে আমরা তাদের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করি। পরবর্তীকালে মাহবুব আলম চাষী এবং এইচটি

পৃষ্ঠাঃ  ১৯৯

ইমামের কাছ থেকে পাওয়া চিঠি থেকে আমরা সরকারের কাঠামাে সম্পর্কে কিছু জানতে  পারি।.. ইতােমধ্যে কিছু কিছু সিভিল কর্মকর্তাও মুজিবনগরে তথা কলকাতায় পৌছেছেন। আমি যখন জানলাম যে, এইচটি ইমাম হয়েছেন সরকারের কেবিনেট সচিব, তখন ১৯৭১ সালের এপ্রিলের শেষ নাগাদ তার কাছে চিঠি লিখে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আমার আনুগত্য জ্ঞাপন করি। আমর বোস্টনে বাংলাদেশ সমিতি গঠন করে কাজ করতে শুরু করেছি বলেও তাকে আমি জানাই।../ ১৯৭১ সালের জুলাই পর্যন্ত আমি এইচটি ইমামের কাছ থেকে কোনো জবাব পাইনি। আমার প্রশিক্ষণ ১৯৭১ সালের মে মাসে সমাপ্ত হয় ।.. এইচ টি ইমামের কাছে লেখা চিঠির উত্তর আমি জুলাই, ১৯৭১ পর্যন্ত পাইনি তারা নিশ্চয় সরকার গঠন এবং অন্যান্য তৎপরতায় খুবই ব্যস্ত ছিলেন। যখন জানলাম মাহবুব আলম চাষী সরকারের পররাষ্ট্র সচিব, তক্ষুনি আমি তার কাছে চিঠি লিখলাম এবং আমাদের সমিতির কাজকর্ম ও আমার নিজস্ব ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে তাকে অবহিত করলাম এবং সরকারকেও জানাতে অনুরােধ করলাম।/ আগস্ট মাসে আমি জনাব চাষীর কাছ থেকে জবাব পাই। তিনি আমাকে হার্ভার্ডে ভালাে রেজাল্ট করা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রােগ্রামে ভর্তি হওয়ার জন্য অভিনন্দন জানালেন। তিনি জানালেন, আমি যে পাকবাহিনীর আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছি ও আমার চাকরি ন্যস্ত করেছি তা তারা জানেন। আমাদের সমিতি গঠন ও তার নানাবিধ কার্যকলাপ সম্পর্কেও তারা অবহিত বলে তিনি জানালেন। তিনি সিনেটে আমাদের লবিং চালু রাখতে পরামর্শ দিলেন, যাতে সিনেট পাকিস্তানকে দেয়া সব ধরনের সহায়তা প্রদান বন্ধ করতে পারে।”৩৩

জনাব আলমের তৎকালীন ভূমিকা সম্পর্কে ব্যাপক উল্লেখ তেমন দৃষ্ট হয় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্রেও এর নাম লভ্য নয়। অথচ তার বক্তব্য যে একেবারে অমূলক, তাও বলা কঠিন। যেমন, স্বয়ং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লিখেছেন: “খােরশেদ আলম, মাহবুবুল আলম মে মাসেও আমার সঙ্গে দেখা করে আন্দোলনের পক্ষে কাজ শুরু করার কথা জানান। এবারে এসে দেখলাম, তারা সংঘবদ্ধ হয়েছেন এবং সুসংহতভাবে আন্দোলনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। খােরশেদ আলম বৃহত্তর বােষ্টনের বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি আন্দোলনের পূর্বে সি, এস, পি অফিসার ছিলেন ।../ ২৬শে মার্চে তারা ঢাকায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বর্বরতার কথা জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়ােজনীয় কর্মপন্থা গ্রহণের জন্য চঞ্চল হয়ে ওঠেন। তারা প্রত্যহ হার্ভার্ড পপুলেশন সেন্টারে মিলিত হতে থাকেন। মাহবুবুল আলম, তৈয়বুদ্দীন মাহতাব এবং খােরশেদ আলম অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে নানা দায়িত্ব

পৃষ্ঠাঃ ২০০

পালনে এগিয়ে আসেন। এঁরা সবাই নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত আমার মে মাসের মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন এবং তাঁরা আমার সঙ্গে তাঁদের পরিকল্পনা এবং কর্মসূচি সম্বন্ধে আলােচনা করেছিলেন। এবারে এসে শুনলাম তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে অধ্যবসায় এবং একাগ্রতার দ্বারা আমাদের সংগ্রামের জন্য সমর্থন অর্জন  করেছেন।”৩৪

একই রকম ব্যাপার সিএসপি হারুন অর রশিদের ক্ষেত্রেও লক্ষণীয়। ২৯ শে মার্চের পরে স্বীয় সঙ্গীদের নিয়ে হােয়াইট হাউস থেকে ক্যাপিটল হিল পর্যন্ত আমেরিকা প্রবাসী সর্বস্তরের বাঙালি বিশেষ করে ছাত্রদের নিয়ে তাঁর যে প্রতিবাদ-যাত্রার কথা আগে উল্লেখ করেছি, তাতে খােরশেদ আলমের নামও পাই। তার ভাষায়: “Khorshed Alam and I were probably the senior-most persons in that group (though only about 35 years old then) and certainly one of the few who had served as a senior government official.” ৩৫

 যাই হােক, আলােচিত-অনালােচিত, জ্ঞাত-অজ্ঞাত এসব মাতৃভূমিপ্রেমিক বাঙালি কর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধপর্বে বহির্বিশ্বে সেদিন যে নানাবিধ কর্মকাণ্ডে নিজেদের জড়িয়ে ছিলেন, বিভিন্নসূত্রে তার আরও দু-চারটি তথ্য নিচে উল্লেখ করা হলাে।

১. “… আমার আনুষ্ঠানিক কর্মের অংশ হিসেবে আমি সে (মে) মাসেই নিউইয়র্ক যাই ।.. যেদিন আমি নিউইয়র্কে পৌছি আরাে কয়েকজন বাঙ্গালী উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মচারী যথা জনাব এ, এম, এ মুহিত, জনাব খােরশেদ আলম, জনাব হারুন রশীদ এবং আরাে অনেকে আমার সাথে দেখা করেন। তাঁদের সাথে আন্দোলনের নানাদিক নিয়ে আলােচনা হয়।”৩৬

২. “সাতাশে আগস্ট সকালে সমবেত বাঙালী ও সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে আমি দূতাবাসের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করি। দূতাবাস উদ্বোধনের খবর ‘লণ্ডন টাইমস’ সহ অন্যান্য পত্রিকায় ছাপা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রায় তিনশ’ বাঙালী এবং অনেক বিদেশী সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন।/ দূতাবাস উদ্বোধনের পর কয়েকজন বৃটিশ পার্লামেন্ট সদস্য বক্তৃতা করেন এবং আমাদের সংগ্রামের সর্বাঙ্গীন (সর্বাঙ্গীণ) সাফল্য কামনা করেন। উদ্বোধনের দিন দূতাবাসের সদস্য ছিলেন আবুল ফতেহ, মহিউদ্দিন আহমেদ, লুৎফুল মতিন, শিল্পী আবদুর রউফ, মহিউদ্দিন চৌধুরী, আবদুস সালাম এবং এ, কে, এম নূরুল হুদা ও ফজলুল হক চৌধুরী।”৩৭

পৃষ্ঠাঃ ২০১

৩.  অধুনালুপ্ত বাংলার বাণী ২১শে সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালের মুজিবনগর ৪র্থ সংখ্যায় প্রকাশিত  ‘মাতৃভূমির বক্তব্য পেশের জন্য বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নিউইয়র্ক যাত্রা’ শীর্ষক কূটনৈতিক প্রতিনিধি প্রেরিত এক সংবাদভাষ্যে জানায়: “বিংশ শতাব্দীর অপরাজেয় জাতীয়তাবাদী গণশক্তির আত্মপ্রতিষ্ঠার দুর্জয় সংগ্রামের নির্ভীক সিপাহশালার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব(বু)র রহমানের নির্দেশে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত বাংলাদেশের দশ দিগন্তে হানাদার পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদস্যুদের হিংস্র বর্বর গণহত্যাযজ্ঞের কালিমালিপ্ত পটভূমিতে আজ (মঙ্গলবার) নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হইতেছে। এই অধিবেশন কালে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ হইতে স্বাধীন বাংলার পক্ষ হইতে, ১৬ সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদল বিশ্বের দরবারে জননী বাংলার দুঃখ ও বেদনার কাহিনী, সংগ্রাম ও বিক্রমের কাহিনী পেশ করিবেন ।.. প্রতিনিধিদলের ১১জন সদস্য আজ মুজিবনগর হইতে নিউইয়র্কের পথে নয়াদিল্লী রওয়ানা হইয়া গিয়াছেন। ইহারা হইতেছেন আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য সর্বজন শ্রদ্ধেয় জননেতা শ্রী ফণীভূষণ মজুমদার এম, পি, এ, সৈয়দ আবদুস সুলতান এম, এন, এ, জনাব সিরাজুল হক এম, এন, এ, ডাঃ মফিজ এম, এন, এ, ডাঃ আজহারুল হক এম, পি, এ, জনাব সাহাবুদ্দিন আহমদ এম, পি এ, জনাব এম, এ, সামাদ এম, এন, এ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড: এ, আর, মল্লিক, ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ, বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘােষণাকারী সাবেক পাকিস্তানী কূটনীতিক জনাব এ, এফ, এম, আবুল ফতেহ ও জনাব খুররম খান পন্নী। প্রতিনিধিদলের অপর ৫ জন সদস্য হইতেছেন বর্তমানে বিদেশে অবস্থানরত বিচারপতি জনাব আবু সাইদ চৌধুরী, জনাব এম, আর, সিদ্দিকী এম, এন, এ, অধ্যাপক রহমান সােবহান, জনাব এস, এ, করিম ও জনাব এ, এম, এ, মুহিত।”৩৭

উপসংহারে বহির্বিশ্বে বিশেষত পাকিস্তান বৈদেশিক মিশনে বা দূতাবাসে নিয়ােজিত পেশাদার (পিএফএস) ও অপেশাদার (সিএসপি ও প্রতিরক্ষা বাহিনী থেকে প্রেষণে নিযুক্ত) বাঙালি কূটনীতিক-কৃত্যক এবং অন্যদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানপক্ষ ত্যাগ করে যারা স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করেছিলেন, তাদের একটি আপাতগ্রাহ্য নাম-তালিকা উদ্ধৃত করে এ আলােচনা শেষ করব। স্মর্তব্য যে, এখানে কেবল কর্মকর্তাদের নামােল্লেখ করা হয়েছে (কর্মচারীদের নাম জানতে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড (পুনর্মুদ্রণ, ২০০৪, পৃষ্ঠা ১০৪৪-৪৭); এইচ. টি. ইমামের বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১; মােহাম্মদ নুরুল কাদেরের একাত্তর আমার প্রভৃতি গ্রন্থ দেখা যেতে পারে।

পৃষ্ঠাঃ ২০২

সংখ্যাতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণে এককথায় বললে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ছিলেন ভারতের নয়াদিল্লিতে ১৩ (কর্মচারী ১১ জন-সহ) ও কলকাতায় ৬৫ জন (কর্মচারী ৫৯ জন-সহ); যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে ১৩ (কর্মচারী ৮ জন -সহ) ও নিউইয়র্কে ২ জন; যুক্তরাজ্যের লন্ডনে ৫ জন (অন্যান্য ৪ জন-সহ); ফ্রান্সের প্যারিসে ২ জন; ইরাকের বাগদাদে ১ জন; হংকং-এ ১ জন, সুইডেনের স্টকহােমে ১ জন; নাইজেরিয়ার লাগােসে ১ জন; ফিলিপাইন্সের ম্যানিলায় ১ জন; বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে ১ জন; স্পেনের মাদ্রিদে ১ জন; লেবাননের বৈরুতে ১ জন: নেপালের কাঠমান্ডুতে ১ জন; আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্সে ১জন এবং জাপানের টোকিয়ােতে ২ জন- সব মিলিয়ে কম-বেশি ১১২ জন। ৩৯

References:

২৯. প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি, পৃষ্ঠা ৮৬।

পৃষ্ঠাঃ ২১১

৩০.  স্মৃতিখণ্ড মুজিবনগর, পৃষ্ঠা ৬৪-৫।

৩১. তদেব, পৃষ্ঠা ১৭৩। আরও দেখুন, স্মৃতিখণ্ড মুজিবনগর, পৃষ্ঠা ৭৭।

৩২. তদেব, পৃষ্ঠা ১৭৪।

৩৩. প্রশাসনে নিবেদিত এক কর্মকর্তার আত্মস্মৃতি, খােরশেদ আলম, পৃষ্ঠা ৯১-৯৩। তার এগ্রন্থের পরিশিষ্ট খণ্ডে তকালীন পররাষ্ট্র সচিব মাহবুবুল আলম চাষীর উত্তর সম্পর্কিত পত্রটি সংযােজিত।

৩৪. প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি, পৃষ্ঠা ১২।

৩৫. দেখুন, Flashbacks to 1971 in American Response to Bangladesh Liberation War, p. 424.

৩৬. আবু সাঈদ চৌধুরী; তথ্য সংগৃহীত, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড, সাক্ষাৎকার, পৃষ্ঠা ৬৯-৭০।

৩৭. প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি, পৃষ্ঠা ১০০-১০১।

৩৮ তথ্য সংগৃহীত, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্রঃ, ষষ্ঠ খণ্ড, মুজিব নগর ও গণ মাধ্যম, পৃষ্ঠা ২৯৬।

৩৯.  তথ্য সংগৃহীত, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্রঃ, তৃতীয় খণ্ড, মুজিব নগরঃ প্রশাসন, পৃষ্ঠা ৯৩২-৯৩৫। এদের নামের বাংলা বানানের জন্য দেখুন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্রঃ, ষষ্ঠ খণ্ড, মুজিব নগর ও গণ মাধ্যম, পৃষ্ঠা ২৭৫-৬।

আমেরিকার শিকাগাে থেকে প্রকাশিত Bangladesh Newsletter পত্রিকার ২৫শে অক্টোবর ১৯৭১ সালের ১১শ সংখ্যার ‘More Diplormats Declare Allegiance to Bangladesh’ শীর্ষক সংবাদসূত্রে জানা যায়, তখন পর্যন্ত পাকিস্তানের বৈদেশিক দূতাবাসে কর্মরত বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলিয়ে ১১৪ জনের মতাে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করেছিলেন, যার মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন, যেমন- আর্জেন্টিনায় নিযুক্ত অ্যাম্বােসাডর আবদুল মমিন/ মােমিন; যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত রাজনৈতিক কাউন্সেলর এম এম রেজাউল করিম; নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত মিনিস্টার-কাউন্সেলর হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী; বৈরুতে জনাব লতিফ; মাদ্রিদে আবদুল করিম মণ্ডল; বেলজিয়ামে নায়েবুল হুদা এবং নেপালে নিযুক্ত প্রথম সচিব মুস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ। (তথ্য সংগৃহীত, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্রঃ, যষ্ঠ খণ্ড, মুজিব নগর ও গণ মাধ্যম, পৃষ্ঠা ৭২৩)। এই তালিকায় সিএসপি হারুন অর রশিদের নাম অনুপস্থিত। অথচ জানা মতে, তিনিই আমেরিকায় কর্মরত বাঙালিদের মধ্যে প্রথম সিএসপি, যিনি চাকুরি তথা পাকিস্তানসরকারের আনুগত্য ত্যাগ করার দৃপ্ত সাহস দেখিয়েছিলেন। এতে তার নাম না থাকার কারণ- যেহেতু তিনি দূতাবাসে বা মিশনে নিযুক্ত ছিলেন না, ছিলেন বিশ্বব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ওয়াশিংটনে।

Source: মুক্তিযুদ্ধে সিএসপি ও ইপিসিএস অফিসারদের ভূমিকা