You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ২২শে অক্টোবর, মঙ্গলবার, ১৯৭৪, ৪ঠা কার্ত্তিক, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ

সর্বগ্রাসী ভাঙনের কবল থেকে চাঁদপুরকে বাঁচাতে হলে—

শতাব্দী প্রাচীন চাঁদপুর রেলওয়ে স্টেশনটি যে কোনো মুহূর্তে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যেই ডাকাতিয়া পাড়ের চাঁদপুর রেল স্টেশনটি ব্যাপক অংশ নদীর অতলে তলিয়ে গেছে। গত শুক্রবার মধ্যরাত থেকে বলা নেই কওয়া নেই মেঘনা এবং ডাকাতিয়া নদীতে আবার নতুন করে ভাঙনের সর্বনাশা খেলা শুরু হয়। জাহাজ ঘাটের চারটি জেটি, রেল স্টেশনের পঁচিশটি বড় বড় দোকান এবং অফিস ঘর ভাঙনের মুখে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। চাঁদপুরে জাহাজ ঘাট বলতে এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। আকস্মিক ভাঙনের ফলে অবস্থার এতোই মারাত্মক অবনতি সাধিত হয়েছে যে, বর্তমানে স্টীমার অন্যত্র ভিড়ানো হচ্ছে। রেল স্টেশনের প্রায় দেড় হাজার ফুট দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ পরিমাণ জায়গা সম্পূর্ণ নদীতে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এবং নদীর সর্বগ্রাসী স্রোতে রেল স্টেশনের সর্বত্র বড়ো বড়ো ফাটল মুখ ব্যাদান করে রয়েছে। রেল কর্তৃপক্ষ অবস্থা বেগতিক দেখে চটপট প্রায় দু’শত ফুট রেল লাইন উঠিয়ে ফেলার কাজ সমাধা করেছেন, বাকি রেল লাইন উঠিয়ে ফেলার জন্যও রেল শ্রমিকরা রাতদিন গলদঘর্ম পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। শুধু যে চাঁদপুর রেল স্টেশনটিই ভয়ঙ্কর ভাঙনের মুখোমুখি হয়েছে তা নয়, রেল স্টেশন সংলগ্ন আভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থার টার্মিনাল, যমুনা অয়েল মিল, রেলওয়ে কলোনী, রেল হাসপাতাল এবং হাইস্কুলও সর্বনাশা ভাঙনের কবলে পড়ে যে কোনো মুহূর্তে নদীর তলদেশে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। কারণ নদীতে এখন সাপের ফণার মতো ঢেউ নেই ঠিকই, কিন্তু নিম্নমুখী প্রবল স্রোতের তোড়ে রেল স্টেশনের সমগ্র এলাকায় বড় বড় ফাটল দাঁত বের করে রয়েছে। এর ফলে দেখতে না দেখতেই ব্যাপক জায়গা নদীগর্ভে দেবে যাচ্ছে। চাঁদপুরবাসীদের কাছে নদীর ভাঙন দীর্ঘদিন ধরেই একটা মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা। এবারের আকস্মিক নদীর ভাঙনের যে ব্যাপকতা তা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে গত তিন বছরের সমস্ত পূর্বতন রেকর্ড ভঙ্গ হয়ে যাবে বলেই আমরা আশংকা প্রকাশ করছি। ভাঙনের কবল থেকে চাঁদপুর শহরকে রক্ষার জন্য সরকার গত বাহাত্তরের আগস্ট মাস থেকে সক্রিয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন এবং এ পর্যন্ত চাঁদপুর শহর সংরক্ষণ খাতে প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয় করেছেন। কিন্তু কোটি কোটি টাকা ঢেলেও নদীর ভাঙন রোধ করা যায়নি। বর্তমানে মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর ভাঙন এতো তীব্র এবং ভয়াবহ রূপ নিয়েছে যে, অবস্থাটা প্রায় পানিতে টাকা ঢালার নামান্তরই হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বয়ং চাঁদপুর শহরের ভাঙন সরেজমিনে দেখার পর জরুরী ভিত্তিতে ভাঙনরোধের নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাতে সাড়ে তিন লাখ ঘনফুট পাথর ফেলা হয়েছিল। পুরানা বাজার এলাকায়ই প্রায় সব পাথর ফেলা হয়েছিল বটে, কিন্তু পাথর ফেলার পরও পুরানা বাজার এলাকাটি এখন আর নিরাপদ নয়। মেঘনা তীরে ‘গ্রোয়েন’ নামে একটি পাথরের বাঁধ তৈরী করা হয়েছিল, মেঘনার প্রবল স্রোতে সে বাঁধও আজ ফেঁসে গেছে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর নির্দেশানুযায়ী সাড়ে তিন লাখ ঘনফুট পাথর ফেলার পর চট্টগ্রাম এবং সিলেট থেকে ওয়াগন এবং বার্জের অভাবে পাথর আনার কাজও এখন বন্ধ রয়েছে। জরুরী অবস্থা মোকাবেলার জন্য এখন কোনো পাথরও মওজুত নেই। আশ্চর্য!
যখনই নদীতে ভাঙন দেখা দেয়, যখনই জায়গা ধসে পড়ে তখনই তড়িঘড়ি শহর সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়, ফেলা হয় পাথর। সাময়িককালের জন্য ভাঙনের তীব্রতা কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত পরিকল্পনার ‘পরী’ উধাও হয়ে যায়। প্রকৃত প্রস্তাবে চাঁদপুর শহরকে ভাঙনের কবল থেকে রক্ষার জন্য বিপুল পরিমাণ পাথর দরকার এবং সে জন্য সরকারের অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ প্রতুল হওয়া চাই। চাঁদপুর শহর সংরক্ষণের জন্য যেখানে দুই কোটি পঁচাশি লক্ষ টাকা দরকার, সেখানে বরাদ্দকৃত ষাট লক্ষ টাকা তো সমুদ্রে গোস্পদ মাত্র। কাজেই চাঁদপুর শহর সংরক্ষণের জন্য হয় কার্যকর ব্যবস্থা চাই, নয় রেল স্টেশনটিকে নিরাপদ দূরত্বে প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা চাই। ভাঙনের সময় শুধু পাথর ফেলে ভাঙন হয়তো সাময়িককালের জন্য বন্ধ রাখা যেতে পারে, তাতে সমস্যার পূর্ণাঙ্গ সমাধান হবে না। ‘ভাঙনের কবল থেকে চাঁদপুর শহরকে রক্ষা করুন’ বলে নাকি-কান্না কুড়ে দিলেও সর্বগ্রাসী ভাঙন ঠেকানো যাবে না। তাই আমরা প্রস্তাব করছি, মিছেমিছি পানিতে টাকা না ফেলে চাঁদপুর রেলওয়ে স্টেশনটিকে অবিলম্বে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা হোক এবং আমাদের বিশ্বাস, সেটাই হবে যোগ্যতর এবং শ্রেয়তর কাজ।

মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতিকে শান্ত করতে হলে

বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে কোনো সমস্যার সমাধান খুঁজতে গেলে তা ফলপ্রসূ হয় না। মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির মোকাবেলা করা বা তার একটা শান্তিপূর্ণ স্থায়ী সমাধানের চেষ্টাও হয়তো সে কারণেই ফলপ্রসূ হচ্ছে না। তাই বাস্তবতা বর্জিত আলাপ-আলোচনার ধানাই-পানাই বন্ধ রেখে একটা সন্তোষজনক ও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথ আবিষ্কার করে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতিকে আয়ত্তে আনার আহ্বান জানিয়ে আলজিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারী বুমেদীন দু’টি বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন।
প্রেসিডেন্ট বুমেদীন অধিকৃত আরব এলাকা থেকে ইসরাইলী সৈন্য প্রত্যাহারের নির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণ এবং স্বাধীন প্যালেস্টাইনী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে স্পষ্ট মার্কিন নীতি ঘোষণার কথা বলেন। সম্প্রতি আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ হেনরী কিসিঞ্জারের সাথে এক বৈঠককালে প্রেসিডেন্ট বুমেদীন স্পষ্টভাবে তার বক্তব্য পেশ করেন। এবং মিসরীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মস্কোয় ৫ দিন সফর শেষে যে রুশ-মিসর যুক্ত ইশতেহার প্রকাশিত হয় সেখানে ও জেনেভায় আসন্ন মধ্যপ্রাচ্য শান্তি সম্মেলনে প্যালেস্টাইনী মুক্তি সংস্থাকে (পি.এল.ও) সমান মর্যাদা দানের দাবী জানানো হয়।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি বিশ্বশান্তির সম্ভাব্য পরিবেশকে সর্বদা হুমকির সামনেই রেখেছে। এতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো তো বটেই বিশ্বের শান্তিকামী দেশগুলোও বিস্ফোরণোন্মুখ মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির অনির্দিষ্ট পরিণতির শঙ্কায় সদা ভীত। সে ব্যাপারে সোভিয়েত কম্যুনিস্ট পার্টি প্রধান এক সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন যে, অবিলম্বে এ ব্যাপারে নিষ্পত্তির আলোচনা না করা হলে মধ্যপ্রাচ্য আগুন বারুদ ডিপোর মতো জ্বলে উঠবে।
পরিস্থিতি যে সুখকর বা আশাপ্রদ নয়—ঘটনা পরম্পরাই তার প্রমাণ। এবং শান্তি আলোচনার অনুকূল আবহাওয়াকে বার বার ইসরাইল যে নস্যাৎ করে দিয়েছে এ কথাও সমানভাবে সত্য। তাই অদূর অতীতের দিকে চেয়ে বলা যায়—গত বছর অক্টোবর যুদ্ধের পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ হেনরী কিসিঞ্জারের উদ্যোগে ইসরাইল, মিসর ও সিরিয়ার সঙ্গে সৈন্য পৃথকীকরণের যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল—তার দ্বারা খুব একটা সুফল কিছু পাওয়া যায়নি। কারণ সৈন্য পৃথকীকরণ ছাড়াও ইসরাইল কর্তৃক দখলীকৃত আরব এলাকার প্রশ্নটি থেকে গিয়েছিল অমীমাংসিত।
হেনরী কিসিঞ্জার আবার মধ্যপ্রাচ্য সফর করেছেন। দীর্ঘ ৬ দিনব্যাপী মধ্যপ্রাচ্য সফরকালে তিনি মরক্কোর বাদশাহ সহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে উচ্চপর্যায়ে ব্যাপক শান্তি আলোচনাও চালান। এবং বরাবরের মত এবারও তিনি আশাবাদ পোষণ করেন। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হলো যুক্তিহীন আশাবাদ বা প্লেটোনিক সমাধানের চিন্তায় মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি সত্যি আসবে কি?
এ কথা অনস্বীকার্য যে, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমেই বর্তমান বিশ্বের ছোট ছোট দেশগুলো ভৌগোলিক সীমারেখা সহ স্বাতন্ত্র্যের ভিত্তিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাইছে। এই জাতীয় চেতনাই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে ভেঙে দিচ্ছে খান খান করে। এমনকি এই জাতীয়তাবাদ প্রবল পরাক্রান্ত দেশগুলোকেও সচকিত করে তুলেছে। সেদিক থেকে বিচার করলে প্যালেস্টাইনীদের মুক্তিযুদ্ধ ও তাদের জাতীয়তাবাদী চেতনা দোষের নয়। এবং বর্তমান বিশ্বের কাছে তাদের এই সংগ্রামের একটা মানবিক আবেদনও আছে বৈকি! হয়তো সে যুক্তিতেই প্যালেস্টাইন সমস্যার উপর আসন্ন বিতর্কে প্যালেস্টাইনী মুক্তি সংস্থার প্রতিনিধিকে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়ার জন্য জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দুঃখের সঙ্গে উল্লেখ করতে হচ্ছে যে, এই মানবিক বিবেচনার প্রতিও ইসরাইল শ্রদ্ধা পোষণ করে না। তারা সরাসরি জানিয়েছে যে, জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত যাই হোক না কেন ইসরাইল প্যালেস্টাইনী মুক্তি সংস্থার সাথে মীমাংসায় বসবে না। শুধু এহেন স্পর্ধিত উক্তিই নয়—ইসরাইল তার বিদেশী মদদদাতাদের উপর অটুট ভরসা রেখে দখলীকৃত আরব এলাকাগুলোকে এখনও আটকে রাখার বেপরোয়া চেষ্টা চালাচ্ছে।
আমাদের ধারণা, মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতিকে শান্ত করতে হলে আজ আর শুধু লোক দেখানো আলাপ-আলোচনা নয় বা শান্তিকামী বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস নয়-বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে শান্তির দূতদের এবং ইসরাইলের অশোভন ঔদ্ধত্যকে যুক্তির নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। সে জন্য পরিচ্ছন্ন সিদ্ধান্ত এবং অব্যর্থ পদক্ষেপ গ্রহণ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। এ ব্যাপারে আমরা আলজিরীয় প্রেসিডেন্টের স্পষ্ট বক্তব্যের সঙ্গে অভিন্ন মতপোষণ করি এবং করবো। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের আগুন নিভুক আমরা মানবিকবোধের সৌজন্যে অকপটভাবেই তা সর্বদা চেয়েছি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!