You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৫ই সেপ্টেম্বর, রোববার, ২৯শে ভাদ্র, ১৩৮১

শিশু খাদ্য নিয়ে কারসাজি

দেশের সঙ্কট মোকাবেলা করার জন্যে বিদেশ থেকে আমদানী করা বাইশ হাজার একশত পঁচিশ কার্টুন শিশুখাদ্য চট্টগ্রাম বন্দরে দেড় মাস পড়ে রয়েছে। আমাদের পত্রিকার প্রকাশিত গতকালের একটি রিপোর্ট এ তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, জানুয়ারী-জুন শিপিং মওসুমে আমদানী করা হয়েছিল এই বেবীফুড। নিয়ম অনুযায়ী ইতিমধ্যেই আমদনীকারক টি, সি, বি বেবীফুডের দাম নির্ধারণের কাজ শেষ করে ভোগ্যপণ্য সরবরাহ সংস্থায় কাছে এলোটমেন্ট দিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু ভোগ্যপণ্য সরবরাহ সংস্থা দেড় মাস হতে চললো এই বেবীফুড উঠিয়ে আনেননি। চট্টগ্রামের টি, সি, বি’র গুদামেই তা পড়ে রয়েছে। প্রকাশিত রিপোর্টর একাংশে বলা হয়েছে, ভোগ্যপণ্য সংস্থার জনৈক মুখপাত্র এলটমেন্টের বিষয় কিছু জানেন না এবং সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা ঢাকার বাইরে থেকে ফিরে না আসা পর্যন্ত এ ব্যাপারে তিনি কিছু বলতে পারবেন না।
শিশুখাদ্য নিয়ে ইতিপূর্বেও বেশ কয়েকবার নানা কেলেঙ্কারীর ঘটনা আমরা দেখেছি। যখনই কতৃপক্ষ শিশুখাদ্য আমদানী করেন তখনই এটাকে একটি জরুরী দ্রব্য হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
কিন্তু আমরা পূর্বাপর লক্ষ্য করেছি, কতৃপক্ষ শিশুখাদ্য আমদানী ও সরবরাহ আজ অবধি নিশ্চিত করতে পারেননি। মাঝে মাঝে যা আনা হয়েছে তাও দ্বিগুণ ত্রিগুণ মূল্যে বাজারে বিক্রি হয়েছে। মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। ন্যায্যমূল্যের দোকান বানিয়েও যথার্থ অর্থে মূল্য নিশ্চিত করা যায়নি। চোরাপথে শিশুখাদ্য সাধারণ বাজারে গিয়ে আগুন মূল্যে বিক্রি হয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম—এহেন অবস্থা বেশীদিন চলবেনা। এর একদিন পরিসমাপ্তি ঘটবে, সরবরাহ ও মূল্য একটি নিশ্চিত অবস্থার মধ্য দিয়ে অবহিত হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ শিশুখাদ্যের ব্যাপারে অজ পর্যন্ত কোন নিশ্চিত ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে কর্তৃপক্ষ পারেননি। চট্টগ্রাম বন্দরে দেড় মাস অবধি শিশু খাদ্য এসে পড়ে রয়েছে, প্রশাসনিক অব্যবস্থার দরূণ তা আজও ছাড়ানো হয় নি। একদিন যখন ঐ শিশুখাদ্য বাজারে এসে পৌছুবে তখন অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণেই তার মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে কৃত্রিম সঙ্কটের সৃষ্টি হবে। বন্দরে কোন মাল যখন গুদামে পড়ে থাকে তখন গুদামভাড়া বইতে হয়। সে কারণে উল্লেখিত শিশুখাদ্যেরও গুদামভাড়া দিয়ে একদিন ছাড়িয়ে আনতে হবে। যদি কর্তৃপক্ষ সাবসিডি না দেন তাহলে ঐ ক্ষতি মূল্য বাড়িয়ে পুষিয়ে নিতে হবে তাকে। এমনিভাবে শুধু শিশুখাদ্য নয় বহুপ্রকার আমদানীকৃত দ্রব্যেরই অন্যায় মাশূল বইতে হয় কর্তৃপক্ষকে। এতে করে যেমন জিনিষের দাম বেড়ে কৃত্রিম সঙ্কটের সৃষ্টি হয় তেমনি কর্তৃপক্ষকেও বইতে হয় এক বিরাট পরিমাণ অর্থিক ক্ষতি।
উদ্ধৃত খবরের পরিপ্রেক্ষিতে যদি কর্তৃপক্ষের প্রশাসনিক অব্যবস্থা অথবা গাফলতির দরুনই অযথা দেড় মাস শিশুখাদ্য বন্দরে এসে পড়ে থেকে থাকে তাহলে তার মূল রহস্য উদঘাটন অবশ্যই প্রয়োজন। দেশের মানুষের অত্যন্ত আবশ্যকীয়। জিনিসের বেলায় এ ধরনের গাফলতি যদি ক্রমাগত কর্তৃপক্ষ সহ্য করে চলেন তাহলে মানুষের ক্ষোভের জবাব একদিন তাদেরকে দিতেই হবে। টি, সি, বি, বা ভোগ্যপণ্য সংস্থার এধরনের দায়িত্বহীনতার উদাহরণ নিঃসন্দেহে এটাই প্রথম নয়। কর্তৃপক্ষ এ দুটি সংস্থার এবং তার নিজের ভালোর জন্যেই চট্টগ্রাম বন্দরে শিশুখাদ্য পড়ে থাকার মূল কারণ উদঘাটন করে দোষী ব্যক্তিদের উদাহরণমূলক শাস্তি প্রদান করবেন—এটাই আমরা আশা করি।

বীজ উত্পাদন খামার প্রসঙ্গে

বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি-তার উপর রয়েছে পোকা-মাকড়ের উপদ্রব। সামগ্রিক এই পরিস্থিতির মধ্যে গ্রামবাংলার কৃষককে প্রতি বছর ফসল উৎপাদনের গুরুদায়িত্ব মাথায় নিয়ে মাঠে নামতে হয়। নির্বিঘ্নে তারা কোনদিনই মাঠের ফসল ঘরে তুলতে পারে না এবং তার খেসারত দিতে হয় সরকার তথা গোটা দেশবাসীকে। তবুও এই প্রাত্যহিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে সামনে রেখে আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হয় এবং সম্ভাব্য বিপদকে মোকাবেলা করার জন্য সব রকমের ব্যবস্থাদি যথাসম্ভব প্রস্তুত রাখতে হয়। যাতে করে সার, বীজ, পাওয়ার পাম্প এগুলোর পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করা যেতে পারে অত্যন্ত প্রয়োজনের মুহর্তে। সাম্প্রতিক বন্যা তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। সবুজ কচিধানের গাছগুলো বানের পানিতে ভেসে গেলে সেই জমিতে নতুন করে ধান লাগানোর জন্য প্রায় ছাপ্পান্ন হাজার মণ বীজধানের প্রয়োজন পড়ে। অথচ সরকারের তরফ থেকে সংগৃহীত হয় মাত্র সাইত্রিশ হাজার মণ এবং বাদবাকী উনিশ হাজার মণ বীজধানের জন্য বিদেশী সাহায্যের উপর নির্ভর করতে হয়। সাহায্যের জন্য বিদেশের কাছে আবেদন জানানো, আবেদনে সাড়া পেলে তা দেশে আসার জন্য প্রয়োজনীয় সময় ব্যয় এবং চাষীদের মধ্যে সে বীজ বিতরণে যে সময় লাগার কথা, তাতে করে এ বছর ঐ উনিশ হাজার মণ বীজ ধান কোন কাজে লাগার কথা নয় এবং নয় বলেই আশংকা করছি এ বছর প্রায় এক লক্ষ একর জমি অনাবাদী থাকার সমূহ সম্ভাবনা।
এই সংকট আংশিকভাবে হলেও মোকাবেলা করা যেত, যদি আমাদের কাছে প্রয়োজনীয় বীজধান থাকত। একথা সমভাবে প্রযোজ্য পাট ও গম বীজের ক্ষেত্রেও। পত্রিকায় খবর বেরিয়েছেঃ বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ পাট বীজ উৎপাদন কেন্দ্র দিনাজপুরের নশিপুর পাটবীজ খামারটি বর্তমানে বহুমুখী সমস্যায় জর্জরিত। মূল খামারটি প্রায় আড়াই হাজার বিঘার জমির উপর প্রতিষ্ঠিত। এই আড়াই হাজার বিঘা জমিতে সবেধন নীলমনি একটি ট্রাক্টরই সচল রয়েছে এবং বাদবাকী ট্রাক্টরগুলো খুচরা যন্ত্রাংশের অভাবে দীর্ঘদিন যাবং অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। চৌদ্দ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত খামারটিতে কোন বাউণ্ডারী নেই এবং এর তিন শ’ বিঘা জমি অন্যে জবর দখল করে রেখেছে। এ ছাড়া খামারের গুদামে কয়েক শত মণ উন্নতমানের পাটবীজ দীর্ঘদিন যাবৎ পড়ে থাকার পর এখন তা বিনষ্ট হওয়ার পথে।
বাংলাদেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী ফসল পাট এবং এই পাট সম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালান হচ্ছে। বীজ উৎপাদন খামার নির্মাণের উদ্দেশ্যও ঐ একই। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে উন্নতমানের বীজ তৈরী এবং তা সময় মত চাষীদের মধ্যে বিতরণের উদ্দেশ্যেই খামারগুলো স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু আড়াই হাজার বিঘা জমিতে মাত্র একটি ট্রাক্টর চালু থাকা, যার কোন বাউণ্ডারী লাইন নেই, মূল জমি অন্যের জবর দখলে এবং শত শত মণ পাটবীজ নষ্ট হওয়া এসব কিসের ঈঙ্গিত বহন করে? প্রকাশিত খবর যদি সত্য হয়, সংশ্লিষ্ট দফতরের কাছে আমাদের জিজ্ঞাসা—এই যথেচ্ছাচার, নৈরাজ্য আর অরাজকতা আপনারা চলতে দিচ্ছেন কিভাবে ? শত শত মণ পাটবীজ বিনষ্ট হতে চলেছে, আর তা সময় মত চাষীদের হাতে পৌঁছাবেনা, প্রয়োজনের মুহর্তে বীজ ক্রয়ের নামে মুল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়—এসব যদি চলতে থাকে তা হলে বীজ উৎপাদন খামারগুলোর প্রয়োজন কেন এবং লক্ষ লক্ষ টাকা তার পেছনে খরচ করার কি অর্থ আছে ?
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের অধীনে সারা দেশে মোট একুশটি বীজ উৎপাদন খামার রয়েছে এবং এই খামারগুলোর জমির পরিমাণ হল প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার একর। খামারগুলোর সম্প্রসারণ এবং উন্নয়নে সুষ্ঠু, ও কার্যকরী পরিকল্পনার মাধ্যমে একদিকে দেশের উন্নত বীজের চাহিদা পূরণ, অপর দিকে সম্ভাব্য সংকট মোকাবেলার নিশ্চয়তা পাওয়া যেতে পারে। কর্তৃপক্ষ আশা করি এদিকে সজাগ দৃষ্টি দেবেন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!