You dont have javascript enabled! Please enable it!

বঙ্গবন্ধুর উত্তরাঞ্চল সফর | গোয়েন্দা নথিতে বঙ্গবন্ধু, 1952

২৩ আগস্ট ১৯৫২ তারিখের পাকিস্তানী গোয়েন্দা রিপোর্টে জানা যায় ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান, আতাউর রহমান, এডভোকেট কাম্রুজ্জামান ও বাদশা মিয়া সকাল ৭ টা ১৫ মিনিটে ট্রেনে করে ঢাকা থেকে রংপুরে পৌঁছান। ১৬ আগস্ট রাত ২ টার সময় শাহ আব্দুল বারী, মাসুদুল হক, হাবিবুর রহমান চৌধুরী, ফজলুর রহমান সহ আরও অনেকে তাদের রিসিভ করেন। রাতে তারা ডাক বাংলোতে থাকেন। ঐদিন পাবলিক লাইব্রেরী কম্পাউন্ডে আতাউর রহমানের সভাপতিত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রায় দুই হাজার লোক উপস্থিত ছিলো।

শেখ মুজিব বলেন, “বক্তব্যের শুরুতে আমি মৌলভি খয়রাত হোসেনের নাম স্বশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি। তিনি এখন কারাগারে বন্দী। মোতিয়ার রহমান, সোবহান এবং মওলানা ভাসানীও কারাগারে আছেন। আমি তথাকথিত Public Safety Act বাতিলের দাবী জানাই। প্রায় পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী জেলে বন্দী। আমি নিজেও আড়াই বছর কারাগারে থেকে কিছুদিন আগে মুক্ত হলাম। আমাদের অপরাধ কেন আমরা সরকারের কাছে সাধারণ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা আর পরনে পোশাক দেবার দাবী করলাম। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগাররা পাকিস্তানকে দোজখে পরিণত করছেন। আমাদের পাট বোর্ড করেছেন জনাব ফারুক আর ইস্পাহানী। তারা কেউই সাধারণ জনগণের থেকে উঠে আসেন নাই। সাধারণ কৃষকের স্বার্থ তারা না দেখে নিজেদের ব্যাংক ব্যালেন্স ভারী করছেন। আমাদের দেশের পাটশিল্প অনেক শক্তিশালী। কিন্তু সেটা ধীরে ধীরে হারাতে বসেছি। মুসলিম লীগারদের এর জবাব দিতে হবে। আমেরিকা আর ব্রিটেনে যদি আমাদের পাটের বাজার না থাকে তাহলে কেন তারা অন্য দেশে চেষ্টা করছেন না? কারণ হচ্ছে তারা আমেরিকা আর ব্রিটেনকে খুশী রাখতে চান। যদি পাটের ন্যায্য দাম আমরা না পাই তাহলে তার জন্য সবাইকেই দায়ী হতে হবে। আমাদের দাবী পাটের দাম মণ প্রতি ৩০ টাকা দিতে হবে। কিন্তু কৃষক পাচ্ছে মাত্র ১৬ টাকা মণ। সরকারের কাছে অনুরোধ করব, আপনারা এসে দেখে যান কেন কৃষকেরা ১৬ টাকা মণ পাট বিক্রি করছে।

তামাকশিল্পের ব্যাপারেও সরকার উদাসীন। শিক্ষাখাত ধ্বংস হয়ে গেছে। দুই মাসের মধ্যে দেশে দুর্ভিক্ষ শুরু হবে। এর পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। গরিব মানুষের কাছে খাদ্য পৌঁছায় না, চিকিৎসা সেবা নাই। অথচ তাদের দেয়া ট্যাক্সের টাকায় ৭৫ লাখ টাকা খরচ করে হোটেল নির্মান করা হয়। ৭ লাখ টাকা ব্যয়ে মন্ত্রীদের সন্তানদের পড়ার জন্য একটি গার্লস স্কুল খোলা হচ্ছে। এসব যখন আমরা বলতে যাই, তখন বলা হয় আমরা নাকি দেশের শত্রু।

মওলানা ভাসানীর মত নিস্বার্থ ব্যক্তিরা আর জেলে বন্দী। বিনা বিচারে অসংখ্য নেতাকর্মী জেলে।

পাকিস্তান জিন্দাবাদ। আওয়ামী লীগ জিন্দাবাদ। জালিম সরকার ধ্বংস হোক।

রাত সোয়া ৮ টার দিকে মিটিং শেষ হয়। এরপর তাঁরা ডাকবাংলোতে ফিরে আসেন।

পরেরদিন সকাল সাড়ে আটটায় ট্রেনে রংপুর থেকে দিনাজপুরে রওনা দেন। সাথে ছিলেন রংপুরের সেক্রেটারি আবুল হোসেন এ এম এল, এবং হাবিবুর রহমান চৌধুরী এ এম এল।

বিকেল ৫ টা ৫০ মিনিটে দিনাজপুর ইন্সটিটিউটে আতাউর রহমানের সভাপতিত্বে মিটিং শুরু হয়। প্রায় ৫০০ লোক সেখানে উপস্থিত ছিলো। রাত ৯ টার দিকে মিটিং শেষ করে তাঁরা তাজ হোটেলে আসেন এবং রাত ১০টায় বগুড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেন।

১৮ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টায় তারা বগুড়া পৌঁছান। সেখানে তারা মডার্ণ হাউসে থাকেন। এটি ঠিক করে দিয়েছিলেন আলিমুদ্দিন মুক্তার। বিকেল সোয়া চারটার দিকে এডওয়ার্ড পার্কে মিটিং শুরু হয়। এখানে প্রায় ৫০০০ লোকের সমাগম হয়। এখানে তিনি Public Safety Act এর সমালোচনা করেন এবং জনগণের খাদ্য সমস্যা তুলে ধরেন। তিনি বলেন যে, লিয়াকত আলীকে জানানো সত্বেও তিনি খাদ্য সমস্যার দিকে নজর দিচ্ছেননা। বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার আবেদন করে আসলেও তা চালু করা হচ্ছেনা। শিক্ষকের অভাবে মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। Public Safety Act এর কারণে স্বনামধন্য প্রফেসররা আটক হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পড়াশোনা বন্ধ হবার জোগাড়। গরীবের মাথায় ট্যাক্সের বোঝা চাপানো হচ্ছে, আর ধনির সন্তানেরা সেই টাকায় পড়াশোনা করছে। মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সন্তানদের জন্য ৭ লাখ টাকা ব্যয়ে বিশেষ বিদ্যালয় চালু করা হয়েছে। সরকার কৃষকের জন্য পাটের দাম মণ প্রতি ১৬ টাকা নির্ধারন করে দিলেও মধ্যস্বত্বভোগী বড় বড় ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে মূল্য নির্ধারন করে দেয়নি। ফলে তারা বিদেশের কাছে উচ্চ মূল্য চাচ্ছে, যার ফলে বিদেশি ক্রেতা রাষ্ট্রগুলো পাট কেনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে এবং পাটের বিকল্প কিছুর দিকে ঝুঁকছে। সরকারের উচিৎ পাট কেনা। সরকার যদি এগুলো না করতে পারেন, তাহলে গদি ছেড়ে দেয়া উচিৎ। এছাড়া পাটের কৃষকদের বাঁচানো যাবেনা। সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। নাজিমুদ্দিন, নুরুল আমিন আমাদের শত্রু নন, বরং তাদের নীতিমালার বিরুদ্ধে আমাদের সকলকে একযোগে রুখে দাঁড়াতে হবে। এই মিটিং সন্ধ্যা পৌনে ৭ টায় শেষ হয়।

রাত ৯ টা থেকে ১১টা পর্যন্ত আরও একটি মিটিং হয়। ১৯ আগস্ট সকালের ট্রেনে তারা সবাই রাজশাহী হয়ে ২০ তারিখে সকাল সাড়ে ৮ টায় পাবনায় পৌঁছেন। সেখানে টাউন হলে বিকাল ৫ তা ৪০ মিনিটে মিটিং হয় এবং প্রায় দুই হাজার লোক সমাগম হয়। [1, pp. 318–329]

Reference:

[1]      S. Hasina, Secret Documents of Intelligence Branch on Father of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, Vol II 1951-1952, vol. II. Hakkany Publisher’s, 2018.

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!