You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.14 | আন্দোলনের ত্রয়োদশ দিবস - সংগ্রামের নোটবুক

১৪ মার্চ ১৯৭১ঃ আজকের এদিনে

আন্দোলনের ত্রয়োদশ দিবস

জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগদানের প্রশ্নে শেখ মুজিবের ৪-দফা পূর্বশর্ত মেনে নেয়ার দাবিতে রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্র-শ্রমিক-পেশাজীবী সংগঠন এবং যুব মহিলা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে সভা-সমাবেশ শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।
বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে সংবাদপত্র প্রেস কর্মচারী ফেডারেশনের উদ্যোগে সকালে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে সমাবেশ শেষে মিছিলসহ শেখ মুজিবের বাসভবনে গিয়ে তাঁর হাতে একটি আবেদনপত্র দেয়া হয়। তাতে নেতারা যে কোন নির্দেশ পালনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে অবিলম্বে একটি জাতীয় সরকার গঠন ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণার জন্য শেখ মুজিবের প্রতি অনুরোধ জানান। এখানে তাদের উদ্দেশে তোফায়েল আহমেদও বক্তৃতা দেন।
খুলনায় স্বাধীন ও মুক্ত বাংলাদেশের দাবীতে মহিলাদের বিশাল মিছিল শহর প্রদক্ষিন করে।
১১৫নং সামরিক নির্দেশের প্রতিবাদে দেশরক্ষা বিভাগের বেসামরিক কর্মচারীরা নগরীতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। পরে তাঁরা বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাসভবনে গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করে বর্তমান আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন।
স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দেশ থেকে সম্পদ পাচার প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট স্থাপন করে।
টেলিভিশন নাট্য শিল্পীদের এক্সভায় আব্দুল মজিদের সভাপতিত্তে ডিআইটি ভবনে এক সভা অনুষ্ঠিত হয় ফরিদ আলীকে আহবায়ক করে টেলিভিশন নাট্য শিল্পী পরিষদ নেমে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়। সংগঠনের অন্যান্য সদস্যরা হলেন হাসান ইমাম, শওকত আকবর, আনোয়ার, আলেয়া ফেরদৌসি, আলতাফ হোসেন, সাদাত হাসমি, কাজী মাকসুদুল হক, রওশন জামিল। সভাস্বাধিকার আন্দোলনের প্রতি তাদের সমর্থন প্রকাশ করেন। গন আন্দোলন পরিপন্থী কোন অনুষ্ঠানে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পাকিস্তান সরকারের দেয়া হেলাল ই ইমতিয়াজ তমঘা খেতাব বর্জন করেন।
চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক এম এ হান্নান আগামীকাল চট্টগ্রাম থেকে যে জাহাজ করাচী যাচ্ছে তা তল্লাসি করার জন্য দলীয় কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন। এ ছাড়াও তিনি রেল দপ্তরকে সেনাবাহিনীর জন্য আলাদা ওয়াগন সরবরাহ না করার আহবান জানিয়েছেন।
চট্টগ্রাম বন্দরে অস্রবাহী জাহাজের মালামাল খালাসে বন্দর শ্রমিকদের অস্বীকৃতি।

আন্দোলন প্রশ্নে তাজ উদ্দিন আহমেদ

আন্দোলনের দুই সপ্তাহ অতিক্রম শেষে তাজউদ্দীন আবারো ঘোষণা করেন পূর্বের ন্যায় আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। তিনি শেখ মুজিবের ৩৫ দফা নির্দেশনা জারীর কথা সকলকে স্মরন করিয়ে দেন। এ নির্দেশাবলী ১৫ মার্চ থেকে কার্যকর হবে এবং আগের সকল নির্দেশাবলী বাতিল গণ্য হবে।

খাদ্যবাহী জাহাজ প্রসঙ্গে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী

প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী দলের নেতা ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এক বিবৃতিতে ১১ মার্চ খাদ্যবাহী জাহাজ ‘ভিন্তেজ হরাইজন’ এর গতিপথ চট্টগ্রাম বন্দরের পরিবর্তে করাচী বন্দরে পরিবর্তনের ঘটনা সম্পর্কে অবিলম্বে তদন্ত অনুষ্ঠানের দাবি জানান। জাহাজটি ৩২০০০ টন খাদ্য নিয়ে চট্টগ্রাম আসছিলো।
বাংলাদেশের জন্য ৪৮০০০ টন খাদ্যশস্যবাহী ‘মন্টেসেলো ভিক্টরি’ নামের আর একটি জাহাজের গতিপথ পরিবর্তন করে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে করাচী নিয়ে যাওয়া হয়। জাহাজটি ৬ মার্চ চট্টগ্রাম পৌছার কথা ছিল। মোট ২ লাখ টন খাদ্য শস্য এই কয়দিনে বাংলাদেশে আসার কথা কিন্তু তা সরিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির পায়তারা করা হচ্ছে।

ছাত্র ইউনিয়ন

পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন বায়তুল মোকাররমে দলের সভাপতি নুরুল ইসলাম নাহিদের সভাপতিত্তে এক জনসভার আয়োজন করে। সভায় আরও বক্তব্য রাখেন দলের সাধারন সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং রোকেয়া হল ভিপি আয়েশা খানম। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম তার বক্তব্বে বলেন বিগত ২৩ বছরের বাংলার গন অধিকার বানচালের চক্রান্তকে পর্যালোচনা করে বলেন যে বারবার বাংলার গন অধিকারকে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র করে বানচাল করলেও এবারে জনগনের স্বাধিকারের আকাঙ্ক্ষাকে কোন শক্তি স্তব্দ করতে পারবে না। বর্তমান গন সংগ্রামের পটভূমিতে পঁচিশে মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কতৃক আহুত জাতীয় পরিষদে অংশগ্রহণের প্রশ্ন বিবেচনার পূর্ব শর্ত হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান প্রদত্ত ৪ দফার প্রতি তার দলের সমর্থন বেক্ত করেন। তিনি বলেন শুধু মাত্র ছাত্রসমাজ ও রাজনৈতিক নেতাদের বিবৃতিতে স্বাধিকার অর্জন করা সম্ভব নয়। এই প্রসঙ্গে তিনি বাংলার সাত কোটি বাঙ্গালীকে লড়াই করার জন্য সৈনিক রূপে প্রস্তুত হওয়ার আহবান জানান। আয়েশা খানম তার বক্তৃতায় আপোষ ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষে পৌঁছানোর জন্য ঘরে ঘরে দুর্গ ও গণবাহিনী গঠন করার আহবান জানান। সভা শেষে একটি মিছিল শহর প্রদক্ষিন করে বাহাদুর শাহ পার্কে গিয়ে শেষ হয়।

বরিশালে আতাউর রহমান খান

স্থানীয় হেমায়েত উদ্দিন খেলার মাঠে জাতীয় লীগ আয়োজিত এক জনসভায় দলের প্রধান আতাউর রহমান খান শেখ মুজিবুর রহমান কে অস্থায়ী সরকার গঠনের আহবান জানিয়েছেন। এ কাজে পূর্ব পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগকে সমর্থন করবে। তিনি জনসাধারণকে যে কোন ধরনের সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত থাকার আহবান জানান। তিনি সংগ্রামের জন্য সকল দল সমন্বয়ে গ্রামে গ্রামে সংগ্রাম কমিটি গঠনের আহবান জানান। তিনি ইয়াহিয়া খানকে দেশে আর রক্তপাত না ঘটিয়ে অবিলম্বে শান্তিপূর্ণ ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানিয়েছেন। সভায় দলের সাধারন সম্পাদক শাহ আজিজুর রহমান, ইকবাল আনসারী , আলতাফ হোসেন বক্তব্য রাখেন।

সমরাস্ত্রবাহী জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর

৩৬২১ কন্টেইনার / কার্টুন অস্র ও গোলাবারুদ নিয়ে পাকিস্তান শিপিং কর্পোরেশনের ‘ওসান এন্ডুরেন্স’ নামের সমরাস্ত্রবাহী একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের ১০নং জেটিতে নোঙর করে। ১৬নং জেটিতে ১৮০ টন সমরাস্ত্রবাহী অপর পাকিস্তান শিপিং কর্পোরেশনের পণ্যবাহী জাহাজ দু তিনদিন আগে বন্দরে ভিড়িলেও ‘সোয়াত’-এর সমরাস্ত্র বন্দর শ্রমিকদের অসহযোগিতার কারণে খালাসের চেষ্টা করে কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়।

অন্যান্য

নৌবাহিনীর সাবেক লেঃ কম্যান্ডার ইমাম হোসেন বলেছেন পূর্ব পাকিস্তানে অবাঙ্গালী সৈন্য প্রত্যাহার করে তদস্থলে বাঙ্গালী সৈন্য মতায়েন করলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে পারে। তিনি বলেন যদি পর্যাপ্ত সৈন্য না পাওয়া যায় ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত অবসরে যাওয়া সৈন্যদের ফিরিয়ে এনে তা পূর্ণ করা যেতে পারে।
ভারত বলেছে পাকিস্তান ভারতের সাথে সরাসরি আলোচনা না করা পর্যন্ত এবং ভারতের দাবী পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ভারত তার আকাশ সীমার উপর দিয়ে পাকিস্তানী বিমান চলাচলের নিষেধাজ্ঞা বিবেচনা করবে না। ভারতীয় মুখপাত্র ভারত পাকিস্তান এ বিষয়ে একটি গোপন সমঝোতায় উপনীত হয়েছেন পাকিস্তানের গণমাধ্যমে যে প্রচারনা চলছে তা তিনি অস্বীকার করেন।
চট্টগ্রাম থেকে সমুদ্রপথে করাচী গামী যাত্রীদের আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকরা তল্লাসি করছে। সম্পদ পাচার রোধে এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
পাকিস্তানের বস্র মিল মালিকগন আজ সরকারের কাছে এক স্মারকলিপিতে শেখ মুজিবের চার দফা দাবী মেনে নেয়ার আহবান জানিয়েছেন। মিল মালিকরা বলেন তাদের অনেকেই পূর্ব পাকিস্তানে বিনিয়োগ করেছেন এখন শেখ মুজিবের নির্দেশের ফলে সেখানকার সম্পূর্ণ অর্থ আটকা পড়েছে এবং মিল গুলো যে কোন সময়ে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তা ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের বস্রের মুল ক্রেতা হল পূর্ব পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তান বছরে ৪০ কোটি টাকার বস্র পূর্ব পাকিস্তানে রপ্তানি করে। তারা বলেন দু অংশের মধ্যে অবাধ বাণিজ্য চালু না করলে ভবিষ্যতে তারা জাপান থেকে কাপর ক্রয় করবে। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের বস্র কল গুলো বন্ধ হয়েযেতে পারে।
পূর্ব পাকিস্তানে রপ্তানির জন্য যে সকল ফল সরবরাহের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল তা পচে যাচ্ছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে পানের সের ১৫০ টাকা উঠেছে।