You dont have javascript enabled! Please enable it!

৯ মার্চ ১৯৭১ঃ আজকের এদিনে

আন্দোলনের ৮ম দিন

আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘোষিত আন্দোলনের কর্মসূচি অনুযায়ী সচিবালয়-সহ সারাদেশে সকল সরকারি ও আধাসরকারী অফিস, হাইকোর্ট ও জেলা কোর্ট প্রভৃতিতে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। হরতালে এখন শীর্ষ কর্মকর্তারাও অফিসে যাচ্ছেন না। সম্প্রতি পদায়নকৃত পশ্চিম পাকিস্তানী তথ্যসচিব ক্যান্টনমেন্ট অবস্থান করছেন। শেখ মুজিবের সর্বশেষ নির্দেশাবলী অনুযায়ী যেসব সরকারি অফিস খুলে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন কেবল সে সব অফিস চালু থাকে।
আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, স্থানীয় সংগ্রাম পরিষদ আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশকে সহযোগিতা দিচ্ছে।
রাজশাহীতে ৯ ঘণ্টা করে কারফিউ অব্যাহত রয়েছে। রাজশাহীর বে সামরিক প্রশাসন জানিয়েছে এ কয়দিনে রাজশাহীতে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি এবং পরবর্তীতে যাতে না ঘটে সে জন্য কারফিউ তুলে নেয়া হচ্ছে না।
আজকের দিনের বৈশিষ্ট্য হল মহল্লায় মহল্লায় সংগ্রাম পরিষদ গঠন হচ্ছে। তারাই কালো পতাকা উড়াচ্ছে মিছিল মিটিং করছে।
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি স্বাধিকার আন্দোলনে শহীদদের জন্য সমবেদনা প্রকাশ করেছে এবং তাদের সাহায্যের জন্য এক দিনের বেতন দান করেছে।
আজ থেকে আওয়ামী লীগ সাহায্য তহবিলে চাদা গ্রহনের বিবরন পত্রিকায় প্রকাশ হচ্ছে।
অল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সাধারন সম্পাদক এএইচএম কামারুজ্জামান এক বিবৃতিতে রাজশাহী শহরে সান্ধ্য আইন জারীর তীব্র নিন্দা করেছেন। তিনি বলেন সেনাবাহিনীকে ছাউনিতে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে বলে ঘোষণার পর রাজশাহীতে হঠাৎ সান্ধ্য আইন জারির কারণ বোধগম্য নয়। এই সান্ধ্য আইন জারি জনসাধারণের জন্য উস্কানি ছাড়া আর কিছু নয়। বিবৃতিতে অবিলম্বে কারফিউ প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়। তিনি আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পুলিশের হাতে ছেড়ে দেয়ার আহবান জানান। তিনি বলেন আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকরা আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালনে পুলিশকে সহায়তা করবে।

ছাত্রলীগ এবং ডাকসু

সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ক্যান্টিনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সংগঠনের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় গৃহীত রাজনৈতিক প্রস্তাবে ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগ ও ডাকসুর নেতৃত্বে গঠিত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ’ এর ছাত্রসভায় গৃহীত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ ঘোষনার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। সভায় আন্দোলনে সকল শহীদানের জন্য গভীর শোক প্রকাশ ও তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করা হয়। শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানানো হয়। সভায় জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রদেশে স্বাধীন জাতীয় সরকার গঠন করার আহ্বান জানানো হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ৪ নেতাকে দায়িত্ব অর্পণ পূর্বক স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উপর অর্পণ করা হয়। সারা দেশে ৯-১১ সদস্য বিশিষ্ট স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করার জন্য বলা হয়। আগামী কাউন্সিলের আগ পর্যন্ত ছাত্রলীগের নামের সাথে পূর্ব পাকিস্তান নাম বর্জন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সভায় জরুরী কাউন্সিল করে ছাত্রলীগের এই কমিটির মেয়াদ বর্ধিত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগ হাসপাতালের ৪ নং ওয়ার্ডের কাছে একটি সেবা শিবির স্থাপন করেছে। এখানে আহত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের সম্ভাব্য সকল প্রকার সহায়তা দেয়া হচ্ছে। সাহায্যকারী জনগণকে দলের সভাপতি অথবা সাধারন সম্পাদক অথবা প্রধান ব্যাবস্থাপক মতিউর রহমানের সাথে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।ঢাকা শহরের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট প্রধানদের এক সভা সংগঠনের সভাপতি আব্দুর রাজ্জাকের সভাপতিত্তে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আব্দুর রাজ্জাক এমপিএ তাদের পরবর্তী করনীয় নির্দেশনা দেন।

জাহাজ শ্রমিক ইউনিয়ন

পূর্ব পাকিস্তান জাহাজ শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে নারায়নগঞ্জ থেকে সোনাকান্দা ঘাট এবং আদমজী জুট মিল পর্যন্ত নদীপথে ছোট বড় ১০ টি জাহাজের শ্রমিকেরা এক বিরাট মিছিল বের করে। জাহাজের মিছিলে অংশগ্রহন কারীদের হাতে লাঠি ছিল। স্লোগানে তারা নদীর দুই কুল কাপিয়ে তোলে। এ সময়ে নদীর ধারে ব্যাপক জনসমাগম হয়। তীরের জনগণও স্লোগান দেয় এবং হাত তুলে অভিবাদন জানায়। সকাল ১১ টা থেকে দুপুর ১ টা পর্যন্ত এই মিছিল চলে। নেতৃত্ব দেয় এরাবিয়ান নামে এক জাহাজ। পূর্ব বাংলায় এধরনের মিছিল এই প্রথম। জাহাজে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য আফজাক হোসেন উপস্থিত ছিলেন। মিছিল শেষে নারায়ন গঞ্জ টার্মিনাল ঘাটে এক জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সভায় এমপিএ আফজাল ছাড়াও বক্তব্য দেন আলি আহাদ, ঢাকা জেলা ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক আব্দুস সাত্তার, সিরাজুল ইসলাম।

মওলানা ভাসানী

মওলানা ভাসানী আজকের সমাবেশে বক্তব্য প্রদানের পর আকস্মিক ভাবে গভীর রাতে ঢাকা ত্যাগ করেছেন। আজ তিনি টাঙ্গাইলে এক সমাবেশে ভাষণ দিবেন। পরদিন ময়মনসিংহে, তার পরদিন ভৈরবে, ১৬ মার্চ গফরগাও জনসভায় বক্তব্য দিবেন। আজকের সমাবেশে তিনি বলেন ইয়াহিয়া যদি আপোষে বাংলার স্বাধীনতা মেনে না নেন তবে তিনি ২৫ মার্চ এর পর থেকে স্বাধীনতার জন্য মুজিবের সহিত একযোগে আন্দোলন শুরু করবেন। তিনি জনগণকে শেখ মুজিবের উপর আস্থা রাখতে বলেন। তিনি বলেন শেখ মুজিব জনগনের সাথে কোনদিন বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন না। তিনি বলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে বাংলার নায়ক হওয়া অনেক গৌরবের। তিনি বলেন তোমরা আমাকে যেই উপাধি দেও না কেন আপোষ করলে আমার আস্ত রান আর থাকবে না শেখ মুজিব আপোষ করলেও বঙ্গবন্ধু আর থাকবে না জনগন তাকে ক্ষমা করবে না। সকালে মুজিব ভাসানি দীর্ঘ টেলিফোন আলাপ হয়েছে। এই সভায় জাতীয় লীগের আতাউর রহমান একটি জাতীয় সরকার গঠন করার জন্য শেখ মুজিবের প্রতি আহবান জানান। তিনি বলেন এখন বাঙ্গালীর মাত্র একটি দাবী তারা চায় মুক্তির স্বাদ।

ওয়ালী খান

লন্ডনে চোখের চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে ওয়ালী খান বলেছেন তিনি শীঘ্রই শেখ মুজিবের সাথে দেখা করতে ঢাকা আসছেন।
ওয়ালী ন্যাপ এর প্রাদেশিক সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ এক বিবৃতিতে সরকারের প্রেস নোট জারীর তীব্র নিন্দা করে বলেন এটি তথ্যগত ভুল, একপেশে, এবং সেনাবাহিনীর গণহত্যার তথ্য চেপে যাওয়া হয়েছে। তিনি বলেন রক্ত চক্ষু ও বেয়নেটের মুখে জনগনের উপর আর কিছু চাপিয়ে দেয়া যাবে না। সর্বপ্রকার নিষ্পেষণ এবং শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলার মানুষের স্বাধিকার আন্দোলনকে আর দমিয়ে রাখা যবে না।

গোলাম আজম

পূর্ব পাকিস্তান জামাতে ইসলামী সভাপতি অধ্যাপক গোলাম আজম এক বিবৃতিতে প্রদেশের সাম্প্রতিক গোলযোগের জন্য জনাব ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টোকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন ইয়াহিয়া খান আবার নতুন করে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকায় নতুন প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। প্রশ্ন গুলো হচ্ছে অধিবেশন স্থগিত রাখার কারন গুলো কি দূর হয়েছে? যদি না হয়ে থাকে তাহলে অধিবেশন ডাকার যৌক্তিকতা কি? তিনি বলেন ভুট্টোর অধিবেশন স্থগিত করা না হলে খাইবার থেকে করাচী পর্যন্ত আন্দোলনের হুমকি, ৩ মার্চের অধিবেশন যোগদান না করার ব্যাপারে বার বার অস্বীকৃতি জানিয়ে রাজনীতির পরিবেশ বিষাক্ত করে তুললেও প্রেসিডেন্ট তার কাজে কোন দোষ খুজে পাননি। তিনি ভুট্টোর প্রতি প্রশ্ন তুলেন মুজিবের সাথে সমঝোতা ছাড়াই তিনি কি করে ২৫ মার্চের অধিবেশনে যোগ দিতে রাজি হলেন। তিনি যদি এখন কোন শর্ত ছাড়াই যোগ দিতে পারেন তবে অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছিলেন কেন? ভুট্টো এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারবেন না। পূর্ব পাকিস্তানের যে জানমালের ক্ষতি হয়েছে এর জন্য তারা দুজনেই দায়ী।
গোলাম আজম এক বিবৃতিতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দেশকে রক্ষার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি আহবান জানান। তিনি অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবী জানান।

মাহমুদ আলী

পিডিপি ভাইস প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আলী শেখ মুজিবের সাথে আলোচনা করে অবিলম্বে জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহবান জানিয়েছেন।

খেলাফতে রাব্বানি পার্টি

খেলাফতে রাব্বানি পার্টি সভাপতি এএসএম মোফাখখার এক বিবৃতিতে শেখ মুজিবের ৪ দফা দাবী মেনে নেয়ার জন্য ইয়াহিয়া খানের প্রতি আহবান জানান।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!