৭ মার্চ ১৯৭১ঃ রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ ও নির্দেশাবলী
বেলা সোয়া তিনটায় রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমান সভাস্থলে এসে উপস্থিত হন। প্রথমে কোরআন তেলওয়াত পাঠ করেন মওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ এবং এর পর আন্দোলনে শহীদদের স্মরনে মোনাজাত করা হয়। সভায় একমাত্র বক্তা ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। মঞ্চে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রস্তাবিত পতাকা উড়িয়ে ২২ মিনিটের ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি বলেন শত্রুর হামলা মোকাবেলার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহনের আহবান জানান। তিনি বলেন শত শহীদের রক্তের উপর দিয়ে পরিষদে যোগদান করা যায়না। তিনি পরিষদে যোগ দেয়ার ৪ টি পূর্ব শর্ত আরোপ করেন, শর্ত গুলি হল সামরিক আইন প্রত্যাহার, সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া, গণহত্যার তদন্ত বিচার এবং জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। তিনি বলেন বাংলার মানুষ যখন ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করে তখনই তারা আমাদের বুকে গুলী বর্ষণ করে। তিনি বলেন অসহযোগ আন্দোলন চলবে। ভাষণের মাঝামাঝি পর্যায়ে তিনি ঘোষণা করেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। বক্তৃতায় তিনি প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহবান জানান। বক্তৃতাকালে জনতার কন্ঠে উচ্চারিত হচ্ছিল শ্লোগান, জাগো জাগো—বাঙালি জাগো, পাঞ্জাব না বাংলা—বাংলা বাংলা, তোমার আমার ঠিকানা –পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার নেতা আমার নেতা—শেখ মুজিব, শেখ মুজিব, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো—বাংলাদেশ স্বাধীন করো।
আজ থেকে আমার নির্দেশ:
(১) বাংলার মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত ট্যাক্স খাজনা বন্ধ রাখুন, (২) সমগ্র বাংলাদেশের সেক্রেটারিয়েট-সরকারী-আধাসরকারী অফিস, সুপ্রীমকোর্ট, হাইকোর্ট এবং অন্যান্য কোর্টে হরতাল করুন। (কোথাও শিথিল করা হইলে জানানো হইবে) (৩) রিক্সা, বেবী, বাস-ট্যাক্সী প্রভৃতি এবং রেলগাড়ী ও বন্দরসমূহ চালু রাখুন; কিন্তু জনগণের উপর জুলুম চালাইবার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র বাহিনীর চলাচলের সঙ্গে রেলওয়ে ও বন্দর কর্মচারীগণ সহযোগিতা করিবেন না এবং এক্ষেত্রে তাহাদের চলাচলের ব্যাপারে কোনো কিছু ঘটিলে আমি দায়ী হইবো না।
(৪) বেতার, টেলিভিশন ও সংবাদপত্র সেবীরা আমাদের বিবৃতি-বক্তৃতার পূর্ণ বিবরণ প্রদান করিবেন এবং গণআন্দোলনের কোনো খবর গায়েব করিবেন না। যদি তাহাতে বাধা দেওয়া হয়, তাহা হইলে এইসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বাঙালিরা কাজে যোগ দিবেন না (৫) শুধু লোকাল এবং আন্তঃজেলা ট্রাঙ্ক-টেলিফোন যোগাযোগ অব্যাহত রাখুন। (৬) স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখুন (৭) সকল গৃহশীর্ষে প্রতিদিন কালো পতাকা উত্তীর্ণ রাখুন(৮)ব্যাংকসমূহ প্রতিদিন দুই ঘণ্টা খোলা রাখুন; কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও যেন পাচার না হয় (৯) আংশিক বা সর্বাত্মক হরতাল ঘোষণা করা হইতে পারে, তজ্জন্য প্রস্তুত থাকুন (১০) স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে অবিলম্বে বাংলার প্রত্যেকটি ইউনিয়ন, মহল্লা, থানা, মহকুমা ও জেলা পর্যায়ে সংগ্রাম কমিটি গঠন করুন। গতকাল (রোববার ৭ মার্চ) রমনা রেসকোর্সের উত্তাল জনসমুদ্রকে সাক্ষী রাখিয়া তুমুল করতালির মধ্যে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবাসীর উদ্দেশ্যে উপরোক্ত ঘোষণা করেন।
জনসভার এ মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন সাধারন সম্পাদক তাজ উদ্দিন, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খোন্দকার মস্তাক, কামারুজ্জামান, মতিউর রহমান, মোস্তফা সারওয়ার, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শামসুল হক, শহর আওয়ামী লীগ সাধারন সম্পাদক গাজী গোলাম মোস্তফা এমপিএ, কোরবান আলী, ডঃ কামাল হোসেন, জহির উদ্দিন এমএনএ, কেএম ওবায়দুর, সিরাজুল ইসলাম এমপিএ, ৪ ছাত্র নেতা, শেখ মনি, তোফায়েল আহমেদ এমএনএ, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক এমপিএ, শ্রমিক লীগ সাধারন সম্পাদক আব্দুল মান্নান এমএনএ, শেখ সেলিম, মমিনুল হক খোকা, আমিনুল হক বাদশা ।
নোটঃ ভাষণের খুব সামান্য অংশ তুলে ধরা হয়েছে। সচরাচর আমরা যে ভাষণ শুনে থাকি তাও খণ্ডিত।